Sunday, February 28, 2021

ঈর্ষা এবং বামপন্থা- সমাজ ধ্বংসের সিঁড়ি

 ঈর্ষা এবং বামপন্থা- সমাজ ধ্বংসের সিঁড়ি

(১)
খ্রীষ্ঠান ধর্মের জনপ্রিয়তা বা কিভাবে আস্তে আস্তে রোমান সম্রাজ্যে খীষ্ঠান ধর্ম জনপ্রিয় হয়, তা নিয়ে জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিক নিৎসের খুব গুরুত্বপূর্ন একটি তত্ত্ব আছে। উনার মতে এর মূল কারন ঈর্ষা। খ্রীষ্ঠান ধর্ম রোমান সম্রাজ্যের গরীব এবং দাসেদের মধ্যে প্রথমে জনপ্রিয় হয়। নিৎসের তত্ত্বে গরীব বঞ্চিত ব্যক্তিরা ধনীদের যে প্রাচুর্য্যের জীবন চোখের সামনে দেখে, তাতে ঈর্ষান্বিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। নিৎসে বলছেন এই ঈর্ষা ভাল। কারন এর জন্যেই গরীব লোকেরা পরিশ্রম করে , রিস্ক নিয়ে থাকে- ধন সম্পদ আহরনের চেষ্টা করে। নিজের ছেলেমেয়েদের উপযুক্ত শিক্ষা দেয়। যাতে এটলিস্ট পরের প্রজন্ম ভাল থাকে।

কিন্ত যেকারনে নিৎসে খাপ্পা ছিলেন খ্রীষ্ঠান ধর্মের প্রতি- এই খৃষ্ট ধর্মে বলা হল ঈর্ষা পাপ। বড়লোক হওয়া পাপ, যৌনইচ্ছা পাপ। ফলে খৃষ্টধর্মের জনপ্রিয় হওয়ার আগে , ইউরোপের গরীবলোকেরা যে বড়লোকদের দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে আরো ধন সম্পত্তি বৃদ্ধির চেষ্টা করত -সেই ইচ্ছাটাই সমাজ থেকে চলে যায়। খ্রীষ্ঠান ধর্মের উত্থানের সাথে সাথে -বিশেষত যবে থেকে সম্রাট কনস্টানটাইন খ্রীষ্ঠধর্মকে রোমান রাষ্ট্রধর্ম বানালেন -তবে থেকে ইউরোপের পতন হয় দ্রুত। বিশেষত যেটাকে আমরা ক্ল্যাসিক্যাল যুগ বলি-তার পতন শুরু হয়।

কারন ঈর্ষা একটি পজিটিভ চালিকা শক্তি। গোটা সমাজের জন্যই। প্রতিটা গরীব, ধন সম্পদ উপার্জনের জন্য পরিশ্রম করে বলেই সমাজে নতুন ব্যবসা, নতুন উৎপাদিকা শক্তি বজায় থাকে।
ধনসম্পত্তি এবং বড়লোক হওয়া হারাম ঘোষনা করে গোটা ইউরোপের চালিকা শক্তি একদা ধ্বংস করেছিল খ্রীষ্ঠান ধর্ম। ইউরোপ আবার গোটা বিশ্বের নেতা হবে সেই পঞ্চদশ শতকে যখন ইউরোপীয় বণিকরা খ্রীষ্টধর্মকে আবার গীর্জার গারাজে ঢুকিয়ে ঠূঁটো জগন্নাথ বানাবে।

(২)
পশ্চিম বাংলার বামপন্থা যেভাবে বাংলাকে ধ্বংস করেছে, তার সাথে নিৎসের ঈর্ষার তত্ত্বের সম্পর্ক কি?
কারন গোটা পশ্চিম বঙ্গের সমাজ যেভাবে ধনী এবং ধনকে ঘৃনা করতে শিখেছে, তাতে এক অদ্ভুত বাঙালী ধর্মের দেখা পাই পশ্চিম বঙ্গে।

এখানকার অধিকাংশ ছেলেপুলের কোন উচ্চাশাই নেই। কোন রকমে একটা ভদ্রস্থ মাইনের চাকর। যদি চা সিঙাড়া খেয়ে মোহনবাঙান ইস্টবেঙ্গল, ইন্ডিয়া-পাকিস্তান- আম্বানি আদানির গুষ্টির তুষ্টি করে দিন কাটানো যায়, এরা তাতেই সন্তষ্ট। কারন অধুনা বাঙালী ধর্মে শেখানো হয়েছে ধন সম্পত্তি বাজে জিনিস না হলেও ধনী মানেই চালচোর কিম্বা গরুচোর।


সিপিএমের টুম্পাগান দেখুন! যেন চাকরি করাই জীবনের পরম উদ্দেশ্য। মুশকিল হচ্ছে দুশো বছর আগে চাকরির অস্তিত্বই ছিল না। প্রায় সবাই ছিল স্বাধীনজীবি-সে কৃষকই হোক, আর শিক্ষকই হোক।

যেকোন সমাজের চালিকা শক্তি হচ্ছে দরিদ্র-মধ্যবিত্ত শ্রেনী। এদের মধ্যে যে উচ্চাশা জাগে, তার উৎস কিন্ত সেই ঈর্ষা- এই গরীব শ্রেনীটির ধন্যাট্য জীবনজাপনের জন্য উচ্চাশা থেকেই বিরাট অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি তৈরী হয় ( আবার চিটফান্ডের মতন ফ্রড ও হবে। কিন্ত ফ্রড বেশী দিন টেকে না। ফিল্টার হয়ে সৎ ব্যপারীটাই একমাত্র টিকে থাকে)।

উদাহরন দেওয়া যেতে পারে। গুজরাতে গেলে দেখবেন, যে মাসে ২০,০০০ টাকার কেরানী-তার উদ্দেশ্য চল্লিশ বছর বয়সের মধ্যে পুঁজি জমিয়ে নিজের ব্যবসা শুরু করা। বাঙালীদের মধ্যে এই ড্রাইভটাই নেই-কারন ধনের ঈর্ষা ব্যপারটা লুপ্ত।

কিন্ত এটা এলো কোত্থেকে? বাংলা মুঘল যুগে একদা সব থেকে সমৃদ্ধশালী রাজ্য ছিল। বাংলার শিল্প এবং বনিকেরা পৃথিবীতে বিখ্যাত ছিল। অথচ, ভারতচন্দ্রের কাব্যে দেখতে পাবেন , বাঙলার পিতামাতার একমাত্র স্বপ্ন-আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।

আমার ধারনা বাংলা যত স্বাধীনতা হারিয়েছে- দিল্লীর মুঘল শাসক, ইংরেজরা যত বাংলাকে শোষন করেছে, বাংলার মানুষ তত বেশী হত দরিদ্র অবস্থার মধ্যে দিন কাটিয়েছে। যেহেতু বাংলা আস্তে আস্তে সামরিক শৌর্য্য বীর্য্যও হারিয়েছে, সেহেতু এই হতাশ দারিদ্রর মানসিক শান্তনা হিসাবে বাংলায় নানান ভাববাদি ধর্ম শিকড় নেয়। যারা ভাবতে শেখায় দারিদ্রে আর কি ক্ষতি আছে-যাতে মানুষ অন্তত প্রচন্ড দরিদ্র অবস্থাকে স্বাভাবিক এবং বড়লোকদের বঞ্চনা বলে মেনে নেয়। দারিদ্রের জয়গান গায়। জাস্ট লাইক ক্রিষ্টিয়ানিটি। কমিনিউজম খ্রিষ্টানিটি ইসলামের আধুনিক সংস্করন।

ফলে এতে আশ্চর্য্য হবার কিছু নেই যে ভারতে বাংলায় প্রথম কমিনিউস্ট আন্দোলন শক্ত মাটি পায়। বাঙালীরা প্রথমে ইংরেজি শিক্ষিত ছিল-সেটাই শুধু কারন না। বাংলার মাটিতে শ্রীচৈতন্যের ভাববাদি সাম্য বহুদিন আগে থেকেই ছিল। এই ধরনের ভাববাদ বাঙালীর ঈর্ষাকে ধ্বংস করেছে-ফলে বাঙালী অল্পেই সন্তুষ্ট। বাঙালী গরীবদের মধ্যে বড়লোক হবার জন্য আগ্রাসী যুবক কম। আনফরচুনেটলি ওটাই সমাজের উন্নয়নের আসল চালিকা শক্তি। যেটা পৃথিবীর সর্বত্র ধনতন্ত্রে প্রমানিত।

আরেকটা ছোট্ট উদাহরন দিই। বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর নাম অনেকেই শুনেছেন। কিন্ত কজন শুনেছেন ব্যারিস্টার রাসবিহারী ঘোষের নাম? রাসবিহারী ঘোষের ১৫ লাখ টাকা দান থেকেই শুরু হয় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। অথবা তারকনাথ পালিতের নাম কজন জানেন? যার দানের টাকায় সায়েন্স কলেজ তৈরী হয়। এদের অপরাধ এরা ধনী ব্যক্তি ছিলেন-তাই দানধ্যান করতেই পারেন। বাঙালী এদের মনে রাখে নি। যারা যাদবপুর বা কোলকাতার সায়েন্স কলেজের ছাত্র-তারা এই দুজনের নাম জানে কি না সন্দেহ। এর একটাই কারন। বাঙালী সমাজে এবং সংস্কৃতিতে ধনের গুরুত্ব এবং অবদান নিয়ে কোন আলোচনাই নেই। শুধু শুধু ত্যাগ এবং দারিদ্রকে মহিমান্বিত করা হয়। ফলে বাঙালী যুবক যুবতীদের মধ্যে ধনী হবার জন্য কঠিন পরিশ্রমী ছেলে মেয়ে পাওয়া শক্ত। যেটা ছাড়া ধনতান্ত্রিক কাঠামোতে একটা সমাজ এগোতে পারে না।




No comments: