Thursday, May 17, 2012

ফেসবুকের আই পি ও এবং বাঙালীর বামাশা


কাল ফেসবুক পাবলিক হচ্ছে। দাম ধার্য্য হয়েছে ১০৪ বিলিয়ান ডলার। শুধু মার্ক জুকারবার্গই না, সাথে সাথে ফেসবুকের প্রথম ৩০০ কর্মীও মিলিয়ানার হতে চলেছে।  আপেলের আই পি ওর পরে, এই প্রথম একদিনে একসাথে এতজন কর্মী কোটিপতি হওয়ার পথে।

 এতগুলো কোটিপতি তৈরী করেছে, এটা নিশ্চয় ফেসবুকের একমাত্র কৃতিত্ব না। ফেসবুক যে সামাজিক বিপ্লবের ভগীরথ, সেটাই তার ঐতিহাসিক কৃতিত্ব।  ইতিহাসের নিক্তিতে মানব জনসংযোগের প্রথম বিপ্লব যদি হয় ভাষার জন্ম, দ্বিতীয় হবে ছাপাখানার আবিস্কার। সমাজ পরিবর্তনের মাপকাঠিতে ফেসবুকের আবিস্কার ভাষার জন্মের কাছাকাছিই থাকবে। পৃথিবীর মানব সমাজ এই ভাবে এত কাছে আর কখনো আসে নি। দেশের সীমানা এত দুর্বল আর কোনদিন ও ছিল না। এখন ত আমি বুঝতেই পারি না আমেরিকাতে থাকি, না পশ্চিম বাংলাতে আছি।  নেটের দ্বিতীয় জীবনই আজ আমার প্রথম জীবন ।
 ফেসবুকের এই সাফল্যের বিপরীতেই আমি দেখছি দুই বাংলার সাম্প্রতিক রাজনীতি। একদিকে মমতা কুনাট্য –অন্যদিকে হাসিনা-খালেদা রঙ্গের নেভার এন্ডিং পলিটিক্যাল কোরিওগ্রাফি। রাজনৈতিক নৃত্যনাট্য বা কুনাট্য।  এরা মাঝে মাঝেই ফেসবুকের বিরুদ্ধে হুমকি দেয়। “ফেসবুক” বন্ধ করার জন্যে আবেদন জানায়। নেহাত আমেরিকা বলে দেশে ফেসবুকের জন্ম-নইলে এই উপমহাদেশে জন্মালে ফাল্গুনের অকাল শীলাবৃষ্টিতে এই চারা অচিরেই ঝড়ে যেত।
      আমেরিকাতে বুদ্ধিমান প্রজন্মর অধিকাংশই সিলিকান ভ্যালির স্টার্টাপ বা নতুন কিছু না কিছু করে।  বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন, এডিসন থেকে জুকারবার্গ।  পৃথিবীকে বদলে দেওয়া “প্রায়” সব প্রযুক্তির আঁতুরঘর আমেরিকা।  ইদানিং সেই প্রযুক্তি বিপ্লবের ঢেও ভারতের ব্যাঙ্গালোর, পুনে, হায়দ্রাবাদেও লেগেছে। বেশ কিছু তরুন, স্টার্টআপ করেছে। অধিকাংশই যদিও আন্তর্জাতিক মানের না-স্থানীয় বিজনেসকে কেন্দ্রকরেই এগুলি তৈরী হচ্ছে-তাও খারাপ কি? চীনেও তরুন প্রতিভাধর আবিস্কারকরা উঠে আসছে বেশ দ্রুত গতিতে।
 এখান থেকেই আমি প্রশ্ন করা শুরু করব। আমাদের দুই বাংলার তরুণেরা কি করছে? সিলিকান ভ্যালি সহ গোটা আমেরিকাতে বাঙালী উদ্যোগপতি অনেক। কারন বাঙালী প্রতিভাধর, তার শিক্ষা এবং উদ্যোম সবই আছে। সুতরাং বাংলার বাইরে বাঙালী উদ্যোগপতির উপস্থিতি স্বাভাবিক। কিন্ত পশ্চিম বাংলা এবং বাংলাদেশ থেকে উদ্যোগপতি প্রায় নেই কেন?
 বাংলাদেশের দিকে তাও বেশ কিছু আই টি উদ্যোগ চোখে পড়ে। এর বড় কারন বাংলাদেশে টিসিএস বা ইনফোসিসের মতন বড় কোম্পানী গুলির অনুপস্থিতি। ওডেক্স, ইল্যান্সের দৌলতে আজকের দুনিয়াতে কাজ জানলে, আই টি বা সার্ভিস কোম্পানী করা আগের থেকে অনেক বেশী সহজ। ফলে ইনফি বা টিসিএসের অবর্তমানে বাংলাদেশের তরুণদের একটা অংশ নিজেরাই নিজেদের ব্যবসা ভাল দাঁড় করিয়েছে ওডেক্স বা ইল্যান্সের সাহায্যে। এটা পশ্চিম বঙ্গের দিকে একদম হয় নি-এর কারন এখানে লোকজন ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করলেই আই বি এম, টিসিএসে চাকরী নিয়ে হারিয়ে যায়।  কিছু কিছু যেসব উদ্যোগ কোলকাতায় হয়েছে-তাদের সবার বড় সমস্যা হচ্ছে লোকজন ধরে রাখা। লোকে কাজ শিখেই কর্মীরা ইনফি বা টিসিএসে পালিয়ে যায়।  বাংলাদেশে এই সমস্যাটা না থাকায়, ছোট ছোট কোম্পানীগুলি বাংলাদেশে ভাল কিছু করার সুযোগ পেয়েছে। কিন্ত সেখানেও বিধি বাম। বাংলাদেশে না আছে বিদ্যুৎ, না আছে ভাল ইন্টারনেট। পরিকাঠামোহীন প্রতিভা খুব বেশী দূর যেতে পারে না।
যাইহোক কোলকাতা বা ঢাকাতে যেটুকু ইনোভেশন হচ্ছে সবটাই ব্যক্তিগত উদ্যোগে। এদের জন্যে কোন কাঠামো, বা সহযোগিতা বা কমিউনিটি নেই। কমিউনিটি, পরিকাঠামো এবং মানসিকতা-এই তিনের ত্রাহ্যস্পর্ষে আবিস্কার এবং নতুন ব্যবসার সূত্রপাত হয়। এর মধ্যে সরকারের দ্বায়িত্ব হচ্ছে পরিকাঠামোর। কোলকাতার পরিকাঠামো পুনে বা ব্যাঙ্গালোরের ধারে কাছে নেই। নতুন সরকার কিছু করবে এমন দেখতেও পাচ্ছি না। শুধু শ্যাম পিত্রোদাকে জগন্নাথের মতন রথে বসিয়ে হবে টা কি?  বাংলাদেশেও দেখি ডিজিটাল বাংলাদেশের মিডিয়াচমক। এদিকে ইন্টারনেট কানেকশনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে।
এর থেকেও ব্যবসার ক্ষেত্রে দুই বাংলার বৃহত্তম সমস্যা বামপন্থী বুদ্ধিজীবিদের উৎপাত।  কিশোর বয়েস হচ্ছে সব থেকে বেশী ফর্মেটিভ-মাথায় ঐ সময় যা ঢোকে তা পরবর্তীকালে উৎখাত করা মুশকিল। পুঁজি হচ্ছে চুরি করা ধণ-এটা ছোট বেলা থেকে মাথায় ঢোকানো হয়।  পশ্চিম বঙ্গ বা বাংলাদেশের পরিপেক্ষিতে, সেটা যে খুব ভুল ধারণা তাও না।  কিন্ত সেটা ধরে বসে থাকলে উন্নতি হবে কি করে? সরকারি মডেলে দেশের উন্নতি হয়েছে ইতিহাসে এমন কোন সফল মডেল নেই। যা কিছু হয়েছে, ব্যক্তিগত উদ্যোগেই হয়েছে। সরকার শুধু পরিকাঠামো দিতে পারে। আসল কাজটা মানুষকেই করতে হবে। আদর্শগত কারনে এটা শুনতে অনেকের ভাল নাও লাগতে পারে-কিন্ত বাস্তবতাকে অস্বীকার করার এই বামাশাতে ( বামপন্থী আমাশা)  ভুগেই  বাঙালী আজ মৃত্যুপথ যাত্রী।  ব্যাক্তিগত উদ্যোগ ছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই কোয়াপরেটিভ উদ্যোগে দেশের উন্নতি হতে পারে । ভেণেজুয়েলা, ব্রাজিল সহ ল্যাটিন আমেরিকাতে এই নতুন সমবায় মডেলের আধা-ধণতান্ত্রিক-আধাসমাজতান্ত্রিক মডেলেও উন্নতি সম্ভব। কিন্ত সব কিছুর মূলেই মানুষের সেই উদ্যোগ। আর মানুষের উদ্যোগের প্রষ্ফুটন সরকারি উৎপাদন ব্যাবস্থায় হয় না। আমি ইচ্ছা করেই সমাজতন্ত্র কথাটা ব্যবহার করলাম না। কারন সোভিয়েতে যা ছিল-সেটা স্টেট ক্যাপিটালিজম । পাবলিক কোম্পানী ও স্টেট ক্যাপিটালিজমের উদাহরণ। যা নিদারুণ ব্যার্থতা এবং তামাসা অধিকাংশ ক্ষেত্রে।  সোভীয়েত ইউনিয়ান উন্নত শিক্ষা এবং গবেষণাতে আমেরিকার দ্বিগুনের বেশী লোক লাগিয়েও কার্যকরী আবিস্কার কিছুই কর‍তে পারে নি। যাবতীয় ওষুধ, সিলিকন চিপস আর ইন্টারনেটের আবিস্কার  আমেরিকাতেই হয়েছে। নতুন প্রোডাক্ট বা আবিস্কার বিবর্তনের মিউটেশনের মতন। বাজার হচ্ছে নির্বাচক। সেই ঠিক করে দেয়, কে টিকে থাকবে। এইভাবেই প্রযুক্তিগত ভাবে উন্নত সমাজের জন্ম হয়। বাজারের নির্বাচন না থাকলে এটা সম্ভবই না।  তাই বাজার বিহীন উন্নত প্রযুক্তি বা প্রযুক্তি বিপ্লবের স্বপ্ন অলীক জগতের বাসিন্দাদের জন্যে।

এর ওপর আছে রাজনৈতিক অধিকার এবং  সাম্যের কুসুম কল্পনা। জীবনের যেহেতু পরম উদ্দেশ্য বলতে কিছু নেই- একজন মানুষ সাম্যের আফিঙেই বুঁদ থাকুক বা আধ্যাত্মিকতার অলীক জগতেই পাড়ি দিক আমার কিছু যায় আসে না। সমস্যা সেখানেই যখন গোটা সমাজে এগুলো কুপ্রভাব ফেলে। সাম্যের ধারনা বা আধ্যাত্মিক শান্তির বাণী সব কিছুই ভাল –মেনে নিতে আমার আপত্তি নেই। কিন্ত এডিশন থেকে জুকারবার্গের সাফল্যের পেছনে আছে পুঁজি-যা সাম্য ও মানে না – ত্যাগেও বিশ্বাস করে না। তা বিশ্বাস করে অসাম্য এবং লোভে।  হ্যাঁ এই অসাম্য এবং লোভকে সিস্টেম বশে না আনতে পারলে-লোভ এবং অসাম্যই ধ্বংশ করবে তার স্রষ্টাকে। কিন্ত বাস্তবত এটাই যে লোভ এবং অসাম্যের অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া ছুটেই চলেছে। এবং যা কিছু “কার্যকরী” আবিস্কার, সেই লোভ আর অসাম্যের পিলারের পুঁজি থেকেই আসছে! লোভ আর অসাম্যের এই যুগল বন্দিকে প্রশ্ন করা ভাল-কিন্ত অস্বীকার করা ততটাই মুর্খামী।  কারন আজকের এই ইন্টারনেট, ব্লগ, ফেসবুক –সব কিছু সেই পাপেরই ফসল। যাইহোক বাঙালী এটাকে পাপের চোখেই দেখে। ফলে, অধিকাংশ বাঙালী পক্ষে নতুন কিছু ব্যবসা করা মুশকিল।

 আমার জীবনের উপলদ্ধিগুলো জেন মাস্টারের মতন । লোভ এবং ত্যাগ, সাম্য এবং অসাম্য-এর মিশ্রন, এদের দ্বন্দ,  ক্রিয়া বিক্রিয়াই জীবন । লোভহীন সাম্যবাদি একটা সমাজ হবে-এসব রোম্যান্টিসিজম নিয়ে বাঙালী পড়ে থাকলে- আরো পিছিয়ে পড়বে। বরং এটা ভাবাই ভাল যে বাস্তব সমাজ এবং জীবনে সাম্য ও অসাম্যে, লোভ এবং ত্যাগের দ্বন্দ ও সহাবস্থান থাকবে।
পৃথিবীতে যত জাতি দেখেছি, তার মধ্যে বাঙালী সব থেকে বেশী হুজুগে, বাস্তব বিমুখ।  তারা বসে থাকবে নদীর এপার, নইলে ওপারে। নৌকা চালাবে না।  এই জন্যে বাঙালীর রাজনীতিতে পোলারাইজেশন সাংঘাতিক বেশী। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ-বি এন পি সাপোর্টারদের মধ্যে মারপিট, পশ্চিম বঙ্গে তৃণমূল সিপিএমে খুনোখুনী- এটা ভারতের অন্যকোন রাজ্যে দেখি নি। এই মাত্রাতে না। ২০০৫-২০১১ সালের মধ্যে পশ্চিম বঙ্গে রাজনৈতিক কারনে যত খুন হয়েছে কাষ্মীরে সন্ত্রাসবাদে তার অর্ধেক লোক ও মরে নি।  এর মূল কারন আবেগপ্রবণ বাস্তববিমুখ বাঙ্গালী। ঘটে সামান্য বুদ্ধি থাকলেও লোকে বোঝে এই সব রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে , তাদের নেতা নেত্রীদের মধ্যে পার্থক্য সামান্যই।  বাঙালী জাতির মধ্যে আদর্শবাদের ভাইরাস যত প্রবল, অন্যত্র তেমন দেখি না।  এর সব কিছুর মূলে আছে বাস্তব বুদ্ধির অভাব-আর সেটা এসেছে জীবনটাকে একমাত্রিক ভেবে।

 অবশ্য শেষে সেই ফেসবুকই ভরসা। আশাকরি সেই অনলাইনেই ভেঙে পড়বে বাঙালীর মনোজগতের অচলায়াতন । 

Saturday, April 14, 2012

টুনটুন ব্যানার্জির রূপকথা

বিপ্লব পাল, পয়লা বৈশাখ-২০১9

রবীন্দ্রনাথ লিখিয়াছিলেন। কুট্টি আঁকিয়াছিলেন। কোন কোন প্রতিবাদি কবির ছেঁড়া শান্তিনিকেতনী ব্যাগের কাগজের টুকরোগুলি বিদ্রোহ করিতে যাইয়া, প্রকাশকের অভাবে কাঁদিতেছিল। কবিতার মার্কেট নাই। গানের বিক্রি নাই। সিনেমা করিয়া লাভ নাই। এমন নাই নাই এর বঙ্গদেশে লালরাজাদের শাসন চলিতে ছিল। সর্বহারার রাজা এবং তাহাদের বিরোধী নাটক দলের অভিনেত্রী টুনটুন ব্যাণার্জির অভিনয় প্রতিভায় বঙ্গদেশের রাজনৈতিক নাট্যমঞ্চ মুখরিত ছিল।

লালরাজারা প্রজাপালন নিমিত্ত কিছু লালমুখো বাণর পুশিতেন। ইহাদের মানুষে হার্মাদ কহিত। এই বানরকূলের কিছু কীর্তিহেতু, বঙ্গদেশে নন্দীগ্রাম এবং সিঙ্গুর বলিয়া দুটি মার্কেটের উদয় হইল। কবি, গায়ক, অভিনেত্রী-যাহাদের প্রতিভা মার্কেটের অভাবে বঙ্গদেশের গোডাউনে ঘুণ ধরিতেছিল-তাহারা নতুন মার্কেটের সন্ধান পাইলেন। সিঙ্গুর এবং নন্দীগ্রাম। টুনটুন ব্যানার্জির অভিণয় প্রতিভায় বাঙালী বরাবরই মুগ্ধ। এই দুই নতুন থিয়েটারের আবির্ভাবে, টুনটন ব্যার্নাজি বাংলার বুদ্ধিজীবি গোডাউনে ছোঁ মারিয়া, তাহার নাটকের দলটিকে আরো প্রতিভা সমৃদ্ধ করিলেন।

বঙ্গবাসী লালশাসনে অসন্তুষ্ট হইলেও, অভিনেত্রীর হাতে রাজ্যের শাসনভার তুলিয়া দিতে দ্বিধায় ভুগিতেছিল। টুনটুন ব্যার্নাজির নব্য দলটি দেখিয়া, তাহাদের ভরসা জন্মিল। লালরাজাদের পতন হইল। টুণটুন ব্যানার্জি বঙ্গের সিংহাসনে বসিলেন। পরিশদরা সেলাম ঠুকিল। কিছু চাষী দেনার দায়ে আত্মহত্যা করিল। বস্তি উচ্ছেদ করিয়া নীল কোলকাতার স্বপ্নে বিভোর হইলেন টুনটুন ব্যার্নাজি। ৯০ দিনের মধ্যে ৯০% প্রতিশ্রুতি পূরণ করিয়া, অতিরিক্ত কাজের সন্ধানে বাহির হইলেন।

জনগণ বুঝিতে ব্যার্থ হইতেছিল ৯০% কাজ বঙ্গদেশের কোন স্কোয়ারফুটে হইয়াছে। ফলত অসন্তোষ যখন ক্রমবর্ধমান, বাকী ১০% কাজ সমাপ্ত করিবার উদ্দেশ্যে টুনটুন ব্যানার্জি মিডিয়াকে সিধা করিতে মাঠে নামিলেন। তাহা ব্যাকফায়ার করিল। পারিষদরা সাধু কহিলেও, জনগণ খাইল না। প্রতিদিন সহ সব চ্যানেল একদা, তাহাকে মঞ্চের অভিনেত্রী হইতে রূপকথারা রাণী বানাইবার চেষ্টা চালাইয়াছিল। ইহাতে উক্ত মিডিয়াগুলির টি আর পি পড়িতেছিল। জনগণ সাথে নাই দেখিয়া-উহাদের কেও কেও পালটি খাইল। রাণী হইতে খলরাণী হইতে কাহারও ভাল লাগিবার কথা নহে। টুনটুন ব্যার্নাজির ও লাগিল না। ইহার পর, জনগণ তাহাকে ক্রমাগত টুনটুন ব্যার্নার্জি ছাড়িয়া কার্টুন ব্যার্নাজি বলিয়া টিপ্পনি মারিতেছিল। ধর্য্যের বাঁধ ভাঙিল। টুনটুন ব্যার্নাজি, মিডিয়া ছাড়িয়া, নিরীহ জনসাধারনের ওপর পুলিশি প্রমোদকর চাপাইলেন। কার্টুন শেয়ার করিবার সাজা হইল জেল। পরিশদরা কহিল, রুপকথার রাণীকে মাঠে নামাইলে, জেল ত হইবেই। প্রতিদিন কহিল, কাহার এত অশ্লীল স্পর্ধা যে টুনটুন ব্যার্নাজির কার্টুন আঁকিতেছ?

টুনটুন ব্যার্নাজিকে বঙ্গদেশের ভাবী টিনটিন বানাইতে যাহারা মাঠে নামিয়াছিলেন, তাহাদের সাপের ব্যাঙ গিলিবার দশা। ফাটা বাঁশে পা পড়িয়াছে। যাহারা তাহার যাত্রাদলে নাম লিখিয়াছিল, তাহাদের কেহ কেহ আজ পঞ্চাশ হাজারী এম পী। বাজনা বাজাইতে যাহাদের দলে স্থান হইয়াছিল, তাহার বুঝিতে পারিতেছেন না, শ্রোতারা সভাস্থল ছাড়িয়াছেন কি না। শুধু বঙ্গবাসী বুঝিতেছে , পরিবর্তন নাটকের যবনিকা পড়িতেছে।

Friday, March 30, 2012

মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী!

মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী,

আপনাকে শতকোটি প্রণাম। নিন্দুকেরা থাকুক সিন্দুকে, প্রতিদিন পৌঁছে দিন প্রতিটি লোকের কাছে। চক্রান্তকারী বাঙালী চিরকালই অকৃতজ্ঞ। বিদ্যাসাগরের অমোঘ প্রবাদ বাক্যটি আপনার মনে আছে নিশ্চয়- আমার ক্ষতি করছ কেন? আমি ত তোমাদের কোন উপকার করি নি!!

আপনি বাংলার মসনদে আসার পর কুনাট্যে মজিবে বঙ্গ-এমন কত লেখা লিখেছিলাম। এখন এসব আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে-নেহাত ইন্টারনেটে লিখি-তাই পোড়াতে পারছি না বলে ভীষন আফশোস হচ্ছে!

বর্তমান আর আনন্দবাজার এমন পালটি খেল? খেলাটা আপনার সাথে না সারদা গোষ্ঠির সাথে? না কুনাল ঘোষের উত্থানে, রতিকান্তবাবু ঈর্ষার জ্বরে কাঁপছেন? শোনা যাচ্ছে বা উক্ত ব্যক্তিটি যখন আপনার সাথে সিপিএমের হাতে মার খেয়েছেন, কুনাল বাবু তখন আজকালের হয়ে আপনার নিন্দা রচনায় হাত পাকাচ্ছেন। আজ সেই কুনাল ঘোষ আপনার ছায়াসহচর-আর রতিবাবু কান্নাকাটি করছেন, আমাকে চিনতে পারছিস না মা? আমি সেই রতিকান্ত, তোর নিউজ কভারেজ করতে গিয়ে কত মার খেয়েছি!!! ছাড়ুন ত এই সব প্যানপেনে রতিকান্ত নালায়েকদের । শাসন করতে দরকার তোষক দাশগুপ্ত এবং তার কাছে হাতেখড়ি করা কুনাল ঘোষেদের। আরে বাবা শাসন করা অত ইজি?? যতই গণতন্ত্র বলে চিৎকার করুক লোকে কানমলে দেওয়া দিদিমনি ছাড়া এই তল্লাটের বদলোকগুলোকে কেও আটকাতে পাড়বে না ম্যাডাম। এই দেখুন না -আপনার টাইট খেয়ে আপনার মন্ত্রীরাও জানে না, তাদের পেছনে চেয়ারটি আছে কি নেই! তবে প্রবলেম হচ্ছে ম্যাডাম-চাষীরা ত মরছে, মেয়েদের ওপর ধর্ষনের অভিযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে, আর আপনার ভাইদের মধ্যে গোষ্টিদ্বন্দও বাড়ছে। তবে এসব সমস্যা না ম্যাডাম। মূল সমস্যা হচ্ছে সিপিএমের কুশাসনের স্মৃতি আস্তে আস্তে এক বছরে অনেকটাই ফিকে!
ওরা শীতঘুমে ব্যস্ত-কংগ্রেস আর বর্তমান এখন এরাজ্যের একমাত্র বিরোধি দল। "ওরা", "ওদের" দেখিয়ে ত আর কোন মাইলেজ পাবেন না- কারন ওরা এখন গর্তে। ফলে কাজ দেখাতে হবে। সেটাই বা করবেন কি করে? হাঁড়িতে ত চাল নেই-ভাত দেবেন কোথা থেকে?

এতএব ম্যাডাম আপনার লাইনটা একদম ইতিহাসের কপিবুক। স্তালিন হলডোমারের দুর্ভিক্ষের সময় আমাদের এটা শিখিয়ে ছিলেন। মিডিয়া আর পলিটিক্যাল কোরিওগ্রাফির চর্চা। মিডিয়ার ভূমিকা সর্বজন বিদিত। আমার এক রাশিয়ান কলিগের কাছ থেকে শুনেছিলাম স্টালিন জমানার এক অদ্ভুত গল্প। তারা বাবা নাকি এখনো বিশ্বাস করে না স্টালিন কোন খুন করেছিলেন- বা স্টালিন কোন বাজে লোক ছিলেন। ওই জেনারেশনের কেওই ওটা বিশ্বাস করে না ! ভারতীয় কমিনিউস্টদয়ের ও কেও এটা বিশ্বাস করে না! যাদের নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন স্টালিন-তারাও না! কারন মিডিয়া। স্তালিনকে কেও দিনে ২৪ ঘন্টা দেখে নি। আপনাকেও দেখে না। মিডিয়া ম্যাজিক যা দেখাবে, মমতা ব্যানার্জি তাহাই! এটাই মিডিয়াজাগতিক নিয়ম। এই নিয়মে যে ঘুঁটি সাজাবে-তারই জিত এই দুনিয়ায়। এতএব এতএব আপনার স্নেহধন্য সারদা গোষ্টি বাংলার সব মিডিয়া চ্যানেল কিনে নিক! এটা কমিনিউজম না-ক্যাপিটালিজম। কমিউনের গদার বদলে ক্যাপিটালের ছিপ ফেলে মিডিয়ার দখল নিতে হয়। আপনি নিয়ে নিন। প্রিন্টের যা খরচ আর ইন্টারনেটের যা প্রচার -আনন্দবাজার, বর্তমানের হরিনাম উঠলো বলে। ধরুন এরা অতীত। বা এদের যত দ্রুত অতীত করা যায়, আপনি তার ব্যবস্থা করছেন দেখে কি ভাল লাগছে!

তবে ম্যাডাম, আনন্দবাজার বা বর্তমান অতীত হলেও জনগণ অতীত হবে না। প্রাচী গোষ্টি যেমন, সিপিএমকে বাঁচাতে পারে নি-সারদা গোষ্টিও তেমন আপনাকে বাঁচাতে পারবে না। বরং এই সব গোষ্ঠি গুলো গুষ্টির পিন্ডি গিলবে, আর গুষ্টি উদ্ধার হবে আপনার। রতিকান্ত বাবুকেই তখন আপনার পাশে পাবেন- তোষক দাশগুপ্তের তষ্য শিষ্য কুনাল ঘোষ কিন্ত তখন ও সরকারের দুধ দুইয়েই বড় হবেন। মানুষ বদলায় না ম্যাডাম। এটাই মহাজাগতিক শিক্ষা। আর শিক্ষা না নিলে মহাজাগতিক নিয়মেই পরিবর্তন হয়ে থাকে বলে নিন্দুকেরা রটিয়ে থাকেন।

-শ্রী বিপ্লব পাল!

Thursday, January 19, 2012

বি এস এফ ভারতের জাতীয় কলঙ্ক


বছর খানেক আগে ১৬ বছরে এক কিশোরীকে মরা পাখীর মতন কাঁটাতারের বেড়াতে ঝুলিয়ে দেওয়ার রেশ শেষ না হতেই বি এস এফের, আরেক ভিডিও ভারতের জাতীয় লজ্জার কারন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

এই ভিডিওতে যেখা যাচ্ছে , বি এস এফের ১০ জওয়ান , বাংলাদেশের এক গরু চোরাচালানকারী হাবু শেখকে উলঙ্গ করে পেটাচ্ছেঃ


সীমান্তে গরুর চোরাচালান একটি বিশেষ সমস্যা। এবং এর পেছনে যদি কেও দায়ী থাকে- সেটা হচ্ছে বি এস এফ নিজে। এরাই এই সব গরু চোরাচালানকারীদের কাছ থেকে টাকা নেয় এবং গরুর চোরাচালানের সব থেকে বড় পার্টনার। বাংলাদেশের এই হাবু শেখ বা হতভাগ্য গরীব লোকগুলি হচ্ছে "ক্যারিয়ার"- যারা পেট চালাতে এপার কার মাল ওপারে করে থাকে। এই চোরাচালানের আসল কেষ্ট বিষ্টু হচ্ছে ভারত এবং বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকার কিছু মহাজনি ব্যক্তি-যারা এই ব্যবসাতে টাকা খাটায় এবং হাবু শেখের মতন হত দরিদ্রদের ক্যারিয়ার হিসাবে নিয়োগ করে-বি এস এফ এবং বিডিয়ার কে ম্যানেজ করে।

আমি সেই প্রসঙ্গে আসছি না। প্রশ্ন হচ্ছে একটি পেশাদারি বাহিনী যদিও কোন চোরাচালান ধরেও ফেলে, পৃথিবীর কোন আইনেই তাকে এই ভাবে নৃশংস ভাবে পেটাতে পারে না। সীমান্তে চোরাচালানের বিরুদ্ধে আইন আছে এবং আইন মোতাবেক তাকে পুলিশের কাছ হস্তান্তর করে কোর্ট তোলা উচিত ছিল। এই ভাবে একজন গরীব লোককে পেটানোর মধ্যে আদিম আদিবাসী "মব" মানসিকতা কাজ করে। এই সব নৃশংসতা, শুধু ডকুফ্লিমের মাধ্যমে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান এবং জার্মান সেনাবাহিনীর মধ্যে দেখতে অভ্যস্ত আমি। ভাবতে পারছি না-কিভাবে একটা পেশাদার সেনাবাহিনী এই ধরনের কাজ করতে পারে।

বি এস এফের মানবিকতা বিরোধি কার্যকলাপের লিস্টটা দীর্ঘ। গত দশ বছরে প্রায় ৭০০ জন বাংলাদেশী এবং ২০০ ভারতীয় বি এস এফের অত্যাচার ও গুলির শিকার হয়েছে।

কিন্ত দুর্ভাগ্যজনক ভাবে দিল্লী বি এস এফকে শোধরানোর চেষ্টা করছে না। বছর খানেক আগে কানাডা কোন এক বি এস এফ অফিসারের ভিসা বাতিল করেছিল এই গ্রাউন্ডে যে এটি একটি কুখ্যাত প্যারামিলিটারী ফোর্স যারা অপেশাদার এবং মানবাধিকার মানে না। এই ঘটনায় দিল্লী কানাডাকে চাপ দিতে থাকে-পররাষ্ট্র মন্ত্রী এস এম কৃষ্ণ বি এস এফের হয়ে সাফাই গাইতে থাকেন এবং কানাডা যেহেতু ভারতের মতন বৃহৎ শক্তির বিরুদ্ধে যাবে না, শেষমেশ কানাডা এই নিশেধাজ্ঞা তুলে নেয়। এই অবস্থায় এস এম কৃষ্ণা নিজের কর্তব্য করেছেন-কিন্ত তার সাথে সাথে বি এস এফের এত দুর্নাম কেন বাজারে সেটা নিয়ে কোন তদন্ত কমিশন বসাতে পারতেন। তাহলেই বুঝতেন এমন অপেশাদার সেনাবাহিনী আফ্রিকার যুদ্ধবাজ জমিদারদের ও নেই। এমনেস্টি ইন্টারন্যাশানালের কাছে এটি একটি "কালো সংগঠন"।

তবে বি এস এফের এই ঘটনাকে ভারতে বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা হিসাবে দেখতে রাজী নই। গত দুই সপ্তাহে পশ্চিম বঙ্গে ছাত্ররা আরাম করে নিজেদের কলেজের প্রিন্সিপালকে পিটিয়ে হাঁসপাতালে পাঠিয়েছে। আর হাবু শেখত কোন এক অন্যদেশের গরীব গরুচোর। আসলে জনসংখ্যার প্রচন্ড চাপে বিরাট অসহিষ্ণু হয়ে বড় হচ্ছে এক প্রজন্ম। তাদের যারা শিক্ষাদিক্ষা দিতে পারত-সেই সব শিক্ষক সমাজ এত অধপতিত যে ছাত্ররা পারলে শিক্ষকেই যখন খুশী পেটাতে পেছ পা হয় না। রাজনৈতিক দলগুলি আবার তাতে ইন্ধন যোগায়। বি এস ফের জওয়ানরা আসে ভারতের সেই সব নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলি থেকে যেখানে এই ধরনের অসহিষ্ণু পরিবেশে তারা বড় হয়েছে। ফলে, হাতে ইনস্যাস রাইফেল পাওয়া মাত্রই তার অপব্যবহার করতে ছারে না। বর্ডার এলাকাতে ধর্ষন, দোকান লুটপাট কিছু এরা বাকী রাখে নি। আর এই ব্যপারে ভারতের আইন ও অসহায়। এদের জন্যে আলাদা মার্শাল আইন। ফলে অপরাধ করেও পার পেয়ে যায় বি এস এফ। এলাকার নির্বাচিত প্রতিনিধিরা মুখ্যমন্ত্রীর মাধ্যমে প্রতিরক্ষামন্ত্রকে অভিযোগ জানালে তবে "কোর্ট মার্শাল" হতে পারে!

প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে বি এস এফের বিরুদ্ধে ভারতের মানবাধিকার কমিশন ও সোচ্চার। বি এস এফের এই পেটানোর ঘটনায় মমতা ব্যানার্জি ও ক্রুদ্ধ হয়ে বি এস এফের হাই কমান্ডের কাছ থেকে উত্তর চেয়েছেন। ফেসবুকের অনেক বাংলাদেশী দেখলাম, এই ঘটনায় ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তি বাতিল-ইত্যাদির দাবী তুলেছেন। তারা ভুল করছেন। বি এস এফের বিরুদ্ধে ভারতের মানবাধিকার কমিশন থেকে আরো অনেকেই

সোচ্চার। অমানবিকতার দেশ হয় না-অত্যাচারীর ও দেশ হয় না। এইসব ঘটনায় ভারত এবং বাংলাদেশের মানবাধিকার কর্মীরা একসুরে বি এস এফকে না চাপ দিলে, ফয়দা লুটবে ভারত আর বাংলাদেশের ধর্মীয় জাতিয়তাবাদিরা। ভারতের জাতীয়তাবাদিরা এই ঘটনায় খুশী-কারন একটা মুসলমান গরুচোরকে পেটানো গেছে। বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদিরাও খুশী-কারন ভারত বিরোধিতার সুযোগ এসেছে।

মানবতাবাদি হিসাবে আমি ভীষন অখুশী-কারন এই ধরনের ঘটনা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ওপর ছায়া ফেলবে। এবং তার জন্যে দিল্লীর বিরাট দায় আছে। এই বি এস এফ বাহিনী জাতীয় কলঙ্ক এবং অপেশাদার মানতে বাধা কোথায়? এদের আরো ট্রেনিং দরকার, দরকার কাউন্সেলিং-দরকার এই ধরনের কাজের বিরুদ্ধে কোর্ট মার্শাল আরো বেশী করে বসানো।

নইলে বি এস এফ, ভারতের লজ্জার আরো অনেক বেশী কারন হবে।

Wednesday, January 11, 2012

স্বামী বিবেকানন্দ-একটি নির্মোহ বিশ্লেষন


(১)

স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে লেখার সমস্যা অনেক-যদিও তার রচনাবলী আমি খুব ছোটবেলা থেকে পড়ছি। তার প্রতিষ্ঠিত বিদ্যায়তনেই আমার শিক্ষা- তবুও বিবেকানন্দকে নিয়ে মৌলিক কিছু চিন্তা লিপিবদ্ধ করা বেশ কঠিন কাজ। মূল সমস্যা এই যে, বিদেশে যাকে ক্রিটিক্যাল দৃষ্টিভংগীতে প্রবন্ধ লেখা বলে, সেই ধরনের লেখা বিবেকানন্দের ওপর নেই। বিবেকানন্দের জীবনী ভাষ্যকাররা মহান বিবেকানন্দর সন্ধানেই লিখে গেছেন। অবস্থা এত খারাপ, একবার বিবেকানন্দর ওপর সব থেকে বড় স্যোশাল ফোরামে আমাকে তাড়ানো হয় এই অপরাধে যে আমি একটি নিরীহ তথ্য দিয়েছিলাম- শেষ জীবনে বিবেকানন্দ অনুতাপ করেছিলেন, কেন গৃহী না হয়ে সন্নাস্যী হয়েছেন-আরেকবার জন্মালে আর সন্ন্যাসী হবেন না, বে-থা করে গৃহীই হবেন।

তথ্যটি সত্য। শুধু তাই না, বিবেকানন্দ নিজের মায়ের দেখভাল করতেন, ভাইএর চাকরির জন্যে তদারকি করেছেন এবং পৈত্বৃক বসত বাড়ির শরিকি মামলার সাথেও ছিলেন। এর কোন কিছুই যদিও তাকে ছোট করে না, তবুও তার ভক্তবৃন্দ তাকে "সাইক্লোন সন্ন্যাসী" হিসাবেই দেখতে পছন্দ করেন বেশী।

সমস্যা আরো বেশী গভীরে। গান্ধী, নেহেরু, নেতাজি থেকে আপামর মহান ভারতীয় নেতারা যে "একটি" ব্যক্তিতে আপ্লুত ছিলেন তিনি বিবেকানন্দ। সাম্প্রতিক অতীতের প্রায় সবকটি জরিপে,তিনিই সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ভারতীয়-গান্ধীর থেকেও স্বামীজি বেশী জনপ্রিয়।

তার বাণী ভারত সহ পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িতে দিতে কেন্দ্রীয় সরকার প্রায় ১৫০ কোটি টাকা খরচ করবে এই বছরে। শুধু সেকালের টাটা রা না, একালেও ভারতের প্রায় সব সবশ্রেণীর নেতাদের ( কর্পরেট, রাজনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ) প্রথম পছন্দের নাম স্বামীজি। ডান, বাম, হিন্দু, মুসলমান, খৃষ্ঠান প্রায় সব শ্রেনীর লোকের কাছেই তিনি প্রিয় ব্যক্তিত্ব। নহেরু, গান্ধীকে নিয়ে অনেক মতভেদ। ভারতীয় জাতিয়তাবাদিরা এদের পছন্দ করে না। বিবেকানন্দকে নিয়ে কোন সমস্যা নেই। প্রবীর ঘোষের মতন হাতে গোনা কয়েকজন যুক্তিবাদি বা নরসিংহমের মতন গবেষক ছারা, আর কেওই সেই অর্থে বিবেকানন্দের সমালোচনা করেন নি।

(২)
কিন্ত এখান থেকেই আমার প্রশ্ন শুরু। বিবেকানন্দ ভারতকে বা এই পৃথিবীকে কি দিয়ে গেছেন, যে আজকে সবাই তাকে সর্বকালের সেরা ভারতীয় বলে মেনে নিচ্ছে?

তিনি দর্শন শাস্ত্রে মৌলিক কোন অবদান রাখেন নি। প্রাচীন ভারতীয় দর্শনকে, আধুনিক মোরকে হাজির করেছেন। এটা ঠিক বিবেকানন্দ রচনাবলী না পড়লে ভারতীয় দর্শন গভীরে বোঝা সম্ভব না। ধর্ম জিনিসটা ঠিক কি-সেটাও বিবেকানন্দ পড়েই আমার শেখা। তিনি একজন আধুনিক ভাষ্যকার। এই পর্যন্ত।

বিবেকানন্দের রাজনৈতিক এবং সমাজ চিন্তা বালখিল্যতা বললে কম বলা হবে।

প্রথমে তার রাজনৈতিক চিন্তার বিশ্লেষনে আসব। ভারতের উন্নতির জন্যে বৃটিশ শাসনের হাত থেকে মুক্তি দরকার-সেই নিয়ে তার সংশয় ছিল না। বৃটিশ ভারতের রাজনৈতিক কাঠামোতে কিভাবে দরিদ্র ভারতীয়রা নিষ্পেষিত হচ্ছে, নিচূ জাতের লোকেরা শোষিত হচ্ছে, সেই নিয়ে তিনি সরব ছিলেন। সেই জন্যেই তিনি ভারতীয় বিপ্লবীদের মন্ত্রগুরু। কিন্ত মুক্ত ভারতের রাজনৈতিক ভিত্তি কেমন হবে-তার জন্যে জাপানকে আদর্শ মনে করতেন। জাপানের ন্যাশালিস্টিক ফ্যাসিজম তার ভাল লেগেছিল। অতীতকে স্মরণে রেখে, জাতিগর্বে উৎসাহিত হয়ে, বস্তুবাদি উন্নতি করতে হবে। জাপানের মতন "ডিসিপ্লিনড" জাতি চাইছিলেন তিনি।

" Only I want that numbers of our young men should pay a visit to Japan and China every year. Especially to the Japanese, India is still the dreamland of everything high and good. And you, what are you? … talking twaddle all your lives, vain talkers, what are you? Come, see these people, and then go and hide your faces in shame. A race of dotards, you lose your caste if you come out! Sitting down these hundreds of years with an ever-increasing load of crystallized superstition on your heads, for hundreds of years spending all your energy upon discussing the touchableness or untouchableness of this food or that, with all humanity crushed out of you by the continuous social tyranny of ages – what are you? And what are you doing now? … promenading the sea-shores with books in your hands – repeating undigested stray bits of European brainwork, and the whole soul bent upon getting a thirty rupee clerkship, or at best becoming a lawyer – the height of young India’s ambition – and every student with a whole brood of hungry children cackling at his heels and asking for bread! Is there not water enough in the sea to drown you, books, gowns, university diplomas, and all?"

অর্থাৎ তার মতবাদ এই রকম- অভুক্ত জাতিকে আগে খেতে দিতে হবে। ভারতের ধর্মীয় সংস্কার এবং অহংকার ছেরে, আগে জাতিকে খাওয়ানো পড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। পেটে ভাত না থাকলে, বস্তুবাদি উন্নতি না হলে, সেই জাতির আত্মমর্যাদা থাকে না। সেই জন্যে জাপানের থেকে শেখ!

আপাত দৃষ্টিতে বিবেকানন্দের এই "মহান ভারত সত্ত্বার" শক্তিশালী লেখনীতে আমিও উদ্বেলিত হতাম। কিন্ত সমস্যা হচ্ছে এই, ইউরোপ, জাপানে ফ্যাসিজিমের উত্থানের পেছনেও ঠিক এই ধারনাই কাজ করেছে। রাজনৈতিক শক্তি দিয়ে জাতিকে গণউত্থানের এই চেষ্টা ফ্যাসিজমের ধাত্রীগৃহ এবং জাপানে উনি যেটা দেখেছেন সেটা একটা প্রাক-ফ্যাসিস্ট সমাজ। তার লেখাতে গণতান্ত্রিক ভারত অনুপস্থিত। বরং বিবেকানন্দের ভারতের সাথে "ফ্যাসিস্ট জাপানের" মিল পাওয়া যাচ্ছে। তার রাজনৈতিক ধারনাতে সবথেকে বেশী অনুপ্রাণিত ছিলেন নেতাজি। এবং নেতাজির মধ্যেও ফ্যাসিজমের ভূত এমন ভাবে চেপে বসেছিল, তিনি হিটলারের সহযোগী হতে রাজী হলেন। নেতাজি জার্মানীতে তিন বছর ছিলেন (১৯৪১-৪৩)-এবং এমন একটা সময়ে যখন জার্মানী গোটা ইউরোপকে ধর্ষন করছে। এর পরেও তিনি অবলীলা ক্রমে নাৎসিদের সাথে একসাথে থাকলেন তিন বছর কারন ফ্যাসিজমের প্রতি তার দুর্নিবার আকর্ষন ছিল। নেতাজীর রচনাবলি পড়লে পরিস্কার হয়, তিনি ছিলেন বিবেকানন্দের রাজনৈতিক মানস সন্তান। তবে আমার এই সিদ্ধান্তও হবে অকালপক্ক-সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি।

এবার আসি আমেরিকান সমাজ প্রসঙ্গে। স্বামীজি দেখলেন, আমেরিকাতে ব্যবসায়ীরা সমাজ গড়ে-তারাই সব থেকে বেশী সন্মান পায়। আর ভারতে ব্যবসায়ী সমাজকে সঙ্গত কারনেই চোর ডাকাতের সাথে তুলনা করা হয়। সেই অবস্থা আজকে ১০০ বছরেও বদলায় নি। কারন আমেরিকাতে ধণতন্ত্র এসেছে কৃষকদের বণিক হিসাবে রূপান্তরের সাথে সাথে। আর ভারতের ধনতন্ত্রে বণিক শ্রেনী পরজীবি একটা কমিউনিটি যা বৃটিশরা তৈরী করে দিয়ে গিয়েছিল। আমেরিকান ধণতন্ত্রের সমস্ত ভালদিক গুলি তার চোখে পড়ল এবং তার উচ্ছাসিত প্রশংসা করেছেন তিনি। আমেরিকান লিবার্টিকে বা মানবমুক্তিকে উন্নতির প্রথম সোপান হিসাবে ঘোষণা করলেন।

ব্যাপারটা হল এই যখন যেটা ভাল লেগেছে, সেটাকেই তিনি মডেল করে দিতেন। জাপানের তিনি উচ্ছাসিত প্রসংশা করেছিলেন-কিন্ত জাপানিজরা সেই সময় মোটেও মুক্ত সমাজ ছিল না। আমেরিকাতে গিয়ে তিনি যা বলেছেন, সেটা মানতে গেলে, জাপানের সমাজের মতন নিকৃষ্ট সমাজ নেই-কারন তারা খুবই ফ্যাসিস্ট এবং টোটালাটারিয়ান রিপাবলিকে বিশ্বাস করত। আবার আমেরিকার মতন মানব মুক্তি দিতে গেলে, আমেরিকান ব্যক্তিস্বতন্ত্রবাদকেও মেনে নিতে হয় যা ভারতীয় দর্শনের সামাজিক কর্তব্যের সম্পূর্ন বিপরীত।

মোদ্দা কথা সামাজিক দর্শনের ব্যাপারে তার লেখাযোখা প্রায় শ্লোগান সর্বস্য। অভিজ্ঞতা নির্ভর। এম্পিরিসিজম থেকে স্ট্রাকচারালিজমে তিনি যান নি। গভীরে তিনি ঢোকেন নি- গভীরে ঢোকার মতন রাজনৈতিক, সামাজিক বা ঐতিহাসিক জ্ঞান তার ছিল বলে মনে হয় নি।

এই ধরনের পরস্পর বিরোধিতা বিবেকানন্দ চরিত্রের ছত্রে ছত্রে। তাতে অসুবিধা নেই। এর থেকে বোঝা যায় তিনি মুক্তমনের অধিকারি ছিলেন, তার মনে দ্বন্দ ছিল। এবং মনে দ্বন্দ থাকাই মনের উন্নতির প্রাথমিক শর্ত। নিজের অভিজ্ঞতার কাছে তিনি সৎ থেকেছেন। কিন্ত রাজনৈতিক বা সামাজিক দর্শনের চর্চা তিনি গভীরে গিয়ে করেন নি।

(৩)
এবার আরেকটি বিতর্কিত টপিকে আসি। নারীমুক্তি নিয়ে বিবেকানন্দের ভাবনা।

ইউরোপ এবং আমেরিকাতে তার শিষ্যর থেকে শিষ্যা বেশী ছিল। নারী মুক্তি এবং নারীর অধিকারের সাম্যতা নিয়ে তিনি দেদারসে শ্লোগান দিয়েছেন। এবং বেদান্তের চোখে নারী-পুরুষ সমান সেটা তার লেখাতে অনেকবার এসেছে। কিন্ত হিন্দু ধর্মে নারীর অবস্থান বা সব ধর্মে নারীর অবস্থান এত বাজে কেন-সেই নিয়ে কোন বিশ্লেষন তিনি করেন নি। করলে, ধর্মের সাথে ঐতিহাসিক সামাজিক শক্তির গুলির বিন্যাস তার চোখে পড়ত। বরং এই ব্যাপারে তার লেখালেখি অনেকটাই চটকদারি মন্তব্য-
The soul has neither sex, nor caste nor imperfection."

"The best thermometer to the progress of a nation is its treatment of its women."

" There is no chance for the welfare of the world unless the condition of women is improved."

"Woman has suffered for aeons, and that has given her infinite patience and infinite preserverance."

"The idea of perfect womanhood is perfect independence."


এরপরেই আবার লিখলেন, ভারতে "নারীর" আদর্শ হচ্ছে মা-ইউরোপে "স্ত্রী"।

আরো লিখলেন, ভারতে নারীকে দেবীজ্ঞানে গৃহে পুজো করা হয়। যদিও বাস্তব হচ্ছে, ভারতে সেই সময় এবং কিছু কিছু সমাজে এখনো নারীর অবস্থান গৃহের গাভীর থেকে কিছু কম। গৃহবধূ হত্যায় ভারত সবার ওপরে। পৃথিবীতে প্রায় ৫৪০ রকমের "বিবাহের" সন্ধান পাওয়া গেছে-এর মধ্যে মোটে চার রকমের বিবাহে বরকে পণ দেওয়া চালু আছে। ভারতীয় সমাজ তাদের অন্যতম। এবং ভারতে মেয়েদের এই বাজে আর্থসামাজিক অবস্থানের জন্যে হিন্দু ধর্মের দায় সব থেকে বেশী।

হিন্দু ধর্মে জাতিভেদের বিরুদ্ধে বিবেকানন্দ যদিও বা কখনো সখনো লিখেছেন ( আবার বিদেশে জাতিভেদকে সমর্থন ও করেছেন ) হিন্দু ধর্মে নারীর করুণ অবস্থানের বিরুদ্ধে তিনি এক লাইন ও লেখেন নি। হিন্দু সমাজে নারী দুরাবস্থা নিয়ে অবশ্যই লিখেছেন। কিন্ত তার উৎসস্থল যে হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলি সেটা স্বীকার করেন নি, বরং এটাই দেখানোর চেষ্টা করেছেন, আদি বৈদিক সমাজে নারীর স্থান ছিল উঁচুতে- ব্রাহ্মনদের চক্রান্তেই এই অবস্থানের অনুন্নতি

In what scriptures do you find statements that women are not competent for knowledge and devotion? In the period of degeneration, when the priests made the other castes incompetent for the study of the Vedas, they deprived the women also of all their righ ts. Otherwise you will find that in the Vedic or Upanishadic age Maitreyi, Gargi, and other ladies of revered memory have taken places of Rishis through their skill in discussing about Brahman. In an assembly of a thousand Brahmans who were all erudite in the Vedas, Gargi boldly challenged Yagnavalkya in a discussion about Brahman. Since such ideal women were entitled to spiritual knowledge, why shall not the women have same privilege now? What has happened once can certainly happen again. History repeats itself. All nations have attained greatness by paying proper respect to women. That country and that nation which edo not respect women have never become great, nor will ever be in future. The principal reason why your race h! ! ! ! as so much degenerated is that you have no respect for these living images of Shakti. Manu says, "Where women are respected, there the gods delight; and where they are not, there all works and efforts come to naught." There is no hope of rise for that fam ily or country where there is no estimation of women, where they live in sadness. (V7. p.214-15)

সমস্যা হচ্ছে পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোন সমাজ আসে নি যা পুরুষবাদি ছিল না। অধিকাংশ নৃতত্ত্ববিদদের মতে অতীতের নারীবাদি সমাজের কল্পনা একধরনের মিথ [১]।

নারীবাদের উত্থান মূলত শিল্প বিপ্লবের সাথে এবং শিশুমৃত্যু হার কম হওয়ার সাথে সাথে। যার জন্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধর সময় থেকে নারীরা কাজে যাওয়া শুরু করে। সব ধর্মই নারীকে ঘরে ঢুকিয়েছে-কারন সমাজের রিপ্রোডাক্টিভ ফিটনেস বজায় রাখতে সেটাই দরকার ছিল। হিন্দু ধর্ম কোন কালেই তার ব্যতিক্রম ছিল না- বরং তা পুরুষবাদি সমাজের উজ্জ্বল উদাহরণ।

মোটামুটি বিবেকানন্দ জীবনীতে যেটুকু দেখছি- বিদেশী নারীর কাছে তিনি নারীবাদি, হিন্দুর কাছে তিনি হিন্দু, বিদেশীদের কাছে তিনি আধ্যাত্মিক, জাপানীদের কাছে তিনি জাপানের জাতিয়তাবাদের ভক্ত!

মোদ্দা কথায়, হিন্দু ধর্মের দোষগুলিকে ঢেকে যেভাবে তিনি হিন্দু ধর্মের মার্কেটিং করেছেন, তা এক কথায় অসাধারন।

(৪)
এর পরেও আমি লিখব বিবেকানন্দ কিছু কিছু দিকে সত্যিই অসাধারন ছিলেন। সেটি হচ্ছে তার সাংগঠনিক ক্ষমতা এবং মানুষকে ভাল কাজের জন্যে অনুপ্রেরিত করার ক্ষমতা। মানবিক শক্তিগুলির এবং গুণের বিকাশের জন্যে তিনি জ্ঞানের থেকেও উপলদ্ধির ওপর জোর দিতেন। সফল সংগঠক হতে গেলে মার্কেটিং করার দক্ষতা লাগেই এবং তার কাছে বিশুদ্ধ জ্ঞানের প্রত্যাশা করাটা ঠিক না। মানবসেবায় সফল সার্থক বিবেকানন্দকে মেনে নিতে আমার আপত্তি নেই। আপত্তি আছে "সমাজ বিপ্লবী, স ংস্কারক" বিবেকানন্দকে মেনে নিতে।

আমার মূল আপত্তি অন্ধ বিবেকানন্দ ভজনায়। বিবেকানন্দ সংস্কার মুক্ত, নির্ভীক ভারত চেয়েছিলেন। তার সাধ শতবর্ষে যে ভারত আমরা পাচ্ছি, সেই ভারত কিন্ত আজো অন্ধ কুসংস্কারে নিমজ্জিত। উত্তর প্রদেশে ভোট হচ্ছে জাতের ভিত্তিতে। আজও। বরং পশ্চিম বঙ্গে জাতপাত তুলনামূলক ভাবে অনেক কম-এবং সেই কমার পেছনে বাংলাতে বাম আন্দোলনের ভূমিকা আছে। বিবেকানন্দের প্রচার বা বাণীতে ভারতের জাতিভেদ বা হিন্দু ধর্মের বজ্জাতি যার বিরুদ্ধে বিবেকানন্দ সরব ছিলেন-কিছুই কমে নি। বধূহত্যা অব্যাহত।

তাহলে বিবেকানন্দের ভুলটা কোথায় ছিল? কেন তার জাতিভেদ মুক্ত, সাম্যের আদর্শে দীক্ষিত নীর্ভিক ভারতের আজও জন্ম হল না?

কারনটা এই যে বিবেকানন্দ হিন্দু ধর্মকে আক্রমন করেন নি। বরং লোককে আরো হিন্দু ধর্মে গর্ব অনুভব করতে বলেছেন। তার চিন্তায় হিন্দু ধর্ম ভাল- সমাজ তাকে বাজে বানিয়েছে। এগুলি, যেকোন সমাজ বিজ্ঞানীর কাছে অসম্ভব বালখিল্য চিন্তা। ফুকোর ক্ষমতার তত্ত্ব দিয়ে এই ব্যাপারটা দেখলে দেখা যাবে বিবেকানন্দ " কেন্দ্রীয় শক্তি" হিসাবে সেই হিন্দু ধর্মের কথাই বলছেন। এই ধরনের চিন্তাতে "ধর্মের বিরুদ্ধে" রাজনৈতিক শক্তিগুলি দুর্বল হয়। যেটা মুসলিম দেশগুলিতে আরো বড় সমস্যা। কোরান ভাল, মুসলমানরা খারাপ- এই ধরনের চিন্তা আসলেই কোন ধর্ম বিরোধি রাজনৈতিক শক্তির জন্ম দিতে পারে না। আর ধর্ম বিরোধি রাজনৈতিক শক্তির জন্ম না হলে, কোন দেশের ধর্মীয় সংস্কার সম্ভব না। যেটা ভারতের রাজনীতিতে সব থেকে বড় বাস্তব। এখানের গোবলয়ে মার্ক্সীয় পার্টিগুলিকেও জাত ধর্মের সমীকরণ মানতে হয়।

********************

[১] Why men rule- A theory of male dominance : Stefan Goldberg





Sunday, December 18, 2011

অযৌত্বিকতার সন্ধানে

(১)
আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে সর্বত্র ইস্যুভিত্তিক, আদর্শভিত্তিক বিতর্ক। ভিন্নমতের উৎসকি-এই প্রশ্নটা যেকোন তর্ককারীকে প্রশ্ন করলে, স্বভাবসিদ্ধ উত্তর আসবে অন্যপক্ষের অজ্ঞতা। মার্ক্সবাদী হলে বলবে শ্রেণী অবস্থান-অর্থাৎ আমরা সমাজের সে ক্লাসে অবস্থান করি- সেই ক্ষুদ্র কোনের দৃষ্টিতে দেখা অভিজ্ঞানই মতপার্থক্যের কারণ। অন্যদিকে ধার্মিকরা প্রত্যেকেই পরিবার এবং সমাজ থেকে যা শিক্ষা এবং নৈতিকতার আচরন পায়, সেই খুঁটি ধরে বাঁচার চেষ্টা করে। আমরা যুক্তিবাদিরা তাদের যুক্তিহীন প্রথানির্ভর আচরনের জন্যে "নিম্নমানের" বা নীচুবুদ্ধির মানুষ বলে মনে করি।

কিন্ত ভিন্নমতের উৎস কি তাই? অন্যপক্ষের অজ্ঞতা? আমরা কি কখনো গভীরে গিয়ে ব্যপারটা নিয়ে ভেবেছি?

(২)
সামাজিক, পারিবারিক, ব্যক্তিগত যে কোন সিদ্ধান্তই আমরা নিই না কেন-সেটা ঠিক না বেঠিক আমরা কি করে বুঝবো? একটু গভীরে গিয়ে ভাবলে দেখা যাবে, এই ঠিক বা বেঠিক ব্যপারটা পরম কিছু না। সবটাই স্থান-কাল-এবং তার পরেও জীবনের উদ্দেশ্য নির্ভর।

উদাহরণ দিচ্ছি। ধরা যাক -আমাদের একটা উদ্দেশ্য "সৎ থাকা" ।
এখান থেকেই শুরু করি-কারন এই উদ্দেশ্য নিয়ে দ্বিমত থাকা সম্ভব না। এবার ধরা যাক দাঙ্গার সময় অন্য ধর্মের কেও আপনার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। দাঙ্গাকারীরা -যারা আপনার ধর্মের লোক-আপনার বাড়িতে এলে কি আপনি তাদের সত্যি কথা বলবেন? সৎ কথা বলতে গিয়ে তাদের ধরিয়ে দেবেন খুনিদের কাছে? ৯৯% ক্ষেত্রেই, দেখা যাবে, আপনি সততার থেকে "প্রাণ" বাঁচানোর "উদ্দেশ্য" কে ওপরে রেখেছেন।

অর্থাৎ যেকোন সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেই অনেকগুলো উদ্দেশ্যের "সংঘাত" থাকে। আরেকটা উদাহরণ দিচ্ছি। ভারতে মাওবাদিদের বা নক্সালদের কার্যকলাপ। "খতম" লাইন ঠিক কি না-তাই নিয়ে ভারতের কমিনিউস্টদের মধ্যেই আছে দীর্ঘ বিতর্ক। এবং তার মূলে গেলে দেখা যাবে-সেই স্থান-কাল পাত্র। অর্থাৎ বিহার, ঝারখন্ড বা ঐ ধরনের আদিবাসিদের গ্রামে লোকেরা যে অত্যাচারের মধ্যে দিয়ে বাঁচে, তাতে হাতে বন্দুক নিয়ে খতম লাইনে যাওয়াটাকে অনেকেই যৌত্বিক বলে মনে করে। অন্য স্থানে এবং কালে অবস্থান করা কোলকাতার সৌখিন বামবাবুরা তাদের যুক্তিকে "ভুল" বলে প্রমাণ করবে কি করে? এরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখায় যে মাওবাদিদের হাতে মারা গেছে সেই সর্বহারা শ্রেণীর লোকজন। আর তোলা দিয়ে টিকে আছে ঠিকাদাররা। তাহলে কমিনিউজমের কি হইল?

আসলে স্টালিন থেকে অধুনা "শহিদ" কিশেনজির ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে-আদর্শের থেকেও "বেঁচে" থাকার চেষ্টাটাই সিদ্ধান্তকে সব থেকে বেশী প্রভাবিত করে। এই বেঁচে থাকা গোষ্টিগত ভাবে বা ব্যক্তিগত ভাবে হতে পারে। একজন সেনা নিজের প্রাণ দেয়, দেশের লোককে বাঁচাতে। এতে নতুন কিছু নেই। প্রতিটা প্রজাতিই এই ভাবে বাঁচার চেষ্টা করে। ভারতের মাওবাদিদের কমিনিউস্ট ভাবলে ভুল হবে -এদের অধিকাংশই অত্যাচারিত আদিবাসী। হাতে বন্দুক পেয়ে, একটু ভাল ভাবে বাঁচার চেষ্টা করছে।

(৩)
তাহলে জীবনের সব উদ্দেশ্যই কি "জৈবিক" যুক্তিবাদে সিদ্ধ?

আজকাল অনেকেই "চাইল্ডলেস বা চয়েস" থাকছে। এর পেছনে কি কোন বৈজ্ঞানিক যুক্তি আছে? অনেকেই ভাবতে পারেন, পৃথিবীতে এত লোক-এই ট্রেন্ড ও সেই "গোষ্টিগত" ভাবে বাঁচার প্রয়াস। রসদ বাঁচিয়ে। সমস্যা হচ্ছে এই প্রবণতা বেশী ইউরোপের উন্নতদেশগুলিতে-যেখানে জনসংখ্যা দ্রুত হারে কমছে-কিন্ত তাদের লোক দরকার!

তাহলেত চাইল্ডলেস বাই চয়েস রাষ্ট্র বা জৈবিক- কোন যুক্তিবাদেই সিদ্ধ না। তবে চাইল্ড লেস বাই চয়েসের পুরুষ মহিলারা ভুল? তাদের অধিকার নেই নিজের পছন্দের ওপর?

অথবা ধরুন আত্মহত্যার অধিকার। কিছু কিছু দেশ দিয়েছে, অধিকাংশ দেশ দিচ্ছে না। আমারা জীবন শেষ করার অধিকার আমার নেই! এটাই অধিকাংশ রাষ্ট্রের আইন। এর পেছনে যুক্তি এই যে "প্রাণ" এত মহার্হ্য যে প্রাণটা যার, তারো অধিকার নেই সেই প্রাণ নেওয়ার। অর্থাৎ "প্রাণের" মূল্যই অন্তিম " উদ্দেশ্য" হিসাবে ধরা হচ্ছে। মাওবাদিদের খতম লাইনের বিরুদ্ধেও সেই "প্রাণের" দামের যুক্তিটাই সবার আগে আসে।

কিন্ত এটা কি ধরনের যুক্তিবাদ? সব প্রাণই ত মরণশীল-ক্ষণস্থায়ী। সেই ক্ষণস্থায়ী, মরণশীল প্রাণকে আমরা এত মুল্যবান হিসাবে দেখি কেন?

ইতিহাসই বোধ হয় কারন। প্রানকে " ক্ষণস্থায়ী মরণশীল" আলোকে দেখতে গিয়ে স্টালিন-হিটলার যা করেছেন, সেটাই যথেষ্ট বোঝার জন্যে প্রাণ কেন মুল্যবান। কিন্ত তাই যদি হয় তাহলে চাইল্ড লেস বাই চয়েস বা আত্মহত্যার অধিকার কিভাবে সিদ্ধ হয়?

(৪) এই সমস্যাগুলোর মূল এই যে জীবনের আসলেই কোন পরম উদ্দেশ্য নেই। থাকতে পারে না। কারন প্রতিটা জন্মই ক্ষনস্থায়ী। সবকিছুর মৃত্যু অবধারিত। নক্ষত্র, পৃথিবী মানুষ-সবকিছুই একদিন শেষ হবে।

মুশকিল হচ্ছে এইভাবে ভাবতে গেলে, বেঁচে থাকার ইচ্ছাটাই হারিয়ে যায়। হারিয়ে যায় ভাল কিছু করার ইচ্ছাও। থাকে না নৈতিকতার ভিত্তি।

ফলে দেখা যাবে সব ধর্মীয় দর্শনে নানান রকমের রূপকথা সৃষ্টী করে মানুষকে "আশ্বস্ত" করা হয়েছে, নশ্বর জন্ম ক্ষনস্থায়ি বটে-কিন্ত স্বর্গের জীবন চিরস্থায়ী। বৌদ্ধ ধর্মের পুনঃজন্মবাদও ঠিক একই কারনে। যদি কেও জানে এটাই একমাত্র জীবন এবং পরম উদ্দেশ্য বলে কিছু থাকতে পারে না-কোন ধর্মীয় দর্শনের ভিতই দাঁড়াবে না। নৈতিকতার ভিত ও থাকবে না। ফলে পরজন্ম বা স্বর্গের অনন্ত জীবনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধর্মগুলো মানুষকে তার জীবনে উদ্দেশ্য নিয়ে আশ্বস্ত করায়। স্বর্গ বা পরজন্ম যতই অযৌত্বিক গাঁজাখুরি হোক না কেন-নৈতিকতা ভিত্তিক সামাজিক বিন্যাসের বিবর্তনে এদের গুরুত্ব আছে। কারন জীবনে উদ্দেশ্য না থাকলে নৈতিকতার কোন দর্শনই টেকে না। আর জীবনের পরম উদ্দেশ্যের যেহেতু কোন যুক্তিবাদি বা বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই-সেহেতু জীবনের সব উদ্দেশ্যই আপাত, ক্ষণস্থায়ী এবং কিছুটা অযৌত্বিকও বটে। সামাজিক বিবর্তনে ধর্মের আগমন মূলত এই পথেই। কারন পশুকুলে "জীবনের উদ্দেশ্য" জৈবিক-তাদের এত ভাবতে হয় না। কিন্ত মানব সমাজের প্রতিষ্ঠাতে শুধু জৈবিক উদ্দেশ্য যথেষ্ট ছিল না। ফলে ঈশ্বর, স্বর্গ, অনন্ত জীবনের ধারনাগুলি "নির্বাচিত" হয়-কারন তা নীতিভিত্তিক সমাজের ভিত্তিপ্রস্তর ছিল এক সময়।

১০০% যৌত্বিক জীবন বলে তাই কিছু সম্ভব না। আমদের প্রত্যেকেরই জীবনের উদ্দেশ্য আছে যার কিছুটা জৈবিক [ জিনের সূত্রে পাওয়া] কিছুটা সামাজিক ( যা ধর্ম , পরিবার বা সামাজিক আইন থেকে এসেছে) এবং বেশ কিছুটা নিজেদের স্বতন্ত্র চিন্তা। আবার আমাদের জীবনকালের মধ্যেই এই উদ্দেশ্যের বিবর্তন হয়। যৌবনে যে কমিনিউস্ট গেরিলা হওয়ার স্বপ্ন দেখে, পৌঢ়কালে সে মহানন্দে বণিক হিসাবে অর্থ সংগ্রহে ব্যস্থ। জীবনে ধাক্কা পেয়ে আস্তিক থেকে নাস্তিক, নাস্তিক থেকে আস্তিক হয় লোকে। সবার মনেই কিছু দ্বন্দ থাকে। যার মনে যত বেশী চিন্তার দ্বন্দ থাকবে, সে তত দ্রুত বেশী আরো গভীর উপলদ্ধি্র জগতে প্রবেশ করতে সমর্থ হবে। কারন মনে দ্বন্দ না থাকলে নতুন চিন্তার সংশ্লেষ অসম্ভব।

এই সমস্যাটি ও নতুন কিছু না ভারতীয় দর্শনে। অদ্বৈতবাদিরা "মায়ার" ধারনা - জগৎ মিথ্যা, ব্রহ্ম সত্য-অথবা এই বর্তমান জগত আসলেই "আপাত সত্য" -এই ধারনা বহুদিন থেকেই বহন করত। সমস্যা হচ্ছে, ভারতের ইতিহাসের ওপর মায়াবাদের প্রভাব ঋণাত্মক। নিউটন, কোপার্নিকাসদের জন্ম নালন্দাতে না হয়ে, হয়েছে ইউরোপে। কারন, সব দর্শনের এবং ধারনার ধাত্রীভূমি হচ্ছে মানুষ। সুতরাং মানুষের বস্তুবাদি "সারভাইভালের" উন্নতি না করে,কোন দর্শন বা ধারনাই টিকতে পারে না। সুতরাং আমরা চাই বা না চাই- একটা "অযৌত্বিক" বিশ্বাস নিয়ে আমাদের চলতেই হবে। আর সেটা হচ্ছে সবার ওপর মানুষ সত্য। এর কষ্টিপাথরেই বিচার করতে হবে সমস্ত ধর্ম, আদর্শ এবং দর্শনকে।

Thursday, November 3, 2011

গ্রীসের সংকট -সমাজমুখী অর্থনীতির অবসান?

(১)
ছমাস আগের ঘটনা। মেরিল লিঞ্চের এক উচ্চপদস্ত কর্তার বক্তব্য শুনতে এসেছিলাম ক্যাপিটাল আই আই টির একটা পার্টিতে। বিষয় সরকারি বন্ডে ইনভেস্টমেন্ট। কেন করবেন?
উনি বার বার করে বোঝাছিলেন কেন মিউনিসিপ্যাল বন্ডে ইনভেস্ট করা উচিত। আমি একবার থাকতে না পেরে বল্লাম-সেটা কি করে ঠিক হবে? ক্যালিফোর্নিয়াতে অনেক মিউনিসিপালিটি দেওলিয়া ঘোষনা করেছে! আর আপনি বলছেন সেখানে ইনভেস্ট করতে?
ভদ্রলোক বললেন, তেমন আর হবে না। প্রতিটা মিউনিসিপালিটি তাদের খরচ সংস্কার করছে, আয় বুঝে ব্যায় করবে।
আমি বললাম, আপনাদের কথা তারা মানবে কেন?
উনি বললেন, না মেনে ওদের উপায় কি? না মানলে ওরা মিউনিসিপালিটি চালাতেই পারবে না। স্কুল, হাসপাতাল সব বন্ধ হবে।
গ্রীসকে নিয়ে গত দুমাসে যে নাটক হল এবং আজকে যেভাবে প্যাপান্দ্রিও লেজগুটিয়ে রেফা্রএন্ডামের বদলে, লোন প্যাকেজ মেনে নিতে বাধ্য হলেন, তাতে বুঝলাম, মেরিল লিঞ্চের ওই ভদ্রলোক ঠিকই বলেছিলেন।
(২)
যেদিন প্যাপান্ডিও রেফারেন্ডামের ঘোষনা করলেন, সেদিন স্যোশাল মিডিয়াতে তথা কথিত কিছু বামপন্থী লাফাচ্ছিল এবার ধনতন্ত্রের কবল থেকে বেড়িয়ে গ্রীসের লোকেরা নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরা নেবে। আমি অবশ্য জানতাম সেটা হবে না-আসলে প্যাপান্ডিও ক্ষমতায় এসেছিলেন এই সব বামেদের লেজ নাড়িয়ে। তারপর দেখেছেন, গ্রীসের হাঁড়ির হাল এত খারাপ, ধার না করলে, সেনা বাহিনীর বেতন পর্যন্ত হবে না। আন্দোলন করে, চলছে না চলবে না বলে ত আর কর্মীদের মাইনে দেওয়া যাবে না। যাইহোক, শেষে চাপ খেয়ে, তাকেও ব্যায় সংকোচ, অর্থাৎ সামাজিক খাতের নানান ব্যায় হ্রাস করতেই হচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে ইনি আবার ক্ষমতায় এসেছিলেন, ব্যায় সংকোচনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে। ফলে নিজেদের দলের চাপে একটু সমাজতান্ত্রিক বীরত্ব দেখাতে গিয়েছিলেন রেফারেন্ডামের মাধ্যমে। কিন্ত বিধি বাম। তাতে গ্রীসের ঘরে ঘরে চুল্লী বন্ধ হত। সারকোজি সহ ইউরোপিয়ান নেতারা গ্রীসকে খরচের খাতায় ফেলে দিতেই, প্যাপান্ডি আবার ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে, সব বাতিল করে, ডিল মেনে নিলেন। কারন উনি যে পথে চলছিলেন, তাদের গ্রীসের ধ্বংশ ছিল অনিবার্য্য-সেনা বিদ্রোহের ও ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল। তার থেকে খরচ কাট ভাল।
(৩)
হিসাবটা খুব সহজ। পৃথিবীতে কোন সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক সিস্টেম টেকে নি- টিকতে পারবেও না। কারন এরা যে সিস্টেমটা চাচ্ছে, তাতে উৎপাদন ব্যবস্থার নিম্নগামী হতে বাধ্য। ইউরোপে একটা লোককে কাজে নেওয়া এবং কাজ না পারলে, ছাড়ানো বেশ কঠিন কাজ। তারপরে এত বেশী বেকার ভাতা, পেনসন স্কীম চালু আছে -একজন লোক কাজ করলেও যা পায়, কাজ না করলেও তাই পাবে। কাজ করলে, তার ৫০-৬০% উপায় ট্যাক্সে যায় তাদের খাওয়াতে যারা কাজ করে না। এমন অবাস্তব সিস্টেম বেশীদিন চলতে পারে না। কিন্ত চলছিল ধার নিয়ে। গ্রীচের জিডীপি ২২০ বিলিয়ান ডলার-আর ধার ৩৩০ বিলিয়ান ডলারের কাছাকাছি। এখন যেই আর কেও ধার দেবে না, এই সিস্টেমের কঙ্কালটা ইটালি, স্পেন, পর্তুগাল, ফ্রান্স সবার মধ্যে থেকে বেড়িয়ে আসছে। বৃটিশরা ২০০৮ সালেই ব্যায় সংকোচ করেছে এবং এখনো করে যাচ্ছে। নইলে বৃটেন সবার আগে টসকাতো।
(৪)
সমস্যা হচ্ছে পৃথিবীটা হয় অতিবাম বা অতিডানে ঘুরছে। যার কোনটাই এই সব সমস্যার সমা্ধান না। পাবলিক হেলথ, শিক্ষা-এসবের দ্বায়িত্ব সরকারকে নিতেই হবে। হ্যা-টাকাটা যাতে ঠিক ঠাক খরচ হয়, তার জন্যে কমিনিউনিটি বা পাবলিক প্রাইভেট ভেঞ্ছার করা যেতে পারে। কিন্ত পেনশন, বৃদ্ধদের সম্পূর্ন চিকিৎসার খরচ একটা জাতিকে পঙ্গু করতে বাধ্য। শিশুদের চিকিৎসা বা শিক্ষার যেখানে টাকা নেই, সেখানে বৃদ্ধদের পেছনে বেশী খরচ করা একটি জাতির জন্যে আত্মহত্যা। আমেরিকাতে একজন বৃদ্ধর পেছনে সরকারের খরচ, একজন শিশুর পেছনের খরচের প্রায় ১৪ গুন। ইউরো্পেও প্রায় তাই। আর বৃদ্ধদের ভাল রাখতে গিয়ে, একেকজন শিশুর ওপর চাপছে বিদেশী ঋণের বোঝা। এখন একজন লোক চাকরি করে ৩০ বছর-আর তাকে পেনসন দিতে হবে ৪০ বছর! এই সিস্টে্ম প্রকৃতির নিয়মেই টিকতে পারে না। অবসরের বয়স ৭০ হোক বা সরকার পেনসনের স্থলে ৪০১(ক) এর মতন স্কীম চালু করুক। অবাস্তব মানবিক সিস্টেম ( যা বামেরা বলে) বা চূড়ান্ত বাস্তববাদের নামে বাজারের অত্যাচার কোনটাই আমাদের কাম্য না। সমাধান পেতে গেলে আমাদের বাস্তববাদি হতে হবে।