আশেপাশের নারীবাদি ইতিহাস----
বিপ্লব পাল, ২৩শে সেপ্টেম্বর
#১ মাশা আমিনির হিজাবের মাপ----
ফ্যাশন পুলিশের লাঠির ঘা খেয়ে মাশা আমিনির মৃত্যুতে ইরান জ্বলছে। ইরানে মোল্লাতন্ত্র বনাম নারীবাদিদের লড়াই ইসলামিক বিপ্লবের শুরু থেকেই। ১৯৭৮ সালে শাহ রেজা পল্লভীকে সরানোর লড়াই একসাথে লড়েছিলেন মোল্লা এবং নারীবাদিরা ( পড়ুন বামেরা)। তারাই মোল্লাদের আদর করে এনেছিলেন । কারন বামেদের কাছে শাহ ছিলেন পশ্চিমের প্রতিনিধি! মোল্লারা ১২ মাসের মধ্যে প্রায় লাখ খানেকের বেশী কমিনিউস্ট হত্যা করে, সহবিপ্লবীদের আগেই সঠিক জন্নতে পাঠিয়েদিয়েছিলেন। নারীবাদিদের কয়েদ করা হয়েছিল। জঘন্য শরিয়া আইন চাপিয়ে দেওয়া হয় মেয়েদের বিরুদ্ধে। যার একটি হচ্ছে, সন্তানের ওপর একমাত্র বাবার অধিকার স্বীকৃত। অর্থাৎ ডিভোর্স আইনে ছেলেমেয়েদের ওপর মায়ের কোন অধিকার নেই। পাঁচ মাসের শিশু হলেও নেই। শরিয়া আইনে মেয়েরা সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন।
এর বিরুদ্ধে আজ না, গত চল্লিশ বছর ধরেই ইরানের মহিলারা লড়ছেন। প্রচুর মহিলা নেত্রীকে কয়েদ করে মেরে ফেলা হয়েছে ইরানে।
ইরানের নারীবাদি আন্দোলন নিয়ে, গত দুই দশক মুক্তমনাতে অনেক লিখেছি। এসব লিখতে গেলে আপনি বাংলার বামেদের কাছে হবেন সিয়ার এজেন্ট। আর মুসলমানদের কাছে মোদির এজেন্ট।
এইসব বাম, ইসলামিস্ট, হিন্দুত্ববাদিদের কাছে শত্রু হচ্ছে পশ্চিম-ওয়েস্ট! ওয়েস্টার্ন কালচার। যদিও শাহ পল্লভীর আমলে ইরান ইউরোপের প্রায় সব রাষ্ট্রগুলির থেকেই শিক্ষা এবং সমৃদ্ধিতে এগিয়ে যাচ্ছিল। বাম এবং মোল্লাদের বিপ্লব তাকে উৎখাত করে, কারন শাহ ছিলেন "পশ্চিমের" এজেন্ট! পশ্চিম ঘেঁসা কোরাপ্ট নেতা। তার নেতৃত্বে ইরানের মহিলারা স্বাধীন জীবনের স্বাদ পাচ্ছিল-ইসলামিক সমাজে তা ছিল কোরাপশনতুল্য!
শাহ অন্যান্য শাসকের মতন ফাইন্যান্সিয়ালি কোরাপ্ট ছিলেন বটে-কিন্ত ইরানকে ইংল্যান্ডের সমকক্ষ করে তুলেছিলেন। এবং সেটা সম্ভব হয়েছিল নারীশিক্ষার ব্যপক প্রসারের জন্যই। কিন্ত মুসলমান সমাজে তা পাপের কাজ!
পশ্চিমের বিরুদ্ধে একাধারে বাম-ইসলামিক-হিন্দুত্ববাদিদের জিহাদ ব্যপারটা আমার ব্যপক লাগে। যদিও আমি গত বাইশ বছর আমেরিকা প্রবাসী, পশ্চিমা সংস্কৃতির আলাদা কোন অস্তিত্ব আমি খুঁজে পাই নি। মানুষ এবং তার চাওয়া পাওয়া পৃথিবীর সব দেশেই এক। কিন্ত মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা না থাকলে, তার মানসিক বিকাশ সম্ভব না। ব্যক্তি স্বাধীনতা= পশ্চিমা সংস্কৃতি, এটা হাস্যকর দাবী। ভারতের ইতিহাস বলে, আজ থেকে ২৫০০ বছর পূর্বে ব্যক্তিস্বাধীনতা না থাকলে, এই আর্য্যভূমে একই সাথে জৈন, চার্বাক, বৌদ্ধ, অভাজিকার মতন নাস্তিক্য ধর্মের বিকাশ অসম্ভব ছিল।
ইতিহাস পড়ে আমি নিশ্চিত, অতীত ভারতে যে চিন্তার স্বাধীনতা, আচরনের স্বাধীনতা মানুষ ভোগ করত-তা উনবিংশ শতাব্দির ইউরোপেও ছিল না। উনবিংশ শতাব্দির ইউরোপে ইমানুয়েল কান্ট থেকে ফ্রেডরিক নিৎসে-সবাই দর্শন চর্চা করেছেন, বা করতে বাধ্য হয়েছেন পর্দার আড়ালে। সেখানে আড়াই হাজার বছর আগে, এই ভারতভূমে বুদ্ধ এবং মহাভীর নির্ভয়ে তাদের বৈপ্লবিক চিন্তা প্রচার করেছেন। রাজানুগ্রহও পেয়েছেন। বুদ্ধের শেষযাত্রায় ভারতের ৭২ জন রাজা অংশ নিয়েছিলেন। আর ব্যক্তিস্বাধীনতার রাজনৈতিক দাবী প্রথম তোলেন লাউৎসে-চীনের দার্শনিক যিনি প্রায় বুদ্ধের সমসাময়িক।
সুতরাং এই ব্যক্তিস্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, আচরনের স্বাধীনতা, নারীর স্বাধীনতা মোটেও ওয়েস্টার্ন কালচার না। এ আমাদের প্রাচ্যের ঐতিহ্য। ভারতের ঐতিহ্য। দীর্ঘদিন বিদেশী শাসকের পায়ের তলায় থাকার জন্য, চিন্তার স্বাধীনতার এই ঐতিহ্য এ অঞ্চলের লোকজন ভুলে গেছে।
#২ বাংলাদেশের চ্যাম্পিয়ান মহিলা ফুটবল টিম
যে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে প্রাক্টিস করে বাংলাদেশের মহিলা টিম সাফ চ্যাম্পিয়ান হয়েছে নেপাল এবং ভারতকে দুরমুশ করে-তার জন্য কোন প্রসংশাই যথেষ্ট না। একদিকে তৃতীয় বিশ্বের সীমাহীন দারিদ্র, অন্যদিকে মোল্লাদের রক্তচক্ষু- এইদুই সাঁড়াশি আক্রমনের সামনে কৃষ্ণারানীদের টি্মের পারফর্মান্স শুধু হলিউড বা বলিউডের সিনেমাতেই দেখেছি। বাস্তবে না।
ইরান এবং বাংলাদেশ-দুটি ক্ষেত্রেই লড়াই নারীবাদি বনাম মোল্লাতন্ত্র। আমি একথা বহুদিন থেকেই লিখে আসছি-আসলে মোল্লাতন্ত্র বলে কিছু নেই। পুরুষতন্ত্রের অনেক রাবনমুখের একটি হচ্ছে মোল্লাতন্ত্র। সুতরাং মেয়েদের সাথে মোল্লাদের গৃহযুদ্ধ অনিবার্য্য। মেয়েদের ঝাঁটা ছাড়া মোল্লাদের মৃত্যু নেই। বাম রাজনীতি বরাবর নারীবাদিদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে- সে সোভিয়েত, ইরান বা বাংলাদেশ- যেদেশের ইতিহাসই আপনি দেখুন না কেন। সুতরাং বাম রাজনীতির স্পর্ষে অহল্যার শাপমোচন হবে, মেয়েরা মোল্লাদের কাছ থেকে তাদের রাজনৈতিক অধিকার পাবে, তা কোন দেশে হয় নি। হবেও না। ওই লড়াইটা মেয়েদের নিজেদেরই করতে হবে!
# ৩ রাধাতত্ত্ব ইসলামিক ষড়যন্ত্র!
এটা হোয়াটসাপ ইউনিভার্সিটির লেটেস্ট পিএইচডি থিসিস যা হোয়াটসাপে বাঙালী হিন্দুদের গ্রুপগুলোতে খুব জনপ্রিয় হয়েছে!
এর মোদ্দা কথা- মহাভারতে কৃষ্ণের কোন রাধা উপাখ্যান নেই! তাহলে কৃষ্ণের নাম কেন এই পরকীয়ার "পাপের" সাথে জড়ালো? কে বাজারে আমদানী করেছে রাধাকৃষ্ণের এই অবৈধ প্রেমকাহিনী? নিশ্চয় সুলতানী আমলের হিন্দু পন্ডিতরা! সুতরাং নিশ্চয় এটাও সেই ইসলামিক চক্রান্তের ফসল---
যাকগে, হিন্দু মোল্লারা যে এদ্দিন বাদে আবিস্কার করেছে রাধাচরিত্র মহাভারতে নেই- সেটাই আশ্চর্য্য। তবে আরেকটু রিসার্চ করলে উনারা জানতে পারতেন, রাধা বৈষ্ণব ধর্মের সাধনমার্গ এবং বৈষ্ণব ধর্মটাই ১০০% বৈদিক না! সুতরাং বৈদিক সমগ্রে রাধাকাহিনী থাকার কথা না!
যারা বৈষ্ণব তারা ভালোই জানেন, রাধা রূপক। সব ভক্তই রাধারূপে কৃষ্ণকে ভালবাসে-কারন এ ভক্তিমার্গ। আর এপ্রেম পরকিয়া। পরকিয়া প্রেমে যেমন সমাজ সংসারকে তুচ্ছ করে, প্রেমরসে ডুবতে হয়-রাধাভাব মানেই সেই গভীররস -ভক্ত যেন সমাজ সংসারের বাঁধন ভুলে কৃষ্ণপ্রেমে ডুবে যায়! আর বৈষ্ণব দর্শনে কৃষ্ণ হচ্ছে সুপার কনসাসনেস বা বিশ্বচৈতন্য।
বৈষ্ণব ধর্মের উৎপত্তি নিয়ে হাজার হাজার গবেষনাপত্র আছে। এর উৎপত্তি ইসলাম আসার অনেক আগে। দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম শতাব্দি। মূলত দাক্ষিনাত্যে। আর্য্য অনার্য্য ধর্মের সব থেকে বড় সিন্থেসিস বৈষ্ণব ভক্তিবাদ।
গোটা বিশ্বের হিন্দুদের ৬০% বৈষ্ণব। বাংলায় সেটা ৯০% হবে। দাক্ষিনাত্যেও তাই। আর বিদেশী হিন্দুদের মধ্যে প্রায় ৯৯% ইস্কনের বৈষ্ণব-বা গৌড়ীয় বৈষ্ণব।
বৈষ্ণব ধর্ম আসলে উত্তরের জাতপাত সম্বলিত ব্রাহ্মন্য ধর্মের বিরুদ্ধে দক্ষিন এবং পূর্বভারতের প্রতিবাদি আন্দোলন-যেখানে জাতপাত নেই। সংস্কৃত মন্ত্রর বদলে হৃদয়ের ভালোবাসার মন্ত্রে কৃষ্ণ পূজিত হন। শ্রী চৈতন্য গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রতিষ্ঠা না করলে, আজকে সব বাঙালীই মুসলমান হত।
সুতরাং অবাক হওয়ার কিছু নেই। বিজেপির লোকজন এখন বৈষ্ণব ধর্মের পেছনে লেগেছে। এটা হওয়ারই ছিল। ব্রাহ্মন্য ধর্মের প্রতিনিধিরা একদিন না একদিন বৈষ্ণবদের পেছনে লাগতই। এটা কেন এত দেরীতে হল, সেটাই ভাবছি।
বিজেপির হিন্দুত্ববাদি লোকজন হিন্দু দর্শন , প্রাচীন ভারতীয় দর্শন কি বোঝে আমি জানি না। তাদের এবং ভারতের লোকেদের দুটো জিনিস জানা উচিত।
১) ভারতে ইসলাম এবং খৃষ্ঠান রাজশক্তি ৮০০ বছর থাকা সত্ত্বেও, হিন্দু ধর্ম টিকে গেছে। আফ্রিকা বা ইন্দোনেশিয়া, মালেশিয়াতে কিন্ত স্থানীয় ধর্মের লোকেরা টেকে নি। তারা মুসলমান বা খৃষ্টান হয়ে গেছে। এই হিন্দু ধর্ম ভারতে টিকে যাওয়ার মূল কারন বৈষ্ণব ধর্ম। তার ভক্তিরস, তার অহিংসা এবং মানবতার তীব্রতাই হিন্দুধর্মকে টিকিছে বিদেশী রাজশক্তির বিরুদ্ধে। তারজন্য কোন হিন্দুত্ববাদি রাজশক্তি লাগে নি। আজ ইস্কন গোটা বিশ্বে জনপ্রিয়। তারজন্য কোন মোদি-আমিত শায়ের পেশী শক্তির দরকার লাগে নি।
২) ধর্মকে রাজনীতির সাথে জড়ালে, সেই ধর্মের কি হাল হয়, তা মুসলমানদের দিকে তাকালে বোঝা যায়।
ইসলামে বিশ্বাস করে লোকে বিন লাদেন ও হয়, আবার দাতা আগাখান ও হয়।
ইসলামের ইতিহাস পড়লে বোঝা যায়, একদা সব থেকে প্রগতিশীল ধর্মটি কিভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতালোভীদের হাতে নষ্ট হয়েছে-কারন তারা ইসলামের জনপ্রিয়তা বেচে রাজনৈতিক ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছেন।
হিন্দুত্ববাদি রাজনৈতিক শক্তিও ঠিক এই কাজটিই করছে।
জীবনে কঠিন মুহুর্তগুলোর মোকাবিলায় আমি নিজেই উপনিষদের স্বরণ নিই। আবার পাশ্চাত্য দর্শনের আলোতেই হিন্দু এবং বৌদ্ধ দর্শনকে বুঝেছি। এ একান্তই ব্যক্তিগত- একান্তই নিজের রিয়ালাইজেশন। এগুলিকে রাজনীতিতে ঢোকালে, তা পচতে বাধ্য।