বর্ধমানের দুবরাজপুর গ্রামের সপ্তদশী কিশোরী অসীমা খাতুন আত্মহত্যা করেছেন। অনেক কারনেই মানুষ আত্মহত্যা করে-কিন্ত এক তরুণী যখন সমাজ, বাড়ি এবং রক্ষনশীলতার চাপে বাঁচার ইচ্ছাটাই হারিয়ে ফেলে-বুঝতে হবে এটা আত্মহত্যা নয়। হত্যা। হত্যাকারী সমাজ এবং রাষ্ট্র।
ঘটনাটা এই রকম। মেয়েটি সুন্দরী-চিত্তাকর্ষক কিশোরী। পরিবার হত-দরিদ্র। দরিদ্র সুন্দরীমেয়েদের রাজরাণী বানানোর স্বপ্ন দেখিয়ে বেশ্যাবৃত্তিতে নামানোর ঘটনা নতুন কিছু নয়। খবরে প্রকাশ গত দশ বছরে বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বঙ্গ থেকে পঁচিশ লাখ মেয়ে মুম্বাইয়ে পাচার হয়েছে। আরো ভালো করে বলা যাক। অধম এই বাঙালী জাতির জীবনে জীবিকা অর্জনের পথ কমেছে-কিন্তু কমেনি টিভিতে ভাল থাকার, ভাল জীবনের লোভনীয় হাতছানি। ফলে দুই বাংলার গ্রাম থেকেই পুরুষ যেমন জীবিকার দায়ে দেশ-গ্রাম ছাড়া, তেমনই অসহায় মেয়েদের ঠাঁই হয়েছে মুম্বাই, দুবাই এর বাজারে। হ্যাঁ জীবিকার জন্যে, গণিকাবৃত্তির জন্যে চিরকালই সবদেশেই এমন হয়ে এসেছে-কিন্তু তথ্য এটাও বলছে মুম্বাই এর বাজারে সব থেকে বেশী মেয়ে আসে নেপাল, বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গ থেকে। পেটের তাড়না-কিছুটা ভালো থাকার হাতছানিত থাকেই। যে মেয়েগুলো আগে যায়, তারা দুদিন বাদে শাড়ি গহনা পড়ে ফিরে এসে গ্রামের অন্য মেয়েদের ফুঁসিয়ে নিজেই এজেন্ট হয়ে যায়। পশ্চিম ভারতের কিছু লোকের হাতে অগাধ টাকা-রক্ষিতা, গণিকা থেকে নর্তকী হওয়ার অনেক কাজই জুটে যায়। যারা একটু দেখতে ভাল, স্মার্ট তাদের জন্যে দুবাই এর কাজ বাঁধা! হত দরিদ্রের পরিবার-আগে পেটে ভাত জুটত না। এখন যখন মেয়ে মুম্বাই থেকে থোকটাকা পাঠাচ্ছে-তাদের বাবা-মায়েরা কি জানতে চাই, কি মূল্যের বিনিময়ে মেয়ে এইটাকা পাঠাচ্ছে? এদের কিভাবে এক দঙ্গল পুরুষদের পার্টিতে (কখনো সখনো মেয়েরাও থাকেন) নগ্ন করে নাচানো হয়-তারা নানান ক্লিপ গোটা ইন্টারনেট ওয়ার্ল্ডে বিচরন করছে। বুঝতে অসুবিধা হয় না-নারীত্বের কত অবমাননা, কত জ্বালা সহ্য করে এরা দেশের বাড়িতে টাকা পাঠাচ্ছেন। কারন, গর্বিত বুদ্ধিমান বাঙালীর জাতে সৌভাগ্যক্রমে জন্মেছেত, তাই পেটে ভাত নেই-দেহ বেচে খাওয়াই নিয়তি।
যাইহোক অসীমার গল্পটা অন্যরকম। মেয়েটি মুম্বাই গিয়ে কিছু টাকা, 'খ্যাতি' অর্জন করে ফিরেও আসে। যদ্দুর খবর পাওয়া যাচ্ছে-রেপুটেশনের দৌলতে বিদেশের টিকিটও মিলে গিয়েছিল। কিন্ত অপমানের জীবনে ফিরতে চাই নি অসীমা। এজেন্টরা টাকার থলি নিয়ে তার বাবা-মায়ের কাছে ঘুর ঘুর করছিল। ঘর থেকে তাকে মুম্বাইয়ে পাঠানোর চাপ ছিলই। এর মধ্যেই দ্বায়িত্বজ্ঞান হীন সাংবাদিকতা করে বসে এক বাঙালী দৈনিক। যখন এমনিতেই অসীমাকে নিয়ে সাতকানে গুঞ্জন, দুবরাজপুরের গ্রামে মুম্বাই ফেরত মেয়েদের "বৈভবশালী" জীবনের নেপথ্য কাহিনী ছাপা হল। ঘরে এবং বাইরে এত চাপ সহ্য করার ক্ষমতা বোধ হয় ছিল না এই কিশোরীর।
অসীমা আত্মহত্যা করলেই যদি এই ঘটনার শেষ হত-তাও মানা যেত-এমন কি হইল। কিন্তু বাঙালীত!-ঘোলা জলে মাছ তুলতে নেমে গেল আরেক দৈনিক-যারা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের মুখপাত্র। যে আত্মহত্যা বিশ্লেষন করে বাঙালীর অধোগতির আত্মবিশ্লেষন করা ছিল আবিশ্যিক-তা না করে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার খেলা দেখছি আমরা। অথচ পশ্চিম বঙ্গে বেকারত্বের এই হালের জন্যে সিপিএম এবং তৃণমূল-কারুর দায়ই খুব কম না।
অসীমার বাবার যদি আজ একটা ভদ্র চাকরী থাকত, তাহলে জেনে শুনে কি উনি মেয়েকে উলঙ্গ করে নাচতে পাঠাতেন? এই কথাটা ত কেও তুলছে না! পশ্চিম বঙ্গে বেকারীর হার ভয়াবহ। দিন মজুররা মোটে বছরে কুড়ি দিন কাজ পাই এই রাজ্যে। তাও মাত্র দিনে পঞ্চাশটাকা মজুরী। গুজরাট এবং মহারাষ্ট্রের দিনমজুররা পাচ্ছে বছরে ৮০ থেকে ৯০ দিন-মজুরী নব্বই টাকা। কারন কৃষি ছাড়া পশ্চিম বঙ্গে দিন মজুরদের গতি নেই-গুজরাটে অনেক শিল্প আছে। তাই কৃষিতে দিনমজুরদের চাহিদা এবং উপায় বেশী, যেহেতু শিল্পেও অনেকে দিনমজুরী খাটছে।
আমাদের একটুও ত বোঝা উচিত-দারিদ্র কোন অবস্থায় পৌঁছালে বাবা-মা নিজের মেয়েকে বেচে দিতে বাধ্য হয়? অসী্মা ত কোন ব্যাতিক্রম নয়। গত দশ বছরে এরকম দশলক্ষ অসীমাকে বেচে দিয়েছে বাঙালী বাবা মায়েরা। কি করবে? বছরে কুড়িদিন রোজ করে ত নিজেরেই ভাত জোটে না।
শিল্পায়ন না হলে পশ্চিম বঙ্গে আরো অসীমারা জন্ম নেবে। যারা শিল্পায়নের বিরোধিতা করছে জমির অজুহাতে-তাদের বাড়ির মেয়েদেরত আর অসীমা খাতুন হতে হয় না। তারা এই জ্বালা আর বুঝবে কি করে?
দুর্ভাগ্য আমাদেরই। পেটে ভাত থাকলে বাঙালী ইন্টেলেকচ্যুয়াল মাস্টারবেশন করতে ভালোবাসে। সেই বুদ্ধিদীপ্ত কামোত্তেজনায় কি আর হাভাতে অসীমাদের কথা এদের মনে থাকে?
No comments:
Post a Comment