জীবন ও জীবিকা 5 - যারা কোর সাবজেক্টএ বিটেক বা সায়েন্সে এম এস সি পাশ করছে তাদের ভবিষ্যত কি? -৬ ই মার্চ, ২০২৩
(১)
ক্যাপিটাল বা পুঁজির গতি
আমরা কি চাই, আমাদের কি কাজ করতে ভাল লাগে, তাই দিয়ে কিন্ত চাকরি বা জীবিকা তৈরী হয় না।
আবার আমাদের কি প্রয়োজন, বিশ্বের কি প্রয়োজন -তাই দিয়েও নতুন জীবিকা তৈরী হয় না।
জীবিকা এবং চাকরির পেছনে, একটাই শব্দ "পুঁজি" বা ক্যাপিটাল। আপনি চান বা না চান, ক্যাপিটাল যেদিকে ছুটবে, চাকরির গতিও সেই দিকেই হয়। আর সেটা অনেক কারনেই সমস্যা। মূল দুটো কারন হল-অনেক ক্ষেত্রেই হাইপের পেছনে অনেক চাকরি তৈরী হয়। তারপর দেখা গেল সেই ফিল্ডের আর হাইপ নেই । ফলে সেখানে প্রচুর বেকার তৈরী হয়। টেলিকম এমন এক উদাহরন। দ্বিতীয় কারন হচ্ছে, এই কোর ফিল্ডগুলির যেসব কোম্পানী-তারা অপেক্ষাকৃত স্টেবল হলেও যখন বসে যায়, তখন নতুন কোন চাকরি পাওয়া সমস্যা হয়। কারন অলিতে গলিতে সফটোউয়ার কোম্পানীর মতন কোর কোম্পানী সর্বত্র সর্বভূতে নেই।
আমি আগেই লিখেছি, কেউ যদি তার সাবজেক্টে খুব ভাল হয়- তাকে চাকরি খুঁজতে হয় না। চাকরি তাকে খুঁজে নেবেই। এটাও লিখেছিলাম ১% ছেলেমেয়েরা যারা নিজেদের সাবজেক্ট ব্যাচেলর বা মাস্টার্স করেছে-তারা নিজেদের সাবজেক্টটা জানে কি না সন্দেহ।
ভবিষ্যত জানতে গেলে একটা জিনিস অবশ্য জানা দরকার। সফটোয়ার বা মেকানিকাল বা ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারদের- মানে কোর সাবজেক্টে যারা বিটেক করেছে -তাদের মাইনে আসে কোথা থেকে?
মূলত তিনটে জায়গা থেকে। প্রোডাকশন, আরেন্ডি বা গবেষনা, আর সেলস ইঞ্জিনিয়ার বা সেলস সাপোর্ট ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে।
এর মধ্যে ভারতে প্রথম দুই এর স্কোপ খুব কম। কারন প্রোডাকশন সবাই আই টি আই পাশ করা ইঞ্জিনিয়ার ডিপ্লোমা দিতে চালায়। খুব কম কোম্পানী বিটেক হায়ার করে। আমি দেখেছি জেকে টায়ার, প্রোক্টর এন্ড গ্যাম্বলের বিরাট প্ল্যান্টে হার্ডলি হাতে গোনা মাত্র কজন বিটেক ইঞ্জিনিয়ার থাকে। তাদের মাইনে ছোট সফটোয়ার কোম্পানীর জুনিয়ার সফটোয়ার ডেভেলপারদের থেকেও কম।
ভারতের অধিকাংশ কোম্পানীর আরেন্ডি নেই। টাটারা ব্যতিক্রম। বাকি সবাই বিদেশ টেকনোলজি লাইসেন্স করে। ভারতের আই আই টিগুলো টেকনোলজি ডেভেলপ করতে পারে না-কারন তাদের পেছনে শিল্প সংস্থার খুব বেশী সাপোর্ট নেই। অবস্থা এখন আস্তে আস্তে বদলাচ্ছে। বিশেষত বিজেপি সরকার ডিফেন্স ইন্ড্রাস্ট্রি ডি আর ডি ও নামক সরকারি সাদা হাতি থেকে বার করে প্রাইভেটাইজ করে ভাল করেছে-কারন এতে অন্তত কোর ইঞ্জিনিয়ারিং এর চাহিদা বাড়বে। আমেরিকাতে মেকানিক্যাল ইলেক্ট্রিক্যাল ইত্যাদি ভাল ভাল কোর ফিল্ডের লোকেদের চাকরি হয় মূলত এইসব ডিফেন্স কোম্পানীগুলিতে। এছাড়াও আর্মিকোর ইঞ্জিনারিং, এয়ারফোর্স মেইন্টেনান্স ইত্যাদি মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং এর চাহিদা আস্তে আস্তে বাড়তেই থাকবে। কারন ভবিষতে যুদ্ধ করবে রোবটেরা, রোবট গাড়িতে চেপে! নেহেরুর সরকারি কোম্পানী খুলে নতুন ট্যাঙ্ক বানানোর ভূত ভারতের মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের বিকাশের প্রচন্ড ক্ষতি করেছে। এখন প্রাইভেটাইজেশনের ফলে আস্তে আস্তে এই সেক্টরের বিকাশ হবে ভারতে। ফলে কোর ইঞ্জিনিয়ারদের চাহিদা বাড়বে। ডিফেন্স শিল্পে লাইসেন্সিং করে বেশী দূর যাওয়া যায় না। ফলে এখানে ভাল কোয়ালিটির কোর ইঞ্জিনিয়ারদের চাহিদা ভালোই বাড়বে।
আর পরে রইল সেলস। সেলস ইঞ্জিনিয়ার যত না ইঞ্জিনিয়ার তার থেকে তাকে সাহিত্যিক হতে হবে-কথা সাহিত্যিক হতে হবে বেশী! যাদের সাহিত্যে ছিল মন, কিন্ত বাবা-মা জোর করে ইঞ্জিনিয়ারিং কলে ঢুকিয়ে দিয়েছে-তাদের জন্য সেলস ইঞ্জিনিয়ার হওয়া ভাল। এখানে কমিউনিকেশনের কদর আছে। সেলস ইঞ্জিনিয়ারদের মাইনে এবং ওঠার স্কোপ দুটোই ভাল। কিন্ত তাদেরকে ইঞ্জিনিয়ারিং, কমিউনিকেশন এবং অপারেশন- এই তিনটেই দক্ষ হতে হয়। যা বেশ কঠিন। তাই তাদের মাইনে আগের দুটো ক্ষেত্রের থেকে বেশী।
(২) নতুন যুগের নতুন ডিমান্ড --
কিন্ত মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার মানে ইলেক্ট্রিকাল, ইলেক্ট্রনিক্স, সফটৌয়ার শেখার দরকার নেই?
এই মুহুর্তে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ সব থেকে হট টপিক - অটোমেটেড কার, ইলেক্ট্রিকাল কার, ড্রোন, রোবটিক্স ইত্যাদি। এগুলো মেকানিক্যাল, ইলেক্ট্রনিক্স, সফটোয়ার, এই আই-সব কিছুর মৃগয়া ক্ষেত্র। এর সাথে আছে মেটাভার্স- যা গেম ইঞ্জিনের বাস্তব অনেক এপ্লিকেশন। সেখানে ফিজিক্স, মেকানিক্যাল, সি প্লাস প্লাস-সব কিছুই লাগে।
আগের মতন মেকানিক্যাল মানে, শুধু মেশিন ডিজাইন শিখে লাভ নেই ( ভারতে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়াদের সেই স্কিলও কারুর নেই )। মেকানিক্যাল ইলেক্ট্রিক্যাল ইদ্যাদি সব ব্রাঞ্চের ছাত্রদের সফটয়ার ডেটা সায়েন্স সেন্সর, মেকাট্রনিক্স ইত্যাদি সাবজেক্ট শেখা উচিত। মুশকিল হচ্ছে ভারতের কোন কলেজে এসব শেখাবে? মেকানিক্যালের ক্লাসিক্যাল সাবজেক্ট পড়ানোর ভাল শিক্ষকই ত নেই!
এই জিনিসটা যারা ফিজিক্স, স্টাট, ম্যাথ , কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়ছে তাদের জন্যও সত্য। কেমিস্ট্রি এবং বায়োলজির ভবিষ্যত ভাল হওয়া উচিত কারন হেলথকেয়ার উত্তোরোত্তর আমাদের ইনকামের, আমাদের জিডিপির অধিকাংশ খেয়ে নিচ্ছে। কিন্ত ভারতে এটা হচ্ছে না। কারন ভারতে বায়োলজি, কেমিস্ট্রির স্টার্টাপ নেই। সবাই ভারতে কর্মাস স্টার্টাপ খোলে ১৪০ কোটি মানুষের মার্কেট পেতে। ফলে ভারতের ছাত্ররা বিদেশে গিয়ে গবেষনা করে নতুন জিনিস তৈরী করছে-আবার ভারতের কোম্পানীরা বিদেশ থেকে লাইসেন্স করে সেটা কিনছে! তবে এখানে দিনকাল আস্তে আস্তে বদলাচ্ছে। আরো বদলাবে।
অনেকেই বলবেন যারা ফিজিক্স কেমিস্ট্রি পড়ছে-তাদের শিক্ষকতার লাইন ত খোলা রইল! আমি খুব নিশ্চিত নই- চ্যাট জিপিটি, গুগুলের যুগে কিভাবে শিক্ষকতা এবং সাবজেক্টের পুনবিন্যাস হবে। আমেরিকাতে অলরেডি স্কুল লেভেলে এসব বেসিক সায়েন্সের টিচারদের ডিমান্ড খুব কমে গেছে। কারন আমেরিকাতে হাই স্কুল থেকেই [ এখানে ক্লাস ৯ থেকে ১২, ৪ বছর হাইস্কুল] "এডভান্সড প্রোগ্রাম" বা এপি স্পেশালাইজেশন করতে দিচ্ছে। ফলে যে ভবিষ্যতে সফটোয়ার ইঞ্জিনিয়ার হতে চাইছে, সে হাইস্কুলেই ৫-৭ টা কলেজ লেভেলের কম্পিউটার সায়েন্স কোর্স নিতে পারে- তাকে ম্যাথ বা ফিজিক্সের বা কেমিস্ট্রির খুব কম কোর্স নিতে হয়। যারা ডাক্তারি বা ফার্মাসিতে যাবে তারা বায়োলজি, কেমিস্ট্রির বেশী কোর্স নিচ্ছে । আমার ধারনা এটা ভারতের নতুন এডুকেশন পলিসিতে এসে গেছে। কারন ভারতের বর্তমান স্কুল সিস্টেম সম্পূর্ন বোগাস এবং ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যতের ক্ষতি করছে। এগুলো বদলাবেই। এবং ভারতের নতুন শিক্ষা পলিসিতে সেটা স্বীকার করা ও হয়েছে।
আমি মনে করি যারা কেমিস্ট্রি বায়োলজি ফিজিক্স নিয়ে পড়ছে-তাদের ভবিষ্যত বেশ ভাল- যদি তারা সাবজেক্টটা শেখে এবং বিদেশে শিল্প গবেষনাতে চান্স পায়। বা দেশেও আরেন্ডিতে কাজ শুরু করে। ইঞ্জিনিয়ারদের কাজ অটোমেট করা সহজ। সায়েন্সে সেটা সম্ভব না। কারন সেখানে কাজটাই হচ্ছে নতুন আবিস্কার। এই এ আই এর যুগে ইঞ্জিনিয়ারিং কাজের অটোমেশন হবে সবার আগে। কারন ইঞ্জিনিয়ারিং রিপিটেটিভ স্টান্ডার্ড কাজ- যার অটোমেশন করা সব থেকে সহজ। সুতরাং ইঞ্জিনিয়াররাও সায়েন্সটিস্ট হয়ে যাবে। এবং সেটাই হচ্ছে। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়াররা রোবটের এ আই নিয়ে গবেষনা করছে।
ভবিষ্যতে মেকানিক্যাল ইলেক্টিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বলে কিছু থাকবে না। এগুলোকে বলা হবে মেকানিক্যাল এন্ড অটোমেশন সায়েন্স বা ওই জাতীয় কিছু।
আসলে আমরা খুব দ্রুত পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। যারা এই পরিবর্তনের ধারাপাতটা দ্রুত বুঝতে পারবেন, একমাত্র তাদের সামনেই উজ্জ্বল ভবিষ্যত। বাকীটা বেশ ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট বাইনারী কেস।