ভারতীয় আইনে বাকস্বাধীনতা নেই!
-বিপ্লব পাল, ১২ই আগষ্ট, ২০২২
বাংলাপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা নেতা গর্গ চ্যাটার্জি, আসাম সরকারের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন। এখন ট্রান্সিট জামিনে। তার অপরাধ -তিনি তার টুইটে একটি প্রশ্ন তুলেছিলেন । বিজেপি যদি বাবর সহ মুঘলদের বহিরাগত তকমা দেয়, তাহলে অহম সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সুকাপাকে কেন বহিরাগত বলা হবে না?
কারন সুকাপা চীনের মং মাও (বর্তমানে উন্নান প্রভিন্সের) রাজ্যের রাজকুমার ছিলেন। আসামের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় তিনি এসেছিলেন পাটকাই পর্বত পেরিয়ে ১২২৮ সালে। প্রায় ন হাজার সৈন্য নিয়ে।
এটা খুব সহজ একটা ঐতিহাসিক প্রশ্ন। এর জন্য আসামের জনগোষ্ঠির অনুভুতিতে আঘাত লেগেছে-এই ধারাতে গর্গ কেস খেয়েছেন, এবং গ্রেফতার হয়েছেন। যেকেউ এটা শুনলেই অবাক হবেন যে স্বাধীন ভারতে ইতিহাস নিয়ে প্রশ্ন তুললেও আপনি গ্রেফতার হতে পারেন। কিন্ত কেন?
এখানে চারটি পয়েন্ট বোঝা খুব গুরুত্বপূর্ন। আমি সেগুলো ব্লগে লিখছি। কারন ইদানিং ফেসবুকে এসব যতই তথ্যসহকারে লিখিনা কেন, ফেসবুকের ডিজফাংশনাল এই আই প্রযুক্তি আমাকেই ধরে ব্যান করে দেবে। ভারতের আইনের থেকেও গোলমেলে ফেসবুকের তথা কথিত এই আই রিভিউ!
যে বেসিক প্রশ্নগুলো সবার তোলা দরকার --
(১) ভারতের সংবিধানে কি তাহলে বাক স্বাধীনতা নেই? আছে এবং যদি গর্গ কেসটা লড়েন, সংবিধানের সেই রক্ষাকবচের জন্য জিতে আসবেন। কিন্ত এই কোর্ট থেকে ওই কোর্টে দৌড়ে তার ভোগান্তি হবে বিশাল। আসামের বিজেপি সরকার সেটাই চাইছে। এটার মূল কারন, ভারতের সংবিধান রচনা হয়েছে ১৯৪৯ সালে। কিন্ত ভারতের সংবিধান অনুসারে ভারতের পেনাল কোডের আইন বদলায় নি। ভারতের পেনাল কোডের আইন বৃটিশ আমলের। যেখানে এইসব ব্লেস্ফেমি ( ধর্মীয় অনূভূতির অবমাননা), সিডিশন (দেশদ্রোহী) ধারায় কেস চলে। যা কোন উন্নত বিশ্বের গণতন্ত্রে নেই। ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ীও থাকা উচিত না। কিন্ত ভারতীয় পেনাল কোডে এই ধারা গুলি রয়ে গেছে। কারন ১৯০৯ সালের পর ভারতের পুলিশ আইনে বিশেষ সংশোধন হয় নি। ফলে ভারতের যেকোন রুলিং পার্টি, খুব বিধিবদ্ধ রুটিন ঐতিহাসিক প্রশ্ন তোলার জন্যও যাকে খুশী, তাকে গ্রেফতার করতে পারে এইসব ভুল্ভাল আইনি ধারায়।
(২) সুকাপা কিভাবে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই ইতিহাস বাবরের মতন পরিস্কার না। স্থানীয় উপজাতিদের সাথে তার যুদ্ধের শুধু দুটো ইতিহাস পাওয়া যায়। কিন্ত অহম সাম্রাজ্য যে দীর্ঘ ৬০০ বছর টিকে ছিল-তাদের নিজেদের ঐতিহাসিক ভাষ্য হচ্ছে সুকাপাকে স্থানীয় লোকজন ভালবেসে রাজা হিসাবে গ্রহন করেছিল। কারন ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বানভাসি জমিতে কিভাবে ধান চাষ করতে হয়, সেই চাষের প্রনালী সুকাপা চীন থেকে এনেছিলেন। ফলে তাদের চৈনিক প্রযুক্তিতে স্থানীয় অধিবাসীরা খুব উপকৃত হয় এবং তারা সুকাপাকে রাজা হিসাবে গ্রহন করে।
কোন সন্দেহ নেই এই অহম রাজ্য একটি উন্নত প্রজাপালক রাজ্য ছিল। নইলে ৬০০বছর টেকার কথা না। আর তারা মুঘলদের প্রায় ১৭ বার পরাজিত করে।
কিন্ত প্রশ্ন হচ্ছে অহম রাজ্যের ঐতিহাসিকদের লেখা ভাষ্য কতটা ঐতিহাসিক সত্য? মনে রাখবেন পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে যে ইতিহাস পড়ানো হয়, সেখানে বাবর, মহম্মদ ঘোরি, বখতিয়ার খিলজি- এরা উন্নত সভ্যতার বীর। পাকিস্তান বাংলাদেশের ইতিহাসে ইসলাম ভারতে আসার আগে স্থানীয় হিন্দু সংস্কৃতি এবং সভ্যতা ছিল নিম্নমানের। তার উদাহরন হিসাবে তারা দেন যে মুঘল আমলে যে এডমিনিস্ট্রিটিভ এবং ল্যান্ড রেভিনিউ স্ট্রাকচার তৈরী হয়েছিল-সেটাই কিন্ত বৃটিশ আমলেও রয়ে গেছিল। সুতরাং বিজয়ীদের ঐতিহাসিক ভাষ্যে সর্বদা এটাই থাকে, তারা উন্নত সভ্যতা এনেছিল বল, এই জাতিটা বেঁচে গেছে!
যেমন ইংল্যান্ডে যে ভারতের ইতিহাস পড়ানো হয়, তাতে ছাত্ররা এটাই শেখে, বৃটিশদের আগে ভারত ছিল বর্বর অসভ্য লোকেদের সভ্যতা। বৃটিশরা এসে ভারতীয়দের পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তি দিয়ে সভ্য করেছে!
অহম রাজ্যের নিজস্ব ইতিহাস ও সেইভাবে লেখা-যাতে সুকাপা সেই জাতির পিতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন।
সেই ইতিহাস নিয়ে প্রশ্ন করলে, ভারতে জেলে যেতে হবে? তাহলে সংবিধানে বাক স্বাধীনতার রক্ষাকবচ কোথায়?
(৩) বাংলাপক্ষের সবাই এটাকে বিজেপির প্রতিহিংসা হিসাবে দেখছেন। কিন্ত আরো গভীরে ভাবা উচিত। বিজেপির নুপুর শর্মাও ক্রিমিন্যাল কেস খেয়েছেন একটি ঐতিহাসিক সত্যকে টিভিতে বলার জন্য।
গর্গ হার্ভাড, এম আই টির প্রাত্তনী। নুপুর শর্মা লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সের প্রাত্তনী। এদের মতন প্রতিভাবান ছেলেমেয়েরা ভারতীয় রাজনীতিতে যোগ দিয়েছে-এটা অত্যন্ত আশার কথা। গণতন্ত্রে মতের বিরোধ থাকবেই। গর্গের সাথে আমি কোলকাতায় আড্ডা মেরেছি অনেক। ওর সাথে অনেক ব্যপারে আমি একমত। আবার উগ্র জাতিয়তাবাদের প্রশ্নে আমি ওর সাথে দ্বিমত পোষন করি। নুপুর শর্মার হিন্দুত্ববাদের ভার্সনের সাথেও আমি তীব্রভাবেই দ্বিমত। কিন্ত এদের মতন উন্নত মেধার ছেলে মেয়েরা ভারতীয় রাজনীতিতে এসেছেন। জন আন্দোলন করছেন। এ বড় আশার কথা।
প্রশ্ন হচ্ছে, ভারতের আইন যদি, আসল অপরাধি রাজনীতিবিদ-যারা জনগনের হাজার কোটি টাকা মেরে দেয়-খুন করে ভোটে জেতে-তাদেরকে বিলকুল ছাড় দেয়- আর গর্গ বা নুপুর শর্মার মতন মেধাবী ছেলেমেয়েদের জেলে ঢোকাতে তৎপর হয়- যে শুধু তারা ঐতিহাসিক সত্যটাকে তুলে ধরেছেন !
তাহলে ভারতের মেধাবী ছেলেরা কেন রাজনীতিতে যোগ দেবে? ভারতের রাজনীতি সেক্ষেত্রে শুধুই চোর ডাকাত ধান্দাবাজদের আখড়া হয়ে যাবে।
আমি বিজেপি-কং-তৃনমূল এসব পাঁকে ঢুকব না। কারন শাসক শ্রেনীর চরিত্র সর্বত্র এক। ভারতের দুর্বল আইনি কাঠামোকে কাজে লাগিয়ে বিরোধিদের হেনস্থা করা। এর কারন ও আমি আগেই বলেছি। ভারতের সংবিধান এবং পুলিশি আইনকে অত্যাধুনিক করতে হবে। বৃটিশ আমলের আইন কারা চালাচ্ছে? কাদের দ্বায়িত্ব ছিল বৃটিশ আইন বদলে ভারতকে নতুন পুলিশ আইন দেওয়ার?
কংগ্রেস সেটা করে নি। কারন তারা বরাবর বৃটিশ আইনের সুবিধা নিয়ে বিরোধিদের দমন করেছে। তার জন্যই ১৯৭৭ সালে জনতা সরকার, প্রথম, ভারতের পুলিশ আইন বদলানোর জন্য , স্বাধীন ভারতের প্রথম পুলিশ কমিশন বসায়। কিন্ত তদ্দিনে তারাও ক্ষমতা স্বাদ পেয়েছেন। প্রবাদ, যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ। ফলে সেই কমিশন যে সুপারিশ করেছিল-সেগুলি তারা বদলানোর জন্য উদ্যোগ নিল না। এদিকে জনতা সরকারের পতন হয় ১৯৮০ সালে। ফলে কমিশন চলেগেল হিমঘরে।
১৯৮৯ সালের ভিপি সিং সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ইন্দ্রজিত গুপ্ত ভারতের পুলিশ কমিশনের সুপারিশ গুলি চালু করার শেষ চেষ্টা করেন। উনি সব মুখ্যমন্ত্রীদের চিঠি লিখলেন, যে একটা সর্বভারতীয় ঐক্যমত দরকার পুলিশ কমিশনের সুপারিশ গুলি চালু করার জন্য। স্বয়ং জ্যোতিবসু সেই চিঠির উত্তর দেন নি। কোন মুখ্যমন্ত্রীই দেন নি। কেন দেবেন? ভারতের আইন শাসক শ্রেনীর স্বৈরাচারের বড় সহায়!
ফলে ভারতে সেই বৃটিশরাজ বা তার থেকেও আরো বেশী জঘন্য অপ্রেসিভ পুলিশ এডমিস্ট্রেশন চলছে। যাদের কাজ শাসক শ্রেনীর লাঠিয়াল হয়ে, বিরোধিমতকে জেলে ঢোকানো। বৃটিশ আমলেও বোধ হয়, বৃটেনের ইতিহাস নিয়ে প্রশ্ন তোলার জন্য কেউকে জেলে যেতে হয় নি।
1 comment:
খুব সুন্দর লেখা
Post a Comment