(১)
প্রথম রোমান সম্রাট অগাস্টাস ( অক্টাভিয়ান) মৃত্যুশয্যায় শায়িত। পাশে কন্যা জুলিয়া। ঘটনাচক্রে জুলিয়া পিতৃবিরোধি বিদ্রোহী কন্যা। অগাস্টাসকে হত্যা করার ব্যর্থ ষড়যন্ত্রে সামিল। সাম্রাজ্য স্থিতিশীল করতে সম্রাট আগাস্টাস কন্যা জুলিয়াকে বাধ্য করেছেন টাইবেরিয়াসের সাথে বিবাহে। জুলিয়ার প্রেমিক ছিল লুলাস এন্টোনিয়াস। আগাস্টাস কন্যাকে বলেছিলেন, প্রেম যার সাথে খুশী কর-বিয়েটা টিবেরিয়াসকেই করতে হবে-কারন টিবেরিয়াস রোমের ভাবী সম্রাট। জুলিয়া হয়ে ওঠেন পিতৃবিদ্রোহী। ঘৃণা করতেন আগাস্টাসকে। আগাস্টাস তার পিতা না-এক ধুরন্ধর লোক যে রাজনীতির জন্য কন্যার প্রেমের বলি চড়িয়েছিল হাড়িকাঠে।
কিন্ত মৃত্যুমুহুর্তে অগাস্টাস কিছু বলে যেতে চান কন্যাকে- অগাস্টাস বললেন " "Did I play my part well in the comedy of life?" [ জীবনের নাটকে, আমার নিজের পাঠটা কি আমি ভাল করতে পেরেছি?]
রাজনীতির ইতিহাসে কথাটি বহুল প্রচলিত। সম্রাট অগাস্টাস একজন সফল রোমান রাজনীতিবিদ। যিনি ছলে বলে কৌশলে বন্ধু প্রতিম মার্ক এন্টনিকে হারিয়ে রোমান সাম্রাজ্য দখল করেন। মৃত্যুর আগে যিনি স্বীকার করে যাচ্ছেন রাজনীতি হচ্ছে রঙ্গমঞ্চ-সেখানে সফল রাজনীতিবিদ মানে আসলে একজন সফল অভিনেতা।
এথেন্সের সেই প্রাচীন গণতন্ত্র থেকে আজকের মোদি বা মমতাদি -পৃথিবীর প্রতিটি রাজনীতিবিদ, প্রথমে অভিনেতা, তারপরে অন্য কিছু। জর্জ ওয়াশিংটন , থমাস জেফারসন, মহত্মা গান্ধী, নেহেরু, নেতাজি বোস, ইন্দিরা গান্ধী, শেখ মুজিবর রহমান থেকে আজকের মোদি বা মমতা কেও এই অভিনয় বৃত্তের বাইরে না ।সমস্যা হচ্ছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভিনয়টা শুধু বিরোধি পক্ষের চোখেই ধরা পড়ে। ভক্তকূলের কাছে ইনারা ১০০% খাঁটি হিরে- তাদের কাছে এই অভিনয়ের প্রশ্ন উঠলে, আপনার পিঠে দুঘা পড়ার সম্ভাবনা আছে ।
রাজনৈতিক অভিনয়ে মমতা ব্যানার্জি সবাইকে পেছনে ফেলেছেন
দক্ষিন ভারতে অবশ্য এই কৃত্রিম বিভাজন ও অবলুপ্ত। সেখানের রাজনীতি সম্পূর্ন ভাবেই সিলভার স্ক্রীনের নেতা অভিনেতাদের দখলে। এনটি রামা রাও বা জয়ললিতাদের ক্ষেত্রে একটা সুবিধা হচ্ছে মমতা ব্যানার্জির মতন ক্যাডবেরি খেয়ে অনশনের অভিনয় করতে হয় না । তারা সিলভার স্ক্রীনে সুপার হিরো ছিলেন। রাজনৈতিক অভিনয়টা তাদের কাছে স্মুথ ট্রানজিশন । মসৃন অভিযোজন। স্টুডিও থেকে রাজনৈতিক মঞ্চে।
এই প্রবন্ধে আমি রাজনীতিবিদদের সেই অন্ধকার দিকটাই আলোচনা করব। অধিকাংশ রাজনীতিবিদ গ্রীনরুম এবং স্টেজের সামনে সম্পূর্ন আলাদা ব্যক্তিত্ব। তাদের ভক্তকূল নারাজ হবেন। কিন্ত তাতে সত্য বদলাবে না । রাজনীতিবিদদের অন্ধভক্তকূল গণতন্ত্রের আপদ। নাগরিকদের নির্মোহ যুক্তিবাদি দৃষ্টীভংগী শক্তিশালী গণতন্ত্রের সূতিকাগৃহ।
(২)
গ্রীক গণতন্ত্র-৪০০/৩০০ খৃষ্টপূর্বাব্দঃ
এথেন্স পৃথিবীর সর্বপ্রথম গণতান্ত্রিক নগর রাষ্ট্র। আজকের গণতন্ত্রের অনেক ধ্যান ধারনার উৎপত্তিস্থল এই এথেন্স। যেহেতু গণতন্ত্র মানুষের পূর্নাঙ্গ বিকাশ নিশ্চিত করে, খুব স্বাভাবিক ভাবে এথেন্সে প্রাচীন সভ্যতা বিকশিত হয়। গ্রীক দর্শন, সাহিত্য, নাটক-যা কিছু আজ বর্তমান আধুনিক সভ্যতার ভিত্তি, তার মূল আকর ছিল এথেন্সের গণতন্ত্রে।
ইক্লেসিয়া, এথেন্সের জনসভা, যেখানে নুড়ির মাধ্যমে ভোট হত । পৃথিবীর প্রথম গণতন্ত্র
এথেন্স স্পার্টার অধীনে ছিল বহুদিন। গণযুদ্ধের মাধ্যমে স্পার্টানদের বহিস্কার করার সাথে সাথে, এথেন্সের গণযোদ্ধা বাহিনী গণতন্ত্রের সূচনা করে। আক্ষরিক অর্থে এটিই পৃথিবীর প্রথম গণজাগরন । ৪৬০ খৃষ্টপূর্বাব্দে এফিয়ালেটসের নেতৃত্বে এথেন্সে শুরু হয় গণতান্ত্রিক শাসন । এছিল সরাসরি গণতন্ত্র। সমুদ্রতটে বসত "ইক্লেসিয়া"-বা গণসভা। সাদা আর কালো নুড়ি ঘড়ায় ফেলে হত ভোট। এথেনিয়ানরা জানত রাষ্ট্রে কারুর ক্ষমতা বেশী হলে, সে গণতন্ত্র ধ্বংস করে, রাজতন্ত্র স্থাপন করবে। সুতরাং গণতন্ত্র বাঁচাতে এক অদ্ভুত প্রথা চালু করে গ্রীকেরা। এথেন্সে কেও রাজনৈতিক ভাবে খুব শক্তিশালী হলে, ইক্লেসিয়া গণভোটের সিদ্ধান্তে তাকে চিরনির্বাচনে পাঠানোর ক্ষমতা রাখত। শক্তিশালীর নির্বাসন ছিল গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ। যা আজও আফ্রিকা বা পাকিস্তান, বাংলাদেশের মতন দেশে নেই। সেই ৪৫০ খৃষ্টপূর্বাব্দে এথেন্সে গণতন্ত্র এতটাই উন্নত -সেখানে থার্মোক্লিস্টের মতন বিজয়ী সেনাপতি, যিনি পার্শিয়ান সম্রাট জার্সির হাত থেকে এথেন্সকে বাঁচিয়েছিলেন, তাকে পর্যন্ত নির্বাসনে পাঠায় ইক্লেসিয়া। একদম গণভোটের মাধ্যমে। ভয় ছিল পাছে থার্মোক্লিস্ট মিলিটারি ক্যু করে গণতন্ত্র ধ্বংস করে। অথচ একবিংশ শতাব্দিতে পাকিস্তান বা বাংলাদেশের মত অসংখ্য দেশে শক্তিশালী মিলিটারী লিডাররা ক্যু করে ক্ষমতা দখল করে। এদের গণতান্ত্রিক ভিত সেই ৪৫০ খৃষ্টপূর্বাব্দের এথেন্সের মতন দৃঢ় না ।
কিন্ত গণতন্ত্রে অমৃতের সাথে গরলের সহাবস্থান। গণতঁন্ত্রের উষালগ্ন থেকেই রাজনীতি হচ্ছে নির্লজ্জ দলাদলি এবং তা অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়েই। সেই ব্যতিক্রম এথেন্সেও হয় নি।
এথেন্সের রাজনৈতিক চিন্তার অধিকাংশটা আমরা পায় প্লেটোর গ্রন্থ "রিপাবলিকে" ।
দেখা যাবে দুই দিকপাল দার্শনিক প্লেটো এবং সক্রেটিস গ্রীক গণতন্ত্র নিয়ে এতটাই বিরক্ত ছিলেন, এরা মডেল ব্যবস্থা হিসাবে গণতন্ত্রকে বাছেন নি। প্লেটোর রিপাবলিকে পাঁচ ধরনের রাজনৈতিক সিস্টেম আছেঃ
এরিস্টোক্রাসি - বুদ্ধিমান দার্শনিক রাজার শাসন
টোমোক্রাসি - বংশানুক্রমে পাওয়া রাজতন্ত্র
অলিয়ার্গকি- কিছু সংখক ফ্যামিলিরা হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা-যেমন রোমের বা ক্যাথ্রিজের সেনেট।
ডেমোক্রাসি- জনগণের শাসন
টাইর্যানি বা স্বৈরাচার-অত্যাচারী রাজা বা সেনাপতির শাসন
প্লেটো এথেন্সের রাজনীতিবিদদের নিয়ে এতটাই হতাশ ছিলেন, "রিপাবলিক গ্রন্থে" গণতান্ত্রিক শাসনকে স্বৈরাচারী শাসনের চেয়েও নিকৃষ্ট বলে উল্লেখ করেছেন।
প্লেটো ছিলেন এক নবীন গণতন্ত্রের নাগরিক। তরুন ভারতীয়দের মতন গণতন্ত্রের শুধু কালোদিকটাই তার চোখে পড়েছিল। আজকের নবীন ভারতীয়রা যেমন স্বৈরাচারী নরেন্দ্রমোদির শাসনকে গণতান্ত্রিক শাসনের থেকে ভাল "হবে" বলে মনে করে, অনভিজ্ঞতার দরুন প্লেটোও সেই দলে ছিলেন।
প্রশ্ন উঠবে পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞানের মহাভগীরথ প্লেটো এথেন্সের গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের প্রতি এত ক্ষাপ্পা হলেন কেন?
প্লেটো-রিপাবলিক গ্রন্থের রচয়িতা- যা পৃথিবীর প্রথম রাজনৈতিক ট্রিটিজ
প্লেটোর সেটা ব্যখ্যা করেছেন এইভাবে-
গণতন্ত্রে ধণী এবং দরিদ্র শ্রেনীর মধ্যে দ্বন্দ প্রকাশিত হবে গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে । যেহেতু গরীবদের সংখ্যা বেশি, কিছু বুদ্ধিমান ধুরন্ধর রাজনীতিবিদ গরীবদের ত্রাতা বিধাতা বলে নিজেদের জাহির করবে। গরীবদের ক্ষোভ কাজে লাগিয়ে এরা নিজেদের সৈন্যদল বানাবে এবং ক্ষমতা দখলের পর স্বৈরাচারী সম্রাট হিসাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে জনগনের ওপর অত্যাচারের স্টিমরোলার চালাবে।
অর্থাৎ প্লেটো বলছেন গণতন্ত্রে গরীবদের "ক্ষোভ" হচ্ছে পপুলিস্ট ডিমান্ড। এরং তা কাজে লাগায় রাজনৈতিক অভিনেতারা। কিন্ত আস্তে আস্তে তা স্বৈরাচারী শাসনে পরিণত হয়।
আশ্চর্য্য! আড়াইহাজার বছর আগে স্টালিন, লেনিনদের উত্থান কি অদ্ভুত ভাবে ভবিষ্যতবাণী করে গেছেন প্লেটো। শুধু তাই না - পশ্চিম বঙ্গে সিপিএম এবং মমতার উত্থান ও প্লেটোর রাজনৈতিক অভিজ্ঞানের চিত্রনাট্য মেনে। ৩৫ বছরের সিপিএম শাসনের পর এটা নিশ্চিত যে, গরীবদরদি হওয়াটা ছিল সিপিএমের অভিনয়-ঠিক যেমনটা প্লেটো বলে গেছেন ২৫০০ বছর আগে। ক্ষমতা দখলের পর পার্টির স্বৈরাচারী শাসনটাই ছিল মুখ্য।
মমতা ব্যানার্জিও প্লেটোর সেই চিত্রনাট্যের আরেক অভিনেত্রী মাত্র। তিনিও নন্দীগ্রাম এবং সিঙ্গুরে গরীবদের মা মাটি মানুষ সেজে অসাধারন অভিনয় করেছেন। প্লেটোর রিপাবলিকের নিয়ম মেনে। তবে সিপিএমের ক্ষেত্রে যে অভিনয়টা বুঝতে জনগণের দুই দশক লেগেছিল, মমতার ক্ষেত্রে স্টেজ আর গ্রীনরুমের ফারাকটা দুবছরেই বোঝা যাচ্ছে।
গণতন্ত্রের ইতিহাসটাই রাজনীতিবিদদের অভিনয়ের ইতিহাস। খাঁটি দুধ বলে কিছু নেই-গণতন্ত্র মানেই রাজনৈতিক অভিনয়ের ভেজাল।
আমি পরের কিস্তিতে এই সব নেতা এবং তাদের রাজনৈতিক অভিনয় নিয়ে আলোচনা করব।
রোমান সেনেট- ২০০ খ্রী পূর্বাব্দ থেকে ৪০০ খ্রীষ্টাব্দঃ
অর্থশাস্ত্র, কৌটিল্য , ৩০০ খ্রীঃ পূর্বাব্দঃ
জর্জ ওয়াশিংটন ঃ
মহত্মা গান্ধীঃ
নেতাজি সুভাস চন্দ্র বোসঃ
পন্ডিত নেহেরু ঃ
স্টালিনঃ
ইন্দিরা গান্ধীঃ
শেখ মুজিবর রহমানঃ
জ্যোতিবসুঃ
নরেন্দ্রমোদিঃ
মমতা ব্যানার্জিঃ
শেখ হাসিনা ঃ
খালেদা জিয়াঃ
এটা স্যোশাল মিডিয়ার যুগ। আমি নিশ্চিত, পাঠক এদের অভিনয় কুশলতা আমার থেকে বেশি ভাল জানেন। তারা মন্তব্য লিখে এই ব্যাপারে যতটা জানাবেন, আমরা সবাই উপকৃত হব।
প্রথম রোমান সম্রাট অগাস্টাস ( অক্টাভিয়ান) মৃত্যুশয্যায় শায়িত। পাশে কন্যা জুলিয়া। ঘটনাচক্রে জুলিয়া পিতৃবিরোধি বিদ্রোহী কন্যা। অগাস্টাসকে হত্যা করার ব্যর্থ ষড়যন্ত্রে সামিল। সাম্রাজ্য স্থিতিশীল করতে সম্রাট আগাস্টাস কন্যা জুলিয়াকে বাধ্য করেছেন টাইবেরিয়াসের সাথে বিবাহে। জুলিয়ার প্রেমিক ছিল লুলাস এন্টোনিয়াস। আগাস্টাস কন্যাকে বলেছিলেন, প্রেম যার সাথে খুশী কর-বিয়েটা টিবেরিয়াসকেই করতে হবে-কারন টিবেরিয়াস রোমের ভাবী সম্রাট। জুলিয়া হয়ে ওঠেন পিতৃবিদ্রোহী। ঘৃণা করতেন আগাস্টাসকে। আগাস্টাস তার পিতা না-এক ধুরন্ধর লোক যে রাজনীতির জন্য কন্যার প্রেমের বলি চড়িয়েছিল হাড়িকাঠে।
কিন্ত মৃত্যুমুহুর্তে অগাস্টাস কিছু বলে যেতে চান কন্যাকে- অগাস্টাস বললেন " "Did I play my part well in the comedy of life?" [ জীবনের নাটকে, আমার নিজের পাঠটা কি আমি ভাল করতে পেরেছি?]
রাজনীতির ইতিহাসে কথাটি বহুল প্রচলিত। সম্রাট অগাস্টাস একজন সফল রোমান রাজনীতিবিদ। যিনি ছলে বলে কৌশলে বন্ধু প্রতিম মার্ক এন্টনিকে হারিয়ে রোমান সাম্রাজ্য দখল করেন। মৃত্যুর আগে যিনি স্বীকার করে যাচ্ছেন রাজনীতি হচ্ছে রঙ্গমঞ্চ-সেখানে সফল রাজনীতিবিদ মানে আসলে একজন সফল অভিনেতা।
এথেন্সের সেই প্রাচীন গণতন্ত্র থেকে আজকের মোদি বা মমতাদি -পৃথিবীর প্রতিটি রাজনীতিবিদ, প্রথমে অভিনেতা, তারপরে অন্য কিছু। জর্জ ওয়াশিংটন , থমাস জেফারসন, মহত্মা গান্ধী, নেহেরু, নেতাজি বোস, ইন্দিরা গান্ধী, শেখ মুজিবর রহমান থেকে আজকের মোদি বা মমতা কেও এই অভিনয় বৃত্তের বাইরে না ।সমস্যা হচ্ছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভিনয়টা শুধু বিরোধি পক্ষের চোখেই ধরা পড়ে। ভক্তকূলের কাছে ইনারা ১০০% খাঁটি হিরে- তাদের কাছে এই অভিনয়ের প্রশ্ন উঠলে, আপনার পিঠে দুঘা পড়ার সম্ভাবনা আছে ।
রাজনৈতিক অভিনয়ে মমতা ব্যানার্জি সবাইকে পেছনে ফেলেছেন
দক্ষিন ভারতে অবশ্য এই কৃত্রিম বিভাজন ও অবলুপ্ত। সেখানের রাজনীতি সম্পূর্ন ভাবেই সিলভার স্ক্রীনের নেতা অভিনেতাদের দখলে। এনটি রামা রাও বা জয়ললিতাদের ক্ষেত্রে একটা সুবিধা হচ্ছে মমতা ব্যানার্জির মতন ক্যাডবেরি খেয়ে অনশনের অভিনয় করতে হয় না । তারা সিলভার স্ক্রীনে সুপার হিরো ছিলেন। রাজনৈতিক অভিনয়টা তাদের কাছে স্মুথ ট্রানজিশন । মসৃন অভিযোজন। স্টুডিও থেকে রাজনৈতিক মঞ্চে।
এই প্রবন্ধে আমি রাজনীতিবিদদের সেই অন্ধকার দিকটাই আলোচনা করব। অধিকাংশ রাজনীতিবিদ গ্রীনরুম এবং স্টেজের সামনে সম্পূর্ন আলাদা ব্যক্তিত্ব। তাদের ভক্তকূল নারাজ হবেন। কিন্ত তাতে সত্য বদলাবে না । রাজনীতিবিদদের অন্ধভক্তকূল গণতন্ত্রের আপদ। নাগরিকদের নির্মোহ যুক্তিবাদি দৃষ্টীভংগী শক্তিশালী গণতন্ত্রের সূতিকাগৃহ।
(২)
গ্রীক গণতন্ত্র-৪০০/৩০০ খৃষ্টপূর্বাব্দঃ
এথেন্স পৃথিবীর সর্বপ্রথম গণতান্ত্রিক নগর রাষ্ট্র। আজকের গণতন্ত্রের অনেক ধ্যান ধারনার উৎপত্তিস্থল এই এথেন্স। যেহেতু গণতন্ত্র মানুষের পূর্নাঙ্গ বিকাশ নিশ্চিত করে, খুব স্বাভাবিক ভাবে এথেন্সে প্রাচীন সভ্যতা বিকশিত হয়। গ্রীক দর্শন, সাহিত্য, নাটক-যা কিছু আজ বর্তমান আধুনিক সভ্যতার ভিত্তি, তার মূল আকর ছিল এথেন্সের গণতন্ত্রে।
ইক্লেসিয়া, এথেন্সের জনসভা, যেখানে নুড়ির মাধ্যমে ভোট হত । পৃথিবীর প্রথম গণতন্ত্র
এথেন্স স্পার্টার অধীনে ছিল বহুদিন। গণযুদ্ধের মাধ্যমে স্পার্টানদের বহিস্কার করার সাথে সাথে, এথেন্সের গণযোদ্ধা বাহিনী গণতন্ত্রের সূচনা করে। আক্ষরিক অর্থে এটিই পৃথিবীর প্রথম গণজাগরন । ৪৬০ খৃষ্টপূর্বাব্দে এফিয়ালেটসের নেতৃত্বে এথেন্সে শুরু হয় গণতান্ত্রিক শাসন । এছিল সরাসরি গণতন্ত্র। সমুদ্রতটে বসত "ইক্লেসিয়া"-বা গণসভা। সাদা আর কালো নুড়ি ঘড়ায় ফেলে হত ভোট। এথেনিয়ানরা জানত রাষ্ট্রে কারুর ক্ষমতা বেশী হলে, সে গণতন্ত্র ধ্বংস করে, রাজতন্ত্র স্থাপন করবে। সুতরাং গণতন্ত্র বাঁচাতে এক অদ্ভুত প্রথা চালু করে গ্রীকেরা। এথেন্সে কেও রাজনৈতিক ভাবে খুব শক্তিশালী হলে, ইক্লেসিয়া গণভোটের সিদ্ধান্তে তাকে চিরনির্বাচনে পাঠানোর ক্ষমতা রাখত। শক্তিশালীর নির্বাসন ছিল গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ। যা আজও আফ্রিকা বা পাকিস্তান, বাংলাদেশের মতন দেশে নেই। সেই ৪৫০ খৃষ্টপূর্বাব্দে এথেন্সে গণতন্ত্র এতটাই উন্নত -সেখানে থার্মোক্লিস্টের মতন বিজয়ী সেনাপতি, যিনি পার্শিয়ান সম্রাট জার্সির হাত থেকে এথেন্সকে বাঁচিয়েছিলেন, তাকে পর্যন্ত নির্বাসনে পাঠায় ইক্লেসিয়া। একদম গণভোটের মাধ্যমে। ভয় ছিল পাছে থার্মোক্লিস্ট মিলিটারি ক্যু করে গণতন্ত্র ধ্বংস করে। অথচ একবিংশ শতাব্দিতে পাকিস্তান বা বাংলাদেশের মত অসংখ্য দেশে শক্তিশালী মিলিটারী লিডাররা ক্যু করে ক্ষমতা দখল করে। এদের গণতান্ত্রিক ভিত সেই ৪৫০ খৃষ্টপূর্বাব্দের এথেন্সের মতন দৃঢ় না ।
কিন্ত গণতন্ত্রে অমৃতের সাথে গরলের সহাবস্থান। গণতঁন্ত্রের উষালগ্ন থেকেই রাজনীতি হচ্ছে নির্লজ্জ দলাদলি এবং তা অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়েই। সেই ব্যতিক্রম এথেন্সেও হয় নি।
এথেন্সের রাজনৈতিক চিন্তার অধিকাংশটা আমরা পায় প্লেটোর গ্রন্থ "রিপাবলিকে" ।
দেখা যাবে দুই দিকপাল দার্শনিক প্লেটো এবং সক্রেটিস গ্রীক গণতন্ত্র নিয়ে এতটাই বিরক্ত ছিলেন, এরা মডেল ব্যবস্থা হিসাবে গণতন্ত্রকে বাছেন নি। প্লেটোর রিপাবলিকে পাঁচ ধরনের রাজনৈতিক সিস্টেম আছেঃ
এরিস্টোক্রাসি - বুদ্ধিমান দার্শনিক রাজার শাসন
টোমোক্রাসি - বংশানুক্রমে পাওয়া রাজতন্ত্র
অলিয়ার্গকি- কিছু সংখক ফ্যামিলিরা হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা-যেমন রোমের বা ক্যাথ্রিজের সেনেট।
ডেমোক্রাসি- জনগণের শাসন
টাইর্যানি বা স্বৈরাচার-অত্যাচারী রাজা বা সেনাপতির শাসন
প্লেটো এথেন্সের রাজনীতিবিদদের নিয়ে এতটাই হতাশ ছিলেন, "রিপাবলিক গ্রন্থে" গণতান্ত্রিক শাসনকে স্বৈরাচারী শাসনের চেয়েও নিকৃষ্ট বলে উল্লেখ করেছেন।
প্লেটো ছিলেন এক নবীন গণতন্ত্রের নাগরিক। তরুন ভারতীয়দের মতন গণতন্ত্রের শুধু কালোদিকটাই তার চোখে পড়েছিল। আজকের নবীন ভারতীয়রা যেমন স্বৈরাচারী নরেন্দ্রমোদির শাসনকে গণতান্ত্রিক শাসনের থেকে ভাল "হবে" বলে মনে করে, অনভিজ্ঞতার দরুন প্লেটোও সেই দলে ছিলেন।
প্রশ্ন উঠবে পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞানের মহাভগীরথ প্লেটো এথেন্সের গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের প্রতি এত ক্ষাপ্পা হলেন কেন?
প্লেটো-রিপাবলিক গ্রন্থের রচয়িতা- যা পৃথিবীর প্রথম রাজনৈতিক ট্রিটিজ
প্লেটোর সেটা ব্যখ্যা করেছেন এইভাবে-
গণতন্ত্রে ধণী এবং দরিদ্র শ্রেনীর মধ্যে দ্বন্দ প্রকাশিত হবে গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে । যেহেতু গরীবদের সংখ্যা বেশি, কিছু বুদ্ধিমান ধুরন্ধর রাজনীতিবিদ গরীবদের ত্রাতা বিধাতা বলে নিজেদের জাহির করবে। গরীবদের ক্ষোভ কাজে লাগিয়ে এরা নিজেদের সৈন্যদল বানাবে এবং ক্ষমতা দখলের পর স্বৈরাচারী সম্রাট হিসাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে জনগনের ওপর অত্যাচারের স্টিমরোলার চালাবে।
অর্থাৎ প্লেটো বলছেন গণতন্ত্রে গরীবদের "ক্ষোভ" হচ্ছে পপুলিস্ট ডিমান্ড। এরং তা কাজে লাগায় রাজনৈতিক অভিনেতারা। কিন্ত আস্তে আস্তে তা স্বৈরাচারী শাসনে পরিণত হয়।
আশ্চর্য্য! আড়াইহাজার বছর আগে স্টালিন, লেনিনদের উত্থান কি অদ্ভুত ভাবে ভবিষ্যতবাণী করে গেছেন প্লেটো। শুধু তাই না - পশ্চিম বঙ্গে সিপিএম এবং মমতার উত্থান ও প্লেটোর রাজনৈতিক অভিজ্ঞানের চিত্রনাট্য মেনে। ৩৫ বছরের সিপিএম শাসনের পর এটা নিশ্চিত যে, গরীবদরদি হওয়াটা ছিল সিপিএমের অভিনয়-ঠিক যেমনটা প্লেটো বলে গেছেন ২৫০০ বছর আগে। ক্ষমতা দখলের পর পার্টির স্বৈরাচারী শাসনটাই ছিল মুখ্য।
মমতা ব্যানার্জিও প্লেটোর সেই চিত্রনাট্যের আরেক অভিনেত্রী মাত্র। তিনিও নন্দীগ্রাম এবং সিঙ্গুরে গরীবদের মা মাটি মানুষ সেজে অসাধারন অভিনয় করেছেন। প্লেটোর রিপাবলিকের নিয়ম মেনে। তবে সিপিএমের ক্ষেত্রে যে অভিনয়টা বুঝতে জনগণের দুই দশক লেগেছিল, মমতার ক্ষেত্রে স্টেজ আর গ্রীনরুমের ফারাকটা দুবছরেই বোঝা যাচ্ছে।
গণতন্ত্রের ইতিহাসটাই রাজনীতিবিদদের অভিনয়ের ইতিহাস। খাঁটি দুধ বলে কিছু নেই-গণতন্ত্র মানেই রাজনৈতিক অভিনয়ের ভেজাল।
আমি পরের কিস্তিতে এই সব নেতা এবং তাদের রাজনৈতিক অভিনয় নিয়ে আলোচনা করব।
রোমান সেনেট- ২০০ খ্রী পূর্বাব্দ থেকে ৪০০ খ্রীষ্টাব্দঃ
অর্থশাস্ত্র, কৌটিল্য , ৩০০ খ্রীঃ পূর্বাব্দঃ
জর্জ ওয়াশিংটন ঃ
মহত্মা গান্ধীঃ
নেতাজি সুভাস চন্দ্র বোসঃ
পন্ডিত নেহেরু ঃ
স্টালিনঃ
ইন্দিরা গান্ধীঃ
শেখ মুজিবর রহমানঃ
জ্যোতিবসুঃ
নরেন্দ্রমোদিঃ
মমতা ব্যানার্জিঃ
শেখ হাসিনা ঃ
খালেদা জিয়াঃ
এটা স্যোশাল মিডিয়ার যুগ। আমি নিশ্চিত, পাঠক এদের অভিনয় কুশলতা আমার থেকে বেশি ভাল জানেন। তারা মন্তব্য লিখে এই ব্যাপারে যতটা জানাবেন, আমরা সবাই উপকৃত হব।
No comments:
Post a Comment