Saturday, February 25, 2023

জীবিকা এবং জীবন- ২ ঃ ভাল ডিগ্রী, ভাল ইউনিভার্সিটি কি জীবনে নিরাপত্তা দিতে পারে ?

 জীবিকা এবং জীবন- ২ ঃ ভাল ডিগ্রী, ভাল ইউনিভার্সিটি কি জীবনে নিরাপত্তা দিতে পারে ?

(১) দ্যা বিগ লেফ --
গত তিনমাসে আমেরিকার সর্ববৃহৎ আই টি কোম্পানীগুলিতে লে-অফ - অর্থাৎ ছাঁটাই এর স্ট্যাটিসস্টিক্স --
আমাজন ১৮,০০০
গুগুল ১২,০০০
মাইক্রোসফট ১০,০০০
ফেসবুক ১১,০০০
আই বি এম ৩৯০০
সেলসফোর্স ৮০০০
বুকিং ডট কম ৪১০০
টুইটার ৩৭০০
কারভানা ৪০০০
সিসকো ৩৭০০
# ১ এটা টিপস অব আইসবার্গ-হিমশৈলের চূড়া। এই বছর এই ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত শুধু আমেরিকাতে আই টিতে লেওফের সংখ্যা প্রায় ১০৪ হাজার। ডিসেম্বর শেষ হওয়া পর্যন্ত এই সংখ্যা দাঁড়াবে ৬ লাখের কাছাকাছি। মেটা, গুগুল, আমাজন প্রথম দফা লেওফ সম্পূর্ন করেছে। দ্বিতীয় দফা, মার্চ মাসেই আসছে। মেটা এবং আমাজন তা ঘোষনা করেও দিয়েছে।
পয়েন্ট টু নোট-১ ঃ আমাজন, গুগুলে যারা চাকরি করতে গেছে- তারা সবাই ভাল ইউনিভার্সিটির ভাল টপ ছাত্রছাত্রী। এই যে গত তিনমাসে প্রায় তিন লাখ ছাঁটাই হয়েছে এসব "ব্র্যান্ড কোম্পানী" থেকে, তাদের প্রায় সবাই ভাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাল ছাত্র-ছাত্রী।
পয়েন্ট টু নোট-২ ঃ এরা মোটেও এদের পারফর্মান্স বাজে ছিল, বা ভাল কাজ করতে পারছিল না বলে ছাঁটাই হয়েছে তা না। এরা সবাই বাজারের পরিস্থিতির শিকার।
# ২ প্রশ্ন হচ্ছে লে অফ হচ্ছে আমেরিকাতে- কিন্ত ভারতে আই টিতে সদ্য পাশ করা ছাত্রছাত্রীরা এটা নিয়ে চিন্তিত হবে কেন? ভারতের আই টি মার্কেটের ৮০% আমেরিকা নির্ভর। আমেরিকাতে আই টি বাজেট কমলে, ভারতের আই টি জবে চাপ আসবেই। এছাড়া ভারতের ইউনিকর্ন স্টার্টাপগুলিতে গত বছর লেওফের সংখ্যা ২ লাখ ছাড়িয়েছে।
এবছর যারা ফোর্থ ইয়ার বিটেকে আছে, তাদের সামনে খুব কঠিন সময়। তাদের তিনটে বুলেট ডজ করতে হবে চাকরি পেতে গেলে। এক, আমেরিকাতে আই টি বাজারে মন্দার কারনে, ভারতের আই টি কোম্পানীগুলি ফ্রেশার হায়ারিং ফ্রিজ করে দিয়েছে। কারন তাদের বেঞ্চের % এখন বেড়েই চলেছে। দুই, আগের বছর যারা অফার লেটার পেয়েছিল-তাদের অনেককেই এখনো জয়েনিং পায় নি। কিছু কিছু কোম্পানী-তাদের ফিরিয়ে দিয়েছে-যেহেতু তারা প্রভিশনাল পিরিয়ডে ছিল। অর্থাৎ আগের ব্যাচের ছেলেমেয়েরাই এখন রাস্তায়। তাদের সাথে ফ্রেশারদের প্রতিযোগিতায় যেতে হবে। তিন, চ্যাট জিপিটি। চ্যাট জিপিটির জন্য সব কোম্পানীই জানে তাদের "বডির" সংখ্যা কম লাগবে। এই পরিস্থিতিতে কেউ নতুন হায়ারিং করবে না। সবাই এখন "দেখি" মুডে পযে আছে। দুদিন বাদে হায়ারিং ত দূরের কথা ব্যাপক ছাঁটাই ভারতেও শুরু হবে। আসলেই শুরু হয়ে গেছে। ভারতে এগুলো হচ্ছে চোরাগোপ্তা ভাবে। যেমন ফলস রেজুমে এসবের আছিলায় ( রেফা- এক্সেঞ্চার ইত্যাদি)।
(২)
সুতরাং কেসটা হল এই যে ভাল ইউনিভার্সিটির ভাল ডিগ্রি ( কম্পিউটার সায়েন্স) নিরাপত্তা দিতে পারে না।
কিন্তু তাহলে নিরাপত্তা কোথায়?
ধরুন আই টি মার্কেটের প্রায় ৬০% ছাঁটাই হবে আগামী ৪ বছরে। বাকী ৪০% টিকে যাবে এবং তাদের মাইনে আরো অনেক বাড়বে। এই টিকে থাকা ৪০% কারা ? বা ছাঁটাই ৯০% ও হতে পারে চ্যাট জিপিটি টাইপের ইনোভেশনের জন্য। কিন্ত এই বাকী ১০% সারভাইভার কারা?
দেখুন মার্কেটে আপডাউন থাকবেই। মার্কেট কখনো ভাল, কখনো খারাপ হবে। কিছু জব অবলুপ্ত হবে। আরো নতুন জব তৈরী হবে। এটাই নিয়ম।
কিন্ত বাস্তব হচ্ছে, এত ছাঁটাই এর পরও মার্কেটে ভাল সফটোওয়ার ইঞ্জিনিয়ারের প্রচন্ড অভাব। তাদের চাহিদা এত ছাঁটাই এর মধ্যেও বিপুল।
বাই দ্যা ওয়ে- যেসব কোম্পানীগুলো ছাঁটাই করছে-তারা হায়ার ও করছে! বেসিক্যালি মধ্যম মেধা ছেঁটে আরো উচ্চমেধা ছেঁকে তোলার চেষ্টা করছে।
সুতরাং প্রশ্ন হচ্ছে - ভারতের কনটেক্সটে ভাল সফটোয়ার, ভাল কোডার হতে গেলে কি ভাল ইউনিভার্সিটি বা ভাল ডিগ্রি লাগবে?
একদম না। এখন সব বড় কোম্পানীই [ আমাজন, গুগুল, মাইক্রোসফট টেসলা] ঘোষনা করে দিয়েছে, তাদের ডিগ্রিধারী দরকার নেই। শুধু তাদের নির্ধারিত কোডিং টেস্ট পাশ করতে হবে।
ধরুন কেউ প্রাইভেট কলেজেও আই টি বা কম্পুউটার সায়েন্সে বিটেক করল না! তার কি সফটয়ার ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কোন ভবিষ্যত নেই?
২০০% আছে। ইনফ্যাক্ট কলেজে যা ইঞ্জিনিয়ারিং শেখানো হয়, তা ফালতু। কেউ যদি সত্যিকারের সফটোয়ার ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়- তার দরকার একটি কোম্পানী- যেখানে কাজ শেখার স্কোপ আছে। এখন পাড়ায় পাড়ায় মোবাইল এপ কোম্পানি- সেখানে ঢুকে শিখলেই বেটার হবে। দরকার একজন ভাল মেন্ট্রর বা গুরুর। ডিগ্রি একটা ন্যাপকিন পেপার। সেটা যেকোন ওপেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করে নিলেই হল। ইউটিউব, ইউডেমিতে শেখা অনেক অনেক বেশী ভাল। শিখে কাজ করার একটা স্কোপ দরকার। হায়ার সেকেন্ডারী পাশ করে, সেটা পাড়ার মোবাইল কোম্পানীতে শুরু করাই ভাল। তারপর আস্তে আস্তে আরেকটু বড়, আরো বড় এইভাবে কোম্পানী চেঞ্চ করে শিখতে হবে। সাথে সাথে যেসব প্ল্যাটফর্মে কোডিং শেখানো হয় [ সবই প্রায় বিনাপয়সায়, যেমন গুগুল জ্যাম, মাইক্রোসফটের কোডিং শেফ] সেখানে অন লাইনে শিখতে হবে। এইভাবে চললে, যখন তার সমবয়সীরা একটা বিটেক ডিগ্রির পেপার নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে, তখন সে, পকেটে চারটে চাকরি নিয়ে ঘুরবে!
পশ্চিম বঙ্গে [ বা ভারতেও] সরকারি বা বেসরকারি কলেজ গুলোতে একজন কোডিং শিক্ষক ও নেই- যা গুগুল জ্যাম লেভেলের ৫০% প্রশ্ন ক্লিয়ার করতে পারবে, বা ছাত্রছাত্রীদের হেল্প করতে পারবে। ভারতের যেসব ছাত্ররা গুগুল জ্যামে ভাল পারফর্ম করছে, নিজেদের উৎসাহে, নিজেদের চেষ্টায় করছে। তাদের প্রাণখোলা স্যালুউট!
অর্থাৎ স্কিল শেখাটাই আসল-বাকি সবকিছুই বর্তমানে নকল। আমি কদিন আগে একটা পডকাস্ট করেছিলাম-কেন বিটেক পাশ করার পর, একজন সতীর্থ, অন্যজনের থেকে পাঁচ বছর বাদে পাঁচগুন ইনকাম করবে।
যে ছেলেটি অন্য সতীর্থর থেকে পাঁচগুন ইনকাম করবে সে কি ক্লাসের ফার্স্ট বয়? মোটেও না। যে কেরিয়ারে স্কিল শেখাকে, কোম্পানীর ব্রান্ড ইত্যাদির থেকে বেশী গুরুত্ব দেবে, সেই জিতবে এই টিকে থাকার খেলায়। আমি ভিডিওটি এখানে দিলাম।

ফ্রেশ আই টি গ্রাজুয়েটদের কেন চ্যাট জিপিটির কোডেক্স শেখা অপরিহার্য্য ?

(১) দ্যা বিগ লেফ --

গত তিনমাসে আমেরিকার সর্ববৃহৎ আই টি কোম্পানীগুলিতে লে-অফ - অর্থাৎ ছাঁটাই এর স্ট্যাটিসস্টিক্স --
আমাজন ১৮,০০০
গুগুল ১২,০০০
মাইক্রোসফট ১০,০০০
ফেসবুক ১১,০০০
আই বি এম ৩৯০০
সেলসফোর্স ৮০০০
বুকিং ডট কম ৪১০০
টুইটার ৩৭০০
কারভানা ৪০০০
সিসকো ৩৭০০
# ১ এটা টিপস অব আইসবার্গ-হিমশৈলের চূড়া। এই বছর এই ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত শুধু আমেরিকাতে আই টিতে লেওফের সংখ্যা প্রায় ১০৪ হাজার। ডিসেম্বর শেষ হওয়া পর্যন্ত এই সংখ্যা দাঁড়াবে ৬ লাখের কাছাকাছি। মেটা, গুগুল, আমাজন প্রথম দফা লেওফ সম্পূর্ন করেছে। দ্বিতীয় দফা, মার্চ মাসেই আসছে। মেটা এবং আমাজন তা ঘোষনা করেও দিয়েছে।
পয়েন্ট টু নোট-১ ঃ আমাজন, গুগুলে যারা চাকরি করতে গেছে- তারা সবাই ভাল ইউনিভার্সিটির ভাল টপ ছাত্রছাত্রী। এই যে গত তিনমাসে প্রায় তিন লাখ ছাঁটাই হয়েছে এসব "ব্র্যান্ড কোম্পানী" থেকে, তাদের প্রায় সবাই ভাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাল ছাত্র-ছাত্রী।
পয়েন্ট টু নোট-২ ঃ মোটেও এদের পারফর্মান্স বাজে ছিল, বা ভাল কাজ করতে পারছিল না বলে ছাঁটাই হয়েছে তা না। এরা সবাই বাজারের পরিস্থিতির শিকার।
# ২ প্রশ্ন হচ্ছে লে অফ হচ্ছে আমেরিকাতে- কিন্ত ভারতে আই টিতে সদ্য পাশ করা ছাত্রছাত্রীরা এটা নিয়ে চিন্তিত হবে কেন? ভারতের আই টি মার্কেটের ৮০% আমেরিকা নির্ভর। আমেরিকাতে আই টি বাজেট কমলে, ভারতের আই টি জবে চাপ আসবেই। এছাড়া ভারতের ইউনিকর্ন স্টার্টাপগুলিতে গত বছর লেওফের সংখ্যা ২ লাখ ছাড়িয়েছে।

(২) এবছর ক্যাম্পাসে চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা কতটা?

এবছর যারা ফোর্থ ইয়ার বিটেকে আছে, তাদের সামনে খুব কঠিন সময়। তাদের তিনটে বুলেট ডজ করতে হবে চাকরি পেতে গেলে।

এক, আমেরিকাতে আই টি বাজারে মন্দার কারনে, ভারতের আই টি কোম্পানীগুলি ফ্রেশার হায়ারিং ফ্রিজ করে দিয়েছে। কারন তাদের বেঞ্চের % এখন বেড়েই চলেছে।

দুই, আগের বছর যারা অফার লেটার পেয়েছিল-তাদের অনেককেই এখনো জয়েনিং পায় নি। কিছু কিছু কোম্পানী-তাদের ফিরিয়ে দিয়েছে-যেহেতু তারা প্রভিশনাল পিরিয়ডে ছিল। অর্থাৎ আগের ব্যাচের ছেলেমেয়েরাই এখন রাস্তায়। তাদের সাথে ফ্রেশারদের প্রতিযোগিতায় যেতে হবে।

তিন, চ্যাট জিপিটি। চ্যাট জিপিটির জন্য সব কোম্পানীই জানে তাদের "বডির" সংখ্যা কম লাগবে। এই পরিস্থিতিতে কেউ নতুন হায়ারিং করবে না। সবাই এখন "দেখি" মুডে পযে আছে। দুদিন বাদে হায়ারিং ত দূরের কথা ব্যাপক ছাঁটাই ভারতেও শুরু হবে। আসলেই শুরু হয়ে গেছে। ভারতে এগুলো হচ্ছে চোরাগোপ্তা ভাবে। যেমন ফলস রেজুমে এসবের আছিলায় ( রেফা- এক্সেঞ্চার ইত্যাদি)।

(৩) তাহলে নতুন চাকরি পাওয়ার উপায় কি?

আমরা ক্রাকিং আই টি জবের পক্ষ থেকে অনেক মিড লেভেল সিইওদের সাথে কথা বলেছি। তারা আর ফ্রেশার হায়ারে আগ্রহী না। সব সাময়িক ভাবে স্থগিত।
কিন্ত তারা একটি এক্সপেরিমেন্টে রাজী হয়েছেন। চ্যাট জিপিটি ভালভাবে কাজে লাগাতে পারে এমন ছেলেমেয়ে তারা খুঁজছেন। যারা চ্যাটজিপিটির সাহায্যে কোড রিভিউ, টেস্টকেস লেখা, ডিবাগিং আরো এফেক্টিভ লেভেলে করতে পারবে। এমন প্রায় ৪০০ টি পজিশন নিয়ে আমরা নানান সিইও এবং এইচ আরের সাথে কথা বলেছি।

সেইজন্য আমরা আই টি শিল্পের অভিজ্ঞ কোডার ( এবং আই আই টি ব্যাকগ্রাউন্ড) দের দিয়ে -পাঁচটি পরীক্ষামূলক কোর্স চালু করেছি। যেগুলিতে শেখানো হবে কিভাবে চ্যাট জিপিটি ব্যবহার করে ইন্ড্রাস্টি স্টান্ডার্ড মেইন্টেনেবল কোডিং করা সম্ভব। এইসব কোর্সে যেসব ছাত্রছাত্রী সফল ভাবে পরীক্ষায় পাশ করবে, তাদেরকে আমরা নানান কোম্পানীতে ইন্টারভিউ দিতে আমরা পাঠাবো- যেখানে চ্যাট জিপিটি দিয়ে কিভাবে আরো এফিশিয়েন্ট ওয়ার্কফোর্স তৈরী করা যায়-তার পরীক্ষা চলছে।

প্রথম ব্যাচে ৫ টি কোর্স, ২৫০ টি সিট। যারা প্রথমে ঢুকবে, তারা ইন্টারভিউ সবার প্রথমে পাবে (সফল ভাবে শিখলে)







Friday, February 24, 2023

জীবিকা এবং জীবন- ১ঃ সন্তান কোন স্ট্রিমে পড়াশোনা করবে? তার ফিউচার কি?

 সন্তান কোন স্ট্রিমে পড়াশোনা করবে? তার ফিউচার কি?

বিপ্লব পাল, ২৪শে ফেব্রুয়ারী
(১)
আমি ফেসবুক ইনবক্সে, এই প্রশ্নটাই সব থেকে বেশী পাই। অবশ্যই বাবা-মাদের কাছ থেকে। ভারত বা বাংলাদেশে বাবা-মা ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যত নিয়ে অনেক বেশী চিন্তিত। আমেরিকাতে এই ধরনের সন্তানচাপ অনেক কম।
এখন মৌলিক প্রশ্ন হচ্ছে- আপনি যখন জিজ্ঞেস করছেন আপনার ছেলে বা মেয়ে কি নিয়ে পড়াশোনা করলে "ভাল" হয়, তখন আপনি আসলেই কি জানতে চাইছেন?
#১ কি নিয়ে পড়াশোনা করলে আপনার সন্তান অনেক বেশী রোজগার করবে?
# ২ কোন সাবজেক্ট নিয়ে পড়লে আপনার সন্তানের চাকরির নিরাপত্তা জীবনের নিরাপত্তা সব থেকে বেশী?
# ৩ কোন সাবজেক্ট নিয়ে পড়লে আপনার সন্তানের নামডাক হবে? সে একটা লেগাসি ছেড়ে যেতে পারবে?
আমি যদ্দুর বুঝি, অধিকাংশ অভিভাবক #১ এবং # ২ চাইছেন। # ৩ কোন কোন ক্ষেত্রে।
দুঃখের ব্যাপার, কোন অভিভাবক বোধ হয় জানতেও চান না, কোন কেরিয়ারে গেলে তার সন্তান মনেপ্রাণে সুখী হবে। জীবনে পূর্নতা পাবে।
(২)
এই #১ এবং #২ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে, ছেলেমেয়ে মানুষ করার ব্যপারে আমার নিজস্ব বক্তব্যটা বলা জরুরী।
"সফল" মানুষ কে, তার ব্যাখ্যা একেকজনের কাছে একেক রকম। আই আই টি খরগপুরে আমার অনেক বন্ধুই বৈবাহিক জীবনে ডিভোর্স মামলা ইত্যাদিতে এত ঘেঁটে আছে হয়ত তাদের থেকে অনেক নিম্নমেধার অতিসাধারন ছেলেমেয়েরা হয়ত গ্রামে প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক বা সাধারন চাকরি করে অনেক ভাল আছে। আমেরিকাতে আমার একদা এক সহকর্মী- এখানকার সেরা বিশ্ববিদ্যালয় এম আই টির গ্রাজুয়েট ছিল। লোকটি যথাযত মেধাবী। কিন্ত সে কিছুতেই কাজে মন দিতে পারত না। তার চতুর্থ বিয়ে চলছে-এর আগের সব ডিভোর্সে জীবনের সব সঞ্চয় হারিয়েছে। এবার ছেলেমেয়ের কাস্টডি-ইত্যাদি নিয়ে প্রায় সব এক্স-ওয়াইফদের সাথে এত ঝামেলা, লোকটাকে আমি কিছুতেই প্রোডাক্টিভ করতে পারি নি। এগুলো ব্যতিক্রম কেস না। আই আই টিতে প্রচুর সুইসাইড কেস নিজে দেখেছি। এখনো হচ্ছে।
পয়েন্ট টু নোট- জীবনে লেখাপড়া, ভাল বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদির থেকেও বেশী জরুরী-
-- সঠিক সিদ্ধান্ত নিওয়ার ক্ষমতা। রাইট জাজমেন্ট। এটি শুধু পড়াশোনার সাবজেক্ট নিয়ে বসে থাকলে হবে না। সাথে সাথে দর্শন, মনোবিজ্ঞান, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি-সব কিছুরই ভাল ফাউন্ডেশন দরকার।
- সুস্থ থাকা। মানসিক এবং শারীরিক দিয়ে। এর জন্য শরীরচর্চা, মনের চর্চা, ঘুম ইত্যাদির দরকার। আজকের ছেলেমেয়ের হাতে স্মার্টফোন, অর্ডার করলে পিজ্জা-আর ঘর থেকে বেড়োলেই দূষন। স্মার্টফোনে চ্যাট করে, গেম খেলে ঘুমের বারোটা বেজে গেছে প্রায় সবার। ফার্স্টফুডের দৌলতে খাবার ও আনহেলদি। ফলে অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীই ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছে। এক্সট্রিম কেসে সুইসাইড। এগুলো হত না যদি বাবা-মায়েরা ছেলেমেয়েদের শরীর চর্চা অর্থাৎ ফিল্ডগেম বা মনের চর্চা-যেমন সঙ্গীত, আর্টস, সাহিত্য এগুলোও মনোযোগ দিয়ে শেখাতেন।
প্লেটোর শিক্ষাচন্তায় এই দুটিদিক খুব আলোচিত। আমি বুঝতে পারি না, ২৪০০ বছর বাদে যখন ভারতে একটা শিক্ষা ব্যবস্থা চলছে সেখানে স্কুলে কেন শরীর এবং মন উপেক্ষিত? কারন যেটুকু বুঝি, ভারতের শিক্ষা থেকে পুলিশ, আই এ এস থেকে রেইল-সবই বৃটিশ কলোনিয়াল দান। দাসবৃত্তির পরস্পরা।
ফলে এই শিক্ষায় শরীর এবং মন গঠন করার বদলে কে কম্পিউটার সায়েন্স- কে কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়বে-তাই নিয়ে বাবা-মারা বেশী চিন্তিত!
আমার কাছে শরীর এবং মন তৈরী করাটাই আসল। কি সাবজেক্ট শিখল সেটার গুরুত্ব তারপর। কারন শরীর এবং মন হচ্ছে শিক্ষার আধার। শরীর আর মন ঠিক না থাকলে-শিখবেই বা কি করে? ডিপ্রেশনে গিয়ে সুইসাইড করে ফেলবে ত!
(৩)
এবার আসি কোন সাবজেক্ট-কোথায় কি পড়বে। ভাল জায়গায় যদি চান্স না পায়!!!!!
এই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের যুগে ভবিষ্যতই বা কি?
এবার কিছু প্রাক্টিক্যাল দিকে দৃষ্টি আকর্ষন করি। মানে কিছু ফ্যাক্ট লিখি
-আজকে অধিকাংশ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত আই টি বা সফটওয়ারের চাকরি করে খাচ্ছে। এই চাকরিগুলি আজ থেকে ২০-৩০ বছর আগে বাজারে ছিল না। আপনার ছেলেমেয়েরা যে চাকরি গুলি করবে সেগুলি এখনো জন্মায় নি।
- এই মুহুর্তে জব মার্কেটে স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটির শিক্ষা সম্পূর্ন "ইউজলেস"। শিক্ষকতা আর সরকারি চাকরি ছাড়া-এগুলো কাজে আসবে না। গুগুল, ফেসবুক, টেসলা-আমেরিকার সব বড়বড় কোম্পানীগুলি বর্তমানে "ডিগ্রির" বদলে নিজেদের সার্টিফিকেট প্রোগ্রাম চালু করেছে। "স্কিল" থাকলে, সেখানে পরীক্ষা দিয়ে, বা শিখে যে কেউ ডিগ্রি না নিয়েও চাকরি পেতে পারে। ভারতে টিসিএস , ইনফি এরাও একই দিকে যাচ্ছে। এটাই ভবিষ্যত। শেখাটাই আসল। সরকারি চাকরি না থাকলে, ডিগ্রি সম্পূর্ন অপ্রয়োজনীয় হতে চলেছে। শিক্ষা --> স্টান্ডাইজড টেস্ট--> ইন্টারভিঊ এই ভাবে চলবে ভবিষ্যত।
- স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যেটুকু জব শেখার স্কিল- তা খুব সীমিত। মূলত চাকরিতেই স্কিল শিখতে হয়। সেইজন্য জীবনের প্রথম ২-৩ টে চাকরি কোথায় করবে-তার খুব গুরুত্বপূর্ন। সেখানে স্কিল শেখা এবং শেখানোর লোক থাকা সব থেকে বেশী জরুরী।
- চাকরির ক্ষেত্রে- তা যদি সরকারি বা শিক্ষকের চাকরি না হয়-শুধু ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি বা শুধু কোডিং, বা শুধু স্টাটিসস্টিক্স শিখে হয় না। কারন তাকে অন্যদের কাজ ও বুঝতে হবে। সুতরাং সর্বদা সব সময় নতুন কিছু শেখার মনোভাব রাখতে হবে।
- কিছু কিছু জিনিস স্কুল লেভেলে ভাল না শিখলে মুশকিল। প্রথমটা হচ্ছে ভাষাজ্ঞান। কমিউনিকেশন স্কিল। এটি হচ্ছে স্কিল অব দ্যা স্কিলস। শুধু ইংরেজি গ্রামার বা শব্দ জানলেই হবে না। সঠিক ভাবে কি করে গুছিয়ে নিজের বক্তব্য রাখতে পারবে- সেটা আরো বেশী জরুরী। কমিউনিকেশন স্কিল ভাল না হলে শুধু কোন সাবজেক্ট জেনে লাভ নেই। দ্বিতীয় হচ্ছে সংখ্যাতত্ত্বের বেসিক। আর কোডিং বেসিক। যারা টেকনিক্যাল লাইনে থাকবে, তাদের এই তিনটি স্কিল মোটামুটি ৭০%। বাকী ৩০% হচ্ছে নিজেদের সাবজেক্ট।
- আই টি, কম্পিউটার সায়েন্স, ইলেকট্রনিক্স, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যাথ, স্টাট- যেকোন সাবজেক্ট শিখলেই ভাল চাকরি পাবে। যদি বাকি তিনটে প্রাথমিক স্কিল থাকে। কিন্ত সমস্যা হচ্ছে কেউ শেখে না। সবাই মার্কস পাচ্ছে। ডিগ্রি পাচ্ছে। এসব বোগাস । ভারতের ৯৮% গ্রাজুয়েট এম্পয়েবল না।
-কেন শেখে না-সেই প্রশ্ন ওঠাও জরুরী। কারন সে ত নিজে থেকে এটা করছে না। বাবা-মা চাপ দিয়ে পড়তে পাঠাচ্ছে। যে শিক্ষক শিক্ষিকা পড়াচ্ছে, তারাও সেই চাপের প্রোডাক্ট। আমার নিজের অভিজ্ঞতা শিক্ষক এর ও ৯৭%+ ইউজলেস। কিন্ত এটা ইউ টিউব, উইকিপেডিয়া এখন চ্যাট জিপিটির যুগ। ইউ টিউবে শেখা যেকোন ক্লাশে শেখার থেকে অনেক গুন ভাল। কিন্ত সেই প্রশ্ন- একজন শিখবে কেন? কোথা থেকে সেই অনুপ্রেরণা পাবে?
এখানেই বুঝতে হবে আপনার সন্তানকে না চাপ দিয়ে, "ভাল লাগতে" শেখান। তার গান, ছবি, কবিতা ভাল লাগুক। গান, ছবি কবিতা এসব ভাল লাগলে, তবেই সে ফিজিক্স কেমিস্ট্রি এলগোরিদমের মধ্যে ছবি এবং ছন্দ দুই খুঁজে পাবে। তবে না সে একটা সাবজেক্টকে ভালবাসতে পারবে!
-শিখতে ভাল লাগা কেন জরুরী? কারনটা আগেই লিখেছি। স্কিল দ্রুত বদলাচ্ছে। নতুন নতুন চাকরি আসছে। পুরাতন চাকরির বাজার ছোট হচ্ছে। প্রতিদিন নতুন নতুন শেখার নেশা না থাকলে, ভবিষ্যতের মার্কেটে সে টিকতে পারবে না।
৪)
ভবিষ্যত কি?
সরকারি চাকরি, স্কুলের চাকরি এসব থাকবে বলে আমার মনে হয় না। কারন গণতন্ত্রে এখন জনগনকে সরাসরি ঘুঁশ দিয়ে ভোট টানার কাল। সুতরাং বাজেট যাবে ইউ বি আই বা উনিভার্সাল বেসিক ইনকামের দিকে। ফলে সরকারি কাজে অটোমেশন আসছে- আরো বেশী আসবে। এতে সরকারের দক্ষতা বাড়বে। বাজেট কমবে। সরকার জনগনের একাউন্টে আরো বেশি টাকা দিতে পারবে। ফলে সরকারি চাকরির স্কোপ কমতেই থাকবে।
আর বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও ক্রমাগত কম লোক লাগবে। কারন অটোমেশন এ আই।
কিন্ত নতুন নতুন বেসরকারি ক্ষেত্র খুলতেই থাকবে। যেমন আজ থেকে ২০ বছর আগেও শরীরচর্চা বা জিম ইন্সট্রাকটর যে একটা পেশা হতে পারে সেটাই কেউ ভাবে নি। কিন্ত এখন দেখুন পাড়ায় পাড়ায় জিমের দরকার। মনোবিদদের কাজ ও দ্রুত বাড়ছে। ফলিত গবেষনার ক্ষেত্র আরো অনেক বাড়বে।
যারা মানুষের হেলথ নিয়ে কনস্যাল্টন্সি করে-শুধু ডাক্তার না- মনোবিদ, ডায়েটিশিয়ান, জিম ইন্সট্রাকটর এসবের চাহিতা হু হু করে বাড়বে।
আন্তারপ্রেনারদের চাহিদাও বাড়বে। কারন তা না হলে, নতুন ব্যবসা তৈরী হবে না। নতুন ফিল্ডে, নতুন চাকরি তৈরী হবে না। ভবিষ্যতে ব্যবসার স্কিলটাও বেসিক স্কিল হিসাবেই ধরতে হবে।
জীবন আসলেই খুব জটিল। শুধু চাকরি করে, টাকা উপার্জন করে জীবন তৈরী হয় না। কবিতা গান প্রেম ভ্রুমন এসব বাদ দিয়ে শুধু টাকা উপার্জন হচ্ছে কলুর বলদগিরি।

Sunday, February 19, 2023

ভাষা দিবসের প্রাক্কালে- আমার বাংলা ভাষা ভাবনা

 ভাষা দিবসের প্রাক্কালে- আমার বাংলা ভাষা ভাবনা

বিপ্লব পাল, ২০ই ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

(১)
ভাষা আবেগের অন্য নাম। আপনি যখন স্বপ্ন দেখেন বা যখন অবচেতন মনের দৈত্য, আপনার সাথে একান্তে নিভৃতে কথা বলতে চায়-তখন আপনি কোন ভাষায় কথা বলেন? সেই ভাষাটি চিনেছেন কি যে ভাষায় আপনি স্বপ্নে কথা বলেন?

 ওটিই আপনার আসল ভাষা!

আমি ভাষাবিদ নই। ভাষার গঠন এবং গ্রামার নিয়েও আমার ধারনা দুর্বল। তবে ওয়েবে বাংলায় লিখছি বহুদিন। লেখার মধ্যে অসংখ্য বানান এবং ব্যাকারন-দুই এরই মা-মাসি করে লিখি। আসলে বিশুদ্ধ বাংলা বা বিশুদ্ধ ভাষায় বিজ্ঞান-প্রযুক্তি চর্চা হতে পারে- কিন্ত সাহিত্য, গান- বা সাধারনের জন্য লেখালেখির ক্ষেত্রে অশুদ্ধ বা আঞ্চলিক ভাষা অনেক বেশী কার্যকরী। আমি এই লেখা লিখছি মূলত একজন প্রযুক্তিবিদ হিসাবে এবং ইতিহাস যেটুকু বুঝি, তার প্রেক্ষিতে। ভাষার সাথে ইতিহাস দর্শন মনস্তত্ব সাহিত্য পুঁজি রাজনীতি প্রযুক্তি-সবকিছুই জড়িত। তাই শুধু গ্রামার বা শুধুই সাহিত্যের ইতিহাস দিয়ে একটা ভাষাকে দেখা-নেহাতই মায়োপিক চিন্তা। যা শুধু ভাষাভিত্তিক সঙ্কীর্নতার ধাত্রীগৃহ।

তাছারা এই চ্যাটজিপিটির যুগে ভাষার ভবিষ্যতই বা কি?  

(২)
প্রথমে ইতিহাসে দেখি। প্রথম লিখিত ভাষার উদ্ভব  মেসোপটেমিয়াতে। সুমেরু সভ্যতার ট্যাবলেট। ইজিপ্সিয়ানরাও লিখতে জানত। হরপ্পানরাও জানত। একটা ব্যাপারত পরিস্কার। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সেই ব্রোঞ্জযুগেও ছিল। আজ থেকে চার হাজার বছর আগেও ভারত ইউরোপ, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যের সাথে বাণিজ্য করছে। একে অন্যের ভাষা না জানলে সেটা সম্ভব হত?

আরেকটা টুইস্ট দিই ইতিহাস থেকে। বৃটিশ বা ইউরোপিয়ানরা ভারতে বাণিজ্য শুরু করে মোটামুটি মুঘল আমলের শুরু থেকে। মুঘল আমলের শেষের দিক থেকে তারা রাজনীতিতে সক্রিয় হয়। আচ্ছা আজ থেকে ৩০০ বছর আগে, একটা বিদেশীদের দল-যারা গোটা ভারতে সংখায় ২০,০০০ ও ছিল না- তারা কি করে ভারতের মতন একটা ভূখন্ড দখল করে বসল? তারা কিভাবে ভারতের স্থানীয় ভাষা শিখল? কি ভাবে কোন ভাষাতে ভারতীয়দের সাথে ব্যবসা করত?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তরে আমি তিনটে তথ্য উপস্থাপন করব

#১- বাংলা ভাষার অভিধান, মানে প্রথম ডিকশনারি কে লেখে? কবে লেখা হয়? বাংলা ভাষার প্রথম ডিকশনারি "Vocabulario em Idioma Bengalla e Portuguez " বাংলা-পর্তুগীজ-ফ্রেঞ্চ। প্রকাশিত পতুগালের লিসবন থেকে ১৭৪৩। সংকলক একজন পাদ্রী- ফাদার মানোয়েল ডে এদামকাম। যিনি ঢাকা এলাকায় দীর্ঘদিন ছিলেন। বইটি ছোটখাট না- ৬০৮ পৃষ্ঠার। মূলত বাংলায় ব্যবসা করতে আসা ইউরোপিয়ান বণিকদের জন্য এটি লেখা। বাংলা শব্দগুলি রোমান হরফে মুদ্রিত।

#২  বৃটিশরা যখন পলাশীর যুদ্ধেরপর গোটা ভারতে ক্ষমতা দখল করছে-তখন বাংলার যেসব ব্যক্তিরা তাদের সহায়ক ছিলেন-বা তখন যে শ্রেনীটি ফুলেফেঁপে ওঠে- যেমন বাবু নবকৃষ্ণ, রাজা রামমোহন, প্রিন্স দ্বারকানাথ-এদের "মূল" কোয়ালিফিকেশন কি?  একটা সাধারন প্যাটার্ন আপনারা দেখতে পারেন। ইনারা সবাই ফার্সি, ইংরেজি, বাংলা, সংস্কৃত, হিন্দুস্থানী -একাধিক ভাষা বলতে এবং লিখতে পারতেন। 

# ৩ আজকে হিন্দি এবং বাংলা ভাষার যে রূপ দেখছি- উভয়ের রূপকার বৃটিশরা।  বিদ্যাসাগরকে বিশুদ্ধ বাংলা ভাষা তৈরীর ঠিকেদারি বা হিন্দুস্থানী ভাষাকে ভারতের যোগসূত্র হিসাবে গড়ে তোলা-যা মুঘল আমল থেকে শুরু হয়েছিল- এসব কিছুই বৃটিশ প্রশাসকদের দান। কিন্ত কেন? কারন একটাই। ভাষার স্টান্ডার্ডাইজেশন ছাড়া, প্রশাসন চালানো মুশকিল। বৃটিশরা এটা বুঝতেন। কেননা তাদের ইউরোপের অভিজ্ঞতা। গোটা ইউরোপের অধিকাংশ তখন হ্যাসবার্গ রাজন্যবর্গদের অধীনে। এই সমস্যাটা তারাও বুঝতেন বলে, অস্ট্রোহ্যাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য থেকে জারের সাম্রাজের ভাষা পলিসিতে "রাজভাষার" পলিসি খুব গুরুত্বপূর্ন ছিল। বৃটিশরা যার জন্যে ভারতে "সাম্রাজ্য" প্রতিষ্ঠার স্বার্থেই বাংলা বা হিন্দি ভাষার গ্রামার থেকে স্টান্ডাডাইজশনে টাকা খরচ করে। বিদ্যসাগর সেই কলোনিয়াল পুঁজির ইচ্ছা পূরন করেছিলেন মাত্র। 

                 (৩)
 সুতরাং...।

  ভাষার আসল চালিকা শক্তি পুঁজি, এবং পুঁজির সব থেকে বড় ইঞ্জিন শাসক কূলের প্রশাসন।  সাহিত্য গান  পৃথিবীর হাজার হাজার ভাষায় লেখা হয়েছে। তাদের ৯৯% আজ বিলুপ্ত। কারন তাদের পেছনে কোন পুঁজি নেই।  ভাষাকে একটা বিজনেস মডেলের অংশ হতেই হবে। নইলে সে বিলুপ্ত হবেই। যেসব ভাষা পৃথিবীতে এখনো বৃহৎ ভাষা হিসাবে টিকে আছে-তাদের পেছনে পুঁজি এবং রাজন্যবর্গের ভূমিকা আছে। বাংলা ভাষা হিসাবে যে একটা বড় ভাষা- তার মূল কারন মুঘল আমলে বাংলা বানিজ্য। বাংলার সমৃদ্ধি। যার টানে গোটা ইউরোপের বণিকরা বাংলায় একদিন বানিজ্য করতে এসেছে। পশ্চিম থেকে মারোয়ারি সহ বেনিয়া সম্প্রদায় এসেছে।  বাংলার পুঁজির টানেই ফাদার মানোয়েল বাংলা-পর্তুগীজ অভিধান লিখেছেন ইউরোপিয়ান বণিকদের জন্য। এবং তা লিসবন থেকে ছাপা হয়েছে। ৬০৮ পৃষ্টার একটা  বাংলা অভিধান  ছাপানোর খরচ ১৭৪৩ সালে কি হতে পারে? তার খরচ কে এবং কেন দিয়েছিল?  
 
কোলকাতার বইমেলা সবে শেষ।  প্রচুর বাঙালী লেখক এখন। ১০০ টা বই বিক্রি হয়েছে এমন বাঙালী লেখকের সংখ্যা আঙুলে গোনা যাবে।  বাংলার পাঠক নেই? ইউটিউবে কোন কোন বাংলা গান দুই থেকে পাঁচকোটি বার লোকে শুনেছে-তাও দেখি। 

আসলে দুটো ব্যপার লক্ষ্য করুন। 

#১  ফেসবুকের লেখা, ইউটিউবের বাংলা গান বা বাংলা নাটক-এসবের প্রচুর পাঠক আছে। কারন ফ্রি।  এর মধ্যে ইউটিউব বা ওটিটির দৌলতে তাও গান বা সিনেমা বা ওয়েব সিরিজের একটা ইকনমি আছে- মানে- লোকে দেখে-তাতে এডসাপোর্টেড রেভিনিউ বা সাবস্কিপশন রেভিনিউএর জন্য বাংলার কনটেন্ট ক্রিয়েটররা কিছু হলেও পাচ্ছে। কিন্ত যারা বাংলাই উপন্যাস বা গল্প লিখছেন-সবাই এখন সৌখিন লেখক। কোন মার্কেট নেই। ইকনমি নেই। ইকোসিস্টেম নেই। 


  নেটফ্লিক্সে বা আমাজন প্রাইমে গোটা ভারত এবং বিদেশ মিলিয়ে ধরুন ৫ লাখ বাঙালী সাবসস্ক্রাইবার আছে। হয়চই প্ল্যাটফর্মে হয়ত বেশী। এই ৫ লাখ হয়ত কিছুই না-নেটফ্লিক্সের মোট ৭৫০ লাখ সাবস্ক্রাইবারের মধ্যে। এমন কি ভারতের ৫০ লাখ সাবস্ক্রাইবার  ও নস্যি। 

# ২ কিন্ত এই ওটিটি প্ল্যাটফর্ম গুলোর আন্তর্জাতিক এক্সেসের কারনেই, আজ বাংলায় ওয়েব সিরিজ করে গোটা বিশ্বে দেওয়া সম্ভব ইংরেজি ডাবিং করে। কারন ৫ লাখ  বাঙালী সাবস্ক্রাইবার থেকে নেটফ্লিক্সের আয় খুব বেশী হলে ৩০-৪০ কোটি ( বাৎসরিক)। যা কিছুই না। সেই জন্য হিন্দি ওয়েব সিরিজ ও আজকাল ইংরেজিতে ডাব করা হচ্ছে-আর স্টোরি লাইন গুলো আন্তর্জাতিক। এটা হচ্ছে যাতে এগুলি ওই ৭৫০ লাখ সাবসক্রাইবারদের মধ্যে অন্তত যদি ১০০ লাখ দেখে-যাদের মাতৃভাষা হয়ত বাংলা বা হিন্দি না। তাহলে ওয়েব সিরিজ বানানোর ৩০-৫০ কোটি খরচ উঠে আসবে। 

 এখন প্রশ্ন উঠবে এই মাস মার্কেটের জন্য লিখে কি নোবেল প্রাইজ তুল্য সাহিত্য হবে?  মার্কোয়েজের অনেক উপন্যাসের সিনেমাটিক ভার্সন আমি নেটফ্লিক্সেই যদিও প্রথম দেখি। আন্তর্জাতিক মার্কেটের জন্য লিখলে, সেটা আর যাইহোক বর্তমান বাঙালী পাঠকের থেকে অনেক বেশী বিদ্গধ এবং ম্যাচিওরড মার্কেটের জন্য লেখা হবে। ভালোই হবে। 

 কিন্ত এখানেই সমস্যা। বাংলায় আন্তর্জাতিক মানের ওয়েব সিরিজ বানালে বিক্রির অসুবিধা নেই। কিন্ত লিখবেটা কে? বাংলায় সেই গোত্রের লেখক নেই। আর শুরুর ইনভেস্টমেন্ট প্রায় ১০-২০ কোটি টাকার। সেটাই বা কে দেবে ? আসলে পুরো সমস্যাটাই পুঁজির। দক্ষিনে পুঁজির সমস্যা নেই। ফলে তেলেগু, তামিল ভাষার ওয়েব সিরিজ দেদার আসছে আন্তর্জাতিক মার্কেটে। 

 বাংলা ভাষায় উন্নত মানের সিনেমা, ওয়েব সিরিজ, উপন্যাস ( কবিতা , গান এগুলোতে কম ইনভেস্টমেন্ট-তাই অসুবিধা নেই)  এগুলোর মূল অন্তরায়-বাঙালীর পুঁজির অভাব।  ভাষা আবেগে টেকে  না। ভাষার পেছনে পুঁজির জোর দরকার। 

 ধরুন একজন বাংলা ভাষায় দুর্দান্ত একটি উপন্যাস লিখবেন।  লোকটিকে প্রচুর পড়াশোনা করে সেটি লিখতে হবে। ছমাসের ধাক্কা। এবার ছমাস খরচ করে একটি উপন্যাস লিখলে, এটলিস্ট লোকটির ১০-২৫ লাখটাকা সেই সাহিত্যকর্ম থেকে পাওয়া উচিত।  এখন একটি বই থেকে ৫০ টাকা রইয়ালিটি পেলে- অন্তত ২০,০০০-৫০,০০০ বই বিক্রি হলে, সেই টাকা উঠবে। যা বর্তমানে প্রায় অসম্ভব। কিন্ত ওই উপন্যাস থেকে ওয়েব সিরিজ হলে-যার বাজেট প্রায়শ ৫-৫০ কোটি টাকার মধ্যে থাকে, ১০ লাখ টাকা রইয়াল্টি সম্ভব। 

 কিন্ত সেই ইকোসিস্টেম তৈরী না হলে-বাংলা ভাষায় সাহিত্যকর্ম সেই টিম টিম করেই চলবে। লোকে চাকরি করতে করতে হবি হিসাবে লিখবে।  এইভাবে ভাল সাহিত্য অসম্ভব। 

(৪)
ভবিষ্যত কি? 
 আমরা ট্রান্সহিউম্যান সভ্যতার দিকে এগোচ্ছি। ট্রান্সহিউম্যানিজম মানে আমরা লেখা শোনা কর্মে প্রযুক্তির সাহায্য আরো বেশী নেব। যেমন--

যেমন ধরুন আমি   ফেসবুকে বাংলায় লিখলেও এখন একটা মোটামুটি ট্রান্সলেশন [ যার অধিকাংশই ভুল]-ইংরেজি ফিডে চলে আসে। কিন্ত লার্জ ল্যাঙ্গোয়েজ মডেলের দৌলতে, যা হয়ত ফেসবুকে শীঘ্রই দেখতে পাব-গুগুল ব্লগেও পাব- আমি কোন ভাষায় লিখছি-এটা গুরুত্বপূর্ন হবে না।  সবকিছুর ঠিকঠাক ইংরেজি ট্রান্সলেশন আমরা শীঘ্রই দেখতে পাব।
 
 কারন রিয়াল টাইম ট্রান্সলেশন সম্ভব হবে। অর্থাৎ কেউ জাপানী বললেও, আমরা শুনতে পাব বাংলা বা ইংরেজিতে। এমন ডিভাইস এখনই কিনতে পাওয়া যায়। লার্জ ল্যাঙ্গোয়েজ মডেলে এগুলি আরো উন্নত হবে। অর্থাৎ ধরুব ওয়েব সিরিজ বানানো হল বাংলায়- কিন্ত বিশ্বের লোক শুনতে পাবে তাদের মাতৃভাষায়।  এগুলো আর কল্পবিজ্ঞান না। এই দশকেই আমরা এর ব্যপক ইউজ দেখতে পাব।

  তাহলে বাংলায় ভাল উপন্যাস লেখায় সমস্যা কি? ওই যে বল্লাম পুঁজি।  আপনি সব কিছু ছেড়ে ছমাস ধরে যে বাংলায় একটা মারকাটারি উপন্যাস লিখবেন-যার থেকে ধরুন নার্কোস বা ওই ধরনের দুর্ধষ্য ওয়েব সিরিজ সম্ভব- সেই রিস্ক কে নেবে? রিওয়ার্ড কোথায়? 

 আমার ধারনা এটা আসবে।  লার্জ লাঙ্গোয়েজ মডেল ট্রান্সলেটর চলে আসার দিন সমাগত। 

(৫)
 হিন্দির বিরুদ্ধে আন্দোলন সময় নষ্ট। ভারতের কারুর মাতৃভাষা হিন্দি না। হিন্দি-যা হিন্দুস্থানী থেকে আগত-তাহল ভারত নামক এই রাষ্ট্রের ইতিহাসের  অবিচ্ছেদ্য অংশ।  মুঘলরা এই রাষ্ট্রের প্রয়োজনেই হিন্দুস্থানী শুরু করে। বৃটিশরা সেই কাজ এগিয়ে দিয়েছে। বর্তমানের ভারত সরকার সেই কাজ সম্পূর্ন করতে চাইছে।  বলিউড যারা তৈরী করেছেন, সেইসব নায়ক নায়িকা- কারুর মাতৃভাষা হিন্দি না। আজকেও বলিউডে হিন্দি স্ক্রিপ্ট রোমানে লেখা হয়।  এটা বুঝতে হবে হিন্দির পেছনে আছে ন্যাশানাল ক্যাপিটাল।  

কিন্ত হিন্দির এই কানেক্টিং ক্ষমতাটাই অপ্রয়োজনীয় হতে চলেছে লার্জ ল্যাঙ্গোয়েজ মডেলের দৌলতে। যদি মাতৃভাষার রিয়াল টাইম ট্রান্সলেশন সম্ভব হয়-তাহলে কিভাষায় অনুষ্ঠান হচ্ছে-কিভাষার সিনেমা-কিছু যায় আসে না।  কারন শুনছি মাতৃভাষাতে। ভারতে এটা হচ্ছে। সব ন্যাশানাল সিরিয়াল আঞ্চলিক ভাষায় হচ্ছে। আঞ্চলিক ভাষার সিনেমা হিন্দীতে ডাব করে বলিউডের মার্কেট ধরছে। কারন? তাদের সেই "গল্প" আছে। 
 
বাঙালী পারছে না। তামিল তেলেগুরা পারছে।  কারন ওদের পুঁজি আছে। বাঙালীর নেই। পুঁজি না থাকলে আবেগে ভাষা বা জাতি কোনটাই টিকবে না। 

সুতরাং বাংলা ভাষার ভবিষ্যত বাঙালী পুঁজির ওপর নির্ভরশীল। বাঙালীর হাতে পুঁজি থাকলে এই ভাষা টিকবে। পুঁজি না থাকলে, তা সম্ভব না।  কিছু পাগোল ছাগল নিজের বই নিজেরা ছাপাবে-নিজেরাই পড়বে।  ফেসবুকের বন্ধুরা তা না পড়েই আহ কি লিখেছিস বলে চুলকে দেবে। ওই দিয়ে ভাষা টিকবে না।  বাংলা  ভাষাকে কেন্দ্র করে বৃহৎ কনটেন্ট বাণিজ্য দরকার। 



Sunday, February 12, 2023

আদানী বনাম হিন্ডেনবার্গ- নেপথ্য ভাষন-১

 আদানী বনাম হিন্ডেনবার্গ- নেপথ্য ভাষন

বিপ্লব পাল, ২৯শে জানুয়ারী
আদানী গোষ্টির বিরুদ্ধে হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের জালিয়াতির অভিযোগে শুধু ভারত না, গোটা পৃথিবীই উত্তাল। হিন্ডেনবার্গের মতে আদানী পৃথিবীর ইতিহাসের বৃহত্তম জালিয়াতি করেছেন। হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের রিপোর্ট নানান কারনে বিশ্বাসযোগ্য --
(১) তারা তাদের রিসার্চ জন সমকক্ষে এনেছেন এবং আদানী গ্রুপকে তা ভুল প্রমানিত করতে আহ্বান করেছেন
(২) এর আগে হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ প্রায় ১৭টি কোম্পানীর বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ এনেছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল নিকোলা ট্রাক কোম্পানী। প্রতিটি ক্ষেত্রেই কোর্টে জালিয়াতি প্রমানিত। নিকোলার মালিক ট্রেভর মিল্টন এখন আমেরিকার জেলে যাওয়ার অপেক্ষায়। তার অপরাধ কোর্টে প্রমানিত। সুতরাং হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ কর্পরেট জালিয়াতি ধরার জন্য পৃথিবীর সব থেকে সমর্থ কোম্পানী। তাদের ট্রাক রেকর্ড ১০০%।
(৩) হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ, আদানীগোষ্টিকে আমেরিকান কোর্টে মামলার জন্য আহ্বান করছে প্রকাশ্যে। তারা জানে আদানীর সেই ক্ষমতা নেই। কারন সব কর্পরেটের পাছাতেই গু লেগে থাকে। তা শেয়ারহোল্ডাররা জানে না। কোর্টে গেলে, সেসব ও বেড়িয়ে আসবে। সেই রিস্ক আদানী নেবে না। সুতরাং এখনো পর্যন্ত আদানী গোষ্টী হিন্ডেনবার্গের একটি অভিযোগ ও খন্ডাতে কোর্টের দ্বারস্থ হয় নি। শুধু মিডিয়াতে বক্তব্য রেখেছে।
(৪) হিন্ডেলবার্গ রিসার্চ শর্টসেলার ফার্ম। অর্থাৎ তারা শেয়ারবাজারে বেট করেছে আদানীর শেয়ার ভ্যালু কমবে। এবং তাদের বেট ফেইল করলে হিন্ডেলবার্গ রিসার্চ হাজার হাজার কোটি টাকা হারাবে। সুতরাং, তারা সব দিক না দেখে এই রিসার্চ রিপোর্ট ছাড়ে নি। ভুল হলে, তাদের প্রচুর লসের সম্ভাবনা।
আদানী গোষ্ঠীর শেয়ার জালিয়াতি থেকে ভারতের কি কি শিক্ষা নেওয়া উচিত, সেটাও হিন্ডেল্বার্গ রিসার্চ রিপোর্টেই আছে -
(১) ভারতের শেয়ার মার্কেটে এক্টিভিস্ট শর্ট সেলার কম। ফলে ভারতের শেয়ার মার্কেটে জালিয়াতির সম্ভাবনা ১০০%। কারন ভারতের মার্কেট কন্ট্রালাররা সবাই রাজনৈতিক পার্টির সাপোর্টে ক্ষমতায় আসে। আদানির জালিয়াতি ভারতের মার্কেট কন্ত্রোলার (সেবি) ধরতে গেলে, সেবির চেয়ারম্যানের চাকরি যাবে আগে।
(২) আদানির বিরুদ্ধে অভিযোগ অনেক। ইন্সাইডার ট্রেডিং, মানি লন্ডারিং থেকে একাউন্টিং জালিয়াতি। এগুলো সেবি দেখেও দেখে নি। তার কারন ও হিন্ডেল্বার্গ রিপোর্ট বলছে- যারাই আদানি গোষ্ঠির বিরুদ্ধে বলতে গেছে তারা চাকরি হারিয়েছে, না হলে জেলে, নইলে স্বর্গে!
(৩) সুতরাং এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে , ভারতে মার্কেট কনফিডেন্স ফেরাতে হিন্ডেল্বার্গের আহ্বান-যে ভারতে এক্টিভিস্ট শর্টসেলার আরো সক্রিয় হোক-যারা কর্পরেট জালিয়াতির ধরবে এবং তার থেকে শর্ট সেলিং করে লাভ করবে। এতে মার্কেটের ওপর বিশ্বাস আরো বাড়বে।
তবে ব্যপারট এত সহজ সরল না। এটা সামনের খেলা। এর পেছনে আছে আরো নেপথ্য সমীকরন।
#১ বিজেপির টাকার উৎস কে বা কারা সবাই জানে। এটাও সবাই জানে আগামী ১০ বছরে বিজেপিকে সরারনোর সম্ভাবনা কম। তার কারন ও সেই টাকার উৎস। তারা টাকা দিয়েই রাজনীতি মিডিয়া সব কিনে নিয়েছে। সুতরাং ভারতের বিদেশ নীতি কন্ট্রোল করতে গেলে, সেই টাকার উৎসে নিয়ন্ত্রন দরকার। ভারত প্রায় স্বাধীন ভাবে বিদেশ নীতি নির্ধারন করছিল- রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে তা প্রমানিত।
এখানে আরেকটা জিনিস অনেকেই জানে না। আদানীর ইনভেস্টর বা লোনারদের মধ্যে এখন ৬০% ই বিদেশী। দেশী ব্যাঙ্কগুলো এখন মাইনরিটি। তাদের মধ্যে অধিকাংশই মিডল ইস্টের তেলের টাকা-সভারেন ফান্ড।
ভারতের বিদেশনীতি এবং ভারতের রাজনীতি নিয়ন্ত্রন করতে [ যা যে কোন বিদেশী শক্তিই চাইবে] আদানীকে নিয়ন্ত্রনে আনা জরুরী-কারনে সেক্ষেত্রে বিজেপিকে নিয়ন্ত্রন করা যাবে অনায়াসে।
# ২ যদি ধরেও নিই আদানী ১০০% জালিয়াতি করেছে শেয়ার ম্যানিপুলেট করে- যেটা দেখতে হবে, আদানীর টাকা কোথায় যাচ্ছে। এই টাকাতে ভারতে ইনফ্রাস্ট্রাকচার উন্নত হচ্ছে। ভারতের বিমান বন্দর, পোর্ট, এনার্জি, গ্রিন এনার্জি এই সব সেক্টরে আদানী টাকা ঢালছে- যাতে ভারতের উন্নতি হয়। আমি মুম্বাই, দিল্লী এয়ারপোর্ট দেখে চমকে গেছি। এগুলি আদানীর তৈরী।
# ৩ পাশাপাশি এটাও ঠিক ভারতের পাবলিক ব্যাঙ্কগুলো যথা স্টেট ব্যাঙ্ক, এল আই সি, যারা আদানীকে টাকা ধার দিয়েছে- তারা বর্তমানে বিপদে। কতটা এই বিপদ তা আগামী দিনের ইতিহাস বলবে। তবে আদানী গোষ্ঠির দেউলিয়া হবার সম্ভাবনা নেই। কারন তাদের পোর্ট এনার্জি সিমেন্ট ব্যবসা বেশ লাভেই চলে। শেয়ারের দাম কম হলেও , তারা মনোপলি ব্যবসার জন্য ধার শোধ করতে এখনো সমর্থ। সুতরাং জনগনের টাকা মার যাবে-সেই ভয় এখনো নেই। আদানী কিন্ত টাকার সদ্বাব্যবহার করেছে ইনফ্রাস্টাকচারে টাকা ঢেলে।
তাহলে আদানী গোষ্ঠির উত্থানে ভারতের ক্ষতি ঠিক কোথায়? মূলত দুটো জায়গায়
(১) তারা ব্যবসা এবং রাজনীতি দুটো ক্ষেত্রেই মনোপলি তৈরী করেছে। দিদি মোদি -দুজনেই তার পকেটে। ফলে আদানীর কোন জালিয়াতি ভারতের কোন সরকারের পক্ষে চেক করা সম্ভব না।
(২) এতে বাকি ছোট ছোট অন্য শিল্প গোষ্ঠির প্রচুর অসুবিধে। তারা আদানিকে তাদের ব্যবসা বেচে দিতে বাধ্য হচ্ছে এবং হবেও। এতে মার্কেটে কম্পিটিশন কমছে। যা মার্কেটের জন্য ভাল না।
(৩) ১ ও ২ কারনের জন্য ভারতে বিদেশী ইনভেস্টররা ক্রমাগত পিছু হটবে।
আদানির পজিটিভ সাইড হচ্ছে-তারা সেই সেব সেক্টরে টাকা ঢালছে- যা ভারতে সবার আগে দরকার। ইনফ্রাস্ট্রাকচার। এয়ারপোর্ট সিপোর্ট এনার্জি। গণতন্ত্রের দরুন ভারতে এসব সেক্টরের অগ্রগতি খুব দুর্বল ছিল। কারন জমি অধিগ্রহন করে ইনফ্রা বানানো গণতন্ত্রে কঠিন কাজ। সেটা আদানি পারছে টাকার জোরে-সব পলিটিক্যাল পার্টিকে পকেটে পুরে। সেটা ভাল না খারাপ, তাও ইতিহাস বলবে। ইতিহাসের গতি এতটা রৈখিক ও নয়।
সুতরাং ওই ভাবে ব্ল্যাক হোয়াইট চশমা পরে, আদানীকে নিয়ে সিদ্ধান্তে আসা যাবে না। ৩৬০ ডিগ্রি ভাবলে অনেক নতুন চিন্তা বেড়িয়ে আসবে। সবটাই আসলে ক্ষমতার লীলাখেলা। সেক্সপিয়ার ধার করে লিখি-uneasy lies the head that wears the crown
তবে হ্যা -রাজায় রাজায় যুদ্ধ হবে, উলুখাগরার ( রিটেল ইনভেস্টর-জনগন) প্রাণ যাবে। এত চিরকালই হয়ে এসেছে।

আদনী-হিন্ডেনবার্গ-নেপথ্য ভাষন-২

 আদানী বনাম হিন্ডেনবার্গ- নেপথ্য ভাষন-2

বিপ্লব পাল, ১২ই ফেব্রুয়ারী

(১)

আমি আগের লেখাতে আদানী কান্ডে সচেতন ভাবে রাজনীতি এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এড়িয়ে গিয়েছিলাম। কিন্ত এই আদানী কান্ড বুঝতে গোটা পৃথিবীর সাম্প্রতিক ইতিহাস জানা দরকার।

বিংশ শতাব্দি থেকে পৃথিবীর সমস্ত রাষ্ট্রের সামনে উন্নতির জন্য, তিনটে রাজনৈতিক দিশা ছিল।

(১) সোভিয়েত বা সমাজতান্ত্রিক মডেল- যেখানে স্টেট ক্যাপিটাল-বা সরকারি পুঁজর সাহায্যে দেশে ইনফ্রাস্টাকচার এবং শিল্প গড়ে তোলা

(২) ওপেন মার্কেট , কম্পিটিটিভ ক্যাপিটালিস্ট মডেল- যা আমেরিকা এবং পাশ্চাত্য মডেল- যেখানে আন্তারপ্রেনার তৈরীর মাধ্যমে, মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে দেশে নতুন নতুন ব্যবসার সৃষ্টি হয়।

(৩) জাপানী মডেল- যেখানে রাষ্ট্র কয়েকটি দেশভক্ত বিজনেস গ্রুপ/ফ্যামিলিকে ব্যবসা করার জন্য বিশেষ সুবিধা দেয়। যেমন টয়োটা, মিসুবিৎসি, হন্ডা-ইত্যাদি যত জাপানি ব্র্যান্ড আমরা আজ দেখি- এগুলি সবই প্রায় ১০০ থেকে ১২০ বছর পুরাতন বিজনেস ফ্যামিলি- যাদের উত্থানের পেছনে ছিল বিংশ শতাব্দির শুরুর জাপানি জাতিয়তাবাদি সরকার। জাপানকে এখনো ওপেন মার্কেট বলা যাবে না। এটা ঘোষন কান্ডেই প্রমানিত। দক্ষিন কোরিয়ার দ্রুত উত্থান ও এই পথে। স্যামসাং, কিয়া , হোন্ডাই এগুলোও ফ্যামিলি বিজনেস, যা দক্ষিন কোরিয়ার সরকার, ১৯৬০ সাল থেকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে আসছে।

অর্থাৎ সরকার যদি ওলিয়ার্গ সিস্টেম-মানে মুষ্টিমেয় কিছু ব্যবসায়ী ফ্যামিলির হাতে দেশের ব্যবসা/ইনফ্রাস্ট্রাকচারের ভার তুলে দেয় , তাতে কিন্ত একটা দেশ দ্রুত এগোতে পারে।

আপনি বলবেন তাহলে মোদি সরকার আদানির হাতে দেশের ইনফ্রাস্টাকচার আউটসোর্স করে ভুল কি করছে? আফটার অল, নেহেরুর সমাজতান্ত্রিক মডেলে গিয়ে ভারত অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক পিছিয়ে গিয়েছিল। এবং ভারতের অন্যান্য ব্যবসায়ী ফ্যামিলিরা রাজনৈতিক ঝামেলার কারনে ইনফ্রাস্টাকচার প্রোজেক্টে খুব বেশী আসতে রাজী না।

ওয়েল, উলটো উদাহরন ও আছে। রাশিয়াতে সমগ্র বিজনেস পুতিন লইয়ালিস্ট অলিয়ার্গদের হাতে আউটসোর্স করার পরে দেশটা ডুবেছে অনেক ভাবে। সুতরাং এটা নিয়ে আরো গভীরে ভাবা দরকার। এটা নিয়ে এই প্রবন্ধের পরে আরো ডিটেলেসে লিখছি।

(২)
১৯৯১ সালে মনমোহন সিং যখন, ভারতকে সোভিয়েত ট্রাক থেকে আমেরিকান ট্রাকে ফেললেন, তখন দেশের গ্রোথ, অর্থনীতির বিকাশ হল বটে- কিন্ত ভারত আটকে গেল একটা জায়গায়। সেটা হচ্ছে ইনফ্রাস্ট্রাকচার- যেমন ধরুন, রেইল লাইন, পোর্ট, ইলেক্ট্রিক পাওয়ার, রোড এগুলোতে কিন্ত সেই সরকারি পুঁজির আওতাই থেকে গেল। কেন?

কারন এই ইনফ্রাস্টাকচার প্রোজেক্ট বানাতে প্রচ্রর টাকা লাগে। মানে টাকা ধার করতে হয়। তারপর গণতান্ত্রিক দেশ। জমি দখল করে এসব প্রোজেক্ট চলে। এবং এসব থেকে ইনকাম খুব বেশী হয় তা না। যেমন ধরুন আদানী পোর্টের লাভের হার মোটে ৩-৫%। ট্রান্সমিশন লাইনে ৮%। ওই লাভ থেকে দীর্ঘমেয়াদি লোন শোধ করে নতুন ক্যাপিটাল তৈরী করা খুব মুশকিল। শেয়ার বাজারেও ইনফ্রাস্টাকচার কোম্পানীগুলির শেয়ারের পি-ই রেশিও- খুব বেশী না। মোদ্দা কথা ওপেন মার্কেট মডেলে- অর্থাৎ আমেরিকান মডেলে প্রাইভেট কোম্পানীগুলি যারা ইনফ্রাস্টাকচারে আসে- তারা শেয়ার বাজারে খুব বড় কোম্পানী না- এবং খোদ আমেরিকাতে ইনফ্রা সেক্টরে সরকারি ক্যাপিটালি এখনো লাগে। আসলে মুক্ত বাজার অর্থনীতি -যা আমেরিকান মডেল তাতে প্রাইভেট ক্যাপিটাল মোটেও দেশের ইনফ্রাস্টাকচারে উৎসাহিত হয় না। সরকারি ক্যাপিটালেই সব কিছু এখনো চলে খোদ আমেরিকাতে। আমেরিকা বহুদিন ধরে লসে চলা মূল রেল কোম্পানী আমট্রাক বেচতে পারে নি কোন প্রাইভেট অপারেটরকে। সরকারকেই চালাতে হয়। আমেরিকার প্রায় সমস্ত রেইল লাইন আগে প্রাইভেট ছিল-এখন সরকারি। উপায় নেই। আসলে মডেল-২তে ইনফ্রাস্টাকচার বিজনেসের জন্য প্রাইভেট ক্যাপিটাল টানা মুশকিল। এটা বুঝতে পারলেই আমরা আদানীকান্ড বুঝতে পারব আরো ভাল ভাবে।

(৩)
এবার আদানীর ইতিহাস দেখা যাক। আদানী কিন্ত বিজেপির লোক ছিল না। সংঘ পরিবারের ও না। আদানী ১৯৮০-২০০২ সাল পর্যন্ত, অর্থাৎ মোদির গুজরাত অভিষেকের আগে পর্যন্ত অত্যন্ত কংগ্রেস ঘনিষ্ঠ ছিলেন।
মোদির ভাইব্রান্ট গুজরাতের আসল রূপকার আদানী নিজে। বেসিক্যালি গুজরাত থেকেই মোদি-আদানীর মডেল-৩ এর খেলা শুরু এবং যা গুজরাতে সফল ভাবে কাজ ও করে। ফলে ২০১৪ সালে যখন মোদি মসনদে বসলেন ( এবং তার জন্য যাবতীয় প্রচার এবং খরচের সিংহভাগ আদানীই জুটিয়েছিলেন) -এটা ভবিতব্য ছিল যে মডেল-৩ এর খেলা এবার গোটা দেশ জুরে হবে। অর্থাৎ মোদির ভারত মডেল-২ থেকে মডেল-৩ তে গিয়ার শিফট করবে-কারন তাতেই মোদি এবং বিজেপির লাভ বেশী। কারন তারা দেশের উন্নতি দেখাতে পারবেন আরো দ্রুত।

কিন্ত মডেল-৩, জাপান , দক্ষিন কোরিয়া এবং চীনে কাজ করলেও কিন্ত রাশিয়াতে কাজ করে নি। এর মূল কারন দক্ষিন কোরিয়ার এই ব্যবসায়ী ফ্যামিলিগুলি- এমন কি চীনেও এইসব বিলিয়ানারদের নিয়ন্ত্রন করে সরকার। রাশিয়াতে কিন্ত তা হয় নি। রাশিয়ান অলিয়ার্গরা উলটে সরকার নিয়ন্ত্রন করেছেন। অর্থাৎ মডেল-৩ তখনই কাজ করে যখন সরকার সম্পূর্ন ভাবে এইসব ফ্যামিলিগুলিকে নিয়ন্ত্রনে রাখে। যেমন ধরুন জ্যাক মাকে চীন সরকার এখন সম্পূর্ন পকেটে পুরে নিয়েছে। স্যামসাং এর ইতিহাস ও তাই। স্যামসাং ও তাই। সরকার নির্ধারন করে স্যামসাং ফ্যামিলির কে সিইও হবে। আর জাপানের দীর্ঘ ইতিহাস সম্পূর্ন ভাবেই তাই- হন্ডা, টয়োটা, মিসুবিৎসি এসব গোষ্ঠির ওপর সরকারে নিয়ন্ত্রন ছিল ১০০%।

আদানীর উত্থান ভারতের ভাল হতে পারে যদি ভারতীয় সরকার আদানী গোষ্ঠিকে নিয়ন্ত্রন করতে পারে। কিন্ত গত তিন বছরে দেখা যাচ্ছে আদানী ঘোষ্ঠির মরিশাসের শেল কোম্পানী থেকে শেয়ার ঘোটালা করা থেকে মুম্বাই এয়ারপোর্ট অধিকরনের কলঙ্কিত কান্ডে সরকারি নিয়ন্ত্রকরা অন্ধ যুধিষ্ঠীরের ভূমিকাতে। অর্থাৎ আদানীর কর্মকান্ড মোটেই স্যামসাং বা হন্ডাদের মতন না- বরং কোরাপ্ট রাশিয়ান অলিয়ার্গদের মতন। যাদের সরকার নিয়ন্ত্রন করে না। বরং এরাই সরকারকে নিয়ন্ত্রন করছে।

(৪)
কিন্ত প্রশ্ন হচ্ছে আদানী গোষ্ঠি নিজেদের শেয়ারের দাম মরিশাসে ৩৩ টা কোম্পানি খুলে কৃত্রিম ভাবে "এত" বাড়াতে গেল কেন? ইনফ্রা কোম্পানীগুলির যেখানে পি-এই রেশিও ৭-১০ এর বেশী হয় না, আদানীর ক্ষেত্রে ১০০- ১৫০ কোন জাদুবলে? নাকি পুরোটাই নগ্ন কোরাপশন?

আমেরিকাতে এগুলো ক্রিমিনাল অপরাধ। কোম্পানি ত শেয়ার বাজার থেকে ডিলিস্টেড হবেই -প্রমোটার ও জেলে যাওয়ার কথা। ভারতের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে এসব অভিযোগ পাওয়া সত্ত্বেও সেবি, ইডি আদানির কোন কোম্পানীর বিরুদ্ধেই কোন অভিযোগের ঠিকঠাক ইনভেস্টিগেশন করে নি। বিরোধিরা যখন জয়েন্ট পার্লামেন্টারী কমিটি চাইছেন আদানীর বিরুদ্ধে ইনভেস্টিগেশনের জন্য, তখন মোদি নারাজ। অসময়ের বন্ধু বলে কথা। অর্থাৎ ভারতে আদানীকে কেউ ছুঁতে পারবে না।

কিন্ত গৌতম আদানী "রেপুটেশনের" এই রিস্ক নিলেন কেন? কারন আদানী গোষ্ঠির ৭৩% ( ৭৫% ম্যাক্সিমাম হতে পারে ) স্টক নিজের হাতে। বাকী ২৭% এর ১৫% বিদেশী ইনভেস্টর- যারা কিনা ইন্সটিউশনাল ইনভেস্টর মূলত আরব, আমেরিকা এবং ইউরোপে, তাদের হাতে। সুতরাং এই অপরাধ বিদেশী, বিশেষত আমেরিকান শর্ট সেলাররা কোন না কোন দিন ধরতই। ভারতে না হয়, হাজার অপরাধ করলেও তাকে ধরার কেউ নেই।

এখানেই আদানী কেলেঙ্কারির মূল সূত্র। আসলে ইনফ্রাস্টাকচার প্রোজেক্টে টাকা লাগে অনেক বেশী। তার প্রচুর সুদ। কিন্ত ইনকাম খুব কম। ৩-৪% প্রফিট। আদানী গোষ্টির মোট প্রফিটের পরিমান তার সমস্ত ধারের তুলনায় কিছুই না। বেশীক্যালি হাজার কোটি টাকা প্রফিট-আর দুশো হাজার কোটি টাকার ধার। মানে এই রেটে চললে, দুশো বছর লাগবে প্রিন্সিপাল শোধ করতে যদি ধারের টাকা কোম্পানীর প্রফিট থেকে শোধ করতে হয়!

তাহলে আদানী কিভাবে তার সাম্রাজ্য বিস্তার করবেন? কারন এমন অবস্থায় ত কেউ ধার দেবে না। ফলে হিন্ডেনবার্গের অভিযোগ তিনি তারা বড়ভাইকে মরিসাসে পাঠিয়ে সেখানে ৩৩ টা বেনামী কোম্পানী খুলে আদানী স্টক পাম্প করা শুরু করলেন। নিজেরাই কিনে, নিজেরাই বেচে শেয়ার ভ্যালু বাড়ালেন। এসবের বিরুদ্ধে শেয়ার মার্কেটে অনেক আইন আছে। কিন্ত তাতে কি? ভারতের কোন রেগুলেটর তাকে আটকাবে? এবার সেইসব শেয়ারের বিরুদ্ধে লোন নেওয়া শুরু করলেন!

(৪)
ভারতের কি ক্ষতি হল?

ভারতের মার্কেটের ওপর বিদেশী বিনিয়োগকারিদের ভরসা উঠে গেছে। কারন মার্কেটে কারচুপি না আটকাতে পারলে, সাধারন ইনভেস্টরা টাকা হারাবেন। আর এই পুলিশি কাজের দ্বায়িত্ব সেবির। দেখা যাচ্ছে আদানী গ্রুপের ওপর ভারতের সেবির কোন নিয়ন্ত্রন নেই। অর্থাৎ ভারতের মার্কেটের ওপর বিশ্বাস উঠে গেছে বিদেশী ইনভেস্টরদের। যার জন্য নরওয়ের সভারেন ফান্ড সব শেয়ার বেচে দিয়েছে।

এতে যেটা হবে, ভারতের শেয়ার মার্কেট তার বিশ্বাসযোগ্যতার জন্য বিদেশী ইনভেস্টরদের কাছে যে প্রিমিয়াম পেত সেটা হারাবে। এটা খুচরো ইনভেস্টরদের লস।

এবার দেখা যাক এল আই সি, এস বি আই এর এক্সপোজারে। ভারতে আমার বাবা-মায়ের মতন মধ্যবিত্তদের শেষ দিনের সম্পদ এখানেই গচ্ছিত। আদানী শেয়ার পড়ে গেলে, মর্টগেজের মূল্য থাকবে না। যেহেতু আদানী লাভে চলে, সেহেতু বেস্ট কেস সিচুয়েশন হচ্ছে এখনো আদানী স্টক বেচে এই কোম্পানীগুলি, প্রচুর প্রফিট সহ টাকা তুলে নিয়ে এক্সপোজার কমিয়ে দিতে পারে। তবে সেটা করলে আদানীর স্টক প্রাইস কমবে। আদানীর বিপদ বাড়বে। মোদি সরকার তা করবে না। তারা আদানীর এত নুন খেয়েছে, আদানীর ক্ষতি করে দেশের লোকের সেবা তারা করবে না। সুতরাং এক্ষেত্রে আমি সব থেকে ক্ষতিকর পরিস্থিতিটার হিসাব নিচ্ছি। সেটা হচ্ছে, তারা আদানী কোম্পানীর কন্ট্রোল নিতে পারে -লোন ডিফল্টের ক্ষেত্রে। এগুলো যেহেতু ইনফ্রা প্রোজেক্ট সেহেতু এইসব কোম্পানীর দাম কিন্ত বিপুল। তারা এক্ষেত্রেও ড্রিসট্রেস সেলে খুব লাভ না করলেও, টাকা তুলে নিতে পারবে বলেই মনে হয়। কারন আদানী গোষ্ঠির কোম্পানীগুলির ফান্ডামেন্টাল ভালোই।

আসল সমস্যা হচ্ছে শেয়ার মার্কেটে খেলে, প্রাইভেটে টাকা ধার নিয়ে ইনফ্রা প্রোজেক্ট করা যায় না। অত লাভ ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রজেক্টে নেই। ইনফ্রাতে সরকারি পুজি লাগবেই। অর্থাৎ সরকারি কন্ট্রোল লাগবেই।

(৫)
শেয়ার মার্কেটে আইন ভেঙে শেয়ার প্রাইস বাড়ানো নতুন কিছু না। বলতে গেলে সব গেমই রিগড। পেটিম, ন্যাকা ইত্যাদি সব নতুন আই পিও ভারতের শেয়ার বাজারে শুয়ে গেছে। অপেনিং এর থেকে ৫০%, ৮০% নীচে নেমে গেছে। তাহলে এই শেয়ার গুলোই বা এত প্রিমিয়াম পেল কি করে? সেবি কি এসব কিছু দেখে নি?

আসলে শেয়ার মার্কেট জুয়ারীদের আড্ডা। প্রায় সব দেশেই। সবটাই রিগড গেম। আদানী খারাপ, আম্বানী ভাল-টাটা ভাল এসব না ভাবাই ঠিক। কেউ বেশী। কেউ কম। আসল সত্য হচ্ছে ক্যাপিটালিজমে আমাদের চাকরি, আমাদের চিকিৎসা, আমাদের ভবিষ্যত-সব কিছুই জুয়ারীদের হাতে। মানুষের হাতে নেই। এটা ভারত-আমেরিকা দুটো দেশের জন্যই সত্য। এবার যারা মার্কেটের নিয়ন্ত্রক, তারা যদি অন্ধ যুধিষ্ঠির হয় বা সরকার যদি তাদের ঠুটো জগন্নাথ করে বসিয়ে দেয় জন সাধারন ভুগবে।

ধরুন গুগল একদিনে ১০০ বিলিয়ান মার্কেট ভালু হারাল,। কি না, চ্যাট জিপিটির প্রতিযোগি আনতে গিয়ে, এমন ডেমো দেখাল-সবাই দেখল, সেখানে ভুল তথ্য আসছে। ব্যস একটা ছোট্ট ভুলে ১০০ বিলিয়ান হাওয়া। 

সুতরাং সবটাই জুয়া।

আরো মিনিংফুল সমাজ রাষ্ট্র কি সম্ভব। অবশ্যই সম্ভব। তবে তার ক্যাপিটালিজম বা কমিনিউজম কোন পথেই আশার আলো নেই। কারন আমদের সমাজে ক্ষমতার পিরামিড আছে। ওটা ছাড়া সিস্টেম কাজ করবে না। কমিনিউজমে ক্ষমতা যায় খুনী শাসকদের কাছে, যারা দেশের লোককে ক্রীতদাস বানায়। সবচেয়ে বাজে সিস্টেম। আর ক্যাপিটালিজমে ক্ষমতার শীর্ষে বসে আছে জুয়ারীরা। তাও ক্যাপিটালিজম মন্দের ভাল যদি রাষ্ট্র এইসব জুয়ারীদের নিয়ন্ত্রন করতে পারে। নাহলে এখানেও ভোগান্তি ।

দুঃখ একটাই ।  ছোটবেলা থেকে কত নীতিশিক্ষা পেয়ে বড় হই আমরা । ছেমেয়েয়েদের ও সৎ পথে থাকতে বলি। মনে হয় সৎপথে থাকার এই লবনের বস্তাটার সব গুরুদ্বায়িত্ব সবদেশের মধ্যবিত্তদের। যারা আমাদের মালিক- সেই পলিটিক্যাল বা ক্যাপিটালিস্ট ক্লাসের কোন দ্বায়বদ্ধতা নেই ওসব মধ্যবিত্তসুলভ নীতিগর্ভতা নিয়ে বেঁচে থাকার! এটাই দুঃখের!