Wednesday, August 21, 2019

ভারতে অর্থনৈতিক মন্দা? সবটাই কি নেতিবাচক ?

ভারতে অর্থনৈতিক মন্দা? সবটাই কি নেতিবাচক ?
*****
(১)
স্যোশাল মিডিয়ার যুগে চারিদিকে তথ্য বর্ষনই যুগধর্ম। অনেক পোষ্ট চোখে এল- ভারতে গাড়ি, স্টিল, টেক্সটাইল, টেলিকম, রিয়াল এস্টেট- সব ব্যবসাই ধুঁকছে। ব্যাঙ্ক কুয়ো ব্যাঙ হয়ে কাদায় - কারন এন পি এ বা অনাদায়ী ইনভেস্টমেন্ট। চারিদিকে ছাঁটাই হচ্ছে। যাকে বলে "ক্ল্যাসিকাল রিশেসন"। মন্দা।

এই পর্যন্ত বর্নন সঠিক। যেটা নিয়ে আমি সিউর না ( কারন আমি অর্থনীতিবিদ নই), এর জন্য মোদি সরকারের ডিমনেটাইজেশন, জিএসটিকে দোষ দেওয়া যায় কি না। অর্থনৈতিক মন্দা মানেই দেশের জন্য খারাপ, এই যুক্তি মানতেও রাজী না।

অর্থনৈতিক মন্দা বা রিশেসন ক্যাপিটালিজম বা মার্কেট ইকনমির অবিচ্ছেদ্য অংশ। ক্যাপিটালিজম মেনে নিলে, রিশেসনও থাকবেই। কারন রিশেসন বা মন্দা, ক্যাপিটালিজমের দৃষ্টিতে কারেকশন। মার্কেট যখন অকারনে ফুলে ফেঁপে ওঠে, তার কারেকশন দরকার হয়-না হলে সেই সেক্টরের ভবিষ্যত আরো অন্ধকার। বেসিক্যালি মন্দা হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় ফ্যাট ঝড়ানো। ব্যবসাকে আরো মেদবিহীন করা।

(২)

একটা উদাহরন দিচ্ছি। ভারতের রিয়াল এস্টেট। কোলকাতায় একটা দুই ঘরের ফ্ল্যাটের দাম অঞ্চল ভেদে ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা। ধরুন এই টাকাটা আপনাকে ব্যঙ্ক থেকে ধার নিয়ে কিনতে হচ্ছে। তাহলে মাসে মাসে ১০-১২% সুদের জন্য, আপনার মাসিক শুধু সুদের কিস্তি যাচ্ছে ৫০ হাজার থেকে ১০০ হাজার টাকা (১৫ বছরের লোন ধরলে) । এর সাথে ফ্ল্যাটের মেইন্টেনান্স ইত্যাদি যোগ করলে মোটামুটি মাসে ফ্ল্যাটের জন্য আপনার খরচ ৫০ হাজার থেকে লাখটাকা। এই ফ্ল্যাট ভাড়া দিলে আপনি দশ থেকে কুড়ি হাজারের বেশী পাবেন না। অর্থাৎ ফ্ল্যাট কেনা যদি ব্যবসায়িক ভিত্তিতে হয়, এবং ফ্ল্যাটের দামের যদি ফাটকা এপ্রিশিয়েশন না হয়, তাহলে কোলকাতা সহ ভারতের নানান শহরে ফ্ল্যাটের দাম অন্তত তিন থেকে চারগুন ইনফ্লেটেড। অর্থাৎ ফাটকা মার্কেটে এই দাম বেড়েছে এবং এই বেলুন যত দ্রুত ফাটে তত ব্যবসার জন্য ভাল। ভারতের রিয়াল এস্টেটে মন্দা ২০১৪ সাল থেকেই চলছে। কারত অত্যাধিক দাম। এবং এটা বার্স্ট না করলে রিয়াল এস্টেটের ব্যবসা ধ্বংস হবে। আমেরিকাতে ২০১০ সালের মার্কেট বাস্টের পর রিয়াল এস্টেটে দাম খুব স্টেবল। কোন ফাটকা নেই। ফলে সাধারন মধ্যবিত্ত অনেক সহজে বাড়ি কিনতে পারছে এখন। মানে লোকে থাকার জন্যই বাড়ি কিনছে। বাড়ি ফ্ল্যাট কিনে ফাটকা ব্যবসার করছে না। ফলে জনসাধারন যাদের "থাকার জন্য" বাড়ি কেনা দরকার, তারা বেঁচে গেছে। ওই বার্স্টটা দরকার ছিল।

গাড়ি শিল্পে দেখুন। প্রাইভেট গাড়ি ভারতে "ব্যান" করা উচিত। কারন রাস্তা নেই। গাড়ির এমিশন কন্ট্রলের বালাই নেই কোরাপশনের জন্য।
ফলে বাতাসের কোয়ালিটি একদম ডেডলি গ্যাস চেম্বার। শীতকালে কোলকাতায় এয়ার কোয়ালিটি ইন্ডেক্স ২৫০-৪০০ এর মধ্যে থাকে। যেখানে ১৫০ এর বেশী হওয়া মানেই গ্যাস চেম্বার। সুস্থ থাকার লিমিট ৫০ এর মধ্যে। ব্যাঙ্গালোর পুনের ভয়াবহ অবস্থা। অন্যদিকে ট্রাফিকের জন্য ফ্লাইওভার লাগছে। আর ভারতের যা ক্রনিক কোরাপশন ফ্লাইওভারগুলো পুতুল ঘরের মতন ভাংছে। তাছাড়া গোটা বিশ্বজুরেই গাড়ি শিল্পে মন্দা। কারন ইলেক্ট্রিক গাড়ি আসছে। যা সম্পূর্ন ক্লিন এবং অনেক ভাল। সুতরাং ভারতের গাড়ি শিল্পে মন্দা খারাপ খবর না।

২০০৮-২০১০ সালের রিশেসনের সব থেকে ভাল দিক ছিল- যে ওই দুই বছর কার্বন এমিশন সব থেকে কমছিল। মানে শিল্পে মন্দা এলে প্রকৃতি অন্তত বেঁচে যায়।

ভারতে ইলেক্ট্রিক ট্রেন, ট্রাম, ইলেক্ট্রিক বাস, মেট্রো -ইত্যাদি আরো উন্নত পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম দরকার। প্রাইভেট কারের দরকার নেই।

টেলিকম শিল্পের বার্স্ট ভারতে ২০১৬ থেকেই শুরু হয়েছে। জিওর সাথে সাথে। তাতে ১২ লাখ লোকের চাকরি গেছে। কিন্ত ভারতের সাধারন লোকেদের কি খারাপ হয়েছে? এখন ৩০০ টাকায় তারা ১০০ জিবি ডেটা পাচ্ছে। এর ফলে অনেক ব্যবসা এবং সাধারন মানুষের খরচ কমেছে। এটাই ক্যাপিটালিজম। যা এফিসিয়েন্সি বাড়ায়। টেলিকম শিল্প এখন অনেক বেশী অটোমেটেড । অত লোকের দরকার নেই। ফলে জনগন অনেক কম খরচে ফোন ইন্টারনেট চালাতে পারছে। যা ব্যবসার সহায়ক।

টেক্সটাইলে দেখুন। আমাদের ছোটবেলায় সারা বছরে দু তিনটি জামাপ্যান্ট হত মধ্যবিত্ত ফ্যামিলিতে। বর্তমানে খুব সাধারন মধ্যবিত্ত মহিলারাও সপ্তাহে সাত দিন দশ রকমের পোষাক না পড়লে লজ্জায় থাকেন। মুশকিল হচ্ছে এর জন্য তুলো আসবে কোত্থেকে? তুলো চাষে প্রচুর জল লাগে। আর ভারতের একুয়েফের বা ভূর্গভস্থ জলের অবস্থা নিবু নিবু। তুলোর ডিমান্ড কমলে ভূর্গভস্থ জল বেঁচে যাবে।

স্টিলের অবস্থা বহুদিন থেকেই খারাপ। রিয়াল এস্টেটের মন্দা এর মূল কারন। প্রাক্টিক্যালি কার্বন ফাইবারের যুগ আসছে। স্টীলের মন্দা আরো বাড়বে।

জোর করে শিল্পোৎপাদন বাড়িয়ে প্রকৃতিকে ধ্বংস করে, গোটা ভারতকে বসবাসের অযোগ্য করে দেওয়াটা কোন বুদ্ধিমান কাজ না। লোকেদের কাজ দরকার, তাই জোর করে শিল্প চালিয়ে পরিবেশ জল ধ্বংস করা আহাম্মকি ছাড়া কিছু হবে না।

(৩) এখন প্রশ্ন উঠবে তাহলে ছাঁটাই করা শ্রমিকরা, কি করবে? ভারতে ত কোন স্যোশাল সিকিউরিটি নেই। সামাজিক নিরাপত্তা নেই। তুলোর চাষ বন্ধ করলে চাষি কি খাবে?

এই প্রশ্নটাই ওঠা উচিত। এটাই আসল প্রশ্ন যেটা নিয়ে কেউ ভাবছে না। যে ভারতে সাধারন লোকেদের সামাজিক নিরাপত্তা নেই। বেকার ভাতা নেই। বার্ধক্যভাতাও নেই। যারা উন্নত বিশ্বে আছে। এই সামাজিক নিরাপত্তার নেট ছাড়া ক্যাপিটালিজম চলে না।

মনে রাখতে হবে, ক্যাপিটালিজমের লক্ষ্য থাকা উচিত প্রতিটা মানুষে যাতে সন্মানের সাথে কাজ পায়।

এখানে দুটো জিনিস দেখার আছে। মোদি এবং দিদি এক রাস্তায় হাঁটছেন। সেটা হচ্ছে ভারতে সরকারের খরচের একটা বড় অংশ যায় সরকারি কর্মচারি এবং সরকারি কোম্পানীর ভর্তুকি দিতে। ইনারা সেই খরচটা জনসাধারনের জন্য স্কিমে ঢালতে চাইছেন। কিন্ত এখনেই মধ্যবিত্ত শ্রেনীর রাগ। তাদের সাধের সরকারি চাকরির তাহলে কি হবে? ওই টাকা কেন ছোটলোকেরা ভোগ করবে নানান স্কিমের মাধ্যমে?

লক্ষ্য করুন মোদি-দিদির লক্ষ্য এই সরকারি সাদাহাতি না পুষে নানান স্কিমের মাধ্যমে জনগনের মধ্যে এই টাকা বাঁটা। সেটা টয়লেট বাড়ি বানানো, গতিধারা নানান কিছু হতে পারে। কারন গণতন্ত্র সেটাই চাইছে।

এটাই কিন্ত হওয়া উচিত। স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশগুলোর দিকে তাকান । ওদের সরকার ছোট। ওখানে ক্যাপিটালিজমই চলে। কিন্ত সরকার তার আয়ের অংশ সরকারি সাদা হাতির পেছনে খরচ না করে, জনসেবার কাজে ঢালছে- বেকার, মাতৃত্ব, চিকিৎসা, বার্ধক্য-সব কিছুর জন্যই ভাতা আছে সেখানে। সরকার চিকিৎসা শিক্ষা সম্পূর্ন ফ্রি করে দিয়েছে।

এটাই প্রশ্ন ওঠা উচিত। সরকারি টাকায় এয়ার ইন্ডিয়ার কর্মী, রেলওয়ের কর্মীদের মাইনে হবে কেন? সেটাত ব্যবসা। ওটা রেলের ব্যবসা থেকেই আসতে হবে। ট্যাক্সের টাকা যাওয়া উচিত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জনগনের সেফটি নেটে। রাস্তা ঘাটে।স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশগুলির সরকার খুব ছোট-কিন্ত সরকার তার সব টাকা সাদা হাতি না পুষে জনসেবাতে ঢালে।

ভারতে এটাই আসছে। বিজেপি পাবলিক কোম্পানি , রেইল, এয়ার ইন্ডিয়া প্রাইভেটাইজেশন করছে যাতে সেই টাকাটা তারা নানান জনসেবার স্কিমে ঢালতে পারেন। কারন সেটাই তাদের ভোটে জেতাবে। দিদিও একই পথে খেলছেন। এই ব্যপারে মোদি দিদির পার্থক্য নেই। এতে গেল গেল রব তোলার কিছু নেই।

আমার দৃষ্টীতে মোদি দিদি দুজনেই ঠিক পথেই হাঁটছেন।

(৪) এবার আসা যাক ছাঁটাই হওয়া কর্মীরা কি করবে। ছাঁটাই ছাড়া ক্যাপিটালিজম টেকে না। সুতরাং এই সমস্যার একটা সিস্টেটেমিক সমাধান থাকা উচিত।

এটাও দেখা যাক। ভারতের এখন ভূর্গভস্থ জলের সাংঘাতিক ক্রাইসিস। বাতাসের কোয়ালিটি খারাপ। কৃষিতে খরচ খুব বেশী।

আমরা অটো শিল্পে ৩ লাখ ছাঁটাই এর কথা বলছি-অথচ কটা শিল্প তৈরী হয়েছে ভূর্গভস্থ জল বাঁচাতে? যখন নাভিস্বাস উঠেছে চেন্নাইতে-এখন জল নিয়ে সব ভাবিতেছে। চাষের খরচ কমাতে প্রযুক্তি কোথায় ভারতে? অথচ ১৬০ টা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়/ কৃষিগবেশনাগার ভারতে। এদের আউটপুট কি?

অর্থাৎ ভারতকে বাঁচাতে যা যা দরকার। জল। বায়ু। গাছ। কৃষি। সেইসব শিল্পে কোন বড় ইনভেস্ট নেই। দরকার ছিল এইসব ক্ষেত্রে বিরাট ইনভেস্টমেন্ট। যেখানে অন্য শিল্পের উদবৃত্ত লোকেরা এই নতুন শিল্পে আসতে পারে। যাতে ভারত দেশটা বেঁচে যেত। মোদি-দিদি-বাম- সবার ব্যর্থতা এখানে যে দেশে কোন রাজনীদিবিদ নেই যে যারা রাজনীতির উর্ধে উঠে ভাবতে পারে। চীন এখানে অনেক এগিয়ে। ভারত পারছে না।

গাদা গাদা গাড়ি রাস্তায় নামিয়ে, ট্রাফিক জ্যাম বাড়িয়ে, বাতাসকে গ্যাস চেম্বার বানিয়ে, সাধারন জনগনকে আরো অসুস্থ করে মেডিকেল শিল্পের বিস্তার হচ্ছে বলে যদি কেউ ভাবে দেশের উন্নতি হচ্ছে, তারা সঠিক ভাবছেন না।

গণতন্ত্রে বিজেপি ব্যাশিং, দিদি ট্রলিং, বাম ট্রাশিং চলুক। কিন্ত কেউ যদি অটো শিল্পে মন্দা বলে ভাবে দেশের ক্ষতি হচ্ছে, আমি বলব, আপনারা কেউ সঠিক ভাবে ভাবছেন না। ভাবুন কোন ভারত আপনাদের ছেলে মেয়েদের জন্য রেখে যাচ্ছেন। তাদের বাঁচতে দেবেন না?

No comments: