Thursday, April 16, 2020

মিথ বনাম বাস্তব-করোনার প্রকোপ

(1) হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন কি করোনার সংক্রমন নিরসনে কাজ করবে?
এই কোটি টাকার প্রশ্নে, চীনের এক গবেষনাদল, প্রথম একটা প্রপার ক্লিনিকাল রিলিজ করেছে [১] । তাতে দেখা যাচ্ছে ওভারল কোন লাভ নেই। বরং সাইড এফেক্টে ক্ষতি হতে পারে [ আমি রেফারেন্স দিচ্ছি]। কিন্ত কিছু কিছু ক্ষেত্রে, যেখানে ব্যাক্টেরিয়াল সংক্রমন ও ছড়ায়, সেখানে ক্লোরোকুইন ভাল কাজ করেছে।
অর্থাৎ এটি মুড়িমুরকির মতন খেলে ক্ষতি হবে। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া একদম নেওয়া উচিত না।
(২) করোনা টেস্ট রেজাল্ট কতটা বিশ্বাসযোগ্য? একদমই না। দেখা যাচ্ছে ২০-৩০% ভুল। বয়স্কদের জন্য আরো ভুল। সুতরাং টেস্ট করলেই করোনা সমস্যা সমাধানের দিকে এগোবে, এটাও রাজনৈতিক মিথ [২]। আমি তথ্যসূত্র দিলাম। বিজ্ঞান এখানেও খুব বেশী সুরাহা করতে ব্যর্থ। এক্ষেত্রে এফেক্টিভ সেই একটাই স্ট্রাটেজি-ধরে নিতে হবে আমাদের সবার করোনা ভাইরাসে ধরেছে। সেই ভাবেই স্যোশাল ডিসটান্স মেইন্টেইন করতে হবে।

টেস্ট হচ্ছে না বলে রাজনীতি করে লাভ নেই। টেস্ট হলেই যে সুরাহা হবে, তথ্য কিন্ত তা বলছে না। তবুও বেশী টেস্ট করা উচিত। কারন নাই মামার থেকে কানা মামা ভাল। কিন্ত টেস্ট করলেই সব মুশকিল আসান-তা কিন্ত না।

(৩) কতটা স্যোশাল ডিসটান্স মেইন্টেইন করবেন অন্যজন্যের কাছ থেকে?
অন্যকেউ ভাইরাস এফেক্টেড হলে তার মুখ থেকে নির্গত হাঁচি এবং নিশ্বাসে থাকা ভাইরাস ২২ ফুট অব্দি যেতে পারে [৩]। তাও পরিস্কার বাতাসে। কোলকাতার দূষিত বাতাসে যেখানে পার্টিকুলেট অনেক কনসেন্ট্রেশন বেশী-এটা আরো দূর যেতে পারে। সুতরাং স্যোশাল ডিস্টান্সিং এর সাথে মাস্কও দরকার। ২২ ফুট দূরত্ব মেইন্টেইন করা অবান্তর। মাস্ক, ভাল এন-৯৫ মাস্ক দরকার। না হলে গামছা। কয়েকটা লেয়ারে।

Monday, April 13, 2020

একটি আষাঢ়ে গল্পের খসড়া

একটি আষাঢ়ে গল্পের খসড়া
-বিপ্লব পাল, ১৪ই এপ্রিল
*****
-নিমতলা? বস লম্বা লাইন আছে। অনেকে ডেডবডি নিয়ে তিনদিন বসে। বরফ দিয়ে রাখতে হচ্ছে। পাক্কা খবর। মিঠুর বাবা মারা গেল বেস্পত্তিবার। এখন রবিবার রাত। এখনো নাম্বার আসে নি মনে হচ্ছে
-তাহলে কাশীপুর, গার্ডেনরিচ, ওখানে কত দিন ?
-কি বলবো মলয়দা। সব এক। তিনশো চারশো বডি। তিন চার দিনের লাইন। তবে একটা ফোন দিতে পারি। কিছু বেকার ছেলে পিলে মিলে খুলেছে। আগে সুইগির হয়ে খাবার দিত। এখন ডেডবডি চুল্লীতে পৌছে দিচ্ছে। তবে হ্যা, তিনদিন বডি আগলে থাকতে পারবে না। প্রচুর ডিমান্ড বুঝতেই পারছ। পার বডি এখন পঞ্চাশ হাজার চাইছে। পাঁচে শুরু করেছিল। পাঁচমিনিট ও দাঁড়াবে না। গাড়ি নিয়ে আসবে। হেভি প্রোটেক্টিভ গিয়ার ওদের। চুল্লীর লাইনে ফেলে দেবে। বরফের জোগার ওরাই করবে। তিন চারদিনের আগে নাম্বার আসবে না। বুঝতেই পারছ। আর হ্যা, তোমাকে ত আবার মুখাগ্নি করতে হবে- তোমার প্রোটেক্টিভ গিয়ার আছে ত? করোনার টেস্ট করিয়েছ? চিন্তা করোনা। আরো দশ হাজার ফেললে ওরাই তোমাকে হেবি প্রোটেক্টিভ গিয়ার দিয়ে দেবে। মানে বুঝতেই পারছ, ক্রিমেটোরিয়ামের মানে দুশো তিনশো করোনার লাশ। চারিদিকে ভাইরাস। হেবি গিয়ার চায়। দেখছ না এখন ডাক্তারদেরও পাত্তা পাওয়া যচ্ছে না। সবাই করোনাতে টসে গিয়ে নিজেরাই বাড়িতে কোরান্টাইন।
দুলাল যাকে বলে পাড়ার সব থেকে ডাকাবুকো ছেলে। সিপিএম, তৃনমূল বদলেছে। কিন্ত পাড়ার মুশকিল আসান বদলায় নি। এ তল্লাটে সব কাজে কাউন্সিলার থেকে এম এল এ দুলালকেই চেনে।
প্রথম প্রথম পাড়ায় সপ্তাহে দু তিনজন বৃদ্ধ বৃদ্ধা টসকাচ্ছিল। অজানা জ্বর। করোনা টেস্টিং নেই। আজকাল জ্বরে টসকালে লোকে ধরে নেয় করোনা। শ্বশান বন্ধু পাওয়া যায় না। ভাই, বোন কেউই যাচ্ছে না। পাড়ার বন্ধুবান্ধবরা কেউ আসবে না। টাকা দিয়ে বডি পাঠাতে হচ্ছে। ওই ভাড়াটে ছেলেছোকরারা ফেসবুক লাইভে আত্মীয় স্বজনদের শেষ যাত্রা দেখিয়ে দিচ্ছে। অনেকের ছেলেমেয়েই কোলকাতার বাইরে। ফলে শেষ যাত্রায় ফেসবুক লাইভই এখন দ্যা ট্রেন্ড। সেটা আবার ঘন্টায় হাজার টাকার আলাদা কনট্রাক্ট। এটাই এখন নিয়ম।
পাড়াতে ডেইলি ছ থেকে দশজন মারা যাচ্ছে। এহাত ওহাত ঘুরে দুলালের নাম্বারেই কল আসে। সবাই দুলালকেই ডাকে। আগে দুলাল কমিশন নিত না। এখন ওই নিমতলা পেশাদার শ্বশানবন্ধু কোম্পানী থেকে কাট নিচ্ছে। শালা এত হেবী ব্যবসা। বছরে এ পাড়াতে খুব বেশী হলে তিন চারটে বাড়ি বিক্রি হয়। একটা ফ্ল্যাট ওঠে। একে ওকে দিয়ে আর কত থাকে? আজকাল দুটো পার্টি শশ্বানবন্ধু কোম্পানীকে পাইয়ে দিতে পারলেই দিনে কুড়ি হাজার! পুরো ক্যাশ!
অবশ্য ক্যাশ দেখলেই যে মন ভাল হচ্ছে তা না। বাড়িতে সত্তর বছরের বাবা মা। কালকেই বাবার কাশি উঠেছিল। ভাবছিল টেস্টিংটা করিয়ে নিয়ে আসে। হাসপাতালে যাওয়ার উপায় নেই। করোনাতে ডাক্তার নার্সরাই বোল্ড হয়ে বাড়িতে বসে গেছে! তাছারা হাসপাতাল থেকে করোনা ছড়াচ্ছে আরো বেশী। ডাক্তাররা রুগী দেখা বহুদিন বন্ধ করেছেন। বাবার হাইপ্রেসার। এখন কিছু হলে ডাক্তারবাবুকে ফোন করে ওষুধ নিয়ে আসা। ব্যবস্থা এইটুকুই। আজ মলয়ের বাবা দেহ রেখেছেন। কাল কার বাবাকে নিতে পেশাদার শ্বশান বন্ধুরা এ পাড়ায় আসবে কেউ জানে না। টাকা, দাদা সবকিছু থেকেও লাভ নেই। অজানা ভয় গ্রাস করছে দুলালকে।
ও প্রান্তে মলয় নির্বাক। দুলালই বলে চলল
-মলয়দা তাহলে ওই শ্বশানবন্ধু পার্টিকে বলে দিই। ওদের সিইইও আমার খুব চেনা। আমি একটা ফোন করে দিলেই হবে।
-ইয়ে দুলাল, ওরা কি পুরো পঞ্চাশই নিচ্ছে? মানে বুঝতেই পারছ। লকডাউনের বাজারে গত তিনমাসে আমার ওই দোকান থেকে কোন ইনকাম নেই। এদিকে ছেলের টিউশুনি অনলাইনে নিতে হচ্ছে। তুমি ত বলছিলে ওদের মালিককে চেন...
-কি বলব মলয়দা। দুসপ্তাহ আগেও পাঁচ ছিল। কিন্ত ওরাইবা কি করবে বল। ডেইলি সত্তর আশিটা বডি। তিনটে মাত্র গাড়ি। মেরেকেটে দশটা ছেলে। কে আসবে বলত এই কাজ করতে? প্রানের ভয়ত আছে। তবে বুঝলে সুইগি, ফুড পান্ডার ছেলেগুলোত বেকার এখন। ওদের অনেকেই খুব নীডি বুঝলে। তাদেরই কেউ কেউ আসছে। কিন্ত হেবী ডেইলি রেট দিতে হচ্ছে । দিনে দু হাজার।
- আচ্ছা দুলাল । দিনে দুহাজার দিলেই বডি পৌছানোর লোক পাওয়া যাচ্ছে? তা তুই এক কাজ কর না । আমি তোকে পঁচিশ হাজার দিচ্ছি, তুই গাড়ি আর চারটে ছেলে জোগার করে দে। পঞ্চাশ দেওয়ার ক্ষমতা নেই। বাড়িতে মাও আছে। যা অবস্থা । আজ পঞ্চাশ দিলে, কাল লাগলে আর কিছু থাকবে না রে ভাই।
দুলাল এতটা ভাবে নি। আসলে দালালি করে অভ্যেস। দ্বায়িত্ব নেওয়ার ঝামেলায় থাকে না। মলয়দার প্রস্তাবটা খারাপ না। সত্যিই ত- ছেলেপুলের ত অভাব নেই। লোক ডাউনের বাজারে সবাই বেকার। কিছু ছেলেপুলে জুটে যাবে। পার্টি প্রতি ত্রিশ-চল্লিশ হাজার টাকা লাভ।
-মলয়দা, ইয়ে যা বলছেন। তাছাড়া কাকুর শেষ যাত্রা বলে কথা। ঠিক আছে। আমিই দেখছি। তোমাকে আর অন্যকোন খানে দেখতে হবে না। আমি ম্যানেজ করে নেব।
সাপ্লাই লাইন যে কখন কেউরাতলার লাইনে মিশে গেছে, কেইই বুঝে উঠতে পারে নি।

Saturday, March 21, 2020

১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্ল যে শিক্ষা নিতে পারি

মহামারীর ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ন তথ্য পেলাম। যার থেকে সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করছি। ভুল হতে পারে। কিন্ত এগুলো ফারদার ইগনোর করলে মুশকিল।
(১) ১৯১৮-১৯ সালে উত্তর ফ্রান্স থেকে যে স্প্যানিশ ফ্ল ছড়িয়েছিল, তাতে সব থেকে বেশী মারা যায় ভারতে। প্রায় ১ কোটি সত্তর লক্ষ। দেশভাগ বা কোন যুদ্ধে ভারতে এত লোক মারা যায় নি। গঙ্গা ভরে গিয়েছিল ভেসে ওঠা পচাগলা মৃতদেহে। অথচ ইতিহাসের এই পর্বটি সম্পূর্ন গায়েব।
এটির উৎপত্তিও মুর্গী থেকে। উত্তর ফ্রান্সে। প্রথম যুদ্ধ শেষে ফ্রান্স ফেরত ২০০ জন সৈনিক বোম্বেতে অবতরন থেকে এটা ভারতে ছড়ায়।
আস্তে আস্তে গঙ্গা ভেসে ওঠে মৃতদেহে। পোড়ানোর লোক পর্যন্ত ছিল না। কেশব বালিরাম হেজগাওগারের জীবনী পড়তে গিয়ে জেনেছিলাম ১৯১৯ সালে মহামারী হয়েছিল। কারন এই মহামারীর বিরুদ্ধে তার স্বেচ্ছাসেবকদের কাজের সাথে পরবর্তীকালে ১৯২৫ সালে আর এস এসের জন্মের একটা সম্পর্ক আছে। ঠিক একই সময় খিলাফত আন্দোলন শুরু হয়। পাকিস্থানের জন্মের বীজ ছিল খিলাফত আন্দোলনে। সুতরাং ১৯১৯ সালের মহামারীর ইতিহাস প্রায় মৃত, সব সার্চ লাইট খেয়েছে খিলাফত আন্দোলন। অথচ গান্ধীজি সহ কংগ্রেস নেতৃত্বের অনেকেই আক্রান্ত হয়েছিলেন এই স্প্যানিশ জ্বরে।
মহামারীতে এত বিশাল মৃত্যু ভারত কেন কোন দেশই কোনদিন দেখে নি। অথচ, স্প্যানিশ ফ্ল ভারতের ইতিহাস থেকে উধাও!
কারন এই মৃত্যুর পেছনে যেহেতু ভাইরাস-সেহেতু ইতিহাসে ঢুকিয়ে কি হবে? পাওয়ার লবির পলিটিক্যাল গেইন নেই। বুঝুন কি অবস্থা। কিভাবে ইতিহাস লিখেছে কংগ্রেসের শিক্ষিত স্যাঙাত বাহিনী।
ইতিহাস পড়ার একটাই কারন। যাতে একই ভুল দুবার না হয়। এই ইতিহাস পড়া থাকলে শাহীনবাগ আর পার্ক সার্কাসে রাজনৈতিক সার্কাস নামাতে কেউ সাহস পেত না। আবার সরকারের উচিত ছিল আন্তর্জাতিক উড়ান অনেকদিন আগে বন্ধ করা। ট্রেইন বাস ও বন্ধ করে দেওয়া উচিত। কিন্ত যে প্রজন্মের ১৯১৯ সালে মহামারীর ইতিহাস জানা নেই, তাদের পক্ষে বোঝা অসম্ভব কি হতে পারে।
(২) অধিকাংশ ভাইরাসের জন্ম জীবজন্তর শরীরে। মানুষের ত্বক ভাইরাসের ঢোকার জন্য সাধারন ভাবে পুরু। সেই জন্য ভাইরাস ত্বকের দুর্বল অংশ দিয়ে ঢুকবে। এইচ আই ভি, ইবোলা, স্প্যানিশ ফ্ল ছাড়া , অধিকাংশ ঐতিহাসিক ভাইরাসের জন্ম চীনে। কারনটাও বোধগোম্য। যেহেতু তারা নানাবিধ পশু খায়। চোদ্দশ শতাব্দির ব্ল্যাক ডেথ ও চীন থেকে।
কিন্ত একটা ব্যাপার ভাবার আছে। উত্তর ফ্রান্স এবং ভারতের আবহাওয়া এক না। তাহলে স্প্যানিশ ফ্ল কিভাবে ভারতে বিধ্বংশী হয়? সাধারনত ভাইরাস যে আবহাওয়াতে জন্মেছে, তাতেই সক্রিয় থাকে বেশী। যেমন এখন যত কোভিড-১৯ স্ট্রেইন পাওয়া যাবে, সবই মেইড ইন চাইনা স্ট্যাম্প। এবং এগুলো ১০-২০ ডিগ্রি তামমাত্রায় বেশী এফেক্টিভ। ২৫+ হলে, এদের ওয়াল গলতে শুরু করে দেবে।
কিন্ত তার মানে কি ভারত নিরাপদ বেশী? উত্তর হ্যা এবং না।
যেটা হবে, ভারতে যে কোভিড-১৯ এল, এটা ভারতীয়দের দেহে মিউটেট করবে। অধিকাংশ মিউটেশন খতরনাক না। কিন্ত একটা বা দুটো মিউটেশন এমন হবে, যে তার ফলে যে নতুন ভাইরাস এল, সে কিন্ত ভারতের আবহাওয়াতে মানিয়ে নেবে। ফলে ডেঞ্জারেস ভাবে ছড়িয়ে যাবে ভারতে।
তার সম্ভাবনা কত? পুরোটাই নির্ভর করছে কত লোকে সংক্রামিত হচ্ছে। যদি কম লোক এফেক্টেড হয়, প্রোবাবিলিটিই বলে দেবে সেক্ষেত্রে কোভিড-১৯ ভারতের ওয়েদারে মিউটেট করার সুযোগ পাবে না। কিন্ত যদি বেশী লোকে এফেক্টেড হয়, এটা মিউটেট করে , ভারতের ওয়েদারেও খতরনাক হবে।
এই জন্যেই স্যোশাল ডিস্টান্সিং, লকডাউন দরকার। যাতে করোনা মিউটেট করে ভারতের ওয়েদারে ডেঞ্জারেস না হয়। হলে আরেকটা ১৯১৯ অপেক্ষা করছে। কারন ১৯১৯ সাল যে স্প্যানিশ জ্বরে ভারতে বিধ্বংশী হয়, খুব নিশ্চিত ভাবেই তা মিউটেড। না হলে উত্তর ফ্রান্সের ঠান্ডা ওয়েদারের ভাইরাস গাঙ্গেয় উপত্যকার গরম সহ্য করে তান্ডব নৃত্য করতে পারে না।

করোনাতে আশার আলো--

করোনাসন্ত্রাসের সবটাই কি নেগেটিভ? আমি কিন্ত পজিটিভ সাইডই বেশী দেখছি।
১) প্রথমে রাষ্ট্রের হেলথকেয়ার সিস্টেম দেখুন। ভারত এবং আমেরিকা দুটো দেশেই এটি ডিফাংক্ট সিস্টেম। আমেরিকাতে উচ্চকোয়ালিটির চিকিৎসা আছে-কিন্ত দাম ধরাছোঁয়ার বাইরে। ফার্মা আর ইন্সিওরেন্স কোম্পানীগুলো রাজনীতিবিদদের পকেটে ঢুকিয়ে দিনে ডাকাতি করছে। ডাকাতরাও এত নির্লজ্জ হয় না।
ভারতে সমস্যা অন্য। সরকার চিকিৎসা খাতে খরচই করতে চায় না। বাজেটের ১-২% স্বাস্থ্যখাতে আসে। যেখানে আমেরিকাতে ওটা ২০%। স্ক্যান্ডেনেভিয়ান বা অন্যান্যদেশ যেখানে সরকারই সমস্ত চিকিৎসার দ্বায়িত্ব নিচ্ছে, সেখানে ৩০%+।
কোভিড-১৯ কে এইজন্য ধন্যবাদ যে এই প্রথম আমাদের প্রজন্ম বুঝছে চিকিৎসা একটা কমিউনিটি সার্ভিস। আমার টাকা আছে, চিকিৎসার সামর্থ্য আছে, তা দিয়ে আমি সুস্থ থাকতে পারি না। আমার পাশের গরীবলোকটির ও নিরোগ থাকার দরকার। আমার নিজের স্বার্থেই। কারন তা না হলে-তার সংক্রামক রোগ আমার মধ্যেও আসবে।
অর্থাৎ চিকিৎসা বা স্বাস্থ্য একটা মৌলিক অধিকার হওয়া উচিত। রাষ্ট্রের টাকা ফার্মা মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের মালিকদের পকেটে না গিয়ে, জনগনের সুস্বাস্থ্যের জন্য ব্যয় হওয়া উচিত।
প্রাইভেট হাসপাতাল, প্রাইভেট ইন্সিওরেন্স থাকাই উচিত না। কারন সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক দর্শনটা হচ্ছে ফেল কড়ি নেও চিকিৎসা। এই মডেলে গরীবদের চিকিৎসা পাওয়া সম্ভব না। আর তারা যদি চিকিৎসা না পায়, কোভিডের মতন মহামারীর সামনে ধনীরাও সুস্থ থাকবে না।
আমেরিকাতে করোনাক্রান্ত রুগীর সংখ্যা ১০০,০০০ ছাড়ালে সিস্টেম পুরো ধ্বসে যাবে। ভারতের অবস্থা আরো বাজে হবে।
(২) বহুদিন বাদে দেখছি লোকে রাম-রাহিমের ঝগড়া, মুসলমানদের প্রতি ঘৃনা থেকে উৎরে, কিভাবে করোনার হাত থেকে বাঁচা যায়, তাই নিয়ে একটু হলেও প্রাথমিক বিজ্ঞান শিক্ষাটুকু নিচ্ছে। যারা গোমূত্রকে মহৌষধি মনে করে, তাদের বোধবুদ্ধি যে প্রাইমারী স্কুলের গন্ডি ডিঙোয় নি-সেটা আমি আপনি বুঝি। তারা কিন্ত তাদের অন্ধত্বে বিভোর। কে হরি ভজনা করবে আর কে আল্লাকে আজান দেবে, তা নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই। সমস্যা এখানেই ভারতের শাসনভার এদের হাতে। আর ধর্মটাও ভাইরাসের মতন সংক্রামক রোগ। কাউকে হিন্দুত্বের ভাইরাসে ধরলে, অন্যপার্টিকে ইসলামিক ভাইরাসে ধরবেই। উল্টোটাও সত্য। একটা "আসল" সংক্রামক ভাইরাসের সামনে আলতো করে হলেও ধর্মের ভাইরাসের সংক্রমন একটু কমেছে। নিজেকে এবং ফ্যামিলিকে বাঁচাতে, বিজ্ঞান প্রযুক্তির স্মরণাপন্ন হওয়া ছাড়া এদের উপায় নেই। লোকে যে ধর্ম চেতনা থেকে বিজ্ঞান চেতনার দিকে সামান্য হলেও এগোল, এটাই যথেষ্ট।
(৩) করোনা অর্থনৈতিক বিপর্যয় আনবে। এটা মোটেও খারাপ না। দরকার ছিল। কারন জমি বাড়ির দাম কৃত্রিম ভাবে বাড়িয়ে, বাতাস ধোঁয়াতে ধুয়ে, শুধু জিডিপির নাম্বার বাড়ে। দেশের উন্নতির থেকে অবনতি হয় বেশী। এখন লোকে অন্যভাবে ভাববে। চিকিৎসা স্বাস্থ্যে, জনস্বাস্থ্যে উন্নতি হয় এমন স্টার্টাপের কথা ভাবতে হবে। বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে বিনিয়োগের কথা আগে ভাববে। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাটের কথা ভাববে। রেগুলার এক্সারসাইজ, ঘুমের কথা ভাববে। ঠিক ঠাক খাবার কিভাবে পাওয়া যায় তার কথা ভাববে। কারন কোভিড-১৯ এর কোন চিকিৎসা নেই। ইমিউনিটি বাড়িয়ে রাখা ছাড়া আর কোন প্রতিরোধ নেই। ফলে লোকে অসুস্থ লাইফস্টাইল থেকে সুস্থ লাইফস্টাইলের দিকে যাচ্ছে। এর জিডিপি ভ্যালু অনেক অনেক বেশী।
(৪) আই টি কোম্পানীগুলো ওয়ার্ক ফ্রম হোম চালু করেছে। আমরাও করে দিয়েছি। ওয়ার্ক ফ্রম হোম এফেক্টিভ, আরো বেশী প্রোডাক্টিভ হতে পারে যদি কর্মীরা সৎ হয়। এতে কার্বন এমিশন, দূষন কমবে।
সঙ্কট সব সময় সম্ভবনার জন্ম দেয়। আমি আশাবাদি। করোনাত্তর পৃথিবী আরো ভাল সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্ম দেবে। কয়েক লাখ লোকের মৃত্যু হবে। কিন্ত মৃত্যুত নিয়তি। উন্নততর রাষ্ট্র এবং সমাজ কিন্ত নিয়তি না-সেটার জন্য এই ধাক্কাটা লাগে।

Wednesday, February 12, 2020

অটোমেশন , জীবিকা এবং চাকরি

অটোমেশনের ফলে ধর্ম কর্পূরের ন্যায় উবে যাবে-এটা লিখেছিলাম, দুদিন আগে। প্রচুর প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। যার অধিকাংশই এই রকম- অটোমেশনের ফলে "চাকরি" গেলে খাব কি?
একদম জ্যোতিবাবুর মতন ভয়। ভীত বাম পশ্চিম বঙ্গে কম্পিঊটার ঢুকতে দেয় নি। ফলে কোলকাতা ব্যাঙ্গালোর হয়ে উঠতে পারে নি। বাঙালীরা ব্যাঙ্গালোরে গিয়ে আই টি শিল্প গড়েছে। ভারত বর্ষে সফটোয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং এই মুহুর্তে প্রচুর ভারতীয়র চাকরি (41 লাখ) দিচ্ছে। যার একটির ও অস্তিত্ব ১৯৯০ সালে ছিল না। আমাদের বেড়ে ওঠার স্কুলের দিন দিনগুলিতে [১৯৮০-৯০]-চাকরি বলতে মধ্যবিত্ত বাঙালী বুঝত - সরকারি কেরানী/আমলা/রেল, শিক্ষকতা। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার ভাল ছেলেমেয়েদের জন্য। সব বদলে গেছে। এখন তাদের বড় অংশটাই আই টি শিল্পের সাথে যুক্ত।
কিন্ত এর পরে যে এ আই, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ৪-০, আই ও টি, ব্লকচেইন আসছে, তার ফলে কি হবে?
এটা নিয়ে আগেও লিখেছিলাম। চাকরি থাকবে না। কিন্ত তার মানেই জীবিকা থাকবে না-তা না। চাকরি = জীবিকা না।
চাকরি ব্যপারটা মানুষের বিবর্তনে নতুন। উনবিংশ শতাব্দির আবিস্কার যে মানুষকে ৯-৫ টা কাজ করতে হবে। এটি শিল্প বিপ্লবের দান। কিন্ত শিল্পের প্যাটার্ন চেঞ্জ হতেই, চাকরির মৃত্যুও আসন্ন। তার মানে এই না যে জীবিকার মৃত্যু হবে।
উদাহরন দিচ্ছি। তিনটে।
এক। ম্যানুফ্যাকচারিং। যে কারখানাতে একসাথে প্রচুর লেবার কাজ করে, প্রোডাক্ট তৈরী করে। বর্তমানে আসছে থ্রিডি প্রিন্টিং বেসড এডিডিভ ম্যানুফাকচারিং। যেসব দোকানি, ডিস্ট্রিবিউটাররা আগে ফ্যাক্টরি থেকে জুতো কিনে লোককে বিক্রি করত-এখন থ্রিডি প্রিন্টার কিনে , তারা নিজেরাই জুতো তৈরী করতে পারবে। ফার্নিচার থেকে পোষাক-সব কিছুই এই এডিটিভ ম্যানুফ্যাকচারিং আসছে। ফলে প্রত্যেকে বাড়িতে বসেই অনেক কিছু তৈরী করতে পারবে। দরকার সামান্য ক্যাপিটাল এবং ডিজাইন ট্রেনিং। ফলে ম্যানুফ্যাকচারিং এর লেবারদের ডিমান্ড থাকবে না। কিন্ত সাধারন লোকজন নিজেরাই ম্যানুফাকচারিং করতে পারবে। সেটা দোকান বা ইকমার্স-যে ভাবে খুশি বিক্রি করতে পারে।
দুই। সফটোয়ার শিল্প। গতি যেদিকে, বড় কোম্পানীগুলি খুব বেশীদিন আর নেই। আস্তে আস্তে সব কিছুই মড্যুউল্যার ইকোসিস্টেমের দিকে যাচ্ছে। মাইক্রোসফট, গুগল, আমাজন -বিরাট ইকোসিস্টেম বানাচ্ছে। মূল খাঁচাটা তাদের। এবার তাদের ইকোসিস্টেমে প্রোডাক্ট বানাও। এক্ষেত্রে যেটা হবে- ৪-৫জন বন্ধু মিলে-কোন একটা মড্যুউল আপ করে ইকোসিস্টেমে দিয়ে দিল। এই ভাবে প্রচুর ছোট ছোট সফটোয়ারর দল মিলে, কমপ্লিট ইকোসিস্টেম বানাবে। সিস্টেম ইন্ট্রিগ্রেশন হবে লেগো লাগানোর মতন। বড় কোম্পানী থাকবে না। ফলে ছোট ছোট এন্টারপ্রাইজ সিস্টেম খুব সহযে, ইকোসিস্টেম থেকেই লোকে বানিয়ে নেবে। এতে যেটা সুবিধা হবে, ছোট ছোট ইনোভেটিভ সফটোয়ার কোম্পানীগুলোর ব্যবসা বাড়বে- যেহেতু মার্কেটিং বটলনেক হবে না। বড় সফটোওয়ার কোম্পানীর দরকার হবে না। এক ওই মাইক্রোসফট-গুগুল- এমাজন বাদে। যারা মূল ইকোসিস্টেম -ইনফ্রাটা দেবে।
তিন। কৃষি। এখন যেভাবে ভারতে চাষ হয়-সেটা দশ বছরে যদি না ওঠে, দেশটাই উঠে যাবে। কারন এই চাষে প্রচুর জল লাগে । প্রচুর খরচ। ফলে ভারতে কৃষিজ পন্যের দাম বেশী। মাটির অবস্থা খুব খারাপ। এই চাষ সাসটেনেবল না। ফলে সমবায় করে বড় জমি বানিয়ে আধুনিক কৃষি আনতেই হবে। এতে জমির মালিক- এবং চাষ করার কোম্পানী হবে আলাদা। আমেরিকাতে আমরা এদের কর্পরেট ফার্মিং বলি। এক্ষেত্রেও এখন চাষি পেশাটাই উঠে যাবে। তার বলে কৃষি হবে শিল্প। এবং সেখানে ছোট ছোট টিম কাজ করবে।
সুতরাং জীবিকার বিবর্তন হচ্ছে এবং হবে। চাকরি জীবিকার একটা রূপ। যা দুশো বছর টিকেছে। আর টিকবে না।

অটোমেশন এবং ধর্ম

(১)
কাল বাংলাদেশের তরুন ক্রিকেটটিমকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে অদ্ভুত সব মন্তব্যের সম্মুখীন হলাম।
আমাদের পশ্চিম বঙ্গের হিন্দু বাঙালী এবং বাংলাদেশের মুসলমান বাঙালীদের অনেকেই আমাকে জানালেন-আমি বৃথাই বাঙালী জাতিয়তাবাদের প্রসঙ্গ আনছি। কারন বাংলাদেশ এই মুহুর্তে ইসলামিক নেশন। বাঙালীত্ব দেশটির ভিত্তি না। অবশ্যই সব হিন্দু এবং মুসলমান বাঙালী এই মত পোষন করেন না। কিন্ত যে জাতি বাঙলা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়ে পাকিস্তানের কাছ থেকে নতুন দেশ ছিনিয়ে নিল, তাদের সিটিজেনরা,ভারতের সিটিজেনদের অধিকাংশই যদি মনে করে বাঙলাদেশের ভিত্তি বাঙালী জাতি গোষ্টি না-তাহলে হয় আমি অন্ধকারে আছি- নাহলে তারা ঘৃণার রাজত্বে বাস করছে।
(২)
ধর্মের যে উৎপাত বাংলাদেশ এবং ভারতে দেখা যাচ্ছে সেটা বেশীদিন থাকবে না। খুব বেশী হলে আরেক প্রজন্ম। কারন সেই অটোমেশন।
আসলে কৃষিভিত্তিক সমাজে উত্তোরনের পর, আমাদের সিস্টেমটা এমন ভাবে তৈরী, এখানে একদম নিরেট মাথামোটা, মানে যাদের আই কিউ ৮০ এর নীচে, তারাও চাকরি পায়। কোন না কোন ভাবে করে খেতে পারে। এই ব্যপারটা আর থাকবে না। আস্তে আস্তে চাকরি বা পেশার বিবর্তনটাই এমন ভাবে হবে- শুধু মাত্র যারা চিন্তা করতে পারে, কবিতা গল্প লিখতে পারে-সৃজনশীল লোকজন তারাই করে খেতে পারবে। কারন বাকী কাজ করবে সফটোয়ার-রোবট-নানাবিধ বট।
আমরা আলরেডী সেই বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আমরা যারা এই লাইনে আছি-তারা এটা এখন বুঝছি। বাকীরা আস্তে আস্তে বুঝবে।
ফলে "মার্কেটের" নিয়মেই স্বাধীন চিন্তার লোকজনের চাহিদা বাড়বে হু হু করে।
এখন মার্কেটের চাহিদা এই যে ভারত-বাংলাদেশের লোকজন ধর্মপ্রান হোক। কারন এই মার্কেট ব্ল লেবার মার্কেট। সস্তা লেবারের মার্কেট। এখানে ইঞ্জিনিয়ার -ডাক্তার-বুদ্ধীজীবি-কবি, আসলে সবাই ক্লার্ক। এরা ধার্মিক হবে-এতে আশ্চর্য্য কি। স্বাধীন চিন্তা কাউকে করতে হয় না।
আস্তে আস্তে সেটা বদলাচ্ছে। চোখের সামনেই। কৃষি, টেক্সটাইল, সব শিল্পেই অটোমেশনের জন্য লেবারদের চাহিদা কমছে। আগে ভারতে আই টির কাজ মানে তৃতীয় শ্রেনীর মেইন্টেনান্সের কাজ ছিল। আই টি কুলীর কাজ। বর্তমানে প্রচুর উন্নত স্টার্টাপ তৈরী হচ্ছে। চাহিদা আছে টালেন্টেড লোকেদের। জোগান নেই। মার্কেটে ভ্যাকুয়াম থাকে না। ট্যালেন্টেড লোকেদের চাহিদা থাকলে, উৎপাদন ও হবে।
সুতরাং ম্যান পাওয়ারের এই বিপ্লব অথবা বিবর্তন সাধিত হলে, বাংলাদেশ এবং ভারতে ধর্মের এই প্রাবল্য ফিকে হতে বাধ্য। কতদিন লাগবে সেটা প্রশ্ন। ২০ বছর ও হতে পারে। ৫০ বছর ও লাগতে পারে।
কিন্ত এটা হবেই।
(৩)
এখন একটা প্রশ্ন ওঠে যে ভারত-বাংলাদেশে ডাক্তার ইঞ্জিয়ার বিজ্ঞানীদের মধ্যেই ধর্মের প্রাবল্য বেশী। তথ্য বলে, ভারতের ৫৪% বিজ্ঞানী ধর্মে বিশ্বাসী। মুসলমান বিজ্ঞানীদের মধ্যে এই সংখ্যাটা ৯০%। আবদুস সালামের মতন পদার্থবিজ্ঞানীও ধার্মিক ছিলেন। তাহলে কি গ্যারান্টি আছে- যে যত উন্নত ম্যানপাওয়ারের দরকার হবে, তত ভারত বাংলাদেশের লোকজন নির্ধামিক হবে?
এর উত্তর অনেক ভাবেই দেওয়া যায়।
প্রথমত আমেরিকাতে বিজ্ঞানীদের ৯৫%+ নিধার্মিক বা ঈশ্বর বিশ্বাসী না। কিন্ত ভারত বাংলাদেশে এর উলটো। এর কারন সার্বিক সমাজ। এখানে নিধার্মিক হলে সমাজে "ফিট" করা মুশকিল। কারন গোটা সমাজটার নির্মানই হয়েছে ধর্মের ওপরে। অর্থাৎ "ধার্মিক" হও বা না হও, ভারত বাংলাদেশে ধর্মিক দেখানোর একটার "পজিটিভ" ইকনমিক ভ্যালু আছে। নির্ধামিক হওয়াটা মুসলিম দেশগুলিতে চূড়ান্ত নেগেটিভ ইকনমিক ইনটেন্সিভ।
দ্বিতীয়ত শিক্ষা ব্যবস্থা । ঈশ্বরে, ধর্মে বিশ্বাস সেদিন যাবে-যেদিন "প্রশ্ন" করার সাহস পাবে। এই উপমহাদেশে ক্লাসে প্রশ্ন করলে ছেলেদের ঠাং ভেঙে দেওয়া হয়। অঙ্ক ভুল করলে মারা হয়। ছোটবেলা থেকে বাচ্চাদের মাথায় অসংখ্য ভীতি ঢোকানো হচ্ছে- অঙ্ক ভুল করার ভয়, বানান ভুলের ভয়, পরীক্ষায় ফেল করার ভয়- এত ভয়পূর্ন যাদের মাথা- তাদের মাথায় ভূত এবং ভগবান যে স্থায়ী বাসিন্দা হবেন-তাতে সন্দেহ নেই।
তৃতীয় হচ্ছে রাষ্ট্রের ক্ষমতা- মানুষকে শাসন করতে ধর্মের চেয়ে ভাল টুল আর নেই।
অটোমেশনের সামনে এর তিনটেই আস্তে আস্তে ডাইল্যুউট হবে। স্বাধীন চিন্তার লোকেদের কদর বাড়বে- কারন মার্কেট। শিক্ষা ব্যবস্থা ভীতিপূর্ন হলে, সৃজনশীল ঊচ্চচিন্তার মানুষ কোত্থেকে আসবে? ফলে সেখানেও সংস্কার, আজ না হলে কালকে হবে। মার্কেটের চাপেই হবে। আর যত অটোমেশন আসবে-আস্তে আস্তে রাষ্ট্রের ভূমিকাও আস্তে আস্তে অনেক কমবে । ভারত এবং বাংলাদেশের ব্যবসা এবং মার্কেটের অনেকটাই সরকারের নিয়ন্ত্রনে। মার্কেট রেগুলেশনে অটোমেশন এসে গেলে ( যা আসছে )- রাজনীতিবিদ এবং রাষ্ট্রের ক্ষমতা কমবে। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রেও প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। এসবের নীট ফল, রাষ্ট্রের প্রয়োজন কমবে। ফলে ধর্মের দরকার ও কমবে। ভারত এবং বাংলাদেশের ধর্মের এত বাড়বাড়ন্তের মূল কারন রাষ্ট্র- এবং যারা রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করতে উৎসুক। তারাই পয়সা দিয়ে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ঘৃণা চাষ করে। সবাই যাতে নিজেকে হিন্দু মুসলমান হিসাবে গর্বিত মানুষ ভাবে, সেটাও পয়সা দিয়ে " ম্যানুফাকচারড"। অধিকাংশ মানুষ সেটা বোঝে না। কারন শিক্ষা-মিডিয়া- এখন স্যোশাল মিডিয়া-পুলিশ-আমলা- এসব কিছুর দখল নিয়ে এসব ঘৃনা তৈরী করা হয়। দুই দেশেই এক অবস্থা।
আপনি বলবেন কেন? বাইবেল, ইসলাম, হিন্দু ধর্ম সর্বত্রই ঘৃনার প্রচুর ছত্র আছে। সেখান থেকেই লোকে শিখছে। এটা ভূল ধারনা। কোরান গীতা কেউ পড়ে না-আর পড়লেও তা বোঝার ক্ষমতা খুব কমলোকের আছে। ফলে ধর্মের ন্যারেটিভ ও পয়সা দিয়েই তৈরী হয়-ক্ষমতা দখলের জন্যই। কালকে যদি বাংলাদেশের সরকার বলে ইসলাম মানে এই এই এই- তাহলে সেই দেশের ইসলাম তাই হবে। কোরানে কি আছে তা কেউ দেখবে না । মোল্লারাও না । কারন শহীদ হওয়ার ইচ্ছা তাদের ও নেই। সুতরাং ধর্ম আসলে কি- ধর্ম বলতে লোকে কি বুঝবে-সেটাও রাষ্ট্র আর মার্কেটই ঠিক করে দেয়।
ফলে রাষ্ট্রযন্ত্রকে দুর্বল করতে না পারলে- ধর্ম দুর্বল হবে না।
(৪)
আমি সেই বাংলাদেশের , ভারতের স্বপ্ন দেখি- যেখানে বর্ডার নেই। সেনা নেই। পুলিশ নেই। বা নামে মাত্র আছে। রাষ্ট্র দুর্বল। ফলে ধর্মও দুর্বল। কিন্ত মানুষ সবল।
সেটা ২০৩০ হতে পারে। ২০৫০ হতে পারে। কিন্ত হবেই। যেদিন ভারত এবং বাংলাদেশের বাঙালীর মার্কেট-শিক্ষা-সংস্কৃতি, একসাথে মিশে যাবে।
ধর্ম নিয়ে লোকজন বৃথায় চিন্তা করছে। ওসব আর বেশীদিন থাকবে না। শুধু মার্কেটকে তার নিজের হাতে ছেড়ে দিন। মার্কেট তার নিজের প্রয়োজনে, নিজের বিবর্তনেই ধর্মকে ডাইল্যুট করবে।

Sunday, January 12, 2020

নির্মোহ দৃষ্টিতে শ্যামাপ্রসাদ

১)
শ্যমাপ্রসাদের মূর্তিকে কালিমালেপনে, বাম এবং রাম, দুই দলই এখন ফেসবুকে যুযুদ্ধমান। কি কৈশর, কি যৌবন কি বর্তমান ইউটিউব-গুগুল-ফেসবুক নির্ভর দিনগত ইতিহাসক্ষয় জীবনে, শ্যমাপ্রসাদের ওপর ভাল কোন লেখা পড়ার সৌভাগ্য হয় নি। ফলে এই ভদ্রলোক সম্মন্ধে আমার জ্ঞান ভাসা ভাসা। মূর্তি বিতর্কের সূত্র ধরে আশাছিল, বিবদমান রাম-বামের পোষ্টের লড়াই এ শ্যমাপ্রসাদকে নিয়ে কিছু জানব। কোথায় কি। শ্যমাপ্রসাদ সম্মন্ধে – রাম/বাম দুই দলেরই অবস্থা দেখলাম সঙ্গীন। অগত্যা নিজেই খোঁজাখুজি শুরু করি। তাতে দেখি শ্যমাপ্রসাদকে নিয়ে প্রমান্য ঐতিহাসিক কাজ প্রায় নেই। হয় সঙ্ঘের প্রপাগান্ডা, না হলে বামেদের কাউন্টার প্রপাগান্ডা। কনটেক্সট বিহীন, অর্থহীন। ফলে বিভিন্ন জায়গা থেকে পাওয়া কিছু কিছু তথ্যকে ছেঁকে এ লেখা সাজাচ্ছি। এই ধরনের কাজের জন্য যে পরিমান সময় এবং গবেষনা দেওয়া উচিত তার ১% সময় ও আমার হাতে নেই। গোদের ওপর বিষফোঁড়া, শ্যামাপ্রসাদকে নিয়ে জানতে গিয়ে দেখলাম ১৯৪২-১৯৫১ সাল পর্যন্ত ভারতের ইতিহাস ও গুলিয়ে যাচ্ছে। আমার ধারনা ছিল দেশ ভাগের ইতিহাস মোটামুটি বুঝি-অন্তত একটা সুতোয় বাঁধতে পারি। গত দুদিন ধরে দেশভাগ সংক্রান্ত যত ইতিহাস পড়ছি বা শুনছি, তাতে প্রচুর পরস্পর বিরোধি তথ্য দেখতে পাচ্ছি। তবুও এই লেখার ধৃষ্টতা করছি-যে আমার ভুল পাঠক শুধরে দেবেন। আলোচনার শেষে সত্যিকারের শ্যমাপ্রসাদকে আমরা উদ্ধার করতে পারব। আমি এই লেখায়, তার জীবন নিয়ে না লিখে, তাকে নিয়ে ওঠা কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছি।
(২) শ্যমাপ্রসাদকে বাঙালী কেন মনে রাখবে?
ফেসবুক এই প্রশ্নে উত্তাল। বামেদের বক্তব্য যে ভদ্রলোক বৃটিশ পতাকা ইউনিয়ান জ্যাক না তোলার অপরাধে, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই জাতিয়তাবাদি ছাত্রনেতা্কে রাস্টিকেট করেছিলেন , কুইট ইন্ডিয়া মুভমেন্টের সময় বাঙলার গভর্নরকে চিঠি লিখে, আন্দোলনকারীদের বিরোধিতা করেছিলেন-তিনি কি করে বাঙলা তথা ভারতের জাতীয়তাবাদি নেতা হতে পারেন? বামদের শ্যমাপ্রসাদ একজন বৃটিশদের পাচাটা সাম্প্রদায়িক হিন্দুনেতা।
অন্যদিকে হিন্দুত্ববাদিদের দাবী-শ্যমাপ্রসাদ না থাকলে আজকে পশ্চিম বঙ্গ, বাংলাদেশে চলে যেত। বাঙালী হিন্দুদের জন্য স্বাধীন রাজ্যের দাবী তিনিই তোলেন।
উভয়ক্ষেত্রেই “ফ্যাক্ট” সামান্য, দৃষ্টি মায়োপিক, আসল শ্যমাপ্রসাদ অন্যকেও!
প্রথমে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে আসি। শ্যমাপ্রসাদ চার বছর কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য্য ১৯৩৪-৩৮। কেন তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন স্বদেশী ঢুকতে দেন নি, সেটা বুঝতে স্যার আশুতোষ, তার বাবার আদর্শকে বুঝতে হবে। কারন ওই চারবছর, বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি তার পিতা স্যার আশুতোষের অসমাপ্ত কাজ এবং আদর্শকেই এগিয়ে নিয়ে গেছেন।
সেটা ১৯১৭ সাল। স্বাধীনতার আকাঙ্খায় বাংলার দামাল মেধাবী ছেলেরা বিপ্লবী মন্ত্রে দিক্ষিত হয়ে বোমা, বন্দুক তুলে নিচ্ছে। মেঘনাদ সাহা ফলিত গণিতে এম এস সি ক্লাসে প্রথম শ্রেনীতে দ্বিতীয় হলেন। কিন্ত পাশ করে বেকার। সাইকেল চালিয়ে টিউশুনি করেন। আর সাথে সাথে স্বদেশী আখরায় যাতায়াত শুরু। খবর গেল স্যার আশুতোষের কাছে। মেঘনাদ সাহা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অসম্ভব মেধাবী ছাত্রটি স্বদেশী হতে চলেছে। স্যার আশুতোষ ডাকলেন মেঘনাদা সাহাকে। বললেন দেখ স্বদেশী করার ছেলে প্রচুর। শুধু বোমাবাজি, আন্দোলন করলেই ভবিষ্যতের ভারত দাঁড়াবে হে ছোকরা? বিদেশীরা বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে বলিয়ান হয়ে আজ আমাদের প্রভু। তাদের সমানতালে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চায় না এগোলে, আমরা কোনদিন জাতি হিসাবে উন্নত হতে পারব না। আমি তোমার আর সত্যেনের জন্য দুটো লেকচারার পদ খুলে দিচ্ছি। বিদেশে পদার্থবিদ্যার নবযুগ শুরু হয়েছে। আমার দেশ পদার্থবিদ্যায় পিছিয়ে থাকতে পারে না। পদার্থবিদ্যার মাস্টার ডিগ্রি ক্লাশ শুরু করে দাও কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে!
আজ স্যার আশুতোষ না থাকলে সত্যেন বোস বা মেঘনাদ সাহা কেউ থাকতেন না। স্যার আশুতোষের স্বপ্ন ছিল, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হবে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড কেম্ব্রিজ, হার্ভাড। ভারতীয়রা এগিয়ে যাবে বিজ্ঞানচর্চায় সমানতালে। এবং তিনি সফল। ১৯৪০ সাল পর্যন্ত বিজ্ঞান চর্চায় কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণযুগ। এই সময় সিভি রামন শুধু বিজ্ঞানে নোবেলই আনেন নি, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন বোস, সি আর মিত্র-ইত্যাদি অনেক তরুন ভারতীয় বিজ্ঞানী জানান দিয়েছেন ভারতীয়রা মেধায় পিছিয়ে নেয়। জাতীয়তাবাদ ত শুধু বোমা বন্দুকের প্রতিবাদি রাজনীতিতে হয় না, জাতির শিক্ষা মেধার উন্নয়ন তার থেকেও গুরুত্বপূর্ন। যে গুরুদায়িত্ব নিয়েছিলেন আশুতোষ, রবীন্দ্রনাথ, সিভি রামন, সি আর টাটা, উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর মতন দিকপাল।
কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় চলত অনুদানে। এডুকেশন ডিপার্টমেন্ট থেকে অল্প সাহায্যই আসত। বৃটিশরা চাকর বাকর ভারতীয় দেখতে চায়, সত্যেন বোস, মেঘনাদ সাহার মতন দিকপাল বিজ্ঞানী তৈরীর জন্য কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে টাকা দেবে না কি? আশুতোষ সারা জীবন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমিদার, রাজাদের কাছে ভিক্ষা করেছেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই সেই কারনে উনি চাননি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যায়লে স্বদেশী রাজনীতি ঢুকুক। রাজনীতি ঢুকলে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎকর্ষতা নষ্ট হবে, অনেক মেধাবী ছাত্রদের তিনি বিজ্ঞানী শিক্ষাবিদ করে তুলেছেন, তা নষ্ট হত। ফলে আশুতোষ একদিকে যেমন স্বদেশী ভাষা এবং শিক্ষা জন্য জান লড়িয়ে দিচ্ছেন, অন্যদিকে মেধাবী ছাত্ররা যাতে স্বদেশী “বিপ্লবী” দের খপ্পরে না আসে, তার জন্য, অত্যন্ত কড়া ছিলেন।
শ্যমাপ্রসাদ তারা বাবাকেই ফলো করেছেন মাত্র। কারন তার কাছে স্বদেশী মানে বোমা আন্দোলন না, স্বদেশী ভাষা ( বাংলা হিন্দির) উন্নতি, স্বদেশী বিজ্ঞানের উন্নতি, স্বদেশী শিল্পের উন্নতি। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, তার চার বছরে এক্সাক্টলি, এই কাজগুলিই দিবারাত্র করেছেন শ্যামাপ্রসাদ। তার এই চারবছরে, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তার অবদান প্রচুর, আমি সামান্য কিছুই লিখছি।
(১) বাংলা ভাষার বিজ্ঞান ও উচ্চশিক্ষা চর্চার জন্য -কমিটি ঘটন করে, বাংলার বিজ্ঞান শব্দকোষ তৈরী করলেন। যা বাংলার প্রথম বিজ্ঞানকোষ।
(২) তার সময় থেকেই স্নাতক স্তরে ছাত্রছাত্রীরা যাতে বাংলায় পরীক্ষা দিতে পারে, সেই ব্যবস্থা হয়।
(৩) ফলিত পদার্থবিদ্যা এবং কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট শুরু হল, সেই সূত্র ধরেই কোলকাতার বিখ্যাত রেডিও ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট শুরু হবে। ইলেকট্রনিক্স সাবজেক্টের শুরু এই ফলিত ডিপার্টমেন্টেই।
(৪) কেমিস্ট্রি যাতে শুধু ক্লাসরুমে আটকে না থাকে, উনি স্পেশাল গ্রান্ট আনলেন, কেমিস্ট্রির ছাত্ররা, অধ্যাপকরা যতে নিজেরাই স্বদেশী স্টাইলে দেশেই কেমিক্যাল তৈরী করে বিদেশ থেকে না ইম্পোর্ট করে। প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এ ব্যপারে তার আদর্শ।
(৫) কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক ইতিহাস চালু হল। না উনি সাম্প্রদায়িক ছিলেন না, চলমান রাজনীতি তাকে বাধ্য করেছিল হিন্দুমহাসভা এবং আর এস এসের সাহায্য নিতে।
(৬) মেয়েরা যতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে পারে, মেয়েদের জন্যও আসন সংরক্ষন করলেন তিনি।
বাংলা ভাষার উন্নতির জন্য, আরো অনেক কিছু করেছেন, যা এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধে লেখা সম্ভব না। শুধু সেই জন্যেই বাঙালী মনে রাখতে পারে শ্যামাপ্রসাদকে। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কনভোকেশন হত ইংরেজিতে-উনিই রবীন্দ্রনাথকে প্রধান অতিথি করে, বাংলায় কনভোকেশন চালু করলেন। রবীন্দ্রনাথ যাতে বাংলার মাস্টার ডিগ্রির ক্লাস নেন, সেই ব্যপার ও পাকা করে ফেলেছিলেন গুরুদেবের সম্মতিতে। কিন্ত বাঙালী সেকালেও ছাগল এবং কূট রাজনীতি করত। যেমন একালেও করে। রবীন্দ্রনাথের “ডিগ্রী” নেই বলে সিন্ডিকেট আপত্তি তুললো! যদিও শ্যামাপ্রসাদ, তা ওভাররুল করেন, কিন্ত গুরুদেব কিছু সিন্ডিকেট মেম্বারদের এই আপত্তিতে ব্যথিত হয়ে, শ্যামাপ্রসাদকে ফিরিয়ে দিলেন।
একমাত্র বাঙালীর মতন নির্বোধ জাতির লোকজনই বোধ হয় পারে বাংলা সাহিত্যের একমাত্র নোবেল প্রাইজ বিজেতার বাঙলায় মাস্টার ডিগ্রির ক্লাসে পড়ানোর যোগ্যতা আছে কি না, সেই নিয়ে প্রশ্ন তুলতে! কারন রবীন্দ্রনাথের কোন ডিগ্রি নাই! কি মারাত্মক!
সুতরাং আজকে সেই আহাম্মক বাঙালী জাতির উত্তরপুরুষরা যখন শ্যমাপ্রসাদ স্বদেশী শিক্ষা, বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা, দেশীয় শিল্প, নারীশিক্ষার জন্য কি করেছিলেন সেটা না জেনে, শুধু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে স্বদেশী আন্দোলনকারিদের প্রতি কঠোর ছিলেন কেন, সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, তখন অবাক হওয়ার অবকাশ নেই। বাঙালী অমনই। তারা রবীন্দ্রনাথের ডিগ্রিগত যোগ্যতা দাবী করতে পারে, স্বদেশী বলতে শুধু বোমাবাজি, মিছিল বুঝতে পারে। বাঙালী চিত্তের বুদ্ধিবিদ্যার যা “হাল” তাতে এর বেশী কিছু আশা করা অন্যায়।
(৩) এবার আসি কুইট ইন্ডিয়া মুভমেন্ট, ভারত ছাড় আন্দোলনে শ্যামাপ্রসাদের ভূমিকা নিয়ে। সেটা ১৯৪২ সাল। এবং এটা সত্য, তখন তিনি বৃটিশ সাথে, স্বদেশী আন্দোলন, বিশেষত কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। কিন্ত কেন ?
কারন তখন তিনি হিন্দুমহাসভার নেতা। বৃটিশদের সাথে সহযোগিতা করে, হিন্দুদের জন্য সুযোগ বেশী করে দেওয়াটাই যে পার্টির একমাত্র রাজনীতি ছিল।
আজকে বিজেপির পূর্বাসূরী, অখিল ভারত হিন্দু মহাসভা, কেন বৃটিশদের পাচাটার রাজনীতি করত?
এটা বুঝতে পারলেই বুঝবেন, এদ্দিন ধরে আমি যা বলে আসছি, যে ভারতের হিন্দুত্ববাদি রাজনীতি, ইসলামিক মৌলবাদি রাজনীতির রিয়াকশন ছাড়া কিছু না, তা আরো স্পষ্ট হবে।
সুতরাং আসুন, স্বাধীনতার পূর্বে এই হিন্দুমহাসভার রাজনীতির সাথে আমরা পরিচিত হই।
হিন্দু মহাসভার সৃষ্টি শ্রেফ মুসলীম লীগকে কাউন্টার করতে। সুতরাং মুসলিম লীগের রাজনীতি কি, কেন তারা ইতিহাসে আলো করে এল, সেটাও বুঝি চলুন। মুসলিম লীগের জন্ম ১৯০৬ সালে। কংগ্রেস তখন একটা হিন্দুদের দলে পরিনত। ভারতের অধিকাংশ উচ্চপদস্থ চাকরি হিন্দুদের দখলে। স্বভাবতই শিক্ষিত মুসলমানরা “মার্জিনালাইজড” বোধ করলেন। এবং ভারতে মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকারের জন্য ১৯০৬ সালে মুসলীম লীগ তৈরী হল।
বৃটিশরা হাতে মোয়া পেল। মর্লি মিন্টো সংস্কার, যার দরুন ভারতে প্রথম গনতান্ত্রিক ভোটাভুটি-বা স্থানীয় স্বয়ত্ব শাসনের শুরু, তারা মুসলীম লীগের সব দাবী স্বীকার করে। কারন তখন বৃটিশরা বুঝেছে, মুসলীম লীগ তাদের তুরুপের তাস-কারন এই লীগকে সামনে রেখে তারা রাজনীতি এবং সরকারি কাজে মুসলমানদের জন্য সংরক্ষণ করবে। যেহেতু সরকারি চাকরি, শিক্ষা সর্বত্রই হিন্দুদের প্রাধান্য, এই ধরনের আইন হিন্দু-মুসলমান বিভেদ সৃষ্টি করবে, ভারতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি শুরু হবে। ১৯০৯ সালে মর্লি-মিন্টো সংস্কার ছিল, সেই দাবার প্রথম চাল। বোরেটাকে প্রথম এগোনো। সেখানে মুসলীম লীগের দাবী মেনে নিয়ে, মুসলিম এবং হিন্দুদের জন্য আলাদা প্রতিনিধিত্ব চালু হয়।
মর্লি-মিন্টো সংস্কারে আইন সভায়, মুসলীমদের জন্য আলাদা প্রতিনিধিত্ব থাকায়, প্রমাদ গনলেন উত্তর-পশ্চিমের হিন্দুরা যেখানে মুসলমানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। অনেক বড় মার্জিনে। সেই জন্য ১৯১০ সালটা হচ্ছে হিন্দুত্ববাদি রাজনীতির আঁতুর ঘর। ওই বছর পাঞ্জাব, সিন্ধ দিল্লী ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্স- যেখানে হিন্দুরা সংখ্যালঘু- সর্বত্রই প্রাদেশিক হিন্দু সভা গঠিত হল। উদ্দেশ্য এরা একটি অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা গড়বেন। যার কাজ হবে, মুসলীম লীগের রাজনীতিকে কাউন্টার করা। হোতা মদন মহন মালব্য, লালা লাজপত রায়।
সেই মোতাবেক আমলাতে ১৯১৩ সালে হিন্দু মহাসভার প্রথম অখিল ভারতীয় অধিবেশন হয়। প্রথম প্রেসিডেন্ট এক বাঙালী- কুচবিহারের মহারাজা মহিন্দ্র নন্দী। প্রথম অধিবেশনেই মত এবং পথ নিয়ে সাংঘাতিক গন্ডোগল। কারন এই হিন্দু মহাসভার আহ্বায়করা অধিকাংশই উত্তর-পশ্চিমের “পলিটিক্যালি এনলাইটেন্ড” উচ্চশিক্ষিত হিন্দু। রক্ষনশীল হিন্দু এরা নন, অধিকাংশই ছিলেন আর্যসমাজি। সুতরাং জাতিভেদ প্রথাকে নিন্দা করে অখন্ড হিন্দু জাতির প্রস্তাব পাশ হয়, কিন্ত বৃটিশদের সাথে সহযোগিতার লাইন ও ঘোষিত হয়। বৃটিশদের পা চাটার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন আর্য্য সমাজের বিখ্যাত সন্ন্যাসী স্বামী শ্রদ্ধানন্দ । কিন্ত দেখা গেল অধিকাংস সদস্য, মুসলীমের লীগের হনুকরনেই বিশ্বাসী-তাদের ধারনা বৃটিশ মহলে প্রভাব না ফেললে-মুসলীম লীগ চাকরি, বাকরি-আইন সব নিয়ে যাবে। সেই লাইনেই চলেছে হিন্দু মহাসভার রাজনীতি। যাতে ১৯৩৬ সালে জয়েন করেছেন শ্যমাপ্রসাদ -কিছুটা বাধ্য হয়ে, কিছুটা সাভারকরের প্রভাবে।
অর্থাৎ বিজেপির জন্ম মুসলীম লীগের রাজনীতির হনুকরনে। সুতরাং তাদের হিন্দুত্ববাদ যে ইসলাম ২ ভার্সান হবে, সেটাই স্বাভাবিক এবং ঐতিহাসিক ও বটে।
হিন্দু মহাসভা , বলাই বাহুল্য রাজনৈতিক দিক থেকে ব্যর্থ এক সংগঠন ছিল। কারন জাতিভেদ, বর্ণহিন্দুত্বের বিরুদ্ধে এই সংগঠন শুরু হলেও অচিরেই তা বর্ণহিন্দুদের সংগঠনে পরিণত হয়। তাছাড়া, বৃটিশদের পাচাটার কারনে তাদের গ্রহনযোগ্যতাও কমে আসে। গান্ধী, নেহেরু, সুভাষের মতন মেধাবী নেতা তারা পায় নি।
এবার দেখাযাক শ্যমাপ্রসাদ হিন্দু মহাসভায় যোগ দিলেন কেন। উনি রাজনীতি শুরু করেছিলেন কিন্ত কংগ্রেসের সদস্য হিসাবে আইনসভায় ১৯২৯ সালে। ১৯৩০ সালে কংগ্রেসে “ আইন অমান্য আন্দোলন “ - লবন সত্যাগ্রহের জন্য সব নির্বাচিত সদস্যকে আইনসভা থেকে পদত্যাগ করতে বলে। ফলে শ্যামাপ্রসাদের আর আইনসভায় থাকা হল না। কিন্ত উনি ইন্ডিপেন্ডেট ক্যান্ডিডেট হিসাবে বাংলার আইন সভায় আবার এলেন ১৯৩১ সালে। কংগ্রেস যেহেতু আইন সভা বর্জন করেছে, সেহেতু বাংলার আইন সভায় তখন হিন্দুদের প্রতিনিধি বলতে শুধু শ্যামাবাবু- বাকী সবাই মুসলিম লীগ, বা ফজলুল হকের কৃষক প্রজাপার্টি।
যেহেতু বাংলার আইনসভায় তখন কৃষক প্রজাপার্টি এবং মুসলীম লীগের একাধিপত্য,সমস্ত চাকরি, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে মুসলীমদের জন্য সমানুপাতিক “সংরক্ষন”-অর্থাৎ ৫৪% সংরক্ষন চালু হল। সেই সময় বাংলায় টোট্যাল ৫৪% মুসলমান, কিন্ত শিক্ষা, চাকরি ইত্যাদি ক্ষেত্রে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব ৫% এর ও নীচে। ফলে এটা হওয়ারই ছিল।
এতে বর্নহিন্দুরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়, যেহেতু হঠাৎ করে তারা দেখে, চাকরির ক্ষেত্র, শিক্ষার ক্ষেত্র সংকুচিত। শিক্ষিত বর্নহিন্দুরা ক্ষেপে ওঠে-কিন্ত কংগ্রেস মুসলীম লীগ এবং কৃষক প্রজাপার্টির এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কিছু করবে না। শ্যমাপ্রসাদ এর বিহিত করতে সুভাষ বোস, নেহেরু, গান্ধী-সবার কাছেই দরবার করেছেন। কিন্ত কংগ্রেস তাকে পাত্তা দিল না-কারন মুসলমানদের ৫৪% সংরক্ষন দরকার ছিল। যেহেতু তারা শিক্ষা এবং চাকরির ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছে।
এই সুযোগ নিল হিন্দু মহাসভা। সাভারকর দেখা করলেন শ্যামাপ্রসাদের সাথে। বল্লেন দেখ শ্যামাবাবু, কংগ্রেস মুসলীম স্বার্থই দেখবে, তুমি সময় নষ্ট না করে হিন্দু মহাসভায় যোগদাও। তোমার মতন সংগঠককে হিন্দু মহাসভার দরকার। এদ্দিন ধরে হিন্দুদের স্বার্থ রক্ষার জন্য কংগ্রেসের সব নেতার কাছে গেছেন। সুভাষ তার বন্ধুতুল্য। সুভাষ বোস ও কোলকাতা মিউনিসিপ্যালিটির চাকরিতে মুসলমানদের সংরক্ষনের পক্ষে! বুঝলেন হিন্দুমহাসভাই হবে তার প্ল্যাটফর্ম। তিনি তার প্রেসিডেন্ট ও হলেন।
এখানে বুঝতে হবে শ্যমাপ্রসাদ আদতে একজন প্রগতিশীল শিক্ষাবিদ, কংগ্রেসই তার ন্যাচারাল প্ল্যাটফর্ম। ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি বৌদ্ধধর্ম অনুরাগী, মহাবোধি সোশাইটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সমস্ত বৌদ্ধদেশ ভ্রুন করেছেন। ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারে অনেক কিছু করেছেন। এমন এক উদার প্রগতিশীল শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি কি করে হিন্দুমহাসভার আশ্রয় নিতে বাধ্য হল?
এর উত্তর জটিল কিছু না। আজকে প্রগতিশীল নাস্তিক বাঙালীর অধিকাংশই বিজেপি প্রেমী হচ্ছে। কেন? কারন তারা দেখছেন কংগ্রেস এবং তথাকথিত সেকুলার পার্টিগুলো ইসলামিক মৌলবাদ ঠেকাতে কিছু করছে না। অধিকাংশ মুসলমান ত, তাদের মধ্যে বর্ধিত মৌলবাদকে স্বীকার করতেই রাজী না। শ্যামাপ্রসাদের কেসটাও তাই। উনি দেখলেন মুসলীম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ঠেকাতে কংগ্রেস কিছুই করছে না-যদিও তিনি লীগকে ঠেকাতে কংগ্রেসের স্বরণাপন্ন হয়েছেন অনেকবার। ফলে বাধ্য হয়েই তিনি হিন্দু মহাসভার রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন। সেই ধারাই এখন বর্ধিষ্ণু- সর্বত্রই দেখছি শিক্ষিত হিন্দু যুবসমাজের মধ্যে ধর্ম নিরেপেক্ষ রাজনীতি নিয়ে “সঙ্গত কারনেই” বিরাট ডিসিল্যুউশনড”। আশাহত। ফলে গোবলয়ের রাজনীতির স্বরণাপন্ন হচ্ছেন তারা, যাদের ক্যাডারবেসের সাথে, এই প্রগতিশীল হিন্দু বাঙালীদের কোন মিলই নেই।
এবার ফিরে আসি কুইট ইন্ডিয়া মুভমেন্ট প্রসঙ্গে। ১৯৪২ সালে শ্যমাপ্রসাদ তীব্র কংগ্রেস বিরোধি। ফলে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে গর্ভনরকে লিখবেন সেটাই স্বাভাবিক। কিন্ত তার বিবেক জাগ্রত ছিল। সেই বছরই নভেম্বর মাসে শ্যামা-হক মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন। বৃটিশদের বিরুদ্ধে সেই ছিল তার প্রথম প্রতিবাদ। এবং তিনি সেটা করলেন তমলুকের মানুষদের জন্য। তমলুক তখন ভারত ছাড় আন্দোলনের ঘাঁটি। স্বাধীন তাম্রলিপ্ত সরকার সেখানেই তৈরী হয়েছে। সেই বছর আছড়ে পড়ল ঘূর্নিঝড়। দশ হাজার লোকের মৃত্যু। অসংখ্যলোক খাদ্যহীন, বস্ত্রহীন। কিন্ত বৃটিশ নির্লিপ্ত। তমলুকবাসীকে শিক্ষা দিতে হবে। এই প্রথম বৃটিশদের ওপর বিরক্ত হলেন শ্যামাপ্রসাদ। মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ করে ঝড় বিধ্বস্ত এলাকার লোকেদের সেবায় নিয়োজিত হলেন। ১৯৪৩ সালেও তিনি রাজনীতির থেকে অবসর নিয়ে দুর্ভিক্ষে পীড়িত লোকেদের সেবা করেছেন। তার সেবাকার্যের সব থেকে বড় সঙ্গী ছিল বিধানচন্দ্র রায়। তিনি মাতঙ্গিনী হাজরা বিরুদ্ধে গুলি চালানোর প্রতিবাদ করেন নি, এই তথ্যও ঠিক না। না তিনি তার জন্য পদত্যাগ করেন নি, কিন্ত বৃটিশ পুলিশের ভূমিকা “এক্সেসিভ” এবং “রিগ্রেসিভ” ছিল, তা কিন্ত বলেছেন। সুতরাং হিন্দুমহাসভার লাইন মেনে তিনিই শুধুই বৃটিশদের পা চেটেছেন, এ কথা ঠিক না।
(৪) আবার আসি আরেকটি বিতর্তিক প্রশ্নে। শ্যামাপ্রসাদকে পশ্চিম বঙ্গ সৃষ্টির কৃতিত্ব দিয়ে হিন্দুত্ববাদিদের অনেক পোষ্ট দেখি। এটিও ইতিহাসের অতিকথন, অসৎকথন না হলেও। আমি এটাকে রাজনৈতিক প্রপাগান্ডাই বলব।
ক্যাবিনেট মিশন (১৯৪৬) ব্যর্থ হল মুসলীম লীগ এবং কংগ্রেসের মধ্যে সমঝোতা করতে। অখন্ড ভারত সম্ভব না, সবাই বুঝেগেছে। এর মধ্যে বৃটিশরা চাইছিল, যাতে ১৯৪৮ সালের জুন মাসের আগেই ক্ষমতার হস্তান্তর হয়। ১৯৪৭ সালের মার্চ মাসে মাউন্ট ব্যাটেন এলেন ভারত ভাগের পরিকল্পনা নিয়ে। তাতে পরিস্কার ভাবেই ছিল, বাংলা এবং পাঞ্জাব ভাগের জন্য রেফারেন্ডাম হবে। সেই সময় কোলকাতা এবং নোয়াখালির দাঙ্গার পরে, হিন্দু মুসলমান একসাথে থাকতে চাইছিল না। কারন অবিশ্বাসের পরিস্থিতি। গান্ধীও নোয়াখালি ঘুরে হাল ছেড়ে দিয়েছেন।
এই সময় শরত বসু, ফজলুল হক, সুরাবর্দীরা চাইছিলেন স্বাধীন অখন্ড বাংলা সরকার। যা মুসলীম লীগ এবং কংগ্রেস দুজনেই অস্বীকার করে মানতে। ফলে বাংলা ভাগের রেফারেন্ডেম তৈরী হয় এবং আইন সভায় তা পাশ হয়।
সুতরাং পশ্চিম বাংলার গঠনের ক্ষেত্রে দুটি ঘটনা দেখা যাচ্ছে
(১) ক্যাবিনেট মিশনের ব্যর্থতা-যেখানে ইন্ডিয়ান ইউনিয়ানের ধারনা খারিজ হল। ফল এই যে ভারত ভাগের ম্যান্ডেট নিয়ে মাউন্টব্যাটন এলেন। সেটা মার্চ মাস, এবং তাতে বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগের ক্ষেত্রে রেফারেন্ডেমের কথা ছিল।
(২) দেখা গেল বাংলার মুসলিম নেতারা পূর্বপাকিস্তানের ধারনার বিরোধি। তারা অখন্ড স্বাধীন বাংলা কিছু হিন্দু নেতাদের সাথে চাইলেন, পূর্ব পাকিস্তান চাইলেন না। কিন্ত কংগ্রেস এবং মুসলীম লীগ, তার বিরোধিতা করার কারনে, সেই প্রস্তাব এগলো না। ফলে বাংলা ভাগ নিশ্চিত হয়।
এক্ষেত্রে শ্যামাপ্রসাদের অবদান
১) শ্যমাপ্রসাদ ও অখন্ড স্বাধীন বাংলার বিরোধি ছিলেন। কিন্ত তার বিরোধিতায় কিস্যু যায় আসত না, আসেও নি-কারন মাউন্টব্যটন কংগ্রেস এবং মুসলীম লীগকেই ভারতের “ রিপ্রেজেন্টেশন” হিসাবে ধরেছেন। কংগ্রেস এবং মুসলীম লীগের নেতারা অখন্ড বাংলার ধারনা বাতিল করার জন্যই, বাংলা ভাগ নিশ্চিত হয়। হিন্দুদের প্রতিনিধি হিসাবে বৃটিশদের কাছে হিন্দুমহাসভা কোনদিনই পাত্তা পায় নি-কংগ্রেসকেই তারা হিন্দুদের প্রতিনিধি হিসাবে ধরত।
২) বলা হয় ১৯৪৭ সালের মে মাসে শ্যমাপ্রসাদ মাউন্টব্যাটনকে লেখেন বাংলা ভাগের জন্য। তাতে কি? তার দু মাস আগেই মাউন্টব্যটন বাংলা ভাগের রেফারেন্ডেম নিয়ে ভারতে এসেছেন। সব থেকে বড় কথা হিন্দু মহাসভার কোন নেতাকে তাদের পাত্তা দেওয়ার কথাও না-বৃটিশদের কাছে সর্বদাই কংগ্রেসই হিন্দুদের প্রতিনিধিত্ব করে।
সুতরাং শ্যামাপ্রসাদের জন্যই পশ্চিম বঙ্গ রাজ্যের জন্ম হয় এটা শ্যামাপ্রসাদকে বাঙালীদের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করার বৃথা রাজনৈতিক চেষ্টা। যার কোন দরকারই নেই। কারন শ্যমাপ্রসাদ বাংলা ভাষার জন্য যা করেছেন, সেটাই যথেষ্ট তার লেগাসির জন্য। কিন্ত মুশকিল হচ্ছে বাঙালী হিন্দুত্ববাদিদের মধ্যে বুদ্ধিজীবির বড় অভাব।
(৫) এবার আসি স্বাধীনতার পরবর্তী শ্যামাপ্রসাদকে নিয়ে। তার রাজনীতি কি সত্যিই খুব বেশী সাম্প্রদায়িক ছিল ? প্রগতিশীলতার বিরোধি ছিল?
কতগুলো জিনিস জানা দরকার।
এক, প্রথম নেহেরু মন্ত্রীসভায় মোটে দুজন কংগ্রেস বিরোধির নাম গান্ধীজি নিজে সুপারিশ করেছিলেন নেহেরুকে। তার মধ্যে একজন শ্যামাপ্রসাদ, অন্যজন আম্বেদকর। কেন? শ্যামাপ্রসাদের রাজনীতি এত সাম্পদায়িক হলে গান্ধী তার নাম সুপারিশ করতেন না।
দুই, ১৯৫১-৫৩, খুব সংক্ষিপ্ত তার সাংসদীয় জীবন। তিনি ছিলেন বিরোধি দলনেতা। তার প্রতিষ্টিত জনসঙ্ঘ তখন বাকী সব বিরোধি দল, কমিনিউস্টদের সাথেও হাত মিলিয়ে কাজ করছে নেহেরু তথা কংগ্রেসের স্বৈরাচার, অগনতান্ত্রিক সিদ্ধান্তকে রোখার জন্য। হিরেন মুখার্জি, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় সহ অনেক কমিনিউস্ট নেতাই তার গুনমুগ্ধ ছিল। কি কি ব্যাপারে তিনি নেহেরুর বিরোধিতা করেছেন ?
- ৩৭০ , যা ভারতে কাশ্মীরকে স্পেশাল স্ট্যাটাস দেয়।
- ইউনিফর্ম সিভিল কোড
-আরো বেশী বাকস্বাধীনতার দাবী
- রাজ্যের হাতে আরো বেশী ক্ষমতা
সহযোগিতাও করেছেন নেহেরুকে। জমিদারি বিলোপ আইনের ক্ষেত্রে। ১৯৫১ সালে জন সঙ্ঘের এম পি ৩ জন, এম এল এ ৩৫। তিনজনের দুজন বাংলার, একজন রাজস্থানের। এম এল এর মধ্যে ৭ জন বাংলার , ৬ জন রাজস্থানের। কিন্ত রাজস্থান লবির সবাই জমিদার বংশের । তারা বললো, তারা কেন নিজেদের বিরুদ্ধে ভোট দেবে। শ্যমাপ্রসাদ বল্লেন দিতে হবে, কারন সেটাই আমাদের ম্যানিফেস্টো। রাজস্থান লবিকে বহিস্কার করেন তিনি। ক্ষমতার জন্য আপোশ করেন নি।লালকৃষ আদাবানী, পার্টিমিটিং অনেক বার এই গল্পটা শুনিয়েছেন দাবী করার জন্য বিজেপি্র ক্যাডারদের নিয়মনিষ্ঠ হতে হবে।
কিন্ত বাংলার বুকে যে বিজেপি শুরু হল, সেই পার্টি পশ্চিম বাংলা থেকে উঠে গেল কি করে ?
হ্যা, আজকের যে বিজেপি, তার শুরু হয়েছিল বাংলার মাটিতেই। ১৯৫১ সালের ইলেকশনে জনসঙ্ঘের এম পি, এম এল এদের অধিকাংশই পশ্চিম বাংলার। কিন্ত তারা উঠে গেল।
সেই গল্প অন্যদিন। জন সঙ্ঘ গঠনের সময়, আর এস এসের সাহায্য নিলেন শ্যামাপ্রসাদ। গুরু গোলাওয়াকার এবং শ্যমাপ্রসাদ দুজনেই হিন্দুত্ববাদি রাজনীতি করলেও, শ্যামাপ্রসাদের রাজনীতি ছিল অনেক প্রগতিশীল। শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুর পর আর এস এস বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ, জনসঙ্ঘের রাজনীতি সম্পূর্ন ভাবে নিজেদের হাতে আনে। যা এখনো চলছে। শ্যামাপ্রসাদের রাজনীতি গোরক্ষার রাজনীতি, দাঙ্গা বাঁধানোর রাজনীতি ছিল না। দাঙ্গার বিরুদ্ধে দাঙ্গার রাজনীতি, সামরিক শিক্ষা -এই মার্শাল বা মারেঙ্গা টাইপের হিন্দু রাজনীতির প্রবক্তা আর এস এস। হিন্দু মহাসভা ছিল শ্রেফ দাবী আদায়ের রাজনীতি। আর এস এসের প্রতিষ্ঠাতা গুরু কেশব বলরাম হেডগেওয়ার ডাক্তারী পড়তে কোলকাতায় আসেন। এসে অনুশীলন সমিতিতে যোগ দেন। অস্ত্র শিক্ষা স্বদেশী শিক্ষা পেলেন। পুনেতে গিয়ে বৃটিশ বিরোধি কার্যকলাপ করতে গিতে জেল খাটলেন। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তার মোহভঙ্গ হয়। ভারতের ইতিহাসে যারা সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাসী ছিলেন, বৃটিশদের জেল খাটার পর, তারা হয় কমিনিউস্ট আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন, না হলে আর এস এসে। কেন? কারন গুরু হেডগেওয়ার দেখলেন এই ভারতীয়দের দিয়ে রাজনীতি হবে না। এটা হাঁটতেই শেখে নি, দুর্বল শরীর, দৌঁড়াবে কি? ফলে হিন্দুদের অস্ত্র শিক্ষায় শিক্ষিত করার দীক্ষা নেন। সেই সুযোগ হাতে আসে গান্ধীর ভ্রান্ত খিলাফত আন্দোলনের ফলে। যার জন্য দক্ষিন ভারতে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা শুরু হয়। নাগপুরে প্রথম দাঙ্গায় হিন্দুরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। দুবছর বাদে আর এস এস পালটা দাঙ্গা বাধায় নিজেদের শক্তি প্রদর্শনের জন্য। এবার নাগপুরের অনেক মুসলমান শহর ছাড়তে বাধ্য হয়।
আর এস এসের ইতিহাস নিয়ে অন্যকোন স্থানে লিখব। কিন্ত যেটা লিখতে চাইছি, সেটা হচ্ছে এই যে আজকের যে বিজেপি, সেটা আর এস এসের, গুরু হেডগেওয়ারের রাজনৈতিক সন্তান। এটা শ্যামাপ্রসাদের রাজনৈতিক আদর্শ না। সুতরাং আজকের বিজেপিকে দেখে শ্যামাপ্রসাদকে মুল্যায়ন করা ভুল হবে।
(৬) আমি হিন্দুত্ববাদ এবং বামপন্থী, দুই ধরনের রাজনীতিরই বিরোধি। আমার কাছে বাম ও রাম এক মুদ্রার দুই পিঠ। মুদ্রাটা হচ্ছে “ভিক্টিমাইজেশনের গল্প ফেঁদে” রাজনীতি। হিন্দুত্ববাদের রাজনীতির ভিত্তি “হিন্দুরা ঐতিহাসিক ভাবে মুসলমানদের হাতে নির্যাতিত”। বাম রাজনীতির ভিত্তি কৃষক শ্রমিক ধনী শ্রেনীর হাতে নির্যাতিত। আপনি বলবেন, এই দুই গ্রান্ড ন্যারেটিভই ত ঠিক। কিন্ত এই ধরনের ভিক্টিমাইজেশনের রাজনীতিই পৃথিবীতে হিটলার, লেনিন, স্টালিনদের মতন দানবদের জন্ম দিয়েছে। সুতরাং সেই পথ কাম্য না। কারন গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের আড়ালে সত্য , জ্ঞান, কর্ম সবই চাপা যায়। আমি আগেও লিখেছি, সেই রাজনীতিই সফল হয় যা জ্ঞান, বুদ্ধি, বোধ এবং “ফ্যাক্ট” ভিত্তিক। সব থেকে বড় কথা এটা জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তির যুগ। একমাত্র প্রযুক্তির মাধ্যমেই দেশের , সমাজের ব্যক্তির উন্নতি সম্ভব। সুতরাং শিক্ষা ও প্রযুক্তি ভিত্তিক ব্যবসা করার সুযোগ, এটাই হওয়া উচিত এই যুগের রাজনীতি। কিন্ত ভোট সর্বস্ব রাজনীতি হিন্দু মুসলমানের পরিচয়টাই আগে এনে দিচ্ছে। এটাই আজকের দিনের লিব্যারাল রাজনীতির ব্যর্থতা। কারন ভোটের জন্য, প্রতিটা রাজনৈতিক দলের নেতাদের মাথা সাম্প্রদায়িক নেতাদের কাছে বিক্রিত।