আদৌ নবজাগরন? না হিন্দু সংস্কার আন্দোলন ( রিভাইভালিজম?
****
ভাবনাতে বাঙালীর নবজাগরনকে নিয়ে কাঁটা ছেঁড়া হচ্ছে-এটা ভাল। এট দ্যা এন্ড ইতিহাস একটা ন্যারেটিভ। যে ন্যারেটিভ স্কুল পাঠ্য বইতে, সমাজের মুষ্টিমেয় কিছু এলিট গুঁজে দিয়েছেন, তার থেকে বেড়িয়ে এসে মুক্তমনে ইতিহাসের পুনপর্যালোচনা দরকার। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, বিবেকানন্দ নিয়ে আলোচনা মূলত তারা কি বলেছেন, কি লিখেছেন, এগুলি নিয়েই সীমাবদ্ধ থাকে। আমার মতে নবজাগরন নিয়ে আলোচনার সীমাবদ্ধতা এটাই যে ভাবুকগন, কে কি লিখেছেন- সেখানেই নিজেদের হারিয়ে ফেলছেন। (১) অর্থনৈতিক উৎপাদন কাঠামো, (২) সাম্প্রদায়িকতার "ধারাবাহিক" ইতিহাস, (৩) আইনের কাঠামোর উৎস (৪) বর্তমানের রাজনীতিতে নবজাগরনের প্রভাব - এই চারটি জিনিসকেই সমান্তরালে দেখে সিদ্ধান্তে আসা উচিত।
আমি উপোরোক্ত চারটি স্তম্ভ বিশ্লেষন করে নিশ্চিত হয়েছি, বাঙালীর এনলাইট্মেন্ট-আসলেই হিন্দু ধর্মের রিভাইভালিজম ছিল। এমন কি বাঙালী হিন্দুর সিপিএম পর্যন্ত সেই হিন্দু রিভাইভালিজমেরই টেইল এইন্ড,। বাঙালী হিন্দুর সিপিএম কোন মার্ক্সিস্ট মুভমেইন্টই না। যার জন্যে সিপিএমের বর্তমান নেতা ক্যাডারদের বিজেপিতে মিশে যেতে কোন অসুবিধাই হচ্ছে না।
তবে এক্ষেত্রে মতামত আমার। বিশ্লেষন আপনাদের!
অর্থনৈতিক উৎপাদন কাঠামো এবং আইন //[১]- প্রথমেই দেখতে হবে ইউরোপে বিশেষত যদি ইংল্যান্ড এবং জার্মানীকে দেখি- অষ্টাদশ শতকের পুনজাগরনের আসল কারন কি? ইংল্যান্ডে জেরেমি বেন্থাম, জন স্টুয়ার্ট মিলের উটিলিটারিনিজম কেন জুদাইক্রিস্টিয়ান আইনের লেগাসির চেয়ে বেশী উপযুক্ত বলে রাজনৈতিক মহলে গন্য হল? জার্মানিতেও দেখা যাচ্ছে ইমানুয়েল কান্টের ক্যাটেগরিক্যাল ইম্পারেটিভের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুশাসকরা অখুশী। কারন কান্ট প্রথম বল্লেন আইনের উৎস হিসাবে ধর্ম টেরিবল আইডিয়া-এবং ক্যারেগরিক্যাল ইম্পারেটিভের উনিভার্সালিজমের মাধ্যমে সেটা ব্যখ্যা করলেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই ধর্মীয় মহল অখুশী। কিন্ত জার্মান এনলাইটেমেন্ট কান্টকে ঘিরেই এল-খ্রীষ্টানিটিকে ঘিরে আসে নি। আইনের ক্ষেত্রে "ধর্মের সংস্কার না" -সম্পূর্ন ভাবে হয় বেন্থামের উটিলিটারিয়ানিজম বা কান্টের ক্যাটেগরিক্যাল ইম্পারেটিভকে কেন্দ্র করে ইউরোপের প্রগ্রেসিভ আন্দোলন এগিয়ে গেছে। যেখানে আমরা দেখেছি - খ্রীষ্টানিটির টোটাল রিজেকশন।
কিন্ত বাংলার নব জাগরনে হিন্দু ধর্মের টোটাল রিজেকশন কোথায়? বরং বেন্থাম পড়ে নবজাগরনের পুরোধারা ভাবলেন এত আমাদের হিন্দু ধর্মেই আছে। কারন ধর্ম এমনিতেই ডিকন্সট্রাকশনের দৃষ্টিতে উইক টেক্সট। ফলে আইনস্টাইন আপেক্ষিকতাবাদ আবিস্কার করলে আলেমরা বেদ কোরানে তা পুনঃআবিস্কার করেন! সেটা পাওয়া যায়! কারন আল্টিমেটলি ধর্মের ৯৫% ই ব্যখ্যা! ফলে নবজাগরনের ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে সেখানে দেখা যাচ্ছে বৃটিশ উটিলিটারিজমের আলোকে "তেনারা" সবাই আলোকিত। কিন্ত উলিলিটারিজমের কন্সকিয়েন্সিয়ালিজমের ভিত্তিটাকেই এরা উড়িয়ে দিয়েছেলেন। তার বদলে, ইহা হিন্দু ধর্মে বহুদিন পূর্ব হইতেই সুল্ভ-এই দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহন করে, হিন্দু ধর্মের আইনের সংস্কারে ব্রতী হোন।
কিন্ত কেন ইংল্যান্ড বা জার্মানীর নবজাগরনে খ্রীষ্টান ধর্মের রিজেকশন কিন্ত বাংলায় সেই একই দর্শনের সূত্র থেকে হিন্দু ধর্মের রিভাইভালিজম?
এক্ষেত্রে পসিবিলিটি অনেক- হয়ত নিম্নোক্ত কারনগুলি কমবেশী সব এফেক্টিভ!
- হিন্দু ধর্মের টেক্সটের ডায়ালেয়াক্টিক বেস। হিন্দু ধর্ম "ক্যানোনিকাল" না। আইন নির্ভর না। রিয়ালাইজেশন নির্ভর। মনু স্মৃতি আইনের কালেকশন হলেও এপ্লিকেশন ছিল লিমিটেড। ফলে ১৭৭২ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস যখন দশজন ব্রাহ্মনকে এপয়েন্ট করলেন হিন্দু আইন বানানোর জন্য, সেই চেষ্টা ২০০ বছরেও সফল হয় নি। বরং পন্ডিতদের মধ্যে বিরাট মতৈনক্যের কারনে লর্ড বেন্টিঙ্কের আমল থেকেই বৃটিশ আইন বেশী করে বলবৎ করা হয়। হিন্দু শাস্ত্রে আইনের বিভাগ এতই দুর্বল, বেসিক্যালি হিন্দু আইন বলে কোন কিছু কোনদিন দাঁড়ায় নি। এমন কি আম্বেদকারের হিন্দু কোড বিল নিয়েও চূড়ান্ত বিতর্ক ছিল। কালকের শাখা সিঁদুরের জাজমেন্ট একটা বড় উদাহরন যে হিন্দু ম্যারেজ এক্টও -আইনের দৃষ্টিতে উইক টেক্সট।
এখানেই সবথেকে বড় প্রশ্ন উঠবে। রামমোহন বিদ্যাসাগর বঙ্কিম রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দ -সবাই হিন্দু ধর্মের সংস্কারে মন দিলেন। কিন্ত তাদের সময় ও দেখা যাচ্ছে হিন্দু পারসোনাল আইন দাঁড়াচ্ছে না। নানা মুনির নানান মত। বৃটিশরা বাধ্য হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে বৃটিশ আইন চালাতে। অথচ বেন্থাম বা কান্টের দর্শন তারা জানতেন না তা না। খুব ভাল করেই জানতেন আইনের উৎস হিসাবে ধর্ম শ্রেফ গার্বেজ। কিন্ত তাও তারা "হিন্দু রুটে" অনড় থাকলেন?
কেন?
এর কারন কি এই যে পরাধীনতার গ্লানির জন্য "হিন্দুত্ব= ন্যাশানালিজম" এক হয়ে ওঠে?
না "হিন্দু ধর্ম কালেক্টিভিস্ট না- ব্যক্তিস্বাতন্ত্রকে গুরুত্ব দেয়-ফলে নব-নির্মিয়মান ধনতান্ত্রিক কাঠামোর সাথে তাল মেলানোতে অসুবিধা হয় নি?
ইউরোপের এনালাইট্মেন্টের মূল কারন সমাজ কে না ভাংতে পারলে, ফ্যাক্টরিতে ";লেবার" পাওয়া অসম্ভব ছিল। খৃষ্টান ধর্ম পুরো এন্টি ক্যাপিটালিস্ট। ফলে অষ্টদশ শতকে যখন বনিকেরা ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক ক্ষমতায় এসেছে, তারা নিজেদের স্বার্থেই ইউটিলিটারিয়ানিজমকে গুরুত্ব দিয়েছে। ধনতন্ত্রের স্বার্থেই খ্রীষ্টান আইন, খ্রীষ্ঠ ধর্মের চার্চের পাওয়ারকে ডাইল্যুউট করা হয়েছে।
বাংলায় শাসক শ্রেনীর ( কোম্পানী) কি সেই স্বার্থ ছিল হিন্দু ধর্মকে ডাইল্যুট করায়?
আমার মনে হয় উত্তর নিহিত আছে এই শেষ প্রশ্নেই । শাসক সব সময় চাইবে এমন একটা শ্রেনী-যারা শাসক শ্রেনীর শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নেবে। সিলেক্টিভলি গোকুলে বুদ্ধিজীবি হিসাবে তারাই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হোন। শাসক বৃটিশ, সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপি-যেই হোন না কেন, " বুদ্ধিজীবী" শ্রেনীটি কিন্ত শাসকে্র রাজনৈতিক দর্শনের ঘোড়া। বিদ্যাসাগর তারই প্রতিফলন। এটা ভুললে চলবে না। কেউ ব্যতিক্রম হতে পারেন না। কারন ব্যতিক্রম হলে তিনি জেলে পচবেন।
সংস্কৃত কলেজ তৈরীর মূল কারন ছিল, এঙলো-হিন্দু আইনের সৃষ্টি। আর বিদ্যাসাগর সেই সিস্টেমের প্রোডাক্ট। যাকে সিস্টেম তৈরী করল হিন্দু ধর্মের রিভাইভালিজমের জন্য-তিনি অন্যকিছু হবেন এমন ভাবা ভুল।
কাঁঠাল বাগানে কাঁঠালই হবে। সুতরাং বিদ্যাসাগর আলোকিত, আর বিবেকানন্দ অন্ধকার এটা ভুল ধারনা। উনারা সবাই এক সূত্রে , এক সিস্টেমে বাঁধা। সেটা হচ্ছে হিন্দু ধর্মের রিভাইভাল।
(২) সাম্প্রদায়িকতার ধারাবাহিক ইতিহাস- মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের সাথে সাথে মারাঠাদের উত্থান। আর তার সাথে সাথেই দ্বিজাতি তত্ত্বের শুরু। উত্তর ভারতে এই সময় সৈয়দ আহমেদ বরেল্ভি এবং হাজি শরিয়তুল্লার ইসলামিক রিভাইভালিজম ও শক্তিশালি হয়। ফলে ইসলাম আবার ক্ষমতায় আসতে পারে ( যা আহমেদ সিন্ধ্রির ভাবধারা) এই ভয়টা হিন্দু মানসে সেখালেও ছিল । এখনো আছে। ফলে ভারত বর্ষের হিন্দুদের একত্রিত করার চেষ্টা -যা অজান্তে ওয়ারেন হেস্টিংস শুরু করেছিলেন ১৭৭২ সালে এংলো-হিন্দু আইন তৈরীর মাধ্যমে-তাকে কেন্দ্র করেই হিন্দু ন্যাশানালিজমের বিকাশ হবে। যাদের বর্তমান সন্তান বিজেপি-আর এস এস। সুতরাং হিন্দু মেইন স্ট্রিমের মধ্যে হিন্দু ধর্মকে সম্পূর্ন বাতিল করে, নতুন এনলাইট্মেন্টের চেষ্টা কোন কালেই সফল হয় নি। কারন ইসলামের ভয়ে একটা হাল্কা বৃহত্তর হিন্দু ঐক্য বহুদিন থেকে আছে।
(৩) এংলো-হিন্দু আইন থেকে হিন্দু পারিবারিক আইন- এটা বিশাল সাবজেক্ট। এর দুশো বছরের ইতিহাস পাঠ করলে, ভারতে হিন্দু ধর্ম এবং রাজনীতির স্বরূপ সম্পূর্ন বোঝা যাবে। আমি জটিল বিষয়ে ঢুকছি না। কিন্ত এটা ভুললে চলবে না-হিন্দু রিভাইভালিজমের উৎসমুখ কিন্ত সংস্কৃত কলেজ -কারন বৃটিশ প্রভুরা চাইছেন পারসোনাল হিন্দু আইন-পন্ডিতরা দিতে পারছেন না-কারন আদতেই উনিভার্সাল হিন্দু আইন ইসলামের শরিয়া আইনের মতন কিছু ছিল না। ফলে হিন্দু ধর্মে বিতর্ক এবং সংস্কারের শুরু হয়। কিন্ত সেটা আর যাইহোক এনলাইট্মেন্ট না। বড়জোর খ্রিষ্ঠান ধর্মের প্রটেস্টান্ট মুভমেন্টের মতন। সেটা লঞ্চিং প্যাড হতে পারে।
(৪) এবার আসি বর্তমানে। কোন সন্দেহ নেই ভারতে্র মেইনস্ট্রিম কমিনিউস্ট আন্দোলন বাংলাতেই সব থেকে জোরদার ছিল। এর মূল কারন দুটো। বাংলাতেই প্রথম ভূমি আন্দোলন শুরু হয়। এবং বাংলাতেই সব থেকে বেশী উদারপন্থী হিন্দু তৈরী হয় হিন্দু রিভাইভালিস্ট আন্দোলনের ফলশ্রুতি হিসাবে।
বাংলার কমিউনিস্ট নেতারা ( থুরি সিপিএম নেতারা) সংস্করিত হিন্দু নেতা না মার্ক্সিস্ট প্রগ্রেসিভ নেতা-এটার ঐতিহাসিক বিচার হওয়া প্রয়োজন। শহরের সিপিএম নেতারা হয়ত কিছুটা প্রগ্রেসিভ ছিলেন-কিন্ত আমার দেখা গ্রামের সিপিএম নেতা মানে ওই উদারপন্থী হিন্দু। সিপিএমের ৩৪ বছরে বাংলায় হিন্দুত্ব আরো গ্রথিত হয়েছে। বলতে পারেন তা উদার হিন্দুত্ব। ধর্মের নাগপাশ কিছু মাত্রায় কমে নি। কারন গ্রাম বাংলায় শিল্পের বিকাশ হয় নি। ইন্ডাস্ট্রি আর মার্কেট- তার নিজের প্রয়োজনে ধর্মীয় সমাজকে ভাঙে এবং গড়ে। পুঁজির অভাবে গ্রাম বাংলায় শিল্পের বিকাশ না হওয়া, ধর্মের শিকর সেখানে এখনো গভীর।
উপসংহারে এটাই বলবো নবজাগরন বাংলার হিন্দুদের ক্ষতিগ্রস্থ করেছে। বিদ্যাসাগর রবীন্দ্রনাথ বিকেকানন্দ নেতাজি যে আদর্শ চরিত্র হিন্দু বাঙালীদের সামনে রেখেছেন, তা ত্যাগী সন্ন্যাসীর। গেরুয়াবাদির। তা রক্ত মাংসের লোভ, যৌনকামনা, যশকামনায় বিশ্বাস করে না। কিন্ত মার্কেট অর্থনীতি হচ্ছে লোভের রাশানালাইজেশন।
নবজাগরন বাংলার ব্যবসা বিমুখতার মূল কারন। দেখুন কোন কোন বাঙালী ব্যবসায় সফল। দেখবেন তারা খুব নীচু ফ্যামিলি থেকে উঠে এসেছে-যাদের ফ্যামিলি এতই গরীব ছিল যে এইসব এনালাইটমেন্টের ট্রাপে পা দেয় নি ।
ফলে বাজার অর্থনীতির সুযোগ নিতে বাঙালী হিন্দু ব্যর্থ হয়েছে। এর কারনে মারোয়ারীরা -যারা ওই এনলাইটমেন্টের ধারে কাছ দিয়েও যায় নি, তারা আজ বাঙালীর প্রভু।
সুতরাং নবজাগরন যে বাঙালীর ক্ষতি করেছে, সেটার বিচার হওয়া দরকার।
আর দিনের শেষে আমরা সবাই সিস্টেমের প্রোডাক্ট। আমি গ্লোবালাইজেশনের সন্তান।
এখন আমি হয়ত সেই সিস্টেম থেকে লাভ করেছি। তার মানে এই না সমগ্র বাঙালী জাতিই লাভ করেছে।
সুতরাং এক্ষেত্রেও দেখতে হবে বিদ্যাসাগর থেকে আমি লাভ করেছি মানেই সমগ্র বাঙালী জাতি লাভ করেছে।