শ্যমাপ্রসাদ মুখার্জী- একটি নির্মোহ বিশ্লেষন
(১)
শ্যমাপ্রসাদের মূর্তিকে কালিমালেপনে, বাম এবং রাম, দুই দলই এখন ফেসবুকে যুযুদ্ধমান। কি কৈশর, কি যৌবন কি বর্তমান ইউটিউব-গুগুল-ফেসবুক নির্ভর দিনগত ইতিহাসক্ষয় জীবনে, শ্যমাপ্রসাদের ওপর ভাল কোন লেখা পড়ার সৌভাগ্য হয় নি। ফলে এই ভদ্রলোক সম্মন্ধে আমার জ্ঞান ভাসা ভাসা। মূর্তি বিতর্কের সূত্র ধরে আশাছিল, বিবদমান রাম-বামের পোষ্টের লড়াই এ শ্যমাপ্রসাদকে নিয়ে কিছু জানব। কোথায় কি। শ্যমাপ্রসাদ সম্মন্ধে – রাম/বাম দুই দলেরই অবস্থা দেখলাম সঙ্গীন। অগত্যা নিজেই খোঁজাখুজি শুরু করি। তাতে দেখি শ্যমাপ্রসাদকে নিয়ে প্রমান্য ঐতিহাসিক কাজ প্রায় নেই। হয় সঙ্ঘের প্রপাগান্ডা, না হলে বামেদের কাউন্টার প্রপাগান্ডা। কনটেক্সট বিহীন, অর্থহীন। ফলে বিভিন্ন জায়গা থেকে পাওয়া কিছু কিছু তথ্যকে ছেঁকে এ লেখা সাজাচ্ছি। এই ধরনের কাজের জন্য যে পরিমান সময় এবং গবেষনা দেওয়া উচিত তার ১% সময় ও আমার হাতে নেই। গোদের ওপর বিষফোঁড়া, শ্যামাপ্রসাদকে নিয়ে জানতে গিয়ে দেখলাম ১৯৪২-১৯৫১ সাল পর্যন্ত ভারতের ইতিহাস ও গুলিয়ে যাচ্ছে। আমার ধারনা ছিল দেশ ভাগের ইতিহাস মোটামুটি বুঝি-অন্তত একটা সুতোয় বাঁধতে পারি। গত দুদিন ধরে দেশভাগ সংক্রান্ত যত ইতিহাস পড়ছি বা শুনছি, তাতে প্রচুর পরস্পর বিরোধি তথ্য দেখতে পাচ্ছি। তবুও এই লেখার ধৃষ্টতা করছি-যে আমার ভুল পাঠক শুধরে দেবেন। আলোচনার শেষে সত্যিকারের শ্যমাপ্রসাদকে আমরা উদ্ধার করতে পারব। আমি এই লেখায়, তার জীবন নিয়ে না লিখে, তাকে নিয়ে ওঠা কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছি।
(২) শ্যমাপ্রসাদকে বাঙালী কেন মনে রাখবে?
ফেসবুক এই প্রশ্নে উত্তাল। বামেদের বক্তব্য যে ভদ্রলোক বৃটিশ পতাকা ইউনিয়ান জ্যাক না তোলার অপরাধে, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই জাতিয়তাবাদি ছাত্রনেতা্কে রাস্টিকেট করেছিলেন , কুইট ইন্ডিয়া মুভমেন্টের সময় বাঙলার গভর্নরকে চিঠি লিখে, আন্দোলনকারীদের বিরোধিতা করেছিলেন-তিনি কি করে বাঙলা তথা ভারতের জাতীয়তাবাদি নেতা হতে পারেন? বামদের শ্যমাপ্রসাদ একজন বৃটিশদের পাচাটা সাম্প্রদায়িক হিন্দুনেতা।
অন্যদিকে হিন্দুত্ববাদিদের দাবী-শ্যমাপ্রসাদ না থাকলে আজকে পশ্চিম বঙ্গ, বাংলাদেশে চলে যেত। বাঙালী হিন্দুদের জন্য স্বাধীন রাজ্যের দাবী তিনিই তোলেন।
উভয়ক্ষেত্রেই “ফ্যাক্ট” সামান্য, দৃষ্টি মায়োপিক, আসল শ্যমাপ্রসাদ অন্যকেও!
প্রথমে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে আসি। শ্যমাপ্রসাদ চার বছর কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য্য ১৯৩৪-৩৮। কেন তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন স্বদেশী ঢুকতে দেন নি, সেটা বুঝতে স্যার আশুতোষ, তার বাবার আদর্শকে বুঝতে হবে। কারন ওই চারবছর, বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি তার পিতা স্যার আশুতোষের অসমাপ্ত কাজ এবং আদর্শকেই এগিয়ে নিয়ে গেছেন।
সেটা ১৯১৭ সাল। স্বাধীনতার আকাঙ্খায় বাংলার দামাল মেধাবী ছেলেরা বিপ্লবী মন্ত্রে দিক্ষিত হয়ে বোমা, বন্দুক তুলে নিচ্ছে। মেঘনাদ সাহা ফলিত গণিতে এম এস সি ক্লাসে প্রথম শ্রেনীতে দ্বিতীয় হলেন। কিন্ত পাশ করে বেকার। সাইকেল চালিয়ে টিউশুনি করেন। আর সাথে সাথে স্বদেশী আখরায় যাতায়াত শুরু। খবর গেল স্যার আশুতোষের কাছে। মেঘনাদ সাহা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অসম্ভব মেধাবী ছাত্রটি স্বদেশী হতে চলেছে। স্যার আশুতোষ ডাকলেন মেঘনাদা সাহাকে। বললেন দেখ স্বদেশী করার ছেলে প্রচুর। শুধু বোমাবাজি, আন্দোলন করলেই ভবিষ্যতের ভারত দাঁড়াবে হে ছোকরা? বিদেশীরা বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে বলিয়ান হয়ে আজ আমাদের প্রভু। তাদের সমানতালে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চায় না এগোলে, আমরা কোনদিন জাতি হিসাবে উন্নত হতে পারব না। আমি তোমার আর সত্যেনের জন্য দুটো লেকচারার পদ খুলে দিচ্ছি। বিদেশে পদার্থবিদ্যার নবযুগ শুরু হয়েছে। আমার দেশ পদার্থবিদ্যায় পিছিয়ে থাকতে পারে না। পদার্থবিদ্যার মাস্টার ডিগ্রি ক্লাশ শুরু করে দাও কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে!
আজ স্যার আশুতোষ না থাকলে সত্যেন বোস বা মেঘনাদ সাহা কেউ থাকতেন না। স্যার আশুতোষের স্বপ্ন ছিল, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হবে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড কেম্ব্রিজ, হার্ভাড। ভারতীয়রা এগিয়ে যাবে বিজ্ঞানচর্চায় সমানতালে। এবং তিনি সফল। ১৯৪০ সাল পর্যন্ত বিজ্ঞান চর্চায় কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণযুগ। এই সময় সিভি রামন শুধু বিজ্ঞানে নোবেলই আনেন নি, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন বোস, সি আর মিত্র-ইত্যাদি অনেক তরুন ভারতীয় বিজ্ঞানী জানান দিয়েছেন ভারতীয়রা মেধায় পিছিয়ে নেয়। জাতীয়তাবাদ ত শুধু বোমা বন্দুকের প্রতিবাদি রাজনীতিতে হয় না, জাতির শিক্ষা মেধার উন্নয়ন তার থেকেও গুরুত্বপূর্ন। যে গুরুদায়িত্ব নিয়েছিলেন আশুতোষ, রবীন্দ্রনাথ, সিভি রামন, সি আর টাটা, উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর মতন দিকপাল।
কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় চলত অনুদানে। এডুকেশন ডিপার্টমেন্ট থেকে অল্প সাহায্যই আসত। বৃটিশরা চাকর বাকর ভারতীয় দেখতে চায়, সত্যেন বোস, মেঘনাদ সাহার মতন দিকপাল বিজ্ঞানী তৈরীর জন্য কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে টাকা দেবে না কি? আশুতোষ সারা জীবন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমিদার, রাজাদের কাছে ভিক্ষা করেছেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই সেই কারনে উনি চাননি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যায়লে স্বদেশী রাজনীতি ঢুকুক। রাজনীতি ঢুকলে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎকর্ষতা নষ্ট হবে, অনেক মেধাবী ছাত্রদের তিনি বিজ্ঞানী শিক্ষাবিদ করে তুলেছেন, তা নষ্ট হত। ফলে আশুতোষ একদিকে যেমন স্বদেশী ভাষা এবং শিক্ষা জন্য জান লড়িয়ে দিচ্ছেন, অন্যদিকে মেধাবী ছাত্ররা যাতে স্বদেশী “বিপ্লবী” দের খপ্পরে না আসে, তার জন্য, অত্যন্ত কড়া ছিলেন।
শ্যমাপ্রসাদ তারা বাবাকেই ফলো করেছেন মাত্র। কারন তার কাছে স্বদেশী মানে বোমা আন্দোলন না, স্বদেশী ভাষা ( বাংলা হিন্দির) উন্নতি, স্বদেশী বিজ্ঞানের উন্নতি, স্বদেশী শিল্পের উন্নতি। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, তার চার বছরে এক্সাক্টলি, এই কাজগুলিই দিবারাত্র করেছেন শ্যামাপ্রসাদ। তার এই চারবছরে, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তার অবদান প্রচুর, আমি সামান্য কিছুই লিখছি।
(১) বাংলা ভাষার বিজ্ঞান ও উচ্চশিক্ষা চর্চার জন্য -কমিটি ঘটন করে, বাংলার বিজ্ঞান শব্দকোষ তৈরী করলেন। যা বাংলার প্রথম বিজ্ঞানকোষ।
(২) তার সময় থেকেই স্নাতক স্তরে ছাত্রছাত্রীরা যাতে বাংলায় পরীক্ষা দিতে পারে, সেই ব্যবস্থা হয়।
(৩) ফলিত পদার্থবিদ্যা এবং কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট শুরু হল, সেই সূত্র ধরেই কোলকাতার বিখ্যাত রেডিও ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট শুরু হবে। ইলেকট্রনিক্স সাবজেক্টের শুরু এই ফলিত ডিপার্টমেন্টেই।
(৪) কেমিস্ট্রি যাতে শুধু ক্লাসরুমে আটকে না থাকে, উনি স্পেশাল গ্রান্ট আনলেন, কেমিস্ট্রির ছাত্ররা, অধ্যাপকরা যতে নিজেরাই স্বদেশী স্টাইলে দেশেই কেমিক্যাল তৈরী করে বিদেশ থেকে না ইম্পোর্ট করে। প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এ ব্যপারে তার আদর্শ।
(৫) কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক ইতিহাস চালু হল। না উনি সাম্প্রদায়িক ছিলেন না, চলমান রাজনীতি তাকে বাধ্য করেছিল হিন্দুমহাসভা এবং আর এস এসের সাহায্য নিতে।
(৬) মেয়েরা যতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে পারে, মেয়েদের জন্যও আসন সংরক্ষন করলেন তিনি।
বাংলা ভাষার উন্নতির জন্য, আরো অনেক কিছু করেছেন, যা এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধে লেখা সম্ভব না। শুধু সেই জন্যেই বাঙালী মনে রাখতে পারে শ্যামাপ্রসাদকে। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কনভোকেশন হত ইংরেজিতে-উনিই রবীন্দ্রনাথকে প্রধান অতিথি করে, বাংলায় কনভোকেশন চালু করলেন। রবীন্দ্রনাথ যাতে বাংলার মাস্টার ডিগ্রির ক্লাস নেন, সেই ব্যপার ও পাকা করে ফেলেছিলেন গুরুদেবের সম্মতিতে। কিন্ত বাঙালী সেকালেও ছাগল এবং কূট রাজনীতি করত। যেমন একালেও করে। রবীন্দ্রনাথের “ডিগ্রী” নেই বলে সিন্ডিকেট আপত্তি তুললো! যদিও শ্যামাপ্রসাদ, তা ওভাররুল করেন, কিন্ত গুরুদেব কিছু সিন্ডিকেট মেম্বারদের এই আপত্তিতে ব্যথিত হয়ে, শ্যামাপ্রসাদকে ফিরিয়ে দিলেন।
একমাত্র বাঙালীর মতন নির্বোধ জাতির লোকজনই বোধ হয় পারে বাংলা সাহিত্যের একমাত্র নোবেল প্রাইজ বিজেতার বাঙলায় মাস্টার ডিগ্রির ক্লাসে পড়ানোর যোগ্যতা আছে কি না, সেই নিয়ে প্রশ্ন তুলতে! কারন রবীন্দ্রনাথের কোন ডিগ্রি নাই! কি মারাত্মক!
সুতরাং আজকে সেই আহাম্মক বাঙালী জাতির উত্তরপুরুষরা যখন শ্যমাপ্রসাদ স্বদেশী শিক্ষা, বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা, দেশীয় শিল্প, নারীশিক্ষার জন্য কি করেছিলেন সেটা না জেনে, শুধু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে স্বদেশী আন্দোলনকারিদের প্রতি কঠোর ছিলেন কেন, সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, তখন অবাক হওয়ার অবকাশ নেই। বাঙালী অমনই। তারা রবীন্দ্রনাথের ডিগ্রিগত যোগ্যতা দাবী করতে পারে, স্বদেশী বলতে শুধু বোমাবাজি, মিছিল বুঝতে পারে। বাঙালী চিত্তের বুদ্ধিবিদ্যার যা “হাল” তাতে এর বেশী কিছু আশা করা অন্যায়।
(৩) এবার আসি কুইট ইন্ডিয়া মুভমেন্ট, ভারত ছাড় আন্দোলনে শ্যামাপ্রসাদের ভূমিকা নিয়ে। সেটা ১৯৪২ সাল। এবং এটা সত্য, তখন তিনি বৃটিশ সাথে, স্বদেশী আন্দোলন, বিশেষত কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। কিন্ত কেন ?
কারন তখন তিনি হিন্দুমহাসভার নেতা। বৃটিশদের সাথে সহযোগিতা করে, হিন্দুদের জন্য সুযোগ বেশী করে দেওয়াটাই যে পার্টির একমাত্র রাজনীতি ছিল।
আজকে বিজেপির পূর্বাসূরী, অখিল ভারত হিন্দু মহাসভা, কেন বৃটিশদের পাচাটার রাজনীতি করত?
এটা বুঝতে পারলেই বুঝবেন, এদ্দিন ধরে আমি যা বলে আসছি, যে ভারতের হিন্দুত্ববাদি রাজনীতি, ইসলামিক মৌলবাদি রাজনীতির রিয়াকশন ছাড়া কিছু না, তা আরো স্পষ্ট হবে।
সুতরাং আসুন, স্বাধীনতার পূর্বে এই হিন্দুমহাসভার রাজনীতির সাথে আমরা পরিচিত হই।
হিন্দু মহাসভার সৃষ্টি শ্রেফ মুসলীম লীগকে কাউন্টার করতে। সুতরাং মুসলিম লীগের রাজনীতি কি, কেন তারা ইতিহাসে আলো করে এল, সেটাও বুঝি চলুন। মুসলিম লীগের জন্ম ১৯০৬ সালে। কংগ্রেস তখন একটা হিন্দুদের দলে পরিনত। ভারতের অধিকাংশ উচ্চপদস্থ চাকরি হিন্দুদের দখলে। স্বভাবতই শিক্ষিত মুসলমানরা “মার্জিনালাইজড” বোধ করলেন। এবং ভারতে মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকারের জন্য ১৯০৬ সালে মুসলীম লীগ তৈরী হল।
বৃটিশরা হাতে মোয়া পেল। মর্লি মিন্টো সংস্কার, যার দরুন ভারতে প্রথম গনতান্ত্রিক ভোটাভুটি-বা স্থানীয় স্বয়ত্ব শাসনের শুরু, তারা মুসলীম লীগের সব দাবী স্বীকার করে। কারন তখন বৃটিশরা বুঝেছে, মুসলীম লীগ তাদের তুরুপের তাস-কারন এই লীগকে সামনে রেখে তারা রাজনীতি এবং সরকারি কাজে মুসলমানদের জন্য সংরক্ষণ করবে। যেহেতু সরকারি চাকরি, শিক্ষা সর্বত্রই হিন্দুদের প্রাধান্য, এই ধরনের আইন হিন্দু-মুসলমান বিভেদ সৃষ্টি করবে, ভারতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি শুরু হবে। ১৯০৯ সালে মর্লি-মিন্টো সংস্কার ছিল, সেই দাবার প্রথম চাল। বোরেটাকে প্রথম এগোনো। সেখানে মুসলীম লীগের দাবী মেনে নিয়ে, মুসলিম এবং হিন্দুদের জন্য আলাদা প্রতিনিধিত্ব চালু হয়।
মর্লি-মিন্টো সংস্কারে আইন সভায়, মুসলীমদের জন্য আলাদা প্রতিনিধিত্ব থাকায়, প্রমাদ গনলেন উত্তর-পশ্চিমের হিন্দুরা যেখানে মুসলমানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। অনেক বড় মার্জিনে। সেই জন্য ১৯১০ সালটা হচ্ছে হিন্দুত্ববাদি রাজনীতির আঁতুর ঘর। ওই বছর পাঞ্জাব, সিন্ধ দিল্লী ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্স- যেখানে হিন্দুরা সংখ্যালঘু- সর্বত্রই প্রাদেশিক হিন্দু সভা গঠিত হল। উদ্দেশ্য এরা একটি অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা গড়বেন। যার কাজ হবে, মুসলীম লীগের রাজনীতিকে কাউন্টার করা। হোতা মদন মহন মালব্য, লালা লাজপত রায়।
সেই মোতাবেক আমলাতে ১৯১৩ সালে হিন্দু মহাসভার প্রথম অখিল ভারতীয় অধিবেশন হয়। প্রথম প্রেসিডেন্ট এক বাঙালী- কুচবিহারের মহারাজা মহিন্দ্র নন্দী। প্রথম অধিবেশনেই মত এবং পথ নিয়ে সাংঘাতিক গন্ডোগল। কারন এই হিন্দু মহাসভার আহ্বায়করা অধিকাংশই উত্তর-পশ্চিমের “পলিটিক্যালি এনলাইটেন্ড” উচ্চশিক্ষিত হিন্দু। রক্ষনশীল হিন্দু এরা নন, অধিকাংশই ছিলেন আর্যসমাজি। সুতরাং জাতিভেদ প্রথাকে নিন্দা করে অখন্ড হিন্দু জাতির প্রস্তাব পাশ হয়, কিন্ত বৃটিশদের সাথে সহযোগিতার লাইন ও ঘোষিত হয়। বৃটিশদের পা চাটার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন আর্য্য সমাজের বিখ্যাত সন্ন্যাসী স্বামী শ্রদ্ধানন্দ । কিন্ত দেখা গেল অধিকাংস সদস্য, মুসলীমের লীগের হনুকরনেই বিশ্বাসী-তাদের ধারনা বৃটিশ মহলে প্রভাব না ফেললে-মুসলীম লীগ চাকরি, বাকরি-আইন সব নিয়ে যাবে। সেই লাইনেই চলেছে হিন্দু মহাসভার রাজনীতি। যাতে ১৯৩৬ সালে জয়েন করেছেন শ্যমাপ্রসাদ -কিছুটা বাধ্য হয়ে, কিছুটা সাভারকরের প্রভাবে।
অর্থাৎ বিজেপির জন্ম মুসলীম লীগের রাজনীতির হনুকরনে। সুতরাং তাদের হিন্দুত্ববাদ যে ইসলাম ২ ভার্সান হবে, সেটাই স্বাভাবিক এবং ঐতিহাসিক ও বটে।
হিন্দু মহাসভা , বলাই বাহুল্য রাজনৈতিক দিক থেকে ব্যর্থ এক সংগঠন ছিল। কারন জাতিভেদ, বর্ণহিন্দুত্বের বিরুদ্ধে এই সংগঠন শুরু হলেও অচিরেই তা বর্ণহিন্দুদের সংগঠনে পরিণত হয়। তাছাড়া, বৃটিশদের পাচাটার কারনে তাদের গ্রহনযোগ্যতাও কমে আসে। গান্ধী, নেহেরু, সুভাষের মতন মেধাবী নেতা তারা পায় নি।
এবার দেখাযাক শ্যমাপ্রসাদ হিন্দু মহাসভায় যোগ দিলেন কেন। উনি রাজনীতি শুরু করেছিলেন কিন্ত কংগ্রেসের সদস্য হিসাবে আইনসভায় ১৯২৯ সালে। ১৯৩০ সালে কংগ্রেসে “ আইন অমান্য আন্দোলন “ - লবন সত্যাগ্রহের জন্য সব নির্বাচিত সদস্যকে আইনসভা থেকে পদত্যাগ করতে বলে। ফলে শ্যামাপ্রসাদের আর আইনসভায় থাকা হল না। কিন্ত উনি ইন্ডিপেন্ডেট ক্যান্ডিডেট হিসাবে বাংলার আইন সভায় আবার এলেন ১৯৩১ সালে। কংগ্রেস যেহেতু আইন সভা বর্জন করেছে, সেহেতু বাংলার আইন সভায় তখন হিন্দুদের প্রতিনিধি বলতে শুধু শ্যামাবাবু- বাকী সবাই মুসলিম লীগ, বা ফজলুল হকের কৃষক প্রজাপার্টি।
যেহেতু বাংলার আইনসভায় তখন কৃষক প্রজাপার্টি এবং মুসলীম লীগের একাধিপত্য,সমস্ত চাকরি, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে মুসলীমদের জন্য সমানুপাতিক “সংরক্ষন”-অর্থাৎ ৫৪% সংরক্ষন চালু হল। সেই সময় বাংলায় টোট্যাল ৫৪% মুসলমান, কিন্ত শিক্ষা, চাকরি ইত্যাদি ক্ষেত্রে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব ৫% এর ও নীচে। ফলে এটা হওয়ারই ছিল।
এতে বর্নহিন্দুরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়, যেহেতু হঠাৎ করে তারা দেখে, চাকরির ক্ষেত্র, শিক্ষার ক্ষেত্র সংকুচিত। শিক্ষিত বর্নহিন্দুরা ক্ষেপে ওঠে-কিন্ত কংগ্রেস মুসলীম লীগ এবং কৃষক প্রজাপার্টির এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কিছু করবে না। শ্যমাপ্রসাদ এর বিহিত করতে সুভাষ বোস, নেহেরু, গান্ধী-সবার কাছেই দরবার করেছেন। কিন্ত কংগ্রেস তাকে পাত্তা দিল না-কারন মুসলমানদের ৫৪% সংরক্ষন দরকার ছিল। যেহেতু তারা শিক্ষা এবং চাকরির ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছে।
এই সুযোগ নিল হিন্দু মহাসভা। সাভারকর দেখা করলেন শ্যামাপ্রসাদের সাথে। বল্লেন দেখ শ্যামাবাবু, কংগ্রেস মুসলীম স্বার্থই দেখবে, তুমি সময় নষ্ট না করে হিন্দু মহাসভায় যোগদাও। তোমার মতন সংগঠককে হিন্দু মহাসভার দরকার। এদ্দিন ধরে হিন্দুদের স্বার্থ রক্ষার জন্য কংগ্রেসের সব নেতার কাছে গেছেন। সুভাষ তার বন্ধুতুল্য। সুভাষ বোস ও কোলকাতা মিউনিসিপ্যালিটির চাকরিতে মুসলমানদের সংরক্ষনের পক্ষে! বুঝলেন হিন্দুমহাসভাই হবে তার প্ল্যাটফর্ম। তিনি তার প্রেসিডেন্ট ও হলেন।
এখানে বুঝতে হবে শ্যমাপ্রসাদ আদতে একজন প্রগতিশীল শিক্ষাবিদ, কংগ্রেসই তার ন্যাচারাল প্ল্যাটফর্ম। ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি বৌদ্ধধর্ম অনুরাগী, মহাবোধি সোশাইটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সমস্ত বৌদ্ধদেশ ভ্রুন করেছেন। ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারে অনেক কিছু করেছেন। এমন এক উদার প্রগতিশীল শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি কি করে হিন্দুমহাসভার আশ্রয় নিতে বাধ্য হল?
এর উত্তর জটিল কিছু না। আজকে প্রগতিশীল নাস্তিক বাঙালীর অধিকাংশই বিজেপি প্রেমী হচ্ছে। কেন? কারন তারা দেখছেন কংগ্রেস এবং তথাকথিত সেকুলার পার্টিগুলো ইসলামিক মৌলবাদ ঠেকাতে কিছু করছে না। অধিকাংশ মুসলমান ত, তাদের মধ্যে বর্ধিত মৌলবাদকে স্বীকার করতেই রাজী না। শ্যামাপ্রসাদের কেসটাও তাই। উনি দেখলেন মুসলীম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ঠেকাতে কংগ্রেস কিছুই করছে না-যদিও তিনি লীগকে ঠেকাতে কংগ্রেসের স্বরণাপন্ন হয়েছেন অনেকবার। ফলে বাধ্য হয়েই তিনি হিন্দু মহাসভার রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন। সেই ধারাই এখন বর্ধিষ্ণু- সর্বত্রই দেখছি শিক্ষিত হিন্দু যুবসমাজের মধ্যে ধর্ম নিরেপেক্ষ রাজনীতি নিয়ে “সঙ্গত কারনেই” বিরাট ডিসিল্যুউশনড”। আশাহত। ফলে গোবলয়ের রাজনীতির স্বরণাপন্ন হচ্ছেন তারা, যাদের ক্যাডারবেসের সাথে, এই প্রগতিশীল হিন্দু বাঙালীদের কোন মিলই নেই।
এবার ফিরে আসি কুইট ইন্ডিয়া মুভমেন্ট প্রসঙ্গে। ১৯৪২ সালে শ্যমাপ্রসাদ তীব্র কংগ্রেস বিরোধি। ফলে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে গর্ভনরকে লিখবেন সেটাই স্বাভাবিক। কিন্ত তার বিবেক জাগ্রত ছিল। সেই বছরই নভেম্বর মাসে শ্যামা-হক মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন। বৃটিশদের বিরুদ্ধে সেই ছিল তার প্রথম প্রতিবাদ। এবং তিনি সেটা করলেন তমলুকের মানুষদের জন্য। তমলুক তখন ভারত ছাড় আন্দোলনের ঘাঁটি। স্বাধীন তাম্রলিপ্ত সরকার সেখানেই তৈরী হয়েছে। সেই বছর আছড়ে পড়ল ঘূর্নিঝড়। দশ হাজার লোকের মৃত্যু। অসংখ্যলোক খাদ্যহীন, বস্ত্রহীন। কিন্ত বৃটিশ নির্লিপ্ত। তমলুকবাসীকে শিক্ষা দিতে হবে। এই প্রথম বৃটিশদের ওপর বিরক্ত হলেন শ্যামাপ্রসাদ। মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ করে ঝড় বিধ্বস্ত এলাকার লোকেদের সেবায় নিয়োজিত হলেন। ১৯৪৩ সালেও তিনি রাজনীতির থেকে অবসর নিয়ে দুর্ভিক্ষে পীড়িত লোকেদের সেবা করেছেন। তার সেবাকার্যের সব থেকে বড় সঙ্গী ছিল বিধানচন্দ্র রায়। তিনি মাতঙ্গিনী হাজরা বিরুদ্ধে গুলি চালানোর প্রতিবাদ করেন নি, এই তথ্যও ঠিক না। না তিনি তার জন্য পদত্যাগ করেন নি, কিন্ত বৃটিশ পুলিশের ভূমিকা “এক্সেসিভ” এবং “রিগ্রেসিভ” ছিল, তা কিন্ত বলেছেন। সুতরাং হিন্দুমহাসভার লাইন মেনে তিনিই শুধুই বৃটিশদের পা চেটেছেন, এ কথা ঠিক না।
(৪) আবার আসি আরেকটি বিতর্তিক প্রশ্নে। শ্যামাপ্রসাদকে পশ্চিম বঙ্গ সৃষ্টির কৃতিত্ব দিয়ে হিন্দুত্ববাদিদের অনেক পোষ্ট দেখি। এটিও ইতিহাসের অতিকথন, অসৎকথন না হলেও। আমি এটাকে রাজনৈতিক প্রপাগান্ডাই বলব।
ক্যাবিনেট মিশন (১৯৪৬) ব্যর্থ হল মুসলীম লীগ এবং কংগ্রেসের মধ্যে সমঝোতা করতে। অখন্ড ভারত সম্ভব না, সবাই বুঝেগেছে। এর মধ্যে বৃটিশরা চাইছিল, যাতে ১৯৪৮ সালের জুন মাসের আগেই ক্ষমতার হস্তান্তর হয়। ১৯৪৭ সালের মার্চ মাসে মাউন্ট ব্যাটেন এলেন ভারত ভাগের পরিকল্পনা নিয়ে। তাতে পরিস্কার ভাবেই ছিল, বাংলা এবং পাঞ্জাব ভাগের জন্য রেফারেন্ডাম হবে। সেই সময় কোলকাতা এবং নোয়াখালির দাঙ্গার পরে, হিন্দু মুসলমান একসাথে থাকতে চাইছিল না। কারন অবিশ্বাসের পরিস্থিতি। গান্ধীও নোয়াখালি ঘুরে হাল ছেড়ে দিয়েছেন।
এই সময় শরত বসু, ফজলুল হক, সুরাবর্দীরা চাইছিলেন স্বাধীন অখন্ড বাংলা সরকার। যা মুসলীম লীগ এবং কংগ্রেস দুজনেই অস্বীকার করে মানতে। ফলে বাংলা ভাগের রেফারেন্ডেম তৈরী হয় এবং আইন সভায় তা পাশ হয়।
সুতরাং পশ্চিম বাংলার গঠনের ক্ষেত্রে দুটি ঘটনা দেখা যাচ্ছে
(১) ক্যাবিনেট মিশনের ব্যর্থতা-যেখানে ইন্ডিয়ান ইউনিয়ানের ধারনা খারিজ হল। ফল এই যে ভারত ভাগের ম্যান্ডেট নিয়ে মাউন্টব্যাটন এলেন। সেটা মার্চ মাস, এবং তাতে বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগের ক্ষেত্রে রেফারেন্ডেমের কথা ছিল।
(২) দেখা গেল বাংলার মুসলিম নেতারা পূর্বপাকিস্তানের ধারনার বিরোধি। তারা অখন্ড স্বাধীন বাংলা কিছু হিন্দু নেতাদের সাথে চাইলেন, পূর্ব পাকিস্তান চাইলেন না। কিন্ত কংগ্রেস এবং মুসলীম লীগ, তার বিরোধিতা করার কারনে, সেই প্রস্তাব এগলো না। ফলে বাংলা ভাগ নিশ্চিত হয়।
এক্ষেত্রে শ্যামাপ্রসাদের অবদান
১) শ্যমাপ্রসাদ ও অখন্ড স্বাধীন বাংলার বিরোধি ছিলেন। কিন্ত তার বিরোধিতায় কিস্যু যায় আসত না, আসেও নি-কারন মাউন্টব্যটন কংগ্রেস এবং মুসলীম লীগকেই ভারতের “ রিপ্রেজেন্টেশন” হিসাবে ধরেছেন। কংগ্রেস এবং মুসলীম লীগের নেতারা অখন্ড বাংলার ধারনা বাতিল করার জন্যই, বাংলা ভাগ নিশ্চিত হয়। হিন্দুদের প্রতিনিধি হিসাবে বৃটিশদের কাছে হিন্দুমহাসভা কোনদিনই পাত্তা পায় নি-কংগ্রেসকেই তারা হিন্দুদের প্রতিনিধি হিসাবে ধরত।
২) বলা হয় ১৯৪৭ সালের মে মাসে শ্যমাপ্রসাদ মাউন্টব্যাটনকে লেখেন বাংলা ভাগের জন্য। তাতে কি? তার দু মাস আগেই মাউন্টব্যটন বাংলা ভাগের রেফারেন্ডেম নিয়ে ভারতে এসেছেন। সব থেকে বড় কথা হিন্দু মহাসভার কোন নেতাকে তাদের পাত্তা দেওয়ার কথাও না-বৃটিশদের কাছে সর্বদাই কংগ্রেসই হিন্দুদের প্রতিনিধিত্ব করে।
সুতরাং শ্যামাপ্রসাদের জন্যই পশ্চিম বঙ্গ রাজ্যের জন্ম হয় এটা শ্যামাপ্রসাদকে বাঙালীদের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করার বৃথা রাজনৈতিক চেষ্টা। যার কোন দরকারই নেই। কারন শ্যমাপ্রসাদ বাংলা ভাষার জন্য যা করেছেন, সেটাই যথেষ্ট তার লেগাসির জন্য। কিন্ত মুশকিল হচ্ছে বাঙালী হিন্দুত্ববাদিদের মধ্যে বুদ্ধিজীবির বড় অভাব।
(৫) এবার আসি স্বাধীনতার পরবর্তী শ্যামাপ্রসাদকে নিয়ে। তার রাজনীতি কি সত্যিই খুব বেশী সাম্প্রদায়িক ছিল ? প্রগতিশীলতার বিরোধি ছিল?
কতগুলো জিনিস জানা দরকার।
এক, প্রথম নেহেরু মন্ত্রীসভায় মোটে দুজন কংগ্রেস বিরোধির নাম গান্ধীজি নিজে সুপারিশ করেছিলেন নেহেরুকে। তার মধ্যে একজন শ্যামাপ্রসাদ, অন্যজন আম্বেদকর। কেন? শ্যামাপ্রসাদের রাজনীতি এত সাম্পদায়িক হলে গান্ধী তার নাম সুপারিশ করতেন না।
দুই, ১৯৫১-৫৩, খুব সংক্ষিপ্ত তার সাংসদীয় জীবন। তিনি ছিলেন বিরোধি দলনেতা। তার প্রতিষ্টিত জনসঙ্ঘ তখন বাকী সব বিরোধি দল, কমিনিউস্টদের সাথেও হাত মিলিয়ে কাজ করছে নেহেরু তথা কংগ্রেসের স্বৈরাচার, অগনতান্ত্রিক সিদ্ধান্তকে রোখার জন্য। হিরেন মুখার্জি, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় সহ অনেক কমিনিউস্ট নেতাই তার গুনমুগ্ধ ছিল। কি কি ব্যাপারে তিনি নেহেরুর বিরোধিতা করেছেন ?
- ৩৭০ , যা ভারতে কাশ্মীরকে স্পেশাল স্ট্যাটাস দেয়।
- ইউনিফর্ম সিভিল কোড
-আরো বেশী বাকস্বাধীনতার দাবী
- রাজ্যের হাতে আরো বেশী ক্ষমতা
সহযোগিতাও করেছেন নেহেরুকে। জমিদারি বিলোপ আইনের ক্ষেত্রে। ১৯৫১ সালে জন সঙ্ঘের এম পি ৩ জন, এম এল এ ৩৫। তিনজনের দুজন বাংলার, একজন রাজস্থানের। এম এল এর মধ্যে ৭ জন বাংলার , ৬ জন রাজস্থানের। কিন্ত রাজস্থান লবির সবাই জমিদার বংশের । তারা বললো, তারা কেন নিজেদের বিরুদ্ধে ভোট দেবে। শ্যমাপ্রসাদ বল্লেন দিতে হবে, কারন সেটাই আমাদের ম্যানিফেস্টো। রাজস্থান লবিকে বহিস্কার করেন তিনি। ক্ষমতার জন্য আপোশ করেন নি।লালকৃষ আদাবানী, পার্টিমিটিং অনেক বার এই গল্পটা শুনিয়েছেন দাবী করার জন্য বিজেপি্র ক্যাডারদের নিয়মনিষ্ঠ হতে হবে।
কিন্ত বাংলার বুকে যে বিজেপি শুরু হল, সেই পার্টি পশ্চিম বাংলা থেকে উঠে গেল কি করে ?
হ্যা, আজকের যে বিজেপি, তার শুরু হয়েছিল বাংলার মাটিতেই। ১৯৫১ সালের ইলেকশনে জনসঙ্ঘের এম পি, এম এল এদের অধিকাংশই পশ্চিম বাংলার। কিন্ত তারা উঠে গেল।
সেই গল্প অন্যদিন। জন সঙ্ঘ গঠনের সময়, আর এস এসের সাহায্য নিলেন শ্যামাপ্রসাদ। গুরু গোলাওয়াকার এবং শ্যমাপ্রসাদ দুজনেই হিন্দুত্ববাদি রাজনীতি করলেও, শ্যামাপ্রসাদের রাজনীতি ছিল অনেক প্রগতিশীল। শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুর পর আর এস এস বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ, জনসঙ্ঘের রাজনীতি সম্পূর্ন ভাবে নিজেদের হাতে আনে। যা এখনো চলছে। শ্যামাপ্রসাদের রাজনীতি গোরক্ষার রাজনীতি, দাঙ্গা বাঁধানোর রাজনীতি ছিল না। দাঙ্গার বিরুদ্ধে দাঙ্গার রাজনীতি, সামরিক শিক্ষা -এই মার্শাল বা মারেঙ্গা টাইপের হিন্দু রাজনীতির প্রবক্তা আর এস এস। হিন্দু মহাসভা ছিল শ্রেফ দাবী আদায়ের রাজনীতি। আর এস এসের প্রতিষ্ঠাতা গুরু কেশব বলরাম হেডগেওয়ার ডাক্তারী পড়তে কোলকাতায় আসেন। এসে অনুশীলন সমিতিতে যোগ দেন। অস্ত্র শিক্ষা স্বদেশী শিক্ষা পেলেন। পুনেতে গিয়ে বৃটিশ বিরোধি কার্যকলাপ করতে গিতে জেল খাটলেন। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তার মোহভঙ্গ হয়। ভারতের ইতিহাসে যারা সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাসী ছিলেন, বৃটিশদের জেল খাটার পর, তারা হয় কমিনিউস্ট আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন, না হলে আর এস এসে। কেন? কারন গুরু হেডগেওয়ার দেখলেন এই ভারতীয়দের দিয়ে রাজনীতি হবে না। এটা হাঁটতেই শেখে নি, দুর্বল শরীর, দৌঁড়াবে কি? ফলে হিন্দুদের অস্ত্র শিক্ষায় শিক্ষিত করার দীক্ষা নেন। সেই সুযোগ হাতে আসে গান্ধীর ভ্রান্ত খিলাফত আন্দোলনের ফলে। যার জন্য দক্ষিন ভারতে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা শুরু হয়। নাগপুরে প্রথম দাঙ্গায় হিন্দুরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। দুবছর বাদে আর এস এস পালটা দাঙ্গা বাধায় নিজেদের শক্তি প্রদর্শনের জন্য। এবার নাগপুরের অনেক মুসলমান শহর ছাড়তে বাধ্য হয়।
আর এস এসের ইতিহাস নিয়ে অন্যকোন স্থানে লিখব। কিন্ত যেটা লিখতে চাইছি, সেটা হচ্ছে এই যে আজকের যে বিজেপি, সেটা আর এস এসের, গুরু হেডগেওয়ারের রাজনৈতিক সন্তান। এটা শ্যামাপ্রসাদের রাজনৈতিক আদর্শ না। সুতরাং আজকের বিজেপিকে দেখে শ্যামাপ্রসাদকে মুল্যায়ন করা ভুল হবে।
(৬) আমি হিন্দুত্ববাদ এবং বামপন্থী, দুই ধরনের রাজনীতিরই বিরোধি। আমার কাছে বাম ও রাম এক মুদ্রার দুই পিঠ। মুদ্রাটা হচ্ছে “ভিক্টিমাইজেশনের গল্প ফেঁদে” রাজনীতি। হিন্দুত্ববাদের রাজনীতির ভিত্তি “হিন্দুরা ঐতিহাসিক ভাবে মুসলমানদের হাতে নির্যাতিত”। বাম রাজনীতির ভিত্তি কৃষক শ্রমিক ধনী শ্রেনীর হাতে নির্যাতিত। আপনি বলবেন, এই দুই গ্রান্ড ন্যারেটিভই ত ঠিক। কিন্ত এই ধরনের ভিক্টিমাইজেশনের রাজনীতিই পৃথিবীতে হিটলার, লেনিন, স্টালিনদের মতন দানবদের জন্ম দিয়েছে। সুতরাং সেই পথ কাম্য না। কারন গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের আড়ালে সত্য , জ্ঞান, কর্ম সবই চাপা যায়। আমি আগেও লিখেছি, সেই রাজনীতিই সফল হয় যা জ্ঞান, বুদ্ধি, বোধ এবং “ফ্যাক্ট” ভিত্তিক। সব থেকে বড় কথা এটা জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তির যুগ। একমাত্র প্রযুক্তির মাধ্যমেই দেশের , সমাজের ব্যক্তির উন্নতি সম্ভব। সুতরাং শিক্ষা ও প্রযুক্তি ভিত্তিক ব্যবসা করার সুযোগ, এটাই হওয়া উচিত এই যুগের রাজনীতি। কিন্ত ভোট সর্বস্ব রাজনীতি হিন্দু মুসলমানের পরিচয়টাই আগে এনে দিচ্ছে। এটাই আজকের দিনের লিব্যারাল রাজনীতির ব্যর্থতা। কারন ভোটের জন্য, প্রতিটা রাজনৈতিক দলের নেতাদের মাথা সাম্প্রদায়িক নেতাদের কাছে বিক্রিত।
(১)
শ্যমাপ্রসাদের মূর্তিকে কালিমালেপনে, বাম এবং রাম, দুই দলই এখন ফেসবুকে যুযুদ্ধমান। কি কৈশর, কি যৌবন কি বর্তমান ইউটিউব-গুগুল-ফেসবুক নির্ভর দিনগত ইতিহাসক্ষয় জীবনে, শ্যমাপ্রসাদের ওপর ভাল কোন লেখা পড়ার সৌভাগ্য হয় নি। ফলে এই ভদ্রলোক সম্মন্ধে আমার জ্ঞান ভাসা ভাসা। মূর্তি বিতর্কের সূত্র ধরে আশাছিল, বিবদমান রাম-বামের পোষ্টের লড়াই এ শ্যমাপ্রসাদকে নিয়ে কিছু জানব। কোথায় কি। শ্যমাপ্রসাদ সম্মন্ধে – রাম/বাম দুই দলেরই অবস্থা দেখলাম সঙ্গীন। অগত্যা নিজেই খোঁজাখুজি শুরু করি। তাতে দেখি শ্যমাপ্রসাদকে নিয়ে প্রমান্য ঐতিহাসিক কাজ প্রায় নেই। হয় সঙ্ঘের প্রপাগান্ডা, না হলে বামেদের কাউন্টার প্রপাগান্ডা। কনটেক্সট বিহীন, অর্থহীন। ফলে বিভিন্ন জায়গা থেকে পাওয়া কিছু কিছু তথ্যকে ছেঁকে এ লেখা সাজাচ্ছি। এই ধরনের কাজের জন্য যে পরিমান সময় এবং গবেষনা দেওয়া উচিত তার ১% সময় ও আমার হাতে নেই। গোদের ওপর বিষফোঁড়া, শ্যামাপ্রসাদকে নিয়ে জানতে গিয়ে দেখলাম ১৯৪২-১৯৫১ সাল পর্যন্ত ভারতের ইতিহাস ও গুলিয়ে যাচ্ছে। আমার ধারনা ছিল দেশ ভাগের ইতিহাস মোটামুটি বুঝি-অন্তত একটা সুতোয় বাঁধতে পারি। গত দুদিন ধরে দেশভাগ সংক্রান্ত যত ইতিহাস পড়ছি বা শুনছি, তাতে প্রচুর পরস্পর বিরোধি তথ্য দেখতে পাচ্ছি। তবুও এই লেখার ধৃষ্টতা করছি-যে আমার ভুল পাঠক শুধরে দেবেন। আলোচনার শেষে সত্যিকারের শ্যমাপ্রসাদকে আমরা উদ্ধার করতে পারব। আমি এই লেখায়, তার জীবন নিয়ে না লিখে, তাকে নিয়ে ওঠা কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছি।
(২) শ্যমাপ্রসাদকে বাঙালী কেন মনে রাখবে?
ফেসবুক এই প্রশ্নে উত্তাল। বামেদের বক্তব্য যে ভদ্রলোক বৃটিশ পতাকা ইউনিয়ান জ্যাক না তোলার অপরাধে, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই জাতিয়তাবাদি ছাত্রনেতা্কে রাস্টিকেট করেছিলেন , কুইট ইন্ডিয়া মুভমেন্টের সময় বাঙলার গভর্নরকে চিঠি লিখে, আন্দোলনকারীদের বিরোধিতা করেছিলেন-তিনি কি করে বাঙলা তথা ভারতের জাতীয়তাবাদি নেতা হতে পারেন? বামদের শ্যমাপ্রসাদ একজন বৃটিশদের পাচাটা সাম্প্রদায়িক হিন্দুনেতা।
অন্যদিকে হিন্দুত্ববাদিদের দাবী-শ্যমাপ্রসাদ না থাকলে আজকে পশ্চিম বঙ্গ, বাংলাদেশে চলে যেত। বাঙালী হিন্দুদের জন্য স্বাধীন রাজ্যের দাবী তিনিই তোলেন।
উভয়ক্ষেত্রেই “ফ্যাক্ট” সামান্য, দৃষ্টি মায়োপিক, আসল শ্যমাপ্রসাদ অন্যকেও!
প্রথমে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে আসি। শ্যমাপ্রসাদ চার বছর কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য্য ১৯৩৪-৩৮। কেন তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন স্বদেশী ঢুকতে দেন নি, সেটা বুঝতে স্যার আশুতোষ, তার বাবার আদর্শকে বুঝতে হবে। কারন ওই চারবছর, বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি তার পিতা স্যার আশুতোষের অসমাপ্ত কাজ এবং আদর্শকেই এগিয়ে নিয়ে গেছেন।
সেটা ১৯১৭ সাল। স্বাধীনতার আকাঙ্খায় বাংলার দামাল মেধাবী ছেলেরা বিপ্লবী মন্ত্রে দিক্ষিত হয়ে বোমা, বন্দুক তুলে নিচ্ছে। মেঘনাদ সাহা ফলিত গণিতে এম এস সি ক্লাসে প্রথম শ্রেনীতে দ্বিতীয় হলেন। কিন্ত পাশ করে বেকার। সাইকেল চালিয়ে টিউশুনি করেন। আর সাথে সাথে স্বদেশী আখরায় যাতায়াত শুরু। খবর গেল স্যার আশুতোষের কাছে। মেঘনাদ সাহা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অসম্ভব মেধাবী ছাত্রটি স্বদেশী হতে চলেছে। স্যার আশুতোষ ডাকলেন মেঘনাদা সাহাকে। বললেন দেখ স্বদেশী করার ছেলে প্রচুর। শুধু বোমাবাজি, আন্দোলন করলেই ভবিষ্যতের ভারত দাঁড়াবে হে ছোকরা? বিদেশীরা বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে বলিয়ান হয়ে আজ আমাদের প্রভু। তাদের সমানতালে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চায় না এগোলে, আমরা কোনদিন জাতি হিসাবে উন্নত হতে পারব না। আমি তোমার আর সত্যেনের জন্য দুটো লেকচারার পদ খুলে দিচ্ছি। বিদেশে পদার্থবিদ্যার নবযুগ শুরু হয়েছে। আমার দেশ পদার্থবিদ্যায় পিছিয়ে থাকতে পারে না। পদার্থবিদ্যার মাস্টার ডিগ্রি ক্লাশ শুরু করে দাও কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে!
আজ স্যার আশুতোষ না থাকলে সত্যেন বোস বা মেঘনাদ সাহা কেউ থাকতেন না। স্যার আশুতোষের স্বপ্ন ছিল, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হবে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড কেম্ব্রিজ, হার্ভাড। ভারতীয়রা এগিয়ে যাবে বিজ্ঞানচর্চায় সমানতালে। এবং তিনি সফল। ১৯৪০ সাল পর্যন্ত বিজ্ঞান চর্চায় কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণযুগ। এই সময় সিভি রামন শুধু বিজ্ঞানে নোবেলই আনেন নি, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন বোস, সি আর মিত্র-ইত্যাদি অনেক তরুন ভারতীয় বিজ্ঞানী জানান দিয়েছেন ভারতীয়রা মেধায় পিছিয়ে নেয়। জাতীয়তাবাদ ত শুধু বোমা বন্দুকের প্রতিবাদি রাজনীতিতে হয় না, জাতির শিক্ষা মেধার উন্নয়ন তার থেকেও গুরুত্বপূর্ন। যে গুরুদায়িত্ব নিয়েছিলেন আশুতোষ, রবীন্দ্রনাথ, সিভি রামন, সি আর টাটা, উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর মতন দিকপাল।
কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় চলত অনুদানে। এডুকেশন ডিপার্টমেন্ট থেকে অল্প সাহায্যই আসত। বৃটিশরা চাকর বাকর ভারতীয় দেখতে চায়, সত্যেন বোস, মেঘনাদ সাহার মতন দিকপাল বিজ্ঞানী তৈরীর জন্য কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে টাকা দেবে না কি? আশুতোষ সারা জীবন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমিদার, রাজাদের কাছে ভিক্ষা করেছেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই সেই কারনে উনি চাননি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যায়লে স্বদেশী রাজনীতি ঢুকুক। রাজনীতি ঢুকলে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎকর্ষতা নষ্ট হবে, অনেক মেধাবী ছাত্রদের তিনি বিজ্ঞানী শিক্ষাবিদ করে তুলেছেন, তা নষ্ট হত। ফলে আশুতোষ একদিকে যেমন স্বদেশী ভাষা এবং শিক্ষা জন্য জান লড়িয়ে দিচ্ছেন, অন্যদিকে মেধাবী ছাত্ররা যাতে স্বদেশী “বিপ্লবী” দের খপ্পরে না আসে, তার জন্য, অত্যন্ত কড়া ছিলেন।
শ্যমাপ্রসাদ তারা বাবাকেই ফলো করেছেন মাত্র। কারন তার কাছে স্বদেশী মানে বোমা আন্দোলন না, স্বদেশী ভাষা ( বাংলা হিন্দির) উন্নতি, স্বদেশী বিজ্ঞানের উন্নতি, স্বদেশী শিল্পের উন্নতি। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, তার চার বছরে এক্সাক্টলি, এই কাজগুলিই দিবারাত্র করেছেন শ্যামাপ্রসাদ। তার এই চারবছরে, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তার অবদান প্রচুর, আমি সামান্য কিছুই লিখছি।
(১) বাংলা ভাষার বিজ্ঞান ও উচ্চশিক্ষা চর্চার জন্য -কমিটি ঘটন করে, বাংলার বিজ্ঞান শব্দকোষ তৈরী করলেন। যা বাংলার প্রথম বিজ্ঞানকোষ।
(২) তার সময় থেকেই স্নাতক স্তরে ছাত্রছাত্রীরা যাতে বাংলায় পরীক্ষা দিতে পারে, সেই ব্যবস্থা হয়।
(৩) ফলিত পদার্থবিদ্যা এবং কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট শুরু হল, সেই সূত্র ধরেই কোলকাতার বিখ্যাত রেডিও ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট শুরু হবে। ইলেকট্রনিক্স সাবজেক্টের শুরু এই ফলিত ডিপার্টমেন্টেই।
(৪) কেমিস্ট্রি যাতে শুধু ক্লাসরুমে আটকে না থাকে, উনি স্পেশাল গ্রান্ট আনলেন, কেমিস্ট্রির ছাত্ররা, অধ্যাপকরা যতে নিজেরাই স্বদেশী স্টাইলে দেশেই কেমিক্যাল তৈরী করে বিদেশ থেকে না ইম্পোর্ট করে। প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এ ব্যপারে তার আদর্শ।
(৫) কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক ইতিহাস চালু হল। না উনি সাম্প্রদায়িক ছিলেন না, চলমান রাজনীতি তাকে বাধ্য করেছিল হিন্দুমহাসভা এবং আর এস এসের সাহায্য নিতে।
(৬) মেয়েরা যতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে পারে, মেয়েদের জন্যও আসন সংরক্ষন করলেন তিনি।
বাংলা ভাষার উন্নতির জন্য, আরো অনেক কিছু করেছেন, যা এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধে লেখা সম্ভব না। শুধু সেই জন্যেই বাঙালী মনে রাখতে পারে শ্যামাপ্রসাদকে। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কনভোকেশন হত ইংরেজিতে-উনিই রবীন্দ্রনাথকে প্রধান অতিথি করে, বাংলায় কনভোকেশন চালু করলেন। রবীন্দ্রনাথ যাতে বাংলার মাস্টার ডিগ্রির ক্লাস নেন, সেই ব্যপার ও পাকা করে ফেলেছিলেন গুরুদেবের সম্মতিতে। কিন্ত বাঙালী সেকালেও ছাগল এবং কূট রাজনীতি করত। যেমন একালেও করে। রবীন্দ্রনাথের “ডিগ্রী” নেই বলে সিন্ডিকেট আপত্তি তুললো! যদিও শ্যামাপ্রসাদ, তা ওভাররুল করেন, কিন্ত গুরুদেব কিছু সিন্ডিকেট মেম্বারদের এই আপত্তিতে ব্যথিত হয়ে, শ্যামাপ্রসাদকে ফিরিয়ে দিলেন।
একমাত্র বাঙালীর মতন নির্বোধ জাতির লোকজনই বোধ হয় পারে বাংলা সাহিত্যের একমাত্র নোবেল প্রাইজ বিজেতার বাঙলায় মাস্টার ডিগ্রির ক্লাসে পড়ানোর যোগ্যতা আছে কি না, সেই নিয়ে প্রশ্ন তুলতে! কারন রবীন্দ্রনাথের কোন ডিগ্রি নাই! কি মারাত্মক!
সুতরাং আজকে সেই আহাম্মক বাঙালী জাতির উত্তরপুরুষরা যখন শ্যমাপ্রসাদ স্বদেশী শিক্ষা, বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা, দেশীয় শিল্প, নারীশিক্ষার জন্য কি করেছিলেন সেটা না জেনে, শুধু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে স্বদেশী আন্দোলনকারিদের প্রতি কঠোর ছিলেন কেন, সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, তখন অবাক হওয়ার অবকাশ নেই। বাঙালী অমনই। তারা রবীন্দ্রনাথের ডিগ্রিগত যোগ্যতা দাবী করতে পারে, স্বদেশী বলতে শুধু বোমাবাজি, মিছিল বুঝতে পারে। বাঙালী চিত্তের বুদ্ধিবিদ্যার যা “হাল” তাতে এর বেশী কিছু আশা করা অন্যায়।
(৩) এবার আসি কুইট ইন্ডিয়া মুভমেন্ট, ভারত ছাড় আন্দোলনে শ্যামাপ্রসাদের ভূমিকা নিয়ে। সেটা ১৯৪২ সাল। এবং এটা সত্য, তখন তিনি বৃটিশ সাথে, স্বদেশী আন্দোলন, বিশেষত কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। কিন্ত কেন ?
কারন তখন তিনি হিন্দুমহাসভার নেতা। বৃটিশদের সাথে সহযোগিতা করে, হিন্দুদের জন্য সুযোগ বেশী করে দেওয়াটাই যে পার্টির একমাত্র রাজনীতি ছিল।
আজকে বিজেপির পূর্বাসূরী, অখিল ভারত হিন্দু মহাসভা, কেন বৃটিশদের পাচাটার রাজনীতি করত?
এটা বুঝতে পারলেই বুঝবেন, এদ্দিন ধরে আমি যা বলে আসছি, যে ভারতের হিন্দুত্ববাদি রাজনীতি, ইসলামিক মৌলবাদি রাজনীতির রিয়াকশন ছাড়া কিছু না, তা আরো স্পষ্ট হবে।
সুতরাং আসুন, স্বাধীনতার পূর্বে এই হিন্দুমহাসভার রাজনীতির সাথে আমরা পরিচিত হই।
হিন্দু মহাসভার সৃষ্টি শ্রেফ মুসলীম লীগকে কাউন্টার করতে। সুতরাং মুসলিম লীগের রাজনীতি কি, কেন তারা ইতিহাসে আলো করে এল, সেটাও বুঝি চলুন। মুসলিম লীগের জন্ম ১৯০৬ সালে। কংগ্রেস তখন একটা হিন্দুদের দলে পরিনত। ভারতের অধিকাংশ উচ্চপদস্থ চাকরি হিন্দুদের দখলে। স্বভাবতই শিক্ষিত মুসলমানরা “মার্জিনালাইজড” বোধ করলেন। এবং ভারতে মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকারের জন্য ১৯০৬ সালে মুসলীম লীগ তৈরী হল।
বৃটিশরা হাতে মোয়া পেল। মর্লি মিন্টো সংস্কার, যার দরুন ভারতে প্রথম গনতান্ত্রিক ভোটাভুটি-বা স্থানীয় স্বয়ত্ব শাসনের শুরু, তারা মুসলীম লীগের সব দাবী স্বীকার করে। কারন তখন বৃটিশরা বুঝেছে, মুসলীম লীগ তাদের তুরুপের তাস-কারন এই লীগকে সামনে রেখে তারা রাজনীতি এবং সরকারি কাজে মুসলমানদের জন্য সংরক্ষণ করবে। যেহেতু সরকারি চাকরি, শিক্ষা সর্বত্রই হিন্দুদের প্রাধান্য, এই ধরনের আইন হিন্দু-মুসলমান বিভেদ সৃষ্টি করবে, ভারতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি শুরু হবে। ১৯০৯ সালে মর্লি-মিন্টো সংস্কার ছিল, সেই দাবার প্রথম চাল। বোরেটাকে প্রথম এগোনো। সেখানে মুসলীম লীগের দাবী মেনে নিয়ে, মুসলিম এবং হিন্দুদের জন্য আলাদা প্রতিনিধিত্ব চালু হয়।
মর্লি-মিন্টো সংস্কারে আইন সভায়, মুসলীমদের জন্য আলাদা প্রতিনিধিত্ব থাকায়, প্রমাদ গনলেন উত্তর-পশ্চিমের হিন্দুরা যেখানে মুসলমানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। অনেক বড় মার্জিনে। সেই জন্য ১৯১০ সালটা হচ্ছে হিন্দুত্ববাদি রাজনীতির আঁতুর ঘর। ওই বছর পাঞ্জাব, সিন্ধ দিল্লী ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্স- যেখানে হিন্দুরা সংখ্যালঘু- সর্বত্রই প্রাদেশিক হিন্দু সভা গঠিত হল। উদ্দেশ্য এরা একটি অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা গড়বেন। যার কাজ হবে, মুসলীম লীগের রাজনীতিকে কাউন্টার করা। হোতা মদন মহন মালব্য, লালা লাজপত রায়।
সেই মোতাবেক আমলাতে ১৯১৩ সালে হিন্দু মহাসভার প্রথম অখিল ভারতীয় অধিবেশন হয়। প্রথম প্রেসিডেন্ট এক বাঙালী- কুচবিহারের মহারাজা মহিন্দ্র নন্দী। প্রথম অধিবেশনেই মত এবং পথ নিয়ে সাংঘাতিক গন্ডোগল। কারন এই হিন্দু মহাসভার আহ্বায়করা অধিকাংশই উত্তর-পশ্চিমের “পলিটিক্যালি এনলাইটেন্ড” উচ্চশিক্ষিত হিন্দু। রক্ষনশীল হিন্দু এরা নন, অধিকাংশই ছিলেন আর্যসমাজি। সুতরাং জাতিভেদ প্রথাকে নিন্দা করে অখন্ড হিন্দু জাতির প্রস্তাব পাশ হয়, কিন্ত বৃটিশদের সাথে সহযোগিতার লাইন ও ঘোষিত হয়। বৃটিশদের পা চাটার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন আর্য্য সমাজের বিখ্যাত সন্ন্যাসী স্বামী শ্রদ্ধানন্দ । কিন্ত দেখা গেল অধিকাংস সদস্য, মুসলীমের লীগের হনুকরনেই বিশ্বাসী-তাদের ধারনা বৃটিশ মহলে প্রভাব না ফেললে-মুসলীম লীগ চাকরি, বাকরি-আইন সব নিয়ে যাবে। সেই লাইনেই চলেছে হিন্দু মহাসভার রাজনীতি। যাতে ১৯৩৬ সালে জয়েন করেছেন শ্যমাপ্রসাদ -কিছুটা বাধ্য হয়ে, কিছুটা সাভারকরের প্রভাবে।
অর্থাৎ বিজেপির জন্ম মুসলীম লীগের রাজনীতির হনুকরনে। সুতরাং তাদের হিন্দুত্ববাদ যে ইসলাম ২ ভার্সান হবে, সেটাই স্বাভাবিক এবং ঐতিহাসিক ও বটে।
হিন্দু মহাসভা , বলাই বাহুল্য রাজনৈতিক দিক থেকে ব্যর্থ এক সংগঠন ছিল। কারন জাতিভেদ, বর্ণহিন্দুত্বের বিরুদ্ধে এই সংগঠন শুরু হলেও অচিরেই তা বর্ণহিন্দুদের সংগঠনে পরিণত হয়। তাছাড়া, বৃটিশদের পাচাটার কারনে তাদের গ্রহনযোগ্যতাও কমে আসে। গান্ধী, নেহেরু, সুভাষের মতন মেধাবী নেতা তারা পায় নি।
এবার দেখাযাক শ্যমাপ্রসাদ হিন্দু মহাসভায় যোগ দিলেন কেন। উনি রাজনীতি শুরু করেছিলেন কিন্ত কংগ্রেসের সদস্য হিসাবে আইনসভায় ১৯২৯ সালে। ১৯৩০ সালে কংগ্রেসে “ আইন অমান্য আন্দোলন “ - লবন সত্যাগ্রহের জন্য সব নির্বাচিত সদস্যকে আইনসভা থেকে পদত্যাগ করতে বলে। ফলে শ্যামাপ্রসাদের আর আইনসভায় থাকা হল না। কিন্ত উনি ইন্ডিপেন্ডেট ক্যান্ডিডেট হিসাবে বাংলার আইন সভায় আবার এলেন ১৯৩১ সালে। কংগ্রেস যেহেতু আইন সভা বর্জন করেছে, সেহেতু বাংলার আইন সভায় তখন হিন্দুদের প্রতিনিধি বলতে শুধু শ্যামাবাবু- বাকী সবাই মুসলিম লীগ, বা ফজলুল হকের কৃষক প্রজাপার্টি।
যেহেতু বাংলার আইনসভায় তখন কৃষক প্রজাপার্টি এবং মুসলীম লীগের একাধিপত্য,সমস্ত চাকরি, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে মুসলীমদের জন্য সমানুপাতিক “সংরক্ষন”-অর্থাৎ ৫৪% সংরক্ষন চালু হল। সেই সময় বাংলায় টোট্যাল ৫৪% মুসলমান, কিন্ত শিক্ষা, চাকরি ইত্যাদি ক্ষেত্রে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব ৫% এর ও নীচে। ফলে এটা হওয়ারই ছিল।
এতে বর্নহিন্দুরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়, যেহেতু হঠাৎ করে তারা দেখে, চাকরির ক্ষেত্র, শিক্ষার ক্ষেত্র সংকুচিত। শিক্ষিত বর্নহিন্দুরা ক্ষেপে ওঠে-কিন্ত কংগ্রেস মুসলীম লীগ এবং কৃষক প্রজাপার্টির এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কিছু করবে না। শ্যমাপ্রসাদ এর বিহিত করতে সুভাষ বোস, নেহেরু, গান্ধী-সবার কাছেই দরবার করেছেন। কিন্ত কংগ্রেস তাকে পাত্তা দিল না-কারন মুসলমানদের ৫৪% সংরক্ষন দরকার ছিল। যেহেতু তারা শিক্ষা এবং চাকরির ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছে।
এই সুযোগ নিল হিন্দু মহাসভা। সাভারকর দেখা করলেন শ্যামাপ্রসাদের সাথে। বল্লেন দেখ শ্যামাবাবু, কংগ্রেস মুসলীম স্বার্থই দেখবে, তুমি সময় নষ্ট না করে হিন্দু মহাসভায় যোগদাও। তোমার মতন সংগঠককে হিন্দু মহাসভার দরকার। এদ্দিন ধরে হিন্দুদের স্বার্থ রক্ষার জন্য কংগ্রেসের সব নেতার কাছে গেছেন। সুভাষ তার বন্ধুতুল্য। সুভাষ বোস ও কোলকাতা মিউনিসিপ্যালিটির চাকরিতে মুসলমানদের সংরক্ষনের পক্ষে! বুঝলেন হিন্দুমহাসভাই হবে তার প্ল্যাটফর্ম। তিনি তার প্রেসিডেন্ট ও হলেন।
এখানে বুঝতে হবে শ্যমাপ্রসাদ আদতে একজন প্রগতিশীল শিক্ষাবিদ, কংগ্রেসই তার ন্যাচারাল প্ল্যাটফর্ম। ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি বৌদ্ধধর্ম অনুরাগী, মহাবোধি সোশাইটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সমস্ত বৌদ্ধদেশ ভ্রুন করেছেন। ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারে অনেক কিছু করেছেন। এমন এক উদার প্রগতিশীল শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি কি করে হিন্দুমহাসভার আশ্রয় নিতে বাধ্য হল?
এর উত্তর জটিল কিছু না। আজকে প্রগতিশীল নাস্তিক বাঙালীর অধিকাংশই বিজেপি প্রেমী হচ্ছে। কেন? কারন তারা দেখছেন কংগ্রেস এবং তথাকথিত সেকুলার পার্টিগুলো ইসলামিক মৌলবাদ ঠেকাতে কিছু করছে না। অধিকাংশ মুসলমান ত, তাদের মধ্যে বর্ধিত মৌলবাদকে স্বীকার করতেই রাজী না। শ্যামাপ্রসাদের কেসটাও তাই। উনি দেখলেন মুসলীম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ঠেকাতে কংগ্রেস কিছুই করছে না-যদিও তিনি লীগকে ঠেকাতে কংগ্রেসের স্বরণাপন্ন হয়েছেন অনেকবার। ফলে বাধ্য হয়েই তিনি হিন্দু মহাসভার রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন। সেই ধারাই এখন বর্ধিষ্ণু- সর্বত্রই দেখছি শিক্ষিত হিন্দু যুবসমাজের মধ্যে ধর্ম নিরেপেক্ষ রাজনীতি নিয়ে “সঙ্গত কারনেই” বিরাট ডিসিল্যুউশনড”। আশাহত। ফলে গোবলয়ের রাজনীতির স্বরণাপন্ন হচ্ছেন তারা, যাদের ক্যাডারবেসের সাথে, এই প্রগতিশীল হিন্দু বাঙালীদের কোন মিলই নেই।
এবার ফিরে আসি কুইট ইন্ডিয়া মুভমেন্ট প্রসঙ্গে। ১৯৪২ সালে শ্যমাপ্রসাদ তীব্র কংগ্রেস বিরোধি। ফলে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে গর্ভনরকে লিখবেন সেটাই স্বাভাবিক। কিন্ত তার বিবেক জাগ্রত ছিল। সেই বছরই নভেম্বর মাসে শ্যামা-হক মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন। বৃটিশদের বিরুদ্ধে সেই ছিল তার প্রথম প্রতিবাদ। এবং তিনি সেটা করলেন তমলুকের মানুষদের জন্য। তমলুক তখন ভারত ছাড় আন্দোলনের ঘাঁটি। স্বাধীন তাম্রলিপ্ত সরকার সেখানেই তৈরী হয়েছে। সেই বছর আছড়ে পড়ল ঘূর্নিঝড়। দশ হাজার লোকের মৃত্যু। অসংখ্যলোক খাদ্যহীন, বস্ত্রহীন। কিন্ত বৃটিশ নির্লিপ্ত। তমলুকবাসীকে শিক্ষা দিতে হবে। এই প্রথম বৃটিশদের ওপর বিরক্ত হলেন শ্যামাপ্রসাদ। মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ করে ঝড় বিধ্বস্ত এলাকার লোকেদের সেবায় নিয়োজিত হলেন। ১৯৪৩ সালেও তিনি রাজনীতির থেকে অবসর নিয়ে দুর্ভিক্ষে পীড়িত লোকেদের সেবা করেছেন। তার সেবাকার্যের সব থেকে বড় সঙ্গী ছিল বিধানচন্দ্র রায়। তিনি মাতঙ্গিনী হাজরা বিরুদ্ধে গুলি চালানোর প্রতিবাদ করেন নি, এই তথ্যও ঠিক না। না তিনি তার জন্য পদত্যাগ করেন নি, কিন্ত বৃটিশ পুলিশের ভূমিকা “এক্সেসিভ” এবং “রিগ্রেসিভ” ছিল, তা কিন্ত বলেছেন। সুতরাং হিন্দুমহাসভার লাইন মেনে তিনিই শুধুই বৃটিশদের পা চেটেছেন, এ কথা ঠিক না।
(৪) আবার আসি আরেকটি বিতর্তিক প্রশ্নে। শ্যামাপ্রসাদকে পশ্চিম বঙ্গ সৃষ্টির কৃতিত্ব দিয়ে হিন্দুত্ববাদিদের অনেক পোষ্ট দেখি। এটিও ইতিহাসের অতিকথন, অসৎকথন না হলেও। আমি এটাকে রাজনৈতিক প্রপাগান্ডাই বলব।
ক্যাবিনেট মিশন (১৯৪৬) ব্যর্থ হল মুসলীম লীগ এবং কংগ্রেসের মধ্যে সমঝোতা করতে। অখন্ড ভারত সম্ভব না, সবাই বুঝেগেছে। এর মধ্যে বৃটিশরা চাইছিল, যাতে ১৯৪৮ সালের জুন মাসের আগেই ক্ষমতার হস্তান্তর হয়। ১৯৪৭ সালের মার্চ মাসে মাউন্ট ব্যাটেন এলেন ভারত ভাগের পরিকল্পনা নিয়ে। তাতে পরিস্কার ভাবেই ছিল, বাংলা এবং পাঞ্জাব ভাগের জন্য রেফারেন্ডাম হবে। সেই সময় কোলকাতা এবং নোয়াখালির দাঙ্গার পরে, হিন্দু মুসলমান একসাথে থাকতে চাইছিল না। কারন অবিশ্বাসের পরিস্থিতি। গান্ধীও নোয়াখালি ঘুরে হাল ছেড়ে দিয়েছেন।
এই সময় শরত বসু, ফজলুল হক, সুরাবর্দীরা চাইছিলেন স্বাধীন অখন্ড বাংলা সরকার। যা মুসলীম লীগ এবং কংগ্রেস দুজনেই অস্বীকার করে মানতে। ফলে বাংলা ভাগের রেফারেন্ডেম তৈরী হয় এবং আইন সভায় তা পাশ হয়।
সুতরাং পশ্চিম বাংলার গঠনের ক্ষেত্রে দুটি ঘটনা দেখা যাচ্ছে
(১) ক্যাবিনেট মিশনের ব্যর্থতা-যেখানে ইন্ডিয়ান ইউনিয়ানের ধারনা খারিজ হল। ফল এই যে ভারত ভাগের ম্যান্ডেট নিয়ে মাউন্টব্যাটন এলেন। সেটা মার্চ মাস, এবং তাতে বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগের ক্ষেত্রে রেফারেন্ডেমের কথা ছিল।
(২) দেখা গেল বাংলার মুসলিম নেতারা পূর্বপাকিস্তানের ধারনার বিরোধি। তারা অখন্ড স্বাধীন বাংলা কিছু হিন্দু নেতাদের সাথে চাইলেন, পূর্ব পাকিস্তান চাইলেন না। কিন্ত কংগ্রেস এবং মুসলীম লীগ, তার বিরোধিতা করার কারনে, সেই প্রস্তাব এগলো না। ফলে বাংলা ভাগ নিশ্চিত হয়।
এক্ষেত্রে শ্যামাপ্রসাদের অবদান
১) শ্যমাপ্রসাদ ও অখন্ড স্বাধীন বাংলার বিরোধি ছিলেন। কিন্ত তার বিরোধিতায় কিস্যু যায় আসত না, আসেও নি-কারন মাউন্টব্যটন কংগ্রেস এবং মুসলীম লীগকেই ভারতের “ রিপ্রেজেন্টেশন” হিসাবে ধরেছেন। কংগ্রেস এবং মুসলীম লীগের নেতারা অখন্ড বাংলার ধারনা বাতিল করার জন্যই, বাংলা ভাগ নিশ্চিত হয়। হিন্দুদের প্রতিনিধি হিসাবে বৃটিশদের কাছে হিন্দুমহাসভা কোনদিনই পাত্তা পায় নি-কংগ্রেসকেই তারা হিন্দুদের প্রতিনিধি হিসাবে ধরত।
২) বলা হয় ১৯৪৭ সালের মে মাসে শ্যমাপ্রসাদ মাউন্টব্যাটনকে লেখেন বাংলা ভাগের জন্য। তাতে কি? তার দু মাস আগেই মাউন্টব্যটন বাংলা ভাগের রেফারেন্ডেম নিয়ে ভারতে এসেছেন। সব থেকে বড় কথা হিন্দু মহাসভার কোন নেতাকে তাদের পাত্তা দেওয়ার কথাও না-বৃটিশদের কাছে সর্বদাই কংগ্রেসই হিন্দুদের প্রতিনিধিত্ব করে।
সুতরাং শ্যামাপ্রসাদের জন্যই পশ্চিম বঙ্গ রাজ্যের জন্ম হয় এটা শ্যামাপ্রসাদকে বাঙালীদের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করার বৃথা রাজনৈতিক চেষ্টা। যার কোন দরকারই নেই। কারন শ্যমাপ্রসাদ বাংলা ভাষার জন্য যা করেছেন, সেটাই যথেষ্ট তার লেগাসির জন্য। কিন্ত মুশকিল হচ্ছে বাঙালী হিন্দুত্ববাদিদের মধ্যে বুদ্ধিজীবির বড় অভাব।
(৫) এবার আসি স্বাধীনতার পরবর্তী শ্যামাপ্রসাদকে নিয়ে। তার রাজনীতি কি সত্যিই খুব বেশী সাম্প্রদায়িক ছিল ? প্রগতিশীলতার বিরোধি ছিল?
কতগুলো জিনিস জানা দরকার।
এক, প্রথম নেহেরু মন্ত্রীসভায় মোটে দুজন কংগ্রেস বিরোধির নাম গান্ধীজি নিজে সুপারিশ করেছিলেন নেহেরুকে। তার মধ্যে একজন শ্যামাপ্রসাদ, অন্যজন আম্বেদকর। কেন? শ্যামাপ্রসাদের রাজনীতি এত সাম্পদায়িক হলে গান্ধী তার নাম সুপারিশ করতেন না।
দুই, ১৯৫১-৫৩, খুব সংক্ষিপ্ত তার সাংসদীয় জীবন। তিনি ছিলেন বিরোধি দলনেতা। তার প্রতিষ্টিত জনসঙ্ঘ তখন বাকী সব বিরোধি দল, কমিনিউস্টদের সাথেও হাত মিলিয়ে কাজ করছে নেহেরু তথা কংগ্রেসের স্বৈরাচার, অগনতান্ত্রিক সিদ্ধান্তকে রোখার জন্য। হিরেন মুখার্জি, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় সহ অনেক কমিনিউস্ট নেতাই তার গুনমুগ্ধ ছিল। কি কি ব্যাপারে তিনি নেহেরুর বিরোধিতা করেছেন ?
- ৩৭০ , যা ভারতে কাশ্মীরকে স্পেশাল স্ট্যাটাস দেয়।
- ইউনিফর্ম সিভিল কোড
-আরো বেশী বাকস্বাধীনতার দাবী
- রাজ্যের হাতে আরো বেশী ক্ষমতা
সহযোগিতাও করেছেন নেহেরুকে। জমিদারি বিলোপ আইনের ক্ষেত্রে। ১৯৫১ সালে জন সঙ্ঘের এম পি ৩ জন, এম এল এ ৩৫। তিনজনের দুজন বাংলার, একজন রাজস্থানের। এম এল এর মধ্যে ৭ জন বাংলার , ৬ জন রাজস্থানের। কিন্ত রাজস্থান লবির সবাই জমিদার বংশের । তারা বললো, তারা কেন নিজেদের বিরুদ্ধে ভোট দেবে। শ্যমাপ্রসাদ বল্লেন দিতে হবে, কারন সেটাই আমাদের ম্যানিফেস্টো। রাজস্থান লবিকে বহিস্কার করেন তিনি। ক্ষমতার জন্য আপোশ করেন নি।লালকৃষ আদাবানী, পার্টিমিটিং অনেক বার এই গল্পটা শুনিয়েছেন দাবী করার জন্য বিজেপি্র ক্যাডারদের নিয়মনিষ্ঠ হতে হবে।
কিন্ত বাংলার বুকে যে বিজেপি শুরু হল, সেই পার্টি পশ্চিম বাংলা থেকে উঠে গেল কি করে ?
হ্যা, আজকের যে বিজেপি, তার শুরু হয়েছিল বাংলার মাটিতেই। ১৯৫১ সালের ইলেকশনে জনসঙ্ঘের এম পি, এম এল এদের অধিকাংশই পশ্চিম বাংলার। কিন্ত তারা উঠে গেল।
সেই গল্প অন্যদিন। জন সঙ্ঘ গঠনের সময়, আর এস এসের সাহায্য নিলেন শ্যামাপ্রসাদ। গুরু গোলাওয়াকার এবং শ্যমাপ্রসাদ দুজনেই হিন্দুত্ববাদি রাজনীতি করলেও, শ্যামাপ্রসাদের রাজনীতি ছিল অনেক প্রগতিশীল। শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুর পর আর এস এস বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ, জনসঙ্ঘের রাজনীতি সম্পূর্ন ভাবে নিজেদের হাতে আনে। যা এখনো চলছে। শ্যামাপ্রসাদের রাজনীতি গোরক্ষার রাজনীতি, দাঙ্গা বাঁধানোর রাজনীতি ছিল না। দাঙ্গার বিরুদ্ধে দাঙ্গার রাজনীতি, সামরিক শিক্ষা -এই মার্শাল বা মারেঙ্গা টাইপের হিন্দু রাজনীতির প্রবক্তা আর এস এস। হিন্দু মহাসভা ছিল শ্রেফ দাবী আদায়ের রাজনীতি। আর এস এসের প্রতিষ্ঠাতা গুরু কেশব বলরাম হেডগেওয়ার ডাক্তারী পড়তে কোলকাতায় আসেন। এসে অনুশীলন সমিতিতে যোগ দেন। অস্ত্র শিক্ষা স্বদেশী শিক্ষা পেলেন। পুনেতে গিয়ে বৃটিশ বিরোধি কার্যকলাপ করতে গিতে জেল খাটলেন। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তার মোহভঙ্গ হয়। ভারতের ইতিহাসে যারা সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাসী ছিলেন, বৃটিশদের জেল খাটার পর, তারা হয় কমিনিউস্ট আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন, না হলে আর এস এসে। কেন? কারন গুরু হেডগেওয়ার দেখলেন এই ভারতীয়দের দিয়ে রাজনীতি হবে না। এটা হাঁটতেই শেখে নি, দুর্বল শরীর, দৌঁড়াবে কি? ফলে হিন্দুদের অস্ত্র শিক্ষায় শিক্ষিত করার দীক্ষা নেন। সেই সুযোগ হাতে আসে গান্ধীর ভ্রান্ত খিলাফত আন্দোলনের ফলে। যার জন্য দক্ষিন ভারতে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা শুরু হয়। নাগপুরে প্রথম দাঙ্গায় হিন্দুরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। দুবছর বাদে আর এস এস পালটা দাঙ্গা বাধায় নিজেদের শক্তি প্রদর্শনের জন্য। এবার নাগপুরের অনেক মুসলমান শহর ছাড়তে বাধ্য হয়।
আর এস এসের ইতিহাস নিয়ে অন্যকোন স্থানে লিখব। কিন্ত যেটা লিখতে চাইছি, সেটা হচ্ছে এই যে আজকের যে বিজেপি, সেটা আর এস এসের, গুরু হেডগেওয়ারের রাজনৈতিক সন্তান। এটা শ্যামাপ্রসাদের রাজনৈতিক আদর্শ না। সুতরাং আজকের বিজেপিকে দেখে শ্যামাপ্রসাদকে মুল্যায়ন করা ভুল হবে।
(৬) আমি হিন্দুত্ববাদ এবং বামপন্থী, দুই ধরনের রাজনীতিরই বিরোধি। আমার কাছে বাম ও রাম এক মুদ্রার দুই পিঠ। মুদ্রাটা হচ্ছে “ভিক্টিমাইজেশনের গল্প ফেঁদে” রাজনীতি। হিন্দুত্ববাদের রাজনীতির ভিত্তি “হিন্দুরা ঐতিহাসিক ভাবে মুসলমানদের হাতে নির্যাতিত”। বাম রাজনীতির ভিত্তি কৃষক শ্রমিক ধনী শ্রেনীর হাতে নির্যাতিত। আপনি বলবেন, এই দুই গ্রান্ড ন্যারেটিভই ত ঠিক। কিন্ত এই ধরনের ভিক্টিমাইজেশনের রাজনীতিই পৃথিবীতে হিটলার, লেনিন, স্টালিনদের মতন দানবদের জন্ম দিয়েছে। সুতরাং সেই পথ কাম্য না। কারন গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের আড়ালে সত্য , জ্ঞান, কর্ম সবই চাপা যায়। আমি আগেও লিখেছি, সেই রাজনীতিই সফল হয় যা জ্ঞান, বুদ্ধি, বোধ এবং “ফ্যাক্ট” ভিত্তিক। সব থেকে বড় কথা এটা জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তির যুগ। একমাত্র প্রযুক্তির মাধ্যমেই দেশের , সমাজের ব্যক্তির উন্নতি সম্ভব। সুতরাং শিক্ষা ও প্রযুক্তি ভিত্তিক ব্যবসা করার সুযোগ, এটাই হওয়া উচিত এই যুগের রাজনীতি। কিন্ত ভোট সর্বস্ব রাজনীতি হিন্দু মুসলমানের পরিচয়টাই আগে এনে দিচ্ছে। এটাই আজকের দিনের লিব্যারাল রাজনীতির ব্যর্থতা। কারন ভোটের জন্য, প্রতিটা রাজনৈতিক দলের নেতাদের মাথা সাম্প্রদায়িক নেতাদের কাছে বিক্রিত।