Saturday, November 3, 2018

সর্দার প্যাটেল স্টাচু অব ইউনিটি- এবং বাম বিরোধিতা

সর্দার প্যাটেলের ১৮৫ মি উঁচু স্ট্যাচু নিয়ে বাঙালীর অতিবাম ফেসবুক বিপ্লব অব্যহত। বক্তব্য ৩০০০ কোটি টাকা বাজে খরচ। কেন কৃষিকাজে বা শিক্ষাখাতে সে খরচ হবে না ইত্যাদি। যদিও বলে নেওয়া ভাল, শুধু এফ সি আই এর মাধ্যমেই কেন্দ্রীয় সরকার বছরে খাদ্যে ভর্তুকি দিয়ে থাকে বছরে ৭০,০০০ কোটি টাকার ওপর। বাকি ভর্তুকি ছেড়েই দিলাম।

যারা এই অতিবিপ্লব করছেন, তাদের কাছে এই প্রশ্ন রাখা নিশ্চয় সঙ্গত যে আপনারাই বা সিনেমা দেখেন কেন? মাল্টিপ্লেক্সে একটা সিনেমার টিকিটের টাকায় দশজন গরীবের খাওয়া সম্ভব। তাহলে সিনেমা না দেখে গরীবদের জন্য পংতি ভোজন করান?

আমি জানি এই ক্ষেত্রে উত্তর আসবে -কেনরে বাপু। আমি সিনেমাও দেখি, আবার সাধ্যমত গরীবদের সাহায্য ও করি।

তা সরকার কি আলাদা হবেরে পাগলা? সরকার ও প্রায় দুই লাখ কোটি টাকার ওপরে গরীবদের জন্য ভর্তুকি দেয়। আবার তাদের ও ত আদর্শ অনুযায়ী শখ আহ্লাদ আছে। তাই সামান্য কিছু স্ট্যাচু খাতে খরচ ও করে! ১৯32-১৯৩3 পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ানে চলেছে পৃথিবীর সব থেকে বড় দুর্ভিক্ষ। হলডোমার। যাতে ইউক্রেনে মারা যায় ৭০ লাখের বেশী লোক। সেই বছর কি সোভিয়েত ইউনিয়ানে লেনিনের স্ট্যাচু বসানোর ওপরে নিষেধাজ্ঞা ছিল ?

এবার প্রশ্ন উঠে্বে জাতির জনক মহত্মাগান্ধী বা ভারতের প্রথম প্রধান মন্ত্রী নেহেরুর স্ট্যাচু না কেন? সর্দার প্যাটেল কোন হনু?

মহত্মা গান্ধীর স্ট্যাচুর দরকার নেই। তিনি এবং গৌতম বুদ্ধ, সর্বকালের সেরা ভারতীয়। যাদের গোটা পৃথিবী চেনে।

আর কংগ্রেস ৪০ বছর ক্ষমতায় থেকে এত কিছু নেহেরুর নামে চালিয়েছে, ভারতের একটু ডিনেহেরুফিকেশন হলে খারাপ কিছু হবে না।

প্রশ্ন উঠবে তাহলে নেতাজি, বাবা সাহেব আম্বেদকর এদের স্ট্যাচু?
এখানে খেয়াল রাখতে হবে, স্ট্যাচুর অর্ধেক টাকা দিয়েছে গুজরাত সরকার। এটা গুজরাতের মানুষের টাকা। তারাত নিজেদের ভূমিপূত্রকেই সন্মান জানাবে।

কিন্ত সর্দার প্যাটেল গুজরাটের জন্য কি করেছিলেন?

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের দুজন ব্যক্তি আমার বিশেষ পছন্দের। বাবা সাহেব আম্বেদকর এবং সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল। বাবা সাহেবের লেখা পড়ে আমি মুগ্ধ হই তার রাজনৈতিক জ্ঞানের গভীরতায়। পরিস্কার ভাবেই বলা যাক, গান্ধী, নেহেরু, নেতাজি বা অন্য কোন ভারতীয় নেতা রাজনৈতিক দর্শনের প্রজ্ঞায় বাবা সাহেবের সমান ছিলেন না। কিন্ত তিনি মহারাষ্ট্রের ভূমিপুত্র।

দ্বিতীয় জন বল্লভ ভাই প্যাটেল। সর্দার প্যাটেল ছিলে্ন দক্ষ এক্সিকিউটিভ। তাকে যখনই যে কাজ দেওয়া হয়েছে দ্বায়িত্ব নিয়ে তাতে সফল হয়েছেন। সাংগঠনিক ক্ষমতায় তার ধারে কাছে কেউ ছিল না।

রাজনীতিতে তার প্রবেশ খেদা সত্যাগ্রহে (১৯১৮)। তিনি তখন বৃটেন ফেরত স্যুটেড বুটেড ব্যরিস্টার। আমেদাবাদে ভাল পসার।

খেদা গুজরাটের একটা জেলা। খরার কারনে চাষীরা ট্যাক্স দিতে পারছিল না। পুলিশ এবং ম্যাজিস্ট্রেট শুরু করে অত্যাচার। গান্ধীর নির্দেশে খেদার গ্রামে গ্রামে ঘুরে সত্যাগ্রহ আন্দোলনে কৃষকদের সংগঠিত করেন সর্দার। ছমাসে প্রায় হাজার খানেক গ্রাম ঘুরেছেন সর্দার প্যাটেল। পুলিশ গ্রামে গ্রামে হানা দিয়ে কৃষকদের ছাগল গরু সব কিছু বাজেয়াপ্ত করেছে। এরকম কোনঠাসা অবস্থায় ও সম্পূর্ন অহিংস ভাবে আন্দোলন করতে থাকে কৃষকরা। তারা কোন মতেই বৃটিশকে ট্যাক্স দেবে না। এক বছরের মধ্যে কর মকুব করতে বাধ্য হয় বৃটিশ রাজ। এটিই ছিল ভারতের তৃতীয় সত্যাগ্রহ, যা সব থেকে বেশী সফল হয়। অন্যদিকে সর্দার প্রমান করলেন-তিনি কাজের লোক। বাজে বকতেন কম, কাজ করেন বেশী। খেদা সত্যাগ্রহের ফলে তিনিই হলেন গুজরাতের সর্বজনগ্রাহ্য কৃষক নেতা।

সর্দার প্যাটেলকে ভাল লাগার আমার অন্য আরেকটা কারন আছে। নেতাজি, ফিদেল কাস্ট্রো, লেনিন, স্টালিন এরা একদম ছাত্র অবস্থা থেকে আগুন খেকো বিপ্লবী। যাকে বলে, হার্ড ওয়ারড বিপ্লবী।

সর্দার কিন্ত আমাদের মতন সাধারন মানুষ ছিলেন প্রথম জীবনে। পাতিদার কাস্টে ( যা এখন ওবিসিভুক্ত) জন্ম, অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করে, চাকরির টাকা জমিয়ে ইংল্যান্ডে গিয়ে আইন পাশ করেন ( বই কেনার টাকা ছিল না, এর ওর কাছে ধার করে পড়তেন)। নেহেরু, নেতাজি বা গান্ধীর মতন বাপের টাকায় উনি বৃটেন যান নি। ফিরে এসে আমেদাবাদে আইন ব্যবসায় ভাল পসার করছিলেন। ব্রীজ খেলতে খুব ভালবাসতেন। একদম সাধারন পরিশ্রমী, মেধাবী একজন মানুষ।

কিন্ত এই মানুষটাকেই আগাপাস্তালা পালটে দিলেন গান্ধী। গান্ধীর সাথে প্যাটেলের দেখা অক্টবর ১৯১৭ । এর আগে গান্ধীর রাজনীতি নিয়ে বন্ধু মহলে হাসি ঠাট্টা করতেন সর্দার। গান্ধীই তাকে দেখালেন খেদা জেলায় কৃষকদের দুর্দশা। সুটেড বুটেড ব্যরিস্টার লোকটা সব কিছু ছেড়ে খাদি ধরল। কৃষকদের সাথে ওঠা বসাই তাকে চিনিয়ে দিল আসল ভারত বর্ষ। তিনি হয়ে উঠলেন কংগ্রেসের নাম্বার ওয়ান ওর্গানাইজার, ফান্ড রেইজার। বাকী সবাই নেতা। কিন্ত কংগ্রেসের সংগঠন সর্দারকে ছাড়া ভাবা যায় না। লোকটা গোছানো, সিস্টেমেটিক এবং কার্যসিদ্ধির জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

আমি আগেই লিখেছি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতা আসে নি-এসেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারনে। কিন্ত তা সত্ত্বেও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন পৃথিবীর ইতিহাসের সব থেকে গৌরবাজ্জ্বল অধ্যায়। কারন এই আন্দোলনই জন্ম দিয়েছে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের । শত্রুকে ভালোবেসে বিজয়ের শিক্ষা আর কোন দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনেই পাওয়া যাবে না। আর এই সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ক্ষেত্রে গান্ধী যদি হৌন বুদ্ধ, তাহলে সর্দার প্যাটেল ছিলেন আনন্দ।
ঠিক এই কারনেই ৫০০ টি দেশীয় রাজ্যের ভারত অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে প্যাটেলই ছিলেন যোগ্য কমান্ডার। খুব বেশী লিব্যারাল নেতাকে এই কাজ দিলে, ভারতের অনেক জমি হাতছাড়া হত। আবার খুব বেশী দক্ষিনপন্থী নেতার হাতে এই কাজ এলে, প্রচুর রক্তপাত অবধারিত ছিল। কিন্ত সর্দার প্যাটেলের সুদক্ষ নেতৃত্বে এর কোন এক্সট্রিমই হয় নি- খুব কম মিলিটারি ইন্টারভেনশনেই অধিকাংশ দেশীর রাজ্যের ভারতভুক্তি সম্ভব হয়েছে।

শুধু তাই না, গুজরাতে নারী শিক্ষা, মেয়েদের ভোটাধিকার, মুসলমান, দলিতদের জন্য স্কুলের দরজা খুলে দেওয়া, কৃষক সভা, শ্রমিক ইউনিয়ান -ইত্যাদি সব বিষয়ে তিনিই পথিকৃত। এমন একজন মহামানব গুজরাত পুত্রকে যদি গুজরাট বাসী তিন হাজার কোটি টাকার স্ট্যাচু তৈরী করে সন্মান জানায়, তাতে বাঙালীর গাত্রদাহ কেন? বাঙালীর ট্যাঁকে জোর থাকলে তারা ২০০ মিটার উচ্চতার নেতাজি বা বিদ্যাসাগরের স্ট্যাচু তৈরী করুক।

সাহিত্যের পথে গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন "অতএব, যদি এমন কথা কেহ বলিত যে, আজকাল বাংলাদেশে কবিরা যে সাহিত্যের সৃষ্টি করিতেছে তাহাতে বাস্তবতা নাই, তাহা জনসাধারণের উপযোগী নহে, তাহাতে লোকশিক্ষার কাজ .... কিন্তু, কালিদাস যদি কবি না হইয়া লোকহিতৈষী হইতেন তবে সেই পঞ্চম শতাব্দীর উজ্জয়িনীর কৃষাণদের জন্য হয়তো প্রাথমিক শিক্ষার উপযোগী কয়েকখানা বই লিখিতেন -- তাহা হইলে .."

কবিগুরুর কথা ধার করেই বলি, দারিদ্র দুর্দশাত পৃথিবীতে থাকবেই-তাই বলে কি ১০০০ কোটি টাকা বাজেটের অভতার বা বাহুবলির মতন সিনেমা তৈরী হবে না?

১৮৫ মিটার লম্বা স্টিল স্ট্যাচু ইঞ্জিনিয়ারং মার্ভেল ও বটে। একটা খবর বাজারে ঘুরছে, যে স্ট্যাচুটি মেইড ইন চাইনা। সেটাও ঠিক না। এর ডিজাইনার ভারতের লার্সন এন্ড টুব্রো। স্টিল ভারতেরই। শুধু ব্রোঞ্জ কাস্টিং চীনের ফাউন্ড্রি থেকে করিয়ে আনাতে হয়েছে, কারন অত বড় ফাউন্ড্রি ভারতে নেই। এটি ভারতের ইঞ্জিনিয়ারিং এর বিজ্ঞাপন ও বটে। ইঞ্জিনিয়ারং আউটসোর্সিং থেকে ভারতের ইনকাম ১৫০ বিলিয়ান ডলার বা 150 x7000 = 1050,000 কোটি টাকা। ৩০০০ কোটি টাকা, তার 0.3% মাত্র। ওই টুকু ভারতের প্রযুক্তির বিজ্ঞাপন খাতে খরচ বলেও ধরা যায়।

1 comment:

শুভ্র said...

আপনার লেখার আমি গুণমুগ্ধ ভক্ত,তাও এই লেখাটাতে আমার একটা জিজ্ঞাসা ছিল,ইতিহাস এর কথা আপাতত বাদ দিলাম,প্রাকটিক্যাল কি বেনিফিট পাচ্ছি সেটাই আমার জিজ্ঞাস্য,সে দিক থেকে দেখলে লাস্ট এর পয়েন্টটা খুবই স্ট্রং,কিন্তু ওই টাকা টার পুরোটাই কি ভারত সরকার এর কাছে যায়?তা না হলে 0.3% এর হিসেবটা কিন্তু অতিরঞ্জিত হয়ে যাবে।আর সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে থেকে,কোনো গভর্মেন্ট কি পার্টিকুলার কোনো কোম্পানির এর বিজ্ঞাপনদাতা হিসেবে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে?