আদর্শকে বাস্তবায়িত করার উপায় জনসংগঠন। ইসলাম, হিন্দুত্ববাদি এবং কমিনিউস্ট-এরা সবাই জন সংগঠন গড়তে ওস্তাদ। এটাই এদের শক্তির ভিত্তি। সুতরাং তার পালটা জবাব দিতে গেলে আমাদের ও জনসংগঠন গড়তেই হবে। এবং যেহেতু আমদের গাইডিং প্রিন্সিপল গণতন্ত্র এবং বিজ্ঞান-সেহেতু প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে আরো উন্নত গণসংগঠন গড়তে হবে। শুধু ব্লগ লিখে এর ওর পিঠ চাপড়ালে হবে না। আজকাল ফেসবুকের যুগে কোন একটা ইস্যুতে লোকজন জড় করাও সোজা-এদিকে সেদিকে মিডিয়াতে দু চারটে প্রতিবাদ পত্র ও পাঠানো যায়-কিন্ত এসবই বিন্দুতে সিন্ধু যদ্দিন না আমরা গ্রামে গ্রামে শহরে শহরে সংগঠন না গড়তে পারব।
সুতরাং কি উপায়ে সংগঠন গড়া যায় তাই নিয়ে ভাবতে হবে।
সাধারণত দুই উপায়ে সংগঠন তৈরী করা যায়। একটি হচ্ছে নিজেদের গ্রুপে করে এনজিও বা ফাউন্ডেশন টাইপের। নন প্রফিট কর্পরেশন । এখানে একটি প্রাইভেট বোর্ড থাকে। মুক্তমনা ও অনেকটা এই টাইপের সংগঠন। আমি অবশ্য সম্পূর্ন ব্যাবসায়িক ভিত্তিতেই সিটিজেন সাংবাদিকতার মিডিয়া সংগঠন চালিয়ে থাকি। এই ধরনের সংগঠন থেকে প্রকাশনা, অর্থ সংগ্রহ বা সেবা মূলক কাজ ভাল হয়। অন্য আরেক ধরনের সংগঠন হল গণ সংগঠন। যেখানে তৃণমূল থেকে গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে বিরাট সংগঠন গড়ে তোলা যায়। সেখানে প্রাইভেট বোর্ডের বদলে নির্বাচিত সংগঠকরা থাকবেন। নির্বাচিত সংবিধান থাকবে দলের। সংবিধানই হবে সেই দলের মেরুদন্ড। রাজনৈতিক শক্তির উৎস হতে গেলে এই ধরনের সংগঠন গড়ার বিকল্প নেই।
নিজের অভিজ্ঞতায় যেটুকু বামপন্থী সংগঠন দেখেছি-তার থেকে এটুকু বুঝেছি সংগঠনের সংবিধান এবং নেতাদের ভিত্তি গণতান্ত্রিক না হলে, আজকে না হলে কালকে আরো দলে ভাংবেই। সুতরাং বৈধ একটি সংগঠন করে সবাইকে নিয়ে চলতে গেলে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতি গুলিকে অনুসরন করতে হবে।
আমার ব্যাক্তিগত মতে মুক্তমনা বা আরো অনেক বিজ্ঞান সংগঠন নানান গঠন মূলক কাজে এগিয়ে আসতেই পারে। কিন্ত জন সংগঠন গড়ার প্রথম ধাপ হিসাবে, একটি শক্তিশালী সংবিধান গড়া দরকার, যা হবে এর মেরুদন্ড এবং তা স্বল্প পরিসরে হলেও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই পাশ করাতে হবে মেম্বারদের মধ্যে। সেই সংবিধানেই নির্দেশ থাকবে, এর গঠন কাঠামো কি হবে-কি কি অপরিবর্তনীয় ধারা থাকবে। কি কি পরিবর্তনীয় ধারা থাকবে। কিভাবে নির্বাচন হবে। মেম্বারশিপ ফিস। কাজের কাঠামো ইত্যাদি। এটি পাশ হওয়ার পরে, আমাদের সাংগঠনিক নির্বাচন করতে হবে।
সুতরাং আমাদের প্রাথমিক কাজগুলি হল [ যা আমরা এই ব্লগের মাধ্যমেই করতে পারি]
[১] একটি নাম ঠিক করা
[২] সংবিধানের খসরা বানানো
[৩] একটি সংবিধান কমিটি বানানো যারা এই নতুন গণ সংবিধানের সংবিধানটি তৈরী করবে।
আসুন এই ব্লগে আমরা আলোচনা করতে পারি, সংবিধানের ভিত্তি কি হবে।
- অপরিবর্তনীয় ধারা কি কি হবে ? অপরিবর্তনীয় ধারা হচ্ছে মূল ভিত্তি। এখানে মূল ভিত্তি হওয়া উচিত [ আমি অবশ্য সবার ইনপুট চাইছি ] বিজ্ঞান চেতনা, বিজ্ঞান প্রয়োগ এবং পরিবেশ রক্ষক। বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত জার্নালে যে জ্ঞান আহরিত হয়েছে প্রকৃতি এবং সমাজবিজ্ঞানে তাই একমাত্র গ্রহনযোগ্য জ্ঞান হিসাবে বিবেচিত হবে। রাজনীতি, ধর্ম, রাষ্ট্র ইত্যাদি ক্ষেত্রে দৃষ্টিভংগী হবে, বিজ্ঞান মুখী। অর্থাৎ নৃতত্ত্ব বিজ্ঞান এবং সমাজবিজ্ঞানে ধর্ম, রাজনীতি এবং অর্থনীতি নিয়ে যে ধারনা আমরা গবেষনার মাধ্যমে জানতে পারছি-সেই রামধেনু রঙেই রাঙা হোক এর চেতনা যার ভিত্তি হবে গবেষনা। এছারাও আমাদের দৈন্যন্দিন সমস্যাগুলি সমাধানের জন্যে স্থানীয় এবং রাষ্ট্রীয় স্তরে বিজ্ঞান প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যাবহারের মাধ্যমে বিদ্যুত , দূষন , খাদ্য , জ্বালানী এবং দুর্নীতি সমস্যার সমাধানের পথে কাজ করতে হবে। এই ব্যাপারে আমাদের নানান ফিল্ডে এক্সপার্ট প্যানেল থাকা উচিত-যারা নানান বিষয় নিয়ে গবেষনা করবে, যার মূল উদ্দেশ্য হবে আমাদের উপমহাদেশে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি আরো বেশী কি করে ব্যাবহার করা যায় রাষ্ট্রীয় এবং বেসরকারী উদ্যোগে। এছারাও বিজ্ঞান প্রসারের এবং ধর্মের ক্ষতিকর দিকগুলি নিয়ে আলোচনার জন্যে আমাদের নিজস্ব প্রিন্ট, কেবল, এফ এম এবং ইন্টারনেট মিডিয়া থাকতেই হবে। এগুলো অপরিবর্তনীয় ধারাতে থাকা উচিত।
- পরিবর্তনীয় ধারা কি কি হবে? সাংগঠনিক কাঠামো, আশু উদ্দেশ্য-রাজনৈতিক স্ট্রাটেজি, ভোটিং কাঠামো-এগুলি পরিবর্তনীয় ধারাতে রাখা উচিত।
- কারা মেম্বার হবার যোগ্য? যারা বিজ্ঞানের গবেষনা লদ্ধ জ্ঞানকে, সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্যে একমাত্র পথ বলে মনে করেন। তিনি আস্তিক, নাস্তিক, কমিনিউস্ট যে কেওই হতে পারেন। কিন্ত রাষ্ট্র ও সমাজের ব্যাপারে বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তকেই সেরা সিদ্ধান্ত বলে মানতে হবে।
- সামাজিক আইন নিয়ে অবস্থানঃ সব ধরনের ধর্মীয় আইন রাষ্ট্র থেকে বাতিল করে, সমাজ বিজ্ঞানকে ভিত্তি করে সামাজিক গবেষনার মাধ্যমে নতুন আইন আনার দাবী জানাতে হবে।-যার ভিত্তি হবে নারী-পুরুষের সমানাধিকার, দূষম মুক্ত সমাজ এবং পশুপাখিদের মানুষের সাথে বেঁচে থাকার সমানাধিকার।
- জাতীয়তাবাদ বনাম আন্তর্জাতিকতাবাদঃ আন্তর্জাতিকতাবাদ ই একমাত্র বৈজ্ঞানিক পথ এটা যেমন ঠিক-ঠিক তেমনই প্রতিটি ভাষা এবং সংস্কৃতির স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ও তাদের শ্রীবৃদ্ধি আমাদের কাম্য।
- পুঁজিবাদ না সমাজতন্ত্র? বাস্তব হচ্ছে পৃথিবীতে সব রাষ্ট্রকেই বাজার এবং সামাজিক দ্বায়িত্ববোধ -এই দুই নিয়েই চলতে হয়। তার কম বেশী তারতম্য থাকে। বাজারহীন রাষ্ট্র বা সমাজতান্ত্রিক কাঠামোহীন রাষ্ট্র বাস্তবে হয় না। সুতরাং মিশ্র অর্থনীতির রূপরেখা নিয়ে আরো ভাবার আছে।
- গণতন্ত্র না ডিজিটাল গণতন্ত্র? আমাদের বর্তমানের গণতন্ত্র প্রতিনিধিত্ব মূলক পার্টি ভিত্তিক গণতন্ত্র। যা সত্যিই অসংখ্য ত্রুটিপূর্ন। সাধারন জনগনের কন্ঠশ্বর এখানে রুদ্ধ। এই ডিজিটাল যুগে চোর ডাকাত প্রতিনিধিদের রাষ্ট্র চালানোর জন্যে পাঠানোর আদৌ কোন দরকার আছে কি না তাই নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। পার্টি ভিত্তিক গণতন্ত্রের ও দরকার নেই । দরকার প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে সরাসরি জনগনের গণতন্ত্র।
বাংলাদেশ এবং ভারতের বিজ্ঞান সংগঠনগুলি ধর্মের উত্থান ঠেকাতে ব্যার্থ হচ্ছে কেন?
বিজ্ঞান সংগঠন বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বঙ্গে বেশ কিছু আছে। কিন্ত তাদের চেষ্টা সিন্ধুতে বিন্দু-যা মৌলবাদ ঠেকাতে ১% ও কার্যকর না। এদের অর্থবল, জনবল , জনভিত্তি কিছুই গড়ে ওঠে নি। তার অনেক কারন আছে-আমার বিশ্লেষন বলে
[১] এরা বিজ্ঞানকে কিছু পুঁথির জ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছেন-সামাজিক আইন, রাজনীতি, রাষ্ট্রীয় নীতির মধ্যে বিজ্ঞান প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যাবহার নিয়ে ভাবেন নি। এদের কার্যকলাপ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বড়জোর বিশুদ্ধ পানীয় জলের মধ্যে আটকে আছে।
[২] আধুনিক মিডিয়াকে ব্যাবহার করার চেষ্টা করেন নি-পুরানো প্রিন্ট মিডিয়াতে বছরে দু একটা পাবলিকেশন করছেন। এতে ভাল কিছু লেখা আমরা পেতে পারি-কিন্ত তাতে জনভিত্তি হবে না। জনভিত্তির জন্যে চাই কেবল মিডিয়া বা নিজেদের দৈনিক পেপার।
[৩] এরা বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করেন-কিন্ত অধিকাংশ মেম্বার বামপন্থী দলের সাথে যুক্ত। ফলে বিজ্ঞান সংগঠন গুলি রাজনীতি থেকে দূরেই থেকেছে। এতে তিনটে ক্ষতি হয়েছে। প্রথমত কোন বামপন্থী দলেই রাজনীতি নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তা নেই বা ধর্মের বিরুদ্ধে কোন প্রোগ্রাম নেই। দ্বিতীয়ত সমাজবিজ্ঞানের আধুনিক চিন্তাগুলি রাষ্ট্র এবং সমাজে আসতে পারছে না-কারন পার্টিগুলির মধ্যে আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক কোন চেতনা নেই। তৃতীয়ত এই কারনেই ইনারা ব্যাপকভাবে মিডিয়া প্রচারের কথা ভাবেন না। এই ট্রেন্ড চললে বিজ্ঞান সংগঠন করে কিস্যুই লাভ হবে না। আমাদের সেই বিজ্ঞান সংগঠন চাই যা আধুনিক সমাজ বিজ্ঞানের ভিত্তিতেই নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে জন্ম নেবে। নইলে এসব করে লাভ নেই।
[৪] আরো একটা গুরুত্বপূর্ন ব্যাপার আছে-সেটা হল সামাজিক শক্তি হিসাবে জন্ম নিতে গেলে অর্থনীতির কাঠামোর মধ্যেও গভীর ভাবে ঢুকতে হয়। আমাদের দেশে এত শিক্ষিত বেকার। তাদেরকে বিজ্ঞান ভিত্তিক উৎপাদন প্রকল্পের সাথে ব্যাবসায়িক ভিত্তিতেই জুড়তে হবে। যেমন গ্রামে গ্রামে বায়োগ্যাস বা সোলার ইউনিট ইত্যাদি গড়ার ছোট ব্যাবসার জন্যে যে টাকা লাগবে, সেসব লজিস্টিক প্রবাসী সদস্য এবং ব্যাঙ্কের সহায়তায় গড়ে তুলতে হবে।
আরো অনেক কিছু লেখার ইচ্ছা ছিল। বাকীরা এই ব্যাপারে লিখুন।
আমি জানি এতদিন আমাদের দুই বাংলার বামপন্থীরাই বিজ্ঞান সংগঠন করেছেন-কিছুটা হলেও মৌলবাদের বিরুদ্ধে ইনারাই সামান্য হলেও লড়াই করেছেন। কিন্ত সেটা মৌলবাদিদের শক্তিবৃদ্ধির তুলনায় কিছুই না। পশ্চিম বঙ্গে বিজেপি ভোট পায় না বলে ভাবার কোন কারন নেই-এখানে মৌলবাদ নেই। ইসলামিক এবং হিন্দু মৌলবাদ খুব ভালভাবেই আছে-যেদিন রাজনীতিতে সিপিএম বনাম এন্টি সিপিএম থাকবে না, সেদিন এদের শক্তি সামনে আসবে। আর বাংলাদেশে মৌলবাদ ঠেকাতে সেদেশের বামপন্থী এবং বিজ্ঞান সংগঠনগুলো সম্পূর্ন ভাবে ব্যার্থ হয়েছে-যদিও তারা একটি ধর্ম নিরেপেক্ষ চেতনাকে ধরে রাখতে পেরেছেন। কিন্ত তা মৌলবাদের পেট্রোডলারের বিরুদ্ধে যথেষ্ঠ না।
সুতরাং একটি নতুন ধরনের বিজ্ঞানমুখী গণসংগঠন গড়ার বিকল্প আমি দেখতে পাচ্ছি না।
No comments:
Post a Comment