Saturday, March 21, 2020

১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্ল যে শিক্ষা নিতে পারি

মহামারীর ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ন তথ্য পেলাম। যার থেকে সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করছি। ভুল হতে পারে। কিন্ত এগুলো ফারদার ইগনোর করলে মুশকিল।
(১) ১৯১৮-১৯ সালে উত্তর ফ্রান্স থেকে যে স্প্যানিশ ফ্ল ছড়িয়েছিল, তাতে সব থেকে বেশী মারা যায় ভারতে। প্রায় ১ কোটি সত্তর লক্ষ। দেশভাগ বা কোন যুদ্ধে ভারতে এত লোক মারা যায় নি। গঙ্গা ভরে গিয়েছিল ভেসে ওঠা পচাগলা মৃতদেহে। অথচ ইতিহাসের এই পর্বটি সম্পূর্ন গায়েব।
এটির উৎপত্তিও মুর্গী থেকে। উত্তর ফ্রান্সে। প্রথম যুদ্ধ শেষে ফ্রান্স ফেরত ২০০ জন সৈনিক বোম্বেতে অবতরন থেকে এটা ভারতে ছড়ায়।
আস্তে আস্তে গঙ্গা ভেসে ওঠে মৃতদেহে। পোড়ানোর লোক পর্যন্ত ছিল না। কেশব বালিরাম হেজগাওগারের জীবনী পড়তে গিয়ে জেনেছিলাম ১৯১৯ সালে মহামারী হয়েছিল। কারন এই মহামারীর বিরুদ্ধে তার স্বেচ্ছাসেবকদের কাজের সাথে পরবর্তীকালে ১৯২৫ সালে আর এস এসের জন্মের একটা সম্পর্ক আছে। ঠিক একই সময় খিলাফত আন্দোলন শুরু হয়। পাকিস্থানের জন্মের বীজ ছিল খিলাফত আন্দোলনে। সুতরাং ১৯১৯ সালের মহামারীর ইতিহাস প্রায় মৃত, সব সার্চ লাইট খেয়েছে খিলাফত আন্দোলন। অথচ গান্ধীজি সহ কংগ্রেস নেতৃত্বের অনেকেই আক্রান্ত হয়েছিলেন এই স্প্যানিশ জ্বরে।
মহামারীতে এত বিশাল মৃত্যু ভারত কেন কোন দেশই কোনদিন দেখে নি। অথচ, স্প্যানিশ ফ্ল ভারতের ইতিহাস থেকে উধাও!
কারন এই মৃত্যুর পেছনে যেহেতু ভাইরাস-সেহেতু ইতিহাসে ঢুকিয়ে কি হবে? পাওয়ার লবির পলিটিক্যাল গেইন নেই। বুঝুন কি অবস্থা। কিভাবে ইতিহাস লিখেছে কংগ্রেসের শিক্ষিত স্যাঙাত বাহিনী।
ইতিহাস পড়ার একটাই কারন। যাতে একই ভুল দুবার না হয়। এই ইতিহাস পড়া থাকলে শাহীনবাগ আর পার্ক সার্কাসে রাজনৈতিক সার্কাস নামাতে কেউ সাহস পেত না। আবার সরকারের উচিত ছিল আন্তর্জাতিক উড়ান অনেকদিন আগে বন্ধ করা। ট্রেইন বাস ও বন্ধ করে দেওয়া উচিত। কিন্ত যে প্রজন্মের ১৯১৯ সালে মহামারীর ইতিহাস জানা নেই, তাদের পক্ষে বোঝা অসম্ভব কি হতে পারে।
(২) অধিকাংশ ভাইরাসের জন্ম জীবজন্তর শরীরে। মানুষের ত্বক ভাইরাসের ঢোকার জন্য সাধারন ভাবে পুরু। সেই জন্য ভাইরাস ত্বকের দুর্বল অংশ দিয়ে ঢুকবে। এইচ আই ভি, ইবোলা, স্প্যানিশ ফ্ল ছাড়া , অধিকাংশ ঐতিহাসিক ভাইরাসের জন্ম চীনে। কারনটাও বোধগোম্য। যেহেতু তারা নানাবিধ পশু খায়। চোদ্দশ শতাব্দির ব্ল্যাক ডেথ ও চীন থেকে।
কিন্ত একটা ব্যাপার ভাবার আছে। উত্তর ফ্রান্স এবং ভারতের আবহাওয়া এক না। তাহলে স্প্যানিশ ফ্ল কিভাবে ভারতে বিধ্বংশী হয়? সাধারনত ভাইরাস যে আবহাওয়াতে জন্মেছে, তাতেই সক্রিয় থাকে বেশী। যেমন এখন যত কোভিড-১৯ স্ট্রেইন পাওয়া যাবে, সবই মেইড ইন চাইনা স্ট্যাম্প। এবং এগুলো ১০-২০ ডিগ্রি তামমাত্রায় বেশী এফেক্টিভ। ২৫+ হলে, এদের ওয়াল গলতে শুরু করে দেবে।
কিন্ত তার মানে কি ভারত নিরাপদ বেশী? উত্তর হ্যা এবং না।
যেটা হবে, ভারতে যে কোভিড-১৯ এল, এটা ভারতীয়দের দেহে মিউটেট করবে। অধিকাংশ মিউটেশন খতরনাক না। কিন্ত একটা বা দুটো মিউটেশন এমন হবে, যে তার ফলে যে নতুন ভাইরাস এল, সে কিন্ত ভারতের আবহাওয়াতে মানিয়ে নেবে। ফলে ডেঞ্জারেস ভাবে ছড়িয়ে যাবে ভারতে।
তার সম্ভাবনা কত? পুরোটাই নির্ভর করছে কত লোকে সংক্রামিত হচ্ছে। যদি কম লোক এফেক্টেড হয়, প্রোবাবিলিটিই বলে দেবে সেক্ষেত্রে কোভিড-১৯ ভারতের ওয়েদারে মিউটেট করার সুযোগ পাবে না। কিন্ত যদি বেশী লোকে এফেক্টেড হয়, এটা মিউটেট করে , ভারতের ওয়েদারেও খতরনাক হবে।
এই জন্যেই স্যোশাল ডিস্টান্সিং, লকডাউন দরকার। যাতে করোনা মিউটেট করে ভারতের ওয়েদারে ডেঞ্জারেস না হয়। হলে আরেকটা ১৯১৯ অপেক্ষা করছে। কারন ১৯১৯ সাল যে স্প্যানিশ জ্বরে ভারতে বিধ্বংশী হয়, খুব নিশ্চিত ভাবেই তা মিউটেড। না হলে উত্তর ফ্রান্সের ঠান্ডা ওয়েদারের ভাইরাস গাঙ্গেয় উপত্যকার গরম সহ্য করে তান্ডব নৃত্য করতে পারে না।

করোনাতে আশার আলো--

করোনাসন্ত্রাসের সবটাই কি নেগেটিভ? আমি কিন্ত পজিটিভ সাইডই বেশী দেখছি।
১) প্রথমে রাষ্ট্রের হেলথকেয়ার সিস্টেম দেখুন। ভারত এবং আমেরিকা দুটো দেশেই এটি ডিফাংক্ট সিস্টেম। আমেরিকাতে উচ্চকোয়ালিটির চিকিৎসা আছে-কিন্ত দাম ধরাছোঁয়ার বাইরে। ফার্মা আর ইন্সিওরেন্স কোম্পানীগুলো রাজনীতিবিদদের পকেটে ঢুকিয়ে দিনে ডাকাতি করছে। ডাকাতরাও এত নির্লজ্জ হয় না।
ভারতে সমস্যা অন্য। সরকার চিকিৎসা খাতে খরচই করতে চায় না। বাজেটের ১-২% স্বাস্থ্যখাতে আসে। যেখানে আমেরিকাতে ওটা ২০%। স্ক্যান্ডেনেভিয়ান বা অন্যান্যদেশ যেখানে সরকারই সমস্ত চিকিৎসার দ্বায়িত্ব নিচ্ছে, সেখানে ৩০%+।
কোভিড-১৯ কে এইজন্য ধন্যবাদ যে এই প্রথম আমাদের প্রজন্ম বুঝছে চিকিৎসা একটা কমিউনিটি সার্ভিস। আমার টাকা আছে, চিকিৎসার সামর্থ্য আছে, তা দিয়ে আমি সুস্থ থাকতে পারি না। আমার পাশের গরীবলোকটির ও নিরোগ থাকার দরকার। আমার নিজের স্বার্থেই। কারন তা না হলে-তার সংক্রামক রোগ আমার মধ্যেও আসবে।
অর্থাৎ চিকিৎসা বা স্বাস্থ্য একটা মৌলিক অধিকার হওয়া উচিত। রাষ্ট্রের টাকা ফার্মা মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের মালিকদের পকেটে না গিয়ে, জনগনের সুস্বাস্থ্যের জন্য ব্যয় হওয়া উচিত।
প্রাইভেট হাসপাতাল, প্রাইভেট ইন্সিওরেন্স থাকাই উচিত না। কারন সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক দর্শনটা হচ্ছে ফেল কড়ি নেও চিকিৎসা। এই মডেলে গরীবদের চিকিৎসা পাওয়া সম্ভব না। আর তারা যদি চিকিৎসা না পায়, কোভিডের মতন মহামারীর সামনে ধনীরাও সুস্থ থাকবে না।
আমেরিকাতে করোনাক্রান্ত রুগীর সংখ্যা ১০০,০০০ ছাড়ালে সিস্টেম পুরো ধ্বসে যাবে। ভারতের অবস্থা আরো বাজে হবে।
(২) বহুদিন বাদে দেখছি লোকে রাম-রাহিমের ঝগড়া, মুসলমানদের প্রতি ঘৃনা থেকে উৎরে, কিভাবে করোনার হাত থেকে বাঁচা যায়, তাই নিয়ে একটু হলেও প্রাথমিক বিজ্ঞান শিক্ষাটুকু নিচ্ছে। যারা গোমূত্রকে মহৌষধি মনে করে, তাদের বোধবুদ্ধি যে প্রাইমারী স্কুলের গন্ডি ডিঙোয় নি-সেটা আমি আপনি বুঝি। তারা কিন্ত তাদের অন্ধত্বে বিভোর। কে হরি ভজনা করবে আর কে আল্লাকে আজান দেবে, তা নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই। সমস্যা এখানেই ভারতের শাসনভার এদের হাতে। আর ধর্মটাও ভাইরাসের মতন সংক্রামক রোগ। কাউকে হিন্দুত্বের ভাইরাসে ধরলে, অন্যপার্টিকে ইসলামিক ভাইরাসে ধরবেই। উল্টোটাও সত্য। একটা "আসল" সংক্রামক ভাইরাসের সামনে আলতো করে হলেও ধর্মের ভাইরাসের সংক্রমন একটু কমেছে। নিজেকে এবং ফ্যামিলিকে বাঁচাতে, বিজ্ঞান প্রযুক্তির স্মরণাপন্ন হওয়া ছাড়া এদের উপায় নেই। লোকে যে ধর্ম চেতনা থেকে বিজ্ঞান চেতনার দিকে সামান্য হলেও এগোল, এটাই যথেষ্ট।
(৩) করোনা অর্থনৈতিক বিপর্যয় আনবে। এটা মোটেও খারাপ না। দরকার ছিল। কারন জমি বাড়ির দাম কৃত্রিম ভাবে বাড়িয়ে, বাতাস ধোঁয়াতে ধুয়ে, শুধু জিডিপির নাম্বার বাড়ে। দেশের উন্নতির থেকে অবনতি হয় বেশী। এখন লোকে অন্যভাবে ভাববে। চিকিৎসা স্বাস্থ্যে, জনস্বাস্থ্যে উন্নতি হয় এমন স্টার্টাপের কথা ভাবতে হবে। বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে বিনিয়োগের কথা আগে ভাববে। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাটের কথা ভাববে। রেগুলার এক্সারসাইজ, ঘুমের কথা ভাববে। ঠিক ঠাক খাবার কিভাবে পাওয়া যায় তার কথা ভাববে। কারন কোভিড-১৯ এর কোন চিকিৎসা নেই। ইমিউনিটি বাড়িয়ে রাখা ছাড়া আর কোন প্রতিরোধ নেই। ফলে লোকে অসুস্থ লাইফস্টাইল থেকে সুস্থ লাইফস্টাইলের দিকে যাচ্ছে। এর জিডিপি ভ্যালু অনেক অনেক বেশী।
(৪) আই টি কোম্পানীগুলো ওয়ার্ক ফ্রম হোম চালু করেছে। আমরাও করে দিয়েছি। ওয়ার্ক ফ্রম হোম এফেক্টিভ, আরো বেশী প্রোডাক্টিভ হতে পারে যদি কর্মীরা সৎ হয়। এতে কার্বন এমিশন, দূষন কমবে।
সঙ্কট সব সময় সম্ভবনার জন্ম দেয়। আমি আশাবাদি। করোনাত্তর পৃথিবী আরো ভাল সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্ম দেবে। কয়েক লাখ লোকের মৃত্যু হবে। কিন্ত মৃত্যুত নিয়তি। উন্নততর রাষ্ট্র এবং সমাজ কিন্ত নিয়তি না-সেটার জন্য এই ধাক্কাটা লাগে।