Saturday, August 10, 2019

"ফ্যাসিজমের ভুত"- স্বৈরতন্ত্রের প্রতি অবচেতন ভালোবাসা

"ফ্যাসিজমের ভুত"- স্বৈরতন্ত্রের প্রতি অবচেতন ভালোবাসা
******
(১)
মোদি শা জুটি ফ্যাসিস্ট, ভারতের গণতন্ত্র বিপন্ন, ভারতের নাজি শাসন আসন্ন- ভারতের লিব্যারাল ন্যারেটিভ মোদিশাহির প্রথমদিন থেকেই "মোদি-শাহ" জুটির "অগণতান্ত্রিক" টেনডেন্সির বিরুদ্ধে সোচ্চার।

মুশকিল, এই যে ভারতের অধিকাংশ ভোটার কিন্ত মোদি-শাহএর এই "ফ্যাসিস্ট" ফেসই পছন্দ করছে। তারা লিব্যারালদের বক্তব্যে কনভিন্সড না। একটা কারন এই যে যেসব বাম এবং তৃনমূলের লোকেরা এই ফ্যাসিজম ফ্যাসিজম বলে লাফাচ্ছে, তারা কতটা গণতান্ত্রিক সবাই জানে বা বোঝে। তাদের রাজ্য শাসনের ইতিহাস আরো বেশী ফ্যাসিস্ট।
সেটাও বোধ হয় আসল কারন না। খুব সম্ভবত বেশ কিছু মনঃস্তাত্বিক কারন আছে -কেন জনসাধারন কিছু কিছু "ফ্যাসিস্ট" নেতাদের পছন্দ করে। এটা বললে ভুল হবে না যে যার মোদি বা দিদিকে পছন্দ করে, তারা এইসব নেতাদের একনায়কতন্ত্র ও পছন্দ করে। আবার সিপিমের ক্ষেত্রে, তাদের কট্টর সমর্থকরা পার্টির একনায়কতন্ত্র পছন্দ করে।

কিন্ত কেন জনসাধারনের এই ফ্যাসিজমের প্রতি ভালোবাসা? আমাদের প্রত্যেকের মনেই কি তাহলে ফ্যাসিজমের প্রতি সুপ্ত ভালোবাসা আছে?

সিপিএম, তৃনমূল পর্যন্ত ও যেতে হবে না। ফেসবুক বা হোয়াটসাপের রাজনৈতিক গ্রুপ গুলোতে মডারেটরদের ফ্যাসিজমের সাথে সবাই অল্পবিস্তর পরিচিত। একটা সামান্য অনলাইন গ্রুপ চালাতেই যদি মডারেটররা ফ্যাসিস্ট টেন্ডেন্সি দেখাতে পারেন, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ফ্যাসিজমের ছায়া থাকবেই। ভারতের ইতিহাসে এমন কোন প্রধানমন্ত্রী নেই যার বিরুদ্ধে বিরোধিরা "ফ্যাসিবাদের অভিযোগ" তোলে নি। সেই অভিযোগ যেমন সত্য, তেমন আরো নিষ্ঠুর সত্য হল, রাষ্ট্রের ভালর জন্য, রাষ্ট্রকে আর শক্তিশালী করে তোলার জন্য কোন নেতা ফ্যাসিস্ট প্রবণতা নিলে- সাধারন জনগণ সেটাকে সাপোর্ট করেছে বরাবর। এটা জেনেও যে তাদের রাজনৈতিক অধিকার এতে হ্রাস পাবে।

জনগণের ফ্যাসিজমের প্রতি এই সুপ্ত ভালোবাসা নতুন কিছু না। ১৯২০-৪০ সালে গোটা ইউরোপে যখন ফ্যাসিজম জনপ্রিয় হচ্ছে- নেতাজি রবীন্দ্রনাথের মতন ব্যক্তিত্বও ফ্যাসিজমের আকৃষ্ট হচ্ছেন- ভিয়েনার তিন বিশ্ববিখ্যাত সাইক্রিয়াটিস্ট- যারা আধুনিক সাইকোএনালাইসিসের জনক -তারা কিন্ত " ফ্যাসিজমের প্রতি মানুষের এই মোহ কেন" - সেটা নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তা করা শুরু করেন। আমি আজ তাদের তত্ত্ব নিয়েই লিখছি-কারন ভারতের বর্তমান অবস্থানে এগুলো খুবই প্রযোজ্য এবং বোঝা যাবে কেন আপামর ভারতীয় জনগণ কেন বজ্রকঠিন এক শাসক চাইছে। এরা সাইকোএনালাইসিসের পায়োনিয়ার

- আলফ্রেড এডলার ( জন্ম অস্ট্রিয়া- ১৮৭০- ১৯৩৭)-ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স তত্ত্বের জনক। আমরা উনার তত্ত্ব দেখব-কিভাবে ইনফিরিওটি কমপ্লেক্স থেকে, "ফ্যাসিজমের প্রতি ফ্যাসিনেশন" তৈরী হতে পারে।

- উইলহেম রাইখ - ১৯৩৩ সালে তিনি প্রকাশ করেন তার গবেশনা গ্রন্থ - "মাস সাইকোলজি অব ফ্যাসিজম"। এখানে তিনি দেখান কিভাবে একটা সমাজের" সেক্সুয়াল সাপ্রেশন" আস্তে আস্তে অথরোট্রিয়ান বা স্বৈরাচারি শাসনের সমর্থক হয়ে ওঠে।

- কার্ল গুস্তাভ ইয়াং। তিনি সাইকোএনালাইসিসে "ইন্ডিভিজুয়েশন" তত্ত্বের জনক। নাৎসিদের ওপর পরীক্ষা করে উনি দেখেন কিভাবে আমাদের "ইন্ডিভিজুয়েশন" অর্থাৎ ব্যক্তিত্ব যখন তৈরী হয়-তার মধ্যেই ঢুকে যায় "ফ্যাসিজমের ভুত"- স্বৈরতন্ত্রের প্রতি সাবকনসাস ভালোবাসা

(২) প্রথমে এডলারের ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স তত্ত্বে আসি। এই তত্ত্বে ঢোকার আগে- যারা মোদিভক্ত তাদের "ন্যাশানালিস্টক মাইন্ড" টা একটু স্ক্যান করা যাক। এরা ভারত যদি পাকিস্তানে দুটো বোমা মারতে পারে, একটা এটম বোম ফাটাতে পারে, বা চাঁদে চন্দ্রযান পাঠাতে পারে, ভারতে বুলেট ট্রেন চলে-তাতেই খুব খুশী। ভারত জগত সভায় শ্রেষ্ঠ আসন নিলেই ইনারা খুশী।

আপনি বলবেন, তাতে অসুবিধা কি- এটাই ত জাতীয়তাবাদ।

না অসুবিধা নেই-কিন্ত এই যে "জাতির" প্রতি ভালোবাসা-এডলার বলছেন এর মূলেও আছে ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স এবং জাতীয়বাদি নেতারা সেটাইকেই এক্সপ্লয়েট করেন।

উনার মূল বক্তব্য- যারা এই মেরা ভারত মহান ( আমেরিকাতে মেক আমেরিকা গ্রেইট এগেইন) ইত্যাদি শ্লোগানে গভীরভাবে বিশ্বাস করেন-তারা আসলে "নিজের ক্ষুদ্রতায়- তা ক্ষমতার হোক, অর্থের হোক বা এচিভমেন্টের হোক-লজ্জিত। সেই জন্য নিজের মরাল বুস্ট করার জন্য ইনারা মহান ভারত, মহান হিন্দু ধর্মের স্বপ্ন দেখেন- যা ব্যক্তি হিসাবে ইনারা যা পারছেন না, যদি সমষ্ঠি হিসাবে সেটা পারেন!

এডলার দেখান এরও ইতিহাস আছে। মধ্যযুগে মানুষ ছিল ধর্ম নিয়ন্ত্রিত। তারা জানত তারা ইশ্বরের সন্তান। রাজা অত্যাচারি হলে এরা মেনে নিত আগের জন্মের দোষ বা পাপের ফল। জ্ঞান বিজ্ঞান মানবতাবাদি দর্শনের অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষ বুঝল উন্নততর রাজনৈতিক সিস্টেম সম্ভব- যেখানে সে "সিস্টেমকে" গণতন্ত্রের মাধ্যমে বদলাতে পারে ! ঐশ্বরিক ভাগ্যকে মেনে নেওয়ার দরকার নেই।

এই যে আমি সমাজ বদলাতে পারি-কিন্ত আমার দেহ, অর্থনৈতিক ক্ষমতা এত ক্ষুদ্র- আমি কিন্ত রাজনৈতিক সিস্টেমকে বদলাতে পারছি না। এই ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স থেকে তৈরী হয় বিরাট "হতাশা"। তখনই মানুষ খপ্পরে পরে কমিউনিজম, ন্যাশানালিজম, ইসলামিজমের রাজনীতি। যারা দেখায় তুমি নিজে একা পারবে না- কিন্ত "শ্রেনী" হিসাবে, বা রাষ্ট্র হিসাবে বা ধর্মের গোষ্ঠীর ছায়ায় এসে সমষ্টীগত ভাবে নিজের ক্ষুদ্রতা থেকে , হতাশা থেকে মুক্তি পাবে। এই জন্যে কমিউনিজম বা ইসলাম বা জাতিয়তাবাদ- সব রাজনীতিই বলে নিজের ব্যক্তিসত্ত্বা বিসর্জন দিয়ে আদর্শ এবং গোষ্ঠির পরিচয় গ্রহন কর। এই ভাবেই বৃহত্তর পরিচয়ের মাধ্যমে তুমি তোমার ক্ষুদ্রতা, ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স থেকে মুক্তি পাবে।

এই পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্ত মানুষ যদি তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র সম্পূর্ন ভাবে বিসর্জন দিয়ে গোষ্ঠীপতির পুতুল নাচের পুতুলে পরিনত হয়, সে নিজের ভালমন্দ না ভেবে, গোষ্টিপতির আগুনের রাজনীতিতে পতঙ্গের মতন ঝাঁপ দেবে। ফ্যাসিজমের শক্তি এবং সমস্যা সেখানেই।


(২) এবার আসি উইলহেম রাইখের বই (১৯৩৩) -মাস সাইকোলজি অব ফ্যাসিজমে।

উনি দেখেছিলেন, জার্মান জাতির স্বৈরতন্ত্র এবং অথোরিটির প্রতি অন্ধ আনুগত্যের বড় কারন সমাজ এবং রাষ্ট্র স্বারা বাল্য থেকেই যৌন ইচ্ছার অবদমন।

রাইখের চিন্তায়, মানুষের যৌন ইচ্ছা হচ্ছে সব থেকে শক্তিশালী "ড্রাইভ"। কিন্ত যখন সে দেখে সমাজ এবং রাষ্ট্রের আইনের কারনে, তার ইচ্ছার প্রতিপালন হচ্ছে না-তাকে জোর করে তার স্বাধীন ইচ্ছাকে চেপে রাখতে হচ্ছে "অথোরিটির ভয়ে"- সে আস্তে আস্তেই গৃহপালিত প্রানীর মতন তার স্বাধীন ইচ্ছাকে চেপে রেখে "অথোরিটির" সৈনিকে পরিনত হয়।

যেমন ধরুন কাশ্মীরের ৩৭০ নিয়ে বিতর্কে, আমি ৩৭০ তুলে দেবার পক্ষপাতি - কাষ্মীরের অর্থনৈতিক উন্নতির কারনে। বিজেপির অনেক সমর্থকের কাছেই তা না। কেউ কেউ ফেসবুকে বিকৃত উল্লাস প্রকাশ করেছেন এবার তারা "কাশ্মীরের সাদা মেয়েদের বিয়ে " করতে পারবেন! যৌনতা কোন লেয়ারে অবদমন করলে এই ধরনের পারভার্ট কথাবার্ত্তা লোকে বলে তা সহজেই অনুমেয়।

(৩) কার্ল গুস্তাভ ইয়াং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই ধৃত নাজিদের ওপর মানসিক পরীক্ষা শুরু করেন। সাথে সাথে যারা প্রানের মায়া কাটীয়ে নাজি বিরোধিতা করেছিল, তাদের ও মন পরীক্ষা করা শুরু করলেন।

রেজাল্ট অদ্ভুত। নাজি এবং নাজি বিরোধি- দুই ক্ষেত্রেই ইয়াং দেখলেন অবচেতন মনে এরা হিটলারের মতন একজন "দৈত্য" কে পছন্দ করনে। চেতন মনস্তরে নাজি বিরোধিরা সেটা দেখতে পান না- কিন্ত নাজি সাপোর্টারদের কাছে দৈত্যের প্রতি সেই অবচেতন ভালোবাসা একদম চেতনার স্তরে চলে এসেছে।

ইয়াং এর এই তত্ত্বকে আমরা অবচেতন দৈত্যের প্রতি ভালোবাসার তত্ত্ব হিসাবে দেখতে পারি।

ইয়াং দেখলেন মানুষের মনের গুহ্য অন্তরে একটা "ডেস্ট্রাক্টিভ ডেমন" বা সব ধ্বংস করেদেওয়া দৈত্যের মন আছে। সে নিজে সেই দৈত্য হতে ভয় পায়, কিন্ত কোন নেতা যখন সেই দৈত্যের মতন ধ্বংস যজ্ঞ শুরু করে- সে আসলে সেটা পছন্দ করে- কারন তার মনের সেই দৈত্যকে নেতার মধ্যে দেখতে পায় লোকজন।

ভেবে দেখুন। মোদির ডিমনেটাইজএশনের সময় লোকজনের একটা মাস সাইকোলজি ছিল- কষ্ট হচ্ছে ত কি- মোদি কালোটাকার কারবারিদের ওপর একটা এটম বোম ফেলেছে। পাকিস্তানে আক্রমন- সেই দৈত্য- যাক এই লোকটা উলটাতে পাল্টাতে পারে। কাশ্মীরের ৩৭০ নিয়েও ভারতের মাস সাইকোলজি ঠিক তাই। মোদিই সেই দৈত্য যে এসব কিছু উল্টাতেপারে- তাই দৈত্যের প্রতি ভালোবাসে। কারন ঐ দৈত্যটাকে আমরা নিজের অজান্তেই ভালবাসি।


( আরো অনেক কিছুই লেখার ছিল। কিন্ত বেশী লিখলে লোকে পড়েনা। তাই সামারিটা লিখলাম)

1 comment:

Avinandan Das said...

আপনি আরও লিখুন, সবাই না পড়লেও কেউ কেউ পড়ে , পুরোটা।