Sunday, December 28, 2008

হিটলার এবং স্ট্যালিন--কুখ্যাততম খুনী কে? ২য় পর্ব

[আগের পর্ব]

রাজনৈতিক ক্ষমতার সংজ্ঞাই হচ্ছে অন্যের ইচ্ছার বিরুদ্ধে, নিজের সিদ্ধান্ত চাপানো। ক্ষমতার প্রতি লোভ কি এদের প্রথম থেকেই ছিল? স্বৈরাচারের লক্ষন কি তাদের আগের রাজনৈতিক জীবনে দেখা যায়? আদর্শবাদের প্রতি নিষ্ঠাই কি তাদের ক্রমশ ক্ষমতা লোভী করে তোলে? না বিবর্তনের পথে এই ক্ষমতার লোভ আগে থেকেই বিদ্যমান-কিন্ত স্যোশাল ডারউনিজমে প্রভাবিত হয়ে-এই লোভ মারাত্মক আকার ধারণ করে? দুজনের জীবনীতে সব থেকে যেটা সাধারন গ্রাউন্ড-সেটা হচ্ছে দুজনেই মনে করতেন রাষ্ট্র এবং আদর্শের দাম মানুষের প্রাণের থেকে বেশী। একাধিবার দুজনেই বলেছেন মানুষ মরণশীল, তাই রাষ্ট্রের প্রগতির জন্যে মানুষের প্রাণ গেলে তা নিয়ে কান্নাকাটি করে বোকারা। স্যোসাল ডারুনিজমে বিশ্বাসী এ এক মারাত্মক কাল্ট অব ডেথ। হিটলার মনে করতেন জার্মানজাত যেহেতু পৃথিবী সেরা, বাকী নীচু জাতের সম্পূর্ণ বিলোপ বিজ্ঞান সম্মত। স্ট্যালিনের ক্ষেত্রে সেটাই ছিল শ্রেণী শত্রু-কুলাক বা একটু সম্পন্ন চাষিরা। প্রতিবিপ্লবে অভিযুক্ত লোকেরা। আসল ঘটনা হচ্ছে, সেসব ও ঠিক না-স্টালিনের সময় শ্রেফ কোটা ঠিক করতেই, কোটি কোটি নিরাপরাধ লোকের প্রাণ গেছে-যারা না ছিল কুলাক, না ছিল প্রতিবিপ্লবী। যদিও বলাই বাহুল্য-এবং আমি আগেই লিখেছি, জীববিজ্ঞান এবং বিবর্তন থেকে আমরা সম্পূর্ণ উলটো সংবাদই পায়। পর্যাপ্ত খাবার থাকলে পশুরা, নিজেদের প্রজাতিকে প্রায় আক্রমন করেই না, লিভ এবং লেট লিভ-অধিকাংশ স্তন্যপায়ীর জীবন দর্শন। সেই জন্যেই স্যোশাল ডারুনিজম পৃথিবীর সব থেকে ভয়ংকরতম রাজনৈতিক মতবাদ-যা মানুষকে পশুর থেকেও অধম বানিয়েছে। অথচ এর সাথে ডারুনিজমের কোন সম্পর্ক নেই।

ছবি-১-লেনিন এবং ট্রটস্কি আড্ডা দিচ্ছেন

লেনিনের মৃত্যুর পর, স্টালিনের সাথে ট্রটস্কির দ্বন্দ বহুল প্রচলিত হলেও, আসল সত্যটা একটু অন্য। আমরা দুই ভাবে এটাকে দেখবো।

প্রথমত, জোসেফ স্ট্যালিনকি আদর্শবাদের বিশুদ্ধতার কারনে ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে নেমেছিলেন? ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি স্টালিন নাকি আদর্শবাদি কম্যুনিউস্ট! শোধনবাদের বিরুদ্ধেই তার যত লড়াই খুন খারাপি!

ভুল। এসব আসলেই রটনা। আসল সত্য সম্পূর্ণ বিপরীত।

স্ট্যালিন মোটেও বিশুদ্ধ আদর্শবাদি ছিলেন না। একদম প্রথম থেকেই ছিলেন বাস্তববাদি। ১৯২১ সালে ক্ষমতা দখলের লড়াই শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত অন্তত তিনবার মেনশেভিকদের সাথে জোট বাঁধার চেস্টায় প্রমান হবে, স্ট্যালিন আসলেই বাস্তববাদি লোক-তাত্ত্বিক জ্ঞানের চেয়ে, বাস্তবকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। বিশুদ্ধ রাজনৈতিক মতবাদে বরং বিশ্বাস করতেন লেনিন-তাই তিনটি ক্ষেত্রেই মেনশেভিকদের সাথে হাত মেলানোতে তিনিই অন্তরায় হয়ে দাঁড়ান।

(১)১৯০৯ সালের মার্চে জারের পুলিস, প্রায় প্রতিটি বলশেভিক নেতাকে ট্রেস করে ফেলে। বলশেভিকদের রাশিয়াতে টেকা দায়। সেই সময়, জারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে মেনশেভিকদের সাথে হাত মেলাতে চেয়েছিলেন স্টালিন, যা লেনিন নাকচ করেন।

(২) দ্বিতীয়বার ১৯১২ সালের জুলাই মাসে জারের দমন নীতির বিরুদ্ধে, স্টালিন বলশেভিক এবং মেনশেভিকদের এক হওয়ার ডাক দিলেন পার্টির মুখপাত্র প্রাভদাতে। মেনশেভিক নেতাদের সাথে জোট বন্ধন ও করে ফেলেছিলেন-কিন্ত এবার লেনিন দারুণ রেগে গেলেন। প্রাভদার সম্পাদক পদ থেকে বহিস্কার করলেন স্ট্যালিনকে। স্ট্যালিন বাধ্য শিষ্যর মতন লেনিনের তিরস্কার মেনে নিলেন[১]।

(৩)তৃতীয়বার একই ঘটনার পুরনাবৃত্তি আমরা দেখবো ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারী বিপ্লবের পরবর্ত্তী সময়ে মার্চ মাসে। সাইবেরিয়ার মধুচন্দ্রিমা বা নির্বাসন থেকে ফিরে এসে লেভ ক্যামেনেভের সাথে হাত মিলিয়ে প্রাভদার পুরানো সম্পাদকমন্ডলীকে সরিয়ে, সম্পাদক হলেন স্ট্যালিন। এবং কেরেনাস্কির সরকারকে সাপোর্ট করে, বিশেষত কেরেনাস্কিকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী বলে প্রশংসা করে সম্পাদকীয় লিখলেন[১]। শুধু তাই নয়। লেনিন নির্বাসনে থেকেই কেরেনাস্কি সরকারের বিরুদ্ধে বলশেভিক আন্দোলনের ডাক দিয়ে প্রবন্ধ লিখলেন মার্চ মাসে। স্টালিন, ছাপালেন না সেই প্রবন্ধ-সরাসরি লেনিনের বিরুদ্ধে গিয়ে, নাকচ করলেন এই বলে, নির্বাসনে থাকার জন্যে লেনিন গ্রাউন্ড রিয়ালিটি বুঝতে পারছেন না[১]। আমি নভেম্বর বিপ্লব না প্রতিবিপ্লব প্রবন্ধে [২]কেরেনাস্কিকে সমাজতন্ত্রী হিসাবে দেখানোয়, অনেক কম্যুনিউস্টরা আমাকে গালাগাল করেছেন। তারা স্ট্যালিনের এই কেরেনাস্কি স্তুতিকে কি বলে গালাগাল দেবেন? যাইহোক, এপ্রিল মাসে লেনিন ফিরে এসে, বলশেভিক পার্টিকে কেরেনাস্কির বিরুদ্ধে দাঁড় করালেন। স্ট্যালিনকে এবারো বাধ্য করলেন লেনিন।

অর্থাৎ দুটো জ়িনিস খুব পরিস্কার। বলশেভিক এবং মেনশেভিক বিভাজন, একমাত্র লেনিনের জন্যে টিকে ছিল। এবং লেনিনের বিরুদ্ধে বলার মতন বলশেভিক পার্টিতে কেও ছিল না। তার থেকেও বড় কথা স্টালিন নিজেই "শোধনবাদি" ছিলেন-যদিও ওই দোষ দিয়ে নিজে খুন করবেন তার সমস্ত কমরেডদের।

তার থেকেও হাস্যকর হচ্ছে স্ট্যালিন পন্থীরা ট্রটস্কির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার সময় লেলিনের লেখা দুটি চিঠি দেখান। যেখানে ট্রটস্কিকে দলবাজির জন্যে তিরস্কার করেছেন লেনিন। অথচ বাস্তব সত্য হচ্ছে লেনিনই সব থেকে বেশী দলবাজি করেছেন ক্ষমতার লোভে-তার জন্যেই বলশেভিক, মেনশেভিকরা এক হতে পারেন নি। এমন কি ট্রটস্কি ১৯০৫ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত মেনশেভিক ও বলশেভিকদের একত্রিত করতে, অনেক চেস্টা করেছেন। স্ট্যালিন বা ট্রটস্কি দুজনের কেওই দলবাজি আগে করেন নি-বিপ্লবকেই গুরুত্ব দিয়েছেন আগে। তাদের দলবাজি পর্ব শুরু হয়, লেনিন স্ট্যালিনের মধ্যে ক্ষমতার বীজ পুঁতলে। স্ট্যালিনকে ক্ষমতালোভি দৈত্য বানানোর পেছনে, সবথেকে বড় হাত লেনিনের।

১৯১৭ সাল থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত স্ট্যালিন এবং ট্রটস্কি দুজনেই বিপ্লবকে প্রতিষ্ঠিত করতে এত নৃশংসতার পরিচয় দিয়েছেন- লেনিনের হাতে তিরস্কৃত হোন তাদের বর্বরোচিত কাজের জন্যে। জর্জিয়ার ওপর দমন নীতি-এবং কৃষকদের ওপর অত্যাচার করে খাদ্য সংগ্রহের কাজে স্টালিন এত দুর্নাম কুড়িয়েছেন তখন, লেনিন মুখরাক্ষার্থে স্টালিনকে তিরস্কার করতে বাধ্য হন (১৯১৯)[৩]। এদিকে গৃহযুদ্ধ জিতে রেড আর্মির সর্বাধিনায়ক হিসাবে, ট্রটস্কি পার্টিতে নিজের পজিশন শক্ত করেছেন -এমন কি পোলান্ডে স্ট্যালিনের ব্যার্থতার বিরুদ্ধে ট্রটস্কির সমালোচনাও পার্টি গ্রহণ করেছে। মনে রাখতে হবে, লেনিনের ঘনিষ্ঠ সার্কলে ট্রটস্কিকে তখন ও সন্দেহ এবং ঈর্ষার চোখে দেখা হচ্ছে। কারন ট্রটস্কি বলশেভিক পার্টিতে যোগ দেন ১৯১৭ সালের জুলাই মাসে-যদিও লেনিনের সাথে তার বন্ধুত্ব এবং কর্মকান্ড সেই ১৯০২ সাল থেকে। আসলে মেনশেভিক এবং বলশেভিকদের মিলন সম্ভব-এমন ধারনার বশবর্ত্তী হয়েই ট্রটস্কি অনেক পরে বলশেভিক পার্টিতে যোগ দেন। যার জন্যে পার্টিতে তার উত্থানে সবথেকে রুষ্ট ছিলেন, আরেক তাত্ত্বিক-লেভ ক্যামেনেভ। এবং এটাও ঈর্ষার দ্বন্দ-আদর্শবাদের দ্বন্দ মোটেও না। কারন লেনিনের পরবর্ত্তীতে তাত্ত্বিক নেতা কে হবেন-সেই পজিশনটা যখন ট্রটস্কি নিয়ে নিচ্ছিলেন, তখনই রুষ্ট হন ক্যামেনভ। ট্রটস্কি আনুষ্ঠানিক ভাবে বলশেভিক পার্টীতে যোগদানের আগে তিনিই ছিলেন লেনিনের পরে তাত্ত্বিক নাম্বার টু-কে আর নিজের পজিশন হারাতে চাই?

ট্রটস্কির পরবর্ত্তীকালের লেখা থেকে অনেকেরই ধারণা, ট্রটস্কি ছিলেন লিব্যারাল গণতান্ত্রিক-আর স্টালিন স্বৈরাচারী। ১৯২০ সালের বাস্তব সম্পূর্ণ উলটো। বস্তুত ট্রটস্কি ছিলেন অতিবাম-রেড আর্মিকে তিনিই যথাযত নেতৃত্ব দিয়ে দাঁড় করিয়েছিলেন। এবং সেটা করতে গিয়ে, বন্দুকের নলের ডগায় প্রাত্তন সৈনিকদের রেড আর্মিতে ঢোকাতেন। দলছুটদের শাস্তি হত্যা। এবং অবাধ্য হলে স্ত্রী ও সন্তানদের পুলিশ তুলে আনতো সৈন্যদের বাধ্য করাতে। নৃসংশতায় তিনিও কম যাচ্ছিলেন না। যদিও তার মধ্যে মানবিকতাও ছিল-তিনি অকারনে সাধারন মানুষের ওপর অত্যাচার নিশিদ্ধ করেন[৪]। এবং গণতান্ত্রিক ও ছিলেন না ট্রটস্কি। নিজের বিরুদ্ধ মতামত মোটেও সহ্য করতে পারতেন না [৫]। ১৯২০ সালে লেনিনের সাথে বিরোধ বাধল ট্রেড ইউনিয়ান নিয়ে। ট্রেড ইউনিয়ান ভেঙে দিতে চাইলেন ট্রটস্কি। তার বক্তব্য ছিল রাষ্ট্রই যখন শ্রমিকদের, ট্রেড ইউনিয়ান দরকার নেই। লেনিন দ্বিমত পোষন করলেন। লেনিন ও আসলেই ট্রটস্কিতে অতটা পছন্দ করতেন না-কারন ট্রটস্কি ছিলেন ভাবুক প্রকৃতির বুদ্ধিজীবি।

স্ট্যালিনকে ডাকলেন লেনিন। এবং দেখলেন যেহেতু ক্যামেনভ এবং স্ট্যালিন দীর্ঘদিন একসাথে কাজ করেছেন এবং উভয়েই ট্রটস্কিকে অপছন্দ করেন, এদেরকেই ট্রটস্কির বিরুদ্ধে লাগানো যাক। লেনিনের সাপোর্টে তেশরা এপ্রিল, ১৯২২ সালে পার্টির দশম পার্টি কংগ্রেসে, স্ট্যালিন জেনারেল সেক্রেটারি মনোনীত হলেন। এখান থেকেই ক্ষমতার ভুত স্ট্যালিনের মাথায় চেপে বসল। এবং বসালেন স্বয়ং লেনিন। নইলে ট্রটস্কিরই জেনারেল সেক্রেটারী হওয়ার কথা।

লেনিনের তখন অথর্ব। গোর্কির বাগান বাড়িতে স্ট্যালিনের মাধ্যমেই পার্টির সব নির্দেশ পাঠাতেন। ট্রটস্কি তখনও রেড আর্মির সর্বাধিনায়ক। যুদ্ধ সংক্রান্ত ব্যাপারে ট্রটস্কির সাথে সরাসরি যোগাযোগ রাখতেন লেনিন। এবং এখানেই স্ট্যালিনের সাথে লেনিনের শেষ এবং সিরিয়াস গন্ডোগল বাধল। ট্রটস্কির সাথে যোগাযোগ রাখার কাজ করতেন লেনিনের স্ত্রী নাডেজা ক্রুপস্কা। স্টালিন জানতেন না, ক্রুপস্কা এই কাজ করছেন লেনিনেরই নির্দেশে। ফলে ক্রপস্কার সাথে একদিন তার প্রচন্ড ঝগড়া বাধল-এবং পার্টি বহির্ভুত কাজের জন্যে ক্রুপস্কাকে সিফিলিটিক হোর অর্থাৎ যৌনরোগ বাধানো বেশ্যা বলে গালাগাল দিলেন[৬]। আসলে মেয়েদের বেশ্যা বলে গালাগাল দেওয়া স্ট্যালিনের পুরানো অভ্যেস।

Moscow, February 1920 by derAmialtebloede.

ছবি-২ঃ লেনিন এবং তার স্ত্রী ক্রুপস্কা-যিনি নিজেও একজন বড় মার্ক্সবাদি দার্শনিক ছিলেন

ক্রুপস্কা তখন মহাখাপ্পা। লেনিন ও পুরো ঘটনা জেনে অগ্নিশর্মা। স্ট্যালিনের অবজেকশন অন্যায় কিছু ছিল না। সত্যিইত-তাকে পার্টির জেনারেল সেক্রেটারী করা হয়েছে। রেড আর্মির সব নির্দেশ তার হাত দিয়েই ট্রটস্কির হাতে যাওয়ার কথা। এখন লেনিন তাকে পুতুল জেনারেল সেত্রেটারী বানিয়েছেন বলে কি, তারজন্যে প্রটোকোল মানা হবে না? আর মেয়েদের বেশ্যা বলে গালাগাল দেওয়াটা তার জর্জিয়ান অভ্যেস! পিতৃতান্ত্রিক সমাজের অভ্যেস কি আর কম্যুনিজম দিয়ে ধোয়া যায়?

সে যাইহোক লেনিন বুঝলেন স্ট্যালিনের মতন কর্কশ স্বৈরাচারীর হাতে পার্টি নিরাপদ না। স্ট্যালিনকে জেনারেল সেক্রেটারি থেকে সরানোর অনুরোধ জানালেন ১৯২৩ সালের এপ্রিল পার্টি কংগ্রেসে [৭]। সমস্যা হচ্ছে লেনিনের সেক্রেটারীকে আগেই হাত করেছিলেন স্টালিন-ফলে বিপদ আসছে জানতে পেরে, পলিটবুরোতে ক্যামেনভ এবং জিনোভিয়েভের সাথে হাত মিলিয়ে পার্টি কংগ্রেসে স্ট্যালিনকে হঠানোর জন্যে লেনিনের টেস্টামেন্ট পড়তেই দিলেন না। এদিকে ১৯২৩ সালের মার্চ মাসে লেনিনের স্ট্রোক হল। ক্রপস্কা লেনিনকে নিয়ে এত ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন, স্টালিনের এই চেপে দেওয়া আটকাতে ব্যার্থ হলেন। কিন্ত লেনিনের এই লাস্ট টেস্টামেন্টের জন্যেই স্ট্যালিনের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দখল আটকে থাকবে আরো পাঁচ বছর। ১৯২৪ সালে ত্রয়োদশ পার্টি কংগ্রেসে লেনিনের লাস্ট টেস্টামেন্ট পড়াতে বাধ্য করলেন ক্রপস্কা। কি লেখা ছিল তাতে? স্টালিনের স্বৈরাচার এবং অন্যান্য কমরেডদের ক্ষমতার লোভের তীব্র সমালোচনাঃ

Comrade Stalin, having become Secretary-General, has unlimited authority concentrated in his hands, and I am not sure whether he will always be capable of using that authority with sufficient caution. Comrade Trotsky, on the other hand, as his struggle against the C.C. on the question of the People's Commissariat of Communications has already proved, is distinguished not only by outstanding ability. He is personally perhaps the most capable man in the present C.C., but he has displayed excessive self-assurance and shown excessive preoccupation with the purely administrative side of the work.

These two qualities of the two outstanding leaders of the present C.C. can inadvertently lead to a split, and if our Party does not take steps to avert this, the split may come unexpectedly.

------\

------\

Stalin is too rude and this defect, although quite tolerable in our midst and in dealing among us Communists, becomes intolerable in a Secretary-General. That is why I suggest that the comrades think about a way of removing Stalin from that post and appointing another man in his stead who in all other respects differs from Comrade Stalin in having only one advantage, namely, that of being more tolerant, more loyal, more polite and more considerate to the comrades, less capricious, etc. This circumstance may appear to be a negligible detail. But I think that from the standpoint of safeguards against a split and from the standpoint of what I wrote above about the relationship between Stalin and Trotsky it is not a [minor] detail, but it is a detail which can assume decisive importance.

অর্থাৎ স্ট্যালিন যে ভবিষ্যতে দৈত্য হয়ে উঠবেন, সে ব্যাপারে লেনিন নিশ্চিত হয়ে গেছেন মৃত্যুর আগে। পার্টিকে সাবধানও করলেন সেই মোতাবেক। সমস্যা হল, নিজের স্ত্রীকে গালাগাল না করা পর্যন্ত লেনিন বোঝেন নি স্ট্যালিন একটি দৈত্য? ১৯১৭-১৯১৯ । এই তিন বছর স্ট্যালিন রাশিয়ায় গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়েছেন-কৃষকদের ওপর স্টীম রোলার চালিয়েছেন। পাঁচ লাখ কৃষক স্ট্যালিনের অত্যাচারে তখনই প্রাণ হারিয়েছে। লেনিন তাকে মৃদু বকে ছেড়ে দিয়েছেন। এমনকি তাকে পার্টির শীর্ষপদেও বসিয়েছেন। আর যেই নিজের স্ত্রী স্ট্যালিনের হাতে বেশ্যা বলে গালাগাল খেল, শুধু সেই জন্যেই স্ট্যালিন হয়ে গেলেন ভিলেন! পাঁচ লাখ কৃষকের হত্যার রক্তে লেনিনের উপলদ্ধি হয় নি-নিজের স্ত্রীর অপমানে হুঁস ফিরলো প্রলেতারিয়েত মহান নেতা লেনিনের! যাকে সমস্ত কমিনিউস্ট সাহিত্য ঈশ্বরের আসনে বসিয়েছে! আসলে কম্যুনিজমের ইতিহাস খুব নিখুঁত ভাবে পড়লে বোঝা যায় প্রতিটা নেতাই ছিলেন ক্ষমতালোভি কুকুর। ক্ষমতা হাঁসিল করতে মহান আদর্শবাদের আলখাল্লা পরে ঘোরাফেরা করতেন। সাচ্চা আদর্শবাদিরা কোনদিনই কম্যুনিউস্ট পার্টিতে টেকে নি। মেরে ফেলা হয়েছে তাদের-ক্ষমতা ভোগ করেছে তারাই, যারা ক্ষমতার জন্যে লালায়িত ছিলেন। লেনিন এই মহান ট্রাডিশনের কোন ব্যাতিক্রম নন।

অবশ্য ১৯২৮ সালের পর এই ডকুমেন্ট চেপে দেওয়া হবে স্ট্যালিনের নির্দেশে। ১৯৩৩ সালে ক্রুপস্কার সন্দেহজনক অবস্থায় মৃত্যু হয়। লেনিনের স্ত্রীয়ের এই মৃত্যুর পেছনেও স্ট্যালিনের হাত আছে বলে শোনা যায়। সমস্যা হচ্ছে স্ট্যালিনের জমানা এত কিছু চেপে গেছে-কি সত্যি আর কি রূপকথা তা ঠিক করাই এক গোয়েন্দা রহস্য [৬]।

লেনিনের এই চিঠি স্ট্যালিনের জন্যে মৃত্যুবানই ছিল। ফলে এই চিঠির জেরে জেরবার হল আরো তিন কংগ্রেস। স্ট্যালিন এখানেই খেল দেখালেন। প্রথমত পার্টির লিব্যারেল উইং-যার নেতৃত্বে ছিলেন বুখারিন, তার সাথে হাত মেলালেন স্ট্যালিন- ট্রটস্কিকে আটকাতে। সবথেকে বড় কথা ক্ষমতার খেয়োখেয়ি, এবং অন্যের দিকে কাদা ছোঁড়া যখন অব্যাহত, চতুর্দশ কংগ্রেসে তিনি সবাইকেই বকা দিলেন, নিজের কৃতকর্মের ও সমালোচনা করলেন। এবং শুধু রাশিয়ার জন্যে স্যোশালিজম বা ন্যাশানাল স্যোশালিজম যা আদতেই কোন মার্ক্সীয় দর্শন হতে পারে না-সেটার মাধ্যমে জাতিয়তাবাদকেই সুরসুরি দিয়ে নিজের তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করলেন। এটা ভীষন দরকার ছিল স্ট্যালিনের জন্যে। এক ঢিলে তিন পাখি মরল। কমিনিউস্ট পার্টতে জেনারেল সেক্রেটারীর রোল তাত্ত্বিকের-সেখানে স্টালিনের পরিচিতি সফল প্রশাসক হিসাবে। কেও তাকে এতদিন তাত্ত্বিক হিসাবে ভাবে নি। সেই খামতি পূরণ করলেন। জাতিয়তাবাদ এনে রাশিয়ান লবি ম্যানেজ করলেন। এবং এটাকে লেনিনের চিন্তার উত্তরাসূরী হিসাবে দেখালেন। যেখানে ট্রটস্কির পৃথিবীব্যাপি বিপ্লবের অতিবিপ্লবী চিন্তা বাকিদের কাছে অবাস্তব কল্পনাবিলাসীর মতন শোনালো।

ছবি৩-বুখারীন-প্রাভদার সম্পাদক এবং লিব্যারাল বলশেভিকদের নেতা-একেও খুন করবেন স্ট্যালিন

জিনোভিয়েভ এবং ক্যামেনকভ, এই দুজনে স্ট্যালিনের সাথে জুটি বেঁধে ছিলেন ট্রটস্কিকে আটকাতে। এদের বলে ত্রৈকা। এরা দুজনেই তাত্ত্বিক-তাই ঈর্ষা উদ্ভুত ক্ষমতার লোভে ট্রটস্কির সাথে নোংরা বাকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেন। স্টালিন কোন তাত্ত্বিক ডীবেটে অংশই নিলেন না। ফলে ইমেজ হারালেন ক্যামেনকভ, জিনোভিয়েভ এবং ট্রটস্কি। চুপচাপ থেকে লাভ হল স্ট্যালিনের। আসলে ত্রৈকার সাথে ট্রটস্কির বিরোধ এক উত্তেজক উপন্যাস। একটা প্যারাগ্রাফে সারা অসম্ভব। তাও নিজের দুকথা বলি।

কমিনিউস্ট পার্টিতে সেক্রেটারী জেনারেলের ক্ষমতা বড্ড বেশী। ট্রটস্কিকে কোনঠাসা করতে এবং লেনিনের লাস্ট টেস্টামেন্টকে নিউট্রালাইজ করতে অভূতপূর্ব বুদ্ধিমত্তার সাথে এই পজিশন ব্যাবহার করেছেন স্ট্যালিন। প্রথমত ক্যামেনকভ আর জিনোভিয়েভের সাথে ট্রটস্কির কাজিয়া ইচ্ছা করে লাগিয়েছেন এবং ম্যানুপুলেট ও করেছেন। ক্যামেনভ ১৯২২ সালেই লেনিনকে আর্জি জানান ট্রটস্কিকে সরাতে হবে। লেনিন বড় মাপের নেতা ছিলেন-ধমক দিলেন ক্যামেনকভকে। আসলে ক্যামেনকভ এবং জিনোভিয়েভ অক্টবর বিপ্লবের বিরুদ্ধেই ছিলেন। কিন্তু লাভের গুড় খাওয়ার বেলায়, ক্ষমতার পিঁপড়ের মতন, লেনিনের অনুগত হলেন। এদের নিউট্রাইজ করতে, অক্টবর বিপ্লবে তাদের ভূমিকা, জনসমকক্ষে ফাঁস করেন ট্রটস্কি[৮]।

ফলে ১৯২৩ সালের দ্বাদশ পার্টি কংগ্রেসে স্ট্যালিনের সাহায্যে এরা ট্রটস্কিকে বসিয়ে রাখলেন। এই ত্রৈকাই সেবারের কনফারেন্স নিয়ন্ত্রন করল-ট্রটস্কি কয়েক মিনিট বলার সুযোগ পেলেন-তাতেই প্রচুর হাততালি পড়ল। স্ট্যালিন নিজের মহাত্ম্য প্রচারের সুযোগ পেলেন। অন্যদিকে প্রাভদার সম্পাদনায় তখন বুখারীন। প্রাভদাতেও ট্রটস্কির লেখা আটকে দেওয়া হল কারন বুখারীন এবং স্টালিন জ়োট বেঁধেছেন ট্রটস্কিকে আটকাতে। অন্যান্য পত্রিকা রাশিয়াতে বন্ধ। ফলে ট্রটস্কি তখন চেকমেট [৮]।

তবুও ট্রটস্কি তখন ক্ষমতাশুন্য নন। রেড আর্মির সর্বাধিনায়ক। ফলে ক্যু ঘটিয়ে আরেকটা বিপ্লব করে এদের সরাতে পারতেন। কিন্ত ট্রটস্কি ছিলেন পার্টির প্রতি নিবেদিত প্রাণ-তাকে এই ত্রৈকা যখন কোনঠাসা করে ফেলেছে, তখনও পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্যে তিনি ১৯২৪ সালের পার্টি কংগ্রেসে আহ্বান জানিয়েছেন। অথচ একেই স্ট্যালিনিস্টরা বলবেন ফ্যাকশনালিস্ট!

The party in the last analysis is always right because the party is the single historic instrument given to the proletariat for the solution of its fundamental problems. I have already said that in front of one's own party nothing could be easier than to say: all my criticisms, my statements, my warnings, my protests--the whole thing was a mere mistake. I, however, comrades, cannot say that, because I do not think it. I know that one must not be right against the party. One can be right only with the party, and through the party, for history has created no other road for the realization of what is right.-ট্রট-১৯২৪ সালের পার্টি কংগ্রেসে ভাষন।

যাইহোক কোনঠাসা অবস্থায় ট্রটস্কিও পালটা চাল দিলেন। তার ভরসা তখন পার্টির সদস্যরা। কারন সেন্টাল কমিটি ত্রৈকা ম্যানেজ করে ফেলেছে। প্রাভদা তার লেখা ছাপাচ্ছে না।

১৯২৩ সালে রাশিয়ার অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়তে, শ্রমিক অসন্তোশ সেই সুযোগ এনে দিল। পার্টির অসন্তুষ্ঠ কমরেডরা দুটি সিক্রেট গ্রুপ তৈরী করে-ওর্কারস ট্রূথ এবং ওয়ার্কারস গ্রুপ। সোভিয়েত পুলিশ এদের পিটিয়ে জেলে পুরে দিল প্রতিবিপ্লবী কার্যকলাপের জন্য। ১৯২৩ সালের সেপেটম্বর মাসে জার্মানীতে কম্যুনিউস্ট অভ্যুত্থান ব্যার্থ হল। শ্রমিকদের মধ্যে কম্যুনিউস্ট নেতাদের প্রতি তীব্র ক্ষোভ লক্ষ্য করলেন ট্রটস্কি-এবং পার্টিকে চিঠি দিলেন, এই ভাবে চললে এটা বুরোক্রাটদের পার্টি হয়ে যাচ্ছে। শ্রমিকদের পার্টি এটা আর নেই। তাই পার্টিতে গণতন্ত্র দরকার।

In the fiercest moment of War Communism, the system of appointment within the party did not have one tenth of the extent that it has now. Appointment of the secretaries of provincial committees is now the rule. That creates for the secretary a position essentially independent of the local organization. [...] The bureaucratization of the party apparatus has developed to unheard-of proportions by means of the method of secretarial selection. There has been created a very broad stratum of party workers, entering into the apparatus of the government of the party, who completely renounce their own party opinion, at least the open expression of it, as though assuming that the secretarial hierarchy is the apparatus which creates party opinion and party decisions. Beneath this stratum, abstaining from their own opinions, there lays the broad mass of the party, before whom every decision stands in the form of a summons or a command.

বাকী কমিনিউস্ট নেতারাও ত্রৈকার অগণতান্ত্রিক কাজে অখুশী-তারাও গলা মেলালেন পার্টির বুরোক্রাটিক নেতৃত্বের ব্যাপারে [৮]

[...] we observe an ever progressing, barely disguised division of the party into a secretarial hierarchy and into "laymen", into professional party functionaries, chosen from above, and the other party masses, who take no part in social life. [...] free discussion within the party has virtually disappeared, party public opinion has been stifled. [...] it is the secretarial hierarchy, the party hierarchy which to an ever greater degree chooses the delegates to the conferences and congresses, which to an ever greater degree are becoming the executive conferences of this hierarchy.

ত্রৈকা সাময়িক ভাবে পিছু হটল। কিন্তু ক্ষমতা তাদের হাতে। তাই ১৯২৪ সালের পার্টি কংগ্রেসে ট্রটস্কির বিরুদ্ধে দলবাজির অভিযোগ আনা হল।

একটা জিনিস মনে রাখতে হবে। পার্টিতে তখন গণতন্ত্র চাইছিলেন বলেন ট্রটস্কিকে শোধনবাদি বলে গালাগাল দেন আজকের স্টালিনিস্টরা।

কিন্তু বাস্তবটা কি? ট্রটস্কি আসলে ১৯২০ সালে ট্রেড ইউনিয়ানও বন্ধ করতে চাইছিলেন! হঠাৎ করে তার এত গণতন্ত্র প্রেম জাগল কেন? উত্তরটা পরিস্কার। শোষনবাদ বা আদর্শবাদ সব কমিনিউস্টদেরই আদর্শবাদের আলখাল্লা-আসল রংটা ক্ষমতা দখলের।

যাইহোক ১৯২৪ সালের কংগ্রেসেও খেয়োখেয়িটা সামনে এল না। লেনিন সদ্য প্রয়াত বলে, চক্ষুলজ্জার খাতিরেই, মৃত মহান নেতার শ্রদ্ধাঞ্জলিতে একটা ঐক্যের চেস্টা হল। স্টালিন পলিটবুরো থেকে সেন্ট্রাল কমিটি সর্বত্র নিজের লোক ঢোকাতে লাগলেন। ট্রটস্কির শরীর ভেঙে পড়ে। উনি ছুটিতে গেলেন। লেনিনের মৃত্যু সংবাদ ট্রটস্কি জানলেন স্ট্যালিনের কাছ থেকে, কিন্তু লেনিনের ফুনারেলে যাতে ট্রটস্কি না থাকতে পারেন, তার জন্যে ভুল একটা ডেট জানানো হল তাকে! তার অসুসস্থতার সুযোগে, রেড আর্মির সর্বাধিনায়ক পদ থেকে তাকে ছেঁটে ফেলা হল[৮]। সেটা জানুয়ারী, ১৯২৫। ক্যামেনকভ, পলিটবুরো এবং পার্টির সেন্ট্রাল কমিটি থেকে ট্রটস্কিকে ছাঁটতে চাইলেন। স্টালিন চাইলেন না। অপূর্ব ম্যনিপুলেশনে খেলছেন তখন স্ট্যালিন। তার ইমেজ উজ্জ্বল হচ্ছে-ক্যামেনকভ তার কাজ করছেন এবং নিজে ডুবছেন [৫]।

ট্রটস্কিকে আটকালেন সবাই মিলে। এবার কি হবে? বাকিরা ত আর আদর্শের জন্যে ট্রটস্কির বিরোধিতা করেন নি-করেছেন ট্রটস্কিকে আটকাতে-কারন ট্রটস্কি থাকলে, তারা সবাই আস্তাকুড়ে থাকতেন। ট্রটস্কিকে বসানো মাত্র খেয়োখেয়ি শুরু হল ত্রৈকার নিজেদের মধ্যে।

১৯২৫ সালের চতুর্দশ পার্টি কংগ্রেসে শুরু হল সেই খেওখেয়ি। এবার জিনোভিয়েভ এবং ক্যামেনিকভ কে সরানোর জন্যে পার্টির মধ্যে লিব্যারাল গ্রুপ-বুখারীন, রাইকভ এবং টমস্কির সাথে স্টালিনের চুক্তি হল। স্যোশালিজম ইন ওয়ান কান্ট্রীর নামে স্ট্যালিনের বিকৃত ন্যাশানাল স্যোশালিজম তত্ত্ব এই পার্টি কংগ্রেসেই পাশ হয়। জিনেভিয়েভ এবং ক্যামেনকভ স্ট্যালিনকে সরানোর জন্যে লেনিনের স্ত্রীর সাথে জোট বাঁধলেন। ফলে ১৯২৭ সালে কংগ্রেসে তারা পার্টি থেকে বিতাড়িত হলেন। ট্রটস্কিও পার্টি থেকে বিতাড়িত হলেন। শেষমেশ স্ট্যালিনের বিরুদ্ধে তারা রেডস্কোয়ারে প্রকাশ্যে বিক্ষোভ দেখাতে বাধ্য হন। তারা গ্রেফতার হলেন। ট্রটস্কিকে রাশিয়া থেকেই তাড়ানো হল।হাতে হাতকড়া পরিয়েই তাড়ানো হল-এবং তার ফিল্মও তোলা হল রাশিয়াতে ত্রাসের সৃষ্টির জন্যে। তখনো নির্বিদ্বিধায় খুন খতম করার মতন অবস্থায় আসেন নি স্ট্যালিন। ১৯২৮ সালের কংগ্রেসে, বুখারীন, রাইকভদের তাড়ালেন পলিটবুরো থেকে। অসংখ্যা পার্টি কর্মীকে তাড়ানো হল ট্রটস্কির সমর্থক সন্দেহে। কারন, তাদের সাহায্য আর তার প্রয়োজন নেই। এইভাবে ১৯২৮ সালের মধ্যে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হলেন স্টালিন। তবে স্বেচ্ছাচারী হওয়ার ক্ষমতা বা খুন খারাপি করার ক্ষমতা তখন ও আসে নি। সেটা হবে প্রেট পার্জের পর। তা নিয়ে পরের পর্বে আলোচনা করব। কি করে অক্টবর বিপ্লবের ৯২% নেতাকে স্ট্যালিন খুন করবেন। ১৯১৭ সালে যারা বলশেভিক বিপ্লব করেছিলেন, তারা যদি একবারো জানতেন-গণতন্ত্রকে ধ্বংশ করে শুধুই দৈত্যই তৈরী হয়! জারের আমলে তাদের কে বড়জ়োর সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে পাঠানো হত-সেখানে প্রেমটেমও তারা করতেন। আর নিজেদের বৈপ্লবিক আমলে-তাদের বিপ্লবী বন্ধুরা একদম ফায়ারিং স্কোয়াডে ফেলবেন! ঈর্ষাত আসলে আদর্শবাদি শত্রুদের চেয়ে আর ভয়ংকর রোগ-এটাই আসল বৈজ্ঞানিক সত্য!

১৯২৮ সালের পর থেকেই স্ট্যালিন সোভিয়েতকে পুলিশ স্টেট বানানো শুরু করলেন। গীর্জায় যেখানে যীশুর ফটো ঝুলছিল, সেখানে তার ফটো লাগানো হল [৯]। রেডীও এবং সংবাদপত্রে তার জয়গান সারাদিন। অবস্থা এমন স্ট্যালিন বক্তৃত্তা দিতে উঠলে, হাততালি থামত না। মানে কেও থামাতে সাহস পেত না। যে প্রথমে থামবে, সে প্রতিবিপ্লবী বলে ধরা পড়তে পারে [৯]। সমস্ত লেখককে স্টালিন স্তুতিতে বাধ্য করা হল। ১৯২৮ সালের পরে রাশিয়াতে এন কে ভিডী বা সিক্রেট পুলিশ কিভাবে জনমানসে সন্ত্রাস সৃস্টি করে এবং দুর্ভিক্ষে একের পর সোভিয়েত প্রদেশে গণহত্যা সংগঠিত হয়, তা নিয়ে পরের সংখ্যায় আলোচনা করব।

তুলনামুলক ভাবে হিটলারের ক্ষমতা উত্থান অনেক অনেক মসৃণ। কারন পার্টিতে তিনি ছিলেন অপ্রতিরোধ্য একমাত্র নেতা। জেল খেটে ফেরার পর মেইন ক্যাম্প লেখার দৌলতে তিনি তখন জনপ্রিয় তাই রাইমার রিপাবলিকে শ্রেফ গণতান্ত্রিক পথেই ক্ষমতা দখল করেন তিনি। বিরোধিদের হত্যা এবং গণতন্ত্রকে ধ্বংশ করা শুরু হবে ১৯৩৩ সালের পর থেকে-যখন গণতন্ত্রের পথেই তিনি নিরঙ্কুশ ক্ষমতা পেয়েছেন।

Nazi Party Election Results

Date

Votes

Percentage

Seats in Reichstag

Background

May 1924

1,918,300

6.5

32

হিটলার জেলে

December 1924

907,300

3.0

14

জেল থেকে মুক্তি

May 1928

810,100

2.6

12

September 1930

6,409,600

18.3

107

জার্মানির অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পরে

July 1932

13,745,800

37.4

230

প্রথম প্রেসিডেন্সি ক্যান্ডিডেট

November 1932

11,737,000

33.1

196

March 1933

17,277,000

43.9

288

চ্যান্সেলর থাকার সময়

এই তথ্য থেকে পরিস্কার- ১৯৩০ সালের গ্রেট ডিপ্রেশন হিটলারের কাছে ছিল সবথেকে বড় আর্শীবাদ। হতাশ জনগণের কাছে হিটলারের শত্রুতত্ত্ব - ভার্সাই এর চুক্তি জার্মানদের দুরাবস্থার জন্যে দায়ী-সেটাই সব থেকে বেশী খেয়েছে। সবথেকে বড় সমস্যা হচ্ছে, সেই সময় নাজিদের ঠেকানোর মতন কেও ছিল না। জার্মান কমিনিউস্টরা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতন এখানেও জন বিচ্ছিন্ন। জণগণ চাইছে চাকরী-এরা শোনাচ্ছিলেন বলশেভিক বিপ্লবের গল্প। তা এদের আর কে পাত্তা দেবে! খ্রীষ্ঠান রক্ষনশীল নেতা প্যাপেন, তাও একটু বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন-কিন্তু কি করে দেবেন? সবাই যে নাজিদের জনপ্রিয় এজেন্ডাতে মহিমান্বিত! এমনকি ১৯৩১ সালে প্রচুর প্রপাগান্ডা করতে গিয়ে নাজি পার্টির ফান্ড যখন শুন্য-স্থানীয় ব্যাবসাদাররা ধার মকুব করে দিলেন! এরা কম্যুনিউস্টদের পেটাচ্ছে, ইহুদিদের শাসাচ্ছে, ভার্সাই চুক্তি যা জার্মানীকে শোষন করার চুক্তি, তা মানবে না বলছে! আর কি চাই? ২৭ শে ফব্রুয়ারী,১৯৩০। এক কমিনিউস্ট রাইখে আগুন ধরানোর চেষ্টা করতেই, বিরোধি রাজনীতি বন্ধ করার ছূতো পেয়ে গেলেন গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত চ্যান্সেলর হিটলার, যিনি বছর খানেক আগেও জার্মান নাগরিকই ছিলেন না! ১৪ই জুলাই, ১৯৩৩ সালে বাকি সবপার্টিকে নিশিদ্ধ করা হল। ট্রেড ইউনিয়ান নিশিদ্ধ করা হল। বিরোধি নেতাদের জেলে ভরা এবং হত্যা করা শুরু করল নাজি পার্টি। নাজিদের পুলিশ স্টেট নিয়ে পরের পর্বে আলোচনা করব।

ছবি-৪-প্রথমবার যখন চ্যন্সেলর

এখানে একটা জিনিস উল্লেখ্য। লেনিনও ঠিক একই ভাবে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেছিলেন[২]-কিন্ত জনগন তার সাথে ছিল না। তাই লেনিনকে ১৯১৭-১৯১৯, এই দুবছর ধরে গৃহযুদ্ধ করতে হয়েছে। হিটলারকে ওসব কিছু করতে হয় নি-শ্রেফ দুদিনেই বিরোধিদের সাফ করে দিয়েছিলেন। কারন, জনগণ তার সাথে ছিল-বক্তৃতার মাধ্যমে হিটলার তাদের মাথাই ঢুকিয়েছিলেন, একমাত্র তিনিই পারবেন তাদের খেতে দিতে, চাকরি দিতে।

যারা বলেন বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমে প্রকৃত ক্ষমতা জণগনের হাতে গেছে-সেটাত ১০০% মিথ্যে কথা বটেই-যদি ধরেও নি, তা সত্য, তাহলেও হিটলারে উদাহরন থেকে বলা যেতে পারে, জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে গণতন্ত্রকে হত্যা করাও আসলে কোন কাজের কথা না। হিটলারের এই কুকীর্তি, পরে নাশের বা সুহার্তোরাও করবেন।

মোদ্দা কথা কোন যুক্তিতেই সংসদীয় গণতন্ত্রের হত্যা সমর্থনযোগ্য নয়। যেসব কমিনিউস্টরা পার্টির আভ্যন্তরীন গণতন্ত্রের মাহাত্ম্যে ভরপুর-তাদের জন্যে ১৯১৭ থেকে ১৯২৮ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার ইতিহাস তুলে দিলাম। ওটাকে পার্টির আভ্যন্তরীন গণতন্ত্র না ক্ষমতার মিউজিক্যাল চেয়ার বলবেন? সংসদীয় গণতন্ত্রকে লেনিন যদি শুয়ারে খোয়ার বলেন, তাহলে তার মৃত্যুর পরে বলশেভিক পার্টির আভ্যন্তরীন গণতন্ত্রকে কি ক্ষমতার সার্কাস বলা যায়? স্টালিন শ্রেফ দাবা খেলেছেন। শেষে যখন জিতেছেন পার্টিতে তার সব বিরোধিদের খুন করেছেন। ১৯২৮ সালের আগে অবশ্য তাদের শুধু বহিস্কার করেছেন। এটা কমিনিউস্টদের ইতিহাসে কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা না। চীনেও একই ঘটনা ঘটেছে। পার্টির মধ্যে বিরোধিদের মেরে ফেলা কোন ধরনের গণতন্ত্র? আর এইসব পার্টি গণতন্ত্রের রূপকথা শোনানো আমাদের বঙ্গজ কমিনিউস্টরা কি রাশিয়ার ইতিহাস কিছুই পড়েন নি?

যাইহোক, বঙ্গজ কমিনিউস্টদের সাথে আমার অভিজ্ঞতা বলে এরা না জানে মার্ক্সবাদ, না জানে বলশেভিকদের ইতিহাস। কারন বলশেভিকদের ইতিহাস ঠিকঠাক জানলে, নিজেদের কমিনিউস্ট বলে পরিচয় দিতে এরা লজ্জা পেত।

[১]http://en.wikipedia.org/wiki/Joseph_Stalin

[২]http://mukto-mona.com/banga_blog/?p=136

[৩]Robert Service. Stalin: A Biography. 2004. ISBN 978-0-330-41913-0

[৪]Leon Trotsky, founder of the Red Army, issued a decree (24 October 1919) proclaiming, “Woe to the unworthy soldier who sticks a knife into an unarmed prisoner” (The Military Writings and Speeches of Leon Trotsky, Vol. 2 [1979]).

[৫] http://mars.wnec.edu/~grempel/courses/stalin/lectures/StalinTrot.html

[৬]http://en.wikipedia.org/wiki/Nadezhda_Krupskaya

[৭]On the suppressed Testament of Lenin by Leon Trotsky (written in December 1932, published in 1934, sometimes incorrectly dated as 1926)

[৮]http://en.wikipedia.org/wiki/Leon_Trotsky

[৯] BBC documentary-war of the centuries: when Hitler met Stalin. http://www.youtube.com/view_play_list?p=0A3666F1AAC47487

হিটলার এবং স্ট্যালিন--কুখ্যাততম খুনী কে?

(১)

এই লেখা ২০০৮ সালে লিখতে বাধ্য হচ্ছি-এটাই আমার সব থেকে বড় দুর্ভাগ্য। নানান ইফোরামের আলোচনা থেকে আমি আতংকিত-এই দুই মহান খুনীর ভূত নতুন প্রজন্মের জাতীয়তাবাদি এবং কমিনিউস্টদের মাথায় দিব্বি করে খাচ্ছে। এই দুই খুনীর ধাত্রীগৃহ ইউরোপিয়ান ইউনিয়ান যতই এদের দুনিয়ার কুখ্যাততম জল্লাদ বলে স্বীকার করে নিক না কেন[১], আমাদের উপমহাদেশে হিটলার-স্টালিন ভক্তের অভাব নেই। আর এস এস এবং হিন্দুত্ববাদি নেতারা, প্রকাশ্যেই হিটলারের ভক্ত। আর এস এসের অফিসে হিটলারের ফটো এখনো শোভা পায়-আফটার অল আর এস এসের উৎসস্থল আর্য্য জাতীয়তাবাদ। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ এবং কেরালায় ঘটা করে স্টালিনের জন্মদিন পালন করা হয়-সেই স্টালিন, যাকে তার মৃত্যুর তিন বছরের মধ্যে সোভিয়েত রাশিয়াতেই সবথেকে ঘৃণ্যতম মানুষ তথা পতিত কম্যুনিউস্ট বলে ঘোষনা করা হয় [২]। দুজনের জীবনীতেই অদ্ভুত মিল আছে। মানুষের জীবনের মূল্য পিঁপড়ের চেয়ে কম বলে মনে করতেন দুজনেই। যৌবন এবং বাল্যকাল থেকে এত মৃত্যু দেখেছেন-শেষ পর্যন্ত মৃত্যুই জীবনের সকল সমস্যার সমাধান বলে মনে করতেন এরা। মৃত্যুকে নিয়ে অবশেষন-কাল্ট অব স্টালিন এবং হিটলারকে একই সূত্রে গেঁথেছে। একই আদর্শবাদের পথিক এই দুই নরঘাতক-স্যোসালিস্ট ন্যাশানালিজম বা সমাজবাদি জাতিয়তাবাদ। ওপরের রং নাজিজম বা কম্যুনিজম যাই হোক না কেন, আসলে দুজনেই ডিক্টেটর হওয়ার পথে ইউরোপের চিরচারিত জাতিয়তাবাদি ফর্মুলাকেই হাতিয়ার করেছেন-পিতৃভূমি, পিতা এবং পিতৃভূমির প্রতি আনুগত্য। মিডিয়া দখল করে, অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ভাবে নিজেদের " জাতির পিতা" ইমেজ প্ল্যান্টেশন করেছেন অসংখ্য খুনের আড়ালে আবডালে। এবং কি আশ্চর্য্য তাদের মিডীয়া ম্যানুপুলেশন! আজও তাদের ভূতের "কৃতিত্বে" বিশ্বাস করে অগুন্তি মানুষ! অথচ ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে দুজনেই অত্যন্ত সাধারন মেধার মানুষ ছিলেন-খুন করে ভয় দেখিয়ে নিজের ক্ষমতার একাধিপত্য বজায় রাখার ব্যাপারে দুজনেই ছিলেন পারদর্শী। গণহত্যার ব্যাপারে দুজনের মেধা পরীক্ষা করলে দেখা যাবে- এ বলে আমায় দেখ। সেখানে দুজনেই অসম্ভব মেধাবী।

ডানে হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, বাঁয়ে স্ট্যালিনের গুলাগঃ নামে আলাদা হলেই জাত আলাদা?

বাল্যকালঃ স্টালিন এবং হিটলারে বাল্যকালে অদ্ভুত মিল হচ্ছে-দুজনেই পিতৃপ্রেম থেকে বঞ্চিত। বরং বলা যায় অত্যাচারী মদ্যপ পিতার সন্তান। মায়েরাই অনেক কষ্টে মানুষ করেছেন-এবং জীবনের প্রথম থেকেই এরা ব্যাক্তিগত জীবনে এত নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছেন-এদের কাছ থেকে পরবর্ত্তী জীবনে মানবতা আশা করাটাই অন্যায়। স্টালিনের মদ্যপ পিতা বেসেরিয়ান, তাকে ১২ বছর বয়সে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে জুতোর ফ্যাক্টরীতে ঢুকিয়ে দেন। স্টালিনের মা কিটোভেন পাদ্রীদের সহায়তায় তাকে উদ্ধার করেন এবং স্কুলে আবার ভর্ত্তি করান। এই ঘটনার পর বেসেরিয়ান স্টালিনের মাকে চিরতরে ত্যাগ করেন। অর্থকষ্টে কিটোভেন নিজের চরিত্র হয়ত ঠিক রাখতে পারেন নি-কিন্ত যা করেছেন পুত্রের শিক্ষার জন্যে আত্মত্যাগ করেছেন। পিতার ন্যায় তাকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে কারখানায় ঢোকান নি। অথচ, মায়ের স্খলিত চরিত্রের জন্যে স্টালিন প্রায় তাকে বেশ্যা বলে তিরস্কার করেছেন। ১৯৩৩ সালে মৃত্যুর পরেও মাকে দেখতে যান নি। একবারো ভেবে দেখেন নি, তার শিক্ষার জন্যেই কিটোভেনের আত্মত্যাগ । নারীজাতির প্রতি বিদ্বেশ ছোটবেলা থেকেই স্টালিনের জীবনে এত তীব্র -পরবর্ত্তীকালে তার তিন স্ত্রীই এর জন্যে ভুগে আত্মহত্যা করেছেন বা স্টালিন তাদের খুন করেছেন। সেই প্রশঙ্গে পরে আসছি।

হিটলার স্টালিনের একদশক জুনিয়ার ( স্টালিনের জন্ম ডিসেম্বর ১৮,১৮৭৮- হিটলারের ২০ই এপ্রিল, ১৮৮৯)। হিটলারের পিতা আলিয়জ হিটলার, স্টালিনের বাবার মতন সমান অত্যাচারী ছিলেন। হিটলার তার তৃতীয় স্ত্রী ক্লারার সন্তান। মেইন ক্যাম্পে নাম না উল্লেখ করে হিটলার যে মদ্যপ বৌ পেটানো স্বামীর কথা লিখেছিলেন্-সে আর কেও নয়-তার বাবা আলিয়জ। স্টালিনের মতন, হিটলারের বাবাও চাইতেন ছেলে বাপের প্রফেশনে যোগ দিক। হিটলার বাবার হাতে প্রচন্ড মার খেতেন-এই ভাবেই ছোটবেলা থেকে ফ্যামিলি ভায়োলেন্সের মধ্যেই দিয়েই, তার মধ্যে এক নিষ্ঠুর মননের জন্ম দেয়। যাইহোক স্টালিন তাও স্কুলের ফার্স্ট বয় ছিলেন-হিটলার কিন্তু হাইস্কুল পাশই করতে পারলেন না! ফাইন আরর্টস স্কুলেও দুবার ঢুকতে ব্যার্থ হলেন। স্থপতি হওয়ার স্কুলে ঢুকতে চাইলেন-সেখানেও ব্যার্থতা! স্টালিনের এক্যাডেমিক জীবন বরং অর্থনৈতিক কারনে ব্যার্থ। টিফলিসের অর্থডক্স সেমিনারীতে টাকা পয়সার অভাবে স্টালিনকে ড্রপ আউট করতে হয়। কিন্তু তার মধ্যেই ছাত্রদের ওপর সেমিনারীর নজরদারী কিভাবে ভয় এবং ভীতির সাহায্যে মানুষকে কন্ট্রোল করা যায়-সে সম্মন্ধে স্টালিনের বাস্তর অভিজ্ঞতা হয়। যা পরে তিনি গোটা সোভিয়েত ইউনিয়ানে কায়েম করবেন।

যৌবন এবং বিপ্লবী কর্মকান্ডের শুরুঃ স্টালিন এবং হিটলারের বিপ্লবী কর্মকান্ড এবং পরবত্তীতে তাদের পারসোনালিটি কাল্টের গঠন বোঝার জন্যে এই অধ্যায় জরুরী। স্ট্যালিনকে ১৮৯৯ থেকে ১৯১৭ সালের নভেম্বর পর্যন্ত গোপনে বিপ্লবী কর্মকান্ড সংগঠিত করতে হয় জারের পুলিশ ওখরানার বিরুদ্ধে চোর পুলিশ খেলে। এই অধ্যায়ে স্টালিন ছিলেন বলশেভিক গ্যাং লিডার-খুন, ব্যাঙ্ক ডাকাতি, রাহাজানি, এক্সটর্শন সবকিছুই করেছেন পার্টির জন্যে। বলশেভিক পার্টিতে একমাত্র লেনিন ছাড়া আর কারোর সুনজরে ছিলেন না। এমনকি মেনশেভিকরা ব্যাঙ্ক ডাকাতি বন্ধ করতে চাপ দিলে, লেনিন ই বারবার বিপ্লবকে ফাইনান্স করার জন্যে স্টালিনের ব্যাঙ্ক ডাকাতিকে সমর্থন করেছেন। বাকুর তৈল ব্যারনদের বিরুদ্ধে তোলাবাজি, গুন্ডাদলদের বলশেভিকদের ছাতায় আনার ব্যার্থ প্রচেষ্ঠা কোন কিছুই স্টালিনের কর্মকান্ড থেকে বাদ যায় নি। লেখালেখি করার সুযোগ পেয়েছেন কম- দীর্ঘ আঠারো বছর মাত্র দুবার স্বল্প সময়ের জন্য পত্রিকা সম্পাদনার সাথে যুক্ত ছিলেন -প্রথমে বাকুতে ( ব্রেদজোলা বা সংগ্রাম নামে পত্রিকা সম্পাদনা করতেন-১৯০১) এবং পরে প্রাভদার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হন। দারিদ্রর সাথে সংগ্রাম করতে করতেই তার উত্থান-তাই পার্টিতে স্বচ্ছলদের "মধ্যবিত্তপনার আঁতলামো" কখনোই তার সহ্য হয় নি। ১৯০৭ সালে লন্ডনে রাশিয়ান স্যোশাল ডেমোক্রাটিক লেবার পার্টির পঞ্চম কংগ্রেসে ট্রটস্কির সাথে প্রথম দেখা। প্রথম দর্শনেই, তাকে গুড ফর নাথিং বলে স্টালিনের মনে হয়েছিল। পার্টির বুদ্ধিজীবিরাও সদয় ছিলেন না-স্টালিনকে বরাবর তারা গুন্ডা-গর্দি বলেই মনে করেছেন। মেনশেভিকদের ভেঙে বলশেভিকরা যখন প্রথম পার্টি কংগ্রেস ডাকল ১৯১২ সালে (প্রাগ), সেখানেও প্রথম বলশেভিক সেন্ট্রাল কমিটিতে তিনি ছিলেন না। সেন্ট্রাল কমিটির কিছু সদস্য জারের পুলিশের হাতে ধরা পড়লে, লেনিন তাকে সেন্ট্রাল কমিটিতে ঢোকান। বস্তুত লেনিনই স্টালিনকে এই দীর্ঘ আঠারো বছর গ্রুম করেছেন-পার্টিতে স্টালিনকে সেক্রেটারী জেনারেল (১৯২৩) করা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই পার্টির বিরুদ্ধে গিয়ে স্টালিনকে তুলে এনেছেন লেনিন। সুতরাং মৃত্যুর আগেই লেনিন যতই লিখুন স্টালিনের স্বৈরাচার বিপ্লবকে ধ্বংশ করবে, তাই ওকে সেক্রেটারী জেনারেল পোষ্ট থেকে সরানো হৌক-ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে। ফ্র্যাঙ্কেস্টাইন তার কাজ শুরু করে দিয়েছে।

এই দীর্ঘ সময়ে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অনেক কবার তাকে জারের পুলিশ সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত করেছে। স্টালিনের সময় রাষ্ট্রদোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত হলে-সবাইকে সাইবেরিয়ার গুলাবে (কনসেণ্ট্রেশন ক্যাম্প) পাঠানো হত-যেখানে প্রথম শীতেই ৯০% কয়েদি মারা পড়ত। আর যে জারের দমন নীতিকে কমিনিউস্টরা এত সমালোচনা করেন-সেই দমন নীতির নমুনা হচ্ছে-স্টালিন তিনবার রাষ্ট্রদোহিতার অভিযোগে সাইবেরিয়াতে নির্বাসিত হন। প্রথমবার নভাইদা নামে একটা ছোট্ট গ্রামে-মাত্র কয়েক মাস ছিলেন (১৯০৩)। দ্বিতীয়বার পাঁচ বছরের জন্যে নির্বাসিত হলেন ছোট সাইবেরিয়ান শহর সলভাইচেগস্কে (১৯১০)। তখন সাইবেরিয়াতে নির্বাসন মানে স্টালিনের জমানার মতন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে কাটানো নয়। সাইবেরিয়ার গ্রামে গিয়ে থাকতে হত। এবার সেখানে রীতিমত মারিয়া নামে তার গৃহকত্রীর সাথে রোমান্সে মাতলেন স্টালিন-একটি ছেলেও হল। কনস্টানটাইন। যদিও এই রোম্যান্স এবং অবৈধ পুত্রকে প্রকাশ্যে কখনোই স্বীকার করেন নি স্টালিন-কনস্টানটাইনের শিক্ষা এবং পার্টিতে নিশ্চিত পজিশন সবই গোপনে ঠিক করে পিতার দ্বায়িত্বও ভোলেন নি। আবার নিজের ইমেজে আঁচ ফেলতেও দেন নি! সেবার মাত্র একবছর বাদেই ছাড়া পেয়েছিলেন-তবে পরের বার তাকে তুরুকানস্ক নামে দুর্গম সাইবেরিয়ান শহরে পাঠানো হয় (১৯১৩)। এখানে আদিবাসিদের সাথে মাছ ধরে এবং পশু শিকার করে এবং তৎসহ লিদিয়া পেরেপাইগিনা নামক তের বছর বয়স্ক এক বালিকার সাথে রোমান্স করে দুবছর কাটিয়ে দিলেন। লিদিয়া পরে স্টালিনের দ্বিতীয় স্ত্রী হবেন-যাকে স্টালিন খুন করতে বাধ্য হবেন ১৯৩৩ সালে। যাইহোক ১৩ বছর বয়স্কা লিদিয়ার সাথে 'প্রগ্রেসিভ স্টালিন' যখন প্রেমে আচ্ছন্ন, তখন পাত্রর বয়স ৩৫। সেটাও আমার বক্তব্য না-যেসব বঙ্গজ কমিনিউস্টরা জারের দমন নীতির কথা তোলেন-তারা একবার ও কি ভেবে দেখেছেন, স্টালিন ত তিনবার সাইবেরিয়াই গিয়ে দুটি বিয়ে করে, দুই পুত্রের জন্ম দিয়ে চলে এলেন বিপ্লব করতে সশরীরে। কিন্তু স্টালিন যাদের দেশোদ্রোহিতার জন্যে সাইবেরিয়াতে পাঠাতেন তাদের খুব সামান্যই প্রথম শীত কাটাতেই অক্কা পেত।[3] এবং যে কোটি খানেক লোক গুলাগে মারা যায় তাদের প্রায় সবাই নিরাপরাধ ছিলেন-কোটা ভর্তি করতে এন কে ভি ডী র‌্যান্ডমলি যাকে পেত, তুলে আনত যেখান সেখান থেকে। তারপর দাঁত ভেঙে বা আঙুল ছেঁচে অপরাধ স্বীকার করানো হত [4]। জারের দমন নীতির পাশে স্টালিনের খুনী নীতি কি খুব মহিমাউজ্জ্বল?

আরেকটা ছোট ঘটনার উল্লেখ না করলেই না। হামেট বা মুসলীম বলশেভিক পার্টির প্রতিষ্ঠাতাও স্টালিন। উদ্দেশ্য ছিল ইরান এবং আজারবাইজানে বলশেভিক বিপ্লব। কিন্তু তার জন্যে আলাদা "মুসলীম বলশেভিক পার্টি" কেন? বলশেভিকদের ধর্ম বস্তুটা কি? আসলে সেই সময় বাকুতে মুসলীমরা সংখ্যাগুরু হলেও, তেলের মালিক ছিল ইহুদি আর ক্রীষ্ঠানরা। তাদের বিরুদ্ধে মুসলীমদের রাগ কাজে লাগিয়ে বলশেভিক বেস বাড়াতে চেয়েছিলেন স্টালিন। সেই উদ্দেশ্যে বাকুতে মুসলিমরা যে খ্রীষ্ঠানদের বিরুদ্ধে জাতিদাঙ্গা শুরু (১৯০৭) করে, তার নাটের মুলে ছিলেন স্টালিন। যদিও বলশেভিকরা সেটাকে পরবত্তীকালে তেলের মালিকদের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের বিদ্রোহ বলেই দেখেন। জালনোটের কারবার, ব্যাঙ্ক ডাকাতি, তোলাবাজি -সব কিছুতেই হাত পাকিয়েছিলেন স্টালিন। তবে সবটাই পার্টির জন্যে। ১৯০৭ সালে এম্পিরিয়াল ব্যাঙ্ক ডাকাতির ২৫০,০০০ রুবল (যার আজকের মূল্য চারমিলিয়ান ডলার) সবটাই জেনেভায় আত্মগোপন করে থাকা লেনিনের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তার প্রথম স্ত্রী এক্তারিনা দারিদ্র এবং যক্ষায় মারা যায়। অথচ সেই ২৫০,০০০ রুবলের এক পয়সাও স্টালিন তার বৌয়ের চিকিৎসার জন্যে নেন নি। এমনকি প্রবল দারিদ্রের জন্যে প্রথম সন্তান ইয়াকভকে দাদুর কাছেই রেখে এলেন। এই ঘটনার পর স্টালিন জানিয়েছিলেন- তার জীবনে মানবিকতার কিছু মাত্র অবশিষ্ট ছিল না। সুতরাং তিনি এতদিন যা অপরাধ করেছেন-বলশেভিক বিপ্লবের উদ্দেশ্যেই করেছিলেন। এক্ষেত্রে স্টালিনের খাঁটি বিপ্লবী। তবে পার্টির বুদ্ধিজীবিরা তাকে ঘৃণা করেছেন বরাবর-তার আত্মত্যাগকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনেন নি। ঠিক এই কারনেই বোধ করি গ্রেট পার্জের সময়,বুদ্ধিজ়ীবিদের খুন করে সব থেকে বেশী খুশী হতেন স্টালিন। ট্রট, বুখারীনের মতন বুদ্ধিজীবিরা পার্টির এসেট নন-লায়াবিলিটি, ঘনিষ্ঠ মহলে সেই ঘৃণা কখনোই চেপে রাখেন নি[5]। ট্রটকে নির্বাসনে তাড়ানোর সময় তাকে জনসমকক্ষে হাতকড়া পরিয়ে প্যারেড করিয়ে হিউমিলিয়েট করানোর আইডিয়াটাও তার! এবং সেই ফিল্ম রাশিয়াতে দেখানো হত বার বার, বোঝাতে যে স্ট্যালিন লাইনে টো না করলে, ট্রটস্কির মতন দিকপালেরই যদি এই হাল হয়-বাকিদের কি হতে পারে! ভয় দেখানো জন্যে মিডিয়ার ব্যাবহারে স্ট্যালিন এবং গোয়েবেলের তুলনা বারবার আসবে। সেই প্রশঙ্গে পড়ে বিশদ আলোচনা করব।

এডলফ হিটলারকে তুলনামুলক ভাবে গণতান্ত্রিক পথেই উঠতে হয়েছে। সুতরাং বক্তৃতা এবং লেখাই ছিল হিটলারের হাতিয়ার। স্ট্যালিন সেই অর্থে ছিলেন স্ট্রীট ম্যানেজার। স্ট্যালিনের বক্তৃতা হিটলারের তুলনায় একদম ম্যারমেরে। কিন্ত অর্গানাইজার হিসাবে স্ট্যালিন অনেক বেশী সফল। নাজি পার্টীতে হিটলারের মূলকাজ ছিল শ্রেফ বক্তৃতা দেওয়া এবং স্স্ট্রাটেজী ঠিক করা। পার্টি গঠনের কাজ করতেন গোয়েবেল। নাজি পার্টিতে হিটলারের কতৃত্ব কখনোই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয় নি। ইহুদিদের বিরুদ্ধে যখন ঘৃণা ছড়াচ্ছিলেন -অসবার্গে পার্টি নেতৃত্ব প্রথম এবং শেষ বারের মতন্ বিদ্রোহ করবে। নিজের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্যে, হিটলার পার্টি থেকে পদত্যাগ করতে চাইলেন (২১ জুলাই, ১৯২১)। হিটলারের জন্যেই যে পার্টির উত্থান-তা কি হিটলার ছাড়া ভাবা যায়। হিটলার ও মওকা বুঝে ৫৪০-১ ভোটে নিজেকে পার্টির সুপ্রীম বা ফুয়েরার বানালেন। এই ব্ল্যাকমেলের স্ট্রেটেজীতে স্ট্যালিনও সিদ্ধহস্ত ছিলেন। নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দখলের জন্য ইনাদের কুকীর্তির লিস্টটা পরে আলোচনা করব। আপাতত শুধু এটা বোঝা যাক (১) স্ট্যালিন যেমন জর্জিয়ান ছিলেন, হিটলার ছিলেন অস্ট্রিয়ান। ফলে স্টালিনকে যেমন রাশিয়ানদের প্রতি আনুগত্য একটু বেশী প্রমান করতে হয়েছে-সেই দায়টা হিটলারের মধ্যেও ছিল (২) দুজনেই জনগণের মন বুঝতেন-পিপলস রিডিং ছিল অসাধারন।

হিটলার প্রথম বিশ্বযুদ্ধে চারবছর ধরে ব্যাভেরিয়ান রেজিমেন্টের হয়ে ফ্রান্স-বেলজিয়াম ফ্রন্টে যুদ্ধ করেছেন। দুবার আইরন ক্রসও পেয়েছেন। তার এই যুদ্ধ-অভিজ্ঞতাই, ভবিষ্যতে পতনের কারন হবে। কারন, জার্মানীর সমস্ত যুদ্ধে জেনারেলদের স্ট্রাটেজ়ীতে হিটলার নাক গলাতেন-এবং রাশিয়া থেকে আফ্রিকা, সব বাজে সিদ্ধান্তগুলোই তার নেওয়া। স্টালিন কাঁধের হাড় ঠিক না থাকায়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেওয়া থেকে অব্যাহতি পান। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, স্ট্যালিন যুদ্ধের সমস্ত স্ট্রাটেজী জেনারেলদের হাতেই ছেড়ে দিয়েছিলেন-কারন তিনি জানতেন, সে ক্ষমতা তার নেই। যদিও যুদ্ধ জেতার পর, সমস্ত প্রোপাগান্ডা ফিল্মে দেখানো হবে, তিনিই স্ট্রেটেজীস্ট [6]।সোভিয়েতের প্রতিটা এচিভমেন্টের জন্যে মিডীয়া, তার আদেশে শুধু তারই জয়গান গাইত! ক্রুশ্চেভের জমানায়, ডিস্টালিনাইজেশনের সময়-এসব প্রপাগান্ডা ফিল্ম বাতিল করা হয়।

যাইহোক যুদ্ধক্ষেত্রে নার্ভ গ্যাস খেয়ে কিছুদিন অন্ধত্বের মধ্যে কাটাতে হয় হিটলারকে। কিন্ত তার এই মৃত্যু অভিজ্ঞতার জন্যেই অনেক মনোবিদ বলেন-হিটলার মানুষ এবং ইঁদুরের মৃত্যুর মধ্যে পার্থক্য করতেন না। যদিও, তিনি জার্মান জাতিয়তাবাদের জয়গান গাইতেন, আদতে ছিলেন অস্ট্রিয়ান সিটিজেন। সেকারনে সেনাবাহিনীতে উঁচু র‌্যাঙ্কে উঠতে পারেন নি। তবুও তিনি জার্মানদের থেকে বেশী জার্মান সেটা সব জ্বালাময়ী বক্তৃতাতেই প্রমান করতেন। ন্যাশানাল স্যোশালিস্ট জার্মান ওয়ার্কারস পার্টিতে তার উত্থান অবশ্য সুবক্তা হিসাবে। ভার্সাই এর চুক্তিতে জার্মানদের যে নিষ্ঠুর ভাবে অপমান করা হয়েছে-তা জ্বালাময়ী ভাষ্যে সর্বত্র প্রচার করতেন। পুঁজিবাদ, মার্ক্সবাদ এবং ইহুদিদের দায়ী করতেন জার্মানদের দুর্দশার জন্যে। বাজারে তা খেতও ভাল। এই ভাবেই ভেবে বসলেন জার্মানরা তার পাশেই আছে। এবং সেই অনুযায়ী ১৯২৩ সালে মিউনিখে বিপ্লবী সরকারের প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ব্যার্থ হলেন-বুঝলেন মার্কেট আছে কিন্তু তার রাজনৈতিক দর্শন এখনো জনগণ বোঝে নি। রাষ্ট্রোদ্রোহের অভিযোগে জেল খাটতে গিয়ে লেখার সেই সুযোগ এসে গেল। জার্মানীর একট বড় অংশ তার প্রতি সহানুভূতিশীল থাকায় জেলে থাকতেন রাজার হালে। রাজনৈতিক বন্দী হিসাবে সেক্রেটারীও জুটলো। এই ভাবেই লিখে ফেললেন আত্মজীবনী "মেইন ক্যাম্প"।

বস্তুত আমাদের বিজেপি বা বাংলাদেশের বি এন পি্র ঘৃণার জাতিয়তাবাদি রাজনীতির আরো গভীর নির্যাস এই বইয়ে পাওয়া যাবে। হিটলার ইতিহাস পড়তেন খুব বেশী-ফলে জার্মানীর দুর্দিনে, নিজেদের ব্যার্থতার জন্যে ফ্রান্স, আমেরিকা, মার্ক্সবাদ, ইহুদি ইত্যাদি জাতির শত্রু দাঁড় করিয়ে নিজের ভিত শক্ত করলেন। ঠিক যেমন ভাবে বিজেপি এবং বি এন পি জাতির শত্রুতত্ত্বের ওপর বিশেষ জ়োর দিয়ে থাকে। তারই সুপ্রীম থিসিস। যেকারনে হিন্দুত্ববাদি নেতারা, হিন্দুত্ববাদি রাজনীতির একদম প্রথম দিন থেকেই হিটলারের আর্য্য জাতিয়তাবাদের সব থেকে বড় ভক্ত [7। অবশ্য একথা মনে করার কারন নেই হিন্দুত্ববাদিরাই একমাত্র হিটলার ভক্ত পাপী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্যালেস্টাইনের মুক্তি আন্দোলনের সব থেকে বড় জাতীয়তাবাদি নেতা হাজ আমিন আল হুসেনি হিটলারের সাথে সাক্ষাত করে প্যালেস্টাইনে ইহুদি নিধনের জন্য মুসলিম প্যান্থার বাহিনী গঠন করেন। মিশর তথা আরব জাতিয়তাবাদের আবিসাংবাদিত নেতা গামেল আবদেল নাশেরও হিটলারের অনুগত ভক্ত ছিলেন[8]। আর আমাদের নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোসকেই বা বাদ দিই কেন! আনোয়ার সাদাত, ইরাকি বার্থ পার্টি থেকে সৌদি রাজা ইবন সাউদ সবাই হিটলারের গুনমুগ্ধ ভক্তের দলেই পড়েন [8]। হিন্দুত্ববাদিদের হিটলার প্রীতি নিয়ে গালাগাল দেওয়ার সময়, আরব জাতিয়তাবাদি নেতারদের হিটলার প্রীতিও মনে রাখা উচিত। কারন "জাতিয়তাবাদ" দর্শন কত ভয়ংকর এবং বিকৃত হতে পারে কোন দেশের সংখ্যালঘুদের জন্যে, তা এই মেইন ক্যাম্প এবং তার পরবর্ত্তীতে নানান দেশের জাতিয়তাবাদি আন্দোলনে এর প্রভাব না দেখলে বোঝা যাবে না।

পরের অধ্যায়ে হিটলার এবং স্ট্যালিন কিভাবে গুপ্ত হত্যা, কনসেনস্ট্রেশন ক্যাম্পে বুদ্ধিজীবি হত্যা এবং মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দখল করেন তাই নিয়ে আলোচনা করব। রাশিয়াকে সুপার পাওয়ার করার জন্যে যারা আজও স্ট্যালিনের ভক্ত, তারা যেন এটা না ভুলে যান, স্ট্যালিনের অনেক কম সময়ে হিটলার জার্মানীকে সুপার পাওয়ার করেছেন। বস্তুত রাশিয়ান শীত না থাকলে মস্কোর পতন নিশ্চিত ছিল জার্মানদের হাতে। সবথেকে বড় কথা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সোভিয়েত ইউনিয়ানকে সুপার পাওয়ার বলা হলেও-আদৌ তাদের সেই স্বীকৃতি দেওয়া যায় কি না সেটাও বিশ্লেষন করা দরকার। যেটা আমি বলতে চাইছি-সেটা হল এই-কোন সমাজের বস্তুবাদি উন্নতি করতে যদি কোটি কোটি নাগরিককে ক্রীতদাশ বানাতে হয় এবং কোটি কোটি লোকের প্রান যায়, সেই বস্তুবাদি উন্নতির কি কোন অর্থ থাকে? যদি ধরেই নি আজ বাংলাদেশে হিটলার বা স্ট্যালিনের মতন ডিক্টেটররা এসে দশ-বিশ বছরে ডান বা বাম পথে বাংলাদেশকে মালেশিয়া বা চীনের মতন উন্নত দেশে নিয়ে যেতে সক্ষম হলেন। কিন্ত ফলস্বরূপ দুই তিন কোটি লোক অর্ধাহারে, অনাহারে, ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে মারা গেল। সংখ্যালঘুদের নিশ্চিহ্ন করা হল। বাংলা সাহিত্যে এবং সংস্কৃতিতেও লালবাতি জ্বলে গেল-যেমনটা স্ট্যালিনিস্ট রাশিয়াতে হয়েছে। পৃথিবীর সব থেকে সমৃদ্ধশালী সাহিত্যের দেশ, স্টালিনের অত্যাচারে বন্ধ্যা হয়ে যায়। এতটা ক্ষতি স্বীকার করে উন্নতির কি মানে হবে? বা ভারতেই যদি ডান বা বাম ডিক্টেটর এসে, দেশটাকে চীন বা হিটলারের জার্মানী বানাতে চাই-পৃথিবীর বৃহত্তম সমৃদ্ধ সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে-সেটা কি খুব অর্থবহ কিছু হবে? এখন বলতেই পারেন যে দেশের লোকেরা খেতে পায় না-তাদের আবার সাহিত্য, সংস্কৃতি নাচ-গান কি? প্রথমত এগুলো বাদ দিয়ে কি বাংলা বা ভারতীয় জাতির আলাদা অস্তিত্ব থাকে? দ্বিতীয়ত গণতন্ত্রের পথে ভারত দারিদ্র অনেক কমিয়ে এনেছে-হয়ত চীনের মতন আমরা সফল নই। কিন্তু এটাও ত সত্য আমাদের বাপ ঠাকুর্দারা মানুষের মর্যাদা নিয়েই বেঁচেছেন। পুলিশের ভয়ে ঘরের কোনে লুকিয়ে- অর্ধাহারে থেকে পশুর মতন বাঁচেন নি।পশুর বা রোবটের মতন বেঁচে বস্তুবাদি উন্নতির কি মুল্য? গণতন্ত্র অবশ্যই ত্রুটিপূর্ণ। উন্নতির পথও অনেক ধীরে। কিন্ত মানুষকে মর্যাদা দিয়ে, যে উন্নতি-তার কোন দাম নেই? যারা গণতন্ত্রের সমালোচনা করেন তারা কি হিটলারের জার্মানী বা স্ট্যালিনের রাশিয়াতে থাকতে চাইবেন? যেখানে কোন কারন বা অকারনে শুধু কোটা পূরণ করার জন্যে লোককে সাইবেরিয়া বা কনসেনস্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে খুন করা হত? উত্তর যদি 'না' হয়, তাহলে কোন যুক্তিতে তারা স্ট্যালিন বা হিটলারকে মহান করেন? দরকার হলে এই প্রবন্ধের শেষে হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরী স্ট্যালিনের ওপর একটা ডকুমেন্টারী আছে-দেখে নিন। দেখার পর বলুন ওই রাশিয়াতে তারা থাকতে চাইতেন কি না?

আরেকটি ছোট কথা বলে নিই। স্ট্যালিন এবং হিটলার দুজনেই স্যোশাল ডারুনিজমে বিশ্বাস করতেন [৯]। অর্থাৎ যোগ্যতম মানুষেরা দুর্বলদের মেরে বেঁচে থাকবে-এটা তারা বিশ্বাস করতেন। এই বিকৃত জ্ঞান, যা মোটেও ডারুনিজম নয় (কারন ডারুনিজম বলে প্রকৃতি সবলদের সিলেক্ট করে-দুর্বলদের ওপর সবলদের অত্যাচারের কোন কাহিনী ডারউইনের তত্ত্বে নেই), তাতে বিশ্বাস করে, কোটি কোটি মানুষের জীবন নাশ করেছেন। জীববিজ্ঞান কিন্তু আমাদের শেখায় পশুকুলেও নেহাত খাবারের অভাব না থাকলে কেওই অন্যদের আক্রমন করে না। অর্থাৎ হিটলার এবং স্ট্যালিন আদর্শবাদের ভাইরাসকে কাজে লাগিয়ে মানুষকে পশূতের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছিলেন। এবং এদের নিয়ে যখন বর্তমান প্রজন্মের নাচানাচি দেখি, কম্যুনিজম এবং জাতিয়তাবাদের আদর্শকে দেখে ভয় হয়-বিশ্বাসের এই ভাইরাস কিভাবে এদের সমর্থকদের ব্রেইন ওয়াশ করে পশুদেরও নীচু পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে।

[চলবে] দ্বিতীয় পর্ব এখানে

[1]http://www.russiatoday.com/news/news/32299

[2]Nenarokov, Albert P., Russia in the Twentieth Century: the View of a Soviet Historian, William Morrow Co, New York, 1968

[3]Barry McLoughlin; Kevin McDermott(eds) (2002). Stalin's Terror: High Politics and Mass Repression in the Soviet Union

[4]Getty, Rittersporn, Zemskov. "Victims of the Soviet Penal System in the Pre-war Years". See also: Stephen Wheatcroft (1996). "[http://sovietinfo.tripod.com/WCR-German_Soviet.pdf The Scale and Nature of German and Soviet Repression and Mass Killings, 1930-45]" (PDF). and Stephen Wheatcroft (1990). "More light on the scale of repression and excess mortality in the Soviet Union in the 1930s

[5]Simon Sebag Montefiore. Young Stalin. 2007.

[6]http://www.youtube.com/watch?v=5AjKWU1h2Vo&feature=related

[7]The Clash Within: Democracy, Religious Violence, and India's Future

By Martha Craven Nussbaum

[8]http://www.nationalreview.com/nr_comment/nr_comment071802a.asp

[9] Lenin, Stalin and Hitler: Age of Social Catastrophe -Robert Gelateley

স্ট্যালিনের জমানার ওপর একটি ভাল ডকুমেন্টারীঃ

১।http://www.youtube.com/watch?v=fun9pGb8wHw

২|http://www.youtube.com/watch?v=bOdr6XE70Rk&feature=related

৩|http://www.youtube.com/watch?v=yWa0Dxo1ngA&feature=related

৪|http://www.youtube.com/watch?v=cw59cnY0Rr0&feature=related

৫|http://www.youtube.com/watch?v=st6rxfI2iS8&feature=related

৬|http://www.youtube.com/watch?v=lNfwEH0yt-s&feature=related

৭|http://www.youtube.com/watch?v=6rVGwnArBxI&feature=related

৮|http://www.youtube.com/watch?v=5AjKWU1h2Vo&feature=related

৯|http://www.youtube.com/watch?v=_75DZ6PdFiM&feature=related

মাও বনাম গান্ধী

বিবর্তনের পথেই রাষ্ট্রের জন্ম। জন্মলগ্ন থেকেই রাষ্ট্রের একটি চরিত্র অপরিবর্তিত। সেটি ক্ষমতার মোহ এবং নিজস্বার্থ রক্ষার্থে শাসক কুলের দমন এবং নিপীড়ন। জীববিজ্ঞানীরা এব্যাপারে মানবকুলের সাথে পশুকুলের অনেক সাদৃশ্য পেতেই পারেন। শাসক শ্রেণীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে শোষিতদের প্রতিবাদ মানব ইতিহাসের সব থেকে গুরুত্বপূর্ন অধ্যায়। সবকটি ধর্মের উৎপত্তিই একেক ধরনের প্রতিবাদি আন্দোলন। রোমান সম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ইতিহাসে আমরা দেখি গল, গথ,ইজিপ্টিশিয়ানদের ধারাবাহিক বিদ্রোহ। ভারতে মুঘল সম্রাজ্যের বিরুদ্ধে মারাঠা, রাজপুত এবং বাঙালীরা বারবার গর্জে উঠেছে-শেষে এদের বিদ্রোহে মুঘল সম্রাজ্যের পতন সম্পূর্ণ। ইতিহাসের সেই ধারা একবিংশ শতাব্দিতেও অবিচ্ছিন্ন। গোটা বিশ্বজুরে যত প্রতিবাদি আন্দোলন এখন চলছে-তার মূলত তিনটি ধারাঃ

(১) নাগরিক এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্যে অহিংস আন্দোলন। তিব্বতের স্বাধীনতা আন্দোলন, বার্মার গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং আমেরিকার সিভিল রাইট মুভমেন্ট এই ঘরানার। গান্ধীবাদি রাজনৈতিক আদর্শই এদের চেতনা।

(২) শোষনমুক্তির জন্য সহিংস কমিনিউস্ট আন্দোলন-ভারত, নেপাল, বাংলাদেশের মাওবাদি চেতনার মূল লক্ষ্য। ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকাতেও মাওবাদি গেরিলাদের প্রভাব বেড়েই চলেছে।

(৩) এছারা ধর্ম ভিত্তিক প্রতিবাদি আন্দোলন প্রায় অনেক দেশেই দেখা যায়। ধর্ম যে সব সময় শাসক শ্রেনীর হাত শক্ত করে তা নয়। যেমন সৌদি আরবে রাজতন্ত্র বা পাকিস্থানের শাসক শ্রেনীর বিরুদ্ধে জিহাদিরাই লড়ছে। তামিল টাইগারও একধরনের হিন্দু প্রতিবাদি আন্দোলনে বিশ্বাসী। তবে এই ধরনের আন্দোলন একটি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে আরেকটি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির লড়াই। সেই জন্যেই শাহর ইরাণের বিরুদ্ধে ইসলামের প্রতিবাদি আন্দোলন আসলেই ক্ষমতার কুশীলবদের প্রতিস্থাপিত করে-শোষন এবং অত্যাচার নতুন জমানাতে বরং আরো বেড়ে ওঠে। এই যে হামাস ইস্রায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই করছে-কিন্ত এদের অন্তিম লক্ষ্য কি? মেয়েদের বোরখা পড়িয়ে ঘরে ঢুকিয়ে সভ্যতার ঘড়িকে উলটো দিকে চালানো।

এখানেই মাও এবং গান্ধীবাদি প্রতিবাদি আন্দোলনের সাথে অন্যদের পার্থক্য। শোষকদের ক্ষমতাচ্যুত করলেই শোষন শেষ হয় না। নতুন শাসক শ্রেনী, যারা এক সময় প্রতিবাদি আন্দোলনের শরিক ছিল-তারাই নব্যশোষক শ্রেণীর স্থান নিয়ে থাকে। পশ্চিম বঙ্গে এটা আমরা দেখেছি। বামফ্রন্ট এসেছিল গ্রামের ক্ষমতাসীন জমিদার শ্রেণীটিকে হটিয়ে। কিন্ত যারা এই পুরাতন ক্ষমতার কেন্দ্রগুলিকে হঠালো, তারাই আজ গ্রামে গ্রামে অত্যাচারের নব্য বুলডোজার।

এই জন্যে মাওবাদি এবং গান্ধীবাদি প্রতিবাদি আন্দোলন কোন দেশকালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। তাদের দৃষ্টিতে প্রতিবাদি আন্দোলন ই আন্দোলনের শেষ কথা না। প্রতিবাদি আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে মানুষের চরিত্রের বিবর্তন এবং তার থেকে সমাজবিবর্তনের মধ্যে দিয়েই শোষনমুক্ত সাম্যবাদি সমাজের উত্তরোনই ফাইনাল ডেস্টিনেশন। তবে দুটি ধারার মত, পথ এবং আদর্শ ১৮০ ডিগ্রী আলাদা।

সহিংস বনাম অহিংসঃ

মাও বিশ্বাস করতেন প্রতিবাদি আন্দোলন কখনোই অহিংস বা গণতান্ত্রিক হতে পারে না। তার চোখে গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ আসলেই শোষক শ্রেনীর বিরুদ্ধে খেটে খাওয়া মানুষদের ক্ষোভকে "ম্যানেজ করার বুর্জোয়া পদ্ধতি। শাসকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামই শ্রেনী সংগ্রামের সর্বোচ্চ ধাপ। এটাই মাওবাদি পথ।

Revolutions and revolutionary wars are inevitable in class society, and without them it is impossible to accomplish any leap in social development and to overthrow the reactionary ruling classes and therefore impossible for the people to win political power.
"On Contradiction" (August1937), Selected Works, Vol. I, p. 344.*

War is the highest form of struggle for resolving contradictions, when they have developed to a certain stage, between classes, nations, states, or political groups, and it has existed ever since the emergence of private property and of classes.
"Problems of Strategy in China's Revolutionary War" (December 1936), Selected Works, Vol. I, p. 180.

অন্যদিকে মহত্মা গান্ধী সব ধরনের যুদ্ধ এবং সহিংসতাকে "ম্যানস্লটার" বা "মানবনিধন যজ্ঞ" বলে মনে করতেন। হিংসাত্মক পদ্ধতিতে হিংসাত্মক স্বাধীনতা বা মুক্তি আসে-এটাই ছিল তার বক্তব্য।

“Violent means will give violent freedom. That would be a menace to the world and to India herself.!”

গান্ধী এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন ইতিহাস বিশ্লেষন করে। নভেম্নর রিভল্যুশন বা লং মার্চের ফলে রাশিয়া বা চীনে যে "মুক্তি" এল- তার বলি কোটি কোটি মানুষ। স্টালিনের জমনাতেই তিন দশক ধরে রাষ্ট্রের হাতে খুন হয়েছে প্রায় চারকোটি লোক। চীনে সাংস্কৃতিক বিপ্লবে প্রাণ দিয়েছে আরো পাঁচ কোটি। সশস্ত্র বিপ্লব দিয়ে বাংলাদেশ মুক্ত হল '৭১ সালে। কিন্তু '৭৫ সালের মধ্যেই আরো রক্তপাতে প্রতিবিপ্লব ঘটিয়ে মুক্তি যুদ্ধের চেতনার দফারফা করে দেওয়া হল। '৭১ এর আগের সেই একই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিটা বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতায় ফিরে এল।

প্রশ্ন উঠবে বাংলাদেশ যদি গান্ধীবাদি অহিংস আন্দোলনের ফলে স্বাধীন হত-তাহলে কি এমন হত? এক্ষেত্রে প্রথম প্রশ্ন ঊঠবে খান সেনাদের বিরুদ্ধে আর কি গান্ধী চলে? ওসব সভ্য বৃটিশদের বিরুদ্ধে ঠিক আছে। অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তির কথা প্রায় কেওই মানতে চাইবেন না। পাকিস্থানের বর্বরতার বিরুদ্ধে এসব খাটত না বলেই সবাই মনে করবেন। কিন্তু ধরুন, যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন অহিংস পথে থাকত-তাহলে মুক্তিযোদ্ধা তথা মুক্তিকামী বাংলাদেশীদের মনে "স্বাধীনতার চেতনা" আরো দৃঢ় বদ্ধমূল হত। হাতে বন্দুক উঠলে, হিংসার পথে মানব মুক্তির চেতনাগুলো দুর্বল হয়-এটা গান্ধীবাদের অন্যতম মুলমন্ত্র। আহিংস আন্দোলনে প্রতিবাদের একমাত্র ভরসা প্রতিবাদির দৃপ্ত চেতনা-কারন তার হাতে বন্দুক নেই। সেই জন্যেই দেখুন ১৯৭৫ সালের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের একটা শ্রেণীই স্বাধীনতার চেতনার বিরুদ্ধে গিয়ে শ্রেফ ক্ষমতার লোভের জন্যে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে থাকা শক্তিটির সাথে হাত মিলিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করল। অর্থাৎ ওই শ্রেণীর মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতার যুদ্ধের স্পিরিটকে মোটেও গ্রহণ করে নি-তাদের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধটা ছিল পাঞ্জাবের শাসককুল থেকে বাংলার শাসককুলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের খেলা। এটা অহিংস আন্দোলনে সম্ভব না। কারন ক্ষমতাদর্পী নররূপী বাঘ সিংহদের বিরুদ্ধে খালি হাতে দাঁড়াতে যে বুকের পাটা লাগে, তা একমাত্র মানুষের ক্ষমতালোভি চরিত্রের বিরুদ্ধে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমেই তৈরী হয়।

এই জন্যেই গান্ধীবাদি আন্দোলন একিই সাথে রাষ্ট্র, সমাজ এবং আত্মোন্নতির পথ-প্রতিবাদি আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে প্রতিবাদির চরিত্রের সর্বোত্তম বিকাশই এখানে শেষ কথা।

সশস্ত্র প্রতিরোধ ইতিহাসে নতুন কিছু নয় সেটা আগেই লিখেছি। গান্ধীবাদি পথও আসলেই প্রাচীন ভারতে জৈন এবং বৌদ্ধদের প্রতিবাদি আন্দোলনের নব্যরূপ। তবে অনেকেই গান্ধীবাদি আন্দোলনকে হিন্দুধর্মের সাথে জড়িয়ে দেন। সেটা মারাত্মক ভুল। গান্ধীবাদি এবং হিন্দুত্বের পথ ১৮০ ডিগ্রী আলাদা। যুদ্ধ সংক্রান্ত প্রতিবাদি আন্দোলনের ব্যাপারে কৃষ্ণের গীতার বাণীর সাথে মাওএর অনেক মিল আছে। গীতার ধর্মযুদ্ধের মতন মাও সমস্ত যুদ্ধকে ন্যায় এবং অন্যায় যুদ্ধ এই দুই ভাগে ভাঙতেন।

“History shows that wars are divided into two kinds, just and unjust. All wars that are progressive are just, and all wars that impede progress are unjust. We Communists oppose all unjust wars that impede progress, but we do not oppose progressive, just wars. Not only do we Communists not oppose just wars; we actively participate in them. As for unjust wars, World War I is an instance in which both sides fought for imperialist interests; therefore, the Communists of the whole world firmly opposed that war. The way to oppose a war of this kind is to do everything possible to prevent it before it breaks out and, once it breaks out, to oppose war with war, to oppose unjust war with just war, whenever possible.
Ibid., p. 150.

শোষনমুক্তির জন্যে মানুষকে আক্রমন করার এই যুক্তি গান্ধী মানেন নি। তার মতে লড়াইটা সিস্টেমের বিরুদ্ধে, মানুষের বিরুদ্ধে নয়-কারন সৃষ্টির লীলাখেলায় সব মানুষই সমান। অত্যাচারী এবং অত্যাচারিত দুজনেই মানুষ। কেও শোষন করলে, অত্যাচার করলে, না বুঝে ভুল করে করছে। শাসকদের সেই ভুল ভাঙাতে হবে। শাসকদের আত্মোপলদ্ধির মধ্যে দিয়েই শোষনের অবসান হবে- এটাই ছিল তার মত।

“It is quite proper to resist and attack a system, but to resist and attack its author is tantamount to resisting and attacking oneself, for we are all tarred with the same brush, and are children of one and the same Creator, and as such the divine powers within us are infinite. To slight a single human being, is to slight those divine powers and thus to harm not only that Being, but with Him, the whole world.”
-Gandhi

অর্থাৎ গান্ধীর সাথে মাওবাদের মূল পার্থক্য ভাববাদ বনাম বস্তুবাদের। গান্ধীর চোখে সবাই ঈশ্বরের সন্তান। শোষকের শোষন যেমন ঈশ্বর বিরুদ্ধ -ঠিক তেমনই শোষকের বিরুদ্ধে যুদ্ধও ঈশ্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। মানুষের সাথে মানুষের যুদ্ধই ঐশ্বরিক চেতনা বিরোধি। তাই তার চোখে আসল ভিলেন হচ্ছে সিস্টেম-যে সিস্টেমে মানুষ ক্ষমতা এবং ধণদর্পে অত্যাচার করে, শোষন করে। ক্ষমতা এবং শোষন মানুষের আধ্যাত্মিক বিচ্যুতি-তাই গান্ধীবাদের লড়াইটা সেই আধ্যাত্মিক বিচ্যুতির বিরুদ্ধে-এবং সেই সিস্টেমের বিরুদ্ধে যা এইসব মানবিক বিচ্যুতি ঘটাচ্ছে। তাই প্রতিবাদি আন্দোলনের মাধ্যমে শোষক এবং অত্যাচারীর মনের পরিবর্তন ঘটিয়ে শোষন এবং অত্যাচারের অবসান ঘটানোই গান্ধীবাদ। ঈশ্বরে জায়গায় মানবিকতা ঢোকালেও তার মূল বক্তব্য একই থাকে।

গান্ধীর এই মডেল সম্পূর্ন মার্ক্সীয় বস্তুবাদ বিরোধি। কারন মার্ক্সীয় বস্তবাদে সিস্টেম থেকে মানুষকে আলাদা করা যায় না। মার্ক্সীয় দৃষ্টিতে মানব মন তার পারিপার্শিক বস্তুবাদি সিস্টেমের প্রতিফলন।

আসল ব্যাপারটা হচ্ছে মানুষের মনের ব্যাপারে ১০০% মার্ক্সীয় বস্তুবাদি বা ১০০% গান্ধীবাদি ভাববাদি মডেল দুটিই ভুল। বিবর্তন মনোবিজ্ঞান থেকে আমরা জানি মানুষের মনের চিন্তার অনেকটাই জেনেটিক্যালি কোডেড-শুধু বস্তুবাদি কণ্ডিশনিং করে মানব মন তৈরী হয় না। মানুষের ক্ষমতার লোভ বিবর্তন প্রসু্ত এবং তা মানুষের যৌনতার আরেকটি প্রতিফলন। আলট্রূইজ়মও বিবর্তনের ধারায় সমাজের "রিপ্রোডাক্টিভ ফিটনেস" যা স্বার্থপর জীনের "ক্ষমতালোভ" এর বিরুদ্ধে কাজ করে যুদ্ধের পরিমান কম রাখে-যাতে অজথা প্রানশক্তির ক্ষয় না হয়। অর্থাৎ বিবর্তনের মধ্যেই ক্ষমতার লোভ বনাম গান্ধীবাদি আলট্রুইজমের ধারা সব সময় থেকে গেছে। গান্ধীবাদি চেতনা পশুকুল থেকে মানবকুলে সব সময় ছিল-এবং গ্রুপ সারভাইভালের সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা টেকনিক। সেটাকেই ঈশ্বরের নামে বাপুজি আরো ভাল ভাবে নিজের জীবনের মাধ্যমে দেখিয়েছেন। এবং এই নিয়ে গত দুই দশক বিস্তর গবেষনা হয়েছে।

সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ Erik Erikson's মনোবিজ্ঞানের ওপর লেখা গবেষনা Gandhi's Truth: On the Origins of Militant Nonviolence। এরিকসন এই গ্রন্থে নেকড়ে এবং হরিনদের মধ্যে চালু কয়েকটি খেলার উল্লেখ করেছেন। নেকড়েরা অনেক সময় যুদ্ধ যুদ্ধ খেলে এবং একগ্রুপ অন্যদের হারালেও, বিজিতদের মেরে ফেলে না-অত্যাচারও করে না-বরং তাদের "ক্ষমা" প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে দুটি গ্রুপের মধ্যে বন্ধুত্ব আরো দৃঢ় হয়। প্রশ্ন হচ্ছে এই একটা গ্রুপ-অন্যের প্রতি আলট্রুইস্ট ব্যাবহার দেখাবে কি না সেটা নির্ভর করছে, যে গ্রুপটি বিরোধিতা করছে-তারা বিরোধি পক্ষকে "অন্য পক্ষের লোক" বা "অন্যস্পেসিস" বলে ধরে নিচ্ছে কিনা। যেমন পশ্চিম বঙ্গে মাওবাদিরা এখন সিপিএমের লোকেদের দেখলেই খুন করে। উভয়েই বাঙালী এবং ভারতীয়-কিন্ত ঘৃণাটা এমন জায়গায় গেছে, মাওবাদিরা সিপিএমের লোকজ়নকে স্বগোত্রীয় বা মানুষ বলেই মানতে চাইছে না। অন্যদিকে মিশনারীরা গোটা পৃথিবীর লোককেই নিজেদের গ্রুপের লোক বলে মানে। গান্ধীর পথ ছিল সেটাই। যাতে জাত, ধর্ম, দেশের নামে অযথা গ্রুপিজম বন্ধ হয়। অবশ্য গান্ধিজী মনে করতেন, তার দর্শন জীববিজ্ঞান বিরোধি-কিন্ত এখন আমরা জানি সেটা ঠিক না। গান্ধীজি সম্ভবত পশুকুলের আলট্রুইস্ট ব্যাবহারের সাথে পরিচিত ছিলেন না।

The law of the survival of the fittest is the law for the evolution of the brute, but the law of self-sacrifice is the law of evolution for the man.... The basis of self-sacrifice is love.... It is no non-violence if
we love merely those that love us. It is non-violence only when we love those that hate us।

বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে আমি মাওবাদি বা গান্ধীবাদী-কোনটার ই ভবিশ্যত আছে বলে মনে করি না। মাওবাদের ভিত্তি-শ্রেণী বৈষম্য এবং শ্রেণী দ্বন্দ, তা গণতন্ত্র এবং প্রযুক্তির আরো বিকাশের সাথে সাথে লুপ্ত হবে। কারন ভবিষ্যতে অটোমেশনের জমানায়, নীচুশ্রেণীর কাজগুলি রোবটরাই করে দেবে। ফলে শ্রেণীর ধারনাটাই লোপ পাবে। অন্যদিকে গান্ধীবাদের মূল ভিত্তি-মানুষে মানুষে বিভেদ, বাজার অর্থনীতি এবং ইন্টারনেট বিষ্ফোরনের ফলে ভেঙে যাবে। ভবিষ্যতের মানুষের শুধু দুটি পরিচয় থাকবে-ক্রেতা আর বিক্রেতা। বাঙালী, ভারতীয়, আমেরিকান, হিন্দু, মুসলমান-এই সবপরিচয় বাজার অর্থনীতি এবং তথ্য বিস্ফোরনে ক্রমশ অর্থহীন হচ্ছে। সেটা আমরা চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি। তবুও গান্ধীবাদের ভিত্তি বিবর্তনের সাথে জড়িয়ে আছে বলে, আত্মবিশ্লেষন এবং ক্ষমতার অনাচারের বিরুদ্ধে তা শ্বাস্বত পথ।

সমস্যা হচ্ছে আমাদের দেশের মাওবাদিদের নিয়ে। ভারতে এই মুহুর্তে প্রায় ১৫,০০০ মাওবাদি গেরিলা। পশ্চিম বঙ্গে প্রতিদিন মাওবাদি বনাম সিপিএমের লড়াই এ লাশ স্তুপীকৃত হচ্ছে। যদিও মাওবাদিরা শোষিতদের পক্ষেই লড়াই করছে-আমি মনে করি তাদের পথ সম্পূর্ন ভুল এবং ব্যার্থ হতে বাধ্য। গণতন্ত্রের মাধ্যমে গরীবদের ক্ষমতায়নের জন্যেই তাদের লড়াই করা উচিত। এতে সময় বেশী লাগবে কিন্তু অনর্থক রক্তপাত আটকাবে। উন্নয়ন ও থেমে থাকবে না।

আমি ব্যাক্তিগত ভাবে সব সময় মনে করি লড়াইটা হওয়া উচিত সিস্টেমের বিরুদ্ধে, ঘৃণার বিরুদ্ধে, ভুল আদর্শের বিরুদ্ধে। মানুষের বিরুদ্ধে নয়। অনেকেই ইসলামিস্ট বা ফ্যানাটিক মুসলমানদের বিরুদ্ধে তীব্রঘৃণা ছড়ান। এটা ভুল পথ। তারাও মানুষ। ভুল আদর্শবাদের ফাঁদে পড়ে তারা আমাদের ঘৃণা করতে শিখেছে। তার জন্যে কি আমরা তাদের পালটা ঘৃণা করবো? তাতে কি ঘৃণা কমবে? বরং উলটো হবে। তাতে ঘৃণা আরো বাড়বে। বরং আমি মনে করি তাদের ফ্যানাটক আদর্শের সমালোচনার সাথে সাথে আমাদের ভালোবাসাটাও তাদের প্রাপ্য। নইলে আমরা তাদের থেকে কিসের জন্য উন্নততর? গান্ধীজির এটাই সবথেকে শক্তিশালী অস্ত্র। যারা গ্রুপিজম করে, তারা অন্যগ্রুপের চেয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠতর ভাবে। আঘাতটা সেই শ্রেষ্ঠতার ধারনায় দাও। বৃটীশদের বিরুদ্ধে সেটাই ছিল গান্ধীজির আমোঘ অস্ত্র-যা স্থান কাল নির্বিশেষে খুবই কার্যকরী।