এই লেখাটা লেখার কোন ইচ্ছা ছিল না। কিন্ত গত এক সপ্তাহ গুরগাওতে আমাদের ভারতীয় অফিসে কাটিয়ে-যেখানে আমাদের দেশের নব্য আই টি বাবুরা চাকরি করেন-অত্যন্ত দুঃখের সাথে লিখতে বসলাম। ভারতে এর আগে অনেক ঘুরেছি-কিন্তু কোনদিন কোন অফিসে চাকরি করি নি। এই প্রথম দু সপ্তাহের জন্য এখানে আছি। ভারতীয় আই টি কর্মিরা বা এম এন সির কর্মীরা কিভাবে কাজ করে, সেই অফিস সংস্কৃতির সাথে এই প্রথম পরিচয়। এরা সবাই তরুন কর্মী। এটা যেমন ভাল দিক। তেমন এনলাইটমেন্টের অভাব বেশ পীড়াদায়ক। শুধু মাইনা, আর ফেসিলিটিই বাড়ছে-মানুষটা বাড়ছে না। অধিকাংশ ছেলে মেয়েরাই কাজ আর ক্রিকেটের বাইরে কোন জ্ঞান রাখে না-রাখলেও ভাসা ভাসা। আর রাখবেই বা কি করে। সকাল আটটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত কাজ করে অফিসে।
যাইহোক সেই জন্যে আমি এটা লিখছি না। ওসব তুচ্ছ ব্যাপার। আমার যেটা এখানে অবাক লাগছে সেটা হচ্ছে লোক শক্তির অপচয়। আমাদের আমেরিকার হেডকোয়ার্টের ৪৫০ জনের জন্যে সাধারন সাফাই বা সিকিউরিটি কর্মী ১০ জন আছে কি না সন্দেহ। এখানে প্রায় ৩০০ জনে কর্মীর জন্যে ১০০ ওপর সাপোর্ট স্টাফ। যারা আই টি বাবুদের চা, জল, জল খাবার দেন এবং সিকিউরিটি দেখেন। এরা আবার কেও আমাদের কর্মী না-সবাই অন্য সংস্থা থেকে কন্ট্রাক্টে এসেছে। আমেরিকাতে আমরা নিজেদের চা কফি নিজেরাই বানিয়ে নিই-এখানে ওসব নেই। সব কিছুর জন্যে অফিসে লোক আছে। এমনকি পার্কিং লট থেকে গাড়ি বার করার জন্যেও কর্মি আছে। যার এইসব এম এন সিএর ফেসিলিটি পান না (শুধু খাওয়াটা ছাড়া) -এবং অত্যন্ত কম মাহিনাতে আসলে অন্য সংস্থার কর্মী। এমন কি আমাদের গেস্ট হাউসে প্রায় ২৪ ঘন্টা খাবার পাওয়া যায়-সব সময় ড্রাইভার আছে। ভারতে সস্তার লেবার এত সস্তা-বিশেষত আমেরিকান কোম্পানীগুলোর কাছে-এরা এখানে সেই ইন্ডিয়ান সিস্টেমটাকেই মজবুত করছে। আমেরিকান কালচারের ভালদিকটা-যে সবাইকে নিজের কাজ নিজেকে করতে হয়-সেটা মোটেও আনছে না। আমেরিকাতে ল্যাবেরটরী ভারী ভারী যন্ত্র এক ঘর থেকে অন্যঘরে নিয়ে আসা-ইত্যাদি সমস্ত ম্যানুয়াল লেবার আমাদের নিজেদেরই করতে হয়। অথচ আমেরিকান সংস্কৃতির এসব ভালোদিক গুলি মেরে, এখানে আমেরিকান কোম্পানী গুলো ভারতের বাবু কালচারকেই আরো বেশী করে পুশ করছে। আর তা যত হবে, ততই ধনতন্ত্রের ফলে, সামন্ততান্ত্রিক অতীত শ্রেণীগুলো মুঝে যাবার যে কথা ছিল, সেটা ত হচ্ছেই না-বরং বাড়ছে।
সমাজ বিজ্ঞানটা ঠিক বিজ্ঞান না-বরং বলা যায় প্রতিটা দেশ এবং কালে সমাজ পরিবর্তনের ধারা এতই আলাদা, প্রতিটা কেসই আলাদা বিশ্লেষনের দাবী রাখে।
ভারতে প্রতিবার এসে যে বিষয়টি আমার মনঃপীড়ার সব থেকে বড় কারন হয়-সেটা হচ্ছে এখানে শিক্ষিত বাবুদের সমাজে নীচু শ্রেণীর লোকেদের প্রতি ব্যাবহার। আমেরিকাতেও ধণী বা দারিদ্রের পার্থক্য অনেকটাই-কিন্ত কেও আমার কাজ করে দিচ্ছে বলে, তার সাথে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যপূর্বক সামন্ততান্ত্রিক ব্যাবহার ভারতে অত্যন্ত দৃষ্টিকটু। এটা কেও আমেরিকাতে দেখবে না। প্রতিটা কাজকেই ওখানে যতার্থ মর্যাদা দেওয়া হয়।
১৮০০ সালে ইউরোপে যখন শিল্প বিপ্লব শুরু হয়-ধণতন্ত্রের অধিক উৎপাদনের ধাক্কায়, দলে দলে সমাজের নীচু শ্রেণীর লোকেরা কারখানাতে যোগ দেয়। অধিকতর উৎপাদন থেকে, সমাজে যে একটা পরভোগী বাবু শ্রেনীর সৃষ্টি হল যেটাকে মার্কিস্টরা বুর্জোয়া বলেন, তারা নতুন রাজনৈতিক সিস্টেমের মধ্যমণি হলেন। সমস্যা হচ্ছে ভারতের শিল্পায়নের সাথে যদি আমি উন্নতদেশগুলির শিল্পায়নের তুলনা করি, তাহলে একটা বিরাট পার্থক্য হচ্ছে ইউরোপের শিল্পায়নের সাথে যে নবচেতনার উন্মেষ হয়-ভারতে সেটা প্রায় অবলুপ্ত। নইলে এই ২০০৮ সালে ভারতে টিভি খুললে, ১৫% চ্যানেল ধর্মীয় চ্যানেল পাচ্ছি। ধর্মীয় চ্যানেল আমেরিকাতেও আছে, কিন্তু এখানে পথে ঘাটে সর্বত্র এত ধার্মিক এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকের দেখা মেলে এবং নীচু শ্রেণীর সাথে তাদের ব্যাবহার, পরিস্কার ভাবেই বলে দিচ্ছে, ধণতান্ত্রিক বিকাশের সাথে যে বৌদ্ধিক বিকাশ অতীতের ইউরোপীয়ান ইতিহাসের সাক্ষী ছিল, তা ভারতে অনুপস্থিত।
2 comments:
শুধু ভারতে নয়, সমগ্র দক্ষিন এশিয়াতেই বিজ্ঞান ও প্রযূক্তির অভাবনীয় উৎকর্ষতা ও ঊন্নতির ( হোক সে পশ্চিমে থেকে ধার করা প্রযুক্তি) সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে ধর্মান্ধতার প্রসার ঘটছে এবং সমাজে শিক্ষিত ও সুশীল শ্রেণীর মধ্যে ধর্ম ব্যপক জনপ্রিয়তা স্থান করে নিচ্ছে। বিজ্ঞান ও ধর্মের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে এক জ়গাখিচুরি পাকিয়ে মিডিয়াতে উপস্থাপন করা হচ্ছে। লোকজনও গোগ্রাস গিলছে। এর পিছনে ড. জাকির নায়েকের ভুমিকাও কম নয়। তার লেকচার বাংলাদেশে ইসলামিক টিভিতে দিনরাত প্রচারিত হচ্ছে। এতে সবচেয়ে বেশী ধর্মের ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে যুবসমাজ। ব্রিটেনে চ্যানেল ফোর এ ২০০৬ সালে বিশ্ববিখ্যাত evolutionary biologist রিচার্ড ডকিন্স এর "The Root of All Evil?" শিরোনামের ডকুমেন্টারীটি প্রচারিত হয় যা ধর্মের কদর্য রূপটিকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। অথচ এটি নিয়ে কোন হই চই হয় নি। কোন ধার্মিক ব্রিটিশ ডকিন্সকে প্রাননাশের হুমকি দেয়নি। কিন্তু এরকম একটি ডকুমেন্টারী যদি বাংলাদেশে করা হত, আমি নিশ্চিত কোন টিভি চ্যানেল এটি প্রচার করতে চাইত না মুসলমানদের ভয়ে। আর প্রচার করা হলেও পরদিন ঐ টিভি স্টেশন ভাংচুর করে শেষ করে দিত কট্টরপন্থী মুসলমানরা। যীশু নিয়ে রসিকতা করলেও ইউরোপিয়ান খৃষ্টানরা কিছু বলবেনা। কিন্তু মুহম্মদ এর "ম" নিয়ে টু শব্দ উচ্চারন করলেও মুসলমানরা গলা চেপে ধরবে। "Da Vinci Code" ছবিটিতে যীশুকে নিয়ে অনেক বিতর্কিত কথা বলা হলেও, তা নিয়ে কোন খৃষ্টান, ছবির পরিচালককে হত্যার হুমকি দেয় নি। কিন্তু মুহম্মদকে নিয়ে এরকম ছবি বানালে বোধহয় পরদিনই পরিচালকের লাশ পাওয়া যেত অথবা মুসলমানরা এর প্রেক্ষাগৃহ ভাংচুর করতো, আগুন জালিয়ে দিত।
Talat
Post a Comment