Saturday, January 27, 2018

আলাউদ্দিন খিলজি, নায়ক না ভিলেন

ভারতের ধারাবাহিক ইতিহাস পাঁচ হাজার বছরের।  খুব স্বাভাবিক ভাবেই ভারতে ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা কম-ওটা আমেরিকা/জার্মানী  এখন চীনে দের হাতে।  অনর্থক  মারামারি ইতিহাসের দখল নিয়ে। বিশেষত যদি তা ভারতের ইসলামিক ইতিহাস হয় তাহলে বহু তর্কে বহু বিতর্কে তা ঘেঁটে ঘ। 

এই অধ্যায়ের নতুন সংযোজন আলাউদ্দিন খিলজী। পদ্মাবৎ সিনেমার ভিলেন চরিত্র। সারাদিন সর্বত্র তর্ক বিতর্ক-সুলতান খিলজী কি খল নায়ক?  নাকি, মোঙ্গল আক্রমন সফল ভাবে প্রতিরোধ করে তিনি নায়ক? এই নিয়ে অনেক লেখাই দেখলাম। সবই সংক্ষিপ্ত নোট। তাই দিয়ে আলাউদ্দিন চরিত্রের নির্মোহ বিশ্লেষন সম্ভব না।

 ভারতে মুসলিম শাসনের ইতিহাসে আলাউদ্দিন খিলজি নিঃসন্দেহে পিভটাল চরিত্র।  কারন তিনিই প্রথম বিন্ধ্যপর্বতের দক্ষিনে ইসলামিক শাসনকে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হোন। তার আগে দিল্লী সুলতানেদের দখলে ছিল ছোট একটা সাম্রাজ্য-যা বাংলার থেকেও ছোট।


 হিন্দু কৃষকদের  ওপর তিনি ৫০% ট্যাক্স চাপান- সেটাই চলে এসেছে বহুদিন পর্যন্ত-বৃটিশ আমল অব্দি।  ধর্মপাল, দেবপাল, হর্ষবর্ধনদের পরে ভারতে দীর্ঘ তিন শতাব্দি তেমন কোন শক্তিশালী সাম্রাজ্য আসে নি। অসংখ্য ছোট ছোট রাজ্যে ভাগ বিভক্ত তখন ভারত। কিন্ত বাণিজ্য কৃষিজ উৎপাদন কমে নি। তন্ত্র মন্ত্র ভ্রান্ত ধর্মের অনাচারে ক্ষত্রিয় শক্তি ক্ষীনমান। সেই পটভূমিতেই উদ্ভব আলাউদ্দিনের। যার মিলিটারী স্ট্রাটেজি এবং ট্যাক্সের স্টিম রোলারের সামনে অসংখ্য সমৃদ্ধ হিন্দু রাজ্য, দরিদ্র দুর্ভীক্ষ পীড়িত রাজ্যে পরিণত হয়।

 আলাউদ্দিনের কাকা এবং শশুর  জালাউদ্দিন খিলজী নৃশংস ছিলেন না। নারী সুরাতেই কাটত তার দিন।  কিন্ত তারা জামাতা  আলাউদ্দিন খিলজীর মতন নৃশংস শাসক ভারত না কখনো দেখেছে এর আগে, না দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারত এমন  নরাধাম শাসক সম্ভব। তবে তার নৃশংস নিষ্ঠুর চরিত্রের উৎস- তাদের উপজাতিক ঐতিহ্য, ইসলাম না। ইতিহাসের নানান দলিল ঘাঁটলে এটাই পরিস্কার আলাউদ্দিনের ছিলেন গর্বিত মামলুক উপজাতির লোক ( যদিও তার জন্ম বাংলার বীরভূমে) -বিশ্বাস করতেন সেই পাহাড়ি ঐতিহ্যে-যেখানে অন্য সর্দারকে যুদ্ধ হারিতে তাদের নারী সন্তান গাভীর দখল নেওয়াটাই গর্বিত ঐতিহ্য।  মনে রাখতে হবে এই মধ্য এশিয়ার ট্রাইবগুলো মোটেও  ওইসব সতী সাবিত্রী নারী, বিয়ের পবিত্র বন্ধনে বিশ্বাস করে না। তাদের কাছে ক্ষমতা যার নারী তার-নারী কোন পুরুষের না, শাসকের।

 আলাউদ্দিন-মিলিটারী জেনারেল ঃ

 আলাউদ্দিন চরিত্র বুঝতে হলে, বুঝতে হবে মিলিটারি জেনারেল হিসাবে তার উচ্চাশাকে। উনি আলেক্সান্ডারের ন্যায় বিজয়ী হতে চেয়েছিলেন-ফলে পদবী নেন  সিকান্দার সানি, দ্বিতীয় আলেক্সান্ডার। কল্পনা করতেন তার লেগাসি হবে আলেক্সান্ডার বা চেঙ্গিস খানের মতন। সেটা করতে গিয়ে তিনি মিলিটারির আমূল সংস্কার করেন।  তার আগে ভারতে বা কোথাও স্থায়ী সেনা বাহিনী ছিল না। তিনিই প্রথম সম্পূর্ন বেতনভোগী সেনা বাহিনী তৈরী করেন ভারতে। আসলে সামন্তরাজা বা ভেসেল স্টেট গুলির উপর তার বিশ্বাস ছিল না। কারন তার শশুর এবং কাকা জালাউদ্দিন খিলজিকে সরাতে, এই সব সামন্ত শক্তিকে ঘুঁশ দিয়েই কাজ হাঁসিল করেন আলাউদ্দিন। ফলে একবার যখন ক্ষমতা সম্পূর্ন হাতে পেলেন, রাজদরবারের সমস্ত মালিকদের ডানা ছাঁটাই করেন।  যারা জালালুদ্দিনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তার দিকে যোগ দিয়েছিল গোপনে, তাদের খুন করেন।  তার উদ্দেশই ছিল ক্ষমতার দ্বিতীয় কেন্দ্র যেন তৈরী না হয়! মুশকিল হল, তার স্থায়ী মিলিটারির খরচ চালাতে গিয়ে ৫০% ট্যাক্স ধার্য্য করেছিলেন আলাউদ্দিন। যার ফলে কৃষিকাজই উঠে যাবার উপক্রম হয়। তার আমলে ভারতে অর্থনীতিতে ধ্বস নামে। কৃষি, বাণিজ্য ধ্বংস হয়। সুতরাং তিনি মোঙ্গল আক্রমণ আটকেছেন-এটা কোন গৌরবের কথা না। কারন মোঙ্গলরা ভারতে যা ধ্বংসলীলা চালাত, তার থেকেও বেশী ধ্বংসলীলা তিনি নিজে চালিয়েছেন ভুল অর্থনৈতিক নীতি নিয়ে।

 সাম্প্রদায়িক আলাউদ্দিন?

 এবার আসা যাক সব থেকে বিতর্কিত প্রশ্নে। আলাউদ্দিন কি সাম্প্রদায়িক ছিলেন? হিন্দুদের প্রতি বৈষম্যমুলক আচারন করেছেন?

 এটা অস্বীকার করার যায়গা নেই, গুজরাট, উত্তরপ্রদেশ এবং রাজস্থানের অধিকাংশ হিন্দু কৃষক আলাউদ্দিনের আমলে চূড়ান্ত দারিদ্রের সম্মুখীন হয়। উত্তরের মোঙ্গল আক্রমন ঠেকানোর জন্য, জমির ওপরে ৫০% কর ধার্য্য হল। এর সাথে জিজিয়া সহ অন্যান্য বিধর্মী কর ত ছিলই। অনাদায়ের শাস্তি ছিল রাষ্ট্র  কৃষক এবং তার সমস্ত পরিবারকে দাস হিসাবে বিক্রি করে দেবে। ফলে আলাউদ্দিনের শাসনের মাত্র দশ বছরের মধ্যেই তার রাজ্যে অর্ধেকের বেশী দাসে পরিনত হয়। এদের সবাই ছিল হিন্দু কৃষক। এদের গৃহিনীরা মুসলমান মালিক ( রাজকর্মচারী) দের যৌনদাসীতে পরিণত হয় কর দিতে না পারায়। এই সব যৌনদাসীদেরই বলা হত লন্ডি-যা  হিন্দিতে গালি হিসাবে এখনো চালু।

 মনে রাখতে হবে আলাউদ্দিনের নির্দেশ ছিল পরিস্কার। হিন্দুদের এমন দারিদ্রের মধ্যে ফেল যেন তাদের ঘোড়া কেনার পয়সাও না থাকে-যাতে কোন ভাবেই সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার দুঃসাহস না দেখায় কেউ।

  কিন্ত এটা কি সাম্প্রদায়িক না স্ট্রাটেজিক সিদ্ধান্ত?  আলাউদ্দিন ধর্মপ্রান মুসলমান ছিলেন না। মামলুকরা কেইই ধর্মপ্রান মুসলমান না। প্রচন্ড মদ্যপায়ী ছিল ।  তারা ইসলামের চেয়ে তাদের পাহাড়ি সংস্কৃতিতেই বিশ্বাস করতেন বেশী। আলাউদ্দিন জীবনে দুবার নিজের ধর্ম প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন। এই ব্যপারে তার অনুপ্রেরণা ছিল চেঙ্গিস খান।

 এটা আরো পরিস্কার হবে উত্তর বনাম দক্ষিনের হিন্দু রাজাদের জন্য তার স্ট্রাটেজি ছিল আলাদা।  গুজরাটের ভাগেলা, রাজস্থানের রনথন্মর চিতোর ইত্যাদি রাজ্য নিজে জিতে তছনচ করেছেন, ওই সব রাজ্যের রানী সহ সব মহিলাদের হারেমে ঢুকিয়েছেন। শুধু চিতোর অভিযানেই ৩০ হাজার হিন্দু হত্যা করেন।  কিন্ত দক্ষিন ভারতে দেবগিরি ওরাঙ্গাল কাকাটিয়া হোসালা -ইত্যাদি রাজাদের পরাজিত করে তাদের করদ রাজ্যে পরিণত করেছেন। তাদের সাথে  বন্ধুত্ব স্থাপন করেন।   তাদের ধ্বংশ করেন নি কেন?

 এখানেই আমরা বিচক্ষণ আলাউদ্দিনকে দেখতে পাব।  ১৩০৩ সালের আগস্ট মাসে মোঙ্গলরা তার আমলে চতুর্থবারের মতন  দিল্লী আক্রমণ  করে। এর আগে তিনবার তিনি মোঙ্গলদের মেরে ভাগিয়েছেন। ১৩০৩ সালের আগস্ট মাসে মোঙ্গলরা দিল্লী ধ্বংশ করে। ৫০,০০০ নিরীহ স্ত্রী পুরুষ খুন করে মোঙ্গলরা। যদিও এবারো মোঙ্গলদের মেরে তাড়িয়েছিলেন আলাউদ্দিন-তদ্দিনে দিল্লীর যা ক্ষতি হওয়ার হয়েই গেছে।

 আসলে সেবার ওরাঙ্গাল অভিযানে ছিলেন আলাউদ্দিন। যখন তার কাছে খবর এল মোঙ্গলরা আসছে-উনি সেনা নিয়ে দিল্লীর দিকে আবার এগোলেন। কিন্ত তখন দক্ষিন থেকে দিল্লী আসতে দু-সপ্তাহ সময় লাগত।  দিল্লীতে সেনা নিয়ে পৌঁছানোর আগেই দিল্লী ধ্বংশ করে মোঙ্গলরা। এর থেকেই আলাউদ্দিন বোঝেন দক্ষিনে লুঠ করা যায়, কিন্ত সেখানে সেনা রেখে শাসন করতে গেলে মোঙ্গল আক্রমন ঠেকানো যাবে না। ফলে দক্ষিনের হিন্দু শাসকদের প্রতি বন্ধুত্বের নীতি নেন আলাউদ্দিন, যেখানে উত্তরের হিন্দু শাসকদের মেরে ধরে তাড়িয়েছেন। পুরো রাজবংশকে ধরে ধরে হারেমে ঢুকিয়েছেন।

 এবার আসা যাক হিন্দু রানীদের হারেমে ঢোকানো নিয়ে তার লেজেন্ডারী কেচ্ছা।  প্রথমেই আসবে কমলা দেবীর কথা। কমলা দেবী ছিলেন ভাগেলা রাজা কর্নের সুন্দরী স্ত্রী।  কমলা দেবী আসলে ছিলেন কর্নের মন্ত্রী মাধবের স্ত্রী।    তবে হ্যা, রাজা কর্নও কমলা দেবীকে ছিনিয়ে নেন তার মন্ত্রী মাধবের কাছ থেকে।  মাধব পালিয়ে যান আলাউদ্দিনের কাছে এবং তাকে রাজা কর্নকে আক্রমণ করার জন্য উস্কাতে থাকেন। ১২৯৯ সালে আলাউদ্দিনের সেনাপতি উগা খান কর্নকে পরাস্ত করে কমলা দেবীকে বন্দী করে আলাউদ্দিনের হাতে তুলে দেন।   দেবগিরির রাজা রামচন্দ্র অবশ্য তার কন্যা জাত্যপালিকে আলাউদ্দিনের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হোন সন্ধির শর্ত হিসাবে।  মধ্যযুগে এসব চলত- এর মধ্যে হিন্দু মুসলমান খোঁজা হাস্যকর। উদাহরন চান? আমির খশরু, আলাউদ্দিনের জীবনীকার লিখছেন কমলাদেবী আসলেই রাজা কর্নকে ঘৃনা করতেন কারন, রাজা কর্ন তার স্বামীর কাছ থেকে তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করেন। ফলে কমলাদেবী আলাউদ্দিনের হারেমে থেকে কর্নের ছিন্ন মস্তক দাবী করেছিলেন। কিন্ত কর্ন গোটা ভারতে পালিয়ে বেঁচেছিলেন।

   আলাউদ্দিন অতীব নিষ্ঠুর ছিলেন-কিন্ত সেই যুগে যেখানে সুলতানের বিরুদ্ধে প্রতিদিন অজস্র ষঢ়যন্ত্র বিদ্রোহ হত, নিষ্ঠুরতা ছাড়া কোন শাসকে টেকার কোন চান্স ছিল না। উনি একদিনে ৩০,০০০ মোঙ্গল মেরেছেন, যারা দিল্লীতে নতুন বাসা বেঁধেছিল থাকার জন্য। এরা সবাই ছিল মুসলমান। শুধু মাত্র সন্দেহের বশে এতজনকে খুন করেছিলেন আলাউদ্দিন। নিজেরা কাকা এবং শশুর জালাউদ্দিনকে মুন্ডু কেটে নিজের শালার কাছে পাঠিয়েছিলেন ভয় দেখাতে।  আরেক শালা ছিল মুলতানের শাসক- জালাউদ্দিনকে হত্যার পরে, তার চোখ উপড়ে, নিজের শাশুড়িকাছে তার কাটা মাথা পাঠান। কারন তার এই শাশুড়ি এবং জালাউদ্দিনের বিধবা স্ত্রী খুব জ্বালিয়েছিলেন আলাউদ্দিনকে। যেখানে নিজের শশুর, শালা, শাশুড়িদেরই নৃশংস ভাবে খুন করেছেন আলাউদ্দিন -সেখানে হিন্দু প্রজাদের প্রতি প্রেম দেখাবেন, এতটা ভাবাই পাগলামো।

 আলাউদ্দিন যা কিছু করেছেন, তা ভারতীয় সভ্যতার দৃষ্টিতে নৃশংস, বর্বরতা। কিন্ত আলাউদ্দিনের উৎস,  মধ্য এশিয়ার আদিবাসীদের কাছে আলাউদ্দিনের নৃশংসতাটাই স্বাভাবিক আচরন। মধ্য এশিয়ার এই সব আদিবাসিদের মধ্যে জোর যার মুলুক তার, নারীও তার।  আলাউদ্দিনকে খুঁজতে গেলে সেই মামলুকদের সংস্কৃতিতেই  তাকে খুঁজতে হবে। এর মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে আসা আহাম্মকি।

 আজকে ভারতের ইতিহাস নিয়ে হিন্দুত্ববাদি বনাম সেকুলারবাদিদের লড়াই কেন?  কংগ্রেস যখন ক্ষমতায় ছিল, মুসলমান শাসকদের নৃশংসতার ইতিহাস চেপে দেওয়া হয়েছে। সেটার দরকার ছিল না। কারন সেই নৃশংসতার পেছনে ছিল তাদের মধ্য এশিয়ার সংস্কৃতি, রাজনীতি। ইসলামের ভূমিকা সেখানে নগন্য । ফলে আজকে সেই ভ্যাকুয়ামের দখল নিচ্ছে হিন্দুত্ববাদি রাজনীতিবিদরা। এই জন্যে ইতিহাসে স্পেডকে স্পেড বলাই ভাল।









No comments: