এই সপ্তাহটা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঘনঘটা। রবিবার ফ্লোরিডাকে দুরমুশ করবে ক্যাটেগরী-৫ হারিকেন ইরমা। এখন সে কিউবার উত্তরে। ফ্লোরিডার প্রায় সব বাসিন্দারাই থাকে এর নয়নাভিরাম সৈকত শহরগুলিতে। সেখান থেকে সবাইকে আপাতত সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। প্রায় এক কোটি লোক, নিজের বাড়িঘর ছেরে অন্যত্র-দেখছেন রবিবার দুপুরে ইরমা তাদের বাড়ির আস্ত রাখবে কি না।
শুধু ইরমা না। ইরমার উত্তর দিকে আরেকটা ক্যাটেগরী-৪ হারিকেন এগোচ্ছে- হারিকেন হোসে। সেটাও ক্যাটেগরী ফাইভ হয়ে পূর্ব উপকূলে ঝাঁপাতে পারে আগামী সপ্তাহের বুধ বৃহস্পতি নাগাদ।
আটলান্টিকের ক্যারিবিয়ান সমুদ্রে দুটী হারিকেনের একত্রে উদ্ভব- বিরল ঘটনা। হয়ত গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর জন্য, এটাই এখন বারে বারে ঘটবে। আরো বেশী ঝড়, বৃষ্টি। এবং ধ্বংসলীলা বা মানুষের বিরুদ্ধে প্রকৃতির প্রতিশোধ।
সেপ্টেম্বার মাসটাকে আমেরিকাতে বলে হ্যারিকেন সিজন। এই সময়টাতে ক্যারিবিয়ান সমুদ্রে অনেক সাইক্লোন তৈরী হয়-এর মধ্যে গুটিকয়েক আস্তে আস্তে উষ্ণবাস্প সংগ্রহ করে আরো বেশী গতিবেগে হারিকেন হয়ে ঝাঁপিয়ে পরে মূলত আমেরিকার দক্ষিনপূর্ব উপকূলে।
আমেরিকান হারিকেনের সাথে প্রথম সাক্ষাত ২০০২ সালে। সেপ্টেম্বের এর ঠিক এই সময়টাতেই সেবার পূর্ব উপকূল তছনচ করেছিল হারিকেন গুস্তাভ। তবে নর্থ ক্যারোলিনা থেকে সে যখন নিউ জার্সিতে পৌঁছায়, তখন সে দুর্বল ক্যাটেগরী ওয়ান হারিকেন। তাতেই গাছের ডাল ভেঙে এমন অবস্থা, রাস্তা ঘাট অনেক জায়গায় আটকে যায়। দুদিন বাড়িতে কারেন্ট ছিল না। আর আমেরিকাতে পাওয়ার না থাকলে কি বিভৎস অবস্থা হয়, সেই অভিজ্ঞতাও প্রথম। ফ্রিজ থেকে মাছ মাংস ফেলে দিতে হয়েছিল।
দ্বিতীয় এবং সর্বাধিক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা ২০১২ সালে, মেরীল্যান্ডে। হারিকেন স্যান্ডি সেবার ক্যাটেগরী-৩ হারিকেন। সাইক্লোনের চোখ আমার বাড়ি থেকে ১৫০ মাইল দূরে আটলান্টিক মহাসাগরে-কিন্ত তাতেই গাছের ডালের অজস্র আঘাতে বাড়ির ছাদ এবং দেওয়ালের প্রচুর ক্ষতি হয় সেবার। ছয়দিন থাকতে হয়েছে পাওয়ার ছাড়া-কারন, লাইন ছিন্নভিন্ন। অবস্থা এতই খারাপ ছিল, পাওয়ার লাইন মেরামতের জন্য, গোটা আমেরিকার অন্যান্য পাওয়ার কোম্পানী ৫০,০০০ লোক পাঠায় বাল্টিমোর পাওয়ারকে। এই ঘটনায় বাল্টিমোর পাওয়ার ইলেক্ট্রিক কোম্পানীর এত দুর্নাম হয়-ওরা এর পরের থেকে সব ট্রান্সমিশণ পাওয়ার লাইন, আন্ডার গ্রাউন্ড বানানো শুরু করে।
এই সপ্তাহে আরো তিনটে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটেছে বা ঘটার ইঙ্গিত আছে।
ইয়োলোস্টোন ন্যাশানাল পার্কে ঘন ঘন ভূমিকম্পের আভাস মিলেছে। ইয়োলোস্টোন ন্যাশানাল পার্ক বসে আছে এক সুপার ভলকানোর ওপরে-যার পাঁচ মাইল নীচে আছে নিউয়ার্ক সিটির তিনগুন বড় জ্বলন্ত লাভা চেম্বার। প্রতি ৬৪০,০০০ বছর বাদে একবার করে হয়েছে সুপার ভলকানিক ইরাপশন। সেই পিরিয়ড অনেকদিন হল পেরিয়েছে, বিজ্ঞানীরা জানেন একটি বড় সুপার ভলকানিক ইরাপশন এখন অপেক্ষা মাত্র। তবে তা এখনই হবে না আরো হাজার হাজার বছর অপেক্ষা করতে হবে, তা জানা নেই। সুপার ভলকানিক ইরাপশন , এক্সটিংশন লেভেল ইভেন্ট। ভলকানিক ইরাপশন থেকে আরাই ট্রিলিয়ান টন ছাই এবং গ্যাস বেরোবে। দশ বছর গোটা পৃথিবীর আকাশ ঘিরে থাকবে ছাই। ফসলের উৎপাদন ধ্বংস হবার ফলে প্রায় পৃথিবীর প্রায় ৯০% লোক অনাহারে থাকবে, ধ্বংস হবে আমেরিকার ৯৫% শহর জনপদ। তবে আশার কথা বিজ্ঞানীরা বলছেন এই ভূমিকম্পের ফলে ম্যাগমা চেম্বারের পরিবর্তন এখনো তারা দেখছেন না। যদি এই ভূমিকম্পের ফলে ম্যাগমা চেম্বার একটুও নড়ে, গোটা পৃথিবীর স্টক মার্কেটে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠবে।
কাল মেক্সিকোতে বিরাট ভূমিকম্প হয়েছে, প্রশান্ত মহাসাগর বরাবর। কিন্ত জনবহূল এলাকাতে না হওয়াতে ক্ষয় ক্ষতি কম।
গত বুধবার পৃথিবীর দিকে ধেয়ে এসেছে, এই দশকের সব থেকে শক্তিশালী সৌড়ঝড়। সূর্য্যের করোনার একটি বড়সর বিস্ফোরন থেকে তৈরী এই প্লাজমা ঝড় পৃথিবীর রেডিও কমিনিউকেশন স্তব্ধ করেছে প্রায় এক ঘন্টা।
যেটা দেখা যাচ্ছে গ্লোবাল ওয়ার্মিং ই হোক বা লুমিং সুপার ভলকানিক ইরাপশন -অনেক কারনেই মানুষের ভবিষ্যতের সামনে প্রশ্ন চিহ্ন। এগুলোর সমাধান ট্রিলিয়ান ডলারের রিসার্চ এবং প্রযুক্তি দাবি করে। যেমন নাসা, একটি ওপেন প্রোজেক্ট দিয়েছে এবার-কি করে ইয়োলোস্টোনের লাভাকে আস্তে আস্তে ডিফিউজ করা যায়। বর্তমানে তাত্ত্বিক সমাধান-যখন দেখা যাবে প্রাক্টিক্যাল কিছু সম্ভব-হয়ত মেগা প্রোজেক্টে হাত দেবে সরকার। কিন্ত ইয়োলোস্টোনের তলায় শুয়ে থাকা টাইম বোম্বকে ডিফিউজ করতে না পারলে, গোটা পৃথিবীর সভ্যতা ধ্বংশ হতে পারে যেকোন সময়।
অন্যদিকে গ্লোবাল ওয়ার্মিং কমানোর জন্য বাতাসের কার্বন ডাই ওক্সাইড কি করে রক বা পাথরে শুষে নেওইয়া যায় তার জন্যেও আবিস্কৃত হচ্ছে অনেক প্রযুক্তি।
মুশকিল হচ্ছে এখনো এই সব গবেষনাতে শুধুই সরকারি ফান্ড। অথচ এখানেই দরকার সব থেকে বেশী টাকা না হলে মানুষ বলে এই প্রজাতিটাই পটল তুলবে। সেটা না করে সব দেশেই সব থেকে বেশী টাকা যায় মিলিটারীর পেছনে। মিলিটারি প্রযুক্তির পেছনে।
আমি বহুদিন আগে লিখেছিলাম, মানব সভ্যতার সামনে ইয়োলোস্টোনের মতন ক্রাইসিস থাকা ভাল। কারন সেক্ষেত্রে সবাই যুদ্ধাস্ত্রের পেছনে খরচ কমিয়ে, একত্রে মানব সভ্যতাকে বাঁচানোর জন্য গবেষনায় টাকা ঢালবে। তাতে এই তেলের জন্য যুদ্ধ, জিহাদি, জঙ্গিবাদ ইত্যাদি কমবে। ক্রাইসিসের সামনে শ্রেফ বাঁচার জন্য মানুষ জাতীয়তাবাদি, সাম্রাজ্যবাদি, ধর্মবাদি এজেন্ডাগুলোকে পেছনে রেখে, আন্তর্জাতিক হবে-কারন এই ধরনের বিরাট বৈজ্ঞানিক সমাধানের জন্য পৃথিবীর প্রতিটা বিজ্ঞানী এবং প্রযুক্তিবিদকে দরকার।
আমাদের উদবৃত্ত পুঁজি( ট্যাক্স ডলার) যদি ধ্বংসের যজ্ঞের ( যুদ্ধ) ঘি হিসাবে না ব্যবহৃত হয়, তাহলে সেই টাকায় এই সব প্রাকৃতিক বিপর্যয় আটকানোর জন্য প্রযুক্তির উদ্ভাবন সম্ভব।
আমাদের রাজনীতি এবং সভ্যতা-দুটোই প্রশ্নবিদ্ধ। শুধুই এই কারনে যে কি করে একটি উন্নত প্রজাতি নিজেদের বাঁচানোর জন্য গবেষনা না করে, নিজেদের মৃত্যু সাধনার গবেষনায় টাকা ঢালে?
No comments:
Post a Comment