Friday, September 22, 2017

প্রযুক্তি এবং ইতিহাস-১

স্কুল লেভেল থেকেই ইতিহাস ভাষ্যের ( ন্যারেটিভ) দখল নেওয়ার কাজটা সব পার্টিই করে। কারন ভবিষ্যতের ক্যাডার তৈরীর জন্য, ওটা প্রথমে দরকার। রাজনৈতিক পার্টির অন্ধ সাপোর্টার বেস তৈরী করার ওটাই প্রথম ধাপ। আর সেই কারনে পৃথিবীর সব দেশেই ইতিহাসের ভাষ্য ভীষন ভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রানদিত। অর্থাৎ ইতিহাসের গল্পে হিরো-ভিলেন থাকে-এবং তাদের নির্মান করা হয় গল্পের মাধ্যমে । প্রয়োজন মাফিক। যদিও আমি যেটুকু ইতিহাস ঘাঁটি, তাতে এটাই আমার কাছে পরিস্কার হয়, ইতিহাসের আসল গল্পের হিরো কিন্ত কারিগড়রা। প্রযুক্তিবিদরা।

এই লেখাটাই বেশ কিছু ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ করব- যেখানে ইতিহাসের গল্পটা, রাজনৈতিক প্রয়োজনে অন্যভাবে আমাদের জানানো হয়েছে ছোটবেলা থেকে।


ধরুন পলাশীর যুদ্ধ। মিরজাফর বিশ্বাসঘাতক, ক্লাইভ ভিলেন, সিরাজ ট্রাজিক হিরো। এটাই ভারতের ইতিহাসের মেইনস্ট্রিম ন্যারেটিভ। এবার ব্যপারটাকে একটু অন্যভাবে দেখি।

২৩শে জুন ১৭৫৭, রাত একটার সময়, ক্লাইভ, তার সেনাপতি মেজর কিলপ্যাট্রিক, মেজর কোটে এবং মেজর গ্রান্ট পলাশীর আম্রকুঞ্জে আশ্রয় নেন। সাথে মেরে কেটে ৩০০০ সেনা। কোন ঘোরসওয়ার ( ক্যাভেলারী) নেই। মোটে ৮ টা কামান, তার মধ্যে দুটো হাউতজার ( যা উচ্চ উচ্চতায় ছুড়ে অনেক দূরে গোলা ফেলা যায়)। কামানগুলোও ছোট ছোট-গোলার ওজন মোটে ছ পাউন্ড বা তিন কিলো। যেখানে নবাবের কামান ৫৩ টি-গোলার ওজন ১৮, ২৪ এবং ৩২ পাউন্ড। বিশাল বড় বড় কামান। প্রতিটা কামান টানতেই লাগত ত্রিশ থেকে চল্লিশটা মোষের গাড়ি।

২২ শে জুন থেকেই পলাশীর প্রান্তরে ক্যাম্প করে আছে নবাবী সেনা। তাদের যুদ্ধ করার ইচ্ছা বিশেষ নেই। কারন তাদের মাইনে হয় নি। ১৯ শে জুন মুর্শিদাবাদ থেকে অনেকেই আসতে চাই নি। শেষে প্রচুর বোনাস দিয়েই তাদের আনতে হয়। সিরাজের মিসম্যানেজমেন্ট আরো সুবিধা করে দেয় মিরজাফরের চক্রান্ত-কারন সেনারাই যখন যুদ্ধে ইচ্ছুক না- মিরজাফরের চক্রান্তের বিরুদ্ধে তার সেনারা দেশপ্রেমের কারনে বিদ্রোহ করবে, তার লেশমাত্র নেই।

নবাবের বাহিনী বিশাল। মিরজাফরের কম্যান্ডেই আছে ১৪ হাজার ঘোড়াসওয়ার ৩৮ হাজার পদাদিক । মীর মদন মোহনলালের কমান্ডে আছে ৬ হাজার ঘোরসওয়ার, সাত হাজার পদাদিক। ৫৩ টি কামানের গোলন্দাজ বাহিনী আলাদা। এর সাথে ফরাসী গোলন্দাজ মসিয়ে ফ্রেজের আছে পঞ্চাশ জন গোলন্দাজ এবং ৬ টি কামান। মোদ্দা কথা মীরজাফরের সেনারা কিছু না করলেও মীর মদনের হাতে যে সেনা, ঘোড়া এবং কামান আছে-তাই দিয়েই জেতা উচিত।

এদিকে ক্লাইভ আছেন দোটানায়। মীর জাফর কি করবেন বলা যাচ্ছে না। কোন ঘাটের জল খাচ্ছেন বা খাবেন কেউ জানে না। দুদিন আগে মীর জাফরের প্রাসাদ ঘিরে তাকে বন্দী করেন সিরাজ। কারন তার কাছে খবর ছিল, মীর জাফর বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেন। মীর জাফর কোরান স্পর্ষ করে প্রতিজ্ঞা করেছেন সিরাজের কাছে, বিশ্বাসঘাতকতা তিনি করবেন না। সেই খবর পৌছে গেছে ক্লাইভের কাছে। মীর জাফর যদি ক্লাইভের দিকে যুদ্ধ না করেন, শ্রেফ মীর মদনের ছ হাজার ঘোর সওয়ারই কচুকাটা করে দেবে তাদের।

সকাল আটটায় যুদ্ধ শুরু হয়। ফরাসী গোলন্দাজরা এবং নবাবের গোলন্দাজরা আগুয়ান ক্লাইভ বাহিনীর দিকে গোলা ছুড়তে থাকে। আধ ঘন্টায় ক্লাইভের প্রায় পঞ্চাশ জন মারা যায়। বেগতিক বুঝে ক্লাইভ পিছিয়ে এসে আম বাগানে লুকালেন। এতে নবাবের গোলার থেকে বেঁচে গেল কোম্পানীর সেনারা। সিরাজ ইনফ্যান্ট্রি ( পদাদিক ) পাঠালেন হাজার দশেক। কিন্ত এবার ক্লাইভের গোলন্দাজরা এবং বন্দুকবাজরা গুলি গোলা চালিয়ে তিন ঘন্টা আটকে রাখল তাদের। নবাবের প্রায় শ দুয়েক পদাদিক ঘায়েল-কিন্ত বৃটিশ ক্যাম্পে কেউ ঢুকতে পারল না।

মাত্র আটটা কামান দিয়ে কি করে এত বড় ইনফ্রান্ট্রি আটকানো সম্ভব-তার কারন ও উন্নত বৃটিশ প্রযুক্তি। কোম্পানীর সেনাদের কাছে ছিল ক্যানিস্টার শেল বা গ্রেপ শট। অর্থাৎ এই গোলা গুলির মধ্যে থাকে ছোট ছোট লোহার বল। যখন ফাটে -তখন এক সাথে ডজনে ডজনে গুলির মতন চারিদিকে ছড়িয়ে যায়। এই ক্যানিস্টার শেলের জোরেই হুগলিতে নবাবের চল্লিশ হাজার সেনাকে আটকে দিয়েছিল মাত্র হাজার খানেক কোম্পানীর সিপাই আর দুটো কামান। যার জেরে সিরাজ দৌল্লা আলিনগরের সন্ধি করতে বাধ্য হোন।

সকাল এগারোটার সময় পলাশীর যুদ্ধের আসল ঘটনা ঘটে। মুশল ধারে বৃষ্টি নামে। নবাবের কামান ঢাকার কোন ব্যবস্থা নেই। কোম্পানীর লোকেরা তখন ত্রিপলের ( ট্রিপলিন ) ব্যবহার জানে কারন তা বৃটেনেই সদ্য আবিস্কৃত। ট্রারপলিন কথাটা এসেছে তার কারন প্রথম ত্রিপল যখন আবিস্কার হয়, তখন কাপড়ের ওপরে টার লাগিতে তা তৈরী হত। তখনো প্লাস্টিক আবিস্কার হয় নি। টারই ছিল বৃষ্টিনিরোধক। বৃষ্টির সময় নবাবের সব গোলা যখন ভিজে অকেজো-কোম্পানীর গোলাগুলি বা কামানের কিছু হল না। তা ছিল ত্রিপল দিয়ে ঢাকা। মুশকিল হচ্ছে, কোম্পানীর সেনাদের কাছে যে ত্রিপল দিয়ে ঢাকার মতন প্রযুক্তি আছে -সেই খবরটাও পর্যন্ত পৌছায় নি নবাবের ক্যাম্পে। যার ফলে ভুল সিদ্ধান্ত নেবেন মীরমদন ।

এদিকে বৃষ্টি যখন মুশলধারে, ক্লাইভ তার জেনারেলদের ডাকলেন। জিজ্ঞেস করছেন এই বৃষ্টির মধ্যে পালাই না এই ভাবেই চলুক? কারন মিরজাফর তখন ও দাঁড়িয়ে। ক্লাইভের দিকে তার সাহায্য না আসলে কচুকাটা করবে নবাব বাহিনী। সবাই গঙ্গা দিয়ে পালানোর দিকেই রায় দিলেন। ক্লাইভের সাথে আছে ২০০ বড় নৌকা। কাজটা কঠিন না। মীরজাফর কথা না রাখলে, পালাতে হবে-সেটা জেনে, দুশো নৌকাকে খুব কাছেই বেঁধে রেখেছেন ক্লাইভ। মেজর প্যাট্রিক বেঁকে বসলেন। প্যাট্রিক বল্লেন, বৃষ্টিতে ওদের কামান অকেজো হবে। ফলে ওরা পালাবে। ক্লাইভ সহ সবার মনে ধরল যুক্তিটা। দেখাই যাক। যদি নবাবের কামান অকেজো হয়ে থাকে বৃষ্টিতে তাহলে জয় নিশ্চিত।

বৃষ্টি থামে বেলা একটা নাগাদ। মীর মদন ভাবলেন এটাই সুযোগ ঘোড়া ছুটিয়ে কোম্পানীর সেনাদের কচুকাটা করার । কারন মীর মদন ভেবেছিলেন যেহেতু ক্লাইভের কামানগুলো নেতিয়ে গেছে জলে ভিজে, ক্যাভেলারি চার্জ আটকানোর ক্ষমতা নেই ক্লাইভের। একমাত্র ক্যানিস্টার চার্জের ভয়েই যুদ্ধের প্রথম তিন ঘন্টা কোন ক্যাভেলারি চার্জ করেন নি মীরমদন।

মীর মদনের ভুল সিদ্ধান্তে মাত্র কয়েক মিনিটেই যুদ্ধের ভাগ্য গেল ঘুরে। মীর মদন প্রায় দুহাজার ঘোড়সওয়ার নিয়ে কোম্পানীর কামান গুলোর দিকে ছুটে গেলেন। কিন্ত উনি জানতেন না ওগুলো কাজ করছে। ফলে শীঘ্রই কামানের ক্যানিস্টার শটে মীরমদন সহ সমগ্র ঘোরসওয়ার বাহিনীই আহত হয়।

মীর মদনকে আহত অবস্থায় দেখে সিরাজ মীর জাফরের কাছে টুপি খুলে অনুরোধ করলেন বৃটিশ দের আক্রমন করতে। মীরজাফর একদিকে সিরাজকে আসস্ত করলেন, অন্যদিকে ক্লাইভের কাছে খবর পাঠালেন সিরাজের দিক -যা ছিল রাইট ফ্ল্যাংক, আক্রমণ করতে।

ততক্ষনে ক্লাইভ বুঝে গেছেন নবাব পক্ষের একটাও কামান কাজ করছে না। ফলে মীর জাফর কি করবে সেই আশায় বসে থেকে লাভ নেই। ক্লাইভের সেনারা মিরজাফরের সেনাদের ও আক্রমণ করে। এমন অবস্থায় বেলা দুটোর সময় সিরাজ দু হাজার ঘোরসওয়ার সহ পালিয়ে যান মুর্শিদাবাদে।

এই সময় কিন্ত মীর জাফর সহ নবাবের সব সেনারাই যুদ্ধে নেমে গেছে। তারা গাদা বন্দুক হাতে আম গাছে আড়াল থেকে গুলি ছুঁড়েছে। কিন্ত তাই দিয়ে ক্যানিস্টার শেলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জেতা সম্ভব না। একেতে যুদ্ধ করার তাগিদ এমনিতেই তাদের কম যেহেতু মাইনে নিয়ে অসন্তোষ আগে থেকে ছিলই। ওই সব দেশপ্রেম বলে তাদের কিছু ছিল না। তাদের কাছে নবাব ও বিদেশী, ক্লাইভ ও বিদেশী। ফলে নবাবের সেনারা আস্তে আস্তে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে পালিয়ে যায়। বেলা পাঁচটার মধ্যেই ক্লাইভের জয় নিশ্চিত হয়ে যায়।

রাতের বেলায় মীরজাফর চিঠি পাঠান ক্লাইভকে যে তিনি দেখা করতে চান। ২৩শে জুন সকালে ক্লাইভ মিরজাফরের সাথে দেখা করেন এবং নির্দেশ দেন মুর্শিদাবাদে দ্রুত ফিরে সিরাজকে হত্যা করতে, যাতে সিরাজ তার ধণরত্ন নিয়ে না পালাতে পারে।

কিন্ত এরকম ইতিহাস লিখলে ভারতীয়দের মধ্যে দেশত্মবোধ জাগবে কি করে? ফলে ভারতের জাতিয়তাবাদের উত্থানের সময় মীরমদনের লড়াইকে দেখানো হল বীররসে

নবীন চন্দ্র সেন লিখলেন - ( কবিতা-পলাশীর যুদ্ধ )
" 
অকস্মাত্‍‌ একেবারে শতেক কামান 
করিল অনলবৃষ্টি 
ভীষণ সংহার দৃষ্টি। 
কত শ্বেত যোদ্ধা তাহে হল তিরোধান। "

 
মুশকিল হচ্ছে, শত কামান না, বৃটিশদের ছিল মোটে আটটি কামান। খুব পরিস্কারভাবেই নবীন সেন, এমন ভাবে লিখেছেন যেন ক্লাইভের ছিল প্রচুর সেনা এবং কামান-তার বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে দেশপ্রেমী নবাবের সৈন্যরা। না তেমন কিছু হয় নি। মুষ্টিমেয় কিছু কোম্পানী সৈন্যর সামনে, পালানোর প্রথম সুযোগেই নবাবের সেনারা পালিয়েছিল। এবং মিরজাফর যুদ্ধে নামলেও সিরাজ হারতেন ই। কারন সেই প্রযুক্তি। নবাবের সমর প্রযুক্তি ছিল নেহাতই আদ্যিকালের। বৃষ্টিতে কামান ঢাকার মতন নুন্যতম প্রযুক্তিও তাদের হাতে ছিল না।

ইতিহাসের এই নব মুল্যায়ন এই জন্যে গুরুত্বপূর্ন, ভারতীয় সমাজে বর্ণবাদের জন্য কারিগড়দের সমাজে উচ্চস্থান দেওয়া হয় নি। যতসব আটভাট গুলমারা ধর্মীয় দর্শন যারা কপচাতে পারে, ভারতীয় সমাজে উচ্চস্থান তাদের। মুসলমানরা আসাতে ভারতের বর্ণবাদ ত কমেই নি, বরং মুসলমান শাসকরাও ভারতের বর্ণবাদ টেকাতেই সচেষ্ট ছিলেন। কারিগড়, কৃষক বা উৎপাদকশক্তির যারা ধারক ও বাহক- তাদেরকে পায়ের নীচে রেখে, গুলবাজ দার্শনিকদের মাথায় বসানো ভারতে ট্রাডিশনে পরিণত। পশ্চিম বঙ্গের বাম শাসনকাল ও একই দোষে দুষ্ট। অনুৎপাদক বাম বুদ্ধিজীবিদের উৎপাদক শ্রেনীর মাথায় বসিয়ে বাঙালী জাতির সর্বনাশ করা হয়েছে । এবং এই সব সর্বনাশের শুরু হয় সেই সব ন্যারেটিভ থেকে যেখানে ইতিহাসে বা মানব সভ্যতায় কারিগড়ি বিদ্যার গুরুত্ব অগ্রাহ্য করে কখনো বাম, কখনো ডান চশমায় ইতিহাসকে দেখানো হয়।

পরে কিস্তিতে আরেকটা গল্প লিখছি।













No comments: