Friday, September 9, 2022

রাণীকাহিনী

 রাণীকাহিনী

-বিপ্লব পাল, ৯ই সেপ্টেম্বর, ২০২২

(১)

বৃটেনের রানীকাহিনীর সব থেকে আকর্ষক দিক-অন্যান্য দেশে রাজা, বৃটেনে রাণী কেন? আরো খোলসা করে বললে, একটা দেশের রাজকন্যা-তার বাবার রাজত্ব পাচ্ছেন- এটা বৃটেনেই দেখা যায়। ভারতের ইতিহাসে মাত্র চার বছর রিজিয়া সুলতানা শাসক ছিলেন। মহাভারতে শিখন্ডী সব থেকে ভাল এবং অভিজ্ঞ সেনানায়ক হওয়া সত্ত্বেও তিনি দ্রুপদ রাজ্যের দাবিদার ছিলেন না। বা তাকে তখন পান্ডব পক্ষের সেনাপতি নির্বাচন করা হয়, কৌরবরা মেনে নেয় নি।

পৃথিবীর সব দেশেই রাজকন্যাদের ভবিষ্যত বাপের রাজত্ব ছেরে, অন্য রাজ্যের রাণী হওয়া। সে রাণী কিন্ত শাসক নন। বৃটেনে "রাণী" অফিশিয়াল শাসক। তার পিতা বা মাতা যদি বৃটেনের কিং বা কুইন হন, তবেই তিনি, কুইন পদের দাবিদার। রাজপরিবারে বিয়ে করে কুইন হওয়া যায় না। রাজা যদি বৃটেনের শাসক হন, যেমন এখন হলেন চার্লস (৩), তার স্ত্রী ক্যামিলা কিন্ত কুইন নন। কুইন কনসর্ট।

কুইন এলিজাবেথ ও কিন্ত বৃটিশ রাজপরিবারের বিবাহিত স্ত্রী না। তিনি ছিলেন রাজা জর্জ-৬ এর কন্যা। জর্জ-৬ এর তিন কন্যা। তার মধ্যে এলিজাবেথ-২ বড়বোন। তাই বৃটেনের সিংহাসন গেছে তার কাছে। তার স্বামী ফিলিপ বরং রাজপরিবারে বিয়ে করেছেন। তাই কুইনের স্বামী-কিং নন। ফিলিপকে উপাধি দেওয়া হয়েছিল ডিউক অব এডিনবরা। শুধু তাই না। পাবলিক সমক্ষে ফিলিপকে মাথা নত করতে হত কুইন এলিজাবেথের সামনে। চলতে হত তার পেছনে পেছনে। অবশ্যই রাজ সিংহাসনে এলিজাবেথ বসার পর। ফিলিপ এসব মেনে নিতে পারেন নি। মনের দুঃখে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে এক বছর বৈরাগী হয়ে পৃথিবী ঘুরেছেন। আবার ফিরে এসেছেন তার ভালোবাসার নারীর কাছে। যাইহোক ঠিক একই কারনে ডায়না কোন দিনই বৃটেনের রানী পদের দাবীদার ছিলেন না। তিনি হতেন কুইন কন্সর্স্ট । যিনি কিন্ত শাসক নন।

এতটা কিচ্ছার দরকার ছিল না। আমার লেখাটা ছিল রানীর শাসন নিয়ে। পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র বৃটেন আর রাশিয়ার রোমানভ বংশের জারের ফ্যামিলিতেই রানীর শাসন ছিল।

আর কোথাও পুরুষতন্ত্রের জন্য, রাজকন্যা বা রানীরা শাসক হতে পারতেন না। হ্যা ঝাঁসির রানী লক্ষীবাই বা চীনের কুইন মাদার দোগের কি- এরাও শাসক ছিলেন। কিন্ত স্বীকৃত শাসক না। নিজের নাবালক পুত্রকে নামেমাত্র রাজা করেই এরা পর্দার পেছনে শাসন করেছেন। কারন পুরুষতন্ত্র নারী শাসককে মেনে নেয় নি। প্রায় কোন দেশেই না। বাংলার ইতিহাসই দেখুন। কোন নারী শাসক নেই। শেখ হাসিনা না মমতা ব্যানার্জি এরা আধুনিক গণতন্ত্রের ফসল। কিন্ত রাজতন্ত্রে রাজকুমারী রাজা হচ্ছেন- এটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কোথাও ছিল না। ব্যতিক্রম শুধু বৃটেন এবং রাশিয়া-বা আরো বিস্তারিত বললে পূর্বের শ্লাভ রাজ্যগুলির মধ্যে।

কিন্ত কেন? শুধু তাই না। আমার ইংল্যান্ডের ইতিহাস পড়ে এটাই মনে হয়েছে- বৃটেন যে গোটা পৃথিবী শাসন করেছে-এর মূল কারন বৃটেনের মাতৃতান্ত্রিক সমাজ। যেখানে মেয়েরা শাসক হতে পারে। যার জন্য ১০০,০০০ বৃটিশ, ৩০ কোটি ভারতীয়কে শাসন করেছে। কেন? এটা আমার নিজস্ব মতামত। আমি পরে ব্যখ্যা করছি।

(২)
বৃটেনের ইতিহাসে রানীর শাসন বহুপুরাতন। যেই যবে থেকে রোমান ঐতিহাসিকরা ইংল্যান্ডের ইতিহাস লিখছেন। প্রথম শতাব্দিতে বৃটেন ছিল রোমের অধীন। ইংল্যান্ড বিভক্ত ছিল অসংখ্য করদ রাজ্যে। তারা প্রায় রোমের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করত। এমন এক করদ রাজ্যের রাজা ছিলেন কসুতোগাস। আসিনি উপজাতিদের সর্দার। তার স্ত্রী বোদিকা। তার দুই কন্যা। পুত্র ছিল না। রাজা কসুতোগাস রোমের সাথেই ছিলেন। তিনি উইল করে যান তার মৃত্যুতে তার বড় কন্যা হবে, সেই রাজ্যের শাসক। রোমের লোকাল কনসাল তা মানে নি। উলটে তার দুই কন্যাকে ধর্ষন করা হয়। রানী বোদিকাকে চাবুক মারা হয়। বোদিকা আত্মসমর্পন করেন নি। এই ঘটনায় বৃটেনের সব রাজ্যের শাসকরাই বিদ্রোহী হয়ে ওঠে রোমের বিরুদ্ধে। তারা বোদিকার নেতৃত্বে প্রথম বারের মতন ঐক্যবদ্ধ বিদ্রোহী সেনাবাহিনী গঠন করে। সেটিই ছিল ইতিহাসের প্রথম ইংলিশ সেনাবাহিনী। বোদিকা রোমের সাথে যুদ্ধে পরাস্ত হোন ('৬১ খৃষ্টাব্দ) ।

কিন্ত এই বিদ্রোহের ঘটনা সুদূরপ্রসারী। ইংল্যান্ডের জনমানসে, রোমান পিতৃতান্ত্রিক শাসকদের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডের বিদ্রোহী জনগনের কাছে "মাতৃতান্ত্রিক শাসন এবং রাজকুমারীদের উত্তরাধারিকার" একটা বড় ইস্যু ছিল। ফলে ইংল্যান্ড যখন রোমান সাম্রাজ্য থেকে মুক্তিপেল- ইংল্যান্ডের আদিবাসী আইনে রাজকুমারীদের শাসক হওয়া কিন্ত ট্রাডিশন হয়ে গেছে। সেটা বোদিকার ওই বিদ্রোহকে স্বরণ করেই। এবং তারপর ও ইংল্যান্ডে ভাইকিং দের রেইড চলতেই থাকবে। এবং ভাইকিং রাজারাও রাজকুমারীর উত্তরাধিকার মেনে নেয়। যদিও ভাইকিংদের মধ্যে এই চল ছিল না।

কিন্ত প্রশ্ন হচ্ছে সেক্ষেত্রে ঝাঁসির রাণী লক্ষীবাইএর ক্ষেত্রে বৃটিশরা উলটো পথে গেল কেন? এত সেই বৃটেনের বিরুদ্ধে রোম যা করেছিল, তারই ফ্ল্যাশব্যাক। কেননা ঝাঁসির রাজা আমৃত্য বৃটিশ অনুগতই ছিলেন। সেক্ষেত্রে ঝাঁসির রানীর শাসন কোম্পানীর লোকের মানে নি কেন? সোজা উত্তর হচ্ছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী সেই রাজ্য বেচে আরো বেশী লাভের আশায় ছিল। যাইহোক ১৮৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর এসব দুরাচারের কারনেই রাণী ভিক্টোরিয়া কোম্পানীর হাতে আর ভারতের শাসনভার রাখেন নি। নিজের হাতে নেন।

এবং একটা হার্ড ট্রুথ হচ্ছে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসনে ভারতের জিডিপি ছিল নিম্নগামী। যবে থেকে ভারতের রানীর শাসন শুরু হয়, তবে থেকে ভারতের লোকেরা অনেক বেশী আইন সুরক্ষা পেয়েছে এবং জিডিপি গ্রোথ ও এই সময় আবার পজিটিভ হয়। ভারতের বৃটিশ কলোনিয়াল ইতিহাসের দুটো অধ্যায়। একটা রানীর শাসনের আগে। কোম্পানীর শাসন। যে সময় লুঠ হয়েছে অবাধে। ভারতের জিডিপি নেগেটিভে ছিল। অন্যটা রাণীর শাসন। যেখানে জিডিপি গ্রোথ ছিল। আইনি সুরক্ষা ছিল অনেক বেশী। ডেটা থেকে খুব পরিস্কার আলাদা করা যায় এই দুই অধ্যায়। মনে রাখবেন ওই সুরক্ষা থাকার কারনেই, রানীর শাসন শুরু হওয়ার পরেই একমাত্র টাটা বা বিড়লারা শিল্পপতি হিসাবে উঠতে থাকেন। যদিও অর্থের সোর্স ছিল চীনে আফিম বেচা।

আপনি বলতেই পারেন তাতে কি? ভারতীয়দের কি অধিকার ছিল রানীর শাসনের বিরুদ্ধে কিছু বলার? কিন্ত সেই প্রশ্ন ত আজও উঠবে। বর্তমানেও দিল্লী বা কোলকাতার শাসকদের সমালোচনা করা বিপজ্জনকই বটে!

তবে কলোনিয়াল শাসন ভাল না খারাপ এটা এই প্রবন্ধের আলোচ্য না। আমার একটা উত্তর দেওয়া বাকি আছে। কেন বৃটেনে এই রানীর শাসনের ঐতিহ্য, এই জাতটিকে মাস্টাররেস করে তোলে।

বৃটেনে রাজকুমারী এবং মেয়েদের প্রায় ছেলেদের সমানই শিক্ষা দেওয়া হত। তলোয়ার খেলা, ঘোড়ায় চড়া বা শিক্ষা। প্রায় সবক্ষেত্রেই মেয়েরা ছেলেদের সমকক্ষ ছিল। সেটা বৃটেনের সেই আদিবাসী সমাজ থেকেই চলে আসছে।

যে দেশে মায়েরা শিক্ষিত এবং যুদ্ধবিদ্যায় স্কিল্ড হবে, সেই দেশে বীর এবং নেতার সংখ্যাও বেশী হবে। যার জন্য ইংল্যান্ডে নেতার অভাব কখনো হয় নি ইতিহাসে ( তবে আজ হচ্ছে! )। বৃটিশরা যে বীরত্ব এবং নেতৃত্বে অনেক এগিয়েছিল-সেই নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। কারন ক্লাইভ যখন ৩০০০ সৈন্য নিয়ে সিরাজকে আক্রমন করেন-তখনো তিনি জানেন না মীরজাফর কোন দলে। আদৌ গদ্দারি করবে কি না। ফলে পলাশী যুদ্ধের দুপুর বেলা থেকে, তার সৈন্যরা মীরজাফরের সৈন্যদলকেও আক্রমন করে ছত্রভঙ্গ করে। মীরজাফর গদ্দারি করবেই এই ভরসাই ক্লাইভ আক্রমন করেন নি। করেছিলেন নিজেদের উন্নত কামান এবং যুদ্ধবিদ্যার জোরেই। ক্লাইভের সমকক্ষ স্ট্রাটেজিস্ট এবং সেনাপতি-সেই সময় ভারতে কেউ ছিল না। পলাশীর যুদ্ধের আগে দাক্ষিনাত্যে ক্লাইভ আরো দুটো যুদ্ধ জিতেছেন। যেখানে তার সেনা বাহিনী ছিল নবাবাদের থেকে অনেক ছোট। এবার প্রশ্ন করুন লর্ড ক্লাইভের মা কে ছিলেন?

তার মায়ের নাম রেবেকা। যদিও ক্লাইভ ম্যাঞ্চেস্টারে তার মাসি এবং মেসোমশাইএর কাছে বড় হয়েছিলেন। তিনি তার মাসীর কাছ থেকেই প্রাথমিক যুদ্ধবিদ্যার পাঠ নেন। এবং সমস্ত স্কুল জীবনে মারপিট করতে অভ্যস্থ ছিলেন। যাকে বলে এডিটেক্ট টু ওয়ার । এটি এসেছিল, তার মাসীর কাছ থেকেই।

আমি জানি ভারতে বৃটিশ উপনিবেশের ইতিহাস যেভাবে পড়ানো হয়, তাতে ভারতীয়রা লর্ড ক্লাইভ ইত্যাদি চরিত্রগুলিকে ঘৃনা করতে শেখে। তার নিশ্চয় সঙ্গত কারন আছে। কিন্ত কেউ একবার ও ইতিহাসে খোঁজ নেয়-কি করে ১০০,০০০ বৃটিশ ৩০ কোটি ভারতীয়কে দাবিয়ে রেখেছিল? কি করে ক্লাইভ প্রায় সব যুদ্ধে অনেক কম সেনানী নিয়ে নবাবদের বিরাট বিরাট বাহিনীকে হারিয়েছেন?

ক্লাইভ এবং তার সমসাময়িক বৃটিশ জেনারেলদের যুদ্ধকুশলতা বুঝতে ইতিহাসের অনেক গভীরে যেতে হবে। কিন্ত মনে রাখা দরকার এইসব যুদ্ধ বিশারদ ক্লাইভদের জন্যেই গোটা বিশ্বে বৃটিশ সাম্রাজ্য ছড়িয়ে যায় । কারন দেশীয় রাজারা বা নবাররা যুদ্ধে বা রাজনীতিতে ক্লাইভদের সমকক্ষ ছিলেন না। কিন্ত কেন ?

কারন ক্লাইভ সহ বৃটিশ জেনারেলরা আসতেন বৃটেনের এলিট ফিউডাল পরিবারগুলি থেকে। যেখানে তারা বীরত্বের শিক্ষা, যুদ্ধের শিক্ষা মা বা মাসী পিশীদের কাছ থেকে পেতেন। মেকস এ লটস অব ডিফারেন্স।

ইতিহাসের গভীরে গেলে অনেক কিছুই শেখা যায়। আর শুধু স্কুলের বই পড়লে কিছু কিছু লোকের প্রতি একগাদা ঘৃনা তৈরী হবে-যা সম্পূর্ন সিস্টেম ম্যানুফাকচারড। 

No comments: