জীবন ও জীবিকা সংক্রান্ত গ্রুপগুলোর মধ্যে অনেকেই আছেন রামকৃষ্ণ মিশনের দীক্ষিত। অথবা তাদের ছেলেমেয়েরা রামকৃষ্ণ মিশনে পড়ছে।
গত কয়েকদিন ইস্কনের অঘোরদাস এবং বেশ কয়েকটি যুক্তিবাদি গ্রুপ, রামকৃষ্ণ মিশন, স্বামী বিবেকানন্দ এবং শ্রীরামকৃষ্ণ নিয়ে কিছু প্রশ্ন তোলায় ( অনেকের ভাষায় তা অপমান করার জন্য, তাদের হেয় করার জন্য ) তারা মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত। কারন সেই মর্মে আমি অনেক চিঠি পাচ্ছি। অনেকেই আমাকে অনুরোধ করেছেন, কিছু যদি কিছু লিখি-এই ব্যাপারে।
# ১ আমি ধর্ম এবং রাজনীতি সংক্রান্ত লেখা থেকে দূরে থাকায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাই এর পক্ষে বা বিপক্ষে কিছুই লিখব না। কারন আগেই লিখেছি। বাঙালীদের মধ্যে ধার্মিক, নিধার্মিক, বাম, ডান, যুক্তিবাদি-সবাই অজ্ঞানের অন্ধাকারে ডুবে আছে। এদের ভালোর জন্যে কিছু বলতে গেলে, বোঝার থেকে ভুল বোঝে। মূল সমস্যা। এরাও সেই মুখস্থ বিদ্যা, টিউশনির প্রোডাক্ট। প্রাইমারী বা সেকেন্ডারী স্কুলের লেভেলে ইতিহাস , যুক্তিবিদ্যা কিস্যুই পড়ে নি। বা পড়েও বোঝে নি। কিন্ত লেখার সময় ভাব দেখাবে পি এই চ ডি করে এসেছে। এরাই বাঙালী বুদ্ধিজীবি। এদের পক্ষে স্বামী বিবেকানন্দ বা শ্রীরামকৃষ্ণর দর্শন বা ভারতীয় দর্শন বোঝা সম্ভব না। তার জন্য ম্যাচিউরিটি লাগে। তারজন্য গোটা ভারত খালি পায়ে , খালি পকেটে ঘুরতে হবে। সব শ্রেনীর মানুষের সাথে মিশতে হবে। শুধু বই পড়ে, বিবেকানন্দকে বোঝা সম্ভব না।
#২ বিবেকানন্দের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ-তার লেখায় স্ববিরোধিতা। কখনো সতীদাহের সমর্থনে বলেছেন। কখনো বিরুদ্ধে বলেছেন। প্রয়াত অভিজিত রায়, যিনি আমার খুব ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন, তিনিও এই অভিযোগ তুলে এক বিরাট লেখা লিখেছিলেন। বর্তমানে যুক্তিবাদিদের তোলা অভিযোগগুলো ঠিক তাই।
# ৩ তথ্যের দিক দিয়ে তাদের লেখা বা প্রশ্ন ঠিক। কিন্ত মুশকিল হচ্ছে -ইতিহাসের কনটেক্সট ভুলে গেলে, ইতিহাসের এমন কোন ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি ভিলেন না। আজ আমেরিকা সব থেকে শক্তিশালী দেশ কারন এর সংবিধান। পলিটিক্যাল স্ট্রাকচার। তার জনক কে? আমেরিকার তৃতীয় প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন। রাজনীতি বিজ্ঞানে তার মতন জ্ঞানী ব্যক্তি পৃথিবীর ইতিহাসে জন্মায় নি। বস্তত, আজ তার দূরদর্শিতায়, আমেরিকা এত শক্তিশালী দেশ হিসাবে আবির্ভূত। কিন্ত বর্তমানে আমেরিকাতেও প্রচুর র্যাডিকাল লোকজন। যার দরুন তার মূর্তি ভেঙে ফেলা হচ্ছে। কেন? কারন তিনি বাজে লোক ছিলেন। কেন? কারন তার প্রচুর দাস ছিল। এবার সমস্যা হচ্ছে সেই সময় সব নেতাদের দাস ছিল। জেফারসন তার নিজেদের দাসেদের প্রতি খুব সদয় ছিলেন। একজন ক্রীতদাসীর সাথে তার চারটি সন্তান ও ছিল [ তার স্ত্রী মারা যাওয়ার পর ]। সেই সন্তানদের তিনি বৈধ স্বীকৃতিও দিয়েছেন। এগুলি সেই যুগের জন্য স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্ত তারজন্য আমেরিকার সংবিধানের রূপকারের, দেশের রূপকারের মূর্তি ভাঙা? নক্সালরা একদা এইভাবেই রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙেছেন।
# ৪ বিবেকানন্দকে বুঝতে গেলে তার সময়টা, তার সামনে থাকা চ্যালেঞ্জটাকে বুঝতে হবে। সেটা না বুঝে, তিনি কোথায় কি বলেছেন, তার ভিত্তিতে তাকে বিচার করতে গেলে, যেটা হবে- সেটা এই রকম- আজকে আমরা যারা পুরুষ আছি-তারা সবাই দ্বাবিংশ শতাব্দিতে ভিলেন বলে প্রতিপন্ন হব। কেন? কারন আমরা বিবাহ করিয়াছি। আর আমি নিশ্চিত ২১০০+ সালের পরে যারা ইতিহাস লিখবে, তারা বলবে, এই পুরুষটা বিয়ে করেছিল মানে ভিলেন-কারন বিয়ে হচ্ছে "নারীর দাসত্বের সুইট লিগ্যালাইজেশন"।
#৫
বিবেকানন্দের নতুন ভারত গড়ার কাজটা খুব কঠিন ছিল। তিনি তাত্ত্বিক সন্ন্যাসী নন। তিনি একই সাথে স্যার জামসেদজি টাটাকে ইন্ডিয়ান ইন্সটিউট অব সায়েন্স গড়ার জন্য অনুপ্রানিত করছেন-আবার ভারতের রাজা-মহারাজাদের জীবন পতিত জেনেও, তাদের অতিথেয়তা, তাদের সাহায্য তাকে নিতে হয়েছে। অঘোর দাস বা বর্তমানে বাঙালী যুক্তিবাদি পর্যন্ত যেতে হবে না। গুরুভাই ব্রহ্মানন্দও অনেক ক্ষেত্রে আপত্তি করেছেন। কিন্ত ব্রহ্মানন্দকে টাকার জোগার করতে হত না। বিবেকানন্দকে করতে হত। ফলে তাকে অনেক কিছুই বলতে হয়েছে, যা সেই স্থানে, সেই জনের জন্য গ্রহনযোগ্য হয়।
#৬
উনি নিজেও জানতেন এর জন্য লোকে উনাকে ভুল বুঝবে। কারন টাকার জোগারযন্ত্র করতে গিয়ে উনাকে সেইসব লোকেদের সাথে মিশতে হচ্ছে, অতিথেয়তা নিতে হচ্ছে-যাদের টাকা আছে। অনেক কিছুই বলেছেন বক্তা হিসাবে- শ্রোতাদের খুশী করার জন্য। কারন , লেকচার থেকে টাকা তুলতে হবে। নাহলে ভারতে তার কর্মযজ্ঞ থেমে যাবে।
কোনটা আগে? ভারতের উন্নতি? না ভবিষ্যতে মি"ঃ এক্স তার স্ববিরোধিতার সমালোচনা করবেন-তাই তিনি পদ্মাসনে যোগী হয়ে থাকবেন? ভারতবাসীর কথা ভাববেন না?
এটা সিম্পল লজিক। এখানে বাচ্চাদের জন্য এই শিক্ষাপ্রজেক্টে কাজ করতে, অনেকেই অনেক কটু কথা বলছে। কিন্ত তাদের কথা শুনে কি আমি পিছিয়ে আসব? আমি এইসব ভুল্ভাল লোকেদের সমালোচনাকে গুরুত্বদেব-না বাচ্চাদের জন্য যেটা করা দরকার আগে, সেটার দিকে গুরুত্ব দেব?
স্বামীজির চিঠি পড়ুন। উনিও জানতেন। সমালোচনা হবে। কিন্ত কাজটা আসল। সমালোচনা হবে, তাই কাজ থেকে পিছিয়ে এসে পদ্মাসনে বসে বাতাসা কুড়াবেন, সেই সন্ন্যাসী তিনি নন।
কাজে নামলে, টাকা লাগে। আর টাকার গায়ে একটু গন্ধ থাকবেই। কিছু করার নেই। নেচার অব মানি।
#৭
স্বামী বিবেকানন্দকে ভুল বোঝা স্বাভাবিক। উনাকে বুঝতে গেলে, উনার প্রতিটা চিঠি পড়তে হবে। উনার সমসাময়িক ইতিহাস বুঝতে হবে। উনি কি চেয়েছিলেন বুঝতে হবে। উনি কি পরিস্থিতিতে কি করেছিলেন, সেটা গভীরে না বুঝলে, বদহজম হবে। তাই উনাকে যারা ভুল বুঝেছেন-তাদের প্রতি আমার ক্ষোভ নেই। কারন মানুষ কম পড়লে, কম বুঝলে, অমন মহান ব্যক্তিকে ভুল বোঝে।
অত সহজে যদি স্বামী বিবেকানন্দকে সব বাঙালী বুঝে যেত-অত বোদ্ধা, অত বিজ্ঞ, অত জ্ঞানী যদি বাঙালী হত - এই রাজ্যের রাজনৈতিক হাল-এত দুরাবস্থা হয় না।
#৮
আমি কোন ধার্মিক লোক নই। কোন ধর্মাচরনে আমি নেই। রবীন্দ্রনাথ, ডস্টভয়েস্কি, ইম্যানুয়েলকান্ট, নিৎসে নিয়ে আমার কৌতুহল এবং চর্চা অনেক বেশী। কিন্ত বিবেকানন্দ কি করেছিলেন, সেটা বুঝতে ইতিহাস এবং দর্শন একটু গভীরে পড়তে হবে। কমন সেন্স ও দরকার। আমি স্বামী বিবেকানন্দ এবং শ্রী রামকৃষ্ণের দর্শন, সম্পূর্ন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে দেখি। তাদের কাজ আমার কাছে সেই ভাবেই গ্রহনযোগ্য।
ব্যক্তিগত ভাবে যেটুকু পড়াশোনা করেছি- যা বুঝেছি, তার ভিত্তিতে এটুকুই বলি -বিজ্ঞান এবং ধর্মের দর্শনের সহাবস্থান সম্ভব। কেন সম্ভব, সেটা নিয়েও একটা ব্লগ আছে। যারা বিজ্ঞান এবং ধর্মের গভীরে যায় নি, তারাই নিজেদের অবস্থান থেকে মারামারি করে। আমার ধর্ম ভাল এইসব মৌলবাদি দাবী করে। তারাই শ্রীরামকৃষ্ণের যতমত তত পথ বুঝতে অক্ষম। কেন তারা শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শন বুঝতে অক্ষম- সেসব প্রশ্নের উত্তর এই ব্লগেই পাবেন-
https://biplabbangla.blogspot.com/2022/11/blog-post.html
No comments:
Post a Comment