এই প্রসঙ্গে মায়ানদের সম্মন্ধে দুচার কথা বলে রাখি। আজকের মেস্কিকানরা ( বা আমরা আমেরিকায় বাঙালীরা যাদের ঠাট্টা করে হোজে মামা বলি) মায়ানদের উত্তরপুরুষ। আনুমানিক ১০০০ খৃষ্ঠপূর্বাব্দে মেক্সিকো বা এই পুরো ক্যারিবিয়ান বেল্টে মায়ান সভ্যতার শুরু। বর্তমানে সে মায়ান স্থাপত্যের ধ্বংশাবশেষ আমরা দেখি, তার সবটাই পোষ্ট ক্ল্যাসিক্যাল মায়া সভ্যতার। আনুমানিক ৭০০-১০০০ খৃষ্ঠাব্দ এই স্থাপত্যগুলির ইতিহাসকাল । মায়ানরা লিখতে জানত-তাদের অক্ষরের সংখ্যা ১০,০০০। প্রাকটেলিস্কোপহীন জ্যোর্তিবিদ্যার নানান নমুনার সাক্ষর তাদের স্থাপত্যে। রাজনৈতিক সিস্টেম ছিল রেনেসাস সাময়িক ইউরোপের মতন-নগর রাষ্ট্র। আনুমানিক শতাধিক নগর রাজ্য নিয়ে গড়ে উঠেছিল মায়ান সাম্রাজ্য। যা স্প্যানিশ আক্রমনে ১৬৮০ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ ধ্বংশ হয়। যদিও মায়ানরা ১৭০ বছর ধরে ইউরোপিয়ান হার্মাদ দস্যুদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার লড়াই লড়ে গেছে। কিন্ত ক্রমাগত বিদ্রোহ এবং গেরিলা যুদ্ধ করেও হার মেনেছে বন্দুক এবং কামানের কাছে। স্প্যানিশরা এদের দাশ হিসাবে ক্যারিবিয়ানের অন্যান্য দ্বীপে চালান করত। মায়ান পুরুষদের মেরে ফেলে নারীর গর্ভে ইউরোপিয়ান বীজ বপন করেছিল স্প্যানিশ জলদস্যুরা যার ফলশ্রুতিতে আজকের মিশ্র মেক্সিক্যান জাতির জন্ম। মেক্সিকানদের মধ্যে কাওকে মায়ান আদিবাসীদের মতন দেখতে-আবার কেও কেও দেখতে পুরো ককেশিয়ান। তবে অধিকাংশ মেক্সিকানদের দেখতে মায়ান এবং স্প্যানিশদের মাঝামাঝি।
মেক্সিকো যুক্তরাষ্ট্রের পাশে হলেও অনেক বেশী সমাজতান্ত্রিক। ক্যাঙ্কুন এয়ারপোর্টে নামতেই সেটা টের পেলাম। মেক্সিকোর টুরিজম কতৃপক্ষ, নানান টুরিস্ট এজেন্সি এখানে কিভাবে কাষ্টমারদের পকেট মারে, সেই ব্যাপারে সাবধান করার জন্যে লোক রেখেছ! শুধু তাই না, নানান টুরে, এখানে কিভাবে পয়সা বাঁচাতে হয়, সেই ব্যাপারে সরকারী কর্মচারিদের কাছ থেকে নানান টিপস পেলাম। সরকারি কর্মচারিরা কাজ করে না-বসে বসে মাইনা চুরি করে, এই স্টিরিওটাইপ ধারনায় যারা ভোগেন তাদের মেক্সিকোতে ঘোর উচিত। শুধু টুরিজম ডিপার্টমেন্টের কর্মীরাই না, এখানে সরকার এবং সাধারন মানুষও সরকারী উদ্যোগের ওপর অনেক ভরসা রাখে। এর অনেক উদাহরন গোটা ট্যুর জুরেই পেলাম।
ক্যাঙ্কুন আমেরিকান পর্যটকদের কাছে ভীষন জনপ্রিয়। কারন এখানকার হোটেলগুলো সব অল-ইক্লুসিভ প্যাকেজ দেয়। অর্থাৎ খানা-পিনা হোটেল ভাড়ার মধ্যেই ধরে নিচ্ছে। খাওয়া মানে, তিন কোর্স মিল বা মাত্র তিনটে ড্রিংস এমন না। সকাল আটটা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত যতখুশি খাও। যতখুশি পান কর। সব ধরনের ককটেল। আমাদের রিসর্টেই ছিল ১১টা বার আর ৫ টা রেস্টুরেন্ট! তার সাথে সন্ধ্যায় লোকনৃত্যের জমাটি আসর! আসলে এই ১০০ মাইল সৈকতরেখা জুরে যেখানে এককালে মায়ান সভ্যতা ছিল-সেখানে আজও কোন সভ্যতা গড়ে ওঠে নি। শুধু কিছু প্রাসাদসম হোটেল ( কিছু কিছু রিসর্ট ১০,০০০ একর জমির ওপর তৈরী!) আর বনজঙ্গল। বাইরে বেড়িয়ে রেস্টুরেন্টে খাওয়া এখানে অসম্ভব। অল-ইনক্লুসিভ প্যাকেজগুলো পৃথিবীর অনেক টুরিস্ট স্পটেই রিসর্টগুলি চাইছে। কিন্ত স্থানীয় ব্যাবসায়ীদের বিরোধিতায় সম্ভব হচ্ছে না। কারন সেক্ষেত্রে টুরিষ্ট স্পটের রেস্টুরেন্ট ব্যাবসা লাঠে উঠবে।
এখান কার রিসর্টগুলির বৈশিষ্ট সমুদ্রর সাথে প্রায় মিশে যাওয়া বিরাট বিরাট সুইমিং পুল। এত বড় সুইমিং পুল আমি লাস ভেগাসের বেলাজিও বা সিজারেও দেখি নি। সুইমিং পুলে সাঁতার কাটতে কাটতেই ক্যারিবিয়ানের সবুজাভ নীল দেখা যায়। যদিও সমুদ্র সৈকত এখানে প্রাইভেট। পানপ্রিয় পর্যটকদের জন্য এ স্বর্গরাজ্য- বীচেই ককটেল বার। সম্পূর্ণ ফ্রি। বীচটি অবশ্য অত ভাল না। বীচের তলায় কোরাল রীফের জন্যে পায়ে বেশ লাগে। ঢেও কিছু উঁচু না। ক্যারিবিয়ান সমুদ্রের সব থেকে ভাল বীচ আছে কিউবাতে। মধ্যাহ্ন এবং অপরাহ্নের প্রচন্ড দাবাদহে অনেকেই বাইরে বেড়োতে চাইছিল না। অধিকাংশ টুরিস্টই সুইমিংপুলে বসে শুধু ককটেল পান করে আর জলের তলায় গা ডুবিয়ে শুয়ে থাকে। যারা একটু এডভেঞ্চারপ্রেমী-তারা সার্ফিং বা স্নটলিং করে।
ক্যাঙ্কুন এলাকায় মায়ান সভ্যতার দুটি বিখ্যাত ধ্বংশাবশেষ আছে। টুলুম আর চিচেনিটজা। টুলুমে আছে সূর্য্যমন্দির। অনেকটা আমাদের কোনার্কের মতন। আর চিচেনিটজাতে আছে পিরামিড। টুলুমের সুর্য্য মন্দির অবশ্য আমাদের কোনার্কের মন্দিরটির চেয়ে অনেক ছোট। স্থাপত্য এবং কারুকার্যও তেমন কিছু না। যদিও কোনার্ক এবং টুলুমের সূর্যমন্দিরের বয়স প্রায় সমসাময়িক। তবে কোরাল রিফের ওপর তৈরী এই মন্দিরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দুর্দান্ত।
টুলুম মানে দেওয়াল ঘেরা শহর। মায়ানদের সব রাজ়্যই ছিল নগর-রাজ্য। তবে নগরে থাকত শদুয়েক বনিক এবং রাজা। শ্রেনী বিভক্ত মায়ান সমাজে, নীচু শ্রেনীর মায়ানদের বাস ছিল দেওয়ালের বাইরে গ্রামে। সূর্য্যমন্দিরে বছরে চারবার নরবলি হওয়ার হিসাব পাওয়া গেছে। মূলত অপরাধীদের দেবতার কাছে বলি দিত মায়ানরা।তাদের নরখুলি মন্দিরেগাত্রের শোভা বর্ধনের কাজে লাগানো হত বলে জানা যায়। কোনার্কের সূর্যমন্দিরের মতন এখানেও একাধিক সূর্যঘরির সন্ধান পাওয়া যায়। আহ্নিক গতি পর্যবেক্ষনের জন্যে পিনহোল তৈরী করে দরজার ওপর ফেলাটা গ্রীক, মিশর এবং ভারতের মতন এখানেও চালু ছিল। তবে মায়ানদের সমস্যা হচ্ছে এরা ঘোড়া বা পুলির ব্যাবহার জানত না। ফলে ভারী পাথর বেশী ওপরে তুলতে পারে নি-কেন না সব কিছুই মানুষদের গায়ের জোরে করা। ফলত এরা মিশরের মতন বড় পিরামিড বা কোনার্কের মতন বড় সুর্য্য মন্দির বানাতে পারে নি।
যেটা সব থেকে ভাল লাগল সেটা হচ্ছে মেক্সিকান সরকারের সমাজতান্ত্রিক দায়বদ্ধতা। এখানে আইন আছে গ্রামবাসীরা হোটেলের মধ্যে ঢুকে তাদের কুটির শিল্প বেচতে পারবে। যেহেতু হোটেলগুলিতে প্রচুর টুরিস্ট আসে এবং স্থানীয় গ্রামবাসিরা তা থেকে উপকৃত হতে পারে সেই জন্যেই এহেন আইন। তার জন্যে হোটেল কতৃপক্ষ লবিতে গ্রামের লোকেদের পসরা সাজিয়ে বসতে দিচ্ছে। আমাদের দেশের ফাইফ স্টার হোটেল বা রিসর্ট গুলির কোন সামাজিক দায়বদ্ধতা নেই। শুধু তাই না, টুলুমে আমাদের যে টুর গাইড ছিল সে আরো জানাল, সমস্ত টুরবাসগুলিকে সরকারী হান্ডিক্রাফটের এক বিশাল দোকানের সামনে ৩০ মিনিট নুন্যতম থামতে হয়। যাতে স্থানীর গ্রামবাসীদের তৈরী কুটির শিল্পের কিছু সুরাহা হয়। এমন কি সেই গাইড ভদ্রলোক আমাদের বার বার অনুরোধ করছিলেন, তাকে টিপস দেওয়ার বদলে যেন, আমরা কিছু কিনি সেই সরকারী দোকান থেকে। কারন স্থানীয় আদিবাসিরা এই সরকারী সাহায্যেই বেঁচে থাকে। আমার ধারনা এই আইনগুলি আমাদের দেশেও চালু করা উচিত।
তবে আমেরিকান টুরিস্টরা সত্যি আমাকে অবাক করেছে। এখানে খাওয়ার জন্যে এলাহি আয়োজন সব সময়। এত হাজার রকমের মেক্সিকান খাবার-দুদিনেই দশকিলো ভুঁড়ি বাড়তে পারে। কিন্ত অধিকাংশ আমেরিকান সেই বার্গার হটডগ আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এর বাইরে কিছু খাবে না। কূপমুন্ডকতা আর কাকে বলে! আগেকার দিনের বাঙালীরাও ছিল ঠিক এই রকম। ভারতের অন্যরাজ্যে বেড়াতে গিয়েও বাঙালী রেস্টুরেন্ট খুঁজবে। এখানেও হোটেল কতৃপক্ষ আমেরিকানদের ফার্স্ট ফুড প্রীতিকে সন্মান জানিয়ে, গোটা দুয়েক ফার্স্টফুড কর্নার বানিয়ে দিয়েছে! ডলারের জোরে এই ভাবেই আমেরিকান সংস্কৃতি সর্বত্র ছড়াচ্ছে। এমনকি টুলুমেও কোন মেক্সিক্যান রেস্টুরেন্ট নেই-আছে সেই ম্যাকডোনাল্ড আর সাবওয়ে!
মেক্সিক্যান সংস্কৃতিতেও সেই অবক্ষয়ের ছাপ স্পষ্ট। এখানে রাতে লোকনৃত্যের আসর বসত। সালসা নৃত্য ত গোটা পৃথিবী জুরেই সমাদৃত। তা সত্ত্বেও এখানে আমেরিকান টুরিস্টদের খুশী করতে হিপ হপ,জ্যাজ, রাপ সব স্ট্যাইলের আমেরিকান এন্টারটেইনমেন্টই চলছে। কারন তা না হলে আমেরিকান দের মন ভরবে না।
শুধু ডলারের জোরে কিভাবে তৃতীয় শ্রেনীর খাবার আর সংস্কৃতি আমেরিকা গোটা পৃথিবী জুরে রপ্তানী করছে-তা ভাবতেই গা ঘিনঘিন করে ওঠে। দেখে মনে হয় ভাল সংস্কৃ্তি পৃথিবীতে টেকে না-বিজয়ী জনগোষ্ঠি গুলির সংস্কৃতিই ক্রমশ ছড়িয়ে যায়। যেমন, মায়ানদের মধ্যে কিছু স্প্যানিশ প্রথম আসে ১৫১৪ সালে। একটি জাহাজ ভেঙে ওরা উপকুলে পৌছালে মায়ানরা তাদের উদ্ধার করে। পরবর্ত্তীকালে সেই ১৪ জন স্প্যানিশ মায়ান মহিলা বিবাহ করে, সেখানেই ঘর সংসার পাতে। মায়ানরা স্প্যানিশদের নিজের আপনজন করে নিয়েছিল। কিন্ত ১৫২৬ সালে স্প্যানিশরা আবার এই উপকূলে হানা দিল-মায়ান আদিবাসিদের দাস বানানোর জন্যে। এই ছিল উন্নত ইউরোপিয়ান সভ্যতা! অথচ তাদের বন্দুক আর কামানের জোরে আজকের মেক্সিকো প্যানিশ কলোনী।
উন্নততর সভ্যতা ব্যাপারটা পুরোটাই গল্প--অথবা উন্নততর সভ্যতা মানে উন্নততর হিংস্র মানবপশুদের পাশবিক আস্ফালন। এটাই পৃথিবীর ইতিহাস। সেকালেও ছিল। একালেও তাই। নইলে অথিতিপরায়ন মায়ান সভ্যতাকে হারিয়ে মানুষকে দাস বানানো স্প্যানিশ সভ্যতা মেক্সিওর নিয়তি হয় কি করে?
No comments:
Post a Comment