আমাদের আগের জেনারেশনটা- মানে আমাদের মা-মাসি, কাকিমাদের গ্যাং উত্তম-সুচিত্রা, উত্তম সুপ্রিয়ার জন্য পাগল। সেই নব্বই দশকে, হ্যাফপ্যান্ট পড়া টিনেজে দূরদর্শনের মাধ্যমে যখন একের পর এক সুপ্রিয়ার সিনেমা গুলো দেখানো হত, মোহমুগ্ধের মতন আমরা তাকে দেখতাম। সুচিত্রার গ্ল্যামার নেই, সেই ষাটের দশকের সিনেমাগুলোতে চড়া মেকাপ ও নিতেন না। কিন্তু তার কমলাক্ষি চোখের বানের হিরন্ময় নীরবতায় শুধুমাত্র নায়কদেরই বিঁধতেন না- তীর হয়ে তা হৃদয়ে ঢুকত আমাদের মতন উঠতি সদ্য গোঁফ গজানো কিশোরদের ও। মেকাপহীন নেক্সট ডোর গার্ল - পাশের বাড়ির সুপ্রীয়া। আশেপাশে সমস্ত মেয়েদের ভীরেই তাকে দেখেছি কখনো!
এর মধ্যেই ক্লাস নাইনে, দূরদর্শনে দেখানো হল ঋত্বিক রেট্রোস্পেক্টিভ। ঋত্বিকের বারোটা সিনেমা নিয়ে। সেই প্রথম পরিচয় মেঘে ঢাকা তারা নীতার সাথে। আসলে উত্তরায়ান বা দুই মনের সুপ্রিয়ার প্রেমে মজা যায়, কিন্ত নীতার চরিত্রটা পশ্চিম বাংলার এক দীর্ঘশ্বাসের ইতিহাস। ওপার বাংলা থেকে উঠে আসা চিন্নমূল পরিবারগুলো কি অভাবে কি যন্ত্রনায় কাটিয়েছে পঞ্চাশ আর ষাটের দশক- সেই দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজ কলোনিতে বড় হয়ে ওঠা বাঙাল ফ্যামিলিগুলোর দুই দেওয়ালে কান রাখলেই শুনতে পাবেন। তার ভাল দিক ও ছিল। অভাবের তাড়নায় মধ্যবিত্ত রক্ষণশীল ফ্যামিলিগুলো বাধ্য হল মেয়েদের অফিস আদালতে কাজ করা মেনে নিতে। তখন অনেক উদবাস্তু ফ্যামিলিতে মেয়েরাই প্রিন্সিপ্যাল ব্রেইড আর্নার। তাদের আয়েই চলে বড় সংসার। তাদের নিজস্ব প্রেম ভালোবাশা আহ্লাদ কিছুই থাকতে নেই-তারা শুধুই সেই সংসারের কূর্ম অবতার।
নায়িকা যতটা নিজের, তার থেকে বেশী ডিরেক্টরের ও। নীতার প্রতিটা ফাইন টেক, ঋত্বিকের আঁকা। সুপ্রিয়া সেখানে যন্ত্রী, ঋত্বিক যন্ত্র। সুপ্রিয়ার ইন্টারভিউতেই শুনেছিলাম, কতটা চোখে জল আনতে হবে, কোন আঙ্গলে আনতে হবে, কিভাবে মুখ ঝটকা দিতে হবে, কতক্ষন তাকাতে হবে, তার সেকেন্ড বাই সেকেন্ড প্ল্যানিং ঋত্বিক তাকে দিতেন। সুপ্রিয়া দশ মিনিট মনে মনে অনেকগুলো অপশন ভেবে, যেটা নিজের ভাল মনে হত, সেটাই করতেন। আসলে রিটেকের পয়সা ছিল না ঋত্বিকের।
ভাবাই যায় না, কোমল গান্ধারের মতন ছবি করার জন্য কোন পরিচালক পাচ্ছিলেন না ঋত্বিক। মাঝা সাঝে একজন এসে কিছু টাকা দেন, শুটিং চলে দুই-পাঁচদিন, তারপরে আবার বন্ধ। কখন টাকা পাবেন তার ঠিক নেই, সুতরাং সুপ্রিয়ার মতন ব্যস্ত অভিনেত্রীকে ডেট দেবেন কি করে ঋত্বিক? সেসবের বালাই ছিল না। কোমল গান্ধারের দুদিনের শুটিং করার টাকা জুটলেই পরের দিন সকালে সোজা সুপ্রিয়ার কাছে হাজির হোতেন ঋত্বিক। সে তিনি শুটিং এর জন্য যেখানেই থাকুন না কেন। শরীর খারাপের অজুহাত দিয়ে ঋত্বিকের সাথে হাওয়া হয়ে যেতেন সুপ্রীয়া। এই ভাবে অনেক কষ্ট দারিদ্রের মধ্যে বানানো ছবি কোমল গান্ধার-অথচ গোটা ছবিটাই ভীষন পজিটিভ। ভাবুন কাল শুটিং করার পয়সা নেই-অথচ কোমলগান্ধারের নাটকের দল পিকনিক মুডে কোরাস গাইছে। কে বলবে মাঝা মাঝে হাতে যা টাকা পেতেন, তাই দিয়ে কোমল গান্ধার বানিয়েছিলেন ঋত্বিক-আর অন্য প্রযোজকদের শুটিং এর ক্ষতি করে, নিজের দুর্নাম হবে জেনেও শুধু ঋত্বিকের জন্যই সব কিছু করতে রাজী ছিলেন সুপ্রিয়া!
উত্তম সুপ্রিয়ার সিনেমাগুলো ষাটের দশক থেকে আশির দশক প্রায় ৭৮ সাল পর্যন্ত ন্যস্ত। একটা অদ্ভত ক্রনোলজি দেখি। সিনেমাগুলোকে তাদের রিলিজ সাল ধরে দেখতে থাকুন। দেখবেন আস্তে আস্তে চড়া হয়েছে সুপ্রিয়ার মেক-আপ, সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে উত্তমের ভুঁড়ি। সন্ন্যাসী রাজার উত্তম-সুপ্রিয়ার সাথে শুন বরনারীর উত্তম-সুপ্রিয়ার একযুগের তফাৎ। তবে হ্যা, বয়সের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সুপ্রিয়ার গ্ল্যামার-আর সেখানে উত্তম কুমার ক্রমশ বেঢপ টাইপের একটা ফিগার নিয়ে সিনেমা করেছেন শেষ বয়সে।
No comments:
Post a Comment