Sunday, August 14, 2022

স্বাধীনতার ৭৫ বছর - "ভারত" বিশ্বের ইতিহাসের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক পরীক্ষা

 যখন ছোট ছিলাম, ভারতে ছিলাম, ভারতের ইতিহাস বই পড়তাম, তখন এক ভারতকে চিনতাম। 

  এখন বয়স হল, ভারতের বাইরে আছি দীর্ঘদীন। পৃথিবীকে যত চিনছি, যত বিশ্বের ইতিহাস আর ভূগোলকে জানার সুযোগ হচ্ছে, অন্য ভারতকে আবিস্কার করছি প্রতিদিন।  হতে পারে সেটা আমেরিকার লেন্সে, দর্শনের  মাইক্রোস্কোপে আর ইতিহাসের দূরবীক্ষনে ।  কিন্ত প্রতিনিয়ত এক অদ্ভত দেশকে আবিস্কার করি! সত্যিই,  এমন দেশটি কোথাও গেলে পাবে নাকো তুমি!

ভারত বা যেকোন দেশই একটা "স্যোশাল কনট্রাক্ট"- বিবাহের মতন জুটি বাঁধা। বিয়ে টেকাতে যেমন প্রতিনিয়ত সবাই কিছুটা  নিজেদের  ব্যক্তিস্বাধীনতা বিসর্জন দিই, নিজস্ব স্বত্ত্বা বিসর্জন দিচ্ছি,  নানাবিধ কম্প্রোমাইজ করে থাকি-  এবং তার বিনিময়ে বিবাহ থেকে অনেক কিছুর নিরাপত্তা পাই।   দেশের সাথে তার জনগনের সম্পর্ক ও তাই। কিন্ত আরো অনেক জটিল স্কেলে।  একটা দেওয়া নেওয়ার সম্পর্কের চুক্তি।  দেশের জন্য সবাইকেই কিছু না কিছু ত্যাগ করতে হয়। বিনিময়ে দেশ দেবে। কিন্ত এই দেওয়া নেওয়ার সম্পর্কে ফাঁকিবাজি বড্ড বেশী। 

ঐক্যবদ্ধ অখন্ড ভারতের ধারনা মহাভারতে বারংবার উচ্চারিত। কেন? কারনটা মহাভারতের লেখক বারংবার বলেছেন। এক, তাতে রাজ্যগুলির মধ্যে যুদ্ধ হবে না। শান্তি বজায় থাকলে,  দেশে সমৃদ্ধি আসবে। বহিঃশত্রুর আক্রমন থেকে ভারত নিরাপদ থাকবে। এই প্রয়োজনেই ভারতের উৎপত্তি এবং বর্তমান অস্তিত্ব। ভারতের মিলিটারি বাজেট জিডিপির ২%।  আজ ভারতের প্রতিটা রাজ্য যদি স্বাধীন রাষ্ট্র হয়, তাহলে প্রতিটা রাজ্যকে আলাদা মিলিটারি রাখতে হবে। এবং তাতে সামরিক বাজেট হবে জিডিপির ১০%+ । কিন্ত তাতেও নিরাপত্তা অনেক অনেক বেশী কমবে। ইউক্রেনের যুদ্ধ প্রমান করে দিয়েছে, বড় শক্তিশালী দেশের নাগরিক না হলে, ছোট দেশের নাগরিকরা নিরাপদ না।  ইউ এন এক ঠুটো জগন্নাথ দর্শক। কোন ছোট রাষ্ট্রকে বড় রাষ্ট্রের আগ্রাসন থেকে নিরাপত্তা দেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। 

কিন্ত মহাভারত এক উপন্যাস। অখন্ড ভারত ইতিহাসে প্রথম বার তৈরী হল আলেক্সান্ডারের আক্রমন থেকে শিক্ষা নিয়ে।  আলেক্সান্ডারের আক্রমন প্রমান করে দিল, বহিঃশত্রুর আক্রমন থেকে বাঁচতে অখন্ড ঐক্যবদ্ধ ভারত দরকার। ফলে গোটা এশিয়াতে গ্রীক সাম্রাজ্য রাজত্ব করেছিল আলেক্সান্ডারের মৃত্যুর পরও দুশো বছর। কিন্ত ভারতে রইল ভূমিপূত্রদের মৌর্য্য সাম্রাজ্য। কারন চানক্য বা বিষ্ণুগুপ্ত বুঝেছিলেন ভারত নিজে "সাম্রাজ্য" না হলে, এই ভূখন্ড অন্য সাম্রাজ্যের অধীন হবে। 


চানক্যের রাজনৈতিক শিক্ষার আরেক সফল প্রয়োগ দেখায় চীনের কুইন সাম্রাজ্য। ২৪৭ খৃঃপূর্বাব্দে তারা বাকি পাঁচটি রাজ্যকে হারিয়ে গোটা চীনকে একটি অখন্ড রাষ্ট্রের আওতায় আনে।  ফলে চীন দীর্ঘদিন পর্যন্ত-  ইউরোপিয়ানদের আগমনের আগে পর্যন্ত পৃথিবীর সব থেকে সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্র হিসাবে টিকে থাকে। এবং তারা আবার পৃথিবীর সব থেকে শক্তিশালী এবং সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্র হিসাবে নিকট ভবিষ্যতে আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে। 

কিন্ত ভারত ভুলে যায় বিষ্ণুগুপ্তকে। ফলে চানক্যের ভবিষ্যতবানী সফল করে উত্তর-পশ্চিমের দুর্ধ্বষ্ব পাহাড়ি যোদ্ধারা  ইসলামের ধর্মজয়ে ধ্বজ্জা উড়িয়ে ভারত আক্রমন করে। সফল ভাবে তারা ভারতের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে।  বিচ্ছিন্ন ভারতের ক্ষমতা ছিল না-সেই শক্তিকে রুখে দেওয়ার। ফলে প্রথমে মধ্য এশিয়ার উপজাতি, পরে ইউরোপিয়ান বনিকদের হাতে এই অঞ্চলের লোকেরা দীর্ঘদিন পদানত ছিল।  যেমন অধিকাংশ মুসলমান শাসকরা  বিদ্রোহের ভয়ে স্থানীয় লোকেদের ঘোড়া, অস্ত্র এবং সৈনিক রাখতে দিত না। বা দিলেও অনুমতি সাপেক্ষে দিত। বৃটিশরা ভারতের লোহ শিল্পকে ধ্বংস করে যাতে অস্ত্র তৈরী না হয়। আর স্থানীয় রাজরাজাদের সেনাবাহিনী তুলে দেওয়া হয় প্রোটেক্টারেট স্টেটের নামে।  

বলতে গেলে বর্তমান এই ভারতের শুরু মুঘলদের হাত দিয়ে যারা মধ্য এশিয়ার থেকে আগত। বৃটিশরা মুঘলদের ভারত নামক পরীক্ষাটাই এগিয়ে নিয়ে গেছে।  সাথে যোগ হয়েছে ইউরোপিয়ান লিব্যারাল ডেমোক্রাসির আদলে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। 

মুঘল আমলেই ভারতের স্থানীয় সংস্কৃতিগুলি- যেমন বাংলা বা তামিল বা মারাঠি জাতিগোষ্ঠিগুলি দিল্লীর অধীনে আসে। দিল্লী থেকে আগত গর্ভনররা ভারতের রাজ্যগুলি শাসন করতে থাকেন। বৃটিশ আমলে সেই ট্রাডিশনই বজায় ছিল-শুধু দিল্লীর বদলে লন্ডন থেকে গর্ভনর আসত।  স্বাধীনতার পর, স্বয়ত্ব শাসনের পরিধি বাড়াতে রাজ্যগুলির হাতে "কিছু" ক্ষমতা দেওয়া হয়-গর্ভনরের পজিশনটা টিটুটেলার হেড হিসাবে থেকে যায়। 

একটা জিনিস খেয়াল রাখতে হবে। এই শতকে পৃথিবীর যে তিনটে দেশ বৃহত্তম এবং সব থেকে শক্তিশালী রাষ্ট্র হতে চলেছে- ইউনাইটেড স্টেটস, চীন এবং ভারত- তাদের ভিত্তি বিশাল দেশের বিপুল অর্থনীতি।  জাপান, জার্মানী, বৃটেন, ফ্রান্সের মতন উন্নত দেশগুলিও ভারতের সাথে সামরিক, অর্থনৈতিক এবং বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে পেরে উঠবে না। 

এটা এক ধরনের মির‍্যাকল। ম্যাজিক।  ১৯৪৭ সালে ভারত ছিল গরীব একটা দেশ। এখনো তাই আছে। কিন্ত এখন দেশে গরীবের সাথে সাথে বিরাট বড় বড় পুঁজি রয়েছে। পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম মধ্যবিত্ত শ্রেনীটি আছে।  বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে শিক্ষিত দ্বিতীয় বৃহত্তম মানব সম্পদ রয়েছে। এখন মার্ক জাকারবার্গ বা জেফ বেজোসকেও ভারতে আসতে হয়। ভারতের কথা ভাবতে হয়। ভূরাজনীতি ভারত ছাড়া ভাবা যায় না। 

কোন সন্দেহ নেই, এ এক উদীয়মান ভারত। অদ্ভুত দেশ। এত জাতি, এত ভাষা, এত ধর্ম সত্ত্বেও দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। 

 কিন্ত আমি সম্পূর্ন নিশ্চিত না। স্কেপ্টিক্যাল। কারন একটাই। 

 একটা দেশকে ধ্বংস করতে আজকাল পরমানু বোমার দরকার হয় না। ট্যাঙ্ক গোলাবারুদ, বায়োওয়েপন, ভাইরাস কোন কিছুই ভারতকে ধ্বংস করতে পারবে না। বিচ্ছিন্নবাদি আন্দোলন ও পারবে না। 

তাও ভারত ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। পৃথিবী যেদিকে এগোচ্ছে, তাতে মানুষের শিক্ষা সব থেকে গুরুত্বপূর্ন হতে চলেছে।  শিক্ষা বিষয়টি ভারতের শাসকেরা কখনোই সিরিয়াসলি নেয় নি। ভারতের স্কুলে যে মুখস্থ বিদ্যা নির্ভর শিক্ষা চলছে- তা বর্তমানে সম্পূর্ন অকার্যকরী। অদরকারি। এতে এক বিকালঙ্গ নাগরিক সমাজ তৈরী হচ্ছে, যারা চিন্তা করতে জানে না।  এরা দেশ দেশ বলে লাফাতে পারবে, কিন্ত দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না।

ভারতকে যদি কোন কিছু ধ্বংস করে, সেটা হবে শিক্ষা ব্যবস্থাকে অবহেলা। উদাহরন দিই? গরমকালে ভারতের সব শহরে জল কষ্ট।  পাম্প খারাপ হয়। ভূগর্ভে জল থাকে না। অথচ ভারতে এখনো বহুতল বানানোর পারমিশন অকাতরে দেওয়া হচ্ছে।  বহূতল মানেই খুব অল্প জায়গায় বিপুল জল মাটি থেকে টেনে, সেখানকার ভূর্গভস্থ জল সম্পূর্ন ধ্বংস করবে। যা ব্যাঙ্গালোর, চেন্নাই, পুনেতে হয়েছে। বহুতল বানানোর পারমিশন শুধুমাত্র কোন অশিক্ষিত জাতিই দিতে পারে। 

আরো উদাহরন দিচ্ছি। ভারত পাঁচ হাজার বছরের সভ্যতা। এখানে বহুদিন ধরে জনগন যেসব ফসল ফলাত-যেভাবে সেই ফসল থেকে খাদ্য হত-তা আজ লুপ্ত।  বহুদিনের এই সুস্থ থাকার শিক্ষা আজ লুপ্ত। তার বদলে ভারতের মেনুতে ঢুকেছে অগুন্তি অস্বাস্থ্যকর খাদ্য তালিকা।  সুস্থ থাকার শিক্ষাটাই স্কুলে পড়ানো হয় না ঠিক করে। 

 আমি নানাবিধ বিষয়ে পড়াশোনা করে এই সিদ্ধান্তে এসেছি- ভারতকে তার হৃদ্গৌরব ফিরে পেতে গেলে, সুস্থ এবং বুদ্ধিমান জনগোষ্ঠির দরকার। ১৪০ কোটি অসুস্থ, নাবালক নাগরিক নিয়ে সবার সেরা আমার সে দেশ হবে না।  আর সেটা করতে গেলে, অতীতে তাকানো প্রয়োজন। যখন ভারতে একটি বাড়ি বানালে, সে বাড়ির পেছনে একটা পুকুর থাকত।  একটা শহর বানাতে গেলে একাধিক হ্রদকাটা হত।  ভোগ না, ত্যাগই ছিল পরম আদর্শ। লোভ না, সেবাই ছিল পরম ধর্ম।  প্রকৃতি ছিল পরম গুরু এবং মাতা।  এসব ভারত থেকে হারিয়ে গেলে,  সে শুধু নামেই ভারত হবে। পৃথিবীর শিক্ষক এবং গুরু হতে পারবে না। 







No comments: