(১)
বিজ্ঞান এবং ধর্ম কি ১৮০ ডিগ্রি আলাদা? নাকি হাত ধরাধরি করে পাশাপাশি চলতে পারে মানবতার উত্তরনে? বিজ্ঞানমনস্ক হতে গেলে কি ধর্মকে আঘাত করতে হবে? এটি প্রবাহমান বিতর্ক যার উদ্ভব উনবিংশ শতাব্দির শেষে। এবং কমবেশী যেখানেই যুক্তিবাদি উদার সমাজের উদ্ভব হয়েছে সেই সময় (ইনক্লুডিং বাংলা), এই বিতর্ক হয়েছে সর্বত্র। আজকের দিনেও এই বিতর্ক গুরুত্বপূর্ন। যদি একজন বিজ্ঞানমনস্ক হয়, সেকি সামাজিক লৌকিক ধর্মাচারন থেকে ১০০ মাইলদূরে থাকবে? নাকি ল্যাবেরটরির গবেষনা এবং পূজোয় কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া একই সাথে সিদ্ধ?
(২)
আমাদের যাবতীয় প্রশ্ন/সৃজন/ চিন্তাধারা/জ্ঞান-বিজ্ঞান-যুক্তি- অর্থাৎ সামগ্রিক দর্শন দুইভাগে বিভক্ত।
ন্যারারালিজম/বিজ্ঞান এবং নীতি/এথিক্স।
ন্যাচারালিজম কি? যেসব প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞানে আছে বা বিজ্ঞান থেকে পাওয়া সম্ভব। এটি হচ্ছে বিজ্ঞান থেকে পাওয়া জ্ঞান। প্রশ্ন এবং উত্তর।
মানে যা পরীক্ষার মাধ্যমে পাওয়া সম্ভব ( টেস্টেবিলিটি)। এটাকে বলব বিজ্ঞানের ডোমেন বা বিজ্ঞানের বলয়। যার সংজ্ঞা দিয়েছিলেন স্যার কার্লপপার।
সংজ্ঞাটি অতি সাধারন কিন্ত পাওয়ারফুল। মোদ্দা ভাষায় বিজ্ঞানে পরম সত্য নেই। সবসত্যই ত্রুটিপূর্ন। এবং এই ত্রুটিকে কমাতে গেলে- সেটির মেথডিক্যাল কন্ট্রোল দরকার। সেইজন্য দরকার ফলসিফিকেশন। অর্থাৎ নেগেটিভ ডেটা যা প্রমান করবে সেই তত্ত্বের মধ্যে/সত্যের মধ্যে ত্রুটি আছে। বিজ্ঞানের গবেষনাতে এটিই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ন। কারন কোন তত্ত্বে ত্রুটির কত % আছে- সেটির সঠিক নির্নয়ের মাধ্যমেই তত্ত্বটির নির্মান হয়।
বিজ্ঞানের যাবতীয় জার্নাল, স্যার পপারের সংজ্ঞা মেনেই নির্নয় করেন কোন কাজ বিজ্ঞানের সংজ্ঞাভুক্ত হওয়ার যোগ্য কি না।
এস্ট্রোলজি, হোমিওপাথি, মার্ক্সবাদ কেন বিজ্ঞান না-তা এই সংজ্ঞা নিয়ে সহযে বোঝা যায়।
দ্বিতীয় চিন্তা/প্রশ্নের ধারাটি হচ্ছে নীতি বা এথিক্স। জীবনে কি করিতে হইবে। কি করা উচিত টাইপের প্রশ্ন। যে প্রশ্নের টেস্টেবিলিটি হয় না। যেমন আপনি কাউকে ভালবাসেন। এবার তাকে ভালোবাসা উচিত না উচিত না- তা পরীক্ষা করা বার করা সম্ভব না।
আপনি বলতেই পারেন। দূর মশাই। হাগা উচিত না উচিত না- এটা কোন প্রশ্ন হল? পেটে বেগ দিলেই হাগা উচিত। কিন্ত যদি রাস্তায় পায়খানা চাপে? আসলে ব্যক্তিগত জীবনে কি করা উচিত-আর কি করা উচিত না-এগুলির পরীক্ষা সম্ভব না। এগুলি নির্নয়ের জন্য সাধারনত পাশ্চাত্য দর্শনের দুটি ভাগ আছে- একটি ইমানুয়েল কান্টের ক্যাটেগরিক্যাল ইম্পারেটিভ। যেখানে মোদ্দা কথা, যা আপনার আমার সবারজন্য ভাল, তাই শুধু ভাল। শুধু আমার জন্য ভাল, আপনার জন্য খারাপ-এটি হলে মুশকিল আছে। আবার ওই রাস্তায় পায়খানার বেগ পেলে কি করা উচিত- সেই প্রশ্নে ফিরে আসি। হাগা পেয়েছে বলে আপনি রাস্তায় নিশ্চয় হাগতে বসে যান না। কেন? সেটা করলে আপনার ভাল হত। কিন্ত রাস্তার লোক আর হাঁটতে পারত না। অর্থাৎ আপনার জন্য ভাল, কিন্ত রাস্তার লোকেদের জন্য গেরো। তাই সেটি উচিত না। আর আপনি তা করেন ও না! পরকীয়ার প্রশ্নেও ক্যাটেগরিক্যাল ইম্পারেটিভ আসে। পরকীয়াতে আপনি এবং আপনার প্রেমিকা না হয় স্ফূর্তি করলেন। কিন্ত আপনাদের কমিটেড পার্টনারের কি হবে? এক্ষেত্রে উত্তর হচ্ছে, যারা ওপেন রিলেশনশিপে, তাদের ক্ষেত্রে এটি প্রশ্নই না। সুতরাং সার্বিক এবং সার্ব্জনীন -বা ইউনিভার্সাল উত্তর নেই। সব স্থান-কাল-ক্ষেত্র বিশেষে বদলাচ্ছে ।
দ্বিতীয় নীতির প্রশ্নটি দেশ এবং সমাজের নীতি কি হবে? কারন এর ওপর নির্ভর করে দেশের আইন। এক্ষেত্রে প্রায় সব ধর্মনিরেপেক্ষদেশ বৃটিশ আইনের অনুশীলন করে। যার ভিত্তি জেরেমি বেন্থামের ইউলিটারিনিজম -বা যে আইন যাতে সর্বাধিক লোকের সর্বাধিক উপকার হয়। ইসলামিক দেশগুলি শরিয়া আইন নির্ভর। ধর্মীয় আইন কোন বৈজ্ঞানিক সার্ভে বা গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্মিত না। যেমন আমেরিকাতে এই মিডটার্মে মেরীল্যান্ডে মারিজুয়ানা সেবন আইনসম্মত হল। এবং তা হয়েছে ব্যালটে। কোন ধর্মীয় নেতা বা বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তিতে তা হয় নি।
মোদ্দা কথা নীতির প্রশ্নগুলির অধিকাংশই বিজ্ঞানের বলয়ের বাইরে। এবং আজ পর্যন্ত অধিকাংশ লোক নীতির প্রশ্নে ধর্মের অনুসারী। যদিও সেই সক্রেটিসের দিন থেকে দার্শনিকরা বলে এসেছেন ধর্ম থেকে আগত নীতিমালা-টেরিবল। দেশ এবং সমাজের জন্য ক্ষতিকর। যার জন্য যেকোন সভ্য ধর্ম নিরেপেক্ষ রাষ্ট্রে আইনের ভিত্তি ধর্ম নয়।
(৩)
তাহলে ধর্ম আসলে কি? মানুষের কোন কাজে আসে?
ধর্ম মানেই ঈশ্বর না। ইহুদি, মুসলমান, খ্রীষ্ঠানদের ঈশ্বর আছে। হিন্দু ধর্মের কিছু সেক্টে ঈশ্বর আছেন-যারা দ্বৈতবাদি। আবার অনেক সেক্টেই নেই। বৌদ্ধ জৈনদের ঈশ্বর নেই। জাপানের সিন্টো, চীনের কনফুসিয়াসিজম-এগুলি ইশ্বর বিহীন ওয়ে অব লাইফ। কমিউনিজম হচ্ছে লেটেস্ট ধর্ম-এখানেও মন্দির ( পার্টি অফিস), ক্যানন বা ধর্মগ্রন্থ ( দাস ক্যাপিটাল), ধর্মগুরঢ়, স্বর্গ ( শ্রেনীমুক্ত সমাজ) -ইত্যাদি ধর্মের সব লক্ষনই আছে।
সুতরাং ঈশ্বর উপাসনা কুসংস্কার ইত্যাদি দিয়ে ধর্মকে বোঝা সম্ভব না। পৃথিবীর সব দেশের সব ধর্মকে বুঝতে একটা সামগ্রিক দার্শনিক ফ্রেমওয়ার্ক দরকার। আর এটি দিয়েছিলেন জার্মান দার্শনিক ফ্রেড্রিক নিৎসে। তার ব্যকগ্রাউন্ডটাও বোঝা দরকার।
উনবিংশ শতাব্দির শেষে বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব অগ্রগতির জন্য, মানুষ তাদের বহুদিনের প্রশ্ন, আমি কোথা হইতে আসিলাম, পৃথিবী এবং সূর্য্যের জন্ম-ইত্যাদি নিয়ে জানতে শুরু করেছে। ডারুইনের বিবর্তনবাদ প্রতিষ্ঠিত। ক্ল্যাসিক্যাল ফিজিক্সে অধিকাংশ কার্যকারনের ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে। ধর্মগ্রন্থের জেনেসিস-উৎপত্তি তত্ত্ব সম্পূর্ন ভাবেই বাতিল। নিৎসে [ এবং হাইডগার] বললেন ঈশ্বর না হয় মরিলেন। কিন্ত ঈশ্বর এবং ধর্ম ছাড়া মানুষ বাঁচবে কি করে? কারন এদ্দিন পর্যন্ত মানুষকে ভাবতে হয় নি তার জীবনের কর্তব্য কি। চার্চের অনুশাসনে সে জন্ম থেকে বিবাহ, বিবাহ থেকে সন্তানপালন, সামাজিক কর্তব্য, ইত্যাদি করে এসেছে।
এখন হঠাৎ করে আপনি বল্লেন ধর্মীয় অনুশাসন অর্থহীন। বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এসবের মানে নেই।
তাহলে বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে জীবনের উদ্দেশ্য কি? সমস্যা হচ্ছে এই প্রশ্নটি সেই নীতির প্রশ্ন। বিজ্ঞানের বলয়ের অন্তর্ভুক্ত না। কারন যদি বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে দেখি- এই মহাবিশ্বের বিপুল আয়তন এবং বিশাল সময়ের সামনে আমরা অতি ক্ষুদ্র এক উপস্থিতি। আমাদের বেঁচে থাকা বা মরে যাওয়াতে এই মহাবিশ্বের কিছু হোলদোল হবে না। একদিন সূর্য্য, পৃথিবী-সবই ধ্বংস হবে। তাহলে বাঁচার উদ্দেশ্য কি?
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে সত্যিই কোন উদ্দেশ্য নেই। একেই বলে নিহিলিজম। উদ্দেশ্যহীন সৃষ্টি।
কিন্ত মানুষকে বাঁচতে হবে। প্রতিটা মুহুর্তে আমরা যা করি, তার পেছনে জীবনের সার্থকতার উদ্দেশ্য আছেই বলে আমরা বেঁচে থাকার চেষ্টা করি। এটি এক্সিস্টেন্সিয়ালিজমের [অস্তিত্ববাদ] মূল সমস্যা। আসলেই জীবনের কোন পরম উদ্দেশ্য নেই। লক্ষ্য নেই। তবু বেঁচে থাকতে হবে। এবং তা করতে গেলে একটি উদ্দেশ্য লাগবে!
নিৎসে ধর্মগ্রন্থ এবং ধর্মের ইতিহাস পর্যবেক্ষন করে সিদ্ধান্তে এলেন-আসলে এই উদ্দেশ্যহীন বিশ্বে ধর্মগুলি মানুষকে বেঁচে থাকার জন্য রূপকথা শোনাচ্ছে- আশা ভরসা দিচ্ছে-ভাল কাজে উৎসাহিত করছে ( আবার খারাপ কাজেও করছে)। স্বর্গ, পরের জন্ম এসব ধারনা ধর্মে এসবের জন্যই এসেছে যাতে সাধারন জনগন বেঁচে থাকার জন্য রসদ পায়। কারন জীবন বিরাট কঠিন এক পথ। রোগ, শত্রু, দারিদ্র, অনিশ্চয়তা, ফ্যামিলি, রাজনীতি-কতকিছুর বিরুদ্ধে কঠিন লড়াই করে মানুষ বেঁচে থাকে। এই কঠিন জীবনের মধ্যে বেঁচে থাকার ইচ্ছা তখনই থাকে-যখন আমরা একটা বড় কিছু দ্বারা অনুপ্রানিত হয়!
এটিকে বলা হল পজিটিভ নিহিলিজম। উদ্দেশ্য আসলেই নেই-তাই মানুষের সামনে ভাল উদ্দেশ্য তৈরী করতে হবে। কেন তারা বেঁচে থাকবে এবং বেঁচে থেকে মানুষের জন্য ভাল কাজ করবে। ধর্ম, ন্যাশানালিজম, কমিউনিজম, সমাজসেবা, আন্তারপ্রেনারশিপ-এসব কিছুই ওই পজিটিভি নিহিলিজমের বৃত্তে।
(৪)
তাহলে ধর্মের ভবিষ্যত কি?
পজিটিভ নিহিলিজম মানুষের জীবনের একটি মৌলিক চাহিদা। অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রে এদ্দিন সেটা ধর্ম মিটিয়েছে। কমিউনিজম, ন্যাশানালিজম-ইত্যাদি নানান রাজনৈতিক আদর্শও সেটি দিতে পারে। যারা সমাজসেবী-তারা মানুষের উপকার করে তার মধ্যে দিয়ে, জীবনে বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য খুঁজছেন। যারা আন্তারপ্রেনার, নতুন সৃষ্টির মাধ্যমে নিজেকে অনুপ্রানিত করছেন।
ইদানিং নানান গুরুকুল এই "পজিটিভ নিহিলিজম" প্রোডাক্টটি সাপ্লাই করছে। স্যোশাল মিডিয়া সেই কাজটি সহজ করে দিয়েছে। আমেরিকা, ভারত, ইউরোপে প্রচুর আধুনিক গুরু। আমেরিকাতে একার্ট, জর্ডন পিটারসন। ভারতে সদগুরু, রবিশঙ্কর। ইস্কন, রামকৃষ্ণ মিশনের প্রচারকরাও আছেন। এর মধ্যে জর্ডন পিটারসন ছাড়া বাকীদের দর্শন এবং বিজ্ঞানে জ্ঞান বেশ দুর্বল। অনেক ক্ষেত্রেই ত্রুটিপূর্ন।
উল্লেখ্য আমেরিকা এবং ইউরোপের নতুন প্রজন্ম ধর্ম থেকে দ্রুত সরে আসছে। এর মূল কারন এসব দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা- যা ছাত্রছাত্রীদের স্বাধীন চিন্তা করতে উৎসাহিত করে। আমেরিকাতে ১৯৮০ সালে নিধার্মিকদের সংখ্যা ছিল ৯%। বর্তমানে তা প্রায় ২৫% ছাড়িয়েছে। পশ্চিম ইউরোপের সব দেশেই এই সংখ্যাটি ৫০% এর বেশী। ভারত এবং মুসলমান দেশগুলিতে এমনটি হচ্ছে না। কারন স্কুলে মুখস্থ করিয়ে কিছু যন্ত্র তৈরী হচ্ছে। যারা স্বাধীন চিন্তায় অক্ষম।
তবে পৃথিবী বিশাল পরিবেশ বিপর্যয়ের সামনে। আবহাওয়ার পরিবর্তনে খাদ্যের উৎপাদন এখন ক্রমাগত কমবে। খাবারের দাম বাড়তেই থাকবে। ফলে রাজনৈতিক চাপে, বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষ বিজ্ঞানমুখী হবে। আর বিজ্ঞানমুখী হলে তার পজিটিভ নিহিলিজমের চাহিদা বদলাবে। সব ধর্মের সেরা প্রোডাক্ট গুলি নিয়েই হয়ত আরো উন্নত ধার্মিক চেতনার জন্ম হবে- যা বিজ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক হবে না।
কিন্ত পজিটিভ নিহিলিজমের মৃত্যু নেই। ওটি ছাড়া এই কঠিন জীবনে মানুষ বেঁচে থাকতেই পারবে না।
1 comment:
খুব সুন্দর এবং গুরুত্বপূর্ণ এই লেখাটির জন্য ধন্যবাদ বিপ্লব বাবু 👍🙂
Post a Comment