Friday, December 27, 2019

দ্বিজাতি তত্ত্ব এবং দেশভাগ ৪- চার্চিল ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি

মেইন ক্যাম্প গ্রন্থে হিটলার লিখছেন, ইতিহাস পড়া মানে, কিছু তারিখ, যুদ্ধ, ঘটনা, রাজার নাম জানা না। ইতিহাস একটি অনুসন্ধান। যেখানে ঘটনাটা গুরুত্বপূর্ন না। যে ঘটনা ঘটে গেল, পৃথিবীটা, আমাদের ঘর সংসার ওলটপালট করে দিল- তার পেছনের "শক্তি" টাকে আবিস্কার করা ইতিহাস পঠনের মূল কাজ। 

 এই সিরিজে সেটাই আমার কাজ। ঘটনা গুলো আসল না।   ওগুলো ঘটানো হয়েছে সুনিপুন পরিকল্পনায়।  দেশভাগের ঘটনা গুলো, তার তারিখ, তার যন্ত্রনা আমরা সবাই জানি। ওই পর্দার পেছনে আসল খেলাটা- সেই অশুভ শক্তি এবং তাদের দেশী এজেন্টদের খোঁজার চেষ্টা করছি। 

 চার্চিল এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি কিভাবে মুসলীম লীগের পাকিস্তানের দাবীকে রাজনৈতিক বাস্তবতা দিল  -সেটা বুঝতে আমাদের চারটি সমান্তরাল ঘটনা বুঝতে হবে

   (১) আমেরিকাতে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস - দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানীর হাতে নাকানি চোবানি খাবার পর চার্চিল, আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের কাছে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে নতজানু।  তখনো আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয় নি।  ফলশ্রুতি আটলান্টিক চার্টার ( আগস্ট ১৯৪১) । যেখানে আমেরিকা বৃটেনকে এক রকম জোর করে স্বীকার করাবে বৃটেনের চল্লিশটি কলোনির স্বাধীনতার প্রশ্নে।  এর চার মাসে বাদেই,  জাপান পার্ল হার্বার ঘটানোর পর,  আমেরিকার কাছে ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নটি আমেরিকান বিদেশনীতির সব থেকে গুরুত্বপূর্ন ইস্যু হয়ে ওঠে।  আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট , বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলকে নানান ভাবে চাপ দেওয়া শুরু করেন ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নের মিমাংসার জন্য। ক্রিপস মিশন মূলত রুজভেল্টের চাপেই চার্চিল পাঠাতে বাধ্য হোন । চার্চিল  ক্রিপস মিশনের পেছনে ছুড়ি মারেন। কিন্ত ব্যাটল অব মিড ওয়েতে আমেরিকার বিরাট নৌবিজয়ের পরে, ভারতের স্বাধীনতার গুরুত্ব আমেরিকার কাছে কমতে থাকে।  ভারত নিয়ে চার্চিলের ওপর আমেরিকান চাপ,  আস্তে আস্তে হাল্কা হয়। ফলে পাকিস্তান নিয়ে চার্চিল নিজের নক্সা বাস্তবায়নের সুযোগ পান।

  (২) চার্চিলের সাথে মুসলীম লীগের ব্যক্তিগত সম্পর্কের ইতিহাসটি পাকিস্তানের জন্মের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ন।  মুসলীম লীগের লন্ডন শাখার মেম্বারদের সাথে চার্চিলের সখ্যতা এবং চার্চিলের ব্যক্তিগত জীবনে মুসলমানদের প্রতি দুর্বলতা, আস্তে আস্তে পাকিস্তান সৃষ্টীর কারন হয়ে দাঁড়ায়।  আফ্রিকাতে দুই ভারতীয় মুসলমান সৈনিক নিজেদের প্রানের বিনিময়ে চার্চিলকে বাঁচিয়েছিল। চার্চিল  মনে করতেন ভারতে "আশরাফি" মুসলমানরাই ( যারা তুর্কী পারস্য থেকে ভারতে এসেছিল ) আসলে রাজার জাত-অভিজাত লোক।  কংগ্রেসের গান্ধী, নেহেরু, হিন্দুয়ানীকে তিনি সহ্য করতে পারতেন না। প্রকাশ্যেই গালাগাল দিয়েছেন হিন্দু ধর্ম এবং তার প্রতিনিধি কংগ্রেসদের বিরুদ্ধে।  উনি নিজে ছিলেন দ্বিজাতি তত্ত্বের সব থেকে বড় সমর্থক। প্রকাশ্যেই বলেছেন, রুজভেল্টকেও লিখেছেন, ভারতের মুসলমাদের ভবিষ্যত হিন্দু কংগ্রেসের হাতে সুরক্ষিত না। ইনফ্যাক্ট  দ্বিজাতি তত্ত্ব এবং পাকিস্তান নিয়ে চার্চিলের ভাষার সাথে জিন্নার ভাষার কোন পার্থক্য ছিল না!

 (৩) নেহেরুর অন্ধ আমেরিকান বিদ্বেশ দেশভাগের জন্য অনেকটাই দায়ী। ১৯০০-১৯৪০। এই সময়টাতে আমেরিকা ছলে বলে কৌশলে ল্যাটিন এবং সেন্ট্রাল আমেরিকার সব দেশেই প্রাধান্য বিস্তারের জন্য কাঠি করেছে।   নেহেরু ছিলেন আদর্শবাদি।  নিজেকে এন্টিকলোনিয়াল যুদ্ধের হিরো বলে মনে করতেন।  তার কাছে বৃটেন, আমেরিকা-সব সমান। সাম্রাজ্যবাদি শক্তি। অন্যদিকে স্তালিনের পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনা এবং সমাজতন্ত্রের প্রতি তার দুর্বলতা ছিল সর্বজন বিদিত।  ফলে ১৯৪৩ সালে, যখন জাপান এবং জার্মানী পিছু হটছে।  তাদের পরাজয় সময়ের অপেক্ষা মাত্র।  স্টালিন এবং চার্চিল পৃথিবীর ম্যাপকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিচ্ছেন "স্পেয়ার অব ইনফ্লুয়েন্স" বা কে সোভিয়েত ব্লক আর কে ওয়েস্টার্ন ব্লকে থাকবে-তখন নেহেরুর এই  কঠোর  আমেরিকা বিরোধি অবস্থানের জন্য , চার্চিল রুজভেল্টকে বোঝাতে সমর্থ হোন স্ট্রাটেজিক কারনে   "আমেরিকান-বৃটীশ" প্রতি অনুগত  পাকিস্তান সৃষ্টির দরকার।  পাকিস্তান,  আফগানিস্তান এবং সেন্ট্রাল সোভিয়েত প্রভিন্সগুলোর কাছে।  স্ট্রাটেজিক্যালি এটা এমন এক ভূখন্ড যা দিয়ে দক্ষিন দিক দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ানকে ঘেরা যায়।   চীনে তখন কমিনিউস্ট না কুয়োমিংটান- কারা জিতবে কেউ জানে না।  নেহেরুর অখন্ড ভারত যে আমেরিকা-বৃটেনের বিরুদ্ধে যাবে সেটা পাক্কা। জিন্না এবং লীগের নেতারা জন্মলগ্ন থেকেই চার্চিল এবং বৃটেনের রক্ষনশীল পার্টির বফাদার কুত্তা। সুতরাং মুসলীম লীগের পাকিস্তানকে আমেরিকা এবং বৃটেনের খুবই দরকার ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উত্তর বিশ্বে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে। চার্চিলের হিসাব নিকেশ যে আমেরিকার স্বার্থের জন্য যে ভুল ছিল না- সেটা সময়ই বলে দিয়েছে।  পাকিস্তান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে সব থেকে বড় আমেরিকান ঘাঁটি। শুধু তাই না- কেউ যদি জিন্নার ১৪ই আগস্টের  স্বাধীনতার ভাষন ইউটিউবে দেখে থাকেন- তাহলে খুব অদ্ভুত জিনিস দেখবেন। জিন্না খুল্লাম খুল্লা ভাবে দ্যর্থহীন ভাষায় জানাচ্ছেন পাকিস্তান বৃটেন এবং আমেরিকার বন্ধু রাষ্ট্র হিসাবে কাজ করবে!  জিন্নার চার্চিল ঘনিষ্ঠতা , চার্চিলের নেহেরু বিদ্বেশ এবং নেহেরুর আমেরিকা বিদ্বেশ- এই তিনটিই দেশভাগের জন্য ক্যাটালিস্টের কাজ করেছে!

 (৪) চীনে কমিনিউস্ট পার্টির সাফল্য।  কুয়োমিংটাং- চৈনিক জাতিয়তাবাদি শক্তি, যা ছিল বৃটেন আমেরিকার বন্ধু তারা সিপিসি বা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সাথে গৃহযুদ্ধে ক্রমাগত হারতে থাকে। এর ফলে পাকিস্তান এবং কাশ্মীরের গিলগিটিস্থান -স্ট্রাটেজিকালি খুব গুরুত্বপূর্ন হয়ে ওঠে। চীনে যদি জাতিয়তাবাদি চিয়াং কাইসেক জিততেন, তাহলে আবার পাকিস্তানের দরকার হত না আমেরিকার।  কারন সেক্ষেত্রে দক্ষিন দিক দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ানকে ঘেরা যেত। কিন্ত চীনের মাঞ্চুরিয়াতে সোভিয়েত বাহিনী ঢুকে জাপানকে হারিয়ে, সেই অঞ্চল সিপিসির হাতে তুলে দিতেই, বৃটিশ-আমেরিকান বুঝতে পারে, চীনে তাদের ভবিষ্যত  দোদুল্যমান। ফলে পাকিস্তান, আফগানিস্থান, গিলগিটিস্থান আমেরিকা-বৃটিশদের কাছে অসম্ভব স্ট্রাটেজিক গুরুত্ব পেতে শুরু করে - কারন দক্ষিন দিক থেকে সোভিয়েত বিরোধি কোন মিলিটারি "পুশের" দরকার হলে, সেটাই একমাত্র রাস্তা!

 মোটামুটি চার্চিলের নির্দেশে বৃটিশরা যে পন্থা নিল পাকিস্তান বানাতে

  (১) কুইট ইন্ডিয়া মুভমেন্টের অজুহাতে সব কংগ্রেস নেতাকে জেলে পুরে দিয়ে হওয়া হল -যাতে পরে থাকে লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, হিন্দু মহাসভা এবং স্থানীয় আঞ্চলিক মুসলমান পার্টিগুলো।
  (২) ইউনিয়ানিস্ট পার্টি, কেপিপি, সিন্ধের ইউনিয়ানিস্ট পার্টি- ইত্যাদি মুসলিম পার্টিগুলি যারা লীগ এবং কংগ্রেসের দুই এরই  বিরোধি ছিল- এদের নেতাদের কাছে দুটো অপশন দিল বৃটিশরা। হয় লীগের পথে এস। লীগের সাথে হাত মেলাও। না হলে জেলে।
  (৩) নর্থ ইস্টার্ন প্রভিন্সের পাঠান আবদুল গফফুর খান তীব্র লীগ বিরোধি এবং কংগ্রেস প্রেমী। তার ক্ষেত্রে দাওয়াই হল আরো কড়া। শুধু জেল না। বৃটিশ ইন্টেলিজেন্স প্রচুর টাকা ছড়ালো খান বা লোক্যাল ট্রাইবাল সর্দারদের লীগের পক্ষে কিনে নিতে।
 (৪) কমিউনিস্ট পার্টিগুলি ১৯৩৭-৪১, জিন্না এবং লীগের বিরোধিতা করেছে। কিন্ত যেই জার্মানি সোভিয়েত আক্রমন করে, বৃটিশ-সোভিয়েত যৌথ সহযোগিতা শুরু হয়- সোভিয়েতের নির্দেশ ভারতের কমিনিউস্টরা ( সিপিয়াই), সম্পূর্ন ভাবে চার্চিলের দ্বিতীয় বফাদার কুত্তায় পরিনত হয়। তারা কুইট ইন্ডিয়া মুভমেন্টে কংগ্রেসের বিরোধিতা করে।  নেতাজির আই এন এর বিরোধিতা করে। এবং লীগের সাথে হাত মিলিয়ে পাকিস্তানের দাবী তোলে। এসব কিছুই তারা করেছে বৃটেনের নির্দেশে। যেহেতু স্টালিন, ভারতের কমিউনিস্টদের মিত্র বৃটেনের প্রতি বিস্বস্ত থাকতে নির্দেশ দেন।
 (৫) হিন্দু মহাসভার না ছিল নেতা, না জন সমর্থন। তারা লীগের সাথে হাত মিলিয়ে বাংলা, সিন্ধ এবং নর্থ ওয়েস্টার্ন প্রভিন্সে ক্ষমতায় গেল।  তারা সিন্ধে লিগের পাকিস্তান প্রস্তাব পাশের বিরোধিতা করেছে। কিন্ত ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের সাপোর্ট তারা পায় নি। হিন্দুরা অন্ধভাবে কংগ্রেসকেই বিশ্বাস করেছে। বিশ্বাস করেছে একমাত্র কংগ্রেসই তাদের ঐক্যবদ্ধ অখন্ড ভারত দিতে পারে। কিন্ত   সম্পূর্ন ভাবে জন বিচ্ছিন্ন হওয়াতে, হিন্দুত্ববাদি নেতারা হিন্দু জনগোষ্ঠিকে লীগের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে পারে নি।  আর গান্ধী এবং নেহেরু - না রাজনৈতিক না মিলিটারি- কোন ভাবেই লীগের মোকাবিলা করার জন্য কোন কাউন্টার  স্ট্রাটেজিই ভাবেন নি। অসহায় ভাবে লীগের কাছে আত্মসমর্পন করেছেন।

                                   (১)
  ১৯৩৭ সালে আমেরিকাতে ভারত নিয়ে কি ভাবনা ছিল?

   মনে রাখতে হবে, আমেরিকাও বৃটিশ কলোনির বিরুদ্ধে যুদ্ধে লড়ে স্বাধীন হয়ছে। আমেরিকার জনগন ও আজো " ব্লাডি রেডকোর্ট" বলে বৃটিশ কলোনিস্টদের গালাগাল দেয়। ভারতের বাইরে যে দেশে ভারতীয় বিপ্লবী এবং স্বাধীনতাপ্রেমীরা সব থেকে বেশী নিরাপদে কাজ করেছে, সেই দেশটা আমেরিকা।  কারন এদেশে বৃটিশ কলোনিস্টদের বিরুদ্ধে জনমত আগে থেকেই আছে।

  আমেরিকাতে ভারতী বিপ্লবী গদর পার্টির ইতিহাস আমরা সবাই জানি।  প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে আমেরিকার ক্যালফোর্নিয়া প্রদেশে পাঞ্জাবীদের একটা সংঘটন ছিল- প্যাসিফিক হিন্দুস্থানী সংগঠন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগের দশ বছর ধরে, ভারতে বিপ্লব সংগঠনের জন্য টাকা এবং অস্ত্রের জোগান দিতে অনেক বিপ্লবী আমেরিকাতে আসেন এই সময়।  প্যাসিফিক হিন্দুস্থানী সংগঠন এদের আশ্রয় দাতা। এই ভাবেই আমেরিকাতে গিয়েছিলেন তারকনাথ দাশ, এম এন রায় , রাশ বিহারী বোস। বোস স্পিকার খ্যাত অমর বোসের বাবা নলিনী বোস।  অন্যদিকে পাঞ্জাব থেকে এলেন, লালা লাজপত রায়।

 প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বৃটিশ যুদ্ধে ব্যস্ত। জার্মানী ভারতের বিপ্লবীদের আর্মস দিতে প্রস্তুত। এই সুযোগ কাজে লাগাতে গদর বিপ্লবীরা জার্মানীর সাহায্যে ভারতে অস্ত্র আনার পরিকল্পনা করেন।

 কিন্ত জার্মানদের সাথে হাত মেলানোতে হিতে বিপরীত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা জার্মানীর বিরুদ্ধে লড়ছে। সেই অবস্থায় আমেরিকান ভারতীয়রা জার্মানীর সাথে হাত মেলানোর ফল কি হবে সহজেই অনুমেয়। গদর পার্টির সব বিপ্লবীদের আমেরিকা গ্রেফতার করে (১৯১৭)। শুরু হয়  বিখ্যাত হিন্দু-জার্মান চক্রান্ত ট্রায়াল।  বৃটিশরা চেয়েছিল এসব বিপ্লবীদের যেন ভারতের পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্ত আমি আগেই লিখেছি,  আমেরিকান জনগন ভারতীয় বিপ্লবীদের সমর্থনে ছিল। ফলে আমেরিকা বৃটেনের কথা শোনে নি। গদর পার্টির নেতাদের হাল্কা দু-এক বছরের জেল দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হল।

 কিন্ত আমেরিকাতে ভারতের স্বাধীনতার আন্দোলন থামল না।  ইন্ডিয়া লীগ অব আমেরিকা এবং ফ্রেইন্ডস অব ইন্ডিয়ান ফ্রিডম বলে দুটি রাজনৈতিক সংস্থা, আমেরিকাতে ভারতের স্বাধীনতার সপক্ষে প্রবল প্রচার চালাতে থাকে।

 ১৯৩৭ সাল নাগাদ আমেরিকাতে প্রায় সব গণ্যমান্য লেখক বিজ্ঞানীরা ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে নানান কাগজে লিখছেন।  চাঁদা দিচ্ছেন। স্বয়ং আইন স্টাইন  ইন্ডিয়া লীগ অব আমেরিকার এডভাইসরি কমিটিতে ছিলেন।   তিনি আমেরিকাতে ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে ভাষন দিয়েছেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় যে আমেরিকার প্রায় সব বিখ্যাত বুদ্ধিজীবিরা   ভারতের স্বাধীনতার দাবীতে আমেরিকান মিডিয়াতে সরব।   প্রেসিডেন্ট   রুজভেল্ট    স্বয়ং ভারতের স্বাধীনতার পক্ষেই সওয়াল করেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শুরু হওয়ার অনেকদিন আগে থেকেই। 

 আর এই অসম্ভবকে একহাতে সম্ভব করেছিলেন এক পাঞ্চাব তনয়। নিউ ইয়ার্কের জেজে সিংহ।  ইন্ডিয়া লীগ ওব আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতা।

আরো দুটো গুরুত্বপূর্ন দিক উল্লেখ করি।

 আমেরিকাতে ভারতের বিপ্লবীদের আরেক উজ্জ্বল কীর্তি, তাদের আন্দোলনের সাথে আমেরিকার  সিভিল রাইট মুভমেন্ট এবং নারীবাদি মুভমেন্টের নেতা নেত্রীদের ডিরেক্ট ইনভলভমেন্ট। গদর পার্টির নেতা তারক নাথ দাশ বিয়ে করেছিলেন মেরী কিটিংস মর্সকে।  মেরী কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান মহিলাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে উজ্বল চরিত্র।  ন্যাশানাল এসোশিয়েসন ফর এডভান্সমেন্ট অব কালারড পিপল, বা সংক্ষেপে  নাকাপের প্রতিষ্ঠাতা মেম্বার। নাকাপ হচ্ছে আমেরিকার সিভিল রাইট মুভমেন্টের পুরোধা দল।

 দ্বিতীয় দিক হচ্ছে এইসব বিপ্লবীদের বীজ কিন্ত অনুশীলন সমিতি থেকে।  অর্থাৎ গীতার হিন্দু নিহিলিজম এদের আধার।   ইনারা বিপ্লবী, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, নারীমুক্তিএবং সিভিল রাইটের জন্য আমেরিকাতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। কিন্ত বিবেকানন্দ অরবিন্দের রিভাইভালিস্ট হিন্দুত্বের সাথে আধুনিকতার বিরোধ পান নি। শেষ দিন পর্যন্ত একহাতে বিবেকানন্দ অন্য দিকে বিপ্লবী আদর্শে কাজ করেছেন। এরা সবাই মুসলিম লীগ, ইসলামের সাম্প্রদায়িকতা  এবং পাকিস্তানের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। লীগের কাছে মাথা নোয়ানোর জন্য নেহেরু এবং  কংগ্রেসের তীব্র সমালোচনা করেছেন তারক নাথ দাশ। খুব সম্ভবত এইসব কারনে ইনাদের কথা ভারতের ইতিহাস বইতে খুব একটা দেখা যায় না। কংগ্রেসের পক্ষে সুবিধাজনক হবে না।

ইন্ডিপেন্ডেস লীগের সভাপতি জেজে সিং এর কথা ভারতের ইতিহাস ভুলে গেছে। বা কংগ্রেসের বফাদার ঐতিহাসিকদের লেখা ইতিহাস উনার অবদান স্বীকার করে নি। কিন্ত এদের কঠোর পরিশ্রমের জন্যই আমেরিকান এডমিনিস্ট্রেশনে ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে অনেক লোকজন ছিল।  যার জন্য ১৯৪১ সালে আটলান্টিক চার্টারে ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্ন নিয়ে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট চার্চিলকে চাপ দেওয়া শুরু করবেন।  যেটা ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসের সব থেকে গ্রুত্বপূর্ন মাইল ফলক। কারন গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন ভাংতে বৃটিশদের দুই সপ্তাহ লাগত। কিন্ত আমেরিকান প্রেসিডেন্ট যখন চাপ দিচ্ছেন - যে আমেরিকার সাহায্য ছাড়া বৃটেন আর এক সপ্তাহও জার্মানীর সাথে যুদ্ধে টিকতে অসমর্থ, সেই চাপের কাছে নতি স্বীকার করেই কিন্ত চার্চিল  ক্রিপস মিশন ভারতের পাঠালেন ( ১৯৪২)।  আর সেই আমেরিকান চাপ ঠেকাতে  জিন্নাকে মাঠে নামালেন চার্চিল। কিভাবে এবং কেন। লিখছি।

 এবার আসি আটলান্টিক চার্টারের ইতিহাসে।  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর-  ভারত সহ ৪০ টি বৃটিশ কলোনীর স্বাধীনতা যে নিশ্চিত, তা এই চার্টারেই স্বীকার করা হয়।  চার্চিলের মতন সাম্রাজ্যবাদি কি  এতটা মানতে রাজি ছিলেন? একদমই না। তবে কিনা বৃটেনের তখন মাজা ভাঙা। ফলে  রুজভেল্ট তাকে জোর  করে রাজী করালেন। আবার এটাও দেখব ১৯৪৩ এর পর-জার্মান এবং জাপানের সাথে যুদ্ধ জয় যখন নিশ্চিত- আস্তে আস্তে রুজভেল্ট ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নে ইন্টারেস্ট হারাবেন। বরং  ১৯৪৩ এর পর থেকে তিনি চার্চিলের সাথেই "এলাইন্ড"। কারন যুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বে সোভিয়েত কমিনিউস্টদের আটকাতে " স্পেয়ার অব ইনফ্লুয়েন্স" আমেরিকার কাছে বড় ইস্যু হয়ে ওঠে।  মোটামুটি ভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে  প্যাসিফিক থিয়েটারের  ইতিহাসের সাথে ভারতের ভাগ্যও দুলতে থাকে।

 ১৯৩৯ সাল থেকে চার্চিল রুজভেল্টকে লিখে যাচ্ছেন যুদ্ধে বৃটেনের পাশে দাঁড়াতে। কিন্ত আমেরিকান পাবলিক বৃটেনের যুদ্ধ থেকে দূরে থাকতে চায়।  ভারতের স্বাধীনতাকামি বিপ্লবীরা তখন আমেরিকার মিডিয়াকে বোঝাতে পেরেছে, এটা বৃটিশদের কলোনি টেকানোর যুদ্ধ। আমেরিকানরা  বৃটিশ কলোনিয়ালিস্টদের ঘৃণা করে।  তারা কেন যুদ্ধে যাবে বৃটেনের কলোনি  বাঁচাতে? চার্চিল রুজভেল্টকে লিখেই চলেছেন-কিন্ত রুজভেল্ট জনমত অগ্রাহ্য করে আমেরিকাকে যুদ্ধে জড়াবেন না। সাফ কথা!

  কিন্ত হিটলার  চালে মারাত্মক ভুল করলেন। যা তার এবং বিশ্ব ইতিহাস ঘুরিয়ে দেয়। যুদ্ধে না জড়ালে কি হবে- আমেরিকা কিন্ত বৃটেনকে খাদ্য, যুদ্ধাস্ত্র সাপ্লাই দিয়েই যাচ্ছে আটলান্টিক দিয়ে। সেই সাপ্লাই লাইন আটকাতে হিটলারের ইউ বোট, শয়ে শয়ে বৃটিশ জাহাজ ডোবাচ্ছে। হিটলারের নির্দেশ ছিল, কোন আমেরিকান জাহাজ আক্রমন না করার। কারন উনিও জানতেন আমেরিকা বৃটেনের পাশে দাঁড়ালে তার কোন চান্স নেই।  হিটলার কিন্ত রুজভেল্টের কাছে পৌছানোর চেষ্টা করলেন না।  ফোর্ড থেকে অনেক আমেরিকান কোম্পানীই জার্মানীতে ব্যবসা করত। আমেরিকার কাছে বানিজ্যের আশ্বাস দিলে, যুদ্ধের ইতিহাস কি হত, বলা যায় না।  নেহেরুর মতন হিটলার ও অন্ধ আমেরিকা এবং আমেরিকান ক্যাপিটালিজম বিরোধি এক ব্যক্তিত্ব।  ফলে চার্চিলের সুবিধা ।

১৯৪১ এর আগস্ট।   লন্ডনের আকাশে তখন ব্যাটল অব বৃটেন সবে থেমেছে। লন্ডন বিদ্ধস্ত। ইংল্যান্ড লড়েছে। কিন্ত ধুঁকছে।  রুজভেল্ট  দেখলেন এবার বৃটেনের জন্য কিছু না করলে, জার্মানীর হাতে ইংল্যান্ডের পতন হতে পারে।  কারন ২২শে জুন সোভিয়েত ইউনিয়ান আক্রমন করেছে জার্মানী। মাত্র দুমাসে মস্কোর কাছাকাছি পৌছে গেছে । সোভিয়েতের পতন আসন্ন। গোটা সোভিয়েতের তেল এবং লোহা, হিটলারের কাছে চলে এলে, জার্মানরা হয়ে উঠবে অপ্রতিরোধ্য।

 এবার চার্চিলের সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিলেন রুজভেল্ট। কিন্ত এটাও জানালেন, আমেরিকার জনমত বৃটেনের কলোনিগুলোর স্বাধীনতার পক্ষে। আমরা পোলান্ডের স্বাধীনতার জন্য জার্মান সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়ব- আর ভারতে বৃটিশরাজকে সমর্থন করব- আমেরিকান জনগনকে এমন উল্লু বানানোর ইচ্ছা বা ক্ষমতা কোনটাই তার নেই! ৯ই আগস্ট (১৯৪১) উত্তর আটলান্টিকের প্যাসেন্টিয়া বেতে আমেরিকান যুদ্ধ জাহাজ ইউ এস এস অগাস্টাতে দুজনের দেখা হল।

  চার্চিল তার স্বভাবমর্জিত ভঙ্গিতে, রুজভেল্টকে বল্লেন ' এট লং লাস্ট মিঃ প্রেসিডেন্ট!"

 রুজভেল্ট চার্চিলকে বোঝালেন, বস- আমেরিকান লোকেরা তোমার বৃটেনের ৪০ টা কলোনী টেকানোর যুদ্ধে নেই। আমেরিকান জনগনকে যুদ্ধটা খাওয়াতে গেলে এই কলোনিগুলোর স্বাধীনতা ঘোষনা করতেই হবে। যাতে আমেরিকান এবং সমস্ত কলোনিয়াল জনগনের সমর্থন পাওয়া যায় । নইলে এর মধ্যে আমি নেই!

চার্চিল মানতে চান নি। এটা ছিল চার্টারের তিন নাম্বার পয়েন্ট। শেষ মেশ  একটা রফা হয়। চার্টারের তিন নাম্বার পয়েন্ট এভাবে লেখা হল " All People have right to self-determination"  । ১৪ ই আগস্ট এটা গোটা বিশ্বকে জানানো হয়।

    এবার চার্টারের তিন নাম্বার পয়েন্ট নিয়ে প্রচুর নাটক। লন্ডনে ফিরে চার্চিল জানালেন, এর মানে এই যে ইউরোপিয়ান রাষ্ট্রগুলিকে জার্মানির কবল থেকে উদ্ধার করা হবে। আর আপাতত এশিয়াতে বৃটেনের কলোনীগুলোর কথা যুদ্ধের পর ভাবা যাবে!

  রুজভেল্ট এদিকে আমেরিকান মিডিয়াকে জানিয়ে দিয়েছেন, চার্টারের ঘোষনায় চার্চিলের বৃটেন তার ৪০ টি কলোনি ছেড়ে দেবে।   চার্চিলের ডিগবাজিতে প্রেসিডেন্টের প্রেস্টিজ পুরো পাংচার।   চার্চিল এমন বিশ্বাসঘাতকতা করবেন রুজভেল্ট ভাবেন নি। আমেরিকান নাগরিকদের এখন কি উত্তর দেবেন রুজভেল্ট?

ফলে আমেরিকা যুদ্ধে জড়াবে কি না, সেই প্রশ্ন ঝুলে গেল!

 কিন্ত ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরের সাত তারিখ সকালে জাপান , পার্ল হার্বার আক্রমন করে বসে। দুহাজার আমেরিকান মৃত ।  তিন ঘন্টায়  তিনটে তীব্র বিমান হানা। ফলে আমেরিকা যুদ্ধে যোগ দেয় পরের দিন। বৃটেনও যুদ্ধ ঘোষনা করে জাপানের বিরুদ্ধে।

 যুদ্ধে নেমেই আমেরিকা বোঝে- তারা তৈরী না। জাপান দ্রুত গতিতে মাত্র ছমাসে ( ১৯৪২ এর প্রথম ছমাস)  কোরিয়া , ভিয়েতনাম,  ফিলিপিন্স সিঙ্গাপুর, মালেশিয়া, ইন্দোনেশিয়া - সব কিছু দখল করে ভারত দখল করতে এগিয়ে যাচ্ছে।  বৃটিশ এম্পায়ারের পাছার কাপড় খুলে গেছে। তারা জাপানের বিরুদ্ধে নুন্যতম প্রতিরোধেও অক্ষম। এদিকে আমেরিকান যুদ্ধজাহাজের প্লেন গুলোও প্রযুক্তিতে জাপানের থেকে অনেক পিছিয়ে।  বৃটিশ ক্যারিয়ার প্রিন্স অব ওয়েলেস মাত্র এক ঘন্টায় মালয় সাগরে  ডুবিয়ে দিল জাপানিরা।  চার্চিল এই খবর শুনে ভিরমি খান। এই বুঝি বৃটেনের সব কলোনি জাপান দখল করে নেয়! 

 তখন জাপান আর বৃটেনের মধ্যে দাঁড়িয়ে শুধু ভারত! বৃটেন সমস্ত শক্তি নিয়ে ভারতে "ফল ব্যাক" করছে। জাপান বুঝছে ভারত দখল করতে ভারতীয়দের সাহায্য দরকার। ফলে তারা প্রচার করছে , জাপান আক্রমন করলে, তারা ভারতকে পূর্নাঙ্গ স্বাধীনতা দেবে। সেই শুনে ভারতের বিপ্লবীরা উচ্ছাসিত। অন্যদিকে ভারতের  কমিনিউস্টরা তখন বৃটেনের দোসর। যেহেতু সোভিয়েত এবং বৃটেন একই পক্ষে। কংগ্রেস সম্পূর্ন দ্বিধায়। এর মূল কারন কোরিয়া থেকে মাঞ্চুরিয়াতে যেসব স্থানীয় সরকার জাপান বসিয়েছিল-তারা সবাই জাপানের পুতুল সরকার। মাত্র পাঁচ বছরেই জাপান প্রমান করে ছেড়েছে  কলোনিয়াল মাস্টার হিসাবে তারা বৃটেনের থেকে অনেক অনেক বাজে।  ফলে জাপানের ভারতের স্বাধীনতার প্রপাগান্ডা নিয়ে অনেক দ্বিধা তৈরী হয়।  তবুও বরদলুই অধিবেশনে সব দ্বিধা ছেড়ে কংগ্রেস ঘোষনা করে তারা বৃটিশদের সাহায্য করবে যুদ্ধে। যদি বৃটেন পূর্নাঙ্গ স্বরাজ দেয়।

 আমেরিকান জনতা পার্ক হার্বারের প্রতিশোধ চাইছে। কিন্ত নেবে কি করে?  পার্ল হার্বারে অনেক ডেস্ট্রয়ার ধ্বংস। শুধু  ক্যেরিয়ার গুলো বেঁচে গেছে। কিন্ত সেগুলো থেকে আক্রমন করার জন্য অনেক পুরনো মডেলের হর্নেট আর ওয়াইল্ড ক্যাট হচ্ছে আমেরিকান ফাইটার বিমান।  যেখানে জাপানের কেরিয়ারের হাতে অনেক উন্নত মানের ফাইটার প্লেন "জিরো"! এদিকে বৃটিশরা টিকতেই পারছে না জাপানের কাছে!

 সেই মুহুর্তে আমেরিকার কাছে ভারতের গুরুত্ব অপরিসীম। ভারতই জাপানের বিরোধিতায় আমেরিকার আশা ভরসা।  কারন পশ্চিম দিকে জাপানকে আটকাতে ভারতে ঘাঁটি দরকার। দরকার ভারতীয় সৈন্যদের সাহায্য- ভারতীয় রসদ। মানে ভারতীয় জনগনের সাহায্য।  ভারতের স্বাধীনতা না দিলে ভারত সাহায্য করবে না -জানিয়ে দিয়েছে কংগ্রেস। বৃটিশদের পক্ষে আছে শুধু মাত্র মুসলীম লীগ, কেপিপি ( ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি), ইউনিয়ানিস্ট পার্টি আর কমিউনিস্টরা।  হিন্দুমহাসভা বৃটিশদের সাথে যোগ দিয়েছে।  কিন্ত এই পার্টির বিপ্লবী উইং জাপানের সাথে হাত মেলাতে চাইছে। 

 অন্যদিকে ফিলিপিন্স, মাঞ্চুরিয়া, ভিয়েতনামে স্থানীয় জাতিয়তাবাদি শক্তিগুলির সাথে জাপান বিরোধি জোট করেছে আমেরিকানরা।  ভিয়েতনামের নেতা হোচিমিন। হ্যা হোচিমিন তখন আমেরিকার বন্ধু। কিন্ত আমেরিকা যদি ভারতের জাতিয়তাবাদি শক্তি কংগ্রেসকে সাথ না দেয়, এই সব জাতিয়তাবাদি নেতারা কেন বিশ্বাস করবে আমেরিকাকে?  সেকথা কুয়োমিংটান নেতা চিয়াং কাইসেক সাফ জানিয়ে দিলেন রুজভেল্টকে।

ফলে ১৯৪২ সালের শুরুতেই আমেরিকান বিদেশনীতির টোটাল ফোকাস গেল চার্চিলকে যেভাবেই হোক  বুঝিয়ে ভারতের স্বাধীনতার ঘোষনা দরকার।

 রুজভেল্ট ভারতের স্বাধীনতার জন্য চার্চিলকে সাঁড়াশি চাপ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।  ভারতে পাঠালেন  কলোনেল লুইজ জনসনকে।  ইংল্যান্ডে আমেরিকান রাষ্ট্রদূত ইউনেটকে বল্লেন চার্চিলকে ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নে চাপ দিতে। 
 
 অন্যদিকে চার্চিল অন্য খেলায় মেতেছেন।    ১৯৪১ সালের ডিসেম্বর মাসেই রুজভেল্টের সাথে দেখা হল চার্চিলের। এবার রুজভেল্ট সরাসরিই বল্লেন ভারতের স্বাধীনতা ব্যাপারে চার্চিল কিছু অন্তত সিদ্ধান্ত নিন!  চার্চিল নিজের আত্মজীবনীতে লিখেছেন, সেই রাতে রুজভেল্টকে এত উদোম হরকেছিলেন রুজভেল্ট আর দুবার ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্ন চার্চিলকে তোলেন নি!

  কিন্ত তা বল্লেই ত হল না- সেক্ট্রেটারী অব স্টেট  বা আমেরিকার বিদেশমন্ত্রী কার্ডেল হল, ছেড়ে দেবার পাত্র না। তিনি  লন্ডনের ওপর চাপ বজায় রাখলেন। ফলে ১৯৪২ সালের মার্চ মাচে চার্চিল ঘোষনা করতে বাধ্য হলেন স্যার ক্রফোর্ড ক্রিপ্স ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নের মিমাংসা করতে ভারত যাচ্ছেন।  ক্রিপস ছিলেন লেবার পার্টির এম পি।  ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে থাকা একজন বৃটিশ লিব্যারাল।

 শুধু আমেরিকানরা চার্চিলকে ভারতের স্বাধীনতা নিয়ে চাপ দিচ্ছিল -তা না। বৃটেনের লেবার পার্টি বহুদিন থেকেই ভারতের স্বাধীনতার পক্ষেই ছিল। তারাও চাপ দেয়।  ইনফ্যাক্ট ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নে, বৃটেনের বামেদের রাজনৈতিক চাপ, অত্যন্ত ক্রিটিক্যাল ফ্যাক্টর ছিল (১৯৪২-৪৭)।

চার্চিল ঘাগু রাজনীতিবিদ। হিটলারের থেকে কোন অংশে কম সাম্রাজ্যবাদি নন।  আমেরিকা তাকে লন্ডনের রাষ্ট্রদূত দিয়ে   ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নে  চাপ দিচ্ছে। তিনি ওয়াশিংটনে বৃটেনের রাষ্ট্রদূল লর্ড হেলিফ্যাক্সকে দিয়ে রুজভেল্টকে ভারতের সমস্যা নিয়ে ভুল বোঝাতে লাগলেন।  রুজভেল্টকে বোঝানো হল, ভারতের সেনা বাহিনীর ৭৫% মুসলমান। তারা পাঠান যোদ্ধা।  তাই জিন্নার তোলা দ্বিজাতি তত্ত্বের সমাধান না করে , ভারত স্বাধীন করলে, সেনাবাহিনী আসলে বিদ্রোহ করবে!

 চার্চিল বিলক্ষন জানতেন রুজভেল্টকে তিনি  ভুল তথ্য খাওয়াচ্ছেন। কারন ভারতের সেনাবাহিনীতে ২৫% ছিল মুসলমান। আর পাঠানরা ছিল কংগ্রসসে এলায়ান্স। এই জন্য ১৯৪২ পর্বে আমরা দেখব বৃটিশ ইন্টেলিজেন্স পাঠান  এবং মুসলমান নেতাদের  মধ্যে টাকা ছড়াচ্ছে।  যাতে মুসলীম লীগের পক্ষে তারা আসে।  সাথে সাথে  লীগকে মুসলিম অধ্যুশিত প্রদেশগুলিতে মন্ত্রীত্ব দেওয়া হল।  বৃটিশরা মুসলীম লীগ এবং জিন্নাকে হঠাৎ করে প্রচুর পাত্তা দিতে শুরু করে। জিন্না  মিডিয়াতে সেই সব কথাগুলিই বল্লেন, যা লর্ড হেলিফ্যাক্সের মাধ্যমে রুজভেল্টকে শুনিয়েছেন চার্চিল। যাতে রুজভেল্টের কাছে চার্চিল বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠেন। ্পুরো রাজনৈতিক নাটকটা তৈরি করলেন চার্চিল। জিন্না ক্রীড়ানক মাত্র।

 অর্থাৎ জিন্না তখন চার্চিলের পুতুল। জিন্নাকে তখন চার্চিল বৃটিশ ইন্টালিজেন্সের মাধ্যমে উস্কে দিচ্ছেন যাতে জিন্না পাকিস্তানের দাবি  আরো  জোরসে তোলে।  জিন্নার পাকিস্তানের দাবী বৃটেনের মিডিয়াগুলো ফলাও করে ছাপত! এদিকে আল ইন্ডিয়া আজাদ কনফরান্স- যেখানে অন্তত আরো পাঁচগুন ভারতীয় মুসলমান জিন্নার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আছেন- সেটা বৃটিশ মিডিয়া পাত্তাই দিত না। তাদের নেতাদের ধরে জেলে পুরে দেওয়া হত।  যাতে আমেরিকানরা বোঝে ভারতের স্বাধীনতার ব্যপারটা   দ্বিজাতি তত্ত্বের কারনে,  এত জটিল, চার্চিলকে চাপ না দেওয়ায় ভাল! পুরোটাই চার্চিলের তৈরী খেলা!
 
 রুজভেল্টকে  চার্চিল জানালেন --

 " We are earnestly considering whether a declaration of Dominion status after the war carrying with it if desired the right to secede should be made at this critical juncture. We must not on any account break with the Moslems who represent a hundred million people and the main army elements on which we must rely for the immediate fighting. We have also to consider our duty towards 30 to 40 million untouchables and our treaties with the princes states [sic] of India, perhaps 80 millions. Naturally we do not"

 পাকিস্তান  ছিল ৫% মুসলমানদের  দাবী। অধিকাংশ মুসলমানই পাকিস্তান দাবীর সাথে সহমত ছিল না।  চার্চিলের কল্যানে এবং বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ টেকানোর প্রয়োজনে, চার্চিল জিন্নাকে বিড়াল থেকে বাঘ বানালেন। 

ক্রিপস ভারতে এলেন ২৩শে মার্চ।  ৩১ এ মার্চের মধ্যে কংগ্রেস তার প্রস্তাব বাতিল করেছে। লর্ড লিনলিথগো চাইছেন, ক্রিপস ফিরে যান!

 কিন্ত  রুজভেল্টের প্রতিনিধি কর্নেল জনসন ছাড়লেন না। ক্রিপস মিশন যাতে সফল হয়, তার জন্য উনি নিজেই নেহেরু, ক্রিপস এর সাথে মধ্যস্ততা করলেন।

 ক্রিপসে মূল বক্তব্য এই যে ভারতের নেতাদের হাতেই সব কিছু থাকবে -শুধু ডিফেন্স ছাড়া! আর ভাইসরয়ের হাতে ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা রাখা হল। গান্ধী মানলেন না। নেহেরু,  জনসন এবং ক্রিপস-একটি আপস ফর্মুলা বার করলেন যে দেশীয় নেতাদের নিয়ে একটা ওয়ার কাউন্সিল গঠন করা হবে। ডিফেন্স যুগ্ম ভাবে ভাইসরয় এবং দেশীয় নেতাদের দ্বায়িত্বে থাকবে। ফলে ৬ ই এপ্রিল নাগাদ একটা খসড়া সমঝোতা হল, যাতে কংগ্রেস এবং ক্রিপস, রাজী!



  ক্রিপস ভাবলেন তিনি সফল। আনন্দে লাফিয়ে লন্ডনে টেলিগ্রাম পাঠালেন চার্চিলের কাছে! মিশন সাকসেসফুল!

  চার্চিল দেখলেন-এত আচ্ছা উল্লুকা পাঁঠা। একে পাঠানো হয়েছিল, যাতে এই মিশন ব্যর্থ হয়। আর এ ব্যাটা লর্ড লিনলিথগোকে পাশ কাটিয়ে, আমেরিকান দূত কলোনেল জনসনকে নিয়ে সমাধান করে দিল!!

 যেহেতু কর্নেল জনসন দ্বায়িত্ব নিয়ে এই কাজ করেছেন এবং তিনি রুজভেল্টের বিশেষ প্রিয়, চার্চিল সরাসরি ক্রিপসের সাফল্যকে বাতিল করতে পারছেন না। উনি বলতেই পারেন, লর্ড লিনলিথগোকে পাশ কাটিয়ে করা এই চুক্তি বৃটিশ মানবে না। কিন্ত সেটা কি আমেরিকানদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হবে?

  অগত্যা উপায়?

  আছে। মুসলীম লীগ এবং জিন্না। জিন্নার কাছে বৃটিশ ইন্টালিজেন্স থেকে নির্দেশ যায়, মুসলীম লিগ যেন ক্রিপ্স মিশন না মানে। জিন্না বৃটিশদের ফেবারিট বোরে । চার্চিল তার অনেক পুরোনো বন্ধু। জিন্না জানালেন ক্রিপ্সের এই ফর্মুলা ভারতের মুসলমানরা মানবে না। কারন এতে পাকিস্তানের দাবী মানা হয় নি। বৃটিশ মিডিয়া সেটাই বড় করে দেখাল!  ভারতের মুসলমানরা ক্রিপ্স মিশন মানবে না!

 চার্চিল রুজভেল্টকে বল্লেন চেখেছ? বলেছিলাম না শুধু হিন্দু কংগ্রেসের সাথে চুক্তি করলেই হবে না। ভারতের মুসলমানরা মানবে না।  এতেব ক্রিপসকে ঘরে ফেরাচ্ছি! আমার কিন্ত কোন দোষ নেই- আমি ত চেষ্টা করেছিলাম। কিন্ত ভারতের হিন্দু-মুসলমান সমস্যার জন্য ওদের স্বাধীনতা দেওয়ার অবস্থা আসে নি!!!

কর্নেল জনসন কিন্ত দ্বিধাহীন ভাষায় রুজভেল্টকে জানালেন, চার্চিল পেছন থেকে ছুরি মেরেছে!

 কিন্ত এর মধ্যে প্যাসিফিক থিয়েটারে ঘটে যায় মিড ওয়ের যুদ্ধ। যার জন্য আমেরিকা সম্পূর্ন ভাবেই ভারতের স্বাধীনতা নিয়ে ইন্টারেস্ট হারায়।

 সেটা হচ্ছে ব্যাটল অব মিডোয়ে (৪-৭ই জুন, ১৯৪২)। আমেরিকা বুড়ো হাবড়া ওয়াইল্ড ক্যাট আর হর্নেট নিয়েই মিডোয়ে দ্বিপপুঞ্জের যুদ্ধে জাপানের নৌবহর ডুবিয়ে দিল!  জাপানের "জিরো" ফাইটার প্রায় প্রতিটা ওয়ান টু ওয়ান যুদ্ধেই আমেরিকান হর্নেট এবং ওয়াইল্ড ক্যাট ফাইটারকে হারায়- আমেরিকার নৌ বিমান বহরে প্রচুর ক্ষতি হয়। জাপানী বোমারু বিমান আমেরিকান যুদ্ধজাহাজকে অনেক বেশী আঘাত করতে সক্ষম হয়। কিন্ত তবুও আমেরিকান নৌবহর সব জাপানী যুদ্ধ জাহাজ যার মধ্যে চারটি ফাইটার কেরিয়ার ও ছিল। সবাইকে ডুবিয়ে দিল!

কারন জাপানের যুদ্ধ জাহাজ এবং যুদ্ধ বিমান প্রযুক্তি উন্নত ছিল ঠিকই -কিন্ত জাপানি যুদ্ধ জাহাজগুলির একটা মারাত্মক ডিজাইন ত্রুটি জাপানকে যুদ্ধে হারিয়ে দেয়। জাপানী ডিজাইনে   জাহাজের ডেকে বোমা থেকে আগুন লাগলে, তা নেভানোর অটোমেটিক সিস্টেম বা প্রিভেনশন সিস্টেম ছিল না। ফলে আমেরিকান বোমারু বিমান মাত্র একবার আঘাত করলেই আগুন ধরে জাপানী জাহাজ গুলো ধ্বংস হয়। কিন্ত আমেরিকান যুদ্ধ জাহাজ গুলো বুড়ো হাবরা হলে কি হবে- ওদের আগুন নেবানোর ক্ষমতা ছিল অনেক বেশী। একাধিক জাপানী বোমা হজম করে দিতে সক্ষম।

 আমেরিকা স্বপ্নেও  ভাবে নি  পুরাতন প্রযুক্তি নিয়ে তারা, জাপানের বিরাট নৌবহর ডুবিয়ে দেবে!   জাপানি যুদ্ধ জাহাজগুলির এই মারাত্মক দুর্বলতা প্রকাশ পেতেই আমেরিকা এবার  প্রশান্ত মহাসাগরে সরাসরি জাপানি বাকী নৌবহর খতম করার দিকে নজর দেয়।  সাথে সাথে জাপানি জিরোর থেকে ভাল ফাইটার বিমান হেলক্যাট ও আমেরিকান হাতে এসে গেছে। ্সুতরাং আমেরিকা তখন থেকে আর ভারত, ভিয়েতনামের ন্যাশালিস্ট নেতারা কি চাইছেন, তাই নিয়ে মাথা ঘামায় নি। তাদের ফোকাস- জাপানী যুদ্ধ জাহাজের সব ফ্লিট ধ্বংস কর।


 ভাবছেন এই তথ্যগুলো ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ন কেন? কারন ১৯৪২ এর জুন মাসে মিডোওয়ের যুদ্ধের পরে আমেরিকা বুঝতে পারে জাপান কাগুজে বাঘ। ওদের যুদ্ধ জাহাজ ডিজাইন এত দুর্বল, প্রশান্ত মহাসাগরে বাকী জাপানি যুদ্ধজাহাজ শেষ করে দিলেই যুদ্ধ শেষ। কারন জাপান একটা দ্বীপ।

ফলে আগে যেমন ভারতকে পাশে দরকার ইত্যাদি ছিল জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে - মাত্র ছমাসেই  খেলা ঘুরে গেছে। ১৯৪২ এর জুলাই মাস থেকেই আমেরিকা ভারতের স্বাধীনতা নিয়ে আর মাথা ঘামায় নি।

 এখানেই নেহেরুর নেতৃত্ব নিয়ে আমার প্রশ্ন আছে। গান্ধীকে ছেড়ে দিলাম। গান্ধী স্ট্রাটেজিস্ট নন।

   নেহেরু কর্নেল জনসনের প্রিয়পাত্র ছিলেন। খুব ভাল করেই জানতেন কেন আমেরিকা ভারতের স্বাধীনতা নিয়ে আগ্রহী। এটাও জানতেন মুসলীম লিগকে খেলিয়ে রুজভেল্টকে ভুল বোঝাচ্ছেন চার্চিল।  সেই সময় নেহেরুর উচিত ছিল আমেরিকার সাথে সরাসরি সম্পর্কে যাওয়া এবং দ্রুত। কারন প্যাসিফিক থিয়েটারে যুদ্ধ ঘুরে গেলে, আমেরিকাও উৎসাহ হারাবে এটা বাচ্চাও বুঝবে। আমেরিকা কোন আদর্শ রাষ্ট্র না  -  তারা  নিজেদের জন্যই ভারতের স্বাধীনতা চাইছিল।

কিন্ত খুব সম্ভবত আমেরিকাকে অপছন্দ করতেন বলে, আমেরিকার কাছে ঘেঁসার চেষ্টা করেন নি নেহেরু। লীগের উৎপাত শেষ করার ওটাই ছিল ভাল উপায়।  চার্চিলকে , রুজভেল্টের টিম পালটা প্রেসার দিচ্ছে। চার্চিল জিন্নাকে খেলিয়ে, সেই প্রেসার রদ করছে। নেহেরু কি এতই বাচ্চা এসব কিছুই বোঝেন নি? লীগকে থামানোর জন্য আমেরিকার সাথে যে বন্ধুত্বের দরকার ছিল, তিনি করেন নি! কারন তিনি আমেরিকাকে সাম্রাজ্যবাদি মনে করেন! মাঝখান থেকে মরল বাঙালী আর পাঞ্জাবীরা। নেহেরু যদি এই সময় আমেরিকার ঘনিষ্ট হতে পারতেন, যে সুযোগ তাকে কর্নেল জনসন  দিয়েয়েছিলেন, তাহলেও দেশভাগ হয় না। কারন আমেরিকা যদি,  ঐক্যবদ্ধ ভারতকে পাশে পাওয়ার প্রতিশ্রুতি পেত, তারা কেন শুধু পাকিস্তানের দাবীকে সমর্থন করবে?  এক আদর্শবাদি আন্টি কলোনিয়াল পৃথিবীর স্বপ্নে বিভোর ছিলেন পন্ডিতজি।  তিনি প্রকাশ্যে আমেরিকার বিরোধিতা করেছেন! তাহলে আমেরিকা সোভিয়েত অক্ষের বিরোধিতা করার জন্য পাকিস্তানের দাবীর সমর্থক হবেই!    বাস্তব, রিয়াল পলিটিক্সে নেহেরুর কোন দিনই কোন ইন্টারেস্ট নেই।   ভুগল বাংলা আর পাঞ্জাবের নিরীহ মানুষ যারা এসবের সাত পাঁচে নেই।

 নেহেরু দেশের লোকের কথা কোনদিনই ভাবেন নি। নিজের আদর্শকে প্রাধান্য দিয়েছেন সর্বদা।
                                   
                                                                        (২)
 
 এবার আসি চার্চিল এবং জিন্নার সম্পর্কে।
 
 ১৯০৮ সালে সৈয়দ আমীর আলি, লন্ডনে মুসলীম লীগের একটি শাখা খোলেন। এই আমীর আলি একজন বিখ্যাত লোক- উনি সেন্ট্রাল  ন্যাশানাল মহামেডান এসোশিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা। লীগের বহুপূর্বেই মুসলমানদের সংগঠিত করেছিলেন এই নেতা। তাছাড়া উনি প্রথম ভারতীয়  যিনি প্রিভি কাউন্সিলে সিট পান। ইন্ডিয়ান ল কাউন্সিলের উনি দ্বিতীয় ভারতীয় মেম্বার।  বিখ্যাত ইস্ট লন্ডন মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা।

 ভারতের ইতিহাস তাকে ভুলে যেতে পারে, কিন্ত তার কার্যকলাপ, ভারতের সাম্প্রদায়িকতা এবং দ্বিজাতি তত্ত্বের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন।  ১৯০৯ সালে আইন সভায় মুসলমানদের জন্য যে স্পেশাল সংরক্ষন চালু হল, তার মূল ব্যক্তি ইনিই।  আইন সভায় মুসলমানদের জন্য আলাদা সংরক্ষন গুরুত্বপূর্ন  এই জন্যেই যে, এই মুসলিম কোটার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেই হিন্দু মহাসভার জন্ম হয়।

 উনি লীগের যে লন্ডন ট্রাডিশন শুরু করেছিলেন, ভারতের ইতিহাসে তা বারবার গুরুত্বপূর্ন হবে। কংগ্রেসের রাজনীতি ছিল, ভারতে আইন অমান্যের রাজনীতি।  রাস্তায় আন্দোলন আবেদনের রাজনীতি। মুসলিম লীগ প্রথম থেকেই হাউস অব লর্ডস, আর হাউস অব কমন্সের মেম্বারদের সাথে সখ্যতা বাড়ায়। তাদের নির্বাচনে চাঁদা দেয়। মানে যাকে বলে লবিং। লীগ বুঝেছিল, ভারতের রাজনীতি চলে বৃটিশ পার্লামেন্ট থেকে। ফলে তারা রাজনীতিটা লন্ডন থেকেই করতেন!

  চার্চিল বুয়োর যুদ্ধ শেষে, ১৯০০ সালে দেশে ফিরে এসে মাত্র ২৫ বছর বয়সে এম পি হোন। আট বছর বয়সে গুরুত্বপূর্ন পোষ্ট পেলেন- আন্ডার সেক্রেটারি ওফ স্টেটস ফর ব্রিটিশ কলোনী। ভারত সহ ৪০ টি বৃটিশ কলোনির দেখাশোনার মন্ত্রীত্ব।

ফলে মুসলিম লীগের লবিস্টদের কাছে চার্চিলের সাথে ঘনিষ্টতা হবেই। তাছাড়া চার্চিলকে সম্ভবত বুয়োর যুদ্ধে প্রান বাঁচিয়েছিল দুই ভারতীয় মুসলিম। তিনি অটোম্যান সম্রাটদের পোষাক, আভিজাত্য, ভোগ-সব কিছু পছন্দ করতেন।   লন্ডনে মুসলিম লীগের অনেক বিখ্যাত নেতার সাথে চার্চিলে ঘনিষ্টতা হয়। এদের মধ্যে ছিল  আগা খান, ব্যারন হেডলি ( লন্ডন মুসলিম সোশাইটির প্রেসিডেন্ট),  ওয়ারিস আলি, ফিরোজ খান নুন ( পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী)।

 এর মধ্যে ওয়ারিশ আলির সাথে চার্চিলের বন্ধুত্ব এবং রাজনৈতিক সম্পর্ক আমাদের স্ক্যানারে আনতে হবে। ওয়ারিশ আলি, জানতেন চার্চিল ঘোর কংগ্রেস, গান্ধী এবং নেহেরু বিরোধি। বৃটেনের লেবার পার্টি ছিল, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিশীল।  কংগ্রেস এবং হিন্দু বিরোধি সমস্ত তথ্য ওয়ারিশ আলি চার্চিলকে দিতেন। চার্চিল হাউস অব কমন্সে সেই তথ্যে ঘায়েল করতেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিশীল লেবার এম পিদের।

  ১২ ই এপ্রিল  ১৯৩১ কানপুরে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হয়। কিছু মুসলমান মারা যায়। ওয়ারিশ আলি এই তথ্য চার্চিলকে এমন ভাবে পেশ করেন, যেন এই ঘটনার জন্য হিন্দু এবং হিন্দুদের পার্টি কংগ্রেস দায়ি। চার্চিল আসলে কি হয়েছিল, তা স্ক্রটিনাইজ না করেই হাউস অব কমন্সে বল্লেন

"well thought-out […] programme for […] the terrorisation of the Muslim minority into submission and surrender of their demand for effective safeguards in the future constitution of India”. Within a month Churchill addressed an audience in Kent thus: “Look at what happened at Cawnpore […] A hideous primordial massacre has been perpetrated by the Hindus on the Moslems because the Moslems refused to join in the glorification of the murder of a British policeman "

লন্ডন মুসলীম লিগ বহুদিন থেকেই চার্চিলের রাজনৈতিক সঙ্গী। ফলে রুজভেল্টের চাপকে প্রতিহত করতে, তাদেরই সাহায্য নিয়েছিলেন চার্চিল।

চার্চিলের সাহায্যে মুসলিম লীগ যে বৃটিশ পার্লামেন্টে দ্বিজাতি তত্ত্ব এবং পাকিস্তানের পাল্লা ভারী করছে, এত সবাই জানত। কংগ্রেস কি আদৌ এর পালটা কোন চাল দিচ্ছিল?

লন্ডনে কংগ্রেসের প্রতিনিধি ইন্ডিয়ান  লীগ। ওয়ারিশ আলির পালটা হচ্ছেন ভারতের প্রথম বিদেশ মন্ত্রী ভিকে কৃষ্ণ মেনন।  উনি ১৯৩০ সালে লন্ডনে ইউসিএল থেকে সাইকোলজিতে এম এ নিয়ে পাশ করেন।  বিখ্যাত বৃটিশ কমিউনিউস্ট নেতা এবং শিক্ষক হ্যারল্ড ল্যাস্কির প্রিয়তম ছাত্র। এই হ্যারল্ড ল্যাস্কি জ্যোতিবসুর ও কমিনিউস্ট গুরু। কৃষ্ণ মেনন ইন্ডিয়ান লীগের মূল নেতা হলেন। ইন্দিরা গান্ধী এবং জ্যোতি বসুর- উভয়ের রাজনৈতিক মেন্টর এই কমিনিউস্ট কৃষ্ণ মেনন।

 লেবার পার্টী ছিল ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে। ফলে মেনন লেবার পার্টিতে সরাসরি যোগ দেন। বৃটিশ বুদ্ধিজীবি যেমন এজরা পাউন্ড, এম ফস্টার, ব্রিট্রান্ড রাশেল ইত্যাদি নামীদামী ব্যক্তিত্বরা ছিল মেননের সাথে। লেবার পার্টির নেতা ক্লিমেন্ট এটলি ১৯৪৬ সালে যখন চার্চিলকে হারিয়ে প্রধান মন্ত্রী হবেন, তখন ভারতের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত করতে কৃষ্ণমেননের পরিশ্রম  নিশ্চয় কাজে এসেছে। এই পর্যন্ত ইতিহাস ঠিকই আছে! 

 কিন্ত কৃষ্ণমেনন এবং তার ইন্ডিয়ান লীগ,  চার্চিল ও মুসলীম লিগের দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরুদ্ধে কিন্ত কোন মতামত তৈরী করে নি লন্ডনে।  তারা শুধুই ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নটাকেই সামনে রেখেছে। দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরোধিতা এবং পাকিস্তান বিরোধিতা কৃষ্ণ মেননের এজেন্ডাতে ছিল না।  কেন?

   এর  উত্তর আমার জানে নেই।  তিনি ছিলেন কঠোর নীতিবাদি কমিউনিস্ট।  তার কমিনিউস্ট তত্ত্বের দিক দিয়ে "হয়ত" জিন্নার দ্বিজাতি তত্ত্বের দাবি ঠিকই ছিল। তার ছাত্র জ্যোতি বসুও পাকিস্তানের দাবীর সমর্থকই ছিলেন।

 কৃষ্ণ মেননের কমিনিউস্ট এবং সোভিয়েত প্রীতির খেসারত দিতে হয়েছে অনেকটাই। ১৯৪৬ সালে তিনি সোভিয়েত বিদেশমন্ত্রী মলোটভের সাথে দেখা করেন।  বৃটিশ ইন্টেলিজেন্স এম আই ফাইভের সার্ভিলেন্সে ছিলেন। আমেরিকা এবং বৃটেনের নেতৃত্বকে তিনি বিশ্বাস করতেন না। তারাও মেনন-নেহেরুকে বিশ্বাস করে নি।

 ফলে পাকিস্তানের জন্ম বৃটেন-আমেরিকার জন্য অনির্বায্য হয়ে ওঠে।  কারন বৃটেন দেখে নেহেরু-মেনন জুটি খুব পরিস্কার ভাবেই সোভিয়েত ইউনিয়ানের দিকে ঝুঁকছে। সুতরাং মুসলীম লীগের তত্ত্ববধানে আমেরিকা এবং বৃটেনের বন্ধু রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্ম দিতে সক্রিয় হয় বৃটিশ ইন্টেলিজেন্স এবং এডমিনিস্ট্রেশন। 

 এই আন্তর্জাতিক ঘটনা সমূহের পরিপ্রেক্ষিতেই আমরা পরের কিস্তিতে কুইট ইন্ডিয়া মুভমেন্টে এবং ১৯৪৫ সালের মুসলীম লীগ সংগঠিত দাংগার পর্যালোচনা করব।

 আপাতত এটা বোঝা গেল বৃটিশ কতৃপক্ষ পাকিস্তান চাইছিল। তারা চাইছিল মুসলিম লীগ দাংগা করুক এবং দেশে আগুন জ্বলুক। মুসলিম লীগ দাঙ্গা করলে বৃটিশ পুলিশ আটকাবে না এটা লীগের নেতারা জানতেন। কারন তারা পাকিস্তান গঠনের  বৃটিশ এজেন্ডা বাস্তবায়িত করছেন।

সমস্যা হচ্ছে এটা কংগ্রেস নেতারা বোঝেন নি, বৃটিশ কতৃপক্ষ এবং লীগ একই সাথে পাকিস্তানের বাস্তবায়নের কাজ করছে?  কেন বৃটিশ এই কাজ করছে, সেটাও নেহেরু-মেনন জানতেন।  নেহেরু জানতেন, তাদের সোভিয়েত প্রীতি এবং আমেরিকা বিরোধিতার  কারনেই বৃটিশ এবং মুসলিম লীগ পাকিস্তান গঠনের দিকে এগোচ্ছে। যার ফলে কোটি কোটি লোক উদ্বাস্তু হবে।

  ধরুন ধরেই নিলাম, তারা সোভিয়েত এক্সিসে থাকবেন বলে স্থির করেছিলেন । সেক্ষেত্রে পাকিস্তানের জন্ম দেবে বৃটিশ কতৃপক্ষ এটা বাচ্চাও বুঝবে।  কিন্ত তাহলে ত স্টালিনের সাহায্য নিয়ে, পাকিস্তান গঠনের বিরোধিতা করতে হয়? কারন আফগানিস্তানের তলায় আমেরিকার বন্ধু রাষ্ট্রের জন্ম স্টালিনের জন্যও কাম্য না!


এইখানে ইতিহাস আরো মজার। মেনন-নেহেরু জুটিকে আমেরিকা-বৃটেন সোভিয়েতের চর ভাবছে! এদিকে স্টালিন নেহেরু-মেননকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। কারন নেহেরু  "নন-আলাইন্ড মুভমেন্টের " নেতা হতে চান। স্টালিন নেহেরু সম্মন্ধে বল্লেন, লোকটা যে কোন দিকে কেউই জানে না!

 মোদ্দা কথা  মেনন-নেহেরুর রোম্যান্টিক আদর্শবাদের জন্য ভারতের আম-ছালা দুই গেল। তিনি পাকিস্তান গঠনের বিরোধিতার জন্য সোভিয়েত থেকে সাহায্য চেলেন না।  আবার নেহেরু-মেননের  আমেরিকা বিরোধিতার জন্য,  মুসলীম লীগ আমেরিকা এবং বৃটেনের সম্পূর্ন সাহযোগিতা পেল।

 জেজে সিংহ এর কঠোর পরিশ্রম- যার মাধ্যমে তিনি আমেরিকার বুদ্ধিজীবিদের ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে, নেহেরুর পক্ষে সংগঠিত করেছিলেন- নেহেরুর আমেরিকা বিরোধিতা সব কিছুতেই জল ঢেলে দেয়।

 আসলে নেহেরু রিয়াল পলিটিক বুঝতেন না।  আর তার প্রতিদ্বন্দি- রিয়াল পলিটিক্সের গুরু জিন্না এবং চার্চিল!  নেহেরু ধোঁয়া ধোঁয়া আদর্শবাদকেই রাজনীতি ভেবেছেন চিরকাল। ফলে ভারতের প্রদেশ কংগ্রেসের ১৩ জন নেতা যখন ভারতের ভাবী প্রধানমন্ত্রী বাছতে বসলেন-কেউ নেহেরুকে ভোট দেয় নি। ১০ টা ভোট সর্দার প্যাটেলের দিকেই যায়।  কংগ্রেসের নেতারা বিলক্ষন জানতেন নেহেরুর এই কবি কবি রাজনীতির খেসারত দিচ্ছে সমগ্র ভারত।  ফলে নেহেরুকে ভারতের ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তারাও দেখতে চান নি।      কিন্ত গান্ধীর ইচ্ছা নেহেরু প্রধানমন্ত্রী হোন।  গান্ধীর একলব্য শিষ্য প্যাটেল প্রধানমন্ত্রীর দাবি ছেড়ে দিলেন।

 গান্ধীর মতন একজন  বিশুদ্ধ চিন্তানায়ক মোটেও রাজনীতিবিদ হতে পারেন না। তাকে কংগ্রেসের মাথায় বসিয়ে হিন্দুরা সব কিছু হারিয়েছে। কারন তিনি "রিয়াল পলিটিক্সে" বিশ্বাস করতেন না। আর এই কাজে হাতে পেলেন নেহেরুকে! যিনি আরেক রোম্যান্টিক বুদ্ধিজীবি।

 জিন্না-চার্চিলের সাথে টিট ফর ট্যাট গেমের জন্য, হিন্দুদের দরকার ছিল নেতাজি,   প্যাটেল বা শ্যামাপ্রসাদের মতন আরেকজন "রিয়াল পলিটিক্স"  এ বিশ্বাসীকে নেতা হিসাবে তুলে ধরা। রিয়াল পলিটিক্সে বিশ্বাসী নেতারা রক্ত, যুদ্ধ, জমি বোঝে।   গান্ধী-নেহেরু-মেনন, এরা আদর্শ ধুয়ে জল খাচ্ছিলেন, আর জিন্না ঘর গোছাচ্ছিলেন। পাঞ্জাব আর বাংলার নিরীহ হিন্দু-মুসলমানরা দাঙ্গায় মরছিল।

সাইমন বলিভারের কথা লিখি এই প্রসঙ্গে।   ইউরোপিয়ান কলোনিয়াল শক্তির হাত থেকে,   তিনি ল্যাটিন আমেরিকার সব দেশকেই মুক্ত করেছেন।  এন্টি কলোনিয়ালিজমের ইতিহাসে তিনিই হচ্ছে গোল্ড স্টান্ডার্ড।  উনি লিখেছিলেন - Art of Victory is learned in defeat.   এটা পরিস্কার নেহেরু কোন ইচ্ছাই ছিল না পাকিস্তানের দাবীর বিরুদ্ধে লড়াই করে ঐক্যবদ্ধ ভারত গঠনে। যা পাচ্ছি নিয়ে নিয়ে নন-এলাইন্ড মুভমেন্টের নেতা হতে চাইছিলেন। নেহেরু, নিজেও সে কথা স্বীকার করেছেন যে তিনি ভীষন টায়ার্ড ছিলেন। ইতিহাস খুঁজে আমি কিছুই পেলাম না যাতে দেখতে পাই, নেহেরু জিন্না-চার্চিলের বিরুদ্ধে কোন স্ট্রাটেজি নিয়েছিলেন। বেসিক্যালি বিনা যুদ্ধেই জিন্না-চার্চিলের দাবী মেনে নিলেন নেহেরু। কারন তিনি যোদ্ধা না। তিনি ছিলেন দার্শনিক।  আর অসংখ্য ভারতবাসি, তাদের দুজনের নেতৃত্বের ভরসায় থাকল যে এরা জিন্নার বিরুদ্ধে কিছু করবেন!










 




























 









































No comments: