Monday, December 23, 2019

দ্বিজাতি তত্ত্ব এবং দেশভাগ - ৩ঃ ভারতীয় মুসলমানদের ভূমিকা

মহম্মদ আলি জিন্না এবং ড আল্লামা ইকবাল পাকিস্তান সৃষ্টির কৃষ্ণ বলরাম ।   কিন্ত বাকী মুসলমান নেতাদের ভূমিকা কি ছিল ?   সামগ্রিক ভাবে দেশভাগ এবং পাকিস্তান সৃষ্টিতে অবিভক্ত ভারতে মুসলমান জনমানসের ভূমিকার বিশ্লেষন প্রয়োজন।

 দেশভাগের আগে মুসলীম লীগ মুসলমানদের বৃহত্তম পার্টি ছিল না। ইনফ্যাক্ট ইউনিয়নিস্ট পার্টি যা ছিল পাঞ্জাবে মুসলমান জমিদারদের পার্টি -তাদের মুসলমান সাপোর্টবেস ছিল আরো অনেক বেশী। বাংলায় ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির সাপোর্ট বেস ও লীগের থেকে অনেক বেশী মজবুত ছিল। কিন্ত আমরা দেখব কোন এক "অজ্ঞাত" কারনে  ১৯৩৭ সাল থেকে আস্তে আস্তে অনেক আঞ্চলিক মুসলিম পার্টিকেই লীগ আত্মসাৎ করা শুর করে।  ইঁদুর থেকে বাঘ হয়ে উঠবে লীগ।  এইসব আঞ্চলিক মুসলিম পার্টিগুলি, যাদের মধ্যে একমাত্র বাংলার কৃষক প্রজা পার্টি ছাড়া আর কেউই দেশভাগের পক্ষে ছিল না, তারা কেন জিন্নার নেতৃত্ব মানলেন ? নাকি কোন এক বৈদেশিক শক্তির অদৃশ্য ছায়াতে যারা এতদিন জিন্নার বিরোধিতা করেছেন, তারা সাপোর্টে এলেন?  এর পেছনের খেলাটা কি ? 

  এটি একটি রোমাঞ্চকর আন্তর্জাতিক ক্রাইম থ্রিলার! এবং যথারীতি ইতিহাসের এই পর্বটা হচ্ছে আমাদের উপমহাদেশে বাস্টার্ড চাইল্ড। কারন ভারতে কংগ্রেস লিখিত ইতিহাস দেখাতে চায়, কংগ্রেসে আবুল কালাম আজাদের মতন মুসলমান নেতা দেশভাগের বিরোধিতা করেছে। এরা বালুচিস্থান, নর্থ ইস্টার্ন প্রভিন্স, পাঞ্জাব, সিন্ধ বলতে গেলে বর্তমান পাকিস্তানের প্রতি্টা রাজ্যের আঞ্চলিক মুসলমান দলগুলি যে দ্বিজাতি তত্ত্ব এবং দেশভাগের বিরোধিতা করেছে  সেটা ভুলিয়ে দিয়ে, কংগ্রেসের ভূমিকাকে "বড়" করে দেখাতে চায়।  কারন এই ইতিহাস যদি ঘাঁটা যায়-এক আশ্চর্য্য তথ্য উঠে আসে। এই সব আঞ্চলিক দলগুলি  ( একমাত্র পাঠান নেতা বাচা খান বাদ দিলে)  কংগ্রেস এবং লীগ -উভয়কেই তাদের জাতিসত্ত্বার রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য খতরনাক মনে করত।  যদিও এদের অনেকেই গান্ধীতে বিশ্বাস রাখত। 

আর পাকিস্তান ইতিহাসের এই পর্ব একদম ভুলে যেতে চাইছে বহু দিন থেকেই। কারন নর্থ ইস্টার্ন প্রভিন্সের খুদাই খিদমতগার পাকিস্তান সৃষ্টি মেনে নেয় নি। পাকিস্তান সৃষ্টির পরে তারা নিজেদের স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু করে।  এরা পশচুনিন্থান দাবী করে সেই ১৯৪৭ সাল থেকেই । আবদুল গফফর খান যেদিন শুনলেন কংগ্রেস জিন্নার দাবী মেনে নিয়েছে, উনি পাথরের মতন নিথর। শুধু মহত্মা গান্ধীর উদ্দেশে  বল্লেন আপনি আমাদের, পাঠানদের নেকরের মুখে ( লীগ এবং জিন্না) ফেলে দিলেন।  

 খান ভুল বলেন নি। ১৯৪৮ সালের ১২ই আগস্ট পাকিস্তানের মিলিটারি পুলিশ  খুদাই খিদমতগারের অহিংস জমায়েতে গুলি চালাল। ৬০০ মৃত। ১২০০ আহত।  কাবুল নদী ছশো পাঠানের রক্তে লাল।  জালিওনাবাগ হত্যাকান্ডের থেকেও আরো ভয়ংকর ছিল- এই বাবরা হত্যাকান্ড  ।  

 পাকিস্তানের ইতিহাস এখনো এই আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদি আন্দোলন থেকে মুক্ত না। সিন্ধ, বালুচিস্তান, নর্থ ইস্টার্ন প্রভিন্স -সর্বত্রই আঞ্চলিক শক্তিগুলি পাকিস্তান থেকে নিজেদের স্বাধীনতার জন্য লড়ছে। সুতরাং পাকিস্তানের ইতিহাস এই পর্ব সম্পূর্ন ভাবেই মুছে দিয়েছে। 


 কিন্তু খুদাই খিদমতগারের ইতিহাসেই লুকিয়ে আছে সেই সূত্র যা আমি খুঁজছিলাম-কিভাবে পাকিস্তানের এক বৃহৎ জনগোষ্ঠি- যারা সম্পূর্ন ভাবেই লীগ এবং জিন্না বিরোধি ছিল- তাদের মাথার ওপর ছলে বলে কৌশলে পাকিস্তান এবং জিন্নাকে চাপানো হল!   জিন্নার ক্যারিশমা? নাকি জিন্নাকে দিয়ে চার্চিল এই কাজ করালেন কারন ঠান্ডাযুদ্ধের দিনে আমেরিকান এক্সিসের জন্য পাকিস্তান সৃষ্টি দরকার ছিল? 

 ইতিহাস খুব পরিস্কার। পাকিস্তানের অধিকাংশ জনগনই চাই নি পাকিস্তান-অন্তত ১৯৪২-৪৩ সাল পর্যন্ত। পাঠানরা ১৯৪৭ সালেও ঘোর পাকিস্তান বিরোধি।  ১৯৩৭ সালে বর্তমান পাকিস্তানে লীগের ভোট ছিল ৩% এর কম! তাহলে কি করে লীগ এবং জিন্নাকে পাকিস্তানের মাথায় চাপাতে সমর্থ হল বৃটিশরা? 

   (১)
 আল ইন্ডিয়া আজাদ মুসলিম কনফারেন্সের নাম আপনারা কজন জানেন?  ১৯২৯ সালে সিন্ধ প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী আল্লা বক্স সুমরো,  এই আম্ব্রেলা সংগঠন বানান। সেই সব মুসলিম সংগঠন নিয়ে যারা  ঐক্যবদ্ধ ভারত চাইছিল। যারা ছিল লীগের দ্বিজাতি তত্ত্বের ঘোর বিরোধি।  দিল্লীতে ১৯৩০ সালের ২৭-৩০শে জুলাই, ১৪০০ জন প্রতিনিধি এই কনফারেন্সে যোগ দেন। এর মধ্যে প্রায় সকল ধরনের মুসলিম সংগঠনই ছিল
    
   
  • সিন্ধ ইত্তেহাদ পার্টি 
  • জামাতই-উলেমাই-হিন্দ
  • মজলিসই আহার উল ইসলাম 
  • আল ইন্ডিয়া মোমিন কনফারেন্স 
  • আল ইন্ডিয়া শিয়া পলিটিক্যাল কনফারেন্স 
  • খুদাই খিদমতগার 
  • কৃষক প্রজা পার্টি (  যা ১৯৩৭ সালে লীগএর সাথে হাত মেলাবে )
  • আঞ্জুমান ই ওয়াতন বালুচিস্তান 
  • আল ইন্ডিয়া মুসলিম মজলিস 
  • জামাত আলিই হাদিস 

  আল্লা বকস সুমরো কড়া ভাষায় লীগের সমালোচনা করে বল্লেন 

 " Whatever our faiths we must live together in our country in an atmosphere of perfect amity and our relations should be the relations of the several brothers of a joint family, various members of which are free to profess their faith as they like without any let or hindrance and of whom enjoy equal benefits of their joint property

 কানাডিয়ান ঐতিহাসিক উলফ্রেড ক্যাটনহিল্ বলছেন এই সংগঠনের পেছনে মুসলমানদের সাপোর্ট ছিল লীগের থেকে অনেক বেশী। বৃটিশ প্রেস ও এই মত সমর্থন করে।  এমন কি খোদ ১৯৪৬ সালেও বোম্বে ক্রনিকল লিখছে আজাদ মুসলিম কনফারেন্সের পেছনে মুসলিম  সমর্থন  লীগের থেকে অনেক বেশী। 

 কিন্ত কি আশ্চর্য্য ! বৃটিশ সরকার এদেরকে মুসলমানদের প্রতিনিধি বলে মনেই করল না!  মুসলীমলীগ, যাদের পেছনে মুসলমানদের সমর্থন এদের থেকে অনেক কম , ১৯৪২ থেকে বৃটিশ সরকার তাদেরকেই তোল্লা দিয়ে গেল ভারতী মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধি হিসাবে ! বৃটিশ ইন্টেলিজেন্স এবং এডমিনিস্ট্রেশন সর্বত  ভাবে সাহায্য করেছে লীগকে যাতে প্রতিটা  পাকিস্তান বিরোধি মুসলিম পার্টি দুর্বল হয় এবং তাদের সমর্থকরা লীগের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হয়। 

  যেখানে ভারতীয় মুসলমানরা দেশ ভাগ চাইছে না, সেখানে লীগকে সামনে রেখে বৃটিশ ইন্টালিজেন্স কিভাবে দেশভাগের বাস্তবায়ন ঘটালো- কেন ঘটালো সেই ইতিহাস আমি পরের খন্ডে লিখছি। কারন সেটাই আসল ইতিহাস দেশভাগের।  কংগ্রেসের নেতৃত্বের দুর্বলতা  এবং ক্ষমতার প্রতি লোভ এই ওয়েল ডিজাইন্ড ইভেন্টের  ক্যাটালিস্ট। 

 (২)  এবার আমাদের সেই ইতিহাস বুঝতে হবে যে কেন  ১৯২০ সাল নাগাদ  লীগ এবং কংগ্রেসের বাইরে, ভারতের মুসলমানরা আলাদা রাজনৈতিক প্ল্যটফর্ম খুঁজছিল।  বাংলার কৃষক প্রজা পার্টি, পাঞ্জাবের ইউনিয়নিস্ট পার্টি, সিন্ধের ইত্তেহাদ, উত্তর পশ্চিমের পাঠানদের খুদাই খিদমতগার , বালুচিস্তানের আনজুমানই ওয়াতন বালুচিস্তান কেন কংগ্রেস এবং লীগের বাইরে গিয়ে আলাদা রাজনৈতিক পার্টির তাগিদ অনুভব করে। যদিও ইতিহাসে আমরা দেখব এদের অনেকেই কংগ্রেস বা কখনো লীগের সাথে হাত মিলিয়েছে। 

  এর উত্তর একটাই। ইসলাম বা মুসলমান আসলেই ত কোন জাতি হতে পারে না। এই যে  দ্বিজাতিতত্ত্বের  ধাপ্পাবাজির ওপর লীগ দাঁড়িয়েছিল, সেটা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ না, ১৯২০ -১৯৩০ সালে এতগুলো প্রদেশিক মুসলিম পার্টির উত্থানেই পরিস্কার। এদের সবগুলিই প্রায় প্রাদেশিক জাতিয়তাবাদি সংগঠন। এরা দেখল লীগ এবং কংগ্রেসের উভয়ের এজেন্ডাতেই ভারতের প্রতিটা প্রদেশের যে আলাদা ডাইভার্সিটি-প্রতিটি জাতিগোষ্ঠির যে আলাদা চাহিদা , তা অনুপস্থিত। লীগ এবং কংগ্রেস -এরা উভয়েই ভীষন ভাবে  দিল্লীর কেন্দ্রিকতায় বিশ্বাসী-প্রদেশিক নেতাদের পাত্তা দেয় না।  স্বাধীনতা উত্তর ভারতে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ ছিল, স্বাধীনতার পূর্বেও সেই একই প্রদেশিকতা বনাম কেন্দ্রিকতার লড়াই দৃশ্যমান। যবে থেকে বৃটিশ তত্ত্ববধানে ভারতে নির্বাচন হচ্ছে ( ১৯২০)। 

 প্রথমে সব থেকে গুরত্বপূর্ন দুটো প্রদেশিক মুসলিম পার্টির ইতিহাসে আসি। বাংলার কৃষক প্রজা পার্টি এবং পাঞ্জাবের ইউনিয়নিস্ট পার্টি।  যদিও এরা নিজেদের কখনোই মুসলিম পার্টি হিসাবে দাবী করে নি, এদের নেতাদের সবাই ছিল মুসলমান। ইউনিয়নিস্ট পার্টিতে অবশ্য কিছু হিন্দু এবং শিখ নেতা ছিলেন। 

   কৃষক প্রজা পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ফজলুল হক।  ১৯২৯।  প্রেক্ষাপট বাংলায় ভাগচাষিদের স্বার্থরক্ষা। যার জন্য পার্মানেন্ট সেটলমেন্ট এবং ১৮৮৮ সালের বেঙ্গল টেনান্সি এক্টের পরিবর্তন দরকার হয়ে ওঠে। 

 বাংলার জমিদারদের অধিকাংশই হিন্দু। কলকাতা নিবাসি। তারা পূর্ববাংলার খাজনায় বাবু। জমিদারি দেখাশোনা করে নায়েবেরা, যারা হিন্দু।  খাজনা তোলে জোদ্দাররা যারা হিন্দু। এদিকে ভাগচাষিদের সবাই প্রায় মুসলমান। লেবার ক্লাসের ও প্রায় সবাই মুসলমান। অন্যদিকে কিছু জমিদার তখনো মুসলমান ছিল, যারা মোঘল আমল থেকেই খানদানি জমিদার।  

 কংগ্রেস তখন সম্পূর্ন ভাবেই হিন্দু জমিদার, জোদ্দারদের প্রতিনিধি । কারন তাদের টাকাতেই পার্টি চলে। এদিকে কংগ্রেসের স্যোশালিস্ট অংশ প্রগ্রেসিভ হওয়ার জন্য ভূমিসংস্কারের কথা বলছে। কিন্ত তারা পার্টির মধ্যে টাকার জোরে পাত্তা পাচ্ছে না। 

অন্যদিকে লীগ হচ্ছে উর্দুভাষী এই ্মোঘল ঐতিহ্যের মুসলমান এলিটদের প্রতিনিধি।

  বাংলার ভাগচাষীদের স্বার্থ দেখার কেউ নেই।  ভারতীয় কমিনিউস্ট পার্টি তদ্দিনে তৈরী হয়েছে । কিন্ত তারা সেকালেও সোভিয়েত ইউনিয়ানের মুখাপেক্ষী । 

রাজনীতিতে ভ্যাকুয়াম বেশীদিন থাকে না। ফলে বাংলার  ভাগচাষীদের  প্রতিনিধি কৃষক প্রজা পার্টি বাংলায় লীগ এবং কংগ্রেসের প্রতিদ্বন্দী হয়ে ওঠে।  ১৯৩৫ সালে গর্ভনমেন্ট ইন্ডিয়া এক্ট পাশ হয়। এক্টের বাস্তবায়নে  ১৯৩৭ সালে বাংলায় প্রথম প্রদেশিক নির্বাচন। কৃষক প্রজা পার্টি বা কেপিপির ঝুলিতে ৩৬। লীগ ৩৭। কংগ্রেস ৫৪! 

 কংগ্রেস বৃটিশ অপশাসনের প্রতিবাদে বাংলায় সরকার গঠনে গেল না । ফলে কৃষক প্রজাপার্টি-এবং লীগ হাত মেলালো।  এটি ছিল কংগ্রেসের সব থেকে বড় ভুল যা বাঙালী মুসলমানদের লীগের দিকে ঠেকে দেয়।


 কিন্ত কেন কংগ্রেস ফজলুক হকের সমর্থনে বা তার সমর্থনে সরকার না গড়ে, মাঝখানে বয়কট করে? বৃটিশ বিরোধিতা না সেটা ছিল নেহাতই একটা অজুহাত? কারন অন্য ৬টা প্রদেশেত কংগ্রেস সরকার গড়েছিল! 

 এর মূল কারন ফজলুলহকের মূল দাবী- ভূমিসংস্কার।  ভূমি সংস্কারের দিকে হাঁটলে কংগ্রেস হিন্দু জমিদারদের সমর্থন হারাত।   মনে রাখতে হবে কলকাতার হিন্দু জমিদারদের চাঁদা ছিল কংগ্রেসের মূল চালিকা শক্তি।  আবার সরকারে গিয়ে ভূমি সংস্কারের বিরোধিতা করলে কংগ্রেসের "প্রগ্রেসিভ" ভাবমূর্তি ধাক্কা খেত। ফলে কায়দা করে কংগ্রেস এই উভয়সংকট নিরসনে সরকার গঠন না করার সিদ্ধান্ত নেয়। অজুহাত খাড়া করে বৃটিশ বিরোধিতা। 

 এর ফল হয় মারাত্মক। ফজলুক হক লীগের সমর্থনে সরকার গঠন করলেন। ফলে বাংলার রাজনৈতিক ক্ষমতা সম্পূর্ন ভাবেই মুসলমানদের  ( অবিভক্ত বাংলায় মুসলমানরা ছিল ৫৪% )  হাতে চলে যায়।  কেপিপি এসেই ভূমিসংস্কারের দিকে মন দেয় এবং ১৯৩৮ সালের বেঙ্গল টেনান্সি এক্টের এমেন্ডমেন্ট চালু করার চেষ্টা করে। ফজলুল হক  যথারীতি লীগের জমিদারদের সমর্থন পায় নি এবং লীগ কেপিপির অধিকাংশ মেম্বারকেই ভাগিয়ে নেয়।   প্রধানমন্ত্রী হক চাকরিতেও মুসলমানদের সমানুপাতিক হারে (৫৪%) সংরক্ষন চালু করলেন। কংগ্রেস এবারও নীরব। শুধু শ্যামাপ্রসাদ প্রতিবাদ করলেন।  হিন্দুরা দেখল, কংগ্রেস হিন্দুদের স্বার্থ রক্ষাতেও আগ্রহী না। ফলে বাংলায় হিন্দু মহাসভাকে নিয়ে আসলেন শ্যামা প্রসাদ। 

 কংগ্রেসের ইতিহাসের সব থেকে বড় সমস্যা এটাই যে ক্ষমতা দখল করা ছাড়া ঐতিহাসিক ভাবে এই পার্টিটার কোন আদর্শ কোনকালেই ছিল না।  ফলে তারা না মুসলমান ভাগচাষিদের সমর্থনে আসতে পারল- না হিন্দুদের সমর্থনে কিছু করতে পারল। মুসলীম লীগ-কৃষক প্রজাপার্টির গোষ্ঠিবন্ধনে বাংলায় দ্বিজাতি তত্ত্ব এবং দেশভাগের ভিত পাকা হয়।  ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে যেখানে পাকিস্তানের দাবী প্রথম পাঠ হয় ( যদিও অনেকেই  তা মানতে চান না )  ফজলুল হক তা সমর্থন করলেন। 

 ইতিহাসে আইরনী। ফজলুল হক ১৯৩০ সালে আল ইন্ডিয়া আজাদ মুসলিম কনফারেন্স ছিলেন। অর্থাৎ তখন তিনি লীগের দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরোধিই ছিলেন। লীগের দিকে ঝুঁকে পড়লেন শ্রেফ কংগ্রেসের ভুলে ।    হিন্দু জমিদারদের চাপে   ফজলুল হকের সাথে কংগ্রেস সরকার গঠন করল না।  বেঙ্গল টেনান্সি এক্ট সমর্থন করল না।  বাংলার মুসলমানরা এমনিতেই বঙ্গভঙ্গ বিরোধি আন্দোলনে হিন্দুদের ভূমিকায় ক্রদ্ধ -কংগ্রেসকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এই অবস্থায় বাংলায় দুই মেজর মুসলিম পার্টিকে কাছাকাছি আসতে দিলে, তার ভবিষ্যত ফল কি হতে পারে, একটা বাচ্চা ছেলেও বুঝবে।  কংগ্রেসের নেতৃত্ব বোঝে নি? বুঝেছে। কিন্ত কংগ্রেস কোনদিনই জনগনের পার্টি ছিল না।  হিন্দু জমিদার এবং ব্যবসায়ীদের পয়সায় চলা পার্টিটী আরো অনেক জায়গায়তেই মুসলিম আঞ্চলিক পার্টিগুলি-যারা ছিল লীগ বিরোধি-তাদের ও বিরোধিতা করতে গিয়ে এদেরকে উলটে লীগের দিকেই ঠেলে দিয়েছে। 

(৩) 
এবার আসি পাঞ্জাবের ইউনিয়নিস্ট পার্টির ইতিহাসে। যারা জন্মলগ্নে  কট্টর লীগ বিরোধি।  । দ্বিজাতি তত্ত্ব সমর্থন করত। কিন্ত পাকিস্তান সমর্থন করে নি।  ঐক্যবদ্ধ ভারত এরাও চেয়েছিল।   এর প্রতিষ্ঠাতা স্যার সিকান্দার হায়াত খান। উনি পাঞ্চাবের তখন অন্যতম বৃহত্তম শিল্পপতি।    পাঞ্জাবের প্রথম প্রধানমন্ত্রী এবং লাহোর প্রস্তাবের একজন সমর্থক। ১৯৩৪ সাল থেকে ৪৬, পাঞ্চাবের সব নির্বাচনে এরা কংগ্রেস এবং লীগকে হারিয়েছে।   মনে রাখতে হবে, লাহোরে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তানের দাবীতে যে দুজনের সমর্থন সব থেকে গুরুত্বপূর্ন ছিল- তারা ছিলেন এই স্যার সিকান্দার হায়াত খান এবং ফজলুল হক।   ভারতের দুই সমৃদ্ধতম প্রদেশ পাঞ্জাব এবং বাংলার প্রধানমন্ত্রী।  অদ্ভুত ভাবে দুজনের রাজনৈতিক জীবনের শুরু লীগের বিরোধিতা দিয়েই।  কিন্ত ১৯৩৭ সালে দুজনেই আবার জিন্নার সাথে হাত মেলালেন। কেন? 

 সোজা কথায় কংগ্রেসের ক্ষমতার লোভ। কংগ্রেসের নিজস্ব মুসলমান নেতা এবং ভোট দুই ছিল। কিন্ত ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে এটা পরিস্কার হয়, আঞ্চলিক মুসলমান দল গুলির দিকে মুসলমান ভোট ঝুঁকে পড়েছে। লীগ এবং এইসব আঞ্চলিক দলগুলো থেকে মুসলমান ভোট টানবার জন্য কংগ্রেস দুটো পন্থা নেয়। 


 এক, কংগ্রেসে মুসলমান নেতারা মুসলমানদের সাথে গ্রাস্রুট সংযোগ শুরু করে। উদ্দেশ্য মুসলমান ভোটকে কংগ্রেসে ফেরানো।  দুই এই কাজে তারা ভারতের মৌলবী সহ বাকি সব গুরুত্বপূর্ন ইসলামিক থিওলজিস্ট মানে সব মৌলনা, মৌলভীদের সংগঠনগুলোকে পাশে পায়।  মোমিন কনফারেন্স, জামাতই উলেমা হিন্দ , মজলিস- প্রায় সব শিয়া এবং সুন্নী মৌলনাদের সংগঠন কংগ্রেসের পাশে দাঁড়ায়।  এবং এরা মুসলমানদেরকে বলে কংগ্রেস সাপোর্ট করতে।  জিন্নার দ্বিজাতি তত্ত্ব এবং পাকিস্তানের দাবীকে না সাপোর্ট করতে।  এটাই জিন্না এবং আঞ্চলিক পার্টির নেতা যেমন ফজলুল হক এবং সিকান্দার হায়াতকে লীগের দিকে যেতে বাধ্য করে। 

 কংগ্রেসের চালে ভুল কোথায় ? 

  প্রথমে দেখতে হবে মুসলমান মৌলনা মৌল্ভীরা লীগকে সমর্থন না করে, আঞ্চলিক মুসলমান পার্টিগুলিকে সমর্থন না করে কেন কংগ্রেসকে সমর্থন করতে গেল ?

   এর কারন ও সেই মৌলনাদের  ক্ষমতার লোভ। ভারতে এইসব মৌলনা মৌলভীর ক্ষমতার কেন্দ্র হচ্ছে উত্তরপ্রদেশ। এদিকে মুসলমান পাল্লা ভারী বাংলা, পাঞ্জাব, সিন্ধে।  মুসলিম লীগ এলিট ব্যারিস্টার জমিদার মুস্লিমদের সংগঠন। সেখানে মৌলনাদের কেউ পাত্তা দিত না। ইউনিয়নিস্ট পার্টিও সেকুলার- সেখানে তারা মুসলমান ব্যবসায়ী, জমিদারদের স্বার্থ দেখতে ব্যস্ত। ইউনিয়ানিস্ট পার্টিতেও  মৌলনাদের  কেউ পাত্তা দিত না।


  একমাত্র গান্ধী  এবং কংগ্রেস এইসব মৌলনাদের পাত্তা দিতেন গরীব মুসলমানদের কাছে ধর্মপ্রচারকদের মাধ্যমে পৌছানোর জন্য। শুধু তাই না। ভারত স্বাধীন হলে যে মুসলমান পারসোনাল আইন চালু থাকবে, সেই প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হল তাদের।  যে প্রতিশ্রুতির কারনে ভারতে হিন্দু পারসোনাল ল বিলুপ্ত হয়, কিন্ত মুসলীম পারসোনাল ল থেকে গেছে। মুসলমান ধর্মগুরুদের তুষ্ট করা-  লীগকে কাউন্টার করার এটাই উপায় ভাবলেন কংগ্রেসের নেতারা। 

     বাংলা বা পাঞ্চাবে এই আঞ্চলিক পার্টিগুলির নেতারা স্থানীয় মুসলমানদের ওপর অনেক বেশী প্রভাব রাখত ।  পাঞ্জাবের একজন ভূমিপূত্র মুসলমান  পাঞ্জাবী ভাষায় তার মুসলমান জমিদারের কথা শুনবে, না হাজার কিলোমিটার দূরে দেওবান্দি মৌলনাদের উর্দু ফরমান শুনবে? যে উর্দু তারা নিজেরাও জানে না!

 কংগ্রেসের উচিত ছিল আঞ্চলিক নেতা সিকান্দার হায়াত খান বা ফজলুল হককে প্রতিদ্বন্দি না ভেবে, জমিদারদের স্বার্থ বাদ দিয়ে সরসরি এদের সাথে কোয়ালিশন তৈরী করা। যাতে জিন্না এদের  সাথে কোয়ালিশনে না যা যেতে পারে। বাংলা এবং পাঞ্চাব জিন্নার হাতে না গেলে, কোনদিনই পাকিস্তানের দাবি তোলার সাহস জিন্নার হত না।  এই দুটি প্রদেশ জিন্নাকে কংগ্রেস নেতৃত্ব উপহার দিল ফজলুল হক এবং সিকান্দার হায়াতের সাথে প্রতিদ্বন্দিতা করতে গিয়ে এবং তাদের অর্থের উৎস জমিদার শ্রেনীকে খুশী রাখার চেষ্টায়। 

(৪)
এবার দেখা যাক,  বাচা খান বা আবদুল গফফর খানের খুদাই খিদমতগারের পাঠানদের সংগ্রামের ইতিহাস । আমরা বাঙালীরা মনে করি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের থেকে আর কারুর বেশী অবদান নেই। সংগ্রামী রক্তের অনেকটাই বাঙালীরা হিন্দুদের। বাঙালী মুসলমানদের মধ্যে অনেকে স্বাধীনতা সংগ্রামী পায় না বলে, মুসলমানরা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহন করে নি বলে ধরে নেয়।  এই ভুল ভেঙে যাবে যদি কেউ খুদাই খিতমতগারের ইতিহাস চর্চা করে।  পাঠানদের এই পার্টি, বৃটিশদের বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলন সত্ত্বেও  যে রক্ত দিয়েছে, তা গোটা ভারতের ইতিহাসেই তুলনাহীন।  খুদাই খিদমতগার অবশ্য কংগ্রেসের প্রবল সমর্থক এবং জিন্নার ভয়ানক বিরোধি ছিল। 

১৯৩৯ সাল পর্যন্ত বৃটিশি পুলিশি দমন, জেল, গুলি কোন কিছুই  বাচা খানের সমর্থকদের দমাতে পারে নি। ১৯৩৭ এবং ৪৬ দুই নির্বাচনেই কংগ্রেসের সাথে জোটে খুদাই খিমতগার জিতেছে। বাচা খানের দাদা ড খান সাহিব নর্থ ওয়েস্টার্ন প্রভিন্সের প্রধান মন্ত্রী ছিলেন। 


 কিন্ত ১৯৩৯ সালের পর যখন মুসলীম লীগ এবং বৃটিশ হাত মেলালো, লীগের অনুরোধে বাচা খানের সমর্থন ভাঙার জন্য বৃটিশরা ধর্মীয় সুড়সুরি দেওয়া শুরু করে। লর্ড কানিঙ্ঘামের ১৯৪২ সালের ২৩শে সেপটেম্বর একটা খসড়া পলিসি পাওয়া যাচ্ছে। তাতে দেখা যাচ্ছে লীগের ভলিউন্টিয়াদের মাধ্যমে বৃটিশরা স্থানীয় মৌলনা এবং খান (জমিদার) এর মধ্যে টাকা ছড়াচ্ছেন, যাতে তারা পাঠানদেরকে  লীগের সমর্থনে আনতে পারে।  এই স্থানীয় মৌলবাদিদের দিয়ে , লীগের সহায়তায় তারা বাচা খানের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায় 
     
    - বাচা খান গান্ধী তথা হিন্দুদের চর
   -   এরা জমিদারি প্রথা তুলে দেবে
   - মেয়েদের জন্য শিক্ষা চালু করবে/পর্দা প্রথা তুলে দেবে। বলা বাহুল্য এই খুদাই খিদমতগার নারী শিক্ষা এবং নারী প্রগতির পক্ষে ছিল। অনেক মেয়েরা পর্দা ছেরে বৃটিশ বিরোধি আন্দোলনে রাস্তায় নেমেছিল। 

 ইনফ্যাক্ট সিন্ধ, বালুচিস্থানেও বৃটিশরা টাকা, পদ সব কিছুই দিয়েছে স্থানীয় মুসলমান নেতাদের লীগের কব্জায় আনতে। 
 
 অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে বৃটিশরাজের অদম্য ইচ্ছাছিল পাকিস্তান তৈরী হৌক । জিন্না ছিল তাদের দাবার চালের মন্ত্রী।   পাকিস্তান বিরোধি সব মুসলমান রাজনৈতিক নেতা এবং দলগুলিকে ছলে বলে কৌশলে  শেষ করে দেওয়ার জন্য বৃটিশরাজ লীগের জন্য নিরলস কাজ করে গেছে । এর আরেকটা উদাহরন যেভাবে বৃটিশরা পাঞ্চাবের খাক্সার  মুভমেন্ট ধ্বংস করে। 

 ১৯৩১ সালে আল্লামা মাশরিকির নেতৃত্বে লাহোরে তৈরী হয় ্মুসলমান যুবকদের সংগঠন খাক্সার । একসময় এদের প্রায় চল্লিশ লাখ মেম্বার ছিল। আল্লামা ছিলেন তীব্র লীগ এবং জিন্না বিরোধি। এরা অনেকটা আর এস এসের ধাঁচে তৈরী সৈনিক অনুশাসনে বিশ্বাসী সংগঠন।   ইনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বৃটেনের পক্ষে লড়ার জন্য ৩০,০০০ খাস্কার স্বেচ্ছাসেবক সৈনিক ও বৃটিশদের দিতে চেয়েছিলেন। কিন্ত এহেন বৃটিশ বফাদার মুসলমান নেতাকেও বৃটিশরা ১৯৪৩ সাল অব্দি মাদ্রাসে জেলে রাখে। কারন উনি অখন্ড ভারত চেয়েছিলেন!   তাকে জেলে রেখে, তার নেতাদের জেলে ভরে খাস্কার সংগঠন সম্পূর্ন ভেঙে দেয় বৃটিশ পুলিশ। কারন খাস্কার সংগঠন অক্ষত থাকলে পাঞ্জাবে দাঙ্গা করার সাহস পেত না লীগ।  দাঙ্গার সময় খাস্কার সংগঠনের সামান্যই বেঁচে ছিল এবং এরাই সাহায্য করেছে পাকিস্তানের হিন্দুদের এপারে আসতে। 

অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে কংগ্রেসের স্ট্রাটেজিক ভুল এবং বৃটিশদের টাকা, পুলিশ এডমিনিস্ট্রেশন -সব কিছু দিয়ে মুসলমান লীগ এবং পাকিস্তানের পথ পরিস্কার হয়। 

 কিন্ত চার্চিল কেন সর্বশক্তিদিয়ে পাকিস্তান চাইছিলেন ?  সেটা বুঝতে আমাদের যেতে হবে থার্ড মস্কো কনফারেন্সে - ১৯৪৩ অক্টবর ১৭-নভেম্বর ১২।  জার্মানরা সোভিয়েত ইউনিয়ানে হারছে। রেড আর্মি ওয়েস্টার্ন পুশ শুরু করে দিয়েছে।  চার্চিল-স্টালিন বৈঠকে যুদ্ধ পরবর্ত্তী পৃথিবী ম্যাপ আঁকা শুরু হয়ে গেছে। 

  ভারতের কমিউনিস্টরা কেন লীগের সাথে পাকিস্তান দাবীর সমর্থক ছিল- সেটা বুঝতেও তৃতীয় এবং চতুর্থ মস্কো বৈঠকের ইতিহাস জানা দরকার। এগুলো নিয়ে লিখব পরের কিস্তিতে।  







 

  





 






























 




    












No comments: