Saturday, September 24, 2022

আশেপাশের নারীবাদি ইতিহাস-

 আশেপাশের নারীবাদি ইতিহাস----

বিপ্লব পাল, ২৩শে সেপ্টেম্বর
#১ মাশা আমিনির হিজাবের মাপ----
ফ্যাশন পুলিশের লাঠির ঘা খেয়ে মাশা আমিনির মৃত্যুতে ইরান জ্বলছে। ইরানে মোল্লাতন্ত্র বনাম নারীবাদিদের লড়াই ইসলামিক বিপ্লবের শুরু থেকেই। ১৯৭৮ সালে শাহ রেজা পল্লভীকে সরানোর লড়াই একসাথে লড়েছিলেন মোল্লা এবং নারীবাদিরা ( পড়ুন বামেরা)। তারাই মোল্লাদের আদর করে এনেছিলেন । কারন বামেদের কাছে শাহ ছিলেন পশ্চিমের প্রতিনিধি! মোল্লারা ১২ মাসের মধ্যে প্রায় লাখ খানেকের বেশী কমিনিউস্ট হত্যা করে, সহবিপ্লবীদের আগেই সঠিক জন্নতে পাঠিয়েদিয়েছিলেন। নারীবাদিদের কয়েদ করা হয়েছিল। জঘন্য শরিয়া আইন চাপিয়ে দেওয়া হয় মেয়েদের বিরুদ্ধে। যার একটি হচ্ছে, সন্তানের ওপর একমাত্র বাবার অধিকার স্বীকৃত। অর্থাৎ ডিভোর্স আইনে ছেলেমেয়েদের ওপর মায়ের কোন অধিকার নেই। পাঁচ মাসের শিশু হলেও নেই। শরিয়া আইনে মেয়েরা সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন।
এর বিরুদ্ধে আজ না, গত চল্লিশ বছর ধরেই ইরানের মহিলারা লড়ছেন। প্রচুর মহিলা নেত্রীকে কয়েদ করে মেরে ফেলা হয়েছে ইরানে।
ইরানের নারীবাদি আন্দোলন নিয়ে, গত দুই দশক মুক্তমনাতে অনেক লিখেছি। এসব লিখতে গেলে আপনি বাংলার বামেদের কাছে হবেন সিয়ার এজেন্ট। আর মুসলমানদের কাছে মোদির এজেন্ট।
এইসব বাম, ইসলামিস্ট, হিন্দুত্ববাদিদের কাছে শত্রু হচ্ছে পশ্চিম-ওয়েস্ট! ওয়েস্টার্ন কালচার। যদিও শাহ পল্লভীর আমলে ইরান ইউরোপের প্রায় সব রাষ্ট্রগুলির থেকেই শিক্ষা এবং সমৃদ্ধিতে এগিয়ে যাচ্ছিল। বাম এবং মোল্লাদের বিপ্লব তাকে উৎখাত করে, কারন শাহ ছিলেন "পশ্চিমের" এজেন্ট! পশ্চিম ঘেঁসা কোরাপ্ট নেতা। তার নেতৃত্বে ইরানের মহিলারা স্বাধীন জীবনের স্বাদ পাচ্ছিল-ইসলামিক সমাজে তা ছিল কোরাপশনতুল্য!
শাহ অন্যান্য শাসকের মতন ফাইন্যান্সিয়ালি কোরাপ্ট ছিলেন বটে-কিন্ত ইরানকে ইংল্যান্ডের সমকক্ষ করে তুলেছিলেন। এবং সেটা সম্ভব হয়েছিল নারীশিক্ষার ব্যপক প্রসারের জন্যই। কিন্ত মুসলমান সমাজে তা পাপের কাজ!
পশ্চিমের বিরুদ্ধে একাধারে বাম-ইসলামিক-হিন্দুত্ববাদিদের জিহাদ ব্যপারটা আমার ব্যপক লাগে। যদিও আমি গত বাইশ বছর আমেরিকা প্রবাসী, পশ্চিমা সংস্কৃতির আলাদা কোন অস্তিত্ব আমি খুঁজে পাই নি। মানুষ এবং তার চাওয়া পাওয়া পৃথিবীর সব দেশেই এক। কিন্ত মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা না থাকলে, তার মানসিক বিকাশ সম্ভব না। ব্যক্তি স্বাধীনতা= পশ্চিমা সংস্কৃতি, এটা হাস্যকর দাবী। ভারতের ইতিহাস বলে, আজ থেকে ২৫০০ বছর পূর্বে ব্যক্তিস্বাধীনতা না থাকলে, এই আর্য্যভূমে একই সাথে জৈন, চার্বাক, বৌদ্ধ, অভাজিকার মতন নাস্তিক্য ধর্মের বিকাশ অসম্ভব ছিল।
ইতিহাস পড়ে আমি নিশ্চিত, অতীত ভারতে যে চিন্তার স্বাধীনতা, আচরনের স্বাধীনতা মানুষ ভোগ করত-তা উনবিংশ শতাব্দির ইউরোপেও ছিল না। উনবিংশ শতাব্দির ইউরোপে ইমানুয়েল কান্ট থেকে ফ্রেডরিক নিৎসে-সবাই দর্শন চর্চা করেছেন, বা করতে বাধ্য হয়েছেন পর্দার আড়ালে। সেখানে আড়াই হাজার বছর আগে, এই ভারতভূমে বুদ্ধ এবং মহাভীর নির্ভয়ে তাদের বৈপ্লবিক চিন্তা প্রচার করেছেন। রাজানুগ্রহও পেয়েছেন। বুদ্ধের শেষযাত্রায় ভারতের ৭২ জন রাজা অংশ নিয়েছিলেন। আর ব্যক্তিস্বাধীনতার রাজনৈতিক দাবী প্রথম তোলেন লাউৎসে-চীনের দার্শনিক যিনি প্রায় বুদ্ধের সমসাময়িক।
সুতরাং এই ব্যক্তিস্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, আচরনের স্বাধীনতা, নারীর স্বাধীনতা মোটেও ওয়েস্টার্ন কালচার না। এ আমাদের প্রাচ্যের ঐতিহ্য। ভারতের ঐতিহ্য। দীর্ঘদিন বিদেশী শাসকের পায়ের তলায় থাকার জন্য, চিন্তার স্বাধীনতার এই ঐতিহ্য এ অঞ্চলের লোকজন ভুলে গেছে।
#২ বাংলাদেশের চ্যাম্পিয়ান মহিলা ফুটবল টিম
যে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে প্রাক্টিস করে বাংলাদেশের মহিলা টিম সাফ চ্যাম্পিয়ান হয়েছে নেপাল এবং ভারতকে দুরমুশ করে-তার জন্য কোন প্রসংশাই যথেষ্ট না। একদিকে তৃতীয় বিশ্বের সীমাহীন দারিদ্র, অন্যদিকে মোল্লাদের রক্তচক্ষু- এইদুই সাঁড়াশি আক্রমনের সামনে কৃষ্ণারানীদের টি্মের পারফর্মান্স শুধু হলিউড বা বলিউডের সিনেমাতেই দেখেছি। বাস্তবে না।
ইরান এবং বাংলাদেশ-দুটি ক্ষেত্রেই লড়াই নারীবাদি বনাম মোল্লাতন্ত্র। আমি একথা বহুদিন থেকেই লিখে আসছি-আসলে মোল্লাতন্ত্র বলে কিছু নেই। পুরুষতন্ত্রের অনেক রাবনমুখের একটি হচ্ছে মোল্লাতন্ত্র। সুতরাং মেয়েদের সাথে মোল্লাদের গৃহযুদ্ধ অনিবার্য্য। মেয়েদের ঝাঁটা ছাড়া মোল্লাদের মৃত্যু নেই। বাম রাজনীতি বরাবর নারীবাদিদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে- সে সোভিয়েত, ইরান বা বাংলাদেশ- যেদেশের ইতিহাসই আপনি দেখুন না কেন। সুতরাং বাম রাজনীতির স্পর্ষে অহল্যার শাপমোচন হবে, মেয়েরা মোল্লাদের কাছ থেকে তাদের রাজনৈতিক অধিকার পাবে, তা কোন দেশে হয় নি। হবেও না। ওই লড়াইটা মেয়েদের নিজেদেরই করতে হবে!
# ৩ রাধাতত্ত্ব ইসলামিক ষড়যন্ত্র!
এটা হোয়াটসাপ ইউনিভার্সিটির লেটেস্ট পিএইচডি থিসিস যা হোয়াটসাপে বাঙালী হিন্দুদের গ্রুপগুলোতে খুব জনপ্রিয় হয়েছে!
এর মোদ্দা কথা- মহাভারতে কৃষ্ণের কোন রাধা উপাখ্যান নেই! তাহলে কৃষ্ণের নাম কেন এই পরকীয়ার "পাপের" সাথে জড়ালো? কে বাজারে আমদানী করেছে রাধাকৃষ্ণের এই অবৈধ প্রেমকাহিনী? নিশ্চয় সুলতানী আমলের হিন্দু পন্ডিতরা! সুতরাং নিশ্চয় এটাও সেই ইসলামিক চক্রান্তের ফসল---
যাকগে, হিন্দু মোল্লারা যে এদ্দিন বাদে আবিস্কার করেছে রাধাচরিত্র মহাভারতে নেই- সেটাই আশ্চর্য্য। তবে আরেকটু রিসার্চ করলে উনারা জানতে পারতেন, রাধা বৈষ্ণব ধর্মের সাধনমার্গ এবং বৈষ্ণব ধর্মটাই ১০০% বৈদিক না! সুতরাং বৈদিক সমগ্রে রাধাকাহিনী থাকার কথা না!
যারা বৈষ্ণব তারা ভালোই জানেন, রাধা রূপক। সব ভক্তই রাধারূপে কৃষ্ণকে ভালবাসে-কারন এ ভক্তিমার্গ। আর এপ্রেম পরকিয়া। পরকিয়া প্রেমে যেমন সমাজ সংসারকে তুচ্ছ করে, প্রেমরসে ডুবতে হয়-রাধাভাব মানেই সেই গভীররস -ভক্ত যেন সমাজ সংসারের বাঁধন ভুলে কৃষ্ণপ্রেমে ডুবে যায়! আর বৈষ্ণব দর্শনে কৃষ্ণ হচ্ছে সুপার কনসাসনেস বা বিশ্বচৈতন্য।
বৈষ্ণব ধর্মের উৎপত্তি নিয়ে হাজার হাজার গবেষনাপত্র আছে। এর উৎপত্তি ইসলাম আসার অনেক আগে। দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম শতাব্দি। মূলত দাক্ষিনাত্যে। আর্য্য অনার্য্য ধর্মের সব থেকে বড় সিন্থেসিস বৈষ্ণব ভক্তিবাদ।
গোটা বিশ্বের হিন্দুদের ৬০% বৈষ্ণব। বাংলায় সেটা ৯০% হবে। দাক্ষিনাত্যেও তাই। আর বিদেশী হিন্দুদের মধ্যে প্রায় ৯৯% ইস্কনের বৈষ্ণব-বা গৌড়ীয় বৈষ্ণব।
বৈষ্ণব ধর্ম আসলে উত্তরের জাতপাত সম্বলিত ব্রাহ্মন্য ধর্মের বিরুদ্ধে দক্ষিন এবং পূর্বভারতের প্রতিবাদি আন্দোলন-যেখানে জাতপাত নেই। সংস্কৃত মন্ত্রর বদলে হৃদয়ের ভালোবাসার মন্ত্রে কৃষ্ণ পূজিত হন। শ্রী চৈতন্য গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রতিষ্ঠা না করলে, আজকে সব বাঙালীই মুসলমান হত।
সুতরাং অবাক হওয়ার কিছু নেই। বিজেপির লোকজন এখন বৈষ্ণব ধর্মের পেছনে লেগেছে। এটা হওয়ারই ছিল। ব্রাহ্মন্য ধর্মের প্রতিনিধিরা একদিন না একদিন বৈষ্ণবদের পেছনে লাগতই। এটা কেন এত দেরীতে হল, সেটাই ভাবছি।
বিজেপির হিন্দুত্ববাদি লোকজন হিন্দু দর্শন , প্রাচীন ভারতীয় দর্শন কি বোঝে আমি জানি না। তাদের এবং ভারতের লোকেদের দুটো জিনিস জানা উচিত।
১) ভারতে ইসলাম এবং খৃষ্ঠান রাজশক্তি ৮০০ বছর থাকা সত্ত্বেও, হিন্দু ধর্ম টিকে গেছে। আফ্রিকা বা ইন্দোনেশিয়া, মালেশিয়াতে কিন্ত স্থানীয় ধর্মের লোকেরা টেকে নি। তারা মুসলমান বা খৃষ্টান হয়ে গেছে। এই হিন্দু ধর্ম ভারতে টিকে যাওয়ার মূল কারন বৈষ্ণব ধর্ম। তার ভক্তিরস, তার অহিংসা এবং মানবতার তীব্রতাই হিন্দুধর্মকে টিকিছে বিদেশী রাজশক্তির বিরুদ্ধে। তারজন্য কোন হিন্দুত্ববাদি রাজশক্তি লাগে নি। আজ ইস্কন গোটা বিশ্বে জনপ্রিয়। তারজন্য কোন মোদি-আমিত শায়ের পেশী শক্তির দরকার লাগে নি।
২) ধর্মকে রাজনীতির সাথে জড়ালে, সেই ধর্মের কি হাল হয়, তা মুসলমানদের দিকে তাকালে বোঝা যায়।
ইসলামে বিশ্বাস করে লোকে বিন লাদেন ও হয়, আবার দাতা আগাখান ও হয়।
ইসলামের ইতিহাস পড়লে বোঝা যায়, একদা সব থেকে প্রগতিশীল ধর্মটি কিভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতালোভীদের হাতে নষ্ট হয়েছে-কারন তারা ইসলামের জনপ্রিয়তা বেচে রাজনৈতিক ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছেন।
হিন্দুত্ববাদি রাজনৈতিক শক্তিও ঠিক এই কাজটিই করছে।
জীবনে কঠিন মুহুর্তগুলোর মোকাবিলায় আমি নিজেই উপনিষদের স্বরণ নিই। আবার পাশ্চাত্য দর্শনের আলোতেই হিন্দু এবং বৌদ্ধ দর্শনকে বুঝেছি। এ একান্তই ব্যক্তিগত- একান্তই নিজের রিয়ালাইজেশন। এগুলিকে রাজনীতিতে ঢোকালে, তা পচতে বাধ্য।

Friday, September 9, 2022

রাণীকাহিনী

 রাণীকাহিনী

-বিপ্লব পাল, ৯ই সেপ্টেম্বর, ২০২২

(১)

বৃটেনের রানীকাহিনীর সব থেকে আকর্ষক দিক-অন্যান্য দেশে রাজা, বৃটেনে রাণী কেন? আরো খোলসা করে বললে, একটা দেশের রাজকন্যা-তার বাবার রাজত্ব পাচ্ছেন- এটা বৃটেনেই দেখা যায়। ভারতের ইতিহাসে মাত্র চার বছর রিজিয়া সুলতানা শাসক ছিলেন। মহাভারতে শিখন্ডী সব থেকে ভাল এবং অভিজ্ঞ সেনানায়ক হওয়া সত্ত্বেও তিনি দ্রুপদ রাজ্যের দাবিদার ছিলেন না। বা তাকে তখন পান্ডব পক্ষের সেনাপতি নির্বাচন করা হয়, কৌরবরা মেনে নেয় নি।

পৃথিবীর সব দেশেই রাজকন্যাদের ভবিষ্যত বাপের রাজত্ব ছেরে, অন্য রাজ্যের রাণী হওয়া। সে রাণী কিন্ত শাসক নন। বৃটেনে "রাণী" অফিশিয়াল শাসক। তার পিতা বা মাতা যদি বৃটেনের কিং বা কুইন হন, তবেই তিনি, কুইন পদের দাবিদার। রাজপরিবারে বিয়ে করে কুইন হওয়া যায় না। রাজা যদি বৃটেনের শাসক হন, যেমন এখন হলেন চার্লস (৩), তার স্ত্রী ক্যামিলা কিন্ত কুইন নন। কুইন কনসর্ট।

কুইন এলিজাবেথ ও কিন্ত বৃটিশ রাজপরিবারের বিবাহিত স্ত্রী না। তিনি ছিলেন রাজা জর্জ-৬ এর কন্যা। জর্জ-৬ এর তিন কন্যা। তার মধ্যে এলিজাবেথ-২ বড়বোন। তাই বৃটেনের সিংহাসন গেছে তার কাছে। তার স্বামী ফিলিপ বরং রাজপরিবারে বিয়ে করেছেন। তাই কুইনের স্বামী-কিং নন। ফিলিপকে উপাধি দেওয়া হয়েছিল ডিউক অব এডিনবরা। শুধু তাই না। পাবলিক সমক্ষে ফিলিপকে মাথা নত করতে হত কুইন এলিজাবেথের সামনে। চলতে হত তার পেছনে পেছনে। অবশ্যই রাজ সিংহাসনে এলিজাবেথ বসার পর। ফিলিপ এসব মেনে নিতে পারেন নি। মনের দুঃখে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে এক বছর বৈরাগী হয়ে পৃথিবী ঘুরেছেন। আবার ফিরে এসেছেন তার ভালোবাসার নারীর কাছে। যাইহোক ঠিক একই কারনে ডায়না কোন দিনই বৃটেনের রানী পদের দাবীদার ছিলেন না। তিনি হতেন কুইন কন্সর্স্ট । যিনি কিন্ত শাসক নন।

এতটা কিচ্ছার দরকার ছিল না। আমার লেখাটা ছিল রানীর শাসন নিয়ে। পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র বৃটেন আর রাশিয়ার রোমানভ বংশের জারের ফ্যামিলিতেই রানীর শাসন ছিল।

আর কোথাও পুরুষতন্ত্রের জন্য, রাজকন্যা বা রানীরা শাসক হতে পারতেন না। হ্যা ঝাঁসির রানী লক্ষীবাই বা চীনের কুইন মাদার দোগের কি- এরাও শাসক ছিলেন। কিন্ত স্বীকৃত শাসক না। নিজের নাবালক পুত্রকে নামেমাত্র রাজা করেই এরা পর্দার পেছনে শাসন করেছেন। কারন পুরুষতন্ত্র নারী শাসককে মেনে নেয় নি। প্রায় কোন দেশেই না। বাংলার ইতিহাসই দেখুন। কোন নারী শাসক নেই। শেখ হাসিনা না মমতা ব্যানার্জি এরা আধুনিক গণতন্ত্রের ফসল। কিন্ত রাজতন্ত্রে রাজকুমারী রাজা হচ্ছেন- এটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কোথাও ছিল না। ব্যতিক্রম শুধু বৃটেন এবং রাশিয়া-বা আরো বিস্তারিত বললে পূর্বের শ্লাভ রাজ্যগুলির মধ্যে।

কিন্ত কেন? শুধু তাই না। আমার ইংল্যান্ডের ইতিহাস পড়ে এটাই মনে হয়েছে- বৃটেন যে গোটা পৃথিবী শাসন করেছে-এর মূল কারন বৃটেনের মাতৃতান্ত্রিক সমাজ। যেখানে মেয়েরা শাসক হতে পারে। যার জন্য ১০০,০০০ বৃটিশ, ৩০ কোটি ভারতীয়কে শাসন করেছে। কেন? এটা আমার নিজস্ব মতামত। আমি পরে ব্যখ্যা করছি।

(২)
বৃটেনের ইতিহাসে রানীর শাসন বহুপুরাতন। যেই যবে থেকে রোমান ঐতিহাসিকরা ইংল্যান্ডের ইতিহাস লিখছেন। প্রথম শতাব্দিতে বৃটেন ছিল রোমের অধীন। ইংল্যান্ড বিভক্ত ছিল অসংখ্য করদ রাজ্যে। তারা প্রায় রোমের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করত। এমন এক করদ রাজ্যের রাজা ছিলেন কসুতোগাস। আসিনি উপজাতিদের সর্দার। তার স্ত্রী বোদিকা। তার দুই কন্যা। পুত্র ছিল না। রাজা কসুতোগাস রোমের সাথেই ছিলেন। তিনি উইল করে যান তার মৃত্যুতে তার বড় কন্যা হবে, সেই রাজ্যের শাসক। রোমের লোকাল কনসাল তা মানে নি। উলটে তার দুই কন্যাকে ধর্ষন করা হয়। রানী বোদিকাকে চাবুক মারা হয়। বোদিকা আত্মসমর্পন করেন নি। এই ঘটনায় বৃটেনের সব রাজ্যের শাসকরাই বিদ্রোহী হয়ে ওঠে রোমের বিরুদ্ধে। তারা বোদিকার নেতৃত্বে প্রথম বারের মতন ঐক্যবদ্ধ বিদ্রোহী সেনাবাহিনী গঠন করে। সেটিই ছিল ইতিহাসের প্রথম ইংলিশ সেনাবাহিনী। বোদিকা রোমের সাথে যুদ্ধে পরাস্ত হোন ('৬১ খৃষ্টাব্দ) ।

কিন্ত এই বিদ্রোহের ঘটনা সুদূরপ্রসারী। ইংল্যান্ডের জনমানসে, রোমান পিতৃতান্ত্রিক শাসকদের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডের বিদ্রোহী জনগনের কাছে "মাতৃতান্ত্রিক শাসন এবং রাজকুমারীদের উত্তরাধারিকার" একটা বড় ইস্যু ছিল। ফলে ইংল্যান্ড যখন রোমান সাম্রাজ্য থেকে মুক্তিপেল- ইংল্যান্ডের আদিবাসী আইনে রাজকুমারীদের শাসক হওয়া কিন্ত ট্রাডিশন হয়ে গেছে। সেটা বোদিকার ওই বিদ্রোহকে স্বরণ করেই। এবং তারপর ও ইংল্যান্ডে ভাইকিং দের রেইড চলতেই থাকবে। এবং ভাইকিং রাজারাও রাজকুমারীর উত্তরাধিকার মেনে নেয়। যদিও ভাইকিংদের মধ্যে এই চল ছিল না।

কিন্ত প্রশ্ন হচ্ছে সেক্ষেত্রে ঝাঁসির রাণী লক্ষীবাইএর ক্ষেত্রে বৃটিশরা উলটো পথে গেল কেন? এত সেই বৃটেনের বিরুদ্ধে রোম যা করেছিল, তারই ফ্ল্যাশব্যাক। কেননা ঝাঁসির রাজা আমৃত্য বৃটিশ অনুগতই ছিলেন। সেক্ষেত্রে ঝাঁসির রানীর শাসন কোম্পানীর লোকের মানে নি কেন? সোজা উত্তর হচ্ছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী সেই রাজ্য বেচে আরো বেশী লাভের আশায় ছিল। যাইহোক ১৮৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর এসব দুরাচারের কারনেই রাণী ভিক্টোরিয়া কোম্পানীর হাতে আর ভারতের শাসনভার রাখেন নি। নিজের হাতে নেন।

এবং একটা হার্ড ট্রুথ হচ্ছে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসনে ভারতের জিডিপি ছিল নিম্নগামী। যবে থেকে ভারতের রানীর শাসন শুরু হয়, তবে থেকে ভারতের লোকেরা অনেক বেশী আইন সুরক্ষা পেয়েছে এবং জিডিপি গ্রোথ ও এই সময় আবার পজিটিভ হয়। ভারতের বৃটিশ কলোনিয়াল ইতিহাসের দুটো অধ্যায়। একটা রানীর শাসনের আগে। কোম্পানীর শাসন। যে সময় লুঠ হয়েছে অবাধে। ভারতের জিডিপি নেগেটিভে ছিল। অন্যটা রাণীর শাসন। যেখানে জিডিপি গ্রোথ ছিল। আইনি সুরক্ষা ছিল অনেক বেশী। ডেটা থেকে খুব পরিস্কার আলাদা করা যায় এই দুই অধ্যায়। মনে রাখবেন ওই সুরক্ষা থাকার কারনেই, রানীর শাসন শুরু হওয়ার পরেই একমাত্র টাটা বা বিড়লারা শিল্পপতি হিসাবে উঠতে থাকেন। যদিও অর্থের সোর্স ছিল চীনে আফিম বেচা।

আপনি বলতেই পারেন তাতে কি? ভারতীয়দের কি অধিকার ছিল রানীর শাসনের বিরুদ্ধে কিছু বলার? কিন্ত সেই প্রশ্ন ত আজও উঠবে। বর্তমানেও দিল্লী বা কোলকাতার শাসকদের সমালোচনা করা বিপজ্জনকই বটে!

তবে কলোনিয়াল শাসন ভাল না খারাপ এটা এই প্রবন্ধের আলোচ্য না। আমার একটা উত্তর দেওয়া বাকি আছে। কেন বৃটেনে এই রানীর শাসনের ঐতিহ্য, এই জাতটিকে মাস্টাররেস করে তোলে।

বৃটেনে রাজকুমারী এবং মেয়েদের প্রায় ছেলেদের সমানই শিক্ষা দেওয়া হত। তলোয়ার খেলা, ঘোড়ায় চড়া বা শিক্ষা। প্রায় সবক্ষেত্রেই মেয়েরা ছেলেদের সমকক্ষ ছিল। সেটা বৃটেনের সেই আদিবাসী সমাজ থেকেই চলে আসছে।

যে দেশে মায়েরা শিক্ষিত এবং যুদ্ধবিদ্যায় স্কিল্ড হবে, সেই দেশে বীর এবং নেতার সংখ্যাও বেশী হবে। যার জন্য ইংল্যান্ডে নেতার অভাব কখনো হয় নি ইতিহাসে ( তবে আজ হচ্ছে! )। বৃটিশরা যে বীরত্ব এবং নেতৃত্বে অনেক এগিয়েছিল-সেই নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। কারন ক্লাইভ যখন ৩০০০ সৈন্য নিয়ে সিরাজকে আক্রমন করেন-তখনো তিনি জানেন না মীরজাফর কোন দলে। আদৌ গদ্দারি করবে কি না। ফলে পলাশী যুদ্ধের দুপুর বেলা থেকে, তার সৈন্যরা মীরজাফরের সৈন্যদলকেও আক্রমন করে ছত্রভঙ্গ করে। মীরজাফর গদ্দারি করবেই এই ভরসাই ক্লাইভ আক্রমন করেন নি। করেছিলেন নিজেদের উন্নত কামান এবং যুদ্ধবিদ্যার জোরেই। ক্লাইভের সমকক্ষ স্ট্রাটেজিস্ট এবং সেনাপতি-সেই সময় ভারতে কেউ ছিল না। পলাশীর যুদ্ধের আগে দাক্ষিনাত্যে ক্লাইভ আরো দুটো যুদ্ধ জিতেছেন। যেখানে তার সেনা বাহিনী ছিল নবাবাদের থেকে অনেক ছোট। এবার প্রশ্ন করুন লর্ড ক্লাইভের মা কে ছিলেন?

তার মায়ের নাম রেবেকা। যদিও ক্লাইভ ম্যাঞ্চেস্টারে তার মাসি এবং মেসোমশাইএর কাছে বড় হয়েছিলেন। তিনি তার মাসীর কাছ থেকেই প্রাথমিক যুদ্ধবিদ্যার পাঠ নেন। এবং সমস্ত স্কুল জীবনে মারপিট করতে অভ্যস্থ ছিলেন। যাকে বলে এডিটেক্ট টু ওয়ার । এটি এসেছিল, তার মাসীর কাছ থেকেই।

আমি জানি ভারতে বৃটিশ উপনিবেশের ইতিহাস যেভাবে পড়ানো হয়, তাতে ভারতীয়রা লর্ড ক্লাইভ ইত্যাদি চরিত্রগুলিকে ঘৃনা করতে শেখে। তার নিশ্চয় সঙ্গত কারন আছে। কিন্ত কেউ একবার ও ইতিহাসে খোঁজ নেয়-কি করে ১০০,০০০ বৃটিশ ৩০ কোটি ভারতীয়কে দাবিয়ে রেখেছিল? কি করে ক্লাইভ প্রায় সব যুদ্ধে অনেক কম সেনানী নিয়ে নবাবদের বিরাট বিরাট বাহিনীকে হারিয়েছেন?

ক্লাইভ এবং তার সমসাময়িক বৃটিশ জেনারেলদের যুদ্ধকুশলতা বুঝতে ইতিহাসের অনেক গভীরে যেতে হবে। কিন্ত মনে রাখা দরকার এইসব যুদ্ধ বিশারদ ক্লাইভদের জন্যেই গোটা বিশ্বে বৃটিশ সাম্রাজ্য ছড়িয়ে যায় । কারন দেশীয় রাজারা বা নবাররা যুদ্ধে বা রাজনীতিতে ক্লাইভদের সমকক্ষ ছিলেন না। কিন্ত কেন ?

কারন ক্লাইভ সহ বৃটিশ জেনারেলরা আসতেন বৃটেনের এলিট ফিউডাল পরিবারগুলি থেকে। যেখানে তারা বীরত্বের শিক্ষা, যুদ্ধের শিক্ষা মা বা মাসী পিশীদের কাছ থেকে পেতেন। মেকস এ লটস অব ডিফারেন্স।

ইতিহাসের গভীরে গেলে অনেক কিছুই শেখা যায়। আর শুধু স্কুলের বই পড়লে কিছু কিছু লোকের প্রতি একগাদা ঘৃনা তৈরী হবে-যা সম্পূর্ন সিস্টেম ম্যানুফাকচারড।