আমেরিকা যেসময় স্বাধীনতার যুদ্ধ লড়ছে, ভারত আস্তে আস্তে বৃটিশ অধীনে চলে যাচ্ছে। কি আশ্চর্য্য, জর্জ ওয়াশিংটন যেখানে ১৭৭৬ সালে প্রবল ঠান্ডায় মাত্র ছ হাজার অপেশাদার সৈন্য নিয়ে লর্ড কর্নওয়ালিশের ৩০ হাজার সেনাকে ট্রেনট্রন এবং প্রিন্সটনের যুদ্ধে ঘোল খাওয়াচ্ছেন, ভারতের নবাবদের ৫০ হাজার সেনা মাত্র তিন থেকে পাঁচ হাজার বৃটিশ সেনার কাছে হেরে যাচ্ছে।
পলাশীর যুদ্ধ না হয় ছিল ষড়যন্ত্র। বক্সারের (১৭৬৪) যুদ্ধে কি হল? মাত্র ছ হাজার কোম্পানীর সেনা ৪০ হাজার নবাবের সেনাকে হারিয়ে দিল!
আলিগড় মুসলিম বিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক ইরফান হাবিব এবং তার ছাত্রী শিরিন মুসভি প্রমান করার চেষ্টা করেছেন মুঘল আমলে ভারতীয়রা বৃটিশ আমলের থেকে অনেক ভাল ছিল। তাদের তথ্যে অনেক গোলমাল। কিন্ত তথ্যের মধ্যে না গিয়েও শুধু এই টুকুই যদি চর্চা করা যায় বৃটিশদের তিন থেকে পাঁচ হাজারের ফোর্স নবাব, মারাঠা , শিখদের ৫০ হাজারের ফোর্সকে অবলীলায় হারাত, তাহলে মুঘল আমলে জনগণ কেমন ছিল-তা নিয়ে কিছু মৌলিক প্রশ্ন ওঠে।
বৃটিশদের অস্ত্র এবং স্ট্রাটেজি নিশ্চয় ছিল অনেক উন্নততর। ভারতের মিলিটারি কমান্ডারদের মধ্যে কেউ জর্জ ওয়াশিংটন ছিলেন না-সম্ভব ও ছিল না। কারন নবাব পুত্ররা ভোগ ব্যসনে বড় হওয়া শাহাজাদা- যুদ্ধবিদ্যার কলা তারা ভাল জানতেন না। তারাই ছিলেন কম্যান্ডার। কিন্ত ওয়াশিংটনের সেনারা আগে যুদ্ধই করেন নি। তার অস্ত্রের অবস্থাও ছিল খারাপ- জনপ্রতি মাত্র আধ পাউন্ড গান পাওডার ছিল! বৃটিশদের সুসজ্জিত সেনাদের থেকে অনেক অনেক পিছিয়ে ছিল তার র্যাগট্যাগ কন্টিনেন্টাল ফোর্স। তিনি কি করে তার থেকে পাঁচগুন বড় বৃটিশ সেনাদলকে আমেরিকা থেকে উৎখাত করলেন-সেটা পরীক্ষা করলেই বোঝা যাবে, ভারতের সাধারন জনগন সম্পূর্ন ভাবেই "রাজা", "নবাব", "নিজের দেশ" ইত্যাদি থেকে সম্পূর্ন বিচ্ছিন্ন ছিল। বাদশা নবাব রাজারা প্রজাদের সুখচিন্তক ছিলেন না- তাদের শোষন করতেই উৎসাহ ছিল বেশী। ফলে গদিতে কে এল গেল, তা নিয়ে সাধারন ভারতীয়দের কোন মাথাব্যাথা ছিল না। সিরাজদৌল্লা দেশের লোক, বৃটিশরা বাইরের এই ধারনাই ছিল না সেকালে। তারা জানত নবাব, রাজা মানেই টাক্স আদায়কারি অত্যাচারি।
১৭৭৫ সালের ক্রিসমাসের রাতে প্রচন্ড ঠান্ডায় বরফে ভর্তি ডেলওয়ার নদী পার করে ওয়াশিংটনের ৫ হাজার সৈন্য। এত ঠান্ডা, সেনাবাহিনীর কয়েজন মারা যায়, অধিকাংশর সেনার হাত পা অবশ। তবুও তারা এগোচ্ছেন, ভোর রাতে ট্রেন্ট্রনে হানা দেবেন অতর্কিতে। তিনমাসের মাইনে বাকী অনেকের। প্রচন্ড ঠান্ডায় নদী পার করতে গিয়ে সেনাদের প্রচন্ড বাজে হাল দেখে, ওয়াশিংটন ভাবলেন, লাভ নেই। আবার ফিরে যাওয়া যাক। কিন্ত তার সেনারাই বাধ সাধল। বৃটিশদের তাড়ানোর এই সুযোগ। তারা তখন নতুন দেশ, নতুন স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর। যেখানে তারাই সিদ্ধান্ত দেবে, রাজা থাকবে না। ট্রেনট্রনের যুদ্ধে পরাজয় থেকেই বৃটিশদের শেষের শুরু হয়।
সেখানে পলাশী যুদ্ধের অবস্থা দেখুন। যদিও ইতিহাসে আমাদের পড়ানো হয় মীরজাফরের ৫০,০০০ সেনা যুদ্ধে অংশ নিতে চায় নি মিরজাফরের নেতৃত্বে -বাস্তব হচ্ছে তারা মুর্শিদাবাদ থেকে পলাশী মার্চ করতেই চায় নি। কারন নবাব মাইনে দিতে পারছিলেন না। যাদের যুদ্ধ করার কোন ইচ্ছাই ছিল না। নবাব শেষ মুহুর্তে মাইনের ব্যবস্থা করে অবস্থা সামাল দেন। কিন্ত বাস্তব হচ্ছে মীরজাফর জানতেন, সেনাবাহিনীর যুদ্ধ করার ইচ্ছা নেই। মুর্শিদাবাদে যখন সিরাজকে বন্দি করে আনা হয়, মুর্শিদাবাদের লোক নবাবের সেই হাল দেখে , বিদ্রোহ করে নি। তারা মজা লুঠছিল- ভাবছিল এক অত্যাচারির হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে, এবার নতুন কে আসবে!
মোদ্দা কথা সেই সময় রাজা/নবাররা যেমন প্রজাদের শোষন করতে ব্যস্ত থাকতেন, সাধারন প্রজা বা সেনারাও "দেশ" বাঁচাতে যুদ্ধ করতেন-এমন কোন ভাবনা ছিল না। অধিকাংশই ছিল পেশাদারি সেনা- মূলত আফগানিস্থান, রাজপুতানার লোক।
ভারত কিভাবে বৃটিশরা দখল করল- তার ইতিহাস ভারতে পড়ানো হয় উলটো ভাবে। দেখানো হয় বৃটিশরা ছিল বুদ্ধিমান ষড়যন্ত্রকারী। আসলে ওসব কিস্যু না। অধিকাংশ নবাবই ছিল জনবিচ্ছিন্ন অত্যাচারি। তাদের সেনাদের ও ইচ্ছা ছিল না যুদ্ধ করার। বৃটিশরা সেই সুযোগই নিয়েছে। ভারতের যদি সেই সময় আদিকালের গণতন্ত্রও ( ষোড়জনপদের সময়ে যা ছিল) থাকত, তাহলেও গুটিকয় বৃটিশদের তারা রুখে দিতেন।
যেমন দিয়েছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন।
ভারতের ইতিহাসের পুনর্নিমান দরকার। সত্যিটা সামনে আসলেই ভাল।
1 comment:
সত্যিটা সামনে আসাটা খুবই জরুরি।
Post a Comment