Thursday, October 20, 2011

গদ্দাফির মৃত্যুঃ স্বৈরাচারের পতন পৃথিবী জুরে আসন্ন


(১)

গদ্দাফির লিবিয়া-হিরক রাজার দেশে

যেদিন লিবিয়াতে গণবিদ্রোহ শুরু হল, 15 ই ফেব্রুয়ারী। সবে টিউনিশিয়া এবং মিশরে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়েছে। প্রায় সেই দিনই লিখতে যাচ্ছিলাম, এবার আরব বসন্ত লিবিয়াতে। সাদ্দাম হুসেনের পর মধ্যপ্রাচ্য বা উত্তর আফ্রিকার আরেকটা সব থেকে বড় নর-জানোয়ারের পতন আসন্ন।

তবে পতন এত সহজে আসল না। গদ্দাফি এবং তার পরিবার গত চল্লিশ বছরে লিবিয়ার সম্পদ এবং বাণিজ্য কব্জা করে বিপুল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। শুধু তাই না, লিবিয়ার লোকজন বিদ্রোহ করতে পারে এই আশঙ্কাতে তার পরিবার আফ্রিকান, পাকিস্তানী বাংলাদেশীদের নিয়ে এক বিরাট প্রাইভেট আর্মিও পুষত। ফলত ফেব্রুয়ারী মাসে লিবিয়ান সেনা বাহিনী যখন বিদ্রোহীদের ওপর গুলি চালাতে অসম্মত হয়, তখন এই সব ভারাটে সৈন্য দিয়েই নিজের দেশের লোক মেরেছে গদ্দাফি। ফলে গৃহযুদ্ধ ছিল আসন্ন, এবং সেই যুদ্ধে ন্যাটো যখন বিদ্রোহীদের পাশে দাঁড়ায় তখন গদ্দাফির পতন ছিল সময়ের অপেক্ষা। তৈল সমৃদ্ধ একটা দেশ-যাদের জিডিপি বেশ বেশী-কিন্ত সেখানে চিকিৎসা, শিক্ষা, কৃষি প্রায় সব ধ্বংস হয়েছে গদ্দাফি শাসনে।

যদিও অনেকেই সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে দেখাবে উত্তর আফ্রিকাতে শিক্ষা এবং জিডিপিতে লিবিয়া এগিয়ে, কিন্ত এটা ভুললে চলবে না, উত্তর আফ্রিকাতে মাথাপিছু তেলের সম্পদ লিবিয়াতেই সব থেকে বেশী। সুতরাং তেলের টাকার সদ্বাব্যবহার করলে, লিবিয়ার অবস্থা হওয়া উচিত ইউরোপের দেশগুলির সমগোত্র।

গদ্দাফি বিরোধিতা ছিল আইনত নিশিদ্ধ এবং মৃত্যুদন্ড ছিল তার সাজা!

হ্যা লিবিয়া ছিল সেই হিরক রাজার দেশ-যেখানে ইংরেজি এবং ফ্রেঞ্চ পড়ানো হত না সরকারি স্কুলে। বিদেশীদের সাথে কথা বলার জন্যে প্রশাসনের অনুমতি লাগত। সরকারি টিভি এবং নিউজপেপার ছারা অন্য কিছুর অনুমতি ছিল না লিবিয়াতে।
তবে গদ্দাফি একটা ছোট্ট ভুল করেছিলেন। স্যোশাল মিডিয়ার যুগে মেইন স্ট্রিমে সেন্সর করে কিছু হয় না। ফেসবুক, টুইটারের মাধ্যমে লিবিয়ানরা অনেকদিন থেকেই সংঘবদ্ধ হচ্ছিলেন।

গদ্দাফির হাতে অনেক সময় ছিল তৈল সম্পদ ব্যবহার করে লিবিয়ার ২০% বেকারত্বকে কমানো। চিকিৎসা, শিক্ষা কৃষির উন্নতি করা।

কিছুটা বুঝেছিলেন গদ্দাফি-উন্নয়নের কিছু কাজ শুরু করেছিলেন। বন্ধুবর সাদ্দাম হুসেনের মৃত্যুর পর, ওর মাথায় ঢুকেছিল, আমেরিকা আর বৃটেনকে হাতে রাখতেই পারলেই, মারে কে! ফলে আমেরিকাকে প্রায় আড়াই বিলিয়ান ডলারের ঘুঁষ আর বৃটেনকে দেড় বিলিয়ান ডলার খাইয়ে, আমেরিকা এবং বৃটেনকে হাত করে ফেলেছিলেন গদ্দাফি। আমেরিকা তার ওপর থেকে সন্ত্রাসবাদি তকমা তুলে নিয়েছিল। বৃটেন ও তাই। চিরকাল আমেরিকা বিরোধিতা করার পরে, যখন দেখলেন আর উপায় নেই, ঠিক টাকা দিয়ে ওয়াশিংটনের সাথে মাখো মাখো একটা সম্পর্ক তৈরী করে ফেলেছিলেন গদ্দাফি।

কিন্ত বিধি বাম! আরব বসন্তের জোয়ারে আমেরিকাও বাধ্য হল তার বিরুদ্ধে যেতে। বিশেষত প্যান এম বম্বিং এ যারা প্রাণ হারিয়েছিলেন, তাদের পরিবার ওবামা প্রশাসনের ওপর নিরন্তর চাপ রেখেছিল গদ্দাফিকে হটানোর জন্যে। নইলে গদ্দাফি বাম হাতে আমেরিকাকে আরো পাঁচ বিলিয়ান ডলার দিতে রাজি ছিলেন ন্যাটোকে তুলে নেওয়ার জন্যে!

(২)
বিশ্বের সফলতম এবং বৃহত্তম গিরগিটীর জীবনী

গদ্দাফি চরিত্র নিয়ে লিখতে বসলে দস্তভয়েস্কিও হাত তুলে দিতেন। আমি অনেকদিন ধরেই ওর জীবনী পড়ছিলাম। সত্যিই এই চরিত্র বিশ্বইতিহাসে ইউনিক।

এই লোকটা একাধারে চূড়ান্ত রকমের ইসলামিক মৌলবাদি যে প্রকাশ্যে সর্বত্র বলে বেড়াত ইসলাম হচ্ছে একমাত্র ধর্ম এবং খ্রীষ্ঠান ধর্ম "ডাইল্যুটেড" -অন্যদিকে যখন ইসলামি মৌলবাদিরা আশির দশকে
তাকে হত্যার চেষ্টা শুরু করে-তখন থেকে পালটি খেয়ে এই লোকটাই হয়ে গেল ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ বিরোধি। তার আগে পর্যন্ত সে নিজে ছিল ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের সব থেকে বড় টাকা জোগানদার!

আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থা সিয়ার সাথে তার সম্পর্ক অদ্ভুত। সিয়া এত সাহায্য আর কারুর কাছ থেকে পায় নি! তাই আজ যখন কিছু কিছু বাম বাঙালী তাকে আমেরিকান সম্রাজ্যবাদ বিরোধি এক চরিত্র বলে হিরো বানানোর চেষ্টা করছে-তাদের দুটো তথ্য জানা উচিতঃ

এক -১৯৮০ থেকে প্যান এম বোম্বিং- সিয়া আফ্রিকা এবং ইউরোপের প্রচুর রাষ্ট্রনেতা এবং জার্নালিস্টদের হত্যা করেছে গদ্দাফির ঘাতক বাহিনী কাজে লাগিয়ে। গদ্দাফির অন্যতম বড় সমর্থক ছিল আমেরিকা। দীর্ঘদিন।
কেন গদ্দাফি-আমেরিকার সম্পর্ক ভেঙে শত্রুতা শুরু হল-সেটা লম্বা কাহিনী।

দুই-১৯৮৪ সালে তাকে খুন করার জন্যে বৃটিশ ইন্টালিজেন্সের ছক ও ভেস্তে দেয় সিয়া! কারন? কারন লিবিয়ার টাকা খাটত অনেক কমিনিউস্ট "বিপ্লবী" পার্টিতে। ব্রাজিল থেকে অস্ট্রেলিয়া-অনেক জায়গাতে কমিনিউস্ট আন্দোলনে টাকা ঢালতেন গদ্দাফি। মজার ব্যাপার হচ্ছে এগুলো গদ্দাফি করত সিয়ার নির্দেশে। কারন ওইসব পার্টিগুলিতে লিবিয়ান ইন্টালিজেন্সির মাথাগুলি ঢুকে যেত। আর খবর পাচার হয়ে যেত সিয়ার কাছে।

যাইহোক, রঙ বদলাতে এমন ওস্তাদ সার্কাসের খেলোয়ার বিশ্বে আর আসে নি।
গদ্দাফি শুরু করছিল প্যান আরব স্যোশালিজম প্রতিষ্ঠার জন্যে। সে খেলা জমলো না-আরব নেশন তৈরী হল না। তখন সে শুরু করল, প্যান আফ্রিকান জাতিয়তাবাদ। সেখানে অবশ্য গদ্দাফির কিছু সাফল্য আছে।

আরো মজার ব্যাপার হল, চাদ আক্রমন করে লিবিয়া যখন খুব একটা সুবিধা করতে পারল না-রাতারাতি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে গদ্দাফি তাদের ত্রাতা হিসাবে আবির্ভুত হয়েছিলেন। তাদের জন্য ঘরবারি বানানো থেকে অনেক কিছুই দিতে চেয়েছিলেন যাতে তার প্যান আফ্রিকান নেতার ইমেজে চোট না লাগে।

১৯৭০-১৯৮০, এক নাগাড়ে তিনি টাকা দিয়েছেন বিশ্বের অনেক মুসলিম সন্ত্রাসবাদি সংস্থাকে। আবার যখন নিজের দেশের ইসলামিক মৌলবাদিরা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, হঠাৎ করে পাশ্চাত্যের কাছে নিজের ইমেজ বানালেন ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে।

মোদ্দা কথা রং বদল করার ব্যপারে গদ্দাফি ছিলেন অদ্বিতীয়। ফলে যে আমেরিকা তার প্রাসাদ বম্বিং করেছিল এবং লিবিয়ার ওপর নিশেধাজ্ঞা আনে-শেষে বিরাট টাকার বিনিময়ে, তাদের সাথেই ঘনিষ্ট হবার চেষ্টা করেছেন। আবার একদম শেষের দিকে যখন তার মনে হয়েছে গণতন্ত্রকে বেশীদিন টুটি চিপে রাখা যাবে না-তখন ২০০৯ সালে তিনি ঘোষণা দেন কিছু কিছু মন্ত্রীর জন্যে নির্বাচন হবে! যদিও তা কোনদিনই হয় নি।
মোটামুটি হাওয়া মোরগ ছিলেন গদ্দাফি-ঠিক ঠাক সময়ে রং বদলাতে তার জুরি মেলা ভার।

গদ্দাফি এবং তার পরিবারের নিষ্ঠুরতা বা লালসা নিয়ে শব্দ খরচ করে লাভ নেই। তবে গিরগিটির শেষ রং টা নিয়ে না লিখে পারছি না।

গদ্দাফির দেশে অবৈধ সঙ্গমের শাস্তি হচ্ছে শরিয়া আইন অনুযায়ী ৫ বছরের জেল আর বেত্রাঘাত। আর এই গদ্দাফিই বিদেশে ভ্রুমন কালে বিদেশীনী সাংবাদিকদের সাথে শোয়ার ব্যপারটা রুটিন করে ফেলেছিলেন। তার ফর্মুলা ছিল সিম্পল-যদি আমার ইন্টারভিউ চাও, আমার সাথে শুতে হবে! শরিয়া আইন অবশ্যই তার জন্যে চলবে না। কারন এই সব সাংবাদিকদের সাথে শোয়ার ব্যপারটা তার কাছে এক সময় এমন প্রেস্টিজের ব্যপার হয়ে দাঁড়ায়, বিদেশ সফর শেষে ফিরে এসে উনি গুনতেন এবার কজন হল এবং সেটা নিয়ে তার তাবুতে টোস্টিং ও হত!

যাইহোক হুগো শ্যাভেজ এবং ফিদেল কাস্ত্রো ছিলেন গদ্দাফির সমর্থক! কারন গদ্দাফি আমেরিকার বিরুদ্ধে এক সময় সন্ত্রাসের চেষ্টা করেছে। বেশ এক দশক আমেরিকা বিরোধিতা চালিয়েছিলেন গদ্দাফি এবং সাদ্দাম হুসেনের উৎখাতে পর বুঝেছিলেন আমেরিকা বিরোধিতা মানে নিজের কবর খোঁজা। সেই মত টাকা ঢেলে পালটিও খেয়েছেন ঠিক সময়ে। গুগো শ্যাভেজ বা ফিদেলের পিঠ চাপড়ানোতে পিঠ বাঁচবেনা-এটা বুঝতেন গদ্দাফি।

অধিকাংশ বাম বাঙালী এবং ইসলামিস্ট ন্যাটোর বিরুদ্ধে গদ্দাফির সমর্থক ছিল। ইসলামিস্টদের ব্যপারটা
বোধগম্য। তবে বামেদের সমর্থনটা আরেকটা বামপন্থী অগভীরতার ফল। গদ্দাফি লোকটা কে, সেটা জানার কোন চেষ্টাই তারা করে নি।


Saturday, October 15, 2011

ইসলাম এবং একটি কচলানো লেবুর গল্প

(১)

আমার এই প্রবন্ধটি মুক্তমনার পাঠক এবং যুক্তিবাদি গুরুভাইদের জন্যে। তাদের জন্যে একদম এক্সক্লুসিভ রচনা।

আজকাল নানান কারনে লেখার সময় প্রায় নেই-শুধু একটু আধটু ব্লগ পড়ি। কিন্ত সৌদি আরবে ৮ বাংলাদেশীর শিরোচ্ছেদকে কেন্দ্রকরে যেভাবে নানান বাংলাদেশী ব্লগে ইসলাম এবং ইসলাম বিরোধি গোষ্টর বিতর্ক হচ্ছে, তাতে দুটো জিনিস আমাকে ভীষন পীড়া দিল। তাই দুটো কথা লিখছি-

প্রথমত একদল মনে করে এর জন্যে ইসলাম দায়ী। আরেকদল মনে করে, ইসলামের এমন নিষ্টুর আইন বিধান সমাজের জন্যে ভাল।

দ্বিতীয়ত গোটা ঘটনাটা কেও ইতিহাস ধরে , ইতিহাসের প্রগতি থেকে বিচার করলো না। আরবে এক সময় বৃটিশরা ক্ষমতায় ছিল। তারা কেন সেখানে বৃটিশ আইন চালু করল না? কেন মধ্যপ্রাচ্য আদিম যুগে থেকে গেল? এর জন্যে কি শুধু ইসলাম দায়ী? যুক্তিবাদিদের দাবী সেই রকমই।

বিতর্ক লেখালেখি ভাল জিনিস। বিরক্ত হয়েছি অন্য কারনে। বর্তমান বিশ্বে অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট, গ্রীস-ইটালিতে সরকার বিরোধি আন্দোলন, অর্থনৈতিক মন্দা, মধ্যপ্রাচ্যে গণতান্ত্রিক জাসমিন বিপ্লব, তীব্র খাদ্য সংকট এবং পরিবেশ বিপর্যয় চলছে। এইসব বর্তমান ঘটনা বিশ্বের ইতিহাসের পরিবর্তন অনুঘটক। মুক্তমনা সমাজে এই নিয়ে খুব বেশী চিন্তা ভাবনা দেখি না। শুধু ইসলাম পেটানোতে লোকের উৎহাস বেশী।

ঢাকা এবং কোলকাতা দুটিই বসবাসের অযোগ্য শহর। এগুলোকে বসবাসযোগ্য করা নিয়ে কোন চিন্তাভাবনা ব্লগে দেখি না। শুধু ব্লগের পর ব্লগ ইসলাম নিয়ে। যতদোষ নন্দঘোষ টাইপের আনক্রিটিক্যাল লেখাতে ভর্ত্তি হচ্ছে মুক্তমনা।

(২)

ইসলাম কি?

ইসলাম প্রেমীদের কাছে তা সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম, ইসলাম বিরোধিদের কাছে তা সর্ব নিকৃষ্ট ধর্ম।

তাতে অসুবিধা নেই। কিন্ত একজন যুক্তিবাদি, বিজ্ঞান মনস্ক মানুষের কাছে "ইসলাম" কি তাহলে?

বিজ্ঞানে ধর্মের অস্তিত্ব নেই। সমাজ বিজ্ঞানে ধর্ম একটি বিবর্তিত সাংস্কৃতিক মিম। সেলফ অর্গানাইজেশন বা সমাজ/রাষ্ট্র গড়ার জন্যে কিছু নির্বাচিত মিম। সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্মের জন্যে এককালে ইহাদের দরকার ছিল। আজকে উন্নত যোগাযোগ এবং বাজারের যুগে তা অর্থহীন। কারন গোটা বিশ্বই একটি ক্ষুদ্র গ্রামে পরিণত হতে চলেছে। আজকে মানুষ সমাজ বদ্ধ হচ্ছে স্যোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে-বাজারের মাধ্যমে। রাষ্ট্রর ধারণাটাই উঠে যেতে চলেছে। এবং আস্তে আস্তে রাষ্ট্রের সীমানা দুর্বল হচ্ছে বাজারের চাপে। ত্রিশ বছর আগেও ইসলাম নিয়ে মাতামাতি ছিল না। কারন আরবের তেলের পয়সা ছিল না। সবটাই একটা বাজারের প্রোডাক্ট। টাকা এল, মাদ্রাসা খুললো-কিছু গরীবের সংস্থান হল। তাহলে ইসলামে পেট চালাতে পারে-এমন ধারনা পেল সবাই। ফলে মধ্যযুগীয় আরবিক ধারনাও ফিরে এল। তেল শেষ হলে আরবের খাওয়ানোর ক্ষমতা চলে গেলে, এসব উৎপাত ও যাবে। যদি কোন হিন্দু গরীবকে খাওয়াতে পারে, তাহলে সেই সর্বহারা হিন্দুয়ানীতে বিশ্বাস করবে, ইসলাম খাওয়ালে সে ইসলামের ভক্ত হবে। কালকে যদি ২৫ লাখ বাংলাদেশী ভারতে আইন মেনে ভাল কাজ পায়, তারাও ভারতীয় সিস্টেমের দিকেই ঝুঁকবে। সুতরাং যেসব বাংলাদেশীরা আরবের টাকায় সংসার প্রতিপালন করে, তাদের আরবের প্রতি দুর্বলতা থাকা স্বাভাবিক।

ইসলামের বর্তমান উৎপাত খুব সাময়িক একটা এবারেশন। যা কিছু উন্নত উৎপাদন দিতে ব্যার্থ-তা দীর্ঘদিন চলতে পারে না। যা করলে পেট চলে, বেঁচে থাকা যায়, মানুষ সেটাকেই ধর্ম হিসাবে নেয়। কলকাতার ঝি লোকাল ট্রেন গুলোতে দেখা যাবে দরিদ্র কবলিত অঞ্চলগুলি থেকে কপালে বিশাল সিন্দুর লাগিয়ে ঝিয়েরা বাবু-বিবিদের বাড়িতে কাজ করতে আসে। এদের অনেকেই মুসলমান-কিন্ত কাজের জন্যে হিন্দু সেজে এসে কাজ করে। দীর্ঘদিন কাজ করার পরে হিন্দুয়ানী রপ্ত ও করে ফেলে।

আমি কিছুক্ষণ আগেই একটা মুদির দোকান থেকে ফিরলাম। দুই পাকিস্তানি মহিলা এর মালিক এবং ভাল চালাচ্ছে। এরা যখন শুরু করেছিল, দোকানের দুদিকে মক্কা মদিনার ছবি, কোরানের আয়াত ইত্যাদি ছিল। কিন্ত কাস্টমাররা ত সব শিখ আর হিন্দু। টাকাও এদের পকেটেই বেশী। আর তার ওপর পাশেই একটা ভারতী মুদির দোকান। দুবছরে এই দুই মহিলা দোকানের ডেকরেশন সব বদলে দিয়েছে। আগে ঢুকলে বোঝা যেত এটা মুসলমানীদের দোকান-এখন সেসব চিহ্ন নেই। মালকিন কারা না জানলে, ঢুকলে মনে হবে এটা আরেকটা ভারতীয়র দোকান। এগুলো কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা না- আমি এমন অনেক কেস দেখেছি।

ভারতে আমার বাড়ীর সামনে নদী পেরোলেই মুসলমান গ্রাম। সেখানে আগে ইসলামের গন্ধ ছিল না। সবাই হিন্দু শহরে এসে জীবিকা নির্বাহ করত। ১৯৯০ সাল থেকে আরবের টাকায় সেখানে মসজিদ, মাদ্রাসা হয়ে, তারা আর ভারতে থাকে না, নিজেদের বেশী আরবীয় বলেই মনে করে। যেদিন আরবের টাকাতে আর এসব চলবে না-সেদিন আবার আগের জায়গাতেই ফিরে যাবে।

সবর্ত্র আমি এটাই দেখছি, ধর্ম পেট চালানোর ক্ষমতা না দিলে, সেই ধর্ম এমনিতেই লোপ পায়। গুটিকয় শিক্ষিতলোকের ধর্মবিলাস দিয়ে ধর্ম নির্নীত হয় না। বাঙালী মুসলমানরা কি ধরনের মুসলমান? ১৮৮০ সালের আগে বাংলা ভাষাতে লেখা কোন কোরানই ছিল না। গিরীশ ভাই নামে এক হিন্দু প্রথম ফার্সী থেকে কোরানের বঙ্গানুবাদ করেন। এর কারন কি? আসলে অসংখ্য বাঙালী মুসলমানদের কাছে ইসলাম ছিল এক সহজিয়া ধর্ম- হিন্দু জাতিভেদ থেকে বাঁচার উপায়। কিন্ত আরবের সংস্কৃতিকে অত জড়িয়ে ধরার প্রয়োজন তাদের হয় নি। কারন সেই সংস্কৃতি থেকে তাদের বাঁচার উপাদান কিছুই ছিল না।

তাই আমরা দেখি ১৬০০ খ্রীষ্ঠাব্দ থেকে মুসলমান বাঙালী কবিরা হিন্দু উপাখ্যান নিয়েই সাহিত্য রচনা করেছে-কোরানের বঙ্গানুবাদ করে তারা সময় নষ্ট করে নি। কোরান হদিস তাদের র‍্যাডারেই ছিল না। হয়ত বিংশ শতাব্দির আগে অধিকাংশ বাঙালী মুসলমান জানতই না কোরান বলে এক গ্রন্থের কথা। কারন তারা ছিল নিরক্ষর এবং বাংলা ভাষাতে কোরান তখনো কেও লেখে নি। তাদের কাছে ইসলাম ছিল এক সাম্যের ধর্ম-যেখানে জাতের কারনে তাদের সমাজে ছোট হয়ে থাকতে হত না। অর্থাৎ ইসলাম ছিল তাদের বাঁচার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এবং সেই বাঙালী ইসলামের সাথে কোরানের কোন সম্পর্ক ছিল না। থাকলে ১৬০০ সালের আগেই যখন আরাকানে বাঙালী মুসলমানরা কাব্য রচনা করছেন-তখনই বাংলাতে কোরান লেখা হত।

আমার বক্তব্য এটাই বিজ্ঞানে ধর্ম বলে কোন কিছু নেই। সমাজ বিজ্ঞানে যা আছে তা হচ্ছে "বেঁচে থাকার জন্যে সাংস্কৃতিক উপাদান" যা বিবর্তনের পথে নির্বাচিত ।

ইসলাম বা যেকোন ধর্মকে ধর্ম বলে মানা এবং দেখা হচ্ছে সব থেকে বড় অবৈজ্ঞানিক যুক্তি। সুতরাং একজন ধর্ম বিরোধি যখন ইসলামকে একটি ধর্ম হিসাবে দেখে এবং ধর্ম হিসাবে তার বিরোধিতা করে-তার যুক্তিও একজন ধার্মিকের সমান অবৈজ্ঞানিক।

(৩)

প্রতিটা মানুষের পরিধি সীমিত। মুক্তমনার অধিকাংশ লেখক বয়সে নবীন। তারা ইসলামিক সমাজের অবিচার, অনাচার এবং অত্যাচার দেখে বড় হয়েছে। এতে তাদের যুক্তিবাদি মন বিদ্রোহী হয়েছে এবং তারা মুক্তমনাতে ইসলাম বিরোধি লেখালেখি করছে। এমন ঘটনা হিন্দু ধর্মে ঘটেছিল ১৮২০-৩০ সালে ডিরোজিওর শিষ্যদের মধ্যে। কিন্ত তাদের যুক্তিবাদি চেতনাতে হিন্দু ধর্ম উঠে যায় নি। বড়জোর বিবর্তিত হয়েছে। এর কারন হিন্দু ধর্মের কিছু কিছু "এলিমেন্ট" এই দেশের মানুষের বেঁচে থাকার জন্যে দরকার ছিল। এই প্রথম এলিমেন্টটার নাম হিন্দু জাতিয়তাবাদ যা বৃটিশ বিরোধি আধুনিক আন্দোলনের প্রথম ধাপ। ইতিহাস খুব ভাল ভাবে পড়লে বোঝা যাবে বিবেকানন্দ, দয়ানন্দ সরস্বতীদের উত্থানের পেছনে একটা বড় কারন বৃটিশ বিরোধি আন্দোলন, বৃটেনের হাত থেকে স্বাধীন হওয়ার আকাঙ্খা।

তাহলে যুক্তিবাদি আন্দোলন শ্রেষ্ঠতর হওয়া সত্ত্বেও হিন্দু ধর্মটা ডিরোজিওর শিষ্যদের হাত থেকে টিকে গেল কি করে?

এখানেও প্রথমে উঠে আসবে বেঁচে থাকার টেকনিক। মানুষ সমাজবদ্ধ ভাবে বেঁচে থাকে। ধর্ম সেই সামাজিক আইনগুলো - পিতা মাতার প্রতি কর্তব্য, সন্তানের প্রতি দ্বায়িত্ব, সমাজের প্রতি দ্বায়িত্ব-এই যুথবদ্ধতা শেখায়। যা গুরুত্বপূর্ন সাপোর্ট সিস্টেম তৈরী করে। বেঁচে থাকার জন্যে এগুলি দরকার। ধর্ম বিরোধি ঋণাত্মক আন্দোলনে এগুলি গুরুত্ব না দিলে, ধর্ম বিরোধিতা ফালতু। এই কারনে রিচার্ড ডকিন্স ফোরামে নাস্তিকদের মধ্যে পেরেন্টিং, স্যোশালাইজেশন ইত্যাদি বিষয়গুলির ওপর বেশী জোর দেওয়া হয়-এই সাপোর্ট সিস্টেম না তৈরী হলে ধর্মকে তোলা অসম্ভব।

এমন নয় যে এই সাপোর্ট সিস্টেম বা সামাজিক আইনগুলির জন্যে ধর্ম অপরিহার্য্য। মোটেও তা না। ধর্ম নিরেপেক্ষ আইনের ভিত্তিভূমি বৃটেনের ইউলিটেরিয়ান আন্দোলন। যা এই ধরনের যুথবদ্ধতার আইনগুলির ভিত্তিভূমি রচনা করেছিল। যদিও অনেকেই মনে করেন, তা খ্রীষ্ঠান ধর্মের সংস্কার আন্দোলন থেকে জন্ম নেওয়া। তেমনই ইসলামের সংস্কার আন্দোলন থেকে ইউলেটেরিয়ান ধরনের ধর্ম নিরেপেক্ষ আইনের জন্ম হতে পারে উন্নততর সমাজের জন্যে। সবটাই সেই উন্নততর উৎপাদনের প্রয়োজনে বিবর্তিত হয়।

(৪)

তাহলে উন্নততর উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্যে ইসলাম বদলাচ্ছে না কেন? খ্রীষ্ঠানরা বদলেছে, হিন্দুরা ধর্ম থেকে আস্তে আস্তে সরে আসছে-মুসলমানরা বদলাচ্ছে না কেন?

আসলে মধ্যপ্র্যাচ্যের তেল ইসলামি বিশ্বের আধুনিক অগ্রগতির দারুণ ক্ষতি করেছে। যদ্দিন মধ্য প্রাচ্যে তেলের আবিস্কার হয় নি তদ্দিন মিশর, ইরান, ইরাকে সর্বত্র আধুনিক বাম ভাবধারার রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৪০ সাল থেকেই যা উপনিবেশ বিরোধি আন্দোলন থেকে উদ্ভুত। কিন্ত মধ্য প্রাচ্যে তেলের আবিস্কারের সাথে সাথে মুসলিম বিশ্বের তিনটি ক্ষতি হয় যা মুসলিমদেরকে আজও মধ্যযুগে আবদ্ধ করে রেখেছে-

এক- বৃটেন এবং আমেরিকা এই সব প্রগতিশীল আন্দোলনগুলিকে ছুড়ি মারে-কারন এগুলি ছিল জাতিয়তাবাদি আন্দোলন যা তৈলখনিগুলির জাতিয়তকরন চেয়েছিল। এতে বৃটিশ এবং আমেরিকার তেলের কোম্পানীগুলি নিজেদের ব্যবসা হারাবার আকাঙ্খায় এই প্রগতিশীল আন্দোলন ধ্বংস করে,সেখানে বশংবদ ডিক্টেটরিয়াল শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলে।

দুই- এইসব প্রগতিশীল আন্দোলনের উৎস ছিল দুটি-পেটের ক্ষিদে এবং উপনিবেশ থেকে মুক্তির আকাঙ্খা। ইসলাম দিয়ে পেটের ক্ষিদে মিটবে না-এটা ১৯৩০-১৯৬০ অব্দি এই সব আন্দোলনের নেতারা বুঝেছিলেন। তারা বুঝেছিলেন, চাই আধুনিক রাষ্ট্র। হোসেন মুবারক থেকে বার্থ পার্টি-সব এই চিন্তাধারার ফসল। কিন্ত তেলের ডলার আসতেই আসল সহজ জীবন-খাবার বিলাস ব্যসন সব সস্তায় এবং সুলভে পেয়ে গেলে-লোকে জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে বেশী ভাবার সময় পায়। ফলে ধর্ম আবার চেপে বসল এদের ঘারে।

তিন- এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে জন সংখ্যাও বাড়তে থাকে গুনিতক প্রগতিতে। ফলত সেই সমৃদ্ধি তারা ধরে রাখতে পারে নি। ইরান এবং মিশরে -বিশেষত উত্তর আফ্রিকাতে খাবারের তীব্র সংকট শুরু হয়েছে। সেই সংকট থেকে, আজকের জাসমিন বিপ্লব ছিল আসন্ন।

মোদ্দা কথা লোকজনকে খাওয়াতে না পারলে কোন ধর্ম, কোন রাজনৈতিক সিস্টেম টেকে না। তেলের টাকায় ইসলামিক বিশ্ব তাদের জনগণকে খাওয়াচ্ছিল-এখন আস্তে আস্তে তা আর সম্ভব হচ্ছে না। যা ফলশ্রুতি স্বরূপ সেই সিস্টেমের বিরুদ্ধে বিপ্লব হচ্ছে। এবং নিজেদের বাঁচাতেই তাদের শ্রেষ্ঠতর সিস্টেম বেছে নিতে হবে।

পেটের আগুনই তাদের ঠিক পথের সন্ধান দেবে।

(৫)

আমার শুধু একটাই অনুরোধ -ইসলাম নামে এই কচলানো লেবুর চর্চা মুক্তমনাতে কমালে ভাল হয়। পরিবেশ, নগর ব্যাবস্থা, দুর্নীতি, অর্থনৈতিক দুরবস্থা, বেকারত্ব, শ্রমিক শোষন-ইত্যাদি বিষয়গুলি ইসলামের থেকে অনেক বেশী জ্বলন্ত। এই বিষয় গুলি নিয়ে বেশী চর্চা হৌক।

নইলে মুক্তমনা ব্লগটি কচলানো লেবুতে পরিণত হবে।

সেই চিন্তাধারাই টেকে, যে চিন্তাধারা উন্নততর উৎপাদনের জন্ম দিতে সক্ষম। এটিই বিবর্তন বিধাতার আইন।

Sunday, September 11, 2011

কমিনিউস্ট চিন্তাধারার বৃত্তীয় ভুল



(১)

ফেসবুক বা স্যোশাল নেটওয়ার্কের রাজনৈতিক চর্চাকারীদের মধ্যে বাম বা ডান মনোভাবা সম্পন্ন লোকেদের একবল্গা লজিকের সাথে আমরা কমবেশী সবাই পরিচিত। পার্টিভক্ত অন্ধ, ধর্মান্ধ, তাত্বিক অন্ধ ইত্যাদি ভক্তিভাবের প্রকাশ শুধু বাঙালী না পৃথিবীর সব দেশে, সব সমাজেই দৃশ্যমান। ধর্মে অন্ধ হয়ে বিবর্তনকে অস্বীকার করা বা পার্টিতে অন্ধ হয়ে স্টালিন বা কমিনিউজমের নৃশংস ইতিহাসকে বুর্জোয়া মিডিয়ার ছল বলা, মূলত একই মানসিক ব্যধির দুই পিঠ।

কিছুদিন আগে ব্রেভিককে নিয়ে লিখতে গিয়ে,আমাকে অনেকের কাছেই ব্যখ্যা করতে হয়েছে কেন দক্ষিনপন্থী হিন্দুত্ববাদি বা ইসলামিস্টদের সাথে "বামপন্থী" কমিনিউস্টদের একসারিতে রেখেছি। এদের অনেকেই বামঘেঁসা বা কমিনিউস্ট প্রীতির আঁতুরঘরের গন্ধমাখা লোকজন। এদের বক্তব্য কমিনিউস্টরা যদি খারাপ কিছু করেও থাকে তা মেহনতি মানুষের জন্যেই করেছে। সেখানে ধর্ম শোষক শ্রেনীর সহায়ক ছারা অন্য কিছুত না!

সমস্যা হচ্ছে, যারা সিপিএমের এই ৩৫ বছরের দুস্বপ্নের দিনগুলি পশ্চিম বঙ্গে কাটিয়েছেন, তারা নিশ্চিতভাবেই মানবেন পার্টি এই রাজ্যে শোষক শ্রেনীর শত্রু না, বন্ধুই ছিল। অন্যথা, কিছু সম্ভব ছিল না। হয় ও নি। এটা ত সাম্প্রতিক বাস্তব।

ইতিহাসে তাকালে দেখা যাবে, ধর্ম মাত্রেই প্রতিবাদি আন্দোলন হিসাবে ইতিহাস থেকে উঠে এসেছে। স্যোশাল জাস্টিস এবং ইনজাস্টিস সব কিছুই হিন্দু এবং ইসলাম ধর্মগ্রন্থগুলির উপপাদ্য। আমেরিকার রিপাবলিকান বা টি পার্টি ছারা আর কোন সামাজিক আন্দোলন বা আদর্শবাদ আমার জানা নেই যা গরীব দরদি না। বস্তত ধর্ম গ্রন্থগুলির মধ্যে ধর্মীয় সমাজতন্ত্রের বা ভাববাদি সমাজতন্ত্রের ছোঁয়া সব সময় ছিল-এবং তার পরেও তারা শাসক শ্রেনীয় সহায়ক হিসাবেই আবির্ভূত। মার্ক্স কথিত বস্তুবাদি সমাজতন্ত্রেও তার ব্যতিক্রম হয় নি-লেনিনিজম সব থেকে কুখ্যত শাসক এবং অত্যাচারীদেরই জন্মদাত্রী। এবং একটু ভাবলে দেখা যাবে, ক্ষমতার কেন্দ্রীকরনের জন্যে এমনটা হওয়ারই কথা।
এই নিয়েও আগেই বিস্তারিত লিখেছি-কিভাবে একটি বাম আন্দোলন আস্তে আস্তে দক্ষিন পন্থী আন্দোলনে ইউ টার্ন নিয়ে থাকে ( যা ধর্ম, লেনিনবাদ , মাওবাদ সবার জন্যেই প্রযোজ্য )।

(২)

আমি এই প্রবন্ধ লিখছি সম্পূর্ন অন্য কারনে। বহুদিন থেকেই দেখছিলাম, কমিনিউস্টরা কমিনিউস্ট ইতিহাসের সব নির্মম দিক নিয়ে গর্ব করে। সাঁইবাড়ির খুনী থেকে স্টালিনের খুন গুলিকে এরা শ্রেণীযুদ্ধে " প্রয়োজনীয়" মনে করে। এবং এটাই পার্টি লাইন।

সমস্যার শুরু এখান থেকেই। কারন এদের মতবাদ বা কমিনিউজমের শাস্বত মতবাদ হচ্ছে কমিনিউজমই আসল
মানবতাবাদ। মার্ক্স ব্যাপারটাকে এভাবে লিখেছিলেনঃ

“... communism, as fully developed naturalism, equals humanism, and as fully developed humanism equals naturalism; it is the genuine resolution of the conflict between man and nature and between man and man – the true resolution of the strife between existence and essence, between objectification and self-confirmation, between freedom and necessity, between the individual and the species. Communism is the riddle of history solved, and it knows itself to be this solution”..

কমিনিউজমের উৎস সন্ধানে, বা মানুষ কেন কমিনিউস্ট হতে চায়, তার মূলে ঢুকতে গেলে, এই বাক্যটির গুরুত্ব অপরিসীম।

কারন যারা কমিনিউজমের বিশ্বাস করে, তারা মনে করে কমিনিউজমই হচ্ছে একমাত্র রাজনৈতিক আদর্শবাদ যা মানুষের সাথে মানুষের, মানুষের সাথে প্রকৃতির, অস্তিত্বের সাথে প্রয়োজনীয়তার, স্বাধীনতার সাথে প্রয়োজনীয়তার, ব্যাক্তির সাথে প্রজাতির দ্বন্দের অবসান ঘটাতে সক্ষম। এবং কমিনিউজম হচ্ছে সেই প্রাকৃতিক দর্শন ( যা প্রকৃতি বিজ্ঞানকে অনুসরণ করে আসে)।

কমিনিউস্টরা ধর্মীয় বা ব্যক্তি স্বতন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে যে মানবতার সংজ্ঞা তাতে "বিশ্বাস" করে না। মানুষ তাদের কাছে সমাজের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। লুইস আলথুজার নামে একজন ফ্রেঞ্চ স্ট্রাকচারালিস্ট ( যিনি একজন অন্ধ স্টালিন ভক্ত ছিলেন), বুর্জোয়া দের দেওয়া মানবতার সংজ্ঞাকে ( অর্থাৎ সবার ওপর মানুষ সত্য ) মানবিক বিভ্রম বলে আখ্যায়িত করেছেন!

“humanism” means the illusion that individual human beings are autonomous, thinking subjects, whereas for structuralists (and poststructuralists), individual human beings are nothing but unconscious agents of structural forces, in much the same way as organisms are agents for the spread of a disease. Thus structuralists associate humanism with a naive and unproblematic conceptions of language and consciousness, and illusory belief in the autonomy of human beings.

অর্থাৎ হে কমিনিউস্ট বৃন্দ- বর্তমান সমাজের মানবিকতার ব্যখাতে ভুলিও না-কমিনিউজমের সেই সোনার ম্যাজিক বলই আসল মানবিকতা! সাঁইবাড়ির প্রনব সাঁই বা ষষ্টি দুলেদের কুপিয়ে কাটা সেই মহান মানবিক সমাজের প্রতিষ্ঠার জন্যেই দরকার!

(৩)

আলথুজারকে নিয়ে চিন্তা নেই-ভদ্রলোক বিজ্ঞানের দর্শন বিশেষ কিছু বুঝতেন না। যা লিখেছেন, তা বিজ্ঞান এবং প্রাকৃতিক দার্শনিকদের চোখে বালখিল্যই হবে। এই প্রবন্ধ লেখা এই কারনে, যে মার্ক্সের ওই মারাত্মক দাবি-কমিনিউজম হচ্ছে সকল বিভেদের সমাধান, সেটা কতটা বালখিল্যতা বা হাস্যকর তা বিচার করা।

প্রথমেই বিশ্লেষণ করা দরকার বিভেদ কেন?

মার্ক্সত, ইয়ে মানে হেভিওয়েট দার্শনিক। তার একবাক্যের ওজন চোদ্দমন। সাধারন মাথাতে ঢোকাতে গেলে কিলোতে ঢোকানোই ভাল। উনার দাবীগুলিকে ১, ২, ৩...এইভাবে ভাংলে গোঁজামিল, বা যুক্তির বৃত্তীয় ভুল খুব সহজে ধরা যাবে,

উনার প্রথম দাবী-কমিনিউজম একধরনের ন্যাচারালাজিজম বা প্রাকৃতিক দর্শন। যেসব দর্শন ভাবে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মাধ্যমে যাবতীয় প্রশ্নের মিমাংসা করা যায়, তাদের বলে প্রাকৃতিক দর্শন। প্রথম দাবীটিই ভুল। কমিনিউজম বিজ্ঞানের দর্শনের প্রথম ধাপ-ফলসিফিকেশন উপপাদ্যটিই মানে না। ফলসিফিকেশনের সাদামাটা মানে আ) সব তত্ত্বই ভুল হতে পারে ক) তাই সব তত্ত্বের বাতিলযোগ্যতার পরীক্ষা দরকার। মার্ক্সীয় বিপ্লবের তত্ত্ব সর্বত্রই ভুল প্রমাণিত-তবুও কমিনিউস্টদের চোখে তা বাতিলযোগ্য না! এটি বহুচর্চিত -স্যার কার্ল পপার এবং মার্ক্সীয় অপবিজ্ঞান নিয়ে আগে অনেক লিখেছি।

এরপরে যদি ধরেও নিই, কমিনিউজম বিজ্ঞানভব (!), তারপরে রাউন্ড টুতে প্রশ্ন আসবে, মানুষে মানুষে বিভেদের কি কোন বৈজ্ঞানিক সূত্র -বা কার্য কারন সূত্র সম্ভব?

খুব সহজ ব্যপার। বাইরে চোখ রাখুন-দেখবেন দুজন পুরুষ মারামারি করে মূলত সম্পদ এবং নারীর অধিকার নিয়ে। "শ্রেণী" যুদ্ধের একমাত্র কারন না-নারী, জাতি, প্রজাতি-আরো অনেক কিছুই বিবাদের কারন হতে পারে। এই জটিল সিস্টেমকে কোন বৈজ্ঞানিক সূত্রে বাঁধা সম্ভব না।

আরেকটা উদাহরন দিচ্ছি। পাওলি দাম নামে এক বাঙালী "মেইনস্ট্রুম" অভিনেত্রী, ছত্রাক নামে এক সিনেমাতে সম্পূর্ন নগ্ন শয্যদৃশ্যে অভিনয় করে বেশ সামাজিক ঝড় তুলেছেন। রক্ষণশীল বনাম প্রগতিশীল বাঙালীরা দ্বিধাভিকক্ত।

কে ঠিক? এর বিচারে কোন বিজ্ঞান বা যুক্তিবাদ চলে না। কারন পাওলি দাম নগ্ন হয়ে ঠিক করেছেন না ভুল করেছেন, তার ফলসিফিকেশন সম্ভব না। কারন এটা ব্যক্তিগত রুচির প্রশ্ন। অর্থাৎ এই বিভেদের মূলে যেতে "একক" কোন বৈজ্ঞানিক সূত্র ব্যর্থ।

আরো উদাহরণ দিচ্ছি। ধরা যাক কমিনিউজম এসেই গেল। কিন্ত তার মানে ত এই নয় রক্তমাংসের মানুষগুলো সব রোবট হয়ে গেল। তখন কমিনিউস্ট সমাজে যদি একজন সুন্দরী মেয়েকে দশজনের ভাল লাগে, তাহলে কি হবে? তাহলে দশজনের মধ্যে গন্ডোগলের সম্ভাবনা নেই? নাকি কমিনিউজমে সাম্যবাদের সূত্র মেনে দশপুরুষই নারীটিকে ভোগ করবে? বা "কমিউন" ম্যারেজ চালু হবে? মানে দশটা পুরুষ দশটা নারীকে বিয়ে করবে! তাতেও কি গন্ডোগল কমবে বলে মনে হয়?

মোদ্দা কথা এমন এক জটিল সামাজিক সিস্টেমের কোন বৈজ্ঞানিক সূত্র হয় না। সেখানে সমাজের কার্যকারন সব বুঝিয়াছি এবং তার বৈজ্ঞানিক সূত্র আবিস্কার করিয়াছি এমন দাবী বেশ বালখিল্যতাই বটে।

এবার আসি রাউন্ড তিনে। মার্ক্স আরো দাবী করছেন, কমিনিউজম মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য এবং বিধেয়র মধ্যে বিভেদ মেটাবে। এটা সত্যই আরো বড় গোলা।

জীবনের উদ্দেশ্য কি এই প্রশ্নটা যুক্তিবাদ এবং বিজ্ঞানের বাইরে। যদি ধরে নেওয়া যায়, জীবনে উদ্দেশ্য বিজ্ঞান দিয়ে ব্যখ্যা করা যায়, অর্থাৎ জেনেটিক সারভাইভালই আমাদের উদ্দেশ্য, তাহলে বিজ্ঞান কিন্ত মানব সমাজ এবং মানবতার অনেক কিছুই ব্যখ্যা করতে পারবে না। আমরা অনেক ক্ষেত্রেই দেখি যদি, দুই সন্তানের মধ্যে একজন পঙ্গু হয়ে জন্মায়, মা কিন্ত পঙ্গু সন্তানকেই বেশী যত্ন করে যদিও এটা জেনেই যে সে প্রজননে অক্ষম। আলট্রুইজম বা উপকারিতা বেঁচে থাকার উপায় বটে কিন্ত অনেক ধরনের আলট্রুইজম বা উপকারীতার কোন বৈজ্ঞানিক ব্যখ্যাই সম্ভব না। এটা ঠিক যে জীবনের উদ্দেশ্যের ৯০% জীববিজ্ঞানদিয়ে ব্যখ্যা করা যায়-কিন্ত যে সন্নাসী হতে চাইছে-তার ব্যখ্যা কি? অনেক দম্পতিই আজকাল চাইল্ডলেস বাই চয়েস থাকছে-তার পেছনেই বা কি যুক্তি?

তাদের জীবনের উদ্দেশ্যকি ভুল যেহেতু তা "ন্যাচারালাজিম" না???

যে ড্রাগ, নারী আসক্ত হয়ে জীবন কাটাচ্ছে সেও কি ভুল?

এই ঠিক বা ভুলের মাপকাঠি কি করে ঠিক করবে? আর ৫০০ মিলিয়ান বছর বাদে সৌর জগত সম্পূর্ন ধ্বংস হবে-আরো সূদূরে এই মহাবিশ্ব সংকুচিত হতে হতে, আবার বিন্দুতেই শেষ হবে। সুতরাং কে কি করল, তাতে মহাবিশ্বের ইতিহাস বদলাচ্ছে না। জীবনটা সাময়িক,সময়ের খুব ক্ষুদ্র স্কেলে করা জ্যাঠামি। কে সন্নাসী হয়ে কাটাল, কে পরকিয়া করে কাটাল-কে বেশ্যাগৃহে কাটাল-তাতে মানুষ এবং মহাবিশ্বের ভবিষ্যত কিছুই বদলাবে না।

সুতরাং ঘুরেফিরে আমরা সেই বৃত্তেই ফিরে আসি-সেখানে মানুষই একমাত্র সত্য। মানুষের হাতে তৈরী ধর্ম বিজ্ঞান কমিনিউজম, ক্যাপিটালিজম কোন তত্ত্বই মানুষের থেকে বড় হতে পারে না। অন্তিম বিচারে এর সবকিছুর ওপরেই মানবতার জয় ঘোষিত হবেই। সুতরাং কোন আদর্শবাদের দোহাই দিয়ে অমানবিক কোন কাজই সমর্থনযোগ্য না-এবং তা সব থেকে বড় অশিক্ষার ও কুশিক্ষার পরিচয়।

Thursday, August 4, 2011

আরেকটি বিশ্বমন্দার সামনে আমরা দাঁড়িয়ে?


[১]

আমি অর্থনীতিবিদ নই। কিন্ত নিয়তি এতই নিঠুর, অর্থনীতির চোরাবালিতে হাঁটতে থাকা নশ্বর জীব আমরা। না বুঝলে, যেকোন মুহুর্তে চোরাবালিতে শেষ হয়ে যেতে পারে সমস্ত জীবনের সঞ্চয়। এই বাজার অর্থনীতিতে আমরাও পণ্য। যত তাড়াতাড়ি এই উপলদ্ধি মাথার মধ্যে ঢোকে, ততই ব্যক্তিগত জীবনে বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব। বাজারের সাপলুডোর সাথে আমাদের সবার ওঠানামা।
২০০৮ সালের সাবপ্রাইম ক্রাইসিস কিভাবে গোটা বিশ্বে থাবা ফেলেছিল, সেই আতঙ্ক কাটতে না কাটতে খুব সম্ভবত আরেকটি অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে আমরা ঢুকতে চলেছি। আজ বিশ্বের বৃহত্তম স্টক এক্সচেঞ্জ ডাওজোন্স পড়েছে ৫০০ পয়েন্ট। মাত্র তিন দিনে গোটা বছরের আয় উড়ে গেছে শেয়ার বাজারের ইনভেস্টরদের। কিন্ত কেন শেয়ার বেচছেন ইনভেস্টরা রা? বাজার কেন আত্মবিশ্বাস হারাচ্ছে?

[২]
এবার সমস্যার শুরু ওয়েলফেয়ার ইকনমিক্স বা জনকল্যানকারি সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি নামক টাইমবোমটি থেকে। প্রতিটি দেশের রাজনৈতিক দলগুলি ক্ষমতায় এসে স্যোশাল ওয়েলফেয়ার বা নানান সামাজিক স্কীম এবং সামরিক খাতে দেদার ব্যায় করে, যা তাদের আয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না। বাকী টাকা মেটানো হয় ধার করে। এই করতে গিয়ে আমেরিকার দেনা প্রায় ১৪ ট্রিলিয়ান ডলার যা তার জিডিপির সমান। ব্যাপারটা এভাবে ভাবা যেতে পারে। আমেরিকার জিডিপি ১৪ ট্রিলিয়ান ডলার এবং ট্যাক্স ও অন্যান্য বাবদ সরকারের উপায় প্রায় ২ ট্রিলিয়ানের কাছে। মানে একটি পরিবারে ধরুন উপায় এক লাখ টাকা, কিন্ত তার দেনা 7 লাখ টাকা। খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠবে, সেই পরিবারটি দেনা শোধ দেবে কি করে? কারন ৭ লাখ টাকার সুদই অনেক। যদি ৫% হারেও সুদ দিতে হয়, তাহলেও সরকারের উপায়ের ৩৫% চলে যাবে সুদ মেটাতে-এবার তার সাথে মূল আমানত মেটানোর দায় যোগ করলে, উপায়ের ৭০-৮০% চলে যেতে পারে শুধু ধার শোধ করতে!

তবে আমেরিকান সরকারের সুদের সমস্যা কম-কারন এই মন্দার বাজারেও সবাই আমেরিকান সরকারের বন্ড কিনতে চায়, যেহেতু সবাই মনে করে, আমেরিকান সরকার দেওলিয়া হতে পারে না। সেই জন্যে আমেরিকাকে ১ বা ২ % সুদে পৃথিবীর সব দেশ এবং সেই দেশের ব্যঙ্করাও ধার দেয়। আমেরিকান সরকারি বন্ড হচ্ছে অধুনা পৃথিবীর সিন্দুক। যেখানে টাকা রাখলে সব "সেফ"-পতনের সুযোগ নেই।

আর এই জায়গাটাতেই সমস্যা। আমেরিকান আইন অনুযায়ী আমেরিকান সরকার একটি লিমিটের বাইরে ধার করতে পারে না। এবং সেই লিমিট বাড়াতে হলে কংগ্রেস ও সেনেটের অনুমতি লাগে। আমেরিকান সরকার জনস্বাস্থ্য খাতে এমন হারে টাকা খরচ করছিল, যে হুহু করে বাড়ছিল দেনা। ফলে এদেশে টিপার্টি বলে একটি রক্ষণশীল আন্দোলণের জন্ম হয়। যাদের বক্তব্যই হল, এই ভাবে চললে সরকার দেওলিয়া হয়ে যাবে এবং বেহিসাবী সরকারি খরচ চলবে না। গত ২০১০ সালের কংগ্রেস নির্বাচনে তারা ৬০ জনকে জেতাতে সমর্থ হয় এবং যার ফলে কংগ্রেসে ডেমোক্রাটরা সংখ্যালঘু। ফলে, গত সপ্তাহে ডেটলিমিট বা ধারের পরিসীমা বাড়াতে গিয়ে ওয়াশিংটনে চলে টানা দুই সপ্তাহের নাটক। এবং মোটামুটি ধারের লিমিট বাড়ালেও ঠিক হয়, সরকার খরচ কমাবে প্রথম ধাক্কায় প্রায় ৯০০ বিলিয়ান ডলার, দ্বিতীয় ধাক্কায় ১২০০ বিলিয়ান ডলার।

[৩]
এই মন্দার বাজারে আমেরিকান সরকার যদি এত খরচ কাটে তার ফল কি হবে?
এমনিতে আমেরিকাতে ৯% চাকরি সরকারি বা সরকারের অনুদানের ওপর নির্ভরশীল। কিন্ত এর প্রভাব আমেরিকান অর্থনীতির ওপর হবে দীর্ঘস্থায়ী। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, গবেষণা, ডিফেন্স সর্বত্র এর প্রভাব পড়বে। সব চেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হবে স্বাস্থ্য বা বায়ো রিসার্চে। উচ্চশিক্ষার জন্যে যারা আমেরিকাতে আসতে চাইছে, তাদের আসা খুব কঠিন হয়ে যাবে। কারন তারা আসে টিচিং এসিস্টটেন্ট হিসাবে এবং সেই টাকাট আসে হয় সরকার থেকে বা ছাত্রদের টিউশন থেকে। আর ছাত্রদের টিউশন আসে স্টুডেন্ট লোন থেকে। এখন সর্বত্রই কাটছাঁট।

আমি ওয়াশিংটন ডিসির খুব কাছে থাকি এবং এখানে সরকারি ছাঁটের প্রভাব হবে আরো বেশী। শুধু ৯০০ বিলিয়ান ছাঁটাইতেই এই রাজ্যের ২৫০,০০০ লোক কাজ হারাবে যেহেতু এই রাজ্যে সরকারি কর্মচারী বা সরকারি অনুদানে চলা চাকরি সব থেকে বেশী। যা এই রাজ্যের মোট কর্মক্ষম লোকের সংখ্যার প্রায় ১৫-২০%।

ফলে আমেরিকার সামনে কি দিন আসছে বলার অপেক্ষা রাখে না।

[৪]

কিন্ত প্রশ্ন উঠবে, কেন তাহলে সরকারি অনুদানে ছাঁটাই হচ্ছে? সবাই একমত, আয়ের সাথে ব্যয় মেলাতে হবে। কিন্ত তাহলে বড়লোকদের ওপর বেশী ট্যাক্স না কেন? পৃথিবীর ৪০% ধনী আমেরিকাতে! তাদের ওপর বর্ধিত কর না চাপিয়ে কেন ছাঁটাই করা হবে সরকারকে?
এই বিতর্কই এখন আমেরিকান রাজনীতির সর্বত্র জুরে। প্রতিদিন টিভি খুললে এই বিতর্কের ট্রেন চলতেই থাকে, স্টেশনের দেখা মেলে না!

রিপাবলিকানদের দুটি মূল বক্তব্য,

(১) টাক্স বাড়ালে অর্থনীতি এবং চাকরির বৃদ্ধি কমবে। কারন আমেরিকাতে ৭০% চাকরি দেয় ছোট ব্যবসা। তাদের ওপর বর্ধিত কর, অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলবে।

(২) ইউরোপে ট্যাক্স বাড়িয়েও, লোন ডিফল্ট আটকানো যাচ্ছে না। গ্রীসকে অক্সিজেন দিয়ে চালানো হচ্ছে। ইটালী এবং স্পেন প্রায় লোন ডিফল্টের পথে। সুতরাং সরকারি খরচ ছাঁটাই এর বিকল্প নেই।
বলাই বাহুল্য (১) এর সপক্ষে কোনদিন কোন সংখ্যাতাত্ত্বিক প্রমাণ আমি দেখি নি।

(২) এর যুক্তিতে সারবত্তা আছে। খরচ ছাঁটাই কিছুটা করতেই হবে। খরচে রাশ না কমালে, শুধু ট্যাক্স বাড়িয়ে এই বিপদ এড়ানো যাবে না, তা সত্য। এটা নিয়েও কোন বিতর্ক নেই। বিতর্ক এখানেই যে ট্যাক্স না বাড়িয়ে শুধু সরকার ছেঁটে কি এই কাজ করা ঠিক? বিশেষত এমন মন্দার সময় এখন।

তাহলে রিপাবলিকানদের বক্তব্য কেন শুনতে হচ্ছে? যেখানে আমেরিকার ৬০% লোক সরাসরি বলছে বড়লোকদের ওপর ট্যাক্স বসুক?

এটি আসলেই প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের দুর্বলতা। দু বছর আগে ডেমোক্রাটদের হাতেই ছিল সেনেট এবং কংগ্রেস। তখন বড়লোকদের ওপর বর্ধিত কর বসাতেই পারত তারা। সেটা না করে, গত ৮০০ দিনে কোন বাজেটই পাশ করে নি তারা। তার বদলে শুধু সরকারি খরচ বাড়িয়ে গেছে।

ডেমোক্রাটদের এই ডবল স্টান্ডার্ড বা দ্বিচারী বা দ্বিমুখী আচরন, আজকের ক্রাইসিসের জন্যে অনেক অংশে দায়ী। ডেমোক্রাটদের ভোটার বেস হচ্ছে গরীব অংশ-যাদের সরকারি চিকিৎসা এবং শিক্ষা দরকার। ফলে তারা সরকারি খরচ বাড়িয়েছে, তাদের ভোট বেস অক্ষুণ্ণ রাখতে। তাতে আপত্তি নেই। কিন্ত সেই বর্ধিত খরচের জন্যে বর্ধিত আয় দরকার। তার জন্যে বড়লোকদের ওপর ট্যাক্স বসানো নিয়ে কোন বিল তারা আনলো না। ফলে সরকারের সংকট শুরু হল এবং সেটা দেখিয়ে রিপাবলিকানরা জিতে গেল।

কিন্ত ধণীদের ওপর কেন কর বসালো না ডেমোক্রাটরা? তারাত ডেমোক্রাটদের ভোট দিচ্ছে না! তাহলে ? রহস্যটা কি?

এটা আমেরিকান রাজনীতির কালো দিক। নির্বাচনী ফান্ড এই দেশে মূলত ধনীরাই দিয়ে থাকে এবং নির্বাচনে লড়তে গেলে ডেমোক্রাট বা রিপাবলিকান পার্থীদের সেই ধনী শ্রেনীর কাছেই হাত পাততে হবে। এবং প্রতিটি ধনী ব্যক্তি এই দেশে দুই পার্টির নির্বাচনী তহবিলে টাকা দেয়। তাদের টাকাতেই লড়তে হয় নির্বাচন। তাদের বিরুদ্ধে যাওয়ার ক্ষমতা আসলেই নেই ডেমোক্রাটদের। তারা ধণী শ্রেনীর বিরুদ্ধে বড় বড় ডায়ালোগ দিয়েই খালাস-যা তোকে ছেরে দিলাম টাইপের ঢপবাজি ওবামাও অনেকদিন চালাচ্ছেন। আসল সত্যি কথাটা আমেরিকান জনগণও জানে।

[৫]
আমেরিকান বাজেট ছাঁটাই আসু মন্দার একমাত্র কারন না। এর সাথে গোদের ওপর বিষ ফোঁড়া-- ইটালি লোন ডিফল্ট করতে পারে। গ্রীসের মতন ছোট দেশকেই বাঁচানো যাচ্ছে না-এর ওপর তার থেকে প্রায় দশগুন বড় একট অর্থনীতি দেওলিয়া হলে, ইউরোপের ব্যাঙ্কিং সিস্টেম ধ্বসে যাবে। ইউরোপে ওয়েল ফেয়ার অর্থনীতির দিন শেষ। সরকার সেখানে আরো বেশী ছাঁটাই করবে। ইউরোপে শিক্ষা,স্বাস্থ্য এসব আর বিনামূল্যে কেও পাবে না। সেদিন শেষ।

তবে মন্দের ভাল এই যে বর্তমানে বেসরকারি কোম্পানীগুলি লাভজনক এবং সেখানে মন্দা নেই। মন্দার সময় তারা প্রচুর ছাঁটাই করেছে-ফলে মন্দার পরবর্তী বাজারে প্রতিটা প্রাইভেট কোম্পানীর অবস্থা বেশ ভাল এখন। বর্তমানের মন্দা মূলত বেহিসাবী রাজনীতির জন্যে। রক্ষণশীল বা উদারপন্থী-কেওই একটি মধ্যম গ্রাউন্ডে আসতে চাইছে না। কিছুটা সরকারি খরচ ছাঁটাই, এবং কিছুটা কর বৃদ্ধি-এই ভাবেই এই সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া যেত। ডেমোক্রাটরা এখন তাই বলছেন-কিন্ত যখন তাদের হাতে ক্ষমতা ছিল-তখন বিল পাশ করেন নি কেন?
তবে অবস্থা যেদিকেই যাক, আমেরিকার খারাপ অর্থনীতি মানে গোটা বিশ্বের নাভিশ্বাস উঠবে।

Monday, August 1, 2011

সংশোধিত বামপন্থী



৩০,০০০ ভোটে হারার পর গৌতম বাবুর উপলদ্ধি, এই বাম বাজারে খাবে না।
বাজারে চালাতে নতুন প্রোডাক্ট- সংশোধিত বাম। সেটি পেটে দেয় না পাতে খায়, উনিই জানেন-কিন্ত রাজ্যবাসী প্রশ্ন করতেই পারেন, সংশোধিত বাম মানে আরো বাম না ডান দিক? কোন দিক সেটি?

পশ্চিম বঙ্গে বামপন্থী তিন প্রকার।
বামাদর্শে বিশ্বাসী কিন্ত মাঠে নেমে রাজনীতি না করে, ধনতন্ত্রের সেবাদাস হয়েই জীবন কাটাবেন। এদের বামপন্থা মৃণাল সেনে আটকিয়ে। এরা অনেক আগেই সিপিএম ছেরে তৃনমূলে।
পারিবারিক আদর্শের কারনে বাম রাজনীতি করেন বা বিশ্বাস করেন-সিপিএমের তথাকথিত বাম এই গোষ্ঠির। এদের বাম সিপিএম এবং গণশক্তির আঠাতে আটকে আছে।
বামাদর্শে বিশ্বাসী এবং জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে রাজনীতি করেন-এরা খ্যাপাটে নক্সাল। সিপিএমের ঘোর শত্রু।
তাহলে গৌতমবাবু যে বামেদের সংস্কারের কথা বলছেন-তারা দ্বিতীয় শ্রেণীর বাম-মূলত পারিবারিক ঐতিহ্যে বাম। কিন্ত এদের মূল সমস্যা -এরা স্বাধীন চিন্তার মালিক নন। পলিটখুড়োরা পাঁজি দেখে যা ব্যখ্যা দেবে, সেটাই এরা মানে। পলিটখুড়ো যখন বলেছিল টাটার পা চাটতে-এরা তখন সেটাকেই সঠিক এবং বাস্তববাদি বাম বলে ঊদবাহু নেত্য করেছে।
এই অধঃপতিত বামেদের একটাই সংস্কার সম্ভব। স্বাধীন চিন্তা এবং যুক্তির বিকাশ যাতে দল বেঁধে পলিটখুরোরা বখলেসে টান খেয়ে ঘেও ঘেও না করে। চিন্তা এবং যুক্তিশক্তির বিকাশ হলে, মানুষ সাধারনত বিচক্ষন হয়-ডান বা বাম হয় না-সোজা পথে চলে। তবুও বাম সংস্কারের এটাই একমাত্র পথ। বকলেস বাঁধা কুকুরগুলিকে মানুষ হতে হবে-নইলে সিপিএমের সমর্থক এবং সিপিএম মানে পশ্চিম বঙ্গের জনগণের কাছে ঘেও ঘেও করা হার্মাদ কুকুরের ইমেজই ভেসে ওঠে।

Monday, July 25, 2011

ব্রেভিক এবং মুসলিম বিদ্বেশী দক্ষিণপন্থার উত্থান



(১)
তিন বছর আগের ঘটনা। আমার একজন ড্যানিশ সহকর্মীর সাথে লাঞ্চ খাচ্ছি- বোধ হয় সেদিন কোন একটা কিছু ইসলামিক চরমপন্থী ঘটনা ঘটেছে। ফলত ইসলামিক চরমপন্থী এবং ইউরোপে মুসলিম অভিবাসন সমস্যার প্রসঙ্গ এসেই গেল। আমি খুব অবাক হলাম। ওর মতন একজন উচ্চশিক্ষিত প্রযুক্তিবিদ, ডেনমার্কে মুসলিম অভিবাসন নিয়ে এত ক্রদ্ধ-যে ও দরকার হলে বন্দুক নিয়ে গৃহযুদ্ধে যেতেও প্রস্তুত। ক্রোধের কারন এন্ডলেস লিস্ট। এবং যার মূলে আছে মুসলিমদের ড্যানিশ সংস্কৃতিকে সম্পূর্ন অস্বীকার করে, ডেনমার্ককে ইসলামিকরনের চেষ্টা। ওর বক্তব্য ওরা কিছুতেই ড্যানিশ হবে না, ড্যানিশ সংস্কৃতিও মানবে না-দেশটাকে পাকিস্তান বানাবে।

মুসলিমদের বিরুদ্ধে এমন মানসিকতা আমি ভারতে হিন্দুত্ববাদিদের মধ্যে দেখতে অভ্যস্ত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইসলামিকরনে প্রশয় দেয় সেই দেশের লিব্যারাল এবং বামপন্থী গোষ্ঠি। ফলে ইসলাম এবং কমিনিউজমের বিরুদ্ধে যুব সমাজের ক্রমবর্ধমান রাগ পৃথিবীর প্রায় সব অমুসলিম দেশেই ( যেখানে মুসলমানদের সংখ্যা ৫-১০% বা তারও বেশী ) ক্রমঃবর্ধমান। দিল্লীতে একটা তরুণ ছেলের কথা শুনে প্রায় অজ্ঞান হবার জোগার। বিহারের এক দাঙ্গায় কিভাবে নিজের হাতে মুসলমানদের পুড়িয়ে মারাতে অংশ নিয়েছিল-সেই কথা গর্ব করে সে বলে বেড়ায়! শুধু তাই না। আমেরিকা এবং ইউরোপের অনেক উচ্চশিক্ষিত (যারা আমার সহকর্মীও বটে) আমার কাছে নরেন্দ্র মোদির প্রশংসা করে গেছে। কারন তাদের নেতারা ইউরোপে যা পারে নি, বা আমেরিকাতও যা পারে না- মুসলমানদের গণনিধন- তা নরেন মোদি করে দেখিয়েছে বটে!

সুতরাং ইউরোপের প্রবল মুসলিম বিদ্বেশ-যা এতদিন শুধু কথাতে বুঝেছি, আজ গোটা বিশ্ব বুঝল এন্ড্রেস ভেরিং ব্রাভিকের গণহত্যার মাধ্যমে। কমিনিউস্ট তথা কালচারাল মার্ক্সিস্টদের প্রতি তার ঘৃণা এত গভীরে, বামপন্থী তরুণ তরুণীদের একটি পলিটিক্যাল ক্যাম্পের ওপর নির্বিচারে গুলি চালালো।

আমি অবাক হইনি। আমার সেই ড্যানিশ বন্ধুটির কথা মনে পড়ছিল-ইসলামের বিরুদ্ধে তার এত রাগ, সে মনে করে বন্দুকের নলই একমাত্র সমাধান-কারন লেবার পার্টি ইউরোপে মুসলিমদের আরো বেশী প্রশয় দিচ্ছে এবং তারা ড্যানিশ সংস্কৃতি ধ্বংশ করছে। ব্রেভিকের ম্যানিফেস্টোও তাই- তার ধারনা মুসলিমরা আর দুদিন বাদে নরওয়েতে সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে এবং নরওয়ে বলে কিছু থাকবে না। ওটা ইউরোপের পাকিস্তান হবে। সুতরাং সে কুর্কীতি করে জনগণ ও মিডিয়া দৃষ্টি আকর্ষন করতে চাইছে। আজকেও সে বলছে-কোর্টরুমকে তার আদর্শবাদি যুদ্ধের প্রচারের জন্যেই ব্যবহার করবে!

(২)

ব্রেভিকের দক্ষিন পন্থী আদর্শ নিয়ে কিছু লেখা দরকার। সে ইসলামের বিরুদ্ধে কোয়ালিশন গড়তে চেয়েছিল-এবং দেখা যাচ্ছে ভারতের হিন্দুত্ববাদি, ইস্ত্রায়েল, আমেরিকা এবং ইংল্যান্ডের দক্ষিণপন্থী মুসলিম বিদ্বেশীদের সাথে ইমেলে তার যোগাযোগ ছিল। সে মোটেও অন্ধ ধার্মিক না- যদিও নিজেকে সে ক্রীষ্ঠান ইউরোপের রক্ষকর্ত্তা বলেই ঘোষনা দিয়েছে। এবং তার কাছে খ্রীষ্ঠান ইউরোপ একটা রাজনৈতিক ধারনা যেখানে খ্রীষ্ঠান ধর্মের ভিত্তিতে ইউরোপে ঐক্য আসবে। যা ক্রুসেডের সময় থেকে একটি প্রচলিত সাংস্কৃতিক রাজনীতি। এমন কি ধর্মীয় রাষ্ট্রও সে তার ম্যানিফেস্টোতে চাই নি-খুব পরিস্কার ভাবেই "ইসলাম মুক্ত" ধর্মনিরেপেক্ষ লিব্যারাল স্টেটই চেয়েছে। তার রাজনৈতিক মতবাদ বিজেপির অন্যপিঠ- ধর্ম সেখানে জাতীয়তাবাদের প্রতীক। এবং অনেক ব্লগেই, ব্রেভিক বিজেপির কিছু বিশিষ্ঠ লেখকদের আকুন্ঠ প্রশংসা করেছে মুসলিমদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থানের জন্যে-- যে ইসলাম বিরোধি অবস্থান তার দেশের রাজনীতিবিদরা নিতে ব্যার্থ হচ্ছে বলে সে মনে করে। অর্থাৎ খুব স্পষ্ট ভাবেই ব্রেভিক এক রাজনৈতিক যোদ্ধা। একজন জেহাদি বা নক্সাল ( কমিনিউস্ট উগ্রপন্থী) যে কারনে হত্যাকান্ড চালিয়েও "সমাজ এবং দেশের জন্যে" বিরাট কিছু করছে বলে গর্ব বোধ করে-তার থেকে ব্রেভিকের হত্যাকান্ড আলাদা কিছু না। এটি খুবই পরিস্কার একটি রাজনৈতিক হত্যাকান্ড এবং দক্ষিনপন্থী উগ্রপন্থাই এর জন্যে দায়ী।

(৩)
কিন্ত এই উগ্রপন্থা কেন? এই ক্ষেত্রে কমিনিউস্ট, হিন্দুইস্ট বা ইসলামিস্ট মৌলবাদি থেকে খ্রীষ্ঠান উগ্রপন্থী ব্রেভিক আলাদা কেও না। নক্সাল, জিহাদি, হিন্দুত্ববাদি বা খ্রীষ্ঠান উগ্রপন্থীদের মধ্যে কিছু প্যাটার্ন আমরা অবশ্যই দেখি

# পৃথিবীতে জাস্টিস নেই-বিচার নেই!
স্যোশাল মিডিয়ার দৌলত কমিনিউস্ট, হিন্দুত্ববাদি, ইসলামিস্ট এবং ক্রীষ্ঠান মৌলবাদিদের আদর্শ এবং মৌলবাদি হিসাবে তাদের বিশ্বাসকে খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য (!) থেকে মনে হয়েছে-এদের মনের গভীরে "ইনজাস্টিস" ব্যাপারটা ভীষন ভাবে উত্তেজিত করে।
জাস্টিসের প্রথম ধাপ আইডেন্টিটি বা নিজেকে একটি গ্রুপের বলে মনে প্রাণে বিশ্বাস করা। যেমন কমিনিউস্টদের ক্ষেত্রে এটি হয় শ্রেণীগত পরিচয়-তাদের ধারনা পৃথিবীতে শোষন আছে-এবং এই শোষন এবং অসাম্যটা একটা বিরাট বড় ইনজাস্টিস-এবং সেই ইনজাস্টিস টিকিয়ে রাখছে কিছু বড়লোক। সুতরাং এই জাস্টিসের দাবীতে সব কিছুই জায়েজ! মাই খুন পর্যন্ত।
ব্রেভিকের ব্যাপারটাও টাই। তার কাছে তার নরওয়েন পরিচিতিই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এবং সেই পরিচিতি যারা ধ্বংশ করতে চাইছে-তারাই শত্রু। নরওয়েকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে শত্রকে খুন করতে হবে! সে এক অলীক যুদ্ধক্ষেত্রের যোদ্ধা। যুদ্ধে খুন করে সে শহীদ হতে চাইছে! একদম জিহাদিদের মতন।

একজন মুসলিম জিহাদির কাছে তার মুসলিম পরিচয় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ন-এবং গোটা পৃথিবী বিশেষত আমেরিকা তাদের ওপর অত্যাচার করছে ইরাক আর আফগানিস্তানে-এটাই তাদের মনকে উত্তেজিত করে। যদিও বাস্তবে আমেরিকা বসনিয়া এবং আফগানিস্তানে মুসলমানদের মুক্তই করেছে!


# সে এক মহান কার্যে নিয়োজিত মহান যোদ্ধা
সে ইনজাস্টিসের বিরুদ্ধে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ছে! সুতরাং সে মহান! মানবিকতার মাপকাঠি সেখানে চলবে না! প্রতিটি হিন্দু, কমিনিউস্ট, ইসলামিস্ট, খ্রীষ্ঠান ভাবে, সে মহান পথের পথিক-কারন এই আদর্শগুলিই পৃথিবীকে "জাস্টিস" এনে দেবে! যদিও তারা একবার ও ভাবে না বা শিক্ষার অভাবে জানে না ( বা জানালেও বিশ্বাস করে না), তাদের এই সব মহান আদর্শগুলিই পৃথিবীতে সব থেকে বড় বড় ইনজাস্টিস এবং নরহত্যা ঘটিয়েছে।

# একদিন গোটা পৃথিবী তার আদর্শের পদতলে আসবে
আদর্শে বিশ্বাসীদের জন্যে এটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। তার আদর্শই একদিন জিতবে, পৃথিবীতে রাজত্ব করবে-এমন ভ্রান্ত বিশ্বাসের বলি না হলে কিছুতেই একজন তরুণ তার আদর্শের জন্যে প্রাণত্যাগ করতে পারে না। এই চরম আত্মবলিদানের পজিশনে সে তখনই পৌঁছায়, যখন এই ফাইনাল জাস্টিস বা সবকিছুর পরে জাস্টিস আসবেই-এবং আসবে তার আদর্শের মাধ্যমে-এই ধারণা, তার মাথার মধ্যে ভীষন ভাবে পোক্ত হয়। ব্রেভিকের ম্যানিফেস্টো থেকে কমিনিউস্ট ম্যানিফেস্টো বা কোরান বা বাইবেল-সবকিছুই মানুষের মাথা ন্যাড়া করে এই ফাইনাল জাস্টিসের গল্প দিয়ে। আমি দেখেছি কমিনিস্ট, হিন্দুত্ববাদি, ইসলামিস্ট সবাই এই ব্যাপারে ভীষন রকমের এক। কার্বন কপি।

# একটা পিঁপড়ে মরলেও, সে সেটাকে তার আদর্শের সাদা কালো ফিল্টার দিয়ে দেখবে!

এদের সামাজিক বাস্তবতাতে পোস্ট মডার্নিজমের স্থান নেই সেখানে-সবই রাজনৈতিক বাস্তবতা। যেমন মুসলিম অভিবাসদের ক্ষেত্রে অসলোতে মোটে ৬০% লোক নিজেদের মুসলিম বলে রেজিস্টার করে-বাকি রা নিজেদের মুসলিম বলে না। অর্থাৎ মুসলিম সমাজেই এমন প্রচুর লোক অসলোতেই আছে, যারা তাদের ইসলামিক পরিচিতির চেয়ে নরওয়ের পরিচিতিই বেশী তুলে ধরতে ইচ্ছুক-এটা কিন্ত ব্রেভিকের ম্যানিফেস্টোতে নেই। দুনিয়া তার কাছে সাদা কালো। কোন মুসলিম অভিবাসী
নরওয়ের সংস্কৃতি গ্রহণ করে না তার মতে!

আমেরিকায় থাকা কোন বাঙালী কমিনিস্টদের বিরুদ্ধে লিখলেই বাঙালী কমিনিউস্টদের কাছে সে শিয়ার চর। মহম্মদের সমালোচনা করলেই সে ইসলামের শত্রু!

জাস্টিসের জন্যে খুন করা পবিত্রকাজ

১৯৭০ সালে বর্ধমানে সিপিএমের লোকেরা সাঁই ভাতৃদ্বয় বলে দুই কংগ্রেস সমর্থকে হত্যা করে তাদের মুন্ডু নিয়ে তাদের মায়ের সামনে নেচে ছিল। নেতৃত্বে ছিল, সিপিএমের কিছু প্রাত্তন মন্ত্রী। এই হত্যাকান্ড নিয়ে আমি যতবার সিপিএমের সমর্থকদের সাথে বিতর্কে গেছি-দেখেছি, তাদের কারুর কোন অনুতাপ নেই। বুক ভরে গর্ব করে। এমন কি ষষ্টি দলুই বলে এক প্রান্তিক কৃষকের চোখ খুবলে মেরেছিল বেশ কিছু সিপিএম হার্মাদ। আমি কোন সিপিএম সমর্থকের মধ্যে কোন অনুতাপ দেখি নি। নিন্দা করতেও দেখিনি। সাইরা বা দলুইরা কংগ্রেসের সমর্থক মানে তারা শ্রেণীশত্রু-সেটাই তাদের একমাত্র পরিচয়! ঠিক একই কারনে মুসলিম দুনিয়া ভারতে ঘটে যাওয়া ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ নিয়ে মোটেও অনুতপ্ত না-তাদের অধিকাংশ গোপনে ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ সমর্থনই করে। ঠিক একই কারনে মোদির আমলে ঘটা মুসলিম নিধন নিয়ে কোন হিন্দুত্ববাদি অনুতপ্ত না-বরং গর্বিত।

ব্রেভিকের অনুতাপহীন খুনী মানসিকতা বুঝতে-এগুলো বুঝতে হবে। সেন্স অব ইনজাস্টিস এবং শত্রুর ধারনা কি করে মানুষকে পশু বানাতে পারে। আজকে খুব পরিস্কার ভাবে বলার দিন এসেছে কমিনিউজম, ইসলামিজম, হিন্দুত্ববাদ, খ্রীষ্ঠান মৌলবাদ মানুষকে পশু বানায়-মানুষ করে না। মানুষ হওয়ার শিক্ষাটা আদর্শের পথে আসে না।

# তাদের শত্রুরা সব সময় শত্রুতা করছে-সবকিছুই তাদের বিরুদ্ধে চক্তান্ত
ব্রেভিকের মনে দৃঢ় বিশ্বাস মুসলিমরা নরওয়ে দখল করার চক্রান্ত করছে! কারন তারা ইঁদুর বিড়ালের হারে অসলোতে বংশ বৃদ্ধি করে! এবং তার কাছে এটা মুসলিম দুনিয়ার চক্রান্ত। যদিও বাস্তব এই যে ইউরোপের মুসলমান অভিবাসীদের মধ্যে বংশবৃদ্ধির হার বেশী কারন সোশ্যাল সিকিউরিটি। আমেরিকান মুসলিমদের বংশ বৃদ্ধির হার আমেরিকানদের সমানই। কারন এদেশে সবাইকে খেটে খেতে হয়। অর্থাৎ এই ধরনের কোন চক্রান্ত কোথাও নেই- মুসলিম অভিবাসীদের ফ্যামিলি সংস্কৃতির কারনে, তারা বেশী বংশ বৃদ্ধি করে-এটাকেই সে "পরিকল্পিত" চক্রান্ত বলে ভাবছে!

ঠিক একই জিনিস কমিনিউস্টদের মধ্যে দেখা যাবে। আমেরিকা যাই করুক তাই সাম্রাজ্যবাদি চক্রান্ত! মুক্ত বাণিজ্যের কারনে সব থেকে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ এবং চাকরী হারিয়েছে আমেরিকানরাই বেশী-সব থেকে বেশী লাভ করেছে ভারত। তবুও তা ভারতের বিরুদ্ধে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ! এই হচ্ছে চক্রান্ত তত্ত্বের মহিমা। আসলে এদের চিন্তার প্যাটার্নে শত্রু, ইনজাস্টিস এবং চক্রান্তের অস্তিত্ব জরুরী। নইলে এরা এদের "আত্মবলিদান" বা "ত্যাগের" পেছনে কোন কারন খুঁজে পাবে না।

# তারা কিছু সংস্কৃতির ব্যাপারে কিছু "বিশুদ্ধতার" ধারনাতে বিশ্বাসী-এবং সংস্কৃতির ধারাবাহিক বিবর্তন তারা মানতে পারে না।

সমস্যা হচ্ছে এদের কে বোঝাবে জীবনের পরম লক্ষ্য বলে কিছু থাকতে পারে না। তাই একটি সংস্কৃতি, অন্যটির চেয়ে বাজে বা অনুন্নত এই ধারনার বলি হওয়াটা বোকামো। প্রতিটা সংস্কৃতির ভালো খারাপ দিক আছে এবং সাংস্কৃতি বিবর্তনের উদ্দেশ্য দুটি সংস্কৃতির সংশ্লেষ -বিরোধ না।

আমেরিকাতে যেমন চৈনিক এবং ভারতীয় সংস্কৃতির সংশ্লেষণ হয়েছে-বিরোধ ঘটেনি। ভারতীয়, চিনা খাবার, মার্শাল আর্, যোগ ব্যায়াম অনেক কিছুই আমেরিকার মূল সংস্কৃতি প্রবাহে ঢুকেছে। ইসলাম এবং কমিনিউস্টদের ক্ষেত্রে সংশ্লেষণ বলে কোন বস্তু হতে পারে না-কারন তাদের মধ্যে "বিশুদ্ধ" ধারনাটির বিশাল প্রভাব। চোখের সামনে একজন লোক যতই দেখুক ১২০০ মিলিয়ান মুসলিমের ১২০০ মিলিয়ান ধর্ম-এবং বিশ্বের প্রতিটা লোকের ধর্ম কার্যত আলাদা হতে বাধ্য- সে নামেই যত মুসলমান বা হিন্দু হোক-তবুও ইসলামিক বিশুদ্ধতা, হিন্দু বিশুদ্ধতা নিয়ে এরা চিন্তা করে যাবেই। দুটো কমিনিউস্ট পাবেন না, যারা কমিনিউজম বলতে একই জিনিস মানে বা বোঝে-তবুও এদের মধ্যে ১০ বার স্নান করে বিশুদ্ধ থাকার প্রবণতা প্রবল। সবটাই মানসিক রোগ।

ব্রেভিকের ও ধারনা বিশুদ্ধ ইউরোপের উত্তরধিকার বিশুদ্ধ খ্রীষ্ঠান সংস্কৃতি! এটা মিথ। জিহাদিদের ধারনা বিশুদ্ধ ইসলামিক সমাজ, মহম্মদের রাজত্বে আরব! হিন্দুত্ববাদিদের বৈদিক সমাজ। কমিনিউস্টদের কাছে স্টালিনের রাশিয়া। এসবই মিথ। কিন্ত মিথের ওপর ভিত্তি করে, আত্মবলিদান ও হত্যাকান্ড ঘটানো, পৃথিবীর ইতিহাসের সব থেকে গুরুত্বপূর্ন দিক। হিটলার থেকে আজকের ব্রেভিক-সবাই সেই "মিথ" ভিত্তিক যোদ্ধা। যার পরিণতি ভয়ংকর।

আমি কমিনিউস্ট, হিন্দুত্ববাদি, ইসলামিস্ট এবং ব্রেভিকের মতন সাংস্কৃতিক মৌলবাদিদের আলাদা করে দেখি না-কারন এদের সবাই মানুষ এবং মানুষ হিসাবে কেওই আলাদা হতে পারে না। শুধু ইনজাস্টিসের ধারনাটা এদের মধ্যে আলাদা। কিন্ত এদের মনের গঠন সম্পূর্ন এক-এটা আমার বহুদিনের নিজস্ব অভিজ্ঞতা।
বিশ্বাসের ভিত্তিতে এরা হত্যাকান্ড ঘটাচ্ছে এবং ঘটিয়ে যাবে। সুতরাং বিশ্বাস এবং মিথমুক্ত পৃথিবী চাই!

Sunday, June 12, 2011

উচ্চশিক্ষা মানে প্রেসিডেন্সি-পশ্চিমবঙ্গ মানে কোলকাতা?


গত কুড়িদিন ধরে নতুন সরকার, অনেক কিছুই করার চেষ্টা করছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে যেমন পাহাড় বা জঙ্গল মহলের ক্ষেত্রে সমাধান এসেছে দ্রুত-কারন সমস্যার উৎপত্তির মূলেই ছিল সিপিএম। বা অসাধু অত্যাচারী সিপিএম নেতাদের প্রতি প্রান্তিক এবং ভাষা সংখ্যালঘুদের চূড়ান্ত অবিশ্বাস। এবং সেটা হয়েওছে সঙ্গত কারনে।

এর মধ্যেই কলকাতার জন্যে নেওয়া হচ্ছে একগুচ্ছের প্রকল্প। এর সবগুলোই ভীষন ভাবে দরকার ছিল-কারন কোলকাতার নাগরিক জীবনের মান ভারতের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেনীর শহরের মধ্যেও আসে না।

অন্যদিকে উচ্চশিক্ষা বলতে প্রেসিডেন্সির হৃতগৌরব কি করে ফেরানো যায়-তাই নিয়ে বঙ্গ সমাজের উচ্চপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের প্রচুর মতামত এবং মিডিয়া ফ্ল্যাশ চোখে পড়ল। গত ২০ দিনে উচ্চশিক্ষা মানেই প্রেসিডেন্সি বা প্রেসিডেন্সি মানেই উচ্চশিক্ষা-এমনটাই মনে হয়েছে!

কিন্ত পশ্চিম বঙ্গ মানেই কোলকাতা না বা প্রসিডেন্সি মানেই উচ্চশিক্ষা না।

বাকি জেলাশহর, মফঃশহর এবং গ্রামের কোন সমস্যা নেই? কোলকাতায় জলের স্তর যাতে না নামে তার জন্যে অর্ডিনান্স তৈরী হল-অথচ গ্রামে গ্রামে যে ডিপটিউবয়েলের জন্যে জলস্তর নামছে-জলাশয় বুঁজিয়ে চাষাবাদ হচ্ছে-তার বিরুদ্ধে কোন উচ্চবাচ্য নেই! প্রতিটা মফঃশরে এমনকি জেলা শহরগুলিতে বাসস্টান্ড ও বাসপরিশেবার বেহাল অবস্থা। আপাতত সেই দিকে চিন্তা নেই কারুর। দিদি কোলকাতার হাঁসপাতালে গেলেন-বরাদ্দ এল। কিন্ত গ্রামের স্বাস্থ্যপরিশেবার হাল কি? সেখানেত ডাক্তারবাবুরা গরু তাড়াতে তাড়াতে প্রেস্ক্রিপশন লিখছেন এখনো!

আর উচ্চশিক্ষা বলতে প্রেসিডেন্সির হাল ফেরাতে যে সময় নষ্ট হচ্ছে আমার চোখে তা দৃষ্টিকটূ এবং ভুল পথ। রাজ্যের কলেজগুলো থেকে যে সব ছেলে মেয়েরা পাশ করে বেড়চ্ছে তাদের অধিকাংশ না লিখতে পারে একলাইন ইংরেজি, না দুলাইন বাংলা। এবার ভাইপো-ভাইজিদের মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের জন্য পড়াতে গিয়ে দেখলাম অত্যন্ত নিম্নমানের নোট বই এর ছড়াছরি। পশ্চিম বঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থা নালন্দার ধ্বংশাবশেষ। এর জন্যে সার্বিক ভাবে পঠন পাঠনের সংস্কার দরকার-ইংরেজীর মান উন্নয়নের জন্যে বৃটিশ কাউন্সিলের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে সব লেভেলে। কারন ইংরেজিতে দক্ষতা না থাকলে-এই গ্লোবাল অর্থনীতিতে বাংলার ছেলেরা আরো পিছিয়ে পড়বে। প্রেসিডেন্সি থেকে আরেকটা অমর্ত্য সেন বার করার থেকে, বাংলার ছেলেরা যাতে বিশ্বঅর্থনীতির সাথে যুক্ত হতে পারে সেই চেষ্টা করতে হবে দ্রুত। ব্রাত্যবসুকে আমার আপাতত একজন ক্লুলেস ভবঘুরে মন্ত্রীর মতই মনে হচ্ছে যিনি সংস্কৃতি দপ্তর না পেয়ে উচ্চশিক্ষার চেয়ারে বসে শুধু নিজের প্রাত্তন কলেজকেই দেখতে পাচ্ছেন।