Wednesday, April 13, 2011

সিপিএম কি নির্বাচনের পরে টিকবে?

বিপ্লব পাল ১৩ই এপ্রিল, ২০১১

***********************



ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের বুকিরা শুনছি-এই নিয়ে এখন বাজি ফেলতে চান। নির্বাচনের পরে সিপিএম কি টিকবে?



যারা মনে করেন সিপিএম ধ্বংশ হবে, তাদের কারনগুলি আগে একত্রিত করিঃ



[১] প্রথম সমস্যা -সিপিএম পার্টির মেশিনারি খরচ। পশ্চিম বঙ্গে সিপিএমই বৃহত্তম কোম্পানী। ৩০০০ এর ওপর পেল্লাই পার্টি অফিস, ৪০,০০০ এর বেশী হোলটাইমার বা পার্টটাইমার। বছরে বিদ্যুত বিলই আসে ১০ কোটি টাকার ওপরে। ক্ষমতাই না থাকলে এই খরচ কে দেবে? পার্টির লেভি থেকে যা আদায় হবে ক্ষমতায় না থাকলে, তাতে ১৫% বিল ও ভরতে পারবে না সিপিএম। তবে পার্টি অফিসগুলির দাম ভরসা-সেগুলি যদি জনরোষে না ধ্বংশ হয়-কিছুটা আর্থিক সুরাহা পার্টীঅফিস বেচে বা ভাড়া দিয়ে সম্ভব।

মোদ্দা কথা সিপিএম এমন একটা ভোট মেশিনারি তৈরী করেছে-ক্ষমতাই না থাকলে, তাকে টেকানো সম্ভব না।

[২] দ্বিতীয় সমস্যা ধান্দাবাজ এবং স্বার্থপরে ভর্তি পার্টিকর্মী- কারা করবে বিরোধি পার্টির কাজ? পার্টির নবীনদের মধ্যে ক্ষুদ্রতম একটা অংশ আদর্শবাদি। কিন্ত তাদের অনেকেই আবার হোয়াইট কলার কর্মী- তারা মাঠে নেমে তৃণমূল আর পুলিশের ঠেঙানি খেয়ে আন্দোলন করবে? মনে হয় না। বাকি ধান্দাবাজ ঠিকেদারি অংশটা আগেই পার্টি ছাড়বে-বা অনেকে ছেড়েও দিয়েছে।

[৩] সব থেকে বড় সমস্যা প্রকাশ কারাতকে নিয়ে। ইনি পাটিগণিত বোঝেন না-বস্তাপচা তত্ত্ব বোঝেন। যা দিয়ে রাজনীতি হয় না। সিপিএমের এই হালের জন্যে এবং তৃণমূলের উত্থানের পেছনে ইনার অবদান সর্বাধিক। কংগ্রেসকে না ফেলার চেষ্টা করলে তৃণমূল-কংগ্রেস জোট এই রাজ্যে সম্ভব ছিল না। সেক্ষেত্রে তৃণমুলের পক্ষে এই রাজ্যে কিছু করা সম্ভব ছিল না। তৃণমূলের আজকের সব শক্তি কংগ্রেসকে ভাঙিয়ে এবং সংখ্যালঘুদের সমর্থনে-যেটার মুল কারন কংগ্রেসের সাথে জোট। এমন অপদার্থ জেনারেল সেক্ট্রেটারী থাকতে সিপিএম ভাংতে মমতা ব্যানার্জির দরকার হয় না।

[৪] চতুর্থ সমস্যা সিপিএম বিরোধি জনরোষ -জনরোষ ঠিক কোন অবস্থায় আছে, সিপিএম হারলে বোঝা যাবে। এটা অজ্ঞাত ফ্যাক্টর।

[৫] পার্টির মধ্যে অন্তর্দ্বন্দও অনেক। তবে লক্ষ্যনীয় যে তৃণমূলের হাতে মার খাওয়া শুরু হওয়ার পরে, নিজেদের বাঁচাতে সিপিএম এখন অনেক বেশী ঐক্যবদ্ধ।

[৬] দিল্লীকেন্দ্রিক একটা দলের পক্ষে পশ্চিমবঙ্গ কেন্দ্রীক একটি পার্টিকে হারানো পশ্চিম বঙ্গে মুশকিল। কারন দিল্লীর নেতারা সর্বদা ক্ষমতা হাতে রাখার জন্যে ছড়ি ঘোরাবেন-এবং অনেক ক্ষেত্রে তা করবেন জেনেশুনে পার্টির শুদ্ধিকরনের নামে। মুসলিমদের আক্রমনে একসময় যেমন হিন্দু ধর্ম হেঁসেলে ঢুকেছিল-বা পুলিশের চাপ বাড়লে নক্সাল পার্টিগুলির যে হাল হয়-সিপিএমের ও সেই হাল হতে পারে। বাস্তব বিচ্ছিন্ন হয়ে তত্ত্ব দিয়ে পার্টি পরিচালনা একটা রোগ-এবং এই রোগ হারের মুহুর্তে বামপার্টিগুলিতে সংক্রামিত হয়। দিল্লী কেন্দ্রীক তাত্ত্বিক পার্টির ধারনাতে এই ধরনের বামরোগ সিপিএম কেও শেষ করে দিতে পারে।

এবার উলটো দিকে ভাবা যাক-কেন সিপিএম টিকে যাবে।

[১] তৃণমূল একটি নৈরাজ্যের নাম। এখানে অতিবাম, অতিডান, মধ্যম, সুবিধাবাদি, নিও লিব্যারাল-সবাই আছে। সিপিএম বিরোধি সবার ঘোঁট। একবার সিপিএম হেরে গেলে, তৃণমূলের অস্তিত্বের সংকট আসবে। কারন সেক্ষেত্রে কমন গ্রাউন্ডটাই থাকবে না। সেক্ষেত্রে একাধিক পার্টির জন্মের সুযোগ আছে। এর মধ্যে সিপিএম সামান্য ক্ষমতাও যদি ধরে রাখতে পারে-তাহলেও তারাই এগিয়ে থাকবে।

[২] ১৯৭৭ সালের আগের কমরেডদের কিছু কিছু এখনো আছেন। মূলত সিপিএমের বেঁচে থাকার জন্যে এরাই ভরসা। এরা স্থানীয় এলাকাতে শ্রদ্ধেয়-কিন্ত পার্টির মধ্যে কোনঠাসা। সিপিএমের হারের পর-আবার আদি সিপিএমে ফিরে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা তৈরী হচ্ছে। কারন ধান্দাবাজরা ধান্দার জন্যে বা গণধোলাই খেয়ে সিপিএম ছাড়বে।

[৩] ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরন- তৃনমুল যেভাবে ইদ্রিস আলি বা আরাবুলের মতন দাগী ক্রিমিন্যালদের স্থানীয় মানুষজনের মাথায় চাপিয়ে দিয়েছে-তাতে পরিস্কার-তৃণমূলে আভ্যন্তরীন গণতন্ত্র নেই। আজকে সিপিএম খেদাতে সবাই নর্দমার জল খেতেও রাজী আছে-তাই এটা বোঝা যাচ্ছে না। কিন্ত সিপিএম জেতার পর-এই ভাবে চাপিয়ে দিলে স্থানীয় মানুষের কাছে বিরাগভাজন হবে তৃণমূল। স্থানীয় মানুষদের দাবীকে অধিকার না দিলে, সিপিএমে দিকের আবার লোক আসবে-বিশেষত যখন ধান্দাবাজরা আর দলে থাকবে না। এবং প্রাক ১৯৭৭ সালের কর্মীরা বা নতুন কর্মীরা দলের মুখ হবেন। আভ্যন্তরীন গণতন্ত্রের কারনেই সিপিএম এই ব্যাপারে তৃনমূলের থেকে অনেক এগিয়ে থাকবে।

[৪] প্রকাশ কারাতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, রাজ্য বিদ্রোহী সিপিএমের জন্ম বা প্রকাশ কারাতের অপসারন-সব কিছুই সম্ভব। প্রকাশ কারাত নামক রাহুটি গেলে, সিপিএম অনেক বাস্তববাদি পথে চলতে পারে।

সিপিএমের মূল সমস্যা আসলে পরীক্ষিত ব্যার্থ পথে পার্টিকে চালনা করা। লেনিনবাদ বা ট্রেড ইউনিয়ান ভিত্তিক সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র-দুটিই মানুষের মধ্যে সমতা ফেরাতে বা রাজনৈতিক দাবী মেটাতে ব্যার্থ হয়েছে। কিন্ত তার মানে এই নয়, শ্রেনীদ্বন্দ নেই বা শ্রমিকদের ওপর অত্যাচার নেই বা শোষন চলছে না। এগুলো আরো বাড়ছে। কিন্ত তার দাওয়াই হিসাবে লেনিনবাদ এবং গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের পথে দলকে চালনা করলে, সিপিএম হয়ত টিকবে -কিন্ত বাম আন্দোলনের ভবিষ্যত শুন্য।

তাদেরকে মার্ক্সবাদের গভীরে ফিরে যেতে হবে-যেখানে গেলে বোঝা যায় উৎপাদন ব্যাবস্থার ওপর "বেস" করেই সমাজ এবং রাজনীতি রচিত। "সামাজিক সাম্য" সেই উৎপাদন ব্যাবস্থার প্রিকন্ডিশন না-বরং উৎপাদন ব্যাবস্থার বিবর্তন থেকেই "সামাজিক সাম্যের" জন্ম নেয়। ধনতান্ত্রিক কাঠামোর চেয়ে উন্নত উৎপাদন ব্যাবস্থার সন্ধান না পেলে, শোষনের বিরুদ্ধে অরণ্যে রোদনই সার হবে। সুতরাং ফ্যাক্টরি কাউন্সিল বা কোয়াপরেটিভ ফার্মিং বা ব্যাঙ্কিং-যার মধ্যে দিয়ে আরো উন্নত উৎপাদন ব্যাবস্থা আনা যায়-যেখানে মানুষের অধিকার থাকবে উৎপাদন ব্যাবস্থার ওপরে-সেই ধরনের বিকল্প বামপন্থার পরীক্ষাগুলি সিপিএমকে চালাতে হবে। লেনিনবাদের সরকারি ধনতন্ত্র নেমে যাবার গলি। আর ট্রেডইউনিয়ানিজম এই বিশ্বায়নের যুগে তালপাতার সেপাইদের প্রতিরোধ।

লেনিনবাদ বা ট্রেডইউনিয়ানের অন্ধগলিতে ভারতে বামআন্দোলনের ভবিষ্যত উজ্জ্বল না। কিন্ত মানুষ এখানে আগের থেকেও বেশী শোষিত। সুতরাং বিকল্প বাম পথ না খুঁজলে সিপিএমের ভবিষ্যত নেই।

No comments: