Sunday, January 17, 2021

বাংলা পক্ষের রাজনীতি

 

বাংলা পক্ষের রাজনীতি

-       বিপ্লব পাল ১/১৭/২০২১

আজ বাংলাপক্ষের সমাবেশ দেখলাম ভিডিওতে। ভাল লাগল। এটা ১৯৭০ নাগাদ হলে আরো ভাল হত। সিপিএম কংগ্রেসের হাতে পশ্চিম্ বঙ্গকে এই ভাবে তিলে তিলে শেষ হতে হত না।

 

 যারা ভূমিপুত্রদের অধিকারের আন্দোলনকে বিচ্ছন্নতাবাদি ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে বাঙালীর আরো ক্ষতি করতেব চাইছেন, তাদের এই পাঁচটা পয়েন্ট অবশ্যই জানা উচিত

 

(১) এই মুহুর্তে অর্থনৈতিক এবং মানবিক উন্নয়নের দিক দিয়ে সব থেকে বেশী এগিয়ে থাকা রাজ্যগুলো দেখুন – তামিলনাডু, অন্ধ্র, মহারাষ্ট্র , পাঞ্জাব ইত্যাদি। এই সব রাজ্যেই আঞ্চলিক দল, আঞ্চলিক ভাষা জাতিয়তাবাদি দলগুলি শক্তিশালী। কারন এইসব রাজ্যের রাজনীতি বরাবর ভূমিপুত্রদের চাকরি ব্যবসার দিকটা সব থেকে বেশী গুরুত্ব দিয়েছে। তার ফল ও পাচ্ছে। তারা কি অন্যরাজ্যের লোকেদের তাড়িয়ে দিয়েছে? মোটেও না। কিন্ত নিজের রাজ্যের ভূমিপুত্রদের দিয়ে অর্থনৈতিক বেসটা তৈরী করেছে। সেটা বাংলায় নেই। বাংলার অর্থনীতি মারোয়ারীদের হাতে। আই এ এস, আই পি এস, -টোটাল এডমিনিস্টেশন  সেটাও অবাঙালীদের হাতে যেহেতু বাঙালীরা শিক্ষায় পিছিয়ে গেছে এবং তারা এই এডমিনিস্ট্রেশনে যেতে অনিচ্ছুক। ২০২১ সালে হয়ত বাঙালীর রাজনীতিটাও দিল্লীর হাতে তুলে দেবে বাঙলারই সাম্প্রাদায়িক হিন্দুরা।  বাঙালীর হাতে নিজভূমেই আর কিছু থাকবে না। এই পরিস্থিতিতে বাঙালীর প্রতিরোধ আন্দোলন হবেই-এবং সেটাই করছে বাংলাপক্ষ।

 

(২) কেন লিখলাম এটা ১৯৭০ সালে হত ভাল হত?  তাহলে মহারাষ্ট্রে শিবসেনার ইতিহাস দেখতে হবে। শিবসেনা মহারাষ্ট্রে সব থেকে দুটো গুরুত্বপূর্ন কাজ করেছিল। সিটুর ট্রেড ইউনিয়ান ধ্বংস করেছিল। আর স্থানীয় মারাঠীদের চাকরির জন্য বহিরাগত শিল্পপতিদের বাধ্য করেছিল ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কুল চালু করতে। যেখানে স্থানীয় বেকারদের ওয়েল্ডিং, ফিটিং ইত্যাদিতে ট্রেনিং দেওয়া হত। এই ভাবে শিবসেনার চাপে মহারাষ্ট্র হয়ে ওঠে শিল্পভূমি, আর পশ্চিম বাংলা সিটুর দৌড়াত্মে শিল্পের বধ্যভূমি। নইলে ১৯৬০-৭০ সালে ভারতে বাংলা এবং মরারাষ্ট্রই ছিল শিল্পে সব থেকে উন্নত রাজ্য। কিন্ত মহারাষ্ট্র যেখানে এক নাম্বার পজিশন ধরে রাখল, বাংলা পিছিয়ে গেল ২২ নাম্বারে। শেষের বেঞ্চে। পার্থক্য? শিবসেনা। যারা মারাঠি ভূমিপুত্রদের জন্য লাগাতার আন্দোলন করেছে। বাংলার মারোয়ারী ক্যাপিটাল চলে গেল গোটা ভারতে। কিন্ত মহারাষ্ট্রের সিন্ধ্রি, গুজরাতি ক্যাপিটাল মহারাষ্ট্রে আরো ইনভেট করল । কেন? শিবসেনা।

 

(৩)  বাঙালীর সব থেকে বড় সমস্যা হচ্ছে এদের মধ্যে যে বুদ্ধিজীবী ক্লাসটা, মানে যারা একটু লিখতে টিখতে পারে, টকশোতে মুখ দেখায়-তারা হচ্ছে শ্রেফ অশিক্ষিত এবং নির্বোধ। প্রথমে বাঙালী ন্যাশানালিস্ট বুদ্ধিজীবিদের কথায় আসি। এর মধ্যে আছে কংগ্রেস এবং বিজেপির দিল্লীতে পাত্তা না পাওয়া রাজ্য নেতারা। এদের ধারনা যেকোন দিল্লী বিরোধি আন্দোলনই বিচ্ছিন্নবাদি আন্দোলন। আমি শুধু তাদের একটা কথাই বলব। ইতিহাস পরিস্কার। ভারত যদি টুকরো টুকরো হয়,তা কাশ্মীরের জঙ্গী, খালিস্থানি বা আলফা জঙ্গীদের জন্য হবে না। তা হবে দিল্লীর কেন্দ্রীকতার জন্য। ভারতের ফেডারালিজম ধ্বংসের জন্য।  কেন ? তাহলে সোভিয়েত “ইউনিয়ন” এবং ইউনাইটেড স্টেটস এর ইউনিয়নের পার্থক্যটা দেখতে হবে।

 আমেরিকার ১৭৭৫ সাল থেকে ২৫০ বছর একটা সাকসেস্ফুল ইউনিয়ান। কিন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ান ৭০ বছরেই ভেঙে ২০ টুকরো হয়ে গেল। কেন?

কারন জোর করে ওইভাবে জাতিয়তাবাদি ঐক্য চাপানো যায় না। সোভীয়েত ইউনিয়ানের রাজ্যগুলো অক্টবর প্রতিবিপ্লবের আগে ছিল জারের রাশিয়ার কলোনী। তাদের আলাদা ভাষা। আলাদা সংস্কৃতি। বিপ্লবের সময় লেনিন প্রতিশ্রুতি দেন, প্রতিটা কলোনী স্বাধীনতা পাবে বলশেভিক বিপ্লবের পর। কিন্ত উল্টোটা হয়েছে।  রাশিয়ান বিপ্লবের তিন বছরের মধ্যে রেড আর্মি সৈন্য দিয়ে , প্রতিটা রাজ্যের নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারকে ধ্বংস করে সোভীয়েত ইউনিয়ানের মধ্যে নিয়ে আসে। এগুলি লেনিন স্টালিনের নির্দেশেই হয়েছে ( অথচ বাঙালী বামেরা এখনো মনে করে, লেনিন স্টালিন সাম্রাজ্যবাদি বিরোধি মূর্ত ভগবান। লেনিন সরনি এখনো বাংলায় শোভা পায় !)

যদিও সোভিয়েত ইউনিয়ান রাজ্যগুলির ভূমিপুত্রদের ভাষা এবং সংস্কৃতির বিকাশে দিল্লীর থেকেও অনেক বেশী উদার ছিল। কিন্ত তবুও সেই ইউনিয়ান টেকে নি। কারন রাজ্যগুলির রাজনৈতিক প্রভু ছিল মস্কো।  ফলে স্বাধীনতার আন্দোলনকে দমানো যায় নি।

 

 আমেরিকাতে ওয়াশিংটন কোন রাজ্যের প্রভু না। প্রতি রাজ্যের নিজস্ব আইন, নিজস্ব ট্যাক্স। ওয়াশিংটনের হাতে শুধু মিলিটারি, বৈদেশিক রিলেশন। আভ্যন্তরীন শাসনের ক্ষেত্রে প্রতিটা রাজ্য স্বাধীন।  ওয়াশিংটন চাইলেও রাজ্যগুলির ওপর কিছু চাপাতে পারে না। ফলে আমেরিকার “ঐক্য” সব থেকে শক্তিশালী।

 

ভারতে যেভাবে শক্তিশালী দিল্লী আবার ফিরে আসছে, তাতে বিচ্ছিন্নবাদি আন্দোলন আরো বাড়বে। কমবে না। ভূমিপুত্রদের হাতে তাদের ভূমির রাজনৈতিক অধিকার না থাকলে, তারা বিদ্রোহ করবে না?

 

(৪) ভারতের ধারনা বৃটিশদের দেওয়া। কলোনিয়াল। মুঘল আমলের আগে পর্যন্ত বাংলা মোটেও দিল্লীর অধীনে কোনকালে ছিল না।  আকবর বাংলাকে মুঘল সম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। এবং সেই সময় বাংলার জিডিপি ছিল ভারতে সর্বোচ্চ। কিন্ত কি হল আউরঙ্গজেবের আমলে? তার দাক্ষিনাত্য অভিযানে সব টাকা এসেছে বাংলা থেকে। তারপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ভার‍ত বিজয়ে সব টাকা এসেছে বাংলা থেকে। তার বিনিময়ে বাংলার নেমে এসেছে দুর্ভিক্ষ। দারিদ্র।

 

অশোকের ভারত, অখন্ড ভার‍্তের ঐক্যের ধারনা, পাঠ্য পুস্তকের জাতিয়তাবাদি ইনডক্ট্রিনেশন। স্কুলে ভারত ধারনা যে ব্রেইন ওয়াশ করা হয়েছে, তা নিয়ে আমৃত্যু বয়ে বেড়ায় অনেক বাঙালী।  বর্তমান ভারতের উৎস বৃটিশ রাজের ভারত। অন্যকিছু না।  এবং সেটা একটা “ইউনিয়ান”। ইউনিয়ান ভাল জিনিস। আমেরিকা তার প্রমান। কিন্ত তা কাজ করে যদি প্রতিটা রাজ্য যথেষ্ট স্বয়ত্বশাসন পায়। ফেডারিলিজম থাকে। ভূমিপুত্রদের অধিকার সুরক্ষিত থাকে।

 

ইতিহাসের রায় স্পষ্ট। দিল্লীর অধীনে থেকে বাংলা শুধুই পিছিয়েছে। সেই মুঘল আমল থেকেই।  বাংলাদেশের সৌভাগ্য তারা ১৯৭১ সালে একটা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে আত্নপ্রকাশ করতে পেরেছে। ফলে তারা আজ অর্তনীতি , শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যে পশ্চিম বঙ্গের থেকে এগিয়ে গেছে।

 

অবশ্য পাশাপাশি এটাও ভাবার দরকার গ্লোবালাইজেশন এবং ক্যাপিটালিজমের যুগে বড় রাষ্ট্রের অংশ হওয়ার সুবিধাও আছে। কারন ক্যাপিটাল এবং মার্কেটের আরো এক্সেসেবিলিটি।  ভারতের মধ্যে থাকার  সেই সুবিধাটা মারাঠারা পেয়েছে। কারন তাদের শিবসেনা আছে। বাঙালী পায় নি। কারন তাদের শিবসেনা ছিল না। ছিল পেছন পাকা অশিক্ষিত বাম এবং কংগ্রেসে নেতা-একদল বিশ্বাস করে আন্তর্জাতিকতায়, আরেকদল জাতিয়তাবাদে।  যেগুলোতে বাংলার ভূমিপুত্রদের কোন লাভ হয় নি।  সেগুলো খায় না মাথায় দেয় বাঙালীর ভূমিপুত্ররা এখনো জানে না।

 ৫) ভারতের সর্বত্রই হিন্দি চাপানো হচ্ছে। হিন্দি ভাষাটা আজ থেকে দুশো বছর আগেও ছিল না। ভারতের ধারনার মতন, হিন্দিটাও বৃটিশদের দান । কলোনিয়াল লেগাসি। তারাই শুরু করেছিল হিন্দুস্তানী ভাষা। তুলসীদাস মৈথিলী কবি। মৈথিলো, বুন্দেলী, ভোজপুরী ইত্যাদি সব কিছু শুষে তৈরী হিন্দুস্থানী-সেটাই আজকের হিন্দি। এর সাথে কোন সংস্কৃতি নেই। আছে কলোনিয়াল ইতিহাস। যোগাযোগের তাগিদ। আর সংস্কৃতি ছাড়া কি করে একটা ভাষার মাটির বুনিয়াদ তৈরী হয়? হিন্দি যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে ঠিক আছে। কিন্ত হিন্দি ভাষা কখনোই ভারতের অন্য ভাষাগুলির, যা মাটির ভাষা তারা প্রতিস্থাপক না। হিন্দির আগ্রাসন বন্ধ না হলে বাঙলা ভাষাটাই পশ্চিম বঙ্গ থেকে উঠে যাবে। আর ভাষা বিনা সংস্কৃতি টেকে না।

 

 আমি এটা বারবার মনে রাখি, পাসপোর্ট পালটে আমি ভারতীয় থেকে আমেরিকান হয়েছি। কিন্ত আমার ভাষাগত পরিচয়, বাঙালী- আমার মাতৃভাষা পালটানো সম্ভব না। কারন ভাষাটা আমার অবিচ্ছেদ্য অংশ। জাতীয় পরিচিতিটা একটা নির্মান। যা কাজের জন্য, মাইগেশনের জন্য বদলাতে পারে।

 

“ভারত” বৃটিশদের কৃত্রিম নির্মান। “বাংলা” কৃত্রিম নির্মান না-তা একটি ভূমি, একটি ভৌগলিক অঞ্চলের  জনগোষ্টির বিবর্তন। এই পার্থক্যটা মাথায় রাখা দরকার।

No comments: