Friday, January 22, 2021

ভারতের কৃষক আন্দোলন ঃ রামরাজ্য বনাম কর্পরেটরাজ

 ভারতের কৃষক আন্দোলন ঃ রামরাজ্য বনাম কর্পরেটরাজ

-বিপ্লব পাল, ১২/২/২০
(১)
এর আগে এমন শাসক বিরোধি উত্তাল আন্দোলন দেখেছিলাম ১৯৯০ সালে। মন্ডল কমিশনের বিরুদ্ধে। বর্তমানের কৃষকদের দিল্লী ঘেরাও এবং সেইদিনের সংরক্ষন বিরোধি আন্দলোনের মধ্যে একটাই মিল। এই জনবিক্ষোভ কোন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় লালিত না। আমার খুব ভাল লাগছে, টিভিতে কৃষক নেতারা পরিস্কার বলছেন -এইসব নেতাদের কেন বিশ্বাস করব? এরাত কর্পরেটের কৃতদাস। অর্থাৎ ভারতের বৃহত্তর জনগন কিন্ত আস্তে আস্তে সেই বোধের দিকে আসছে যে “সমান্তরাল গণ সংগঠন” গুলি তাদের স্বার্থ রক্ষার্তে লড়বে (যেমন এক্ষেত্রে এই কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্বে আছে ৩৫ টি কৃষক সংগঠন। সমর্থন আছে ৪০০+ কৃষক সংগঠনের)। কিন্ত কোন রাজনৈতিক দল এবং তার নেতাদেরকে তারা বিশ্বাস করে না। এরা সবাই সোল্ড আউট। কর্পরেটের কাছে বিকিয়ে দিয়েছে নিজেদের। যতই মোদি এবং তার গোদি মিডিয়া মাইক ফুঁকুক, এই বিল কৃষক স্বার্থে- কৃষক তাকে বিশ্বাস করে না। ঠিক পশ্চিম বঙ্গে সিঙ্গুর নন্দীগ্রামে একই কান্ড হয়েছিল। সিপিএম বলছিল উন্নয়ন।
কৃষক তাকে শুনিয়ে দিয়েছে-চুপ, তোদের কে বিশ্বাস করে? কোন মূর্খ?
আরেকটা ব্যপার জানিয়ে রাখি। মোদি যে এই কৃষিবিল নিয়ে আসবে সেটা কৃষকদের এই ৪০০ টা সংগঠন না জানলেও ভারতের কর্পরেট জানত। ২০১৯ সাল থেকেই নতুন কৃষিবিল পাশ হবে এই ভিত্তিতেই অনেক কোম্পানী তৈরী হয়ে গেছিল কৃষিকর্মাস, মান্ডির এগ্রিগেশন মডেল এইসব নিয়ে।
ভারতের বাম এবং ডান দলগুলোর এই প্রবল সমস্যা। তারা ভাবে, জনগনের কিসে ভাল হবে, তারা তার ঠিকেদারটি নিয়ে নিয়েছে।
এখানে সরকার বলছে কৃষিমন্ডির/সব্জিমন্ডির মিডল ম্যান দরকার নেই। কৃষক বলছে আছে। তারাই আন্তরাজ্য বানিজ্য করে, চাষে টাকা লাগলে দেয়। এটা অবশ্যই উত্তরভারতের দৃশ্য। বাংলাতে চাষিদের অবস্থা এতটাই খারাপ, এরা আন্দোলন করার অবস্থায় ও নেই। নিজেদের ভাল বুঝতেও একটা অবস্থার দরকার হয়।
(২)
কৃষি বিলের উদ্দেশ্য একটাই। কৃষির কর্পেরেটাইজেশন। যাতে বড় কোম্পানীগুলি বড় চাষ করতে পারে। এখন ভারতে কর্পরেটাইজেশন দরকার হোক না হোক, কৃষির আধুনিকিরন দরকার আছে। তার জন্য চাষের জমির পরিমান ১০০-৫০০ একর দরকার। নইলে অটোমেশনের খরচ উঠবে না। ভারতে কৃষিজাত পন্যের দাম ক্রমশ বেড়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমেরিকার থেকেও বেশী। খাদ্য দ্রব্যের দাম এত বাড়তে থাকলে সরকার সামাল দিতে পারবে না। এছাড়া কৃষিতে জলের ব্যবহার প্রায় দশগুন বেশি। ফলে জলের স্তর নেমে যাচ্ছে হুহু করে। ভয়ংকর অবস্থা। কিন্ত আধুনিক প্রযুক্তি্র খরচ ছোট চাষির পক্ষে সম্ভব না। সুতরাং কর্পরেট ইনভেস্টমেন্ট ছাড়া, ভারতে কৃষি বাঁচবে না। পরিবেশ বাঁচবে না।
কর্পরেট চাষই একমাত্র পথ না। ভারতের কৃষির আধুনিকরনের আদর্শ পথ হতে পারত কোয়াপরেটিভ ফার্মিং। তাহলে আজকের এই কৃষিবিল দেখতে হত না। কর্পরেট ইনভেস্টমেন্ট লাগত না। কিন্ত সেই কাজ করবে কে ? ভারতের বামেরা তাত্ত্বিক বাম- বেশী পরিশ্রম তাদের শরীরে নেয় না। সেই জন্যে পশ্চিম বঙ্গে ৩৪ বছর পেয়েও তারা সেখানে কোয়াপরেটিভ আন্দোলনকে কোন শক্তিশালী বুনিয়াদের ওপর দাঁড় করাতে পারে নি। ওর থেকে ভোট চুরি করে জেতা ছিল অনেক সহজ। সেটাই করেছে। ‘
কৃষিবিলে কি কৃষকদের ভাল হবে? প্রধানমন্ত্রী বলছেন হবে। কিন্ত কে বিশ্বাস করবে তাকে? ডিমনেটাইজেশন, জি এস টি ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই আসলে কি হয়েছে জনগন দেখেছে। কৃষক নেতারা সেটাই টিভিতে বলছেন। গত চারমাস ধরে তারা আলোচনায় বসতে চাইছেন। দিল্লী তাদের পাত্তা দেয় নি। তারা স্থানীয় বিজেপি নেতাদের মাধ্যমে দিল্লীতে যোগাযোগ করেছেন। কিন্ত বিজেপির কেন্দ্রীয় নেত্বত্ব কি রাজ্য নেতাদের কথা শোনে?
শুধু এক্ষেত্রে না, কোন ক্ষেত্রেই শোনে না।
মনে রাখবেন, দেশ ভাগের হেতু কিন্ত হিন্দু-মুসলমান না। স্কুলের বইতে আপনি পড়েছেন দেশভাগ হয়েছে কারন জিন্না মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র পাকিস্তান দাবী করেন। কিন্ত এই ইতিহাস যে ভুল তা স্কুল বই এর বাইরে সামান্য পড়াশোনা করলেই জানবেন। জানবেন যে জিন্না চেয়েছিলেন আমেরিকার মতন সংবিধান, যাতে প্রতিটা রাজ্য প্রায় স্বাধীন দেশের মতন হবে। ফেডারেশন। দিল্লী দুর্বল হবে। রাজ্য শক্তিশালী হবে। এতে মুসলমান প্রধান রাজ্যগুলির নিজস্ব স্বাধীনতা থাকত, নিজেদের আইন পাশ করানোর। নেহেরু রাজী হোন নি। কারন উনার ক্ষমতার লোভ। অবশ্য রাজনীতিবিদ মাত্রই তাই। ২০০৭ সালে এই মোদিই বলেছিলেন, তিনি চান শক্তিশালী রাজ্য দুর্বল দিল্লী। দি;ল্লীর লাড্ডুর স্বাদ পাওয়ার পর আমি এটাই দেখছি, আগে কাস্টমস, কোম্পানী সংক্রান্ত সেসব কাজ কোলকাতায় হত, এখন দিল্লীতে পাঠিয়ে দিয়েছে। উনিও নেহেরুর মতন শক্তিশালী দিল্লী তৈরীর জন্য ডিগবাজি খেয়েছেন। শক্তিশালী দিল্লী বানালে, শক্তিশালী ভারত তৈরী হয় না। হোয়াটসাপ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েটদের এসব রাজনৈতিক তত্ত্ব কে বোঝাবে?
এই কৃষক আন্দোলন পুরোটাই দিল্লীকে শক্তিশালী করার ফল। আমেরিকার মতন ফেডারেশনে এই ধরনের বিল রাজ্য আনতে পারে। কেন্দ্র না। পাঞ্জাবে কৃষকদের স্বার্থ আর বাংলার কৃষকদের স্বার্থ এক না। ফেডারেশনের ক্ষেত্রে সুবিধা এই যে যদি একটা রাজ্য এই কৃষিবিল এনে দেখাতে যে এতে কৃষকদের উপকার হচ্ছে, তাহলে বাকী রাজ্যের কৃষকরা নিজেরাই চাপ দিত কর্পরেটাইজেশনের জন্য। আমেরিকাতে এই ভাবেই কৃষিকাজ এখন সম্পূর্ন ইন্ডাস্ট্রি। চাষি জমি ভাড়া দেয় মাত্র।
(৩)
বিজেপি রামরাজ্য চাইছে। কিন্ত রামায়নটাই বোঝে নি। রামের চরিত্র ও বোঝে নি। রামরাজ্য কি? রামায়ন থেকে আমরা কি রাজনৈতিক শিক্ষা পাচ্ছি?
রামায়নের আসল চরিত্র রাবন। কে রাবন? তিনি কি শুধুই এক পৌরানিক চরিত্র? রামায়ন বলছে তিনি জ্ঞানে শ্রেষ্ঠ, ধনে শ্রেষ্ঠ, বলে শ্রেষ্ঠ। রাবন যখন মৃত্যুমুখে, রাম লক্ষনকে বলছেন, যাও রাবনের পায়ের কাছে বসে রাজনীতির, রাষ্ট্রনীতির পাঠ নাও। রাবন ছিলেন শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মন। তবুও তিনি মহাভিলেন। কেন? কারন অহংকার এবং ক্ষমতার গর্বে তিনি অন্ধ।
রামায়ন এটাই দেখাচ্ছে, রাজা যখন তার রাজনৈতিক শক্তি, অর্থবলে, জ্ঞানবলের অহঙ্কারে ভোগে, সাধারন মানুষের কথা শোনে না তার পতন অনিবার্য্য। তা তিনি যতই শক্তিশালি, ধনশালী, জ্ঞানশালী হোন না কেন। বিজেপির দিল্লী নেতৃত্বকি রামায়ন পড়ে?
উলটে রামকে দেখুন। তার রাজ্যের লোকেরা সীতাকে নিয়ে সমালোচনা করাতে, তিনি তার প্রিয়তমা স্ত্রীকেও ছাড়তে বাধ্য হলেন। তিনি কি জানতেন না, তার জনগন ভুল? অবশ্যই জানতেন তিনি ভুল করছেন। কিন্ত রামায়নের “রাজনৈতিক” বার্তা সিম্পল- রাজা যতই শক্তিশালী জনপ্রিয় হোন, প্রজাদের অপ্রিয় এমন কি ভুল দাবীও তিনি মানতে বাধ্য। কারন সেটা না হলে, রাজা হবেন স্বৈরাচারী।
রামরাজ্য মানে কি রামলীলার পূজো আর মুসলমান পেটানো, মুসলমান খেদানো?
রামরাজ্য কি-সেটা রামায়নে খুব স্পষ্ট। যেখানে শাসক প্রজাএর কথা শুনতে বাধ্য। এমন কি প্রজা যদি মনে করে রানীকে ডিভোর্স দিতে হবে, রাজা সেটাও শুনতে বাধ্য। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এত শক্তিশালী বার্তা আর কোন রাজনৈতিক আদর্শে আছে?
এই জন্যেই বিজেপিকে আমি কোনদিন হিন্দুত্ববাদি পার্টি বলে মনে করি নি। আমার কাছে এরা ইসলাম ২। এদের কীর্তি কলাপে হিন্দু দর্শনের ছিঁটেফোঁটাও পাওয়া যাবে না।
Pankaj Pramanik, Indranil Basu and 66 others
18 Comments
39 Shares
Like
Comment
Share

No comments: