Wednesday, February 12, 2020

অটোমেশন , জীবিকা এবং চাকরি

অটোমেশনের ফলে ধর্ম কর্পূরের ন্যায় উবে যাবে-এটা লিখেছিলাম, দুদিন আগে। প্রচুর প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। যার অধিকাংশই এই রকম- অটোমেশনের ফলে "চাকরি" গেলে খাব কি?
একদম জ্যোতিবাবুর মতন ভয়। ভীত বাম পশ্চিম বঙ্গে কম্পিঊটার ঢুকতে দেয় নি। ফলে কোলকাতা ব্যাঙ্গালোর হয়ে উঠতে পারে নি। বাঙালীরা ব্যাঙ্গালোরে গিয়ে আই টি শিল্প গড়েছে। ভারত বর্ষে সফটোয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং এই মুহুর্তে প্রচুর ভারতীয়র চাকরি (41 লাখ) দিচ্ছে। যার একটির ও অস্তিত্ব ১৯৯০ সালে ছিল না। আমাদের বেড়ে ওঠার স্কুলের দিন দিনগুলিতে [১৯৮০-৯০]-চাকরি বলতে মধ্যবিত্ত বাঙালী বুঝত - সরকারি কেরানী/আমলা/রেল, শিক্ষকতা। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার ভাল ছেলেমেয়েদের জন্য। সব বদলে গেছে। এখন তাদের বড় অংশটাই আই টি শিল্পের সাথে যুক্ত।
কিন্ত এর পরে যে এ আই, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ৪-০, আই ও টি, ব্লকচেইন আসছে, তার ফলে কি হবে?
এটা নিয়ে আগেও লিখেছিলাম। চাকরি থাকবে না। কিন্ত তার মানেই জীবিকা থাকবে না-তা না। চাকরি = জীবিকা না।
চাকরি ব্যপারটা মানুষের বিবর্তনে নতুন। উনবিংশ শতাব্দির আবিস্কার যে মানুষকে ৯-৫ টা কাজ করতে হবে। এটি শিল্প বিপ্লবের দান। কিন্ত শিল্পের প্যাটার্ন চেঞ্জ হতেই, চাকরির মৃত্যুও আসন্ন। তার মানে এই না যে জীবিকার মৃত্যু হবে।
উদাহরন দিচ্ছি। তিনটে।
এক। ম্যানুফ্যাকচারিং। যে কারখানাতে একসাথে প্রচুর লেবার কাজ করে, প্রোডাক্ট তৈরী করে। বর্তমানে আসছে থ্রিডি প্রিন্টিং বেসড এডিডিভ ম্যানুফাকচারিং। যেসব দোকানি, ডিস্ট্রিবিউটাররা আগে ফ্যাক্টরি থেকে জুতো কিনে লোককে বিক্রি করত-এখন থ্রিডি প্রিন্টার কিনে , তারা নিজেরাই জুতো তৈরী করতে পারবে। ফার্নিচার থেকে পোষাক-সব কিছুই এই এডিটিভ ম্যানুফ্যাকচারিং আসছে। ফলে প্রত্যেকে বাড়িতে বসেই অনেক কিছু তৈরী করতে পারবে। দরকার সামান্য ক্যাপিটাল এবং ডিজাইন ট্রেনিং। ফলে ম্যানুফ্যাকচারিং এর লেবারদের ডিমান্ড থাকবে না। কিন্ত সাধারন লোকজন নিজেরাই ম্যানুফাকচারিং করতে পারবে। সেটা দোকান বা ইকমার্স-যে ভাবে খুশি বিক্রি করতে পারে।
দুই। সফটোয়ার শিল্প। গতি যেদিকে, বড় কোম্পানীগুলি খুব বেশীদিন আর নেই। আস্তে আস্তে সব কিছুই মড্যুউল্যার ইকোসিস্টেমের দিকে যাচ্ছে। মাইক্রোসফট, গুগল, আমাজন -বিরাট ইকোসিস্টেম বানাচ্ছে। মূল খাঁচাটা তাদের। এবার তাদের ইকোসিস্টেমে প্রোডাক্ট বানাও। এক্ষেত্রে যেটা হবে- ৪-৫জন বন্ধু মিলে-কোন একটা মড্যুউল আপ করে ইকোসিস্টেমে দিয়ে দিল। এই ভাবে প্রচুর ছোট ছোট সফটোয়ারর দল মিলে, কমপ্লিট ইকোসিস্টেম বানাবে। সিস্টেম ইন্ট্রিগ্রেশন হবে লেগো লাগানোর মতন। বড় কোম্পানী থাকবে না। ফলে ছোট ছোট এন্টারপ্রাইজ সিস্টেম খুব সহযে, ইকোসিস্টেম থেকেই লোকে বানিয়ে নেবে। এতে যেটা সুবিধা হবে, ছোট ছোট ইনোভেটিভ সফটোয়ার কোম্পানীগুলোর ব্যবসা বাড়বে- যেহেতু মার্কেটিং বটলনেক হবে না। বড় সফটোওয়ার কোম্পানীর দরকার হবে না। এক ওই মাইক্রোসফট-গুগুল- এমাজন বাদে। যারা মূল ইকোসিস্টেম -ইনফ্রাটা দেবে।
তিন। কৃষি। এখন যেভাবে ভারতে চাষ হয়-সেটা দশ বছরে যদি না ওঠে, দেশটাই উঠে যাবে। কারন এই চাষে প্রচুর জল লাগে । প্রচুর খরচ। ফলে ভারতে কৃষিজ পন্যের দাম বেশী। মাটির অবস্থা খুব খারাপ। এই চাষ সাসটেনেবল না। ফলে সমবায় করে বড় জমি বানিয়ে আধুনিক কৃষি আনতেই হবে। এতে জমির মালিক- এবং চাষ করার কোম্পানী হবে আলাদা। আমেরিকাতে আমরা এদের কর্পরেট ফার্মিং বলি। এক্ষেত্রেও এখন চাষি পেশাটাই উঠে যাবে। তার বলে কৃষি হবে শিল্প। এবং সেখানে ছোট ছোট টিম কাজ করবে।
সুতরাং জীবিকার বিবর্তন হচ্ছে এবং হবে। চাকরি জীবিকার একটা রূপ। যা দুশো বছর টিকেছে। আর টিকবে না।

অটোমেশন এবং ধর্ম

(১)
কাল বাংলাদেশের তরুন ক্রিকেটটিমকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে অদ্ভুত সব মন্তব্যের সম্মুখীন হলাম।
আমাদের পশ্চিম বঙ্গের হিন্দু বাঙালী এবং বাংলাদেশের মুসলমান বাঙালীদের অনেকেই আমাকে জানালেন-আমি বৃথাই বাঙালী জাতিয়তাবাদের প্রসঙ্গ আনছি। কারন বাংলাদেশ এই মুহুর্তে ইসলামিক নেশন। বাঙালীত্ব দেশটির ভিত্তি না। অবশ্যই সব হিন্দু এবং মুসলমান বাঙালী এই মত পোষন করেন না। কিন্ত যে জাতি বাঙলা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়ে পাকিস্তানের কাছ থেকে নতুন দেশ ছিনিয়ে নিল, তাদের সিটিজেনরা,ভারতের সিটিজেনদের অধিকাংশই যদি মনে করে বাঙলাদেশের ভিত্তি বাঙালী জাতি গোষ্টি না-তাহলে হয় আমি অন্ধকারে আছি- নাহলে তারা ঘৃণার রাজত্বে বাস করছে।
(২)
ধর্মের যে উৎপাত বাংলাদেশ এবং ভারতে দেখা যাচ্ছে সেটা বেশীদিন থাকবে না। খুব বেশী হলে আরেক প্রজন্ম। কারন সেই অটোমেশন।
আসলে কৃষিভিত্তিক সমাজে উত্তোরনের পর, আমাদের সিস্টেমটা এমন ভাবে তৈরী, এখানে একদম নিরেট মাথামোটা, মানে যাদের আই কিউ ৮০ এর নীচে, তারাও চাকরি পায়। কোন না কোন ভাবে করে খেতে পারে। এই ব্যপারটা আর থাকবে না। আস্তে আস্তে চাকরি বা পেশার বিবর্তনটাই এমন ভাবে হবে- শুধু মাত্র যারা চিন্তা করতে পারে, কবিতা গল্প লিখতে পারে-সৃজনশীল লোকজন তারাই করে খেতে পারবে। কারন বাকী কাজ করবে সফটোয়ার-রোবট-নানাবিধ বট।
আমরা আলরেডী সেই বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আমরা যারা এই লাইনে আছি-তারা এটা এখন বুঝছি। বাকীরা আস্তে আস্তে বুঝবে।
ফলে "মার্কেটের" নিয়মেই স্বাধীন চিন্তার লোকজনের চাহিদা বাড়বে হু হু করে।
এখন মার্কেটের চাহিদা এই যে ভারত-বাংলাদেশের লোকজন ধর্মপ্রান হোক। কারন এই মার্কেট ব্ল লেবার মার্কেট। সস্তা লেবারের মার্কেট। এখানে ইঞ্জিনিয়ার -ডাক্তার-বুদ্ধীজীবি-কবি, আসলে সবাই ক্লার্ক। এরা ধার্মিক হবে-এতে আশ্চর্য্য কি। স্বাধীন চিন্তা কাউকে করতে হয় না।
আস্তে আস্তে সেটা বদলাচ্ছে। চোখের সামনেই। কৃষি, টেক্সটাইল, সব শিল্পেই অটোমেশনের জন্য লেবারদের চাহিদা কমছে। আগে ভারতে আই টির কাজ মানে তৃতীয় শ্রেনীর মেইন্টেনান্সের কাজ ছিল। আই টি কুলীর কাজ। বর্তমানে প্রচুর উন্নত স্টার্টাপ তৈরী হচ্ছে। চাহিদা আছে টালেন্টেড লোকেদের। জোগান নেই। মার্কেটে ভ্যাকুয়াম থাকে না। ট্যালেন্টেড লোকেদের চাহিদা থাকলে, উৎপাদন ও হবে।
সুতরাং ম্যান পাওয়ারের এই বিপ্লব অথবা বিবর্তন সাধিত হলে, বাংলাদেশ এবং ভারতে ধর্মের এই প্রাবল্য ফিকে হতে বাধ্য। কতদিন লাগবে সেটা প্রশ্ন। ২০ বছর ও হতে পারে। ৫০ বছর ও লাগতে পারে।
কিন্ত এটা হবেই।
(৩)
এখন একটা প্রশ্ন ওঠে যে ভারত-বাংলাদেশে ডাক্তার ইঞ্জিয়ার বিজ্ঞানীদের মধ্যেই ধর্মের প্রাবল্য বেশী। তথ্য বলে, ভারতের ৫৪% বিজ্ঞানী ধর্মে বিশ্বাসী। মুসলমান বিজ্ঞানীদের মধ্যে এই সংখ্যাটা ৯০%। আবদুস সালামের মতন পদার্থবিজ্ঞানীও ধার্মিক ছিলেন। তাহলে কি গ্যারান্টি আছে- যে যত উন্নত ম্যানপাওয়ারের দরকার হবে, তত ভারত বাংলাদেশের লোকজন নির্ধামিক হবে?
এর উত্তর অনেক ভাবেই দেওয়া যায়।
প্রথমত আমেরিকাতে বিজ্ঞানীদের ৯৫%+ নিধার্মিক বা ঈশ্বর বিশ্বাসী না। কিন্ত ভারত বাংলাদেশে এর উলটো। এর কারন সার্বিক সমাজ। এখানে নিধার্মিক হলে সমাজে "ফিট" করা মুশকিল। কারন গোটা সমাজটার নির্মানই হয়েছে ধর্মের ওপরে। অর্থাৎ "ধার্মিক" হও বা না হও, ভারত বাংলাদেশে ধর্মিক দেখানোর একটার "পজিটিভ" ইকনমিক ভ্যালু আছে। নির্ধামিক হওয়াটা মুসলিম দেশগুলিতে চূড়ান্ত নেগেটিভ ইকনমিক ইনটেন্সিভ।
দ্বিতীয়ত শিক্ষা ব্যবস্থা । ঈশ্বরে, ধর্মে বিশ্বাস সেদিন যাবে-যেদিন "প্রশ্ন" করার সাহস পাবে। এই উপমহাদেশে ক্লাসে প্রশ্ন করলে ছেলেদের ঠাং ভেঙে দেওয়া হয়। অঙ্ক ভুল করলে মারা হয়। ছোটবেলা থেকে বাচ্চাদের মাথায় অসংখ্য ভীতি ঢোকানো হচ্ছে- অঙ্ক ভুল করার ভয়, বানান ভুলের ভয়, পরীক্ষায় ফেল করার ভয়- এত ভয়পূর্ন যাদের মাথা- তাদের মাথায় ভূত এবং ভগবান যে স্থায়ী বাসিন্দা হবেন-তাতে সন্দেহ নেই।
তৃতীয় হচ্ছে রাষ্ট্রের ক্ষমতা- মানুষকে শাসন করতে ধর্মের চেয়ে ভাল টুল আর নেই।
অটোমেশনের সামনে এর তিনটেই আস্তে আস্তে ডাইল্যুউট হবে। স্বাধীন চিন্তার লোকেদের কদর বাড়বে- কারন মার্কেট। শিক্ষা ব্যবস্থা ভীতিপূর্ন হলে, সৃজনশীল ঊচ্চচিন্তার মানুষ কোত্থেকে আসবে? ফলে সেখানেও সংস্কার, আজ না হলে কালকে হবে। মার্কেটের চাপেই হবে। আর যত অটোমেশন আসবে-আস্তে আস্তে রাষ্ট্রের ভূমিকাও আস্তে আস্তে অনেক কমবে । ভারত এবং বাংলাদেশের ব্যবসা এবং মার্কেটের অনেকটাই সরকারের নিয়ন্ত্রনে। মার্কেট রেগুলেশনে অটোমেশন এসে গেলে ( যা আসছে )- রাজনীতিবিদ এবং রাষ্ট্রের ক্ষমতা কমবে। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রেও প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। এসবের নীট ফল, রাষ্ট্রের প্রয়োজন কমবে। ফলে ধর্মের দরকার ও কমবে। ভারত এবং বাংলাদেশের ধর্মের এত বাড়বাড়ন্তের মূল কারন রাষ্ট্র- এবং যারা রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করতে উৎসুক। তারাই পয়সা দিয়ে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ঘৃণা চাষ করে। সবাই যাতে নিজেকে হিন্দু মুসলমান হিসাবে গর্বিত মানুষ ভাবে, সেটাও পয়সা দিয়ে " ম্যানুফাকচারড"। অধিকাংশ মানুষ সেটা বোঝে না। কারন শিক্ষা-মিডিয়া- এখন স্যোশাল মিডিয়া-পুলিশ-আমলা- এসব কিছুর দখল নিয়ে এসব ঘৃনা তৈরী করা হয়। দুই দেশেই এক অবস্থা।
আপনি বলবেন কেন? বাইবেল, ইসলাম, হিন্দু ধর্ম সর্বত্রই ঘৃনার প্রচুর ছত্র আছে। সেখান থেকেই লোকে শিখছে। এটা ভূল ধারনা। কোরান গীতা কেউ পড়ে না-আর পড়লেও তা বোঝার ক্ষমতা খুব কমলোকের আছে। ফলে ধর্মের ন্যারেটিভ ও পয়সা দিয়েই তৈরী হয়-ক্ষমতা দখলের জন্যই। কালকে যদি বাংলাদেশের সরকার বলে ইসলাম মানে এই এই এই- তাহলে সেই দেশের ইসলাম তাই হবে। কোরানে কি আছে তা কেউ দেখবে না । মোল্লারাও না । কারন শহীদ হওয়ার ইচ্ছা তাদের ও নেই। সুতরাং ধর্ম আসলে কি- ধর্ম বলতে লোকে কি বুঝবে-সেটাও রাষ্ট্র আর মার্কেটই ঠিক করে দেয়।
ফলে রাষ্ট্রযন্ত্রকে দুর্বল করতে না পারলে- ধর্ম দুর্বল হবে না।
(৪)
আমি সেই বাংলাদেশের , ভারতের স্বপ্ন দেখি- যেখানে বর্ডার নেই। সেনা নেই। পুলিশ নেই। বা নামে মাত্র আছে। রাষ্ট্র দুর্বল। ফলে ধর্মও দুর্বল। কিন্ত মানুষ সবল।
সেটা ২০৩০ হতে পারে। ২০৫০ হতে পারে। কিন্ত হবেই। যেদিন ভারত এবং বাংলাদেশের বাঙালীর মার্কেট-শিক্ষা-সংস্কৃতি, একসাথে মিশে যাবে।
ধর্ম নিয়ে লোকজন বৃথায় চিন্তা করছে। ওসব আর বেশীদিন থাকবে না। শুধু মার্কেটকে তার নিজের হাতে ছেড়ে দিন। মার্কেট তার নিজের প্রয়োজনে, নিজের বিবর্তনেই ধর্মকে ডাইল্যুট করবে।