Thursday, January 21, 2016

দলিত রাজনীতি এবং বর্ণবাদের উপকথা

http://biplabbangla.blogspot.com/2016/01/blog-post_21.html
(১)
  রোহিত ভেমুলার মৃত্যুতে ভারতের জাতপাতের রাজনীতি উত্তাল । আরো খোলসা করে লিখলে, ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে গেছে সব রাজনৈতিক পার্টি।

     প্রশ্ন হচ্ছে ভারতের এই দলিত শ্রেনীটির উৎপত্তি কোথায় ?  ব্রাহ্মণ্যবাদ, ব্যাদে আছে-অনেক কিছুই বলা যায়। কিন্ত এটাও সত্য পৃথিবীর সব দেশের ইতিহাসেই দলিতরা ছিল-এখনো আছে। খোদ আমেরিকাতেই কালোদের স্থান, ভারতের দলিতদের মতন। শুদ্রদের অস্তিত্বের কারন মনুবাদি হিন্দুধর্ম-এমন মনে করাটা সরলীকরন। কারন এই দাসশ্রেনীর অস্তিত্ব ইতিহাস জুরে পৃথিবীর সকল দেশে । শুধু ভারতেই এটার ওপর ধর্মীয় সীলমোহর মারা আছে।  সুতরাং এই বর্ণবাদের একটা সঠিক ঐতিহাসিক নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষন দরকার। কেন কোন দেশে দলিত বা বর্ণবাদের জন্ম হয়?

       পৃথিবীর প্রাচীন তিনটি সভ্যতা-ইজিপ্ট, মেসোপটেমিয়া এবং সিন্ধু সভ্যতা। এই তিনটি সমাজে দাসেরা এল কি করে? মানুষ যখন প্যালিওলিথিক স্টেজে, বনেবাদারে ঘুরছে-সেই হান্টার গ্যাদারার সমাজে ত দাসেরা ছিল না। দাসেদের উৎপত্তি হল কৃষিকাজ শুরুর সাথে সাথে?

  সত্যিই কি তাই ? কৃষিভিত্তিক সমাজ শুরু হতেই কি সভ্যতাতে মানুষ "ক্রীতদাস" দের দেখলো?

   এটা বুঝতে প্রথমেই এই তিন অতীত নদী সভ্যতা-যা উন্নতির চরম শিখরে উঠেছিল-তাদের দিকে তাকাতে হবে।

  সিন্ধু সভ্যতাতে দুটো জিনিসের সন্ধান পাওয়া যায় নি। এক, অস্ত্র। দুই দাস প্রথা। পাশাপাশি রাজা বা রাজপ্রাসাদের ও সন্ধান পান নি প্রত্নতাত্ত্বিকরা।

    মিশরের প্রাচীন সভ্যতা-তিন ভাগে বিভক্ত। ওল্ড, মিডল এবং নিউ কিংডম।  বিখ্যাত পিরামিডের জন্ম এই ওল্ড কিংডমে ( খৃঃ পূ ২৬৮৬-২১৮১)।   পিরামিড করতে হাজারে হাজারে শ্রমিক লেগেছে-কিন্ত তাদের কেউ ক্রীতদাস ছিল না। এই সময়ে মিশরে ক্রীতদাসের নজির নেই। তবে ৮০% লোক ছিল ভূমিদাস। কিন্ত মিডল কিংডমের ( খৃঃ ২০৫৫-১৬৫০) সময় থেকে ফারাওরা নুবিয়া, কানান এবং সিরিয়া আক্রমন এবং আধিপত্য বিস্তার শুরু করেন।  এই সময় থেকেই মিশরীয় সভ্যতাতে ক্রীতদাসের দেখা পাওয়া যাবে-যুদ্ধে পরাজিত জাতির লোকেদের ক্রীতদাস হিসাবে রেখে দেওয়া হত। এছাড়াও ধার শোধ করতে না পারলে, লোকে ক্রীতদাস হতে বাধ্য হত-তবে সারা জন্মের মতন না। ধার শোধ করতে যদ্দিন থাকতে হয়।

   কিন্ত নিউ কিংডমে মিশরে ক্রীতদাস ব্যবসার রমরমা শুরু।  ফারাও তৃতীয় টিসমোস অসংখ্য ক্রীতদাসের মালিক ছিলেন-যা উনি মূলত হাইতি এবং ন্যুবিয়ানদের  যুদ্ধে হারিয়ে পেয়েছিলেন।

  মোদ্দা কথা, মিশর সাম্রাজ্য যেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির রূপ নেওয়া শুরু করে-বাণিজ্যের শুরু হয়-ঠিক সেই সময় থেকেই ক্রীতদাস বা আজন্ম দাসবৃত্তির ধারনা মিশরীয় সভ্যতায় আসতে শুরু করে।
 শুধু কৃষিভিত্তিক সমাজে ক্রীতদাস আসে না। যখন সেই সমাজ আস্তে আস্তে সাম্রাজ্যবাদি হয় বা সাম্রাজ্যবাদি শক্তির পদানত হয়-ঠিক তখনই সভ্যতার মধ্যে ক্রীতদাসের জন্ম। এটা আরো পরিস্কার হয় মেসোপটেমিয়ার ইতিহাস থেকে।

      ইনফ্যাক্ট ভারতে  যখন হরপ্পা মহেঞ্জোদারোতে ক্রীতদাসহীন, শ্রেনীহীন কৃষিসমাজ চলছে-সমসাময়িক ( খ্মৃঃপূ ২৩০০) মেসোপটেমিয়ার উরু, আকাদ এবং মারী শহরে ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মন, বৈশ্য, শূদ্র -এই চারটি শ্রেণীর পরিস্কার অবস্থান।  তার সাথে ছিল ক্রীতদাস, তবে বৈশ্য আর শুদ্র শ্রেনীকে আকাডেমিয়ান সম্রাজ্যে বলত আপার আর লোয়ার কাস্ট।

    (২)
 তাহলে ভারতে বর্নবাদ এলো কোথা থেকে?  সিন্ধু সভ্যতায় বর্ণবাদ ছিল না-এটা নিয়ে কোন দ্বিমত নেই। কিন্ত ওই সময়,  মেসোপটেমিয়াতে একদম বর্তমান ভারতের বর্নবাদ চালু ছিল। সেটাও বহুল প্রমানিত।  তাহলে কি কোন সন্দেহের অবকাশ থাকে এই বর্ণবাদ ভারতের বাইরে থেকেই এসেছে?

  বর্তমানের হিন্দুত্ববাদিরা মানতে চান না আর্য্য সভ্যতা -যা ঋকবেদ নিয়ে ভারতে ঢুকলো-তারা ভারতের বাইরের ! ঋকবেদে ত চারটে শ্রেনীর পরিস্কার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে-যা সিন্ধু সভ্যতায় নেই।  যদি হিন্দুত্ববাদি ঐতিহাসিকদের কথা সত্য হয় যে আর্য্যরা বা ঋকবেদ ভারতের বাইরে থেকে আসে নি -তাহলে ঋকবেদের সমসাময়িক সময়ে ( ৩০০০-১৫০০ খৃঃপূ )  ভারতে কেন বর্নবাদের সাপেক্ষে কোন প্রত্নতাত্বিক উদাহরন নেই -যেখানে ঋকবেদে বর্নবাদের উল্লেখ আছে প্রায় সর্বত্র?

  স্যার উইলিয়াম জোন্স এরিয়ান ইনভেশন তত্ত্বের জনক। সংস্কৃত শিখতে গিয়ে উনিই প্রথম লক্ষ্য করেন ঋকবেদের আদি সংস্কৃতের ভাষার সাথে ল্যাটিনের অসংখ্য মিল। ইনফ্যাক্ট ইটালীয়ান শিখতে গিয়ে, আমিও অবাক হয়েছিলাম ল্যাটিনের সাথে সংস্কৃতের এত অজস্র মিল আছে দেখে। এর পরে এই নিয়ে ঐতিহাসিকদের অজস্র কাজ আছে- প্রোটো ইন্ডো ইরানিয়ান সংস্কৃতির সাথে মেলে এমন দুটি মধ্য এশিয়ার সভ্যতাও আবিস্কৃত [  সিন্থাস্থা এবং আন্দ্রনোভো কালচার] । আর্য্যরা যে বহিরাগত সংস্কৃতি-তার অজস্র আধুনিক ইতিহাস উইকিপেডিয়াতেই পাওয়া যাবে ( https://en.wikipedia.org/wiki/Indo-Aryan_migration_theory ) ।

 তবে হিন্দুত্ববাদিদের আশা ভরসাতে শেষ পেরেক  ঠুকেছে জেনেটিক্স রিসার্চ। দেখা যাচ্ছে ভারতের ব্রাহ্মনদের সাথে ইউরোপিয়ান ওয়াই জিনের মিল খুব সাংঘাতিক রকমের বেশী। শুদ্রদের সাথে কিন্ত সেই মিল নেই!  হার্ভাডের মাইকেল উইজেল এই ব্যপারে কাজ করেছেন-যাতে দেখা যাচ্ছে ভারতীয়দের দুটী জেনেটিক গ্রুপ স্পষ্ট।  একটি ভারতীয় এবোরিজিনাল-অন্যটি ককেশিয়ান বা মধ্য এশিয়ান অরিজিন। এই আর্টীকলে সব ডিটেলেসে পাবেন ( http://www.livescience.com/38751-genetic-study-reveals-caste-system-origins.html )।  আরো দুটি আর্টিকল দেখে নিতে পারেন আর্য্য এবং বর্নবাদি সিস্টেমের উৎস কিভাবে জেনেটিক্স রিসার্চের মাধ্যমে জানা হয়েছে

   ক) Time Magazine :http://world.time.com/2013/08/27/what-dna-testing-reveals-about-indias-caste-system/

   খ)  Link of the original paper : http://www.cell.com/AJHG/abstract/S0002-9297%2813%2900324-8

  " Most Indian groups descend from a mixture of two genetically divergent populations: Ancestral North Indians (ANI) related to Central Asians, Middle Easterners, Caucasians, and Europeans; and Ancestral South Indians (ASI) not closely related to groups outside the subcontinent. The date of mixture is unknown but has implications for understanding Indian history. We report genome-wide data from 73 groups from the Indian subcontinent and analyze linkage disequilibrium to estimate ANI-ASI mixture dates ranging from about 1,900 to 4,200 years ago. In a subset of groups, 100% of the mixture is consistent with having occurred during this period. These results show that India experienced a demographic transformation several thousand years ago, from a region in which major population mixture was common to one in which mixture even between closely related groups became rare because of a shift to endogamy."

 অবশ্য ভারতে হিন্দুত্ববাদিরা অতীতে প্লেইন এট্মবোম ইত্যাদি ছিল বলেও বিশ্বাস করেন! যাদের ঘিলুর দৌঁড় ক্লাস ফোরের বেশী না-তাদের এত কিছু মাথায় ঢুকবে বলে মনে হয় না।

 (৩)
 এবার ইতিহাস থেকে আসি বর্তমানে। বলা হচ্ছে আই আই টি গুলোতে নাকি সিডিউলড কাস্টের ওপর অনেক অত্যাচার অবিচার হয়। তা হয়। সে নিজের চোখেই দেখেছি। কিন্ত তার কারন দলিত রাজনীতি। এই নয় যে আই আই টির অধিকাংশ ছেলেরা বর্ণবাদি। কোটা সিস্টেমের মাধ্যমে, দলিতদের প্রতি ঘৃণা তৈরী হয় অটোমেটিক্যালি।

 কারনটা লিখি। আই আই টিতে মুসলমান-হিন্দু জেনারেল কাস্টের মধ্যে ভাই ভাই সম্পর্ক। কিন্ত দলিতদের প্রতি উষ্মা । কেন ? কেন হবে না ? আপনি যদি দেখেন, আপনার বাবা একজন সাধারন চাকুরে-একটা ছেলে বহু খেটে কোন রকমে আই আই টিতে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে, আর পাশের ঘরে একটা ছেলে, এসসি কোটাতে কম্পুটার সায়েন্স পড়ছে-তার সাথে তার খাওয়া থাকা ফ্রি-এবং তার বাবা আই এ এস অফিসার। আপনার রাগ হবে না? রাগ না হওয়াটা কি অস্বাভাবিক?  এগুলোর জন্যেই আই আই টি ক্যাম্পাসে দলিতদের ওপরে  বাকীদের রাগ। যদি এই কোটা সিস্টেমে অর্থনৈতিক ক্রাইটেরিয়া থাকত যে গরীব দলিতের ছেলে মেয়েদের জন্য এই কোটা-আমি গ্যারান্টি দিয়ে লিখতে পারি, আই আই টি ক্যম্পাসে এমন এন্টি দলিত ফিলিংস থাকত না। কিন্ত যখন একজন ছেলে দেখছে, তার থেকে অনেক বড়লোকের ছেলে এস সি কোটাতে  বিনা পয়সায় পড়ছে, সে রাগতে বাধ্য। আই আই টিতে এস টি কোটাতে যেসব ছেলেরা আসে তারা খুব গরীব। কীন্তু দলিত কোটাতে আসা ছেলে মেয়েদের মধ্যে ৯০% বেশ বড়লোক ঘরের।

  এর মধ্যে দলিত ছাত্রদের মধ্যে একটা ক্ষুদ্র শ্রেনী আছে, যাদের চির জীবনের ধারনা, তারা এস সি বলে মার্কস পায় না। স্যারেরা ফেইল করিয়ে দিচ্ছে!!  তারা নির্যাতিত!  এদের সবাই প্রায় জীবনে ব্যর্থ হয়েছে।  আমরা দলিত, তাই ভিক্টিমাইজ - এই ভাবে সর্বত্র ভিক্টিমাইজেশন তত্ত্ব নিয়ে চললে, তাদের মেন্টাল ব্রেইক ডাউন হতেই পারে।  কিছু কিছু ক্ষেত্রে কিছু বর্ণবাদি প্রফেসর থাকেন-সেটাও সত্য। কিন্ত তারা ব্যতিক্রম। নিয়ম কখনোই না।

 এবার বলবেন মশাই আপনি দলিত না-দলিতদের ব্যথা কি বুঝবেন? আমি উত্তর দেব আপনি বুলশিট বকছেন। আমি উঁচু কাস্টের লোক নই-বরং দলিত না হলেও নীচু কাস্টেই আমার জন্ম।  কিন্ত তাতে কি? সমাজে কখনো কি কিছু ঘটেছে, যাতে আমার কাস্ট সামনে এসেছে?  আসল কাস্ট সামাজিক অবস্থান। আমার দাদু ছিল প্রাইমারী স্কুলের হেডমাস্টার, ঠাকুর্দা পাট ব্যবসায়ী। বাবা-মা দুজনেই হাইস্কুলের টিচার। সেই সামাজিক অবস্থানই আমার আসল কাস্ট।  স্কুল কলেজে একজন ব্রাহ্মন ও জেনারেল কোটাতে ঢুকেছে-আমিও জেনারেল কোটাতে ঢুকেছি -ফলে একজন ব্রাহ্মনের সাথে আমার কখনোই কোন দূরত্ব তৈরী হয় নি। কিন্ত এটাই হত-যদি কোটাতে ঢুকতাম। তাহলে এই এন্টি দলিত ফিলিংস জেনারেল  ছাত্রদের মধ্যে ঢোকানোর জন্য দায়ী কে? দলিত রাজনীতি। যারা অর্থনৈতিক বা সামাজিক ক্রাইরেটিয়া না রেখে কোটা সিস্টেম তৈরী করেছে।  একজন ধনী বা উচ্চশিক্ষিত এস সি ছেলে মেয়েদের জন্য কেন কোটা সিস্টেম থাকবে? তাতেত গরীব হরিজনদের পথই বন্ধ করা হচ্ছে!!!

  আমাদের প্রত্যন্ত নদী শহর করিমপুরে ব্রাহ্মন ছিল মাত্র কয়েকঘর। তিনটে পুরুত বামুন ফ্যামিলি ছিল। তারা এবং আমাদের ঝি রা -দুই পক্ষই থাকত শহরের ধারে কলোনীতে যেখানে গরীবেরা থাকে। ফলে আমিও ছোট বেলাতে ভাবতাম বামুনরা মানে  ঝি চাকরদের মতন গরীব শ্রেনী!

 এই সেন্স অব ভিক্টিমাইজেশনের আবহ তৈরী করাটা খুব বাজে-রাজনীতি। এবং তাতে আসলেই দলিত ছাত্রদের ও ধ্বংস করা হয়।

      আমার ছেলে এখানে ফুটবল খেলে। মাঠে বেশ রেশিয়াল স্লার এবং বুলিং হয়-মাঝে মাঝে আমার ছেলে এসে অভিযোগ করেছে আগে।  আমি ওকে কি বলবো ?  আমি পরিস্কার বলেছি-যারা এসব রেশিয়াল স্লারিং করে তারা অশিক্ষিত, অজ্ঞ। ইগনোর। তাদের প্রতি রাগলে, খেলায় ফোকাস নষ্ট হবে। আর ও যেহেতু গোলকীপার খেলে, বিরোধি টিমের উদ্দেশ্যই থাকে গোলকিপারের মনঃসংযোগ নষ্ট করা।  যদি বেশী করে, বা ফিজিক্যালি কিছু হয়-তার জন্যে রেফারি আছেই। আমি এটাও তাকে বলেছি-এগুলো জীবন এবং খেলার অংশ। লোকে ফোকাস নষ্ট করার চেষ্টা করবে-কিন্ত নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাকতে হবে সাফল্যের জন্য।  পৃথিবীর প্রায় সব মহান ব্যক্তিই অন্যায় অবিচার বুলিং এর শিকার হয়েছে ছাত্র বা পেশাদার জীবনে। কিন্ত তারা সেটা নিয়ে ওবসেসড হয়ে বসে থাকে নি। নিজেদের কাজটা ভাল ভাবে করে গেছে।


 ফেসবুকে কিছু লোকজন সেটাই দেখছি সারাদিন  দলিত ছাত্রদের জন্য সেন্স অভ ভিক্টিমাইজেশন ফিলিং তৈরী করছে। তাতে কি দলিত বিরোধিতা কমবে? কিছু কমবে না। দলিত বিরোধিতা কমাতে গেলে দলিত কোটাতে অর্থনৈতিক অবস্থানের ক্রাইটেরিয়া ঢোকাতেই হবে।










    

No comments: