Tuesday, March 6, 2018

লেনিন ধরে মারো টান লেনিন হবে খান খান!

ত্রিপুরায় লেনিনের স্টাচ্যু বুল্ডোজার দিয়ে গোঁড়ানোই বামপন্থী আবেগ ফেসবুকে একদম উথলে উঠছে!  লেনিন স্টালিনের মতন কুখ্যাত খুনীদেরকে শ্রমিক এবং কৃষকের ভগবান বানালে, গরুকেও গাছে তোলা সম্ভব।

 ঠিক আছে। আমি না হয় একজন বাম বিরোধি লোক। নোয়াম চমস্কিকেত সমকালীন সব বামেরাই সন্মান করেন, তার বামপন্থী আমেরিকা বিরোধি লেখা বামবাঙালীরা দেদারসে শেয়ার করেন। তা আমার কথা বাদ দিন। স্বয়ং চমস্কিই লেনিনকে বামপন্থার চরম বিশ্বাসঘাতক একজন দক্ষিনপন্থী বলে অভিহিত করেছেন [১]।

  লেনিন কিভাবে শ্রমিক কৃষক শ্রেনীর বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন সেই ইতিহাস এতই ব্যপৃত এবং নৃশংস, তার মধ্যে এখনই ঢুকছি না।  ধরুন বামেরাই ঠিক। লেনিন শ্রমিক কৃষকের একজন ভগবান ছিলেন।  ভাল কথা। তাহলে বামেরাত এটাও মানবেন লেনিন মানে স্ট্যাচু না-লেনিন মানে লেনিনবাদ, লেলিনের লেখা, কর্ম? রাইট? এই নিয়ে নিশ্চয় দ্বিমত থাকার কথা না।


   এবার বামবাঙালীদের কতগুলো তথ্য দিই। উনাদের সাধ্য থাকলে খন্ডন করুন।

 (১)  লেনিনের লেখা সোভিয়েত ইউনিয়ানেই সেন্সর করা হয়েছিল স্টালিন জমানায়।  লেনিনের লেখা স্টালিন সংগ্রহ করে রেখেছিলেন মার্ক্স এঙ্গেলস লেনিন ইন্সটিউটে। খুব কম লোকের ছাড়পত্র ছিল তার সব লেখা দেখার। জনসাধারনের জন্য স্টালিন পাঁচ খন্ডে লেনিনের লেখা প্রকাশ করেন (১৯২৭-৪০)। প্রিয় পাঠক, এবার আসুন সচেতন বাঙালী বামেদের  কিছু প্রশ্ন করি


  •         ওই পাঁচ খন্ডে, লেনিনের লেখাগুলির ৫০% এর ও কম প্রকাশ করা হয়-কেন?
  •         যেটুকু করা হয়, সেখানেও তার বাক্যকে হয় বাদ দেওয়া হয়েছিল, না হলে বদলানো হয় স্টালিনের নির্দেশে যাতে লেনিনের লেখা স্টালিনের স্বৈরাচারকে কমিনিউস্ট কবর থেকে সাপোর্ট করে। লেনিনের স্ট্যাচু ভাঙা অপরাধ না তার লেখার ভর্তা বানানো অপরাধ? 
  •  শুধু তাই না, লেনিনের লেখার ( অরিজিন্যাল, স্টালিন কতৃক সম্পাদিত নকল নহে) অনেক জায়গায় লেনিন তার নিজের অরিজিন যে ইহুদি এবং তিনি রাশিয়ান না-লিখেছেন। স্টালিন বিলকুল সেসব বাদ দিয়েছিলেন! স্টালিনের জমানায় লেনিনকে রাশিয়ান খৃষ্ঠান ফ্যামিলির বলে চালানো হয়।  উনি ছিলেন মায়ের দিক থেকে ইহুদি ফ্যামিলির। বাবা চুজাস জাতির, মা ছিল জার্মান সুইডিশ।  কিন্ত প্রশ্ন হল স্টালিন এসব চেপে গিয়েছিলেন কেন? 
  •  ক্রশ্চেভ এসে ওই পাঁচ খন্ড বই এর নতুন এডিশনে, স্টালিনের বিকৃতি থেকে লেনিনকে মুক্তি দেন। নতুন কিছু লেখাও যোগ হয়। এবার দেখা যায় লেনিনের রাজনৈতিক আদর্শের প্রকৃত সন্তান ক্রুশ্চেভ।
  •   গর্ভাচেভ আবার গবেষকদের নির্দেশ দেন (১৯৮২)  লেনিনের লেখাগুলি অথেন্টিক কি না চেক করতে। তার আমলেও লেনিনের নতুন নতুন লেখা এবং ফুটনোট এল। দেখা গেল লেনিনই চাইছিলেন গ্লস্তনস্ট!   গর্ভাচেভ নিমিত্ত মাত্র। 

   ১৯৯১ সালে কমিউনিজমের পতন ঘটে। এর পরে কমিনিউজমের ঘোর শত্রু বরিস ইয়েলতসিন নির্দেশ দিলেন গবেষকদের যাও লেনিনের সব লেখা উদ্ধার কর।   প্রিয় পাঠক লেনিনপ্রেমিক বাঙালীদের প্রশ্ন করুন -লেনিনের কতগুলি লেখা অপ্রকাশিত ছিল? এনি গেজ?

   লেনিনের ছহাজার লেখা প্রকাশিতই হয় নি সোভিয়েত জমানায়। লেনিনের মুক্তি ঘটান ইয়েলতসিন ওই ছহাজার লেখা প্রকাশ করে।

 এবার বাম বাঙালীকে প্রশ্ন করুন-বিজেপির লোকজন না হয় শুধু স্টাচু ভেঙেছে-কিন্ত "শ্রমিক কৃষকের ভগবান" লেনিনের লেখাকে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ কমিনিউস্ট স্টেটই চেপে রেখেছিল? কোনটা বড় অপরাধ????

    আপনি বলবেন লেনিনের চ্যালা চামুন্ডারা ছিল ভন্ড-তার দোষ কেন হবে?  ভন্ড গুরুর শিষ্যরা কি সাধু হবে?   জনগণকে বিভ্রান্ত করতে রাজনৈতিক ভন্ডামোর সীলমোহরে ছাপ্পাটা লেনিনই দিয়েছিলেন। সেই ডিডেলসে যাচ্ছি না। শুধু আরো একটা ছোট তথ্য দিই। পৃথিবীর ইতিহাস শুধু একটা দেশই পার্লামেন্টে আইন এনেছিল -সেই দেশে লেনিনের সব স্ট্যাচু ( প্রায় হাজার খানেক ছিল ) ভেঙে দেওয়ার জন্য । দেশটার নাম, ইউক্রেন , আইনের নাম " ডিকমিউনাইজেশন আইন"। ২০১৫ সালের  এপ্রিল মাসে।  ২০১২ সালে রাশিয়াতে স্টালিনের সব স্ট্যাচু ভাঙার জন্য প্রস্তাব আসে লিব্যারাল ডেমোক্রাটিক পার্টির তরফ থেকে। যেকটা লেনিনের স্ট্যাচু রাশিয়ার জনরোষ বাঁচিয়ে টিকে আছে, সেগুলোও ভাঙা হৌক। যাইহোক, তাদের প্রস্তাব ভোটে জেতে নি।

 লেনিন জমানায় অসংখ্য কৃষক এবং শ্রমিক গণহত্যা হয়েছে। আমি শুধু দুটো ঘটনাকে সামনে আনছি। কারন এগুলো ছিল কৃষক-শ্রমিক বিদ্রোহ যা নির্বিচারে দমন করেছিলেন লেনিনের রেড আর্মি। 

  (১)  কনস্টাড বিদ্রোহ ।  মার্চ  ৭-১৭, ১৯২১।  এই বিদ্রোহে সামিল ছিল নৌসেনা এবং শ্রমিকরা।  রেড আর্মি প্রায় ১০০০ লোকে খুন করে, ৪০০ সেনার ফাঁসি হয়। নেহাৎ সেনা বিদ্রোহ হলে এই বিদ্রোহের প্রসঙ্গ এখানে আনতাম না। আপনারা বাম বাঙালীদের প্রশ্ন করুন এই কনস্টাড বিদ্রোহের বিপ্লবীদের দাবী কি কি ছিল ???

   শুনবেন?  ওদের ১৫ দফা দাবী ছিল ট্রেড ইউনিয়ান করার অধিকার ফেরাতে হবে, গণতন্ত্র বাক স্বাধীনতা ফেরাতে হবে,  সোভিয়েতের শ্রমিকদের হাতে ক্ষমতা ফেরাতে হবে! অর্থাৎ বাই ১৯২১, সোভিয়েত ইউনিয়ানের শ্রমিক কৃষকরা বুঝে গেছে,  শ্রমিক দরদির টুপি পরিয়ে, তাদেরকে জারের জমানা থেকেও অধপতনে ফেলা হয়েছে! কারন তদ্দিনে  শ্রমিক কৃষকের ভগবান লেনিন, শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ান করার অধিকার, সোভিয়েতে শ্রমিকদের অধিকার বেয়াইনি ঘোষনা করেছেন! ইয়েস, লেনিন ফ্যাক্টরী কাউন্সিলকে ধ্বংশ করেছিলেন। 

 (২)  তম্ভব কৃষক বিদ্রোহ - ১৯২০।  প্রায় ৭০,০০০ কৃষক বন্দুক হাতে বিদ্রোহ করে, কারন রেড আর্মির  খাবার জোগাতে তাদের ওপর অসম্ভব অত্যাচার শুরু হয়। এরা কেউ দক্ষিন পন্থী ছিলেন না-অধিকাংশই ছিলেন বলশেভিকদের কৃষক সংগঠনের লোক।  রেড আর্মিরই একটা ফ্যাকশন। ১৯১৭ সালে লেনিনের সাথেই এরা ছিলেন।  যখন দেখলেন লেনিন বিশ্বাসঘাতক, মারাত্মক এক ফ্রড, এবং যার হাতে পরে, তারা সর্বস্ব খোয়াতে বসেছেন, তখন বলশেভিকদের কৃষক সংগঠন ভেঙেই এই বিদ্রোহের শুরু।  প্রায় ১৪,০০০ কৃষক হত্যা করে লেনিন এই বিদ্রোহ দমন করেন।

 আমি এই লিস্টটা আরো অনেক অনেক লম্বা করতে পারতাম- শুধু একটা ছোট্ট তথ্য। লেনিন জমানায় প্রায় ৫০০,০০০ কৃষক হত্যা হয়েছিল। 

শ্রমিকদের সাথে লেনিন কিভাবে একের পর এক বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন, তার ইতিহাস বিরাট লম্বা। যার জন্য চমস্কির মতন বিখ্যাত বামপন্থী স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন লেনিন  বামপন্থার কোন প্রফেট না- বামপন্থার কুলাঙ্গার বিশ্বাসঘাতক দক্ষিন পন্থী। 

 এসব অবশ্য বাঙালী বামদেরকে বলে লাভ নেই। কারন এরা পড়াশোনা করে না, আবেগে চলে। বাম বাঙালীর চেয়ে বড় অশিক্ষিত গোটা পৃথিবীতেই বিরল। বাঙালী সব কিছুতেই ফাঁকি মারে। রাশিয়ার ইতিহাস পড়তেও ফাঁকি দিয়েছে। ফল এই যে আবেগপ্রবন বামপন্থায় ভেসেছে। 

 সেটা অবশ্য ব্যক্তিগত ইচ্ছা। মুশকিল হচ্ছে না পড়াশোনা করে আবেগে ভেসে এরা পশ্চিম বঙ্গকে ৩৪ বছর ধরে উচ্ছন্নে পাঠিয়েছে। একটা এগিয়ে থাকা রাজ্য, এই সব আবেগে ভাসমান রাজনীতির পাল্লায় এসে ভারতের সব থেকে পিছিয়ে থাকা একটা রাজ্যে পরিনত হয়। 

 আর মার্ক্সের পাশে লেনিনকে বসিয়ে মার্ক্স-লেনিনিস্ট তত্ত্ব বানাতে গেলে দর্শন শাস্ত্রে রীতিমত অশিক্ষিত হতে হয়। মার্ক্স দর্শন শাস্ত্রে পি এই চ ডি ছিলেন-উনার যেকোন লেখা বুঝতে আরো গভীরে যেতে হয়। যেখানে লেনিনের লেখা সব কিছুই লিফলেট মার্কা- বুলি আড়ম্বর রেটোরিক- সেখানে দর্শন বা গভীর চিন্তার ছাপ নেই।  এটা আজ ঐতিহাসিক ভাবে প্রমানিত মার্ক্সের অধিকাংশ লেখাই লেনিনের কাছে ছিল না-কারন সে যুগে মার্ক্সের বই অত সহযে পাওয়া যেত না। লেনিন মার্ক্সের লেখার সাথে বিশেষ পরিচিত ছিলেন না-তার কাছে মার্ক্সের অধিকাংশ লেখাই ছিল না।    লেনিনকে মার্ক্সের সাথে একাসনে বসানোর লজিকটা ওই ছাগলের ও দাঁড়ি আছে, রবীন্দ্রনাথের ও দাঁড়ি আছে তাই ছাগল ও রবীন্দ্রনাথ-ওই গোত্রের। 

 যাইহোক, গরুকে গাছে চড়িয়ে লেনিনকে মহান বানালে বামপন্থার ক্ষতিই হবে। নতুন বামপন্থার সন্ধান করুন কমরেড, যা মানুষকে ভালবাসতে শেখায়।  ঘৃণা এবং হিংসা থেকে কোন মহানপন্থার জন্ম হতে পারে না।  ভারতের মাটিতে শ্রীচৈতন্যই প্রকৃত বামপন্থী আইকন -যিনি অহিংস পথেই কৃষকদের সাথে কীর্তন করতে করতে ট্যাক্স বিদ্রোহ করেছেন। অন্যায় আইনের বিরুদ্ধে লাঠি না খোল করতাল নিয়ে সবাইকে নিয়ে মাঠে নামিয়েছেন। সেখানে হিংসা না, ভালোবাসার পথেই আন্দোলন হয়েছে -প্রেমের পথেও গণতান্ত্রিক  রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়। প্রতিটা ধর্মের উত্থানই প্রতিবাদি বামপন্থী আন্দোলন যা সময়ের গর্ভে দক্ষিনপন্থা হয়ে ওঠে। 

 লেনিনের মতন ফ্রড বিশ্বাসঘাতকে ছেড়ে ভারতের বামপন্থী উপাদানগুলিকে না চিনলে, ভারতের বামেরা হারতেই থাকবে। ভারতের বাম আন্দোলন দুর্বল হতেই থাকবে।

[১] 
https://www.youtube.com/watch?v=7nUNNSMQwTc







 





       

       







  

No comments: