Saturday, October 27, 2018

ইতিহাসের ন্যারেটিভের দখল

বাচ্চাদের মাথার দখল নেওয়াটা বোধ হয় সব রাষ্ট্রের শিক্ষানীতির অংশ। এবং সবটাই শাসক শ্রেনীর স্বার্থ মেনে।

ভারতে যেহেতু অধিকাংশ সময় কংগ্রেস রাজত্ব করছে, ভারতীয় ইতিহাস বইগুলোও সেই ভাবেই তৈরী। যাতে দেখানো হচ্ছে, কংগ্রেসের স্বাধীনতা সংগ্রামের ফলে, আরো বললে নেহেরু, গান্ধী সহ কংগ্রেসী নেতাদের আত্মত্যাগই ভারতের স্বাধীনতা এনেছে।

ভারতের রাজনীতিতে বিজেপি বা হিন্দুত্ববাদিদের উত্থানের আগে,বামেরাই ছিল কংগ্রেসের প্রধান বিরোধি শত্রু। তারা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে আরেকটা কাউন্টার ন্যারেটিভ আনার চেষ্টা করে - যে গান্ধীর অহিংস আন্দোলন না, সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনই ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল চালিকা শক্তি। এর একটা বড় কারন, অতীতের বিপ্লবীদের অধিকাংশই আন্দামানে জেল খেটেছেন। সেখানকার সেলুলার জেল থেকে মার্ক্সীয় মন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে পরবর্তী কালে বামপন্থী রাজনীতি করেছেন।

এইদিক দিয়ে দেখলে, স্বাধীনতা সংগ্রামে বিজেপির কোন লেগাসি নেই। কারন আর এস এসের প্রতিষ্ঠাতা কেশব বালিরাম হেজোয়ার নিজে ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী- প্রাত্তন কোর অনুশীলন সমিতি ক্যাডার। কিন্ত আর এসে এসের উদ্দেশ্য নিয়ে খুব পরিস্কার ভাবে লিখেছেন- এই সংগঠনের কাজ স্বাধীনতা সংগ্রাম না- হিন্দুদের শারীরিক এবং মানসিক উন্নতিই তার লক্ষ্য। উনি আর এস এসকে এতটাই স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলেন, ১৯৩০ সালে গান্ধী যখন সত্যাগ্রহের ডাক দিলেন, তখন উনি নিজে স্বাধীনতা আন্দোলনে আবার যোগ দিলেন। কিন্ত আর এস এসকে ওর মধ্যে টানলেন না। সংঘ প্রচারকরা বরাবরই স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে দূরে থাকতে চেয়েছেন । হিন্দুদের আত্মিক, দৈহিক উন্নতিই ছিল তাদের পলিটিক্যাল লাইন।

নেতাজিকে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ঘোষনার মধ্যে দিয়ে, বিজেপি কংগ্রেসের একটা কাউন্টার ন্যারেটিভ তৈরী করার চেষ্টা করছে-কিন্ত তা বুমেরাং হবে। কারন এক - নেতাজি জাপান অধিকৃত ভারতের ( যেমন আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ) প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আসলেই জাপানের হাতের পুতুলমন্ত্রী ছিলেন। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে জাপানী সেনারা ২০০০ স্বাধীনতা সংগ্রামীকে হত্যা করে ( ১৯৪২-৪৪)। আসল ক্ষমতা জাপানীদের হাতেই ছিল। দুই- নেতাজি হিন্দু মহাসভার বিরোধি ছিলেন। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরোধিতা করেছেন চিরকাল। তার রাজনীতির সাথে বিজেপির রাজনীতির কোন সংযোগ নেই।

ইতিহাস খুব ভাল ভাবে পড়লে বিজেপির হাতে কাউন্টার ন্যারেটিভ ছিল। ভারতের স্বাধীনতা নেতাজির হিংসা বা গান্ধীর অহিংসা-কোন পথেই আসে নি। এসেছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির আবহে। ১৯৪২ সালে বৃটেন যখন যুদ্ধ করতে দেউলিয়া, চার্চিল হাত পাতলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের কাছে। তখনো পল হার্বার হয় নি। আমেরিকানরা যুদ্ধে জড়াতে চাইছে না। কারন তারা মনে করে বৃটেনের জমিদারি টেকানোর ভার আমেরিকা কেন নেবে? সেটাই জানালেন রুজভেল্ট চার্চিলকে। আগে ভারত সহ ৪০ টা রাষ্ট্রের কলোনীর স্বাধীনতা ঘোষনা কর, কারন তা নাহলে জার্মানীর কলোনাইজেশনের বিরোধিতা করা অনৈতিক। চার্চিলের তখন দেওয়ালে পিঠ। ফলে নাই নাই করে বাধ্য হলেন আটলান্টিক সনদে সাইন করতে। যাতে বলা হল যুদ্ধের পরে বৃটেনের আন্ডারে থাকা চল্লিশটা দেশ স্বাধীন হবে!

কিন্ত বৃটেনে ফিরেই চার্চিল উলটো গাইলেন। এর মধ্যে জাপান পল হার্বার ঘটিয়েছে। আমেরিকা জাপানের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে গেছে। ফলে জাপানকে হারাতে ভারতকে পাশে দরকার আমেরিকার। আমেরিকার চাপ খেয়ে, চার্চিল পাঠালেন স্যার স্টাফোর্ড ক্রিপসকে, যা ক্রিপ্স মিশন নামে খ্যাত। ক্রিপস লোকটা ভাল ছিল-জেনুইনলি কাজ শুরু করতেই চার্চিল ব্যাগরা দিলেন। এদিকে চার্চিল ভারতের স্বাধীনতা বিরোধি জেনে, ক্রিপস মিশন যাতে ব্যর্থ না হয়, তার জন্য রুজভেল্ট ভারতে পাঠালেন আমেরিকার রাষ্ট্রদূত থমাস উইলসনকে। থমাস উইলসন , ক্রিপ্স , রুজভেল্ট -এরা চার্চিলকে ক্রমাগত চাপ দিয়েও ভারতের স্বাধীনতা আদায় করতে পারেন নি। এর মধ্যে আমেরিকা ব্যাটল অব মিডীওয়েতে জেতার পর পরিস্কার হয়, জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আমেরিকার দরকার নেই ভারতকে-তারা একেলাই যথেষ্ট। ফলে ১৯৪৩ সালের পরে রুজভেল্ট আর চার্চিলকে ভারতের স্বাধীনতা নিয়ে বিরক্ত করেন নি।

চার্চিল ভারতের স্বাধীনতা দেওয়ার বিরুদ্ধে ছিলেন ১৯৪৫ সালেও। কিন্ত ১৯৪৫ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হলেন লিব্যারাল ক্লিমেন্ট এটলি। যার ম্যনিফেস্টোতেই ছিল, বৃটেন সমস্ত কলোনী ছেড়ে দেবে। এটলির হাতেই ভারত, জর্ডন , প্যালেস্টাইন-সমস্ত কিছু স্বাধীনতা পায়। চার্চিল জিতলে, ভারতকে স্বাধীনতা পেতে আরো অনেক দিন অপেক্ষা করতে হত। বাই দ্যা ওয়ে, জর্ডনের কোন স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল না- কিন্ত তারাও ভারতের সাথে স্বাধীন হয়েছে! সুতরাং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে গান্ধী, নেহেরু, সুভাষ বোসের অবদান অতিরঞ্জিত। তার থেকে অনেক বেশী কৃতিত্ব দাবী করতে পারেন স্বয়ং হিটলার যিনি বৃটেনকে ব্যাঙ্করাপ্ট করে ছেরেছিলেন-যার ফলে বৃটেনের সাধারন জনগন ভারতের স্বাধীনতার সমর্থনে এটলীকে বিপুল ভোটে জয়ী করে।

কিন্ত ভারতের কোন ইতিহাস বইতে, এই ন্যারেটিভ পাওয়া মুশকিল। কারন তাহলে কংগ্রেসের ঝুলিতে ক্রেডিট কিছু কম হইবে।

ভারত কোন ব্যতিক্রম না। পাকিস্তানের স্কুল বইতে এত ভারত বিরোধি ন্যারেটিভ, যে পাকিস্তানে ভারত বিরোধি সন্ত্রাসবাদি তৈরী হওয়াটা একটা স্বাভাবিক ঘটনা।

আমেরিকাও ইম্যুউন না। এই বছর ক্লাস সেভেনে আমার ছেলে পড়ছে আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস। এখানে তাদের প্রথম পরিচয় হয় কমিউনিউজমের সাথে। তাদের শিক্ষক কমিউনিজম চেনার জন্য পড়তে দিয়েছে জর্জ ওরোয়েলের এনিম্যাল ফার্ম। ওদের বন্ধুরা কমিউনিজম এবং স্বৈরতন্ত্র নিয়ে কি হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ান, উত্তর কোরিয়া, ভিয়েতনামে খুব ভাল করেই শিখছে। চীনের কালচারাল রিভোলিউসন নিয়েও টিচার প্রজেক্ট দিচ্ছে। এবং আমি মনে করি এটা খুব ভাল ইতিহাস শিক্ষা হচ্ছে, যেটা পশ্চিম বঙ্গে শেখালে রাজ্যটা ৩৪ বছরে বামপন্থীদের গাধার ঘারে যেত না। কিন্ত আমেরিকান স্কুলে যেটা সেখাচ্ছে না- সেটা হচ্ছে ঠান্ডা যুদ্ধের সময় আমেরিকা ডজনে ডজনে স্বৈরাচারী মিলিটারী জেনারেলদের সিংহাসনে বসিয়েছে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে।

এতেব দুঃখ করে লাভ নাই- ইতিহাস বিকৃত হবেই। কারন ইতিহাসের ন্যারেটিভ একটা জাতির, পার্টির পরিচয়। সেখানে বিকৃতিই বাস্তব।

Saturday, October 20, 2018

চীনকে দেখে শিখুন

আমরা যা নিয়ে সারাদিন ভাবি, সেই দিকেই গড়ায় আমাদের জীবন। যে সারাদিন ধন সম্পত্তি নিয়ে ভাবে, সে আস্তে আস্তে ধনী হয়। যে জ্ঞানের পিপাসায় ঘোরে, সে জ্ঞানী হয়ে ওঠে। অধিকাংশ মানুষই সাধারন স্তরে থেকে যায়, কারন সে নিত্যদিনের আহার নিদ্রা মৈথুন আড্ডা ফাঁকির কুম্ভিপাকের বাইরে কিছুই ভাবে না!

রাষ্ট্রের জীবন ও তাই। একটা রাষ্ট্রর "অবশেসন" কি, তাই দেখে বোঝা যাবে, সেই রাষ্ট্রের নাড়ির গতি। যেমন ধরুন, ভারত। আলোচনার শীর্ষে সবরিমালা মন্দিরে নারীর প্রবেশ। তাই নিয়ে লিব্যারাল বনাম রক্ষণশীলদের ফেসবুক কাজিয়া। ঠিক যেন ছেঁড়া জাঙ্গিয়ার বুক পকেট বাঁদিকে না ডান দিকে লাগাবে, তাই নিয়ে মারামারি। ইশ্বর আছে কি নাই, তার ঠিক নাই। থাকলেও তিনি মন্দিরে মসজিদে মানুষের মতন শীত ঘুম দ্যান কিনা, তারো ঠিক নাই। আর থাকলেও তিনি পুরুষ না নারী তাও কেহ জানে না। আর যদি তিনি পুরুষ ও হৌন মর্ত্যের মানুষদের ন্যায়, "মিট্যু" এফেক্টেড হবেন - মানে ঋতুমতী নারীদের প্রেমে কামাসক্ত হবেন সেই ভয়ে মন্দিরে কোন মেয়েকে ঢুকতে দেওয়া হবে না -সেটা হচ্ছে একটা জাতির আলোচনার অবশেসন! এবার বুঝুন একটা জাতির বুদ্ধি চেতনা কি হাস্যকর লেভেলে ঊঠলে সবরিমালা নিয়ে অবশেসন হয়। বা দুশেরার দেখতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পরে।

উল্টোদিকে চীনকে দেখুন। গত সপ্তাহে চীন থেকে আসা তিনটে খবর। এক, ওরা শহরকে আলোকিত করতে কৃত্রিম চাঁদ তৈরী করছে ২০২২ সালের মধ্যে। দুই, ওরা নতুন ধরনের বুলেট ট্রেন তৈরী করেছে, যার গতি হবে ৮০০ কিমির ওপরে। তিন, গবেষনা খাতের খরচে আমেরিকাকে ধরে ফেলেছে। ২০১২ সালে যা ছিল আমেরিকার ৩৪% , এখন তা ৮৮%।

আমি আগের সপ্তাহে, স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ আই ও টির প্রয়োগ সংক্রান্ত কিছু জার্নাল পাবলিকেশনের খোঁজে ছিলাম। দেখি সব ভালো কাজই চীন থেকে। আমেরিকা, জাপান, ইউরোপ, ভারত ধারে কাছেও নেই। কাজ গুলো আবার চাইনিজে লেখা ( এবসট্রাক্ট ছিল ইংরেজিতে)। যা দিনকাল এল। এবার দেখছি, আপ টু ডেট থাকতে চাইনিজটা শিখে নিতেই হবে। অতীতে অবশ্য এমনটাই ছিল। চীন ছিল জ্ঞান এবং প্রযুক্তির পীঠস্থান। ১৬০০ সাল পর্যন্ত জিডিপি, রপ্তানি, প্রযুক্তিতে চীন ছিল পৃথিবীর সেরা। যার জন্য ইতিহাসে দেখি- কি ইউরোপ, আরব বা ভারত- আমরা দেখব, নতুন কিছু প্রযুক্তি বা কার্যকরী জ্ঞান শিখতে লোকে চীনে যেত। হজরত মহম্মদ মুসলমানদের উপদেশ দিয়েছিলেন চীনে গিয়ে নতুন জ্ঞান বিজ্ঞান শিখতে । সেই দিনকালই ফিরে আসছে।


আজকে চিনের এই চমকপ্রদ উন্নতির পেছনে কমিউনিজম বা ক্যাপিটালিজমের ভূত দেখতে গেলে ভুল হবে। চীন বা ভারতের মতন প্রাচীন সভ্যতার ডি এন এ বহুদিন আগেই তৈরী। বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে লিডারশিপ পজিশনে থাকা চীনের কাছে নতুন কিছু না-আগেই বলেছি ইউরোপের রেনেশাসের আগে চীনই ছিল জ্ঞানবিজ্ঞানের নেতা । চীনই একমাত্র দেশ-যাদের দর্শন ঈশ্বর ভিত্তিক না। মানুষের কর্ম ভিত্তিক। যে সময় ভারতের অশোক রাজত্ব করছেন, সেই সময়টা চীনের ইতিহাসে ১০০ বছরের যুদ্ধের যুগ। যদিও কনফুসিয়াস বুদ্ধের সমসাময়িক, চীনের অভূতপূর্ব প্রযুক্তির উন্নতি এই "ওয়ারিং স্টেটের" সময়টা থেকেই যখন ছটি চৈনিক রাজ্য একে অপরের সাথে যুদ্ধে রত। এই যুগেই জন্মেছেন কালোত্তীর্ন চৈনিক দার্শনিকরা - সান জু, ওয়ে লিওবি। বৌদ্ধ দর্শন, কনফুসিয়াস, সান জু ইত্যাদি নানান দার্শনিকদের চিন্তার ওপরে তৈরী চৈনিক সভ্যতা- যা সম্পূর্ন ভাবেই ঈশ্বর বিহীন, মানুষের কল্যানকামী। আবার উন্নত মিলিটারী শক্তির ও পূজারী।


ভারতে প্রতিভার অভাব কোনদিনই ছিল না। ভারতের বৌদ্ধ ধর্ম , আয়ুর্বেদ, গণিত চীনে গেছে অতীতে। এবং চীনের দার্শনিক চিন্তাবিদদের হাতে তা উন্নতি প্রাপ্ত হয়েছিল। আর ভারত থেকে আস্তে আস্তে সব কিছুই হারিয়ে গিয়েছিল।
এখনো অবস্থাটা প্রায় তাই। ভারতে প্রতিভার অভাব নেই। কিন্ত রাজনৈতিক সিস্টেম যেভাবে ধর্মের কাদায় পচা জল খাচ্ছে, তাতে প্রতিভাবান ভারতীয়দের হাতে বিকল্প খুব কম।



Sunday, October 14, 2018

হিন্দু ধর্মীয় উৎসব এবং গণতন্ত্র

পূজা এবং উৎসব-এর শিকড় এবং আকর বেশ গভীরে। অতীতের এমন কোন সভ্যতা পাওয়া যায় নি, যাদের ধর্মীয় উৎসব ছিল না।

প্যাগান ধর্মাচারন সর্বদাই উৎসব কেন্দ্রিক। উৎসবের কেন্দ্রবিন্দুতে যৌনতা, ভাল ফসল ও যুদ্ধ ।

ধর্মীয় উৎসবের প্রথম লিখিত প্রমান সুমেরিয়ানদের। তাদের ছিল জল ( নামু ) , আকাশ (আন), বাতাস (এনকি), পৃথিবীর ( কি) দেবতা। সেই নগর সভ্যতায় পুরোহিতরাই ছিল শাসক-কারন তারাই নাকি পুজোর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রন করতে পারত প্রকৃতি (!) । আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে, তাদের সেই উৎসবে, বাজত একশো আশি বাদ্য যন্ত্র!

পরবর্তীকালে যত প্যাগান ধর্মের উৎপত্তি- তাদের অনেকের ভিত্তিই এই আদিম সুমেরিয় সভ্যতা। মিশর, গ্রীস, রোমান, ভারতীয় আর্য্য সভ্যতা- এদের পুরোহিত, মন্দির, মূর্তিপূজো, সৃষ্টি এবং ধ্বংসের পুরান , এগুলোর অনেক কিছু উপাদানই সুমেরিয় প্যান্থেয়িজমে পাওয়া যাবে।

গণতন্ত্রের সাথে প্যাগানিজমের একটা সম্পর্ক আছে। সুমেরিয় প্যাগানিজমের ভিত্তি সুমেরিয়া সিটি স্টেটগুলোর স্বতন্ত্রতা। গ্রীক এবং রোমান গণতন্ত্রের ভিত্তির অনেকটাই নির্ভর ছিল এই প্যাগান উৎসবের। এর একটা বড় কারন, বিভিন্ন জনগোষ্ঠির (ট্রাইব ) ছিল আলাদা আলাদা দেব দেবী। একটা রাষ্ট্রে তার সমস্ত জনগোষ্ঠির সমান সন্মান দিতে সব দেব দেবীর পুজো, সব উৎসব চালু থাকত।

ঠিক এই কারনেই রোমান সম্রাট কনস্টানস্টাইন প্যাগানিজম ছেড়ে রোমের রাষ্ট্র ধর্ম খ্রীষ্ঠান বানালেন। কারন প্যাগানিজমে সম্রাটের ক্ষমতা একছত্র করার সমস্যা ছিল অনেক- যেহেতু সমস্ত দেব দেবীর পুরোহিতদের হাতেও ক্ষমতা ছিল। রোমান সেনেটকে, যা ছিল রোমের গণতন্ত্রের প্রতীক, তা নির্মূল করতে রোমের প্যাগানিজম ধ্বংশ করতেই হত কনস্টানটাইনকে। খ্রীষ্ঠান ধর্মকে রাষ্ট্র ধর্ম বানানোর সাথে সাথেই রোমান গণতন্ত্রের প্রতীক সেনেটকেও ধ্বংশ করেন সম্রাট কনস্টানস্টাইন।

একেশ্বরবাদ -যথা ইহুদি, খ্রীষ্ঠান এবং ইসলামের জন্মই হয়েছে স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্রের সাধনে। জন্মের সময় সেই উদ্দেশ্য না থাকলেও ঐতিহাসিক ভাবে স্বৈরাচারী একনায়ক তন্ত্র সিদ্ধ করতেই একেশ্বরবাদের উদ্ভব। একটু ইতিহাস ঘাঁটলেই ব্যপারটা পরিস্কার হবে।

ইতিহাসে প্রথম একেশ্বরবাদ চালু করেন মিশরের প্রখ্যাত ফেরাও- আখেনাতেন ( ১৩৫৩-১৩৩৬ খৃঃপূঃ )। উনি দেখলেন, প্যাগান সংস্কৃতিতে ফারাওদের হাতে ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। উনিই প্রথম আবিস্কার করেন, সম্রাটের ক্ষমতা একছত্র করতে, পুরোহিত ক্লাসকে ডাইলুউট করা আবশ্যক এবং সেটা করতে গেলে বহু দেবদেবীর পূজো ছেড়ে এক দেবতার পূজো চালু করতে হবে। আখেনাতেন এই উদ্দেশ্য প্রচলিত সব দেব দেবীর মন্দির ভেঙে শুধু দেব এটেন ( সূর্য্য) এর পূজা চালু করেন। এবং ফারাওকে এটেনের একমাত্র সন্তান বলে দাবী করেন। তার এই একেশ্বরবাদ বিপ্লব বেশীদিন চলে নি। তার সাম্রাজ্যের শেষের দিকে মহামারী দেখা দেয় এবং ক্ষমতাচ্যুত পুরোহিতরা বোঝাতে সমর্থ হয় দেব দেবীদের ক্রোধ এবং রাজার ভ্রান্ত ধর্মচারনই মূল কারন।

কিন্ত যে বীজ বপন করেছিলেন আখেনাতেন, তাকেই মহীরূহ করেন কনস্টানটাইন। এবং ইসলাম হচ্ছে যার সর্বাধিক পূরিপূর্ন রূপ।

যার ফলে গ্রীস-ইউরোপে খ্রীষ্ঠান ধর্মের আগমন হেতু মধ্যযুগে গণতন্ত্র সম্পূর্ন লুপ্ত হয়। এই গণতন্ত্র ফেরাতে অপেক্ষা করতে হবে সেই রেঁনেশাসের সময় পর্যন্ত। যেখানে খ্রীষ্ঠান ধর্মকে দুর্বল করেই আধুনিক গণতন্ত্রের সূচনা হয় ইউরোপের সিটি স্টেটগুলিতে।

এটাই কারন- কেন কোন মুসলিম দেশে গণতন্ত্র বস্তুটি ভাল চলে না। সেখানে একেশ্বরবাদের সাহায্য নিয়েই চলে স্বৈরতন্ত্র। কিন্ত ভারতের হিন্দুদের কাছে গণতন্ত্রই স্বাভাবিক। এর কারন সেই একটাই-একাধিক দেবদেবী এবং একাধিক ধর্মাচারন মানার মাধ্যমেই গণতান্ত্রিক ভাবের প্রসার হয়। ভিন্নমত এবং ভিন্নপথের মান্যতাই গণতন্ত্র।

সুতরাং ভারত বর্ষে যে অগনিত ধর্মীয় অনুষ্ঠান, অসংখ্য দেব দেবী- এবং তাদের সবাইকেই সত্য বলে মেনে নেওয়ার যে প্রবনতা হিন্দু ধর্মে বিদ্যমান, তাই ভারত বর্ষের গণতন্ত্রের মূল সোপান। ভারতের গণতন্ত্রের সাফল্যের পেছনে হিন্দু ধর্মের বৈচিত্রপূর্ন আচার আচরনের ভূমিকা নেহেরুর থেকেও বেশী। ইতিহাস সাক্ষী, মহম্মদ আলি জিন্না, নেহেরুর থেকেও বেশী গণতান্ত্রিক ছিলেন। কিন্ত গণতান্ত্রিক পাকিস্তান দিয়ে যেতে পারেন নি। কারন একেশ্বরবাদ গণতন্ত্রের সাথে খাপ খায় না। হ্যা, ইসলামিক দেশগুলোতেও খ্রীষ্ঠান দেশগুলির মতন গণতন্ত্র আসতেই পারে- তবে তা ধর্মের বিষ দাঁত ভেঙেই আসতে হবে।

সুতরাং গণতন্ত্রের সাধনে এই প্যাগান উৎসবগুলির ঐতিহাসিক ভূমিকা অনস্বীকার্য্য।