আমি মমতা ব্যানার্জির সমর্থনে লিখলেই দেখি শিক্ষিত বাঙালী হাহাকার করে ওঠেন।
মমতা ব্যানার্জি যা করছেন, সব কিছুই ঠিক করছেন, তৃনমূলের শাসন স্বর্গরাজ্য, এমন উন্মাদের দাবী কেউ করছে না। মৌলবাদিদের তোষন করা অবশ্যই তার একটা ভুল কাজ। কিন্ত তাতে তার অর্জনগুলো ছোট হয় না। আমি যে কারনে মমতা ব্যার্নার্জিকে সমর্থন করি- সেগুলো খুব প্রিসাইজলি কোয়ান্টিফায়েবল এবং ট্যাঞ্জিবল
(১) বিজেপি, সিপিএম বা কংগ্রেস দিল্লীর নেতাদের অঙ্গুলিহেলনে চলে। এর ফলে পশ্চিম বঙ্গের ক্ষতি হয়েছে সাংঘাতিক। প্রদেশ কংগ্রেস যে সিপিএমের ৩৪ বছর নিশ্চিত করেছে, তাও দিল্লীর নির্দেশে। তার তার জন্য বাঙালীর পাওনা? ২০০৪ সালে ডিজনি কোলকাতায় এনিমেশন স্টুডিও খুলতে চেয়েছিল। চেয়েছিলেন বুদ্ধদেব। সেই অনুযায়ী কাজ এগোয়। কিন্ত প্রকাশ কারাত জানা মাত্র বুদ্ধকে তলব করে ডিজনি প্রোজেক্ট বাতিল করেন। এতে কোলকাতার শিল্পীদের অনেক ভাল হত। শুধু তাই না। ইউএস ইন্ডিয়া নিউক্লিয়ার ডিলের সময় ও শুধু কারতের জন্য পশ্চিম বঙ্গে অনেক ইনভেস্ট আসে নি। সেই সময় ইউএস ইন্ডিয়া বিজনেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিল রন সমার্স। আমি উনাকে চিনতাম। উনিই বলেছিলেন আমাকে যে তোমাদের মুখ্যমন্ত্রীটি ( বুদ্ধ) ভাল লোক, কিন্ত প্রকাশের জন্য ওই রাজ্যে অনেক আমেরিকান ইনভেস্টমেন্ট আসবে না। মনে রাখতে হবে, ঠিক এই সময় ব্যাঙ্গালোর পুনে হায়দ্রাবাদ আমেরিকান চাকরিতে ফুলে গেল, কিন্ত কোলকাতা পেয়েছিল শুন্য। পশ্চিম বঙ্গের সিপিএম স্বাধীন পার্টি হলেও কিন্ত ওই সেই বুদ্ধরাই অনেক অনেক ভাল কাজ করতে পারত।
আজকের রাজ্য বিজেপির নেতাদের দেখুন, অতীতের দিল্লীর পাচাটা কংগ্রেসের নেতাদের মতন। এটা আবেগ না, ঐতিহাসিক ভাবেই সত্য দিল্লীর পাচাটা নেতাদের দিয়ে পশ্চিম বঙ্গের ভাল কিছু হয় নি। যদি বাংলার সিপিএম বা বাংলার বিজেপি পার্টি তৈরি হয়, তবেই মমতা ব্যার্নার্জি বিকল্প ভাবা যেতে পারে। আদার ওয়াইজ না।
(২) মমতা ব্যানার্জির সব থেকে বড় সাফল্য পশ্চিম বঙ্গে স্ট্রাইক নামক রাজনৈতিক আত্মহত্যা বন্ধ করা। মাত্র সাত বছরে পশ্চিম বঙ্গের চলছে না চলবে না বামপন্থাকে উনি জোর করে না আটকালে রাজ্যের অর্থনীতি আরো বাজে হত। সিটুকে ভ্যানিশ করে দেওয়ার ফলে, এটলিস্ট এখনো পশ্চিম বঙ্গে ছোট মাঝারী শিল্পগুলো আস্তে আস্তে বাড়ছে। এগুলো চোখের সামনেই দেখছি কারন পেশার প্রয়োজনে ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পগুলোতে ঘুরতে হয় । কিছু কিছু শিক্ষিত বাঙালী শিল্প বলতে শুধু আই টি শিল্প , টিসিএস ইনফি বোঝে- তারা দেখতে পাচ্ছে না পশ্চিম বঙ্গে এস এম ই গুলো আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। কেন্দ্রের সমীক্ষাও তাই বলে। হ্যা মমতার এস এই জেড নীতি ভুল। আমি সেটা আগেও লিখেছি। কিন্ত উনি রাস্তাঘাটের উন্নতি এবং স্ট্রাইক বন্ধ করে শিল্পের পথ আস্তে আস্তে খুলেছেন। ৩৪ বছরের বাম শাসনের ফলে পশ্চিম বঙ্গে দক্ষ শ্রমিক বা এডভ্যান্সড আই টি কর্মী খুব কম। সবাই বাইরে। ফলে এখানে শিল্প খোলার সমস্যা এখনো বিশাল। ৩৪ বছর ধরে পশ্চিম বঙ্গ কে শশ্বান বানানো হয়েছে, তা একদিনে সুজলা সুফলা হবে, এমন ভাবা ভুল।
(৩) পশ্চিম বঙ্গের ক্লাস ডিভিশনটা অন্যরকম। এটা কলোনিয়াল শাসনের ফল। এখানে তিনটে ক্লাস। মধ্যবিত্ত বাবু, গরীব শ্রমিক কৃষক, ধনী অবাঙালীরা। মধ্যবিত্ত বাবুদের হাতেই ছিল এদ্দিন ক্ষমতা। সিপিএম সেটাই নিশ্চিত করেছিল। এবং তারা নিজেদের ছেলে বৌএর চাকরি বাইরে কিছু ভাবতে পারত না রাজ্যের জন্য। সিপিএমের ছিল এই মধ্যবিত্ত শ্রেনীকে পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি। মমতা সেখানে শুরু করেছেন গরীবদের পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি। সিপিএম মধ্যবিত্তকে স্কুলের চাকরি দিত। তাতে অর্থনীতির লাভ নেই। কারন স্কুলে কোন পড়াশোনা বহুদিন হয় না। মমতা সেই টাকায় এখন গরীবদের ছাগল মুর্গী দিচ্ছেন, পিঠেপুলি উৎসব হচ্ছে। তাতে গ্রামে অর্থনীতি অনেক বেশী সচল।
(৩) নাম্বার কারনের জন্য শিক্ষিত মধ্যবিত্ত যারা একধরনের সামাজিক পরজীবি হওয়া সত্ত্বেও সিপিএমের আমলে ক্ষমতার শীর্ষে ছিল, তারা মমতার আমলে সিউরলি ভাল নেই! আমিও যেহেতু সেই পরজীবি বাঙালী বাবু শ্রেনী থেকেই উঠে আসা, আমার বন্ধু বান্ধবরাও পছন্দ করছেন না, তাদের ক্ষমতা হ্রাস। কিন্ত এটা তাদের বুঝতে হবে বৃহত্তর বাংলায় ৮০% মানুষের মাসিক ইনকাম ৫০০০ এর নীচে। ভারতের সব থেকে বেশী ভিখিরি এবং বেকার বাংলায়। এদের তুলতে গেলে তিনটে জিনিস আবশ্যক- স্ট্রাইক/ বন্ধ সম্পূর্ন বন্ধ, ভাল ইনফ্রাস্টাকচার এবং সরকার থেকে ক্ষুদ্র সাহায্য-যেমন সরকার থেকে মুর্গী, ছাগল, মাছ চাষে সাহায্য। পরজীবি বাঙালী বাবুদের মুর্গী বা মাছ চাষ বোঝানো অসম্ভব। তারা স্বার্থপর। শুধু বোঝে আরামের স্কুলের চাকরি-মানে সরকারি দানছত্র। না হলে ইনফি বা টি সিএসে ক্লার্কের চাকরি। অধিকাংশ বাঙালীরা কি ভাবে বাঁচবে সেই নিয়ে তাদের চিন্তা নেই।
মমতা ব্যানার্জির অনেক ভুল আছে। কিন্ত তিনি সেগুলো বোঝেন, নিজেই নিজেকে কারেক্ট করেন। কারন তিনি স্বাধীন। কিন্ত দিল্লীর নেতাদের ভুল ঠিক করবেন প্রদেশ নেতারা ? ইতিহাসে সেই উদাহরন কিন্ত নেই।