প্যাটেল এবং আম্বেদকর -- এরা আর্টীকল ৩৭০ এর পক্ষে ছিলেন? রিয়ালি?
*****
ইতিহাস খুবই জটিল সাবজেক্ট। যিনি লেখেন তাকে একাধারে ঐতিহাসিক চরিত্র এবং ঘটনা বোঝার জন্য হতে হবে ঔপন্যাসিক। তথ্যে যেখানে “গ্যাপ” আছে তা বোঝার জন্য দরকার ডিটেক্টিভ ইন্সটিক্ট । শকুনের মতন এখান ওখান থেকে খাবলে তথ্য তুলে ইতিহাস হয় না। ঘটনা পরস্পরায় তা সাজাতে হয়। এবং ইতিহাসের নানান লেয়ার এবং নানান ভাষ্য এই জন্যেই থাকে, যে অনেক ক্ষেত্রেই তথ্যে “মিসিং লিংক” থাকে।
কালকে দেখলাম বেশ কিছু বঙ্গীয় বাম লিব্যারালবৃন্দ “প্রমান” হাজির করেছেন, সর্দার প্যাটেল এবং আম্বেদকার আর্টিকল ৩৭০ এর সপক্ষেই ছিলেন। তাদের সব ডকুমেন্টের এবং যুক্তির হাল এই রকম
(১) আম্বেদকর সংবিধান কমিটির চেয়ারম্যান হিসাবে আর্টিকল ৩৭০তে সাইন করেছেন
(২) নেহেরু তখন দীর্ঘদিন আমেরিকাতে ছিলেন। আমেরিকাতে যাওয়ার আগে প্যাটেলকে নির্দেশ দিয়ে গিয়েছেন, গোপালকৃষ্ণ আয়াঙ্গার যেন শেখ আবদুল্লার সাথে ্সমঝোতা করে এই ড্রাফট লেখে এবং কংগ্রেসের সংখ্যাধিক্য নিয়ে, প্যাটেল যেন কনস্টিউয়েন্ট এসেম্বলিতে তা পাশ করিয়ে নেন। এবং প্যাটেল তা করেও ছিলেন।
এতেব এতদ্বারা প্রমানিত হয় প্যাটেল ৩৭০ এর আর্কিটেক্ট। আম্বেদকর মোটেও বিরোধি ছিলেন না। কারন তিনিও সাইন করেছেন। এমন কি শ্যামাপ্রসাদ ও সাইন করেছেন।
এটা হচ্ছে পেঁইয়াজের খোঁসার লেয়ার ওয়ান ইতিহাস।
আম্বেদকর এবং প্যাটেল চরিত্র নিয়ে যারা সামান্যটুকুও জানেন, তারা বুঝবেন, এই ধরনের এপিজমেন্ট রাজনীতির বিরোধি ছিলেন দুজনেই। সুতরাং পেঁয়াজের খোসা ছাড়িয়ে আসল সত্যে আসা দরকার।
(১) আম্বেদকর যেকোন ধরনের “ মুসলিম এপিজমেন্ট” রাজনীতির বিরোধি ছিলেন।খিলাফত আন্দোলন, লক্ষনৌ প্যাক্ট ইত্যাদি কংগ্রেসের এপিজমেন্টের রাজনীতির তিনি ছিলেন ঘোরতর বিরোধি। তিনি দেশকে যথার্তই ভালবাসতেন। রাজনীতি বিজ্ঞানে ছিল তার গভীর পান্ডিত্য। তিনি জানতেন এক সত্যিকারের শক্তিশালী সমৃদ্ধশালী দেশ গড়তে দরকার সেই সংবিধান যাতে বৈষম্য থাকবে না, স্যোশাল জাস্টিস আরো শক্তিশালি হবে।
(২) সর্দার প্যাটেল বরাবর শক্তিশালী ফেডারেল ভারত চেয়েছেন। সেখানে ভারতে দুর্বল করা আর্টীকল ৩৭০ পাশ করানোর ভার নেহেরু কেন তাকেই দিলেন? তিনি রাজীই বা হলেন কেন?
মোদ্দা কথা ভারতকে দুর্বল করে, এমন ক্লজ ৩৭০। এটা তারা সমর্থন করবেন, এটা তাদের চরিত্রের সাথেই সামঞ্জস্য না।
সুতরাং পেঁয়াজের খোঁসা ছাড়াতে আরো তথ্য, আরো ঘটনার উল্লেখ দরকার।
একটা জিনিস ভুলে গেলে চলবে না। নেহেরু, প্যাটেল, আম্বেদকর তখন একই ক্যাবিনেটের সদস্য। ভারত সবে জন্ম নিয়েছে। চারিদিকে রিফিউজি সমস্যা। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার আগুন। তার মধ্যে কাশ্মীরে ভারতের সেনা লড়ার জন্য প্রচুর খরচ। এই অবস্থায় একে ওপরে বিরুদ্ধে বিবৃত্তি দিয়ে ভারতকে দুর্বল করার মতন খলনায়ক বা অবিবেচক তারা নন। সুতরাং যেটা আমরা দেখব
- খুব অদ্ভুত ভাবে আম্বেদকর বা প্যাটেল -দুজনের লেখা এবং পাবলিক ভাষনে ৩৭০ নিয়ে নীরব। এমনি যেদিন ৩৭০ এর ড্রাফট নিয়ে প্রশ্নত্তোর হয়, সেদিন ও সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন গোপালকৃষ্ণ আয়াঙ্গার। আম্বেদকর ৩৭০ প্রসঙ্গে কোন প্রশ্নোত্তরে যোগ দেন নি। চেয়ারম্যানের অদ্ভুত নীরবতা।
- আম্বেদকরে সাথে নেহেরু অনেক ইস্যু নিয়েই মতবিরোধ হওয়াতে ১৯৫১ সালে তিনি পদত্যাগ করেন। একাধিক ইস্যুতে তিনি নেহেরুকে নিয়ে হতাশ ছিলেন।
এবার তাহলে দেখতে হয় আম্বেদকর বিভিন্ন ব্যক্তিগত পরিসরে কি বলেছেন। ঘটনা পরস্পরা কি ছিল। এখানেই ইতিহাস গড়তে অনেক লোকের ভাষ্যের ওপর নির্ভর করতে হবে। বিভিন্ন ঘটনার পরস্পরাকে দেখতে হবে, এবং প্রশ্ন করা শিখতে হবে।
এক্ষেত্রে আর এস এস প্রচারক, বলরাম মোদকের দাবী আম্বেদকর শেখ আবদুল্লাকে বলেছিলেন “"You wish India should protect your borders, she should build roads in your area, she should supply you food grains, and Kashmir should get equal status as India. But Government of India should have only limited powers and Indian people should have no rights in Kashmir. To give consent to this proposal, would be a treacherous thing against the interests of India and I, as the Law Minister of India, will never do it."
যেহেতু আর এস এসের সোর্স, সেহেতু লিব্যারালরা নাকচ করছেন। এক্ষেত্রে যেটা করা উচিত, এই কোটেশন ঠিক কি না, সেটা বোঝার জন্য বাবা সাহেব আর কোথাও কাশ্মীর প্রসঙ্গে, ৩৭০ প্রসঙ্গে কি বলেছেন সেগুলো দেখা দরকার এবং দেখতে হবে অন্যস্থলে তার বক্তব্য, এই ওপরের কোটেশনের সাথে সঙ্গতিপূর্ন কিনা।
(১) ধনঞ্জয় ক্ষীরের বায়োগ্রাফি থেকে সেখা যাচ্ছে ১৯৫৩ সালে আউরঙ্গাবাদের এক প্রেস কনফারেন্সে আম্বেদকর ৩৭০ যে তার ওপর জোর করে চাপানো হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে বিদ্বশগার করেন [We can possibly cite Dhananjay Keer’s biography which talks about the press conference by Ambedkar at Aurangabad, in 1953, where Ambedkar quite brusquely pointed out that it was unfair on the part of Kashmir to expect India to provide military and other necessary services to the state and yet decide not to merge with it.
https://www.news18.com/news/opinion/opinion-the-story-of-ambedkars-scepticism-on-article-370-is-only-half-told-2262893.html ]
(২) একথা ভুললে চলবে না, তিনি একজন রাজনৈতিক বিজ্ঞানী। কাশ্মীর নিয়ে তা মতামত ছিল স্পষ্ট। তার মতে কাশ্মীরের বিভাজন দরকার। হিন্দু বৌদ্ধ অংশ ভারতে থাক। ইসলামিক অংশ পাকিস্তানে যাক। কারন তখন বাংলায় রিফিউজি সমস্যা দেখে তিনি ক্লান্ত। পাশাপাশি কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত বন্ধু হারাচ্ছিল। প্রচুর টাকা খরচ হচ্ছিল মিলিটারি বাজেটে। ফলে উনি ৩৭০কে উটকো ঝামেলা বলেই মনে করতেন। এসবই তাকে চিন্তিত করে এবং এগুলো তার লেখাতেই পাওয়া যাবে। তার বক্তব্য ছিল “the real matter of enquiry is not “who” is right in Kashmir, but “what” is right for it. The question of “what” is always the question of the principle to be applied to a concrete situation, which is the principle that is either nullified, rendered inoperative or seriously threatened by the forceful action. Can we relate it to the action undertaken by the government yesterday? To me, it seems that the principle concerned is the principle of Constitution itself. And to understand such a principle one must again go to the proper method laid down in Article 370 of how to abrogate it through a presidential order.”
অর্থাৎ খুব পরিস্কার তার ওপর ৩৭০ চাপানো হয়েছিল এবং তিনি কখনোই মনে করেন নি এই ৩৭০ এর কলা দেখিয়ে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হবে। তিনি কাশ্মীর ভ্যালি পাকিস্তানে দিয়ে, লাদাখ জম্মু ভারতে নিয়ে পূর্নাঙ্গ সমাধান চাইছিলেন। সুতরাং বলরাম মোদক যে আম্বেদকর-শেখ আবদুল্লা ভাষ্য দিয়েছেন তা সঠিক হতেই পারে। আম্বেদকরের পরবর্তী রিয়াকশনে সেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি।
এবার আসি বল্লভভাই প্যাটেলের ভূমিকা নিয়ে। তার সেক্রেটারি বিদ্যাশঙ্কর লিখছেন
“"One of Sardar's notable achievements in relation to Jammu and Kashmir was the addition of Article 370 of the Constitution of India, which defines the relation of the State to India. This matter was handled by Gopalaswami Ayyangar in consultation with Sheikh Abdullah and his Ministry and with the approval of Pandit Nehru. Although Nehru was himself away in the United States, at the time, his approval had been taken in advance to the draft formula. But Sardar had not been consulted. The Congress party in the Constituent Assembly was strongly, even violently, opposed to the draft article which gave a special position to the State. On principle, opinion in the party was that Kashmir should accept the Constitution on the same terms as other States; and in particular the provision that basic articles, e. g. Fundamental Rights as enshrined in the Constitution would not apply to the State was greatly resented. Gopalaswami Ayyangar failed to carry conviction and sought Sardar's intervention. Sardar was anxious, in the absence of Nehru, that nothing should be done which would appear as letting him down. In the absence of Nehru, Sardar, therefore, undertook the task of persuading the party to change stand. He carried out the task with such success that in the Assembly there was not much discussion, and no much discussion, and no opposition to the Article (370)."
সেক্রেটারি সাহেবের দুটো পয়েন্ট খেয়াল করুন।
(১) কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটী এবং গোটা কংগ্রেস পার্টি ৩৭০ এর বিরোধিতা করেছিল
(২) নেহেরুর মান ইজ্জত বাঁচাতে ( কারন নেহেরু তখন আমেরিকাতে, এবং তার অবর্তমানে ৩৭০ ঢোকাতে প্যাটেল ব্যর্থ হলে, এটা ভাবা হত, প্যাটেল পেছন থেকে নেহেরুকে ছুড়ি মেরেছেন) প্যাটেল আসরে নেমে কংগ্রেসকে রাজী করাচ্ছেন।
এবার দেখা যাক প্যাটেলের কাশ্মীর নিয়ে কি মত ছিল-কারন এটা পরিস্কার নেহেরুর ইজ্জত বাঁচাতে প্যাটেল এই কাজ করেছেন।
প্যাটেল এর কত বিরোধি ছিলেন তা বোঝা যাবে ৩৭০ এর রচয়ি্তা গোপালকৃষ্ণ আয়ঙ্গারের সাথে তার কমিউনিকশনে। কারন ৩৭০ তে কাশ্মীরে স্বার্থ রক্ষার জন্য শেখ আবদুল্লা, গোপালকৃষ্ণকে চাপ দিচ্ছিলেন। এতটাই ছিল সেই চাপ, গোপালকৃষ্ণ ৩৭০ এর ড্রাফটিং ছেড়ে দিতে চাইছিলেন। গোপালকৃষ্ণকে সর্দার প্যাটেল লিখলেন “Whenever Sheikh Sahib wishes to back out, he always confronts us with his duty to the people. Of course he owes no duty to India or to the Indian government, or even on a personal basis to you and the Prime Minister (Nehru) who have gone all out to accommodate him’.
শুধু তাই না, এই ৩৭০ যে টেম্পরারি প্রভিশন সেটাও ঢোকান প্যাটেল, যাতে কংগ্রেসের কর্মীদের বোঝাতে পারেন। এই “টেম্পরারী” শব্দটার জন্য শ্যামাপ্রসাদ বা হিন্দু মহাসভার নেতারাও এটিকে পাশ করান। শ্যামাপ্রসাদের বক্তব্য ছিল, তিনি কাশ্মীরের স্পেশাল স্টাটাসের বিরুদ্ধে। কিন্ত বর্তমানে যা রাজনৈতিক পরিস্থিতি, তাতে কিছুদিনের জন্য স্পেশাল স্টাটাস দিলে যদি কাশ্মীরে শান্তি বজায় থাকে , তাহলে নতুন রাষ্ট্রের জন্য ভা ভাল।
এখানে সবার বোঝা দরকার, এই ইস্যুর জটিলতা। প্যাটেল, আম্বেদকর, নেহেরু-এদের সবাই একেক জন দিকপাল। প্রত্যেকের রাজনৈতিক আদর্শও ছিল আলদা। কাশ্মীর নিয়ে তাদের প্ল্যানিং, চিন্তা ভাবনাও ছিল আলাদা। কিন্ত নেহেরু ছিলেন ক্যাবিনেটের প্রধানমন্ত্রী। কেউই ক্যাপ্টেনের বিরুদ্ধে মুখ খোলেন নি প্রকাশ্যে। কারন গোটা বিশ্বকে দেখানো দরকার ছিল, ভারতের গণতন্ত্র কাজ করছে। সুতরাং নিজেদের ইগো, ব্যক্তিগত মতামতের চেয়েও “ ইয়াং ডেমোক্রাসি ওয়ার্কিং” দেখানোর তাগিদ ছিল। এখানেই প্যাটেল মহান। কারন তিনি সবার সাথে কাজ করতে পারতেন-ঠিক এই কারনেই কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটি তাকেই প্রধানমন্ত্রী হিসাবে চেয়েছিল।
আমি নিজেকে ইতিহাসে সামান্য আমেচার ছাত্র হিসাবেই দেখি। ইতিহাস এত জটিল, শুধু কিছু দলিল দস্তাবেজ টুকে ইতিহাস লেখা যায় না। তাকে একাধারে ডিটেক্টিভ, গণিতজ্ঞ এবং ঔপন্যাসিক হতে হয়। প্রতিটা চরিত্রের “মাল্টিপল ডাইমেনশন” বুঝতে হয়।২+২=৪ বুঝতে হবে ঘটনার সঙ্গতি অসঙ্গতি থেকে। এখান ওখান থেকে খাবলা মেরে “লিব্যারাল” বা “দক্ষিনপন্থী” হওয়া যায়। ঐতিহাসিক হওয়া যায় না।
৩৭০ ইস্যুতে বিজেপি বা লিব্যারালরা কি বলছে বা লিখছে, তা নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই। আমি নিজের মতন পড়ে চলেছি, সেই অধ্যায়কে, সেই ঘটনাগুলো বুঝতে।
No comments:
Post a Comment