Sunday, February 28, 2021

ঈর্ষা এবং বামপন্থা- সমাজ ধ্বংসের সিঁড়ি

 ঈর্ষা এবং বামপন্থা- সমাজ ধ্বংসের সিঁড়ি

(১)
খ্রীষ্ঠান ধর্মের জনপ্রিয়তা বা কিভাবে আস্তে আস্তে রোমান সম্রাজ্যে খীষ্ঠান ধর্ম জনপ্রিয় হয়, তা নিয়ে জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিক নিৎসের খুব গুরুত্বপূর্ন একটি তত্ত্ব আছে। উনার মতে এর মূল কারন ঈর্ষা। খ্রীষ্ঠান ধর্ম রোমান সম্রাজ্যের গরীব এবং দাসেদের মধ্যে প্রথমে জনপ্রিয় হয়। নিৎসের তত্ত্বে গরীব বঞ্চিত ব্যক্তিরা ধনীদের যে প্রাচুর্য্যের জীবন চোখের সামনে দেখে, তাতে ঈর্ষান্বিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। নিৎসে বলছেন এই ঈর্ষা ভাল। কারন এর জন্যেই গরীব লোকেরা পরিশ্রম করে , রিস্ক নিয়ে থাকে- ধন সম্পদ আহরনের চেষ্টা করে। নিজের ছেলেমেয়েদের উপযুক্ত শিক্ষা দেয়। যাতে এটলিস্ট পরের প্রজন্ম ভাল থাকে।

কিন্ত যেকারনে নিৎসে খাপ্পা ছিলেন খ্রীষ্ঠান ধর্মের প্রতি- এই খৃষ্ট ধর্মে বলা হল ঈর্ষা পাপ। বড়লোক হওয়া পাপ, যৌনইচ্ছা পাপ। ফলে খৃষ্টধর্মের জনপ্রিয় হওয়ার আগে , ইউরোপের গরীবলোকেরা যে বড়লোকদের দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে আরো ধন সম্পত্তি বৃদ্ধির চেষ্টা করত -সেই ইচ্ছাটাই সমাজ থেকে চলে যায়। খ্রীষ্ঠান ধর্মের উত্থানের সাথে সাথে -বিশেষত যবে থেকে সম্রাট কনস্টানটাইন খ্রীষ্ঠধর্মকে রোমান রাষ্ট্রধর্ম বানালেন -তবে থেকে ইউরোপের পতন হয় দ্রুত। বিশেষত যেটাকে আমরা ক্ল্যাসিক্যাল যুগ বলি-তার পতন শুরু হয়।

কারন ঈর্ষা একটি পজিটিভ চালিকা শক্তি। গোটা সমাজের জন্যই। প্রতিটা গরীব, ধন সম্পদ উপার্জনের জন্য পরিশ্রম করে বলেই সমাজে নতুন ব্যবসা, নতুন উৎপাদিকা শক্তি বজায় থাকে।
ধনসম্পত্তি এবং বড়লোক হওয়া হারাম ঘোষনা করে গোটা ইউরোপের চালিকা শক্তি একদা ধ্বংস করেছিল খ্রীষ্ঠান ধর্ম। ইউরোপ আবার গোটা বিশ্বের নেতা হবে সেই পঞ্চদশ শতকে যখন ইউরোপীয় বণিকরা খ্রীষ্টধর্মকে আবার গীর্জার গারাজে ঢুকিয়ে ঠূঁটো জগন্নাথ বানাবে।

(২)
পশ্চিম বাংলার বামপন্থা যেভাবে বাংলাকে ধ্বংস করেছে, তার সাথে নিৎসের ঈর্ষার তত্ত্বের সম্পর্ক কি?
কারন গোটা পশ্চিম বঙ্গের সমাজ যেভাবে ধনী এবং ধনকে ঘৃনা করতে শিখেছে, তাতে এক অদ্ভুত বাঙালী ধর্মের দেখা পাই পশ্চিম বঙ্গে।

এখানকার অধিকাংশ ছেলেপুলের কোন উচ্চাশাই নেই। কোন রকমে একটা ভদ্রস্থ মাইনের চাকর। যদি চা সিঙাড়া খেয়ে মোহনবাঙান ইস্টবেঙ্গল, ইন্ডিয়া-পাকিস্তান- আম্বানি আদানির গুষ্টির তুষ্টি করে দিন কাটানো যায়, এরা তাতেই সন্তষ্ট। কারন অধুনা বাঙালী ধর্মে শেখানো হয়েছে ধন সম্পত্তি বাজে জিনিস না হলেও ধনী মানেই চালচোর কিম্বা গরুচোর।


সিপিএমের টুম্পাগান দেখুন! যেন চাকরি করাই জীবনের পরম উদ্দেশ্য। মুশকিল হচ্ছে দুশো বছর আগে চাকরির অস্তিত্বই ছিল না। প্রায় সবাই ছিল স্বাধীনজীবি-সে কৃষকই হোক, আর শিক্ষকই হোক।

যেকোন সমাজের চালিকা শক্তি হচ্ছে দরিদ্র-মধ্যবিত্ত শ্রেনী। এদের মধ্যে যে উচ্চাশা জাগে, তার উৎস কিন্ত সেই ঈর্ষা- এই গরীব শ্রেনীটির ধন্যাট্য জীবনজাপনের জন্য উচ্চাশা থেকেই বিরাট অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি তৈরী হয় ( আবার চিটফান্ডের মতন ফ্রড ও হবে। কিন্ত ফ্রড বেশী দিন টেকে না। ফিল্টার হয়ে সৎ ব্যপারীটাই একমাত্র টিকে থাকে)।

উদাহরন দেওয়া যেতে পারে। গুজরাতে গেলে দেখবেন, যে মাসে ২০,০০০ টাকার কেরানী-তার উদ্দেশ্য চল্লিশ বছর বয়সের মধ্যে পুঁজি জমিয়ে নিজের ব্যবসা শুরু করা। বাঙালীদের মধ্যে এই ড্রাইভটাই নেই-কারন ধনের ঈর্ষা ব্যপারটা লুপ্ত।

কিন্ত এটা এলো কোত্থেকে? বাংলা মুঘল যুগে একদা সব থেকে সমৃদ্ধশালী রাজ্য ছিল। বাংলার শিল্প এবং বনিকেরা পৃথিবীতে বিখ্যাত ছিল। অথচ, ভারতচন্দ্রের কাব্যে দেখতে পাবেন , বাঙলার পিতামাতার একমাত্র স্বপ্ন-আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।

আমার ধারনা বাংলা যত স্বাধীনতা হারিয়েছে- দিল্লীর মুঘল শাসক, ইংরেজরা যত বাংলাকে শোষন করেছে, বাংলার মানুষ তত বেশী হত দরিদ্র অবস্থার মধ্যে দিন কাটিয়েছে। যেহেতু বাংলা আস্তে আস্তে সামরিক শৌর্য্য বীর্য্যও হারিয়েছে, সেহেতু এই হতাশ দারিদ্রর মানসিক শান্তনা হিসাবে বাংলায় নানান ভাববাদি ধর্ম শিকড় নেয়। যারা ভাবতে শেখায় দারিদ্রে আর কি ক্ষতি আছে-যাতে মানুষ অন্তত প্রচন্ড দরিদ্র অবস্থাকে স্বাভাবিক এবং বড়লোকদের বঞ্চনা বলে মেনে নেয়। দারিদ্রের জয়গান গায়। জাস্ট লাইক ক্রিষ্টিয়ানিটি। কমিনিউজম খ্রিষ্টানিটি ইসলামের আধুনিক সংস্করন।

ফলে এতে আশ্চর্য্য হবার কিছু নেই যে ভারতে বাংলায় প্রথম কমিনিউস্ট আন্দোলন শক্ত মাটি পায়। বাঙালীরা প্রথমে ইংরেজি শিক্ষিত ছিল-সেটাই শুধু কারন না। বাংলার মাটিতে শ্রীচৈতন্যের ভাববাদি সাম্য বহুদিন আগে থেকেই ছিল। এই ধরনের ভাববাদ বাঙালীর ঈর্ষাকে ধ্বংস করেছে-ফলে বাঙালী অল্পেই সন্তুষ্ট। বাঙালী গরীবদের মধ্যে বড়লোক হবার জন্য আগ্রাসী যুবক কম। আনফরচুনেটলি ওটাই সমাজের উন্নয়নের আসল চালিকা শক্তি। যেটা পৃথিবীর সর্বত্র ধনতন্ত্রে প্রমানিত।

আরেকটা ছোট্ট উদাহরন দিই। বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর নাম অনেকেই শুনেছেন। কিন্ত কজন শুনেছেন ব্যারিস্টার রাসবিহারী ঘোষের নাম? রাসবিহারী ঘোষের ১৫ লাখ টাকা দান থেকেই শুরু হয় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। অথবা তারকনাথ পালিতের নাম কজন জানেন? যার দানের টাকায় সায়েন্স কলেজ তৈরী হয়। এদের অপরাধ এরা ধনী ব্যক্তি ছিলেন-তাই দানধ্যান করতেই পারেন। বাঙালী এদের মনে রাখে নি। যারা যাদবপুর বা কোলকাতার সায়েন্স কলেজের ছাত্র-তারা এই দুজনের নাম জানে কি না সন্দেহ। এর একটাই কারন। বাঙালী সমাজে এবং সংস্কৃতিতে ধনের গুরুত্ব এবং অবদান নিয়ে কোন আলোচনাই নেই। শুধু শুধু ত্যাগ এবং দারিদ্রকে মহিমান্বিত করা হয়। ফলে বাঙালী যুবক যুবতীদের মধ্যে ধনী হবার জন্য কঠিন পরিশ্রমী ছেলে মেয়ে পাওয়া শক্ত। যেটা ছাড়া ধনতান্ত্রিক কাঠামোতে একটা সমাজ এগোতে পারে না।




Saturday, February 20, 2021

মঙ্গল গ্রহের রোভার অভিযান - প্রযুক্তি বিদ্যার ম্যাজিক

                                                               (১)

 ১৮ই ফ্রেব্রূয়ারী মঙ্গলে নামল নাসার রোভার পারসিভারেন্স।  অভিযান মারস ২০২০।  এটি পঞ্চম মঙ্গলরোবটযান। এর আগের রোভারগুলি - মারস পাথ ফাইন্ডার ( ১৯৯৭),  স্পিরিট (২০০৪), অপার্চুনিটি (২০০৪)  এবং কিউরোসিটি (২০১২)।  এর মধ্যে কিউরোসিটি এখনো জীবন্ত এবং পৃথিবীতে ডেটা পাঠাচ্ছে।  প্রতিটি রোভার আগেরটি থেকে উন্নত এবং অনেক বেশী সক্ষম।  আগের রোভারের সমস্যাগুলি সমাধান করে পরের রোভার মডেল তৈরী হয় সার্দান ক্যালিফোর্নিয়ার জেট প্রপালসন ল্যাবেরেটরীতে ( জেপিএল)।  প্রায় একটনের কাছাকাছি ওজন। এস ইউ ভি গাড়ীর সাইজ। এটি চলমান ল্যাবেরটরি। 

                                       

                                       ( ১৮ই ফ্রেব্রুয়ারী মঙ্গলে নেমেছে রোভার )

আগের রোভার মডেল, কিউরোসিটি যথেষ্ট উন্নত ছিল। কিন্ত অটোনোমি বা নিজে নিজে চলার "ব্রেইন" ছিল কম। বর্তমানে গত দশকে অটোনোমাস ভেহিকলে অভূতপূর্ব উন্নতির হয়েছে। টেসলা, এপল, গুগল এরা কি করে একটা গাড়ী নিজেই চলতে পারবে, তা নিয়ে প্রচুর নতুন প্রযুক্তি এনেছে। ফলে   কর্মাশিয়াল অটোনোমাস টেকনোলজি পারসিভারেন্সে আছে। এর মানে হচ্ছে মঙ্গলের ধূলিঝড়, শীত গ্রীষ্ম, গর্তে পড়লে, পৃথিবী থেকে মানুষের ব্রেইন খাটিয়ে আর রোভারকে উদ্ধার করতে হবে না। যদিও বর্তমান রোভারের ব্রেইন ও খুব ছোট -মাত্র ৪ গিগাবাইটের ফ্ল্যাশ, ১২৮ মেগা মাইটের ডির‍্যাম, ৬৬ মেগা হার্জের স্পীড। প্রশ্ন উঠতে পারে  প্রায় একটন ওজনের রোভারের এত ছোট মেমরী বা মাথা কেন?

 এর মূলকারন মঙ্গলের হিমেল ঠান্ডা ।  ওই  প্রচন্ড ঠান্ডায় ইলেক্ট্রনিক্স চালাতে কৃত্রিম হিটিং দরকার। কারন অত ঠান্ডায় ইলেক্ট্রনিক্স জমে যাবে। মঙ্গলের গ্রীষ্মে  বিষুব রেখায় ( ইকোয়েটরে) তাপমান ২০ সেন্টিগ্রেড উঠতে পারে। কিউরোসিটি রোভার গ্রীষ্মের   দুপুরে কখনো সখনো ৪-৬ সেন্টিগ্রেডের দেখা পায় । কিন্ত রাতে তাপমান -৭০ সেন্টিগ্রেডে নেমে যায়।  শীতকালে দিনের বেলায় তাপমাত্রা থাকে -৩০ সেন্টিগ্রেডের নীচে।  এছাড়া মঙ্গল পৃথিবীর থেকে ৬০% কম সূর্য্যরশ্মি পাচ্ছে ।  ফলে খুব বেশী ঠান্ডা দেখলে রোভার হাইবারনেট করে। নইলে এনার্জি ক্রাইসিসে ভুগে কোলাপ্স করে যাবে। এর আগে স্পিরিট রোভারে এই ক্রাইসিস বার দুয়েক দেখা গেছে। 

 সমস্যা হচ্ছে ওই ইন্টারন্যাল হিটিং চালু রাখা - ইলেকট্রানিক্স চালাতে। এছাড়া মটোর এবং ইলেক্ট্রিক্যাল চালাতেও পাওয়ার দরকার। এই পাওয়ার আসবে কোত্থেকে? 

 অনেকের ধারনা এটা আসবে রোভারের স্যোলার প্যানেল থেকে।  সোলার প্যানেল থেকে  বিদ্যুৎ শক্তি  জমা হবে, লিথিয়াম ব্যাটারিতে। দিনের বেলায়। সেই ব্যাটারি পাওয়ারে  চলবে রোভার। কিন্ত তা ঠিক না!

  আগের রোভারের সোলার  এক্সপেরিয়েন্স যাকে বলে ডিজাস্টারাস-বিপজ্জনক।  বিজ্ঞানীরা দেখেছেন মঙ্গলে সোলার পাওয়ারের ওপর নির্ভর করলে বিরাট বিপদ। এর কারন মঙ্গলের ধুলোবালি। এই ধূলোতে প্যানেল প্রায় ঢেকে যায়। আবার ঝড় উঠলে প্যানেল পরিস্কার হয়।  মঙ্গলে সোলার পাওয়ার হার্ভেস্ট করা টোটালি আনরিলায়েবল। একে শুধু গ্রীষ্মের দুপুরে কিছু পাওয়ার পাওয়া যায়-তাও যদি স্যোলার প্যানেল পরিস্কার থাকে! 

  সেই জন্য পারসিভারেন্স রোভারে আছে  ১১০ ওয়াটের থার্মোইলেক্ট্রিক পাওয়ার জেনারেটর। যা চলে ৫ কিলো রেডিওএক্টিভ প্লুটোনিয়াম ওক্সাইডে।  পাওয়ার তৈরী হয় সিবেক এফেক্টের জন্য।  রেডিওএক্টিভ প্লুটোনিয়াম ওক্সাইড আলফা কনা বিকিরন করে,  এর কনটেনারকে উচ্চতাপমাত্রায় রাখে। রোভারের বাইরে যেহেতু বিশাল ঠান্ডা-ওই গরম আর ঠান্ডার গ্রাডিয়েন্ট থেকে তৈরী হয় বিদ্যুৎ প্রবাহ। যার থেকে প্রায় সর্বোচ্চ ১১০ ওয়াট পাওয়া যায়। কিন্ত মঙ্গলের বুকে দিনে তাপমাত্রা বাড়লে  এই প্রবাহ কমে যাবে। যেহেতু থার্মাল গ্রাডিয়েন্ট কম হবে। কিন্ত তখন আবার সোলার পাওয়ার জেনারেশন বেড়ে যাবে। ফলে সোলার এবং থার্মাল মিলিয়ে পার্সিভারেন্সে মোটামুটি ধারাবাহিক পাওয়ার সোর্স রাখে। কিন্ত ওই ১১০ ওয়াট পাওয়ারে ১ টনের একটি গাড়িকে চালানো বেশ মুশকিল। থেমে থেমে চালাতে হয়  ( সমান ওজনের  টেসলার গাড়ি  চলে  ২০,০০০ ওয়াটে)। ফলে রোভারের গতি খুব কম রাখতে হয়। প্রায় কয়েক সেন্টিমিটার সেকেন্ডে।  সেই জন্য রোভার স্পিরিট ছ বছরে ঘুরেছে মোটে সাত কিলোমিটার। অপর্চুনিটি ১৫ বছরে চলেছে টোটাল ৪৬ কিলোমিটার। 

এছাড়াও এবারের পার্সিভারেন্স রোভারের ছটি চাকার টায়ারে বৈচিত্র আনা হয়েছে। এদের টায়ার মানে টাইটেনিয়াম-এলুমিনিয়াল এলয়ের তৈরী। আগের সব রোভারের চাকা বসে যেত।   কারন চাকার তলপৃষ্টে প্রচুর ড্যামেজ হয় দ্রুত।  এর মূল কারন মঙ্গলে ভূপৃষ্টে প্রচুর এমন সব শীলা আছে যাদের মুখ বর্শার মতন সরু এবং সূক্ষ্য।  এবার রোভারের নিজের দৃষ্টি আছে বেশী-সে এইসব জায়গা গুলো এড়িয়ে যাবে-শুধু তায় না-তারা চাকার প্যাটার্ন এমন করা হয়েছে যে ওইসব বর্শামুখী শীলাগুলি ( শার্প রক) কোন ক্ষতি করতে পারবে না। 

 এবার আসি আসল প্রশ্নে। কিউরোসিটি রোভার চালু থাকতে, কেন পারসিভারেন্স রোভারকে মঙ্গলে ছাড়া হল? পারসিভারেন্সে কি আছে যা কিউরোসিটিতে নেই? 


 পার্সিভারেন্সের মূল উদ্দেশ্য মঙ্গলে অতীতে প্রান ছিল কি না তা খুঁজে বার করা। এর জন্য পারসিভারেন্স নেমেছে জেজেরো ক্রাটার বা জ্বলামুখে। যেখানে অতীতে ৩০-৪০ কিমি দীর্ঘ লেক বা হ্রদ ছিল। নদী ছিল। অতীতে সূর্য্যের তাপ ছিল ২৫% বেশী। মঙ্গলের বায়ূ ছিল আরো গভীর। ফলে বর্তমানে মঙ্গল যেমন শীতল, অতীতের মঙ্গল কিন্ত তা না। সেই গ্রহ ছিল পৃথিবীর থেকে হাল্কা ঠান্ডা। আজকের মঙ্গলের চেয়ে, সে অতীতের দিনে  গড়ে ২০ ডিগ্রি বেশী গরম থাকত -প্রায় ১০ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড ছিল গড়ে ( বিষুব রেখায়)।  জল, মিথেন, এত কার্বন ডাই অক্সাইডে প্রান থাকবে না?? 


                                                           (২)

পারসিভারেন্স রোভারের মূল উদ্দেশ্য দুটি

  -মঙ্গলের বুকে আদিতে কোন জীবানুকনা ছিল কিনা তা খুঁজে বার করা। কারন আগের রোভার অভিযানেই স্পষ্ট যে মঙ্গলের বুকে প্রান জন্মানোর জন্য যেসব জৈব অনু বা অর্গানিক মলিকিউল থাকার দরকার সবই আছে বা এক্কালে ছিল। অতীতে মঙ্গলে জলের নদী হ্রদ সব কিছুই ছিল। কারন আগের রোভার অভিযানগুলি প্রমান করেছে সেইসব  রক বা শীলার অস্তিত্ব ( যেমন হেমাটাইট) যারা জল ছাড়া জন্মাতে পারে না।  সুতরাং পারসিভারেন্স প্রথমেই  খুঁজবে পাথর, শীলার মধ্যে লুকিয়ে থাকা সেই সব অর্গানিক মলিকিউল যা প্রান ছাড়া তৈরী হতে পারে না। অর্থাৎ রকের মধ্যে বায়োসিগ্নেচার আছে কিনা। এর জন্যে পারসিভারেন্সে আছে তিনটি যন্ত্র-যা চলমান ল্যাবেরটরি। এক্সরে লিথোকেমিস্ট্রি, সুপারক্যাম এবং একটি নতুন যন্ত্র শার্লক- যা আল্ট্রাভায়োলেট রমন স্পেক্ট্রোস্কোপি। এই তিনটি যন্ত্র কিভাবে অতীতে প্রানের সন্ধান করবে-তা নিয়ে সংক্ষেপে লিখছি। 

  

                        (শার্লক -মঙ্গলের বুকে জৈব অনুর সন্ধানে )

-দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ন উদ্দেশ্য মঙ্গলে অক্সিজেন তৈরী করা। এটা করবে মক্সি বলে একটা যন্ত্র। মঙ্গলের কার্বন ডাই ওক্সাইড ভেঙে অক্সিজেন এবং কার্বন মনোক্সাইড তৈরী করবে মক্সি। তবে ঘন্টায় ১০-২০ গ্রামের মতন। কিন্ত এই পরীক্ষা সফল হলে, মক্সির ১০০ গুন বড় যন্ত্র পাঠানো হবে মঙ্গলে যা ঘন্টায় ২ কিলো অক্সিজেন তৈরী করবে। এই ভাবে দুই বছরে কয়েকশোটন অক্সিজেন তৈরী করে রাখবে যাতে ভবিষ্যতে যখন মঙ্গল থেকে পৃথিবীর বুকে রিটার্ন ফ্লাইটের দরকার হবে, তখন সেই অক্সিজেন ব্যবহার করা হবে। এটা নিয়েও সংক্ষেপে লিখছি। 

প্রথমেই আসি রোভারের শার্লক নামক যন্ত্রটির কথায়। যা আল্ট্রাভায়োলেট রমন স্পেক্ট্রোস্কোপ। বোঝা যাক বায়োসিগনেচার খুঁজতে আল্ট্রাভায়োলেট রমন স্পেক্ট্রোস্কোপ কি করবে। শার্লক আসলে একই সাথে চলা দুটো ইন্সট্রুমেন্ট। এটি একই সাথে ২৪৮ ন্যানোমিটার আল্ট্রাভায়োলেট লাইটে ইমেজিং ( অর্থাৎ ফটো তোলা ) এবং ২৪৮ ন্যানো  ফ্লুরোসেন্স স্পেক্ট্রোস্কোপি ( অর্থাৎ সেই ২৪৮ ন্যানোমিটার আল্ট্রাভায়োলেট লাইট অর্গানিক মলিকিউলগুলিকে এক্সাইট করে যে অন্য আলোক তরঙ্গে বিভাসিত হবে তা বার করবে)। কিন্ত ২৪৮ ন্যানোমিটার কেন? কারন  প্রোটিনের কার্বন -হাইড্রোজেন বন্ডিং ওই তরঙ্গ শোষন করতে পারে। শার্লক যেটা দেখবে-সেটা হচ্ছে কোন রকের   ১/১০ মিলিমিটারেরও ক্ষুদ্র জায়গায় যদি একই সাথে ছবি এবং স্পেক্ট্রোস্কোপ সাজেস্ট করে, সেখানে স্পেশাল বায়োমলিকিউল পাওয়া যাচ্ছে ( যেমন আমাইনো এসিড বা অন্য যেকোন বায়ো মনোমার) তাহলে বুঝতে হবে অতীতে প্রানের অস্তিত্ব ছিল। 

শার্লক ছাড়াও, আরো দুভাবে বায়ো সিগনেচার খুঁজবে রোভার। প্রথমটি সুপারক্যাম। সুপারক্যাম লেজার ইন্ডিসড ব্রেইকডাউন স্পেক্ট্রোস্কোপি বা লিবস ।  লিবস মানে কি?  এর মানে ধরুন রোভারের ৫-৭ মিটার দূরে কোন রক বা শীলা আছে। সেখানে রোভারের যাওয়া সম্ভব না। সুপারক্যাম কি করবে? ১০২৪ আই আর বা ইনফ্রারেড লেজারবিম ছুঁড়ে মারবে সেখানে। যেখানে লেজারের উত্তপ্ত বীম পড়বে, খুব ছোট্ট জায়গায় ( চালের মতন ক্ষুদ্র), রক ভেপারাইজড হবে-হ্যা, শীলটি জ্যন্ত গলে বাস্প হবে লেজারের উত্তাপে। তারপরে সুপারক্যাম ছুঁড়ে দেবে ৫৩২ ন্যানোমিটারের গ্রীন লেজার। ভিজিবল বা দৃশ্যমান আলোর রমন স্পেক্ত্রোক্সোপির জন্য। এছাড়াও সুপার ক্যাম দৃশ্যমান এবং ইনফ্রারেড স্পেক্ট্রোস্কোপিও করবে। রমন , ভিজিবল এবং আই আর স্পেক্ট্রোস্কোপি সব কিছুই অর্গানিক বা জৈব অনুর অস্তিত্ব বুঝতে। মানে রক বা শিলা টুকরোটি যখন বাস্পীভূত হবে তখন সেই রকে জমা হয়ে থাকা কোটি কোটি বছরের জৈবঅনু গুলিও অহল্যার শাপমোচনের মতন বাস্প হয়ে বেড়িয়ে আসবে।  সেই বাস্পের জৈব অনুগুলিই বলে দেবে ওই পাথরের মধ্যে জৈব অনু ছিল কি না। 

      

                                          ( রোভারের সুপার ক্যাম)

এছারাও থাকছে এক্সরে লিথোকেমিস্ট্রি- এক্স রে আল্ট্রাভায়োলেটে লাইটের থেকে আরো ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যে। এটি একই সাথে ক্রিস্টালের স্ট্রাকচার এবং অনুর গঠন বলে দেয়। কঠিন অবস্থায় জৈব অনুর গঠন জানতে এই ইনস্ট্রুমেন্টটি কাজে আসবে। 

                                         (৩)

এবার আসি মক্সি অর্থাৎ ছোট্ট অক্সিজেন তৈরী করার পরীক্ষামূল যন্ত্রটির গঠনে। 

 মক্সি তৈরী করেছে বিশ্ববিখ্যাত এম আই টি বা ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিউট অব টেকনোলজি। মঙ্গলের আবহাওয়া খুব পাতলা, পৃথিবীর ১%। মানে পৃথিবী পৃষ্টে ৮০ কিমি উচ্চে বাতাস যত পাতলা, মঙ্গলগ্রহের সারফেসের বাতাস ততটা ঘন! এই বাতাসের ৯৬% কার্বন ডাই ওক্সাইড।

  কার্বন ডাই অক্সাইডে দুটি অক্সিজেন পরমানু আছে- যারা কিন্ত খুব শক্তভাবে কার্বন পরমানুটাকে ধরে থাকে। মক্সি  সলিড স্টেট ক্যাটালিসিস করে। কার্বন ডাই অক্সাইডকে চালান করে দিচ্ছে জার্কোনিয়া দিয়ে তৈরী ইলেক্ট্রোডের মধ্যে-এখানে কার্বন ডাই অক্সাইড ভেঙে তৈরী হচ্ছে কার্বন মনোক্সাইড এবং অক্সিজেন।


                          ( মঙ্গলের বুকে প্রথম অক্সিজেন জেনারেটর -মক্সি)

মক্সি খুবই ছোট স্কেলে অক্সিজেন তৈরী করে-মাত্র ১০-২০ গ্রাম ঘন্টায়। শুধু এটুকু করতেই ৩০০ ওয়াট পাওয়ার লাগে! আমি আগেই লিখেছি রোভারের রেডিওএক্টিভ পাওয়ার জেনারেটর মোটে ১১০ ওয়াট।  তাহলে এত পাওয়ার পাবে কোথায়? কেন ? সোলার প্যানেল। কিন্ত তা গ্রীষ্মের দুপুর ছাড়া এত পাওয়ার জেনারেট করতে পারবে না!  সব মিলিয়ে ১২০০ ঘন্টা সক্রিয় থাকবে মক্সি। কিন্ত ওইটুকু চালাতেই হয়ত ৫-১০ বছর কেটে যাবে। কারন  ৩০০ ওয়াট পাওয়ার জমা করতে করতেই বেশ কয়েকদিন লাগবে। তারপর এক ঘন্টা হয়ত অক্সিজেন প্ল্যান্ট চলবে। 

 কিন্ত তাহলে মক্সির ১০০ গুন বড় যে অক্সিজেন জেনারেটর বানানোর কথা হচ্ছে মঙ্গল থেকে পৃথিবীতে ফেরার জন্য, তা কি করে সম্ভব হবে যেখানে ঘন্টায় দুই কিলো অক্সিজেন বানানোর প্ল্যান??  আরো গুরুত্বপূর্ন এই যে একজন মানুষের দিনে ৫৫০ লিটার মানে ঘন্টায় প্রায় ৩০-৪০ গ্রাম অক্সিজেন লাগে।  অর্থাৎ মক্সিযে অক্সিজেন তৈরী হবে তার একজন মানুষের জন্যও পর্যাপ্ত না এবং তাও তৈরী হবে শুধু গ্রীষ্মের দুপুরে?  অতেব মঙ্গলে মানুষ গিয়ে অক্সিজেন পাবে কোথায় বা ফিরে আসার রকেটে জ্বালানীই বা তৈরী হবে কি করে?

এক্সরে লিথোগ্রাফি- রোভার 

 সূর্যলোক বা স্যোলার প্যানেলের ভরসা করছেন না বিজ্ঞানীরা। ভবিষ্যতে ১০০ গুন বড় যে অক্সিজেন জেনারেশন প্ল্যান্ট মঙ্গলে বসানো হবে, তার জন্য দরকার ৩০ কিলোওয়াটের প্ল্যান্ট। সেটির জন্য সেই রেডিওএক্টিভ থামোইল্কট্রিক ব্যাটারিই লাগবে। কিন্ত অত বড় ব্যাটারি মহাকাশযানে পাঠাবে কি করে?  

সমাধান। যদি মঙ্গলেই পাওয়া যায় রেডিওএক্টিভ রক। তাহলেই উপনিবেশ বানানোর পথ পোয়াবারো। কিন্ত শুধু সূর্যালোকের ভরসায়, মঙ্গলে  মানুষ কেন, রোবট পাঠানোও অসম্ভব। 

                   (৪)

রোভারের সাথে মার্স ২০২০ অভিযানে আছে একটা ক্ষুদ্র হেলিকপ্টার ইনজেনুইটি। ওজন মোটে দুকিলো। চলে সোলার পাওয়ারে। ব্যাটারি ফুল চার্জ হলে উড়বে মোটে ৯০ সেকেন্ড। মঙ্গলে হেলিকপ্টার চালানো খুব কঠিন কাজ। কারন পৃথিবীর তুলনায় মঙ্গলের বায়ুমন্ডল মোটে ১%।  অন্যদিকে মঙ্গলে গ্রাভিটি ৬০% কম। ফলে হেলিকপ্টারে ব্লেডগুলি এত বড় হতে হবে যাতে পৃথিবীর তুলনায় এটলিস্ট ৪০গুন বেশী থ্রাস্ট তৈরী হয়। এদিকে সেটা চালাতে শক্তি লাগবে তো? পাওয়ার নেই রোভারে। ফলে স্যোলার ব্যাটারি ভরসা। এদিকে ব্যাটারির ওজন বেশী হয়ে গেলে মুশকিল। তারপরে আগেই বলেছি গ্রীষ্মের দুপুর ছাড়া মঙ্গলে স্যোলার ভাল চলে না। ফলে ইনজেনুইউটি একটা এক্সপেরিমেন্ট- এক্সপ্লোরেশনের কাজে খুব বেশী আসবে না। কারন দশদিন চার্জ দিলে একদিনে এক মিনিট চলবে। 



                                  ( মঙ্গলের বুকে প্রথম হেলিকপ্টার ইনজেনুইটি) 

 তবে আমরা আশায় আছি। অতীতে মঙ্গলে প্রান ছিল, আশা করা যায় এই বছরই আবিস্কার হবে। হলে তা হবে পৃথিবীর বৃহত্তম বৈজ্ঞানিক
আবিস্কার।