ডস্টভয়েস্কির "নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড" -খুব সম্ভবত পৃথিবীর প্রথম অস্তিত্ববাদি উপন্যাস।
প্রসঙ্গত অস্তিত্ববাদি দর্শন দুলাইনে বোঝানোর চেষ্টা করি। অস্তিত্ববাদের মূল ভিত্তি- জীবনের পরম উদ্দেশ্য বলে কিছু হতে পারে না ( কারন মৃত্যু অবধারিত, যাইকিছু করনা কেন, এই শরীর, মন, কীর্তি-একদিন না একদিন শেষ হবেই। ) আবার জীবনের উদ্দেশ্য না থাকলে, বাঁচার ইচ্ছাও থাকে না! সুতরাং এই আমার এই অস্তিত্বটাই আসল! আমি কেন বাঁচছি, কিসের জন্য বাঁচছি, এই নিরন্তর জীবন সংগ্রাম-এসব কিছুই মায়া। সুতরাং যদি এটা আমরা জেনেই করি যে যা কিছু করছি, যেসব সাফল্যের জন্য এত লাফাচ্ছি-তার সব কিছুই মায়া, তাহলে, বেশ লিল্যাক্সড করেই জীবনকে উপভোগ করা যায়। সেক্ষেত্রে নৈতিকতার প্রশ্নে জীবনকে না বেঁধে ( এই যে এটা করা ঠিক, এটা বেঠিক-এসব ল্যাঠার মধ্যে না গিয়ে ), অনেকটা স্বাধীন ভাবেই জীবনের গুটিগুলো সাজানো সম্ভব।
ফরাসী দার্শনিক আলবার্ট কামুস- ডস্টভয়েস্কির প্রায় এক শতক বাদে অস্তিত্ববাদি দর্শনের আরেকটি ধারা শুরু করেন-যেটাকে এখন আমরা এবসার্ডিজিম বলে জানি। অর্থাৎ বেঁচে থাকার চেষ্টাটাই এবসার্ড-কারন সারা জীবন ধরে একটা মানুষ বেঁচে থাকার পরম উদ্দেশ্য খুঁজছে-কিন্ত পাচ্ছে না।
ধার্মিক লোকেদের কথা আলাদা। গোটা ধর্মটাতত্বই আসলে অস্তিত্ববাদের একটা শাখা। ধর্মগুরুরা মানুষের এই এবসার্ডিজমকে এক্সপ্লয়েট করে। ধর্মগুরু/ প্রফেটরা জানে প্রতিটা মানুষ জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজছে-কিন্ত পাবে না- কারন সেই এবসার্ডিজম ! এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তারা দাবী করে, ভগবান তাদের কানে ফিস ফিস করে জীবনের উদ্দেশ্য কি বলে গেছে! এতেব হে বোকা পাঁঠার দল, সব কিছু ত্যাগ করে আমার স্বরণে এস! মানুষও পিল পিল করে দৌঁড়ায়-কারন মানুষ মাত্রই সবাই এত জীবন সংগ্রামে ব্যস্ত, এবসার্ডিজম বোঝার মতন ক্ষমতা অধিকাংশ মানুষের নেই। ফলে তারা নিজের মধ্যের স্বাধীন সত্ত্বার বিকাশকে ধ্বংশ করে - ধর্মানুরাগী ধর্মভীরু মানুষ হিসাবে "এবসার্ডিজমের" ধারে কাছে যেতে ভয় পায়।
বৌদ্ধ বা জৈন ধর্মে ঈশ্বর নেই। জীবনের উদ্দেশ্য সেখানে পুনঃজন্মে।
তবে ইন্টারেস্টিং হলেও এটা ঠিক, উপনিষদে বা বৈদিক দর্শনে এবসার্ডিজম এসেছে "মায়া" র রূপে। বেঁচে থাকার জগত, এই আমরা যে বাস্তবতায় বাস করে আহার মৈথুনে ব্যস্ত -তা যেসবটাই মায়া! হিন্দু দর্শনে মায়ার বহু ইন্টারপ্রেটেশন বা স্কুল থাকলেও, আদি শঙ্করের ত্রৈত্রীয় উপনিষদ ভাষ্যে "এবসার্ডিজমের" প্রশ্নটি আলবার্ট কামুর বহু শতক আগে, শঙ্করই তুলে ছিলেন তার ভাষ্যে এই রূপে -" নিজেকে জানার বা জীবনের পরম উদ্দেশ্য ( ব্রহ্ম ) জানার চেষ্টা করাটা আবসার্ড"। এর পরেই অবশ্য কামুর সাথে শঙ্করের বা ভারতীয় ভাষ্যের বিচ্ছেদ। কারন অই কিছু নাই, বলে ছেড়ে দিলে সাধারনে খাবে না। তাই শঙ্করভাষ্যে এটাও ঢোকে নিজেকে বাস্তবতার, প্রতিদিনের জ্ঞান দিয়ে বোঝার চেষ্টা বৃথা , আবসার্ড কারন "আসল" জ্ঞান "মায়ার" কম্বলে ঢাকা! ভারতীয় দর্শন এখানেই "এনালাইটিক বা র্যাশানাল" ডোমেন ছেরে আধ্যাত্মিক ডোমেনে ঢুকেছে ! সেখানে পাশ্চাত্য অস্তিত্ববাদের ক্ষেত্রে ডস্টভয়েস্কি, কিয়ার্ডগার্ড, সাত্রে বা কামু-এরা সবাই " এনালাইটিক" ডোমেনেই থেকেছেন- ভাবের জগতে ডোবেন নি। ফলে অস্তিত্ববাদি পাশ্চাত্য দার্শনিকরা -যেমন নিৎসে বা সাত্রে বা কামু-সবাই এই অস্তিত্ববাদের সংকটকে কাজে লাগিয়ে মানুষের মন এবং মরালকে মুক্ত করার চেষ্টা করেছেন।
আমি আবার নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ডে ফিরে আসি। এই জন্যেই এত কথা লিখলাম, অনেকেই দর্শন চর্চা সময়ের অপচয় বলে মনে করেন। কারন সেই এবসার্ডিজম! কারন এত ভেবে কি হবে? দিনের শেষে হাতে রইবে সেই পেন্সিল- এবাসার্ডিজম!
ওয়েল-এর একটা বিশাল প্রাক্টিক্যাল দিক আছে। ওই নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ডে ডস্টভয়েস্কি এই অস্তিত্ববাদের সূত্র ধরেই মানব সম্প্রদায়কে বিরাট সাবধানবানী শুনিয়েছিলেন। উনার সময়টা ইউটোপিয়ান স্যোশালিস্টদের যুগ। উনি লিখছেন এই যে মানুষের জন্য "আদর্শ সমাজের ধারনা" -যেখানে মানুষটা, সিস্টেম, সমাজ, রাজনীতিবিদ, বিচার ব্যবস্থা-সব কিছু পারফেক্ট হতে হবে-এই ধরনের যেসব আদর্শবাদ আস্তে আস্তে তখন সবে রাশিয়াতে ঢুকতে শুরু করেছে- তার ফল হবে মারাত্মক। কারন ডস্টভয়েস্কি লিখেছেন, ধরুন মানুষ একটা অমন নিঁখুত সমাজ পেল। কিন্ত সে থাকবে কি করে? কারন সে ত সব সময় নিজেকে প্রকাশ করতে চাইছে। যদি এমন সমাজে তাকে ফেল , যেখানে এ টু জেড, তাকে গঁতে বেঁধে কথা বলতে হবে, প্রতিটা কাজ আইন মেনে করতে হবে-তার মানব সত্ত্বাই ত বিকশিত হবে না! ফলে সে বিদ্রোহ করবেই!
উনি এটা লিখেছিলেন উনবিংশ শতকে (১৮৬৪)। বিংশ শতকের শুরু থেকেই নিঁখুত "ইউটোপিয়ান পলিটিক্যাল সিস্টেম গড়ার লক্ষ্যে" কমিউনিজিম, ফ্যাসিজম, নাজিজম ইত্যাদির জন্ম হল। এগুলো সবই স্যোশালিস্ট আন্দোলন। বামপন্থীরা নিজেদের ইতিহাস থেকে হিটলার বা মুসোলিনীকে বাদ দিতে চান-কিন্ত চাইলেই ত হবে না। হিটলার এবং মুসোলিনী দুজনেই স্যোশালিস্ট আন্দোলনের ফসল। হিটলারের পার্টিটার নাম ন্যাশালিস্ট স্যোশালিস্ট ওয়ার্কারস পার্টি। শুধু তাই না মেইন ক্যাম্পে বেশ অসংখ্য স্থলে হিটলার আমেরিকান ক্যাপিটালিজমের সমালোচনা করেছেন-পুঁজির সমালোচনা করেছেন-এবং কিভাবে পুঁজিবাদি সমাজের জন্য শ্রমিক শ্রেনী বেকারত্বের জ্বালায় ভোগে, তার সম্পূর্ন বর্ননা দিয়েছেন। মুসোলিনিও তাই। ১৯২১ সালে মুসোলিনী ছিলেন ইটালিয়ান স্যোশালিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য -লেনিনের বলশেভিক পার্টির, লেনিনের প্রশংসা করে ভাষন দিতেন ( পরে অবশ্য মার্ক্স ছেড়ে উনি নিৎসের দর্শনের ওপর ভিত্তি করে বাম আন্দোলন গড়ে তোলেন)। এগুলো আমাদের বামপন্থী ভাইরা লজ্জায় চেপে যায়। ইতিহাস সামান্য পড়লেই বুঝবেন হিটলার এবং মুসোলিনী ছিলেন হার্ডকোর বামপন্থী । হ্যা তারা কমিনিউস্টদের হত্যা করেছেন। কিন্ত সেটা ওই বামপন্থী লাইন কার ঠিক, সেই নিয়ে ঝামেলা। যেমন পশ্চিম বঙ্গে মাও বনাম সিপিএম। তাতে তারা দক্ষিন পন্থী হয়ে যান না। ক্ষমতায় আসার পরে হিটলার, মুসোলিনী যেমন দক্ষিনপন্থী হয়ে ওঠেন-ঠিক তেমনই লেনিন, স্টালিনও ক্ষমতায় আসার পরে শ্রমিক এবং প্রজাবিরোধি দক্ষিনপন্থী। কোন পার্থক্য নেই ।
বিংশ শতাব্দিতে নাজি, ফ্যাসিবাদ এবং কমিউনিজমের স্টিমরোলারে কত মানুষকে খুন করা হয়েছে, কত গণহত্যা হয়েছে সেই প্রসঙ্গ বাদ দিচ্ছি। যেটা আমার কাছে খুব ভয়ংকর লাগে, এই একবিংশ শতাব্দিতেও আমার আশে পাশের লোকেরাও সেই আদর্শ নিঁখুত হিন্দু রাষ্ট্র, নইলে ইসলামিক রাষ্ট্র, নইলে কমিনিউস্ট রাষ্ট্রের প্রশ্নে বিভোর। এদের কে পড়াবে দস্তভয়েস্কির নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড? কে বোঝাবে মানুষ চাইছে স্বাধীনতা-তাকে ওই ভাবে আদর্শ কোন সিস্টেমে বাঁধা সম্ভব না!
আরেকটা উদাহরন দিচ্ছি। আজকাল অধিকাংশ বাবা-মা " তার ছেলে মেয়েদের" জন্য আদর্শ নিঁখুত জীবন ভেবে রেখেছেন - ছেলে কোন স্কুলে পড়বে, কত মার্কস পেতে হবে, ইঞ্জিনিয়ারিং না ডাক্তারি পড়বে- কত মাইনে পাবে, কি টাইপের চাকরি পাবে, কি টাইপের বৌমা ঘরে আনবে-একদম জন্ম থেকেই ভেবে রেখেছেন বাবা মায়েরা! অনেকটা কমিনিউস্টরা যেমন দেশের গরীবদের জন্য, হিন্দুত্ববাদিরা হিন্দুদের জন্য, ইসলামিস্টরা গোটা পৃথিবীর জন্য-ইত্যাদি ইত্যাদি । আজকাল দেখি প্রতিটা বাবা মা, তাদের সন্তানের প্রতিটা মিনিট (ঘণ্টা না) নিয়ন্ত্রন করছেন। প্রতিটা গৃহই আজকের শিশুদের জন্য গুলাগ ( রাশিয়ান লেবার ক্যাম্প যেখানে সকাল থেকে সন্ধ্যা রুটিন মেনে কাজ করতে হত )। সে ত নিজের সত্ত্বাকে বোঝার সময়ই পাচ্ছে না! পাবে কি করে? মানুষ নিজের সত্ত্বাকে খুঁজে পায়, যখন যে কবিতা লেখে, নইলে গান বাঁধে বা নাটক করে বা ছবি আঁকে। আটটা টিউশুনির পরে এসব করার সময় বাচ্চাদের কোথায়? ছবি টবি আঁকলে সেই কম্পিটিশনের জন্য-নিজের জন্য কখন আঁকে? বাড়ির আইন ভাঙাও বাচ্চাদের দরকার মাঝে সাঝে, নইলে সে চিরকাল অন্যের দাস হয়েই কাটাবে। নিজের অস্তিত্বই বিকশিত হবে না। এই জন্যেই কৃষ্ণ বাল্যকালে নটঘট নন্দদুলাল। সেই আদিকালেও লোকজন বুঝত বাল্যে শিশুদের বেশী শাসন করতে হয় না-দৌরাত্বেই তাদের বিকাশ ঘটে দ্রুত। আর এখন ত সম্পূর্ন উল্টোরথ।
আর এর ফল? এই সব ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে মুক্তচিন্তার মানুষ হয়ে উঠবে না। তারাও আল্টিমেটলি সেই হিন্দুত্ববাদি, না হলে ইসলামিজম বা কমিনিজম, মহিলা হলে ফেমিনিজম - আর রাজনীতি ভাল না লাগলে রবিশঙ্কর বা রামকৃষ্ণমিশন বা ইস্কন -কোন না কোন বন্ধনে বেঁধে নিজের সত্তাকে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর করে আরো মিহিয়ে যাচ্ছে!
করুন অবস্থা হে করুণাময়!