সেটা ২০০৭-৮ সাল। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামে উত্তাল বাংলার রাজনীতি। তখনো সিপিএম ক্ষমতায়, কিন্ত ভিত নড়ছে। সেই সময় স্যোশাল মিডিয়াতে সিপিএমের দুটো দল- একট শোকেস, অন্যটা গোডাউন। আপনি খুভ ভদ্রভাবে সিপিএমের সমালোচনা করলেও গোডাউনের হার্মাদ পার্টি আপনাকে অকথ্য গালাগাল দিয়ে যেত। তারপরে সিপিএমের শোকেসের যুবনেতৃবৃন্দ আপনার চরিত্র হননে নেমে যেত- যাদের অধিকাংশই প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া সেক্টর ফাইভে চাকরি করা আই টি কর্মী। সিপিএমকে নিয়ে যুক্তি তর্ক তথ্যানুসন্ধানের কোন যায়গা তখন স্যোশাল মিডিয়াতে ছিল না। কেউ সিপিমের বিরুদ্ধে যুক্তপূর্ন উপদেশপূর্ন কিছু লিখলেও তাকে খিস্তি মার- এই ছিল সিপিএম। এগুলো বাস্তব, অর্কুটের পাতায় পাতায় নথিবদ্ধ। পলিটিক্স ইন ওয়েস্টবেঙ্গল নামে একটা গ্রুপে সব থেকে বেশী রাজনৈতিক আলোচনার যায়গা ছিল- কিন্ত সেখানেও সিপিএম মানে আত্ম্রম্ভিকতায় ভোলা হার্মাদ বাহিনী-যুক্তির স্থান নেই-শুধুই গালি দিতে নামত।
ওই সময় সফিদা, মানে সিপিএম থেকে বহিস্কৃত এমপি সইফুদ্দিন চৌধুরীর সাথে অনলাইনে পরিচয় হয়। সফিদা খুবই পন্ডিত, ভদ্র এবং অমায়িক ব্যক্তি ছিলেন। ওমন ভদ্র এবং পন্ডিত লোক সিপিএমে টিকবেন না, সেটা বুঝতে পিইচডির দরকার হয় না।
সফিদার সাথে অনেক কথা হত-উনার কাছ থেকে সিপিএমের আভ্যন্তরীন কোন্দল নিয়েও অনেক কিছু জেনেছিলাম। সোভিয়েতের পতনের পরে ১৯৯৩ সাল থেকেই সইফুদ্দিন চৌধুরী চাইছিলেন সিপিএম নতুন ধরনের বামপন্থা নিয়ে ভাবুক। কারন লেনিনবাদ বহুদিন স্বর্গে গেছে। অথচ এই বিমান বুদ্ধ অনিল বিশ্বাসরা তখনও বালক ব্রহ্মচারীর সন্তান দলের মতন লেনিনের মৃতদেহকে হিমঘরে রেখে নাম সংকীর্তন গাইছেন-তাদের লেনিনবাবা আবার বেঁচে উঠবেন। প্রকাশ কারাত, সিতারাম ইয়েচুরীরা তখন যুব নেতা। গুন্ডা-ভোট্মেশিনারী মিশিয়ে একটা রেজিমেন্ট তৈরী করে তখনো ভোটে জিতে আসা পার্টি ভাবেই নি জনগণ কি চাইছে-আদৌ এই ভাবে চললে পার্টি বেশীদিন চলবে কি না। সফিদা ভাবছিলেন। এবং তার ভাবনার কথাগুলো নিয়ে প্রকাশ কারাত ইয়েচুরির সাথে অনেক কথাও বলেছেন। কিন্ত পার্টির অভ্যন্তরে কেউ তাকে পাত্তা দেয় নি। দরকার ছিল না-সবাই ভেবে বসেছিল পশ্চিম বঙ্গের লোকজন সিপিএমকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ইজারা দিয়েছে। ক্ষমতা লোভে অন্ধ হলে, সব মানুষকেই রাবণ রোগে ধরে।
সফিদা আমাকে বলেছিলেন, সিপিএম যেদিন পশ্চিম বঙ্গে গদি হারাবে, তার দশ বছরের মধ্যে পার্টিটা সাইনবোর্ড হবে। সেটা হয়েই যেত-কিন্ত মমতা ব্যানার্জি সম্ভবত তা হতে দেবেন না। কারন বিজেপিকে ঠেকাতে সিপিএমের ১৪% বর্তমান ভোট ব্যঙ্ক ধরে রাখা জরুরী। সেতা যাতে হয় তার জন্য সিপিএমকে অক্সিজেন দেওয়ার যাবতীয় চেষ্টা উনি করবেন।
সব গণতন্ত্রেই বামেদের ১০-২৫% ভোট থাকে। ওটা ধনতান্ত্রিক সমাজের সেফটি ভাল্ভ। ২৫%+ এর বেশী হয়েগেলে সেই রাজ্যে ধর্মঘট, কর্মহীনতায় অর্থনীতিতে লালবাতি জ্বলবে। যা পশ্চিম বঙ্গের ৩৪ বছরের শাসনের লেগাসি। ১০-২৫% বামভোট থাকা ভাল-তাতে শ্রমিক, জনবিরোধি আইনের বিরুদ্ধে কিছু সেফটি ভালভ থাকবে। কিন্ত মুশকিল হচ্ছে এই সিপিএমের নেতৃত্ব এতই অপদার্থ, জনসাধারনের জন্য দরকারি কোন আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ। একটা উদাহরন দিই। সিপিএম স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ কেন হচ্ছে না তাই নিয়ে আন্দোলন করছে। অথচ আজকের খবর কোলকাতায় ৭৫ টা সরকারি স্কুল বন্ধ হচ্ছে কারন ছাত্র নেই। কেন নেই? কারন সরকারি স্কুলে পড়াশোনা হয় না। শিক্ষকদের জন্য সিপিএম আন্দোলন করেছে, কিন্ত শিক্ষকদের দায়বদ্ধতার জন্য কোনদিন কিস্যু করে নি। কারন তাদের রাজনীতিটাই ছিল মধ্যবিত্তশ্রেনীকে পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি। "প্রোডাক্টিভিটির উন্নতি" নিয়ে তাদের কোনদিন কোথাও মাথাব্যাথা নেই। অথচ সেটাই মার্ক্সবাদের ফান্ডামেন্টাল! এরা মার্ক্স এবং মাছভাত এক করে দিয়েছে!
ফলে ১৪% ভোট শেয়ার ও সিপিএম ধরে রাখতে পারবে কি না সন্দেহ। এসবের ওপরে আছে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতন সংখ্যালঘু ভোট টানার জন্য প্যালেস্টাইন বন্দনা। এদিকে বাংলাদেশের হিন্দুদের দুরাবস্থা দেখিয়ে যে বাঙালী হিন্দুভোটে বিজেপি বিরাট থাবা বসিয়েছে, সেদিকে লক্ষ্যই নেই। ইনফ্যাক্ট পৃথিবীর যেকোন গণতন্ত্রে যদি কোন বাম পার্টির ভোট ১০% এর নীচে নেমে আসে, সেই দেশের বামপার্টির নেতারা যে অপদার্থ সেই নিয়ে সন্দেহ থাকে না। কিছু না করে যদি শুধু জনসাধারনের দুর্দশা নিয়েই এরা বলতে থাকে, তাহলেও ১৫-২০% ভোট পৃথিবির অধিকাংশ বামদলই পায়। কিন্ত এরা পাবে না। কারন দুই জ্ঞানপাপী মূর্খ এদের নেতা। ফলে ত্রিপুরাও গেল। আর ফিরবে না-৪৫%, ১৫% হতে ৫-১০ বছর লাগবে। পশ্চিম বঙ্গ সাক্ষী।
অথচ মাঠ ছিল ফাঁকা। কংগ্রেস বিজেপি দুটো দলের বিরুদ্ধেই জনগণের অসংখ্য অশন্তোষ। কিন্ত সেই ঝোল বামঘরে তুলতে হলে বিজেপির হিন্দুত্বের ন্যারেটিভে থাবা বসাতে হবে। সেটাও আমার মতে খুবই সহজ কাজ। দরকার দুটো- এক ইসলামিক মৌলবাদের বিরুদ্ধে কঠোর এবং পরিস্কার অবস্থান, দুই মার্ক্স ছাড়িয়া শ্রী চৈতন্যের সাম্যবাদকে গ্রহন। যেমনটা ইভো মরালেস করেছেন বলিভিয়াতে -মার্ক্সের সাম্যবাদ ছেড়ে যীশুর সাম্যবাদ এনে সাধারন লোকেদের সাথে মিশে গেছেন। সিপিএম, বিজেপির হিন্দুত্বের কাউন্টার ন্যারেটিভ তৈরীর চেষ্টাই করল না। অদ্দুর বুদ্ধি বা শিক্ষা নাই। কাউন্টার ন্যারেটিভ তৈরী করতে হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধেই চলে গেল পার্টি টা। যা আরো বোকা বোকা। জাতিভেদের বিরুদ্ধে বলে কি হবে? বর্নবাদ বিরোধি ম্যাসেজ মহাভারতে আরো কড়া করে বলাআছে আছে এবং আর এস এস জাতিভেদের বিরুদ্ধেই। কৃষ্ণলীলার বিরুদ্ধে বলবেন? হিন্দু কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বলবেন? কিভাবে বলবেন? হিন্দু ধর্মের ছটা মূল দর্শনের মধ্যে পাঁচটাই নাস্তিক্যদর্শন। হিন্দু দর্শনেই বেদ এবং বেদ বিরোধি দুই অবস্থানই আছে। আর এস এসের প্রতিষ্ঠাতাও নাস্তিক হিন্দু ধর্মের লোক। বর্তমানে বাঙালী নাস্তিকদের অধিকাংশ বিজেপির ছুপা সাপোর্টার। হিন্দু ধর্ম নিয়ে ডিটেলসে না জেনে ওপর ওপর ফালতু দুচার কথা শুনিয়ে হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে কাউন্টার ন্যারেটিভ তৈরী করা যায় না।
কিন্ত এসব কথা বলে লাভ নেই। ওপরে এসব কিছুই সফিদা অনেকদিন আগে বলে গেছেন। আজকে ত্রিপুরা, কালকে কেরালাও ফুটবে। সিপিএম তথা ভারতের বামেদের বাঁচার পথ একটাই। সফিদা ১৯৯১-৯৫, বিভিন্ন পার্টি দলিলে যেসব বিতর্ক সামনে আনতে চেয়েছিলেন, সেগুলো পড়ুন। ভাল করে বুঝুন। সেটা এদ্দিন করলে, কংগ্রেসের হেগো পোঁদ পরিস্কার করবেন , না করবেন না-তাই নিয়ে বোকা বোকা বিতর্ক করে পার্টির ৯৫% শক্তি কেউ ক্ষয় করে না। জেনিউ এর সব নাবালকরা যদ্দিন পার্টির মাথায়, কিস্যু হবে না।
No comments:
Post a Comment