ভারত বনাম আমেরিকার সংবিধান- দুই গণতন্ত্রের ভাল খারাপের সংলাপ
- বিপ্লব পাল, ১/২৫/২০২১
(১)
সবাইকে প্রজাতন্ত দিবসের শুভেচ্ছা।
আমার অর্ধেক জীবন ভারতে, অর্ধেক আমেরিকাতে । দুটো দেশের গণতন্ত্র এবং রাজনীতিকে কাছ থেকে দেখছি। পলিটিক্যাল সিস্টেমের এবসোল্যুউট ভাল খারাপ বলে কিছু নেই। ভারতের গণতন্ত্রের কিছু ভাল জিনিস আমেরিকার শেখার আছে। আবার আমেরিকার সংবিধান থেকেও ভারতের গণতন্ত্রে কিছু নিলে, ভারতের বেশ কিছু রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হবে।
আমেরিকার রাজনৈতিক সমস্যা গুলির সমাধানে, ভারতের গণতন্ত্রের কিছু অভিজ্ঞতা বেশ কার্যকরী। আবার ভারতের রাজনৈতিক সমস্যায়, আমেরিকান সমাধান ফলপ্রদ হবে বলেই মনে করি।
এই লিস্টটা বিশাল লম্বা হতে পারে। তাই খুব সংক্ষেপে লিখি---
(১) শাসক গোষ্ঠির স্বৈরাচার -এটি ভারতের রাজনীতির অন্যতম সমস্যা। যেই যায় লঙ্কায় সেই হয়ে ওঠে অত্যাচারী রাবন। কেন? কারন অবশ্যই সংবিধানের সমস্যা। মুখমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী-যিনি চিফ এক্সিকিউটিভ তাদের হাতে, তাদের পার্টির হাতে পুলিশ থাকা উচিত না। পুলিশ থাকা উচিত বিচারবিভাগের হাতে। যেমন থাকে আমেরিকাতে। উল্লেখ্য স্বাধীন ভারতের একমাত্র পুলিশ কমিশন (১৯৭৮) , ঠিক একই সংস্কার চেয়েছিল। কিন্ত রাজনীতিবিদরা পুলিশ দিয়ে বিরোধী পেটানোর ক্ষমতা ছাড়বে কেন? ফলে জ্যোতি বসু, ইন্দিরা গান্ধী, বাজপেয়ীজি-কেউ এই সুবিধাটি হাতছাড়া করতে চান নি। এতেব ভারতে ক্ষমতায় সে রাজনৈতিক দলই যাক না কেন- তারা স্বৈরাচারী হবেই। এর সমাধান কিন্ত আমেরিকার সংবিধানেই পাওয়া যাবে।
(২) বিচ্ছিন্নতাবাদি শক্তি, রাজ্যগুলির স্বাধীন হওয়ার ইচ্ছা – এটি ভারত , আমেরিকা দুটি দেশের সমস্যা। ভারতের সংবিধান রাজ্যেকে স্বাধীন হওয়ার কোন স্কোপ দেয় না। আমেরিকাতে একটি রাজ্য ইউনিয়ান থেকে আলাদা হতে পারে-তবে তার দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া আছে । দেশের সেনেট ও হাউসে পাশ হতে হয়। ফলে সংবিধানে থাকলেও, এটি সম্ভব হয় না। তবে আমেরিকাতে যেহেতু একটি রাজনৈতিক পক্রিয়া আছে প্রথমেই সন্ত্রাসবাদের পথে না গিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদিরা রাজনৈতিক পথ নেয়। যেমন এখন উয়োমিঙটনের সেনেটে সেই রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদিরা প্রস্তাব আনবে । কিন্ত লাভ নেই। দেশের সেনেটে , কংগ্রেসে আটকাবে। কিন্ত এতে সন্ত্রাসবাদ কিছুটা কমে। তাছাড়া আমেরিকার রাজ্যগুলি ভারতের রাজ্যগুলি থেকে অনেক বেশী রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়ে স্বাধীন। ফলে বিচ্ছিন্নতাবাদ থাকলেও সন্ত্রাসবাদ কম আমেরিকাতে।
(৩) ভোট গ্রহন পদ্ধতি, প্রেসিডেন্টিয়াল ইলেকশন, সেনেট নির্বাচন , হাউস অব রিপ্রেসেন্টিটিভ নির্বাচন - ---
ভোট গ্রহন এবং ভোটের মাধ্যমে জনগনের ইচ্ছার প্রতিফলনে, ভারত আমেরিকার থেকে এগিয়ে। আপনি হয়ত অবাক হবেন-কিন্ত আমার এবং অনেকের অভিজ্ঞতা তাই। ভারতের রাজনীতিতে জনগনের কথা, জনগনের ইচ্ছা অনেক বেশী প্রতিফলিত।
এবারের আমেরিকার প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশনে যে কেলো হল এটা ভারতে সম্ভব না। কারন আমেরিকাতে ভোটার আইডেন্টিকার্ড নেই। ভোটে কারচুপি করা কঠিন না। ভারতের ভোটার আইডেন্টিকার্ড সিস্টেম অনেক ভাল।
আমেরিকার কোন নির্বাচন কমিশন নেই। প্রতিটা রাজ্যের নির্বাচন কমিশন আছে। আর প্রতিটা জেলার নির্বাচন কমিশন ঠিক করে ভোট কিভাবে হবে। ফলে সব জেলার আলাদা নিয়ম। এটা টোটাল মেস। ট্রাম্পকে প্রতিটা জেলার বিরুদ্ধে মামলা করতে হয়েছে। শুধু তাই না। আমেরিকাতে বর্নবাদ বা রেসিজিমের এটাই সব থেকে বড় কারন। গৃহযুদ্ধের পর বহুদিন আমেরিকার কালো মানুষরা ভোটাধিকার পায় নি দক্ষিনের রাজ্যগুলিতে। কারন নানান আইন করে, তাদের ভোটার লিস্ট থেকে বাদ দেওয়া হত। যেহেতু আমেরিকাতে কালোমানুষদের বহুদিন ভোটাধিকার ছিল না- তাদের ওপর সব রকমের রেসিস্ট আইন চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ভারতে দলিতদের জন্য আলাদা পল্লী আলাদা স্কুল, আলাদা কুয়ো থাকতেই পারে- কিন্ত, ভারতের আইনে তা নিশিদ্ধ। অথচ আমেরিকাতে ১৯৬৫ সালের আগে পর্যন্ত দক্ষিনের কালো মানুষদের জন্য বাস, বসবাসের জায়গা সব আলাদা ছিল। একদম আইন করে ( জিম ক্রো আইন)। এর কারন এই এক্সেসিসিভ ফেডারিলিজম এবং ক্ষমতার বেশী বিকেন্দ্রীকরন।
-যদিও আমেরিকাতে দুটো রাজনৈতিক দল, কিন্ত যেহেতু নির্বাচনের পার্থীরা টিকিট পায়, দলের স্থানীয় মেম্বারদের ভোটে নির্বাচিত হয়ে- প্রতিটা পার্থীর নিজেদের টিম থাকে। দলের সাহায্য খুব বেশী পায় না ভোটে জেতার জন্য। টাকাও নিজেকেই তুলতে হয়। ফলে আমেরিকার রাজনীতিতে ব্যবসায়ী এবং লবি সাংঘাতিক ভাবে চলে। কারন লবির টাকা না পেলে, নির্বাচনে লড়া সম্ভব না। ফলে আমেরিকাতে সেনেটর বা হাউস রেপরা বিজনেস এবং ইন্টারেস্ট গ্রুপএর লোক। ফলে এরা জনগনের কথা না শুনে লবির কথা চলে।
ভারতে যেহেতু ভোটপার্থীর সপক্ষে সমগ্র পার্টি খাটে সেহেতু, পার্থীটিকে সম্পূর্ন ভাবে কোন বড় বিজনেস কিনে নিতে পারে না। তাকে পার্টির কথা শুনে চলতে হয়। আমেরিকার পার্থীদের সেই দায় নেই-তাদের পার্টি লাইন মানার দায় থাকে না। ভারতে পার্টিকে বড় বিজনেস কিনতে পারে। সেটা টেবিলের তলায় হয়ে থাকে। কিন্ত আমেরিকাতে এটা আইন মেনেই হয়।
সামগ্রিক ভাবে দেখতে গেলে, ভারতে একটা পার্টি জনবিরোধি ব্যবসা স্বার্থপন্থী কোন বিল আনতে গেলে হাজারবার ভাববে। আমেরিকাতে প্রোবিজনেস আইন আনা জলভাত। এদিক দিয়ে ভারতের গণতন্ত্র তার জনগণকে অনেক বেশী রক্ষাকবচ দিয়েছে।
আদর্শ গণতন্ত্র বলে কিছু নেই। সুতরাং একটা গণতন্ত্র থেকে অন্য গণতন্ত্র যত শিক্ষা নেবে, ততই গণতন্ত্রের মঙ্গল। এটা আমি ভারতে আমেরিকাতে দুটো দেশের পলিটিক্যাল ফোরামেই বলি। মুশকিল হচ্ছে, দুই দেশেই রাজনীতিতে উতসাহী লোকজন, তাদের বিরুদ্ধ মতের লোকজনের বিরুদ্ধে গায়ের ঝাল মেটাতে ব্যস্ত। রাজনীতির যে একটা ইনফ্রাস্টাকচার আছে এবং সেটা না বদলালে, রাজনীতি বদলায় না, এতটা গভীরে কেউ ঢুকতেই চায় না। এব্যাপারে আমেরিকা, ভারতের লোক সব সমান। সবাই এই ক্ষেত্রে ঝগড়া করার ট্রাইবাল এটিচুড নেবে।
প্রজাতন্ত্রের সমস্যা থাকবেই,। তবুও প্রজাতন্ত্রই এখনো পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ সিস্টেম। যদিও চীনের উত্থান, এই ধারনাকে ধাক্কা দিচ্ছে। তবুও চীনই শেষ কথা হবে কি না, আমরা জানি না। একসময় পৃথিবীর সবার কাছেই মুসোলিনীর ফ্যাসিজিম খুব কার্যকরী বলে মনে হত।
আমি এখনো গণতন্ত্রে আশা রাখি। তবে চীনের উত্থান আমার গণতান্ত্রিক আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরিয়েছে, সেটাও স্বীকার করে নিই
No comments:
Post a Comment