ভারত এবং আমেরিকার গণতন্ত্র আর কদিন টিকবে?
৭ই জুলাই, ২০২২, বিপ্লব পাল
(১)
গণতন্ত্র এবং স্বৈরতন্ত্র- ডেমোক্রাসি বনাম ডিক্টেটরশিপ, এটা নিয়ে আমার বহুদিন ভুল ধারনা ছিল। আমি নিশ্চিত, আমার মতন আরো অনেকেই ভাবেন, ডেমোক্রাসি এবং ডিক্টেটরশিপ দুটো ১৮০ ডিগ্রি আলাদা পলিটিক্যাল সিস্টেম। ডেমোক্রাসিতে জনগনের মতে সরকার চলে। কারন নির্বাচন হয়। ডিক্টেটরশিপে, ডিক্টেটরের মর্জিতে।
ভুল। খুব ভুল রাজনৈতিক ধারনা এটা। আসল সত্য হচ্ছে এই --একটা সফল পলিটিক্যাল সিস্টেমে- তা গনতান্ত্রিক বা স্বৈরতান্ত্রিক যাইহোক না কেন- মানুষের অনেক কিছু স্বাধীনতা খর্ব করা হয় জনগণের নিরাপত্তা এবং রাষ্ট্রের সিস্টেম মসৃন ভাবে চালানোর জন্য। এবং মানুষকে কিছু লিমিটেড স্বাধীনতা দেওয়া হয়, উৎপাদনশীলতার বিকাশের জন্য। উৎপাদন, অর্থাৎ প্রোডাকশন বৃদ্ধির জন্য লাগে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-শিল্পে সৃজনশীলতা। প্রোডাকশন সাব সিস্টেমগুলির সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা। এখন প্রোডাকশন সাব সিস্টেম কি? সেটা ফ্যামিলি, মুদির দোকান, কারখানা ইত্যাদি।
রাজনৈতিক ( অর্থনৈতিক) বিজ্ঞানী ফ্রেড্রিক হায়েক প্রথম একটি থিসিস দেন ( যা খুব সমালোচিত ও বটে) -যদি কোন রাষ্ট্র মানুষের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা-অর্থাৎ মার্কেটের স্বাধীনতাকে মেনে নেয়, ব্যক্তিগত সম্পত্তির মৌলিক অধিকারকে মেনে নেয় -কিন্ত যদি রাজনৈতিক ভাবে স্বৈরতন্ত্রী হয়- অর্থাৎ যেখানে ভোট হয় না- মানুষের বাক স্বাধীনতা নেই- সেই স্বৈরতন্ত্রী রাষ্ট্র, গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রের থেকে আরো দ্রুত বিকাশ করবে। এবং জনগন যদ্দিন, ঠিকঠাক ভাবে খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসার নিরাপত্তা পাবে-গণতান্ত্রিক অধিকার গুলো নিয়ে কোন চিন্তা করবে না। হায়েক খুব সমালোচিত ছিলেন। কিন্ত চীনের অভূতপূর্ব সাফল্যে দেখা যাচ্ছে, হায়েক খুবই নির্ভুল এবং নির্মম ছিলেন তার বৈজ্ঞানিক বোদ্ধায়।
অর্থাৎ হায়েকের দৃষ্টিতে সব স্বৈরতন্ত্র এক না। কিউবা, ভেনেজুয়েলা এবং উত্তর কোরিয়ার স্বৈরতন্ত্রের সাথে দুবাই, রাশিয়া, বাংলাদেশ এবং চীনের স্বৈরতন্ত্রের পার্থক্য আছে। কিউবা, ভেনেজুয়েলা, উত্তর কোরিয়াতে ব্যবসা বানিজ্য মার্কেট স্বাধীন ভাবে চলে না। আর রাজনৈতিক অধিকার বলতে কিছু নেই।
অন্যদিকে দুবাই, বাংলাদেশ, চীন বা রাশিয়াতে রাজনৈতিক অধিকার শুন্য হলেও সরকার বানিজ্য এবং মার্কেটের স্বাধীনতা খর্ব করে নি । বরং এইসব স্বৈরতন্ত্রী সরকার প্রো বিজনেস। তারা বরং মার্কেটের বিকাশের পক্ষেই কাজ করেছে। ফলে এইসব দেশগুলি অর্থনৈতিক ভাবে অনেক ভাল অবস্থানে।
হায়েকের থিসিসে কিউবা, ভেনেজুয়েলা বা উত্তর কোরিয়ার পলিটিক্যাল সিস্টেম জনগণের দাবীদাওয়া পূরনে ব্যর্থ হবে ( যা সত্য বটে) এবং তা টিকবে না। তাসের ঘরের মতন একদিন না একদিন ভাংবেই। সাথে পাওনা রইবে সীমাহীন দুর্ভিক্ষ এবং দারিদ্র। জেনোসাইড।
অন্যদিকের স্বৈরতন্ত্র- যা মার্কেটের বিকাশের সহায়ক- মার্কেটের স্বাধীনতা, ব্যক্তি সম্পত্তির স্বাধীনতাকে খর্ব না করে, স্বৈরতন্ত্র চালাচ্ছে- সেইসব দেশগুলি গণতান্ত্রিক দেশগুলির থেকেও বেশী উন্নতি করবে। পাশের বাংলাদেশ, চীন উজ্জ্বল উদাহরন।
অর্থাৎ সব স্বৈরতন্ত্র এক না। সেটা রোমান থেকে সব সাম্রাজ্যেই ছিল। যেমন জুলিয়াস সিজার বা অগাস্টাস বা মার্কাস অরেলিয়াস-এরা প্রজাপালক সম্রাট ছিলেন। জুলিয়াস সিজার প্রথম রাষ্ট্রের টাকায় সব সিটিজেনদের খাদ্য, বস্ত্র এং চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। যা ওয়েলফেয়ার স্টেটের আদি উদাহরন। আবার টিবেরিয়াস, ক্যালিগুলা বা কমোডিয়াস-এদের আমলে এই পাবলিক রেশন সিস্টেম ভেঙ্গে যায়। ফলে সম্রাট জনপ্রিয়তা হারান। এবং এই সব স্বৈরাচারী সম্রাটরা প্রায় প্রত্যেকেই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে নিহত হোন। বিদুর মহাভারতে যুধিষ্টিরকে যে রাজনীতির পাঠ দিয়েছিলেন, তার নির্যাস হচ্ছে-কোন রাজাই স্বৈরাচারি শাসক হয়ে টিকতে পারে না। সেক্ষেত্রে প্রজাবিদ্রোহে, না হলে সেনা বিদ্রোহে, না হলে প্রাসাদ বিদ্রোহে তার উৎখাত হবেই।
সুতরাং স্বৈরতন্ত্রের ব্যাপারটা অতটা ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট না।
(২)
আবার গণতন্ত্র মানে তাতে স্বৈরতন্ত্র থাকবে না, সেটাও ভুল।
ভারতের সংবিধানে, নির্বাচিত সরকারকে স্বৈরাচারি হওয়ার অনেক ক্ষমতাই দেওয়া আছে। নইলে সেই সরকার , এডমিনিস্ট্রেশন চালাতেই পারবে না।
আমেরিকাতে বরং ক্ষমতার বিভাজন এত ব্যপক, এখানে কোন নির্বাচিত রাজনীতিবিদের স্বৈরাচারি হয়ে ওঠা প্রায় অসম্ভব। আসলে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিশ্বপ্রেসিডেন্ট-খোদ আমেরিকাতে তার কোন ক্ষমতাই নেই! শুধু কিছু বেয়াইনি ডিক্রি ইস্যু করা ছাড়া। সেগুলোও সুপ্রীম কোর্টে প্রায় ধাক্কা খায়।
কিন্ত ক্ষমতার এত বিভাজনের জন্য, আমেরিকাতে আসল ক্ষমতা ব্যবসায়ী গোষ্ঠিগুলোর হাতে। গণতন্ত্রের জন্য আমেরিকা এত শক্তিশালী হয় নি। আমেরিকা শক্তিশালী হয়েছে-এর মূল কারন দেশটা চালাচ্ছে ব্যবসায়ী গোষ্ঠিগুলো। অর্থাৎ পাওয়ার স্ট্রাকচার, ক্ষমতার পিরামিডের শীর্ষে বুদ্ধিমান লোকেরা আছে। ব্যবসা টু গণতন্ত্র সেটাই করে দিচ্ছে।
তাহলে আমি আমেরিকার স্বৈরতান্ত্রিক যাত্রানিয়ে ভাবছি কেন? যা গত ২৫০ বছরে সম্ভব হয় নি?
ওয়েল, এখানে চীনের দিকে তাকাতে হবে। একটা দেশ কতটা সফল হবে, তার অধিকাংশ নির্ভর করে পাওয়ার স্ট্রাকচার বা ক্ষমতা কাদের হাতে। কারা দেশ চালাচ্ছে। চীনের রাজনীতি চালাচ্ছে কমিনিউস্ট পার্টি- কিন্ত দেশটার এডমিনিস্ট্রেশন চালাচ্ছে সিনহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকনোক্রাটরা। সিনহুয়া পৃথিবীর শীর্ষবিশ্ববিদ্যালয়গুলির অন্যতম। ভারতের আই আই টির থেকে অনেক এগিয়ে। যারা চাইনিজ মিনিস্টার বা সেক্রেটারি-তাদের বায়োডেটা গুলো দেখবেন। তারা প্রত্যেকেই নিজেদের ফিল্ডে বিরাট কৃতবিদ্য। এদের রাজনীতি নিয়ে ভাবতে হয় না। এদের ভাবতে হয়, নিজেদের পজিশন টেকাতে এরা দেশকে নির্ধারিত কর্মসূচী দিতে পারছে কি না। অর্থাৎ চীনে, তাদের শ্রেষ্ঠ সন্তানরা, তাদের শ্রেষ্ঠ মেধাবী লোকগুলো সেই দেশ চালানোর সুযোগ পাচ্ছে। ভারতেও তাই। তবে তারা চৌর্য্যবৃত্তি এবং দুর্নীতিতে মেধাবী। দুর্নীতি অবশ্য চীনেও আছে।
এর উলটো দিকে আমেরিকার পাওয়ার স্টাকচার ব্যবসায়ী, আইনজীবি এবং এক্টিভিস্টদের খিচুরি। আমেরিকান সেক্ট্রেটারিরা ও কম্পিটেন্ট-কিন্ত তাদের হাত বাঁধা থাকে সেনেটের আইনজ্ঞদের কাছে! আর ভারত নিয়ে আমি আলোচনা করতে চাইছি না। কংগ্রেসের আমলে মনমোহন সিং এবং অন্যান্য টেকনোক্রাটদের আনা হয়েছে। বিজেপির আমলে এই চেষ্টাটা হয়েছে অনেক পরে। কিন্ত মুশকিল হচ্ছে এটা খুব আংশিক। এবং এদের ও অনেক হাত পা বাঁধা।
ফল হচ্ছে এই যে, ভারত জাতি ধর্ম দাঙ্গা ইনফ্লেশন নিয়ে হিমসিম খাচ্ছে। ইনফ্রাস্টাকচারে উন্নতি হচ্ছে না। আর আমেরিকা গর্ভপাতের গর্ভশ্রাব নিয়ে ব্যস্ত। উন্নত ইনফ্রাস্টাকচার ভেঙে পড়ছে। ইনফ্লেশন এখন লাগাম ছাড়া। আমেরিকার অনেক অংশ এখন তৃতীয় বিশ্বের সাথে তুলনীয়।
এর ফল হবে এই যে রাষ্ট্রের কাছে মানুষে যেগুলো নুন্যতম পাওনা, তা দিতে খুব শীঘ্রই ব্যর্থ হবে দুই দেশের গণতান্ত্রিক সরকার। ভারতে এটা কিছুটা গা সওয়া ব্যপার। আমেরিকাতে তা নয়। ফলে অলরেডি আগুন জ্বলছে।
রাষ্ট্রের সাথে জনগনের একটা স্যোশাল কনট্রাক্ট আছে। গণতন্ত্র যদি সেগুলো মেটাতে ব্যর্থ হয় -তা টেকার কথা না। ইতিহাস সাক্ষী। ইনফ্লেশনে লাগাম লাগাতে ব্যর্থ হলে সেই দিন হয়ত খুবই কাছে।
No comments:
Post a Comment