Saturday, October 24, 2020

করোনা টেস্ট নিয়ে ভুল তথ্য এবং ব্যাখ্যা দিয়েছে রামকৃষ্ণ মিশন

 করোনা টেস্ট নিয়ে ভুল তথ্য এবং ব্যাখ্যা দিয়েছে রামকৃষ্ণ মিশন

******
বেলুড় মঠের কুমারী পূজোয় রামকৃষ্ণ মিশন পুরোহিত এবং কুমারী বালিকার জন্য মাস্ক ব্যবহার করে নি। কাজটি সরকারি বিধি, ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের নির্দেশ লঙ্ঘন করেছে। নিজেদের কীর্তির সাফাই গাইতে গিয়ে মিশনের বক্তব্য ( সূঃ আনন্দবাজার পত্রিকা)

"সোশ্যাল মিডিয়ায় নেটাগরিকদের প্রশ্ন এবং উদ্বেগ নিয়ে সুবীরানন্দজির জবাব, ‘‘প্রশ্ন করার জন্য এক ধরনের লোক থাকেন। বিনা কারণেই প্রশ্ন করেন। সব প্রশ্নের উত্তর তো আমরা দেব না! আর যাঁরা প্রশ্ন তুলছেন, তাঁরা সকলে কি পুজোর মণ্ডপে যাওয়ার আগে করোনা পরীক্ষা করিয়েছেন? মাস্ক হল সেকেন্ডারি। পরীক্ষাটাই আসল। সেটা আমরা করিয়েছি।’’ পাশাপাশিই তাঁর প্রশ্ন, ‘‘কারও যদি করোনা হয়ে থাকে, তবে তাঁর সামনে মাস্ক পরে যাওয়াও কি নিরাপদ? আমরা তাই কুমারী মা-সহ সকলের করোনা পরীক্ষা করিয়েছি। অন্য কোনও পুজো কমিটি এটা করেছে কি না জানি না। শুধু কুমারী পুজোই নয়, দুর্গামায়ের পুজো যাঁরা করেছেন, পুরোহিত, তন্ত্রধারক থেকে ঢাকি— সকলের করোনা পরীক্ষা করিয়েছি।’’

****
সুবীরানন্দজী বিরাট ভুল যুক্তি দিয়েছেন যা সাধারন মানুষকে বিভ্রান্ত করবে। উনার মতে করোনা টেস্টে নেগেটিভ হলেই মাস্ক ছাড়া থাকা যায়। কারন উনার ধারনা করোনা টেস্টে নেগেটীভ আসা মানেই, ব্যক্তির মধ্যে করোনা ভাইরাস নেই। এটি তার অজ্ঞতা এবং সেই জন্যেই আমার এই লেখা।


কোভিড-১৯ এর মূলত তিন ধরনের টেস্ট হয়। কুইক র‍্যাপিড টেস্ট হচ্ছে এন্টিজেন টেস্ট। এতে "ফলস নেগেটিভ" অর্থাৎ কোভিডে আক্রান্ত কিন্ত টেস্ট বলছে কোভিড হয় নি -তার সম্ভাবনা ৫০% এর কাছাকাছি। ( সূত্র-১ ঃ হার্ভাড হেলথ , আমি লিংক পোষ্ট করছি ) ।

দ্বিতীয় টেস্ট, মলিকিউলার পিসিয়ার টেস্ট, যার রেজাল্ট আসতে কিছুদিন সময় লাগে এবং ন্যাজাল বা থ্রোট সোয়াব স্যাম্পলের আর এন এ থেকে দেখা হয়, তাতে এই ফলস নেগেটিভের সম্ভাবনা ২%-৩৭% ( ( সূত্র-১ ঃ হার্ভাড হেলথ)। কোলকাতায় এই টেস্টই মূলত করা হয়।

পিসিয়ার টেস্টে ফলস নেগেটিভ আসার সম্ভাবনা নিয়ে সম্প্রতি আমেরিকার ন্যাশানাল ইন্সটিউট অব হেলথ একটি পূর্নাঙ্গ কাজ পাবলিশ করেছে ( সূত্র -২ ,এটাও পোষ্ট করছি)। এই পেপারে করোনা টেস্টের নির্ভুলতা নিয়ে প্রকাশিত সব কাজের ( ১৯ শে জুনের আগে পর্যন্ত প্রায় ১০০০ পেপারের ) এক দীর্ঘ সামারি পাবেন। এতে দেখা যাচ্ছে পি সি আর এ ফলস নেগেটিভ খুব কম ও হতে পারে ( বেস্ট কেস ২%)। কিন্ত লো কোয়ালিটির পিসিয়ার মেশিন ব্যবহার করলে ফলস নেগেটিভ ৩৭% ও নানান পাবলিকেশন রিপোর্ট করেছে। মিডিয়ান ২০-২৫%। কোলকাতায় পিসিয়ার বেসড মলিকিউলার টেস্টিং এর রেজাল্ট যে রিলায়াবল না, সেটা সব ডাক্তারই জানেন। আমি এই হাই রেফারেন্স গুলি ব্যবহার না করলেও সবাই এটা এখন জেনে গেছে কোভিড টেস্ট প্রায় ফালতু। কিন্ত ডাক্তাররা এটা নিয়ে খুব উচ্চবাচ্য করেন না। কাটমানি, সহজ মানি আর কে ছাড়তে চাইবে!

অর্থাৎ মহারাজ জানেন না, কোভিড-১৯ এর পিসিয়ার টেস্ট খুবই আনরিয়ালেবল। ওর ভিত্তিতে আর যাইহোক মাস্ক এবং সামাজিক বিধি ভঙ্গ করা যায় না।

মাস্ক আসলেই টেস্টের থেকে অনেক বেশী রিয়ায়েবল। মহারাজ যা বলেছেন তার উল্টোটাই সত্য। মাস্ক কতটা এফেক্টিভ তাই নিয়ে প্রচুর কাজ প্রকাশিত এখন। এর একটা সামারি ৬ ই অক্টবর নেচার জার্নালে প্রকাশিত পেপারে পাবেন ( সূত্র-৩-নেচার অনেক কাজের ক্রস রেফারেন্স আছে)। মোটামুটি সামারি হচ্ছে

- ভাইরাস যখন মুখ থেকে বেড়োচ্ছে তখন তা থাকে ওয়াটার ড্রপলেটের মধ্যে-যা কিন্ত খুব সাধারন ক্লোদিং মাস্কেও অনেকটাই আটকায়। ভাইরাসের সাইজ ১০০ ন্যানোমিটার-কিন্ত ওই সাইজে ফ্রি ভাইরাস থাকে না। ফলে সাধারন ক্লোদিং মাস্ক ও ভালোই ভাইরাস আটকায় যেহেতু ড্রপলেটগুলি পাঁচ মাইক্রনের বেশী সাইজের হয়।
- কোভিড-১৯ পেশেন্ট থেকে কোন ডোজে আপনি ভাইরাস পেয়েছেন সেটা গুরুত্বপূর্ন। আপনি মাস্ক পড়ে থাকলে ভাইরাস ঢুকলেও তার পরিমান কম হবে। এতে রোগ হলেও সম্ভাবনা বেশী যে তা এসিম্পটোম্যাটিক হবে ।

নেচারের এই পেপারে আরো দেখা যাচ্ছে, যেসব দেশ মাস্কএর ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছিল, তাদের মৃত্যুহার প্রায় ১/৪ বা তার আরো কম।

রামকৃষ্ণ মিশনকে অপমান করা আমার এই পোষ্টের উদ্দেশ্য না। আমি নরেন্দ্রপুরে উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র ছিলাম। মিশন যেমন মানুষের জন্য ভাল কাজ করে-ঠিক তেমনই তারা অনেক অবৈজ্ঞানিক ধারনা নিয়েও চলে। মিশনের ভালকাজ সমর্থনযোগ্য। অনেক মহারাজের সাথেই আমার ভাল পরিচয় আছে-তাদের ভাল কাজে সাথে থাকারও চেষ্টা করি।

কিন্ত যা ভুল, তা ভুল এবং সমাজের জন্য মারাত্মক। অধিকাংশ বাঙালীই অশিক্ষিত এবং এরা গেরুয়াধারীদের অভ্রান্ত মেসিয়া ভাবেন। সুতরাং তারা এই ধরনের অবৈজ্ঞানিক ধারনা যেন না ছড়ান, সেটাই আমার অনুরোধ।

[১] হার্ভাড হেলথ - Which test is best for COVID-19?
POSTED AUGUST 10, 2020, 10:30 AM , UPDATED SEPTEMBER 30, 2020, 3:17 PM
Robert H. Shmerling, MDRobert H. Shmerling, MD
Senior Faculty Editor, Harvard Health Publishing
[২] The estimation of diagnostic accuracy of tests for COVID-19: A scoping review
Dierdre B. Axell-House,a Richa Lavingia,b,c,d Megan Rafferty,c,d Eva Clark,a,e E. Susan Amirian,c and Elizabeth Y. Chiaof,⁎
[৩]
Nature
Face masks: what the data say
The science supports that face coverings are saving lives during the coronavirus pandemic, and yet the debate trundles on. How much evidence is enough?

Saturday, October 17, 2020

রায়চৌধুরী সমীকরন থেকে পেনরোজ হকিং সিঙ্গুলারিটি তত্ত্ব -পর্ব-৩

                                                                                (৬)

সিঙ্গুরালিটিই বা কি? আর এই সিঙ্গুলারিটি থেকে উদ্ভুত ব্ল্যাকহোলই বা কি? কেন ব্ল্যাকহোল নিয়ে এত হইচই? সত্যিইকি কোন রাক্ষুসে ব্ল্যাকহোল আমাদের সৌরজগতটা কোনদিন খেয়ে ফেলতে পারে? একদম সাপের ব্যাঙগোলার মতন ? আস্তে আস্তে সূর্য্যসহ গোটা সমস্ত গ্রহ ব্ল্যাকহোল শুষে নিতে পারে?

তারআগে ব্ল্যাকহোল কি আমরা জেনে নিই।  আসলে নিউটনের অভিকর্ষের সূত্রেই সিঙ্গুলারিটি ছিল। মানে ব্ল্যাকহোলের সংকেত ছিল।  নিউটনের সূত্র দিয়েই বোঝা যায়, দুটি বস্তুর মধ্যে দূরত্ব শুন্য হলে, তাদের মধ্যে অভিকর্ষজ বল অসীম!  তাছাড়া নিউটনের সূত্র এটাও বলছে, পৃথিবী থেকে ১২ কিমি/ প্রতি সেকেন্ডে ঢিল ছুঁড়লে তা অসীম মহাশূন্যে হারিয়ে যাবে। যারে কয় এসকেপ ভেলোসিটি। মুক্তিবেগ।  পৃথিবীর ভর যদি সমান থাকে এবং তার ব্যাসার্ধ কমতে থাকে-তাহলে এই মুক্তিবেগের মান বাড়তেই থাকবে! ধরুন পৃথিবীর ব্যাসার্ধকে কমিয়ে ৯ মিলিমিটারে নামিয়ে আনা হল। তাহলে মুক্তিবেগ কত হবে? তিনলাখ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড! অর্থাৎ আলোর গতিবেগের বেশী! মানে সেক্ষেত্রে আলোও আটকে যাবে সেই ক্ষুদ্র পৃথিবীতে! আলো পৃথিবীর অভিকর্ষজ বেগ ছাড়াতে পারবে না।

আলোর যে একটি নির্দিষ্ট বেগ আছে এবং তা আড়াই লাখ কিমি প্রতি সেকেন্ডের কাছাকাছি-এটি আবিস্কার করেছিলেন ডাচ এস্ট্রোনমার ওলে রোমার। অনেকদিন আগে ১৬৭৬ সালে। নিউটনের অভিকর্ষ আবিস্কারের ও আগে। বৃহস্পতির উপগ্রহ আয়োর গ্রহণ প্রায় ১৪ বছর ধরে পর্যবেক্ষন করে উনি বুঝতে পারেন, আলোর গতিবেগ মোটেও অসীম না।  নিউটন অভিকর্ষের সূত্র দিলেন এগারো বছর পর।  ১৬৮৭ সালে। এবং অলে রোমারের কাজ নিউটনের অজানা ছিল না।  কিন্ত এর পরে প্রায় ১০০ বছর ধরে এটা কারোর কল্পনায় আসে নি-আচ্ছা যদি গ্রহ নক্ষত্রের ঘনত্ব  এত বেশী হয়, যে সেখানে মুক্তিবেগ আলোর বেগের সমান হয়ে যায় ( যা নিউটনের সূত্র দিয়েই বার করা যায়)  তাহলে সেখানে আলো সহ সব কিছু আটকে যাবে- সৃষ্টি হবে সম্পূর্ন এক কালো গহ্বর !

এটা প্রথম মাথায় আসে এক বৃটিশ  পাদ্রির -জন মিচেল। ২৭শে নভেম্বর ১৭৮৩ সালে রয়াল সোসাইটিতে পেশ করা এক পেপারে তিনি অঙ্ক কষে দেখালেন সূর্য্যের ব্যাসার্ধ্য যদি ছোট হত বা ভর বেশী হত-সেখান থেকে আলো আসত না। উনি তখনো ব্ল্যাক হোল বলেন নি। একে বল্লেন ডার্ক স্টার। অন্ধকার সূর্য্য!

  অদ্ভুত ! মিশেল আরো বল্লেন এই গ্যালাক্সিতেই আছে আরো অনেক অন্ধকার সূর্য্য-যাদের ভর বিরাট- যাদের দেখা যায়। এবং তারা জোড়ায় জোড়ায় ঘোরে ( বাইনারী ব্ল্যাকহোল সিস্টেম )!

  ব্ল্যাকহোল নিয়ে মিশেলের  সব প্রেডিকশন আজ একবিংশ শতাব্দিতে মিলে গেছে। বাইনারি ব্ল্যাকহোল সিস্টেম এই গ্যালাক্সিতে প্রচুর-যার থেকে এক্স রে বিকরিত হয়। কারন আজ আমাদের হাতে স্যাটেলাইট টেলিস্কোপ আছে। গামারে টেলিস্কোপ আছে। এক্সরে টেলিস্কোপ আছে। আমরা পদার্থবিদ্যার সূত্রগুলি জেনেছি। 

আর মিশেলের হাতে ছিল নিউটনের সূত্র এবং ত্রিশ ইঞ্চির এক টেলিস্কোপ। যা তিনি নিজেই বানিয়েছিলেন আকাশ দেখবেন বলে। 

মিশেল ভূমিকম্পবিদ্যার জনক। আবার প্রথম ইলেক্ট্রোম্যাগনেট তিনিই বানিয়েছিলেন। 

 এহেন লোকের না ছিল কোন বিজ্ঞানের ডিগ্রি-না বিজ্ঞানীর সন্মান। সবাই ভাবত এক পাগল ধর্ম যাজক।  তার একটা পোট্রেট পর্যন্ত কোথাও নেই।  অথচ ব্ল্যাকহোলের ধারনা প্রকৃত আদি জনক তিনিই। 

 অর্থাৎ আমরা দেখলাম, নিউটনের অভিকর্ষের সূত্রের মধ্যেই ব্ল্যাকহোল লুকিয়ে ছিল এবং আইনস্টাইনের জন্মের অনেক আগে,  প্রায় দেড় শতাব্দি আগে ব্ল্যাকহোলের ধারনা, ইভেন্ট হরাইজনের ধারনা ( অর্থাৎ যে রেডিয়াসের মধ্যে সব আলো শুষে নেবে)  সব কিছুই জনমিচেল দিয়ে গিয়েছিলেন। 

আইনস্টাইনের সমীকরনের সোয়ার্জচাইল্ড সমাধান থেকে ব্ল্যাকহোলের ধারনার জন্ম, ইভেন্ট হরাইজনের জন্ম-এটা সম্পূর্ন ভুল ধারনা এবং "হাইজ্যাকড"  ন্যারেটিভ!  আইনস্টাইনের সমীকরন এবং সোয়ার্জচাইল্ড সমাধান আসলে মিচেলের ধারনাটিকে একটি পোক্ট গণিতিক ফ্রেমওয়ার্কের ওপর দাঁড় করালো-আর সেই ফ্রেমওয়ার্কই আরো উন্নত করলেন অধ্যাপক অমল রায়চৌধুরী। 

মুশকিল হচ্ছে জন মিচেল ছিলেন আপন ভোলা গবেষক। নিজের ঢাক পেটান নি। আবার অধ্যাপক মহল, গবেষক মহলের লোক না। ফলে তার মতন অসামান্য প্রতিভা নিয়ে কোন লেখাপত্তর পর্যন্ত পাবেন না।  আমাদের অধ্যাপক রায়চৌধুরিও কিছুটা এই জন মিচেলের মতন। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াতেন- মানে বিশ্ববিজ্ঞানী মহলের সার্কলে নেই-ফলে তার নাম ও খুব কম লোকেই শুনেছে। এমন কি পেনরোজ তার সমীকরন ব্যবহার করলেও , প্রথম পেপারে ওটিকে রায় চৌধুরী ইকোয়েশন বলে উল্লেখ করেন নি।  জন মিচেল এবং অমল রায়চৌধুরী উজ্জ্বল উদাহরন- বিজ্ঞানীদের ও কিছুটা ঢাক বাজাতে হয়!


                                                              (৭)

ব্ল্যাকহোলের ফিজিক্স কি আসলেই খুব জটিল? মজার ব্যপার হচ্ছে ব্ল্যাকহোলের যেটুকু বোধগোম্য, আমাদের "জানা" ফিজিক্সের মধ্যে সেটি বেশ সহজ সরল। আর যার উত্তর নেই,  সেখানে আমাদের জানা ফিজিক্স ও বাতিল। 

ধরুন পৃথিবীটা গ্রাভিটেশনাল কোলাপ্সে একবিন্দু হয়ে গেল। যদিও তা হবার না। সূর্য্যের ভরের প্রায় দশগুন ভরের তারার মৃত্যু হলে তা  গ্রাভিটেশনাল কোলাপ্সে একবিন্দুতে মিশে যাবে।

ভর না হয় কোলাপ্স করে এক বিন্দুতে চলে এল। কিন্ত ওই বিন্দুকে কেন্দ্র করে সোয়ার্জ চাইল্ড রেডিয়াসের একটি গোলকের মধ্যে আমাদের জানা পদার্থবিদ্যা সব ফেইল্ড। কারন সূর্য্য বা লাখে লাখে সূর্য্যের ভর যদি একটি বিন্দুতে কোলাপ্স করে তাহলে তাহলে সেই বিন্দু বা বিন্দু থেকে সোয়ার্জ চাইল্ড রেডিয়াসের মধ্যে ( ইভেন্ট হরাইজনের মধ্যে) স্পেস টাইম পার্টিকল -এদের কি হবে- কেউ জানে না। জানবে কি করে?  ইভেন্ট হরাইজনের মধ্যের কোন খবর ( ইনফর্মেশন)ই বাইরের বিশ্বে আসে না! ব্ল্যাকহোল নিয়ে আমাদের যাকিছু জানা, মানি পরীক্ষিত সত্য, কাল্পনিক তত্ত্ব না, তার সবকিছুই ইভেন্ট হরাইজনের আশেপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনার নিরীক্ষন। ইভেন্ট হরাইজনের মধ্যে আমাদের জানা কোন বিজ্ঞানই কাজ করে না। 

ইভেন্ট হরাইজনে  আমাদের বিশ্ব থেকে দেখলে মনে হবে সময় থেমে গেছে। ব্যপারটা এমন। যদি কোন স্পেসশাটল স্পেস ক্রাফট থেকে ইভেন্ট হরাইজনের দিকে যাত্রা করে- তাহলে শাটলের লোকটির মাত্র কয়েক ঘন্টা, স্পেস ক্রাফটে বসে থাকা লোকেদের কয়েক বছর হয়ে যাবে। এমন একটা দৃশ্য আপনারা দেখবেন ক্রিষ্টোফার নোলানের ইন্টারস্টেলার সিনেমায়। স্পেশ শাটলের যাত্রী যখন ইভেন্ট হরাইজনের কাছ থেকে আবার স্পেস ক্রাফটে ফিরে এল, তখন স্পেস ক্রাফটের সবাই বুড়ো হয়ে গেছে! 

মৃত্যু যেহেতু অবধারিত-সেহেতু ইভেন্ট হরাইজনের গিয়ে মরলে খারাপ হয় না। কেন জানেন? কারন এই সৌরজগত আর পাঁচ বিলিয়ান বছর বাদে মারা যাবে-কিন্ত ওই পাঁচ বিলিয়ান বছর ইভেন্ট হরাইজনে ১ সেকেন্ড  ও না! ফলে একবার ইভেন্ট হরাইজনে পৌছাতে পারলে-এবং সেখানকার বিভৎস গ্রাভিটেশন  এক সেকেন্ড ও  সহ্য করতে পারলে, অমরত্ব একেবারে গ্যারান্টিড! মরলেও! 

কত ধরনের ব্ল্যাকহোলের সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা ?  মূলত দুই ধরনের ( এর বাইরেও কিছু আছে-সে ডিটেলেস যাচ্ছি না )। এক, ভারী নক্ষত্রের মৃত্যু হলে তার পরিনতি হয় নিউট্রন স্টার  আর তার থেকেও ভারী হলে এক বিন্দুতে কোলাপ্স করে তা হয় ব্ল্যাকহোল। আমাদের মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সিতেই ওমন প্রায় এক কোটি ব্ল্যাকহোল আছে-যারা মৃত নক্ষত্র।   এদের মধ্যে অধিকাংশ কোথায় লুকিয়ে আছে কেউ জানে না। শুধু সেই সব ব্ল্যাকহোলদেরই সনাক্ত করা সম্ভব যারা একটি নক্ষত্রকে বা আশেপাশের গ্যাসপুঞ্জকে  গিলে খাচ্ছে আস্তে আস্তে। মানে ব্ল্যাকহোলের প্রবল মহাকর্ষের টানে নক্ষত্র থেকে প্ল্যাজমা স্পাইরাল আকারে ইভেন্ট হরাইজনে ঢুকে যায়-আর প্ল্যাজমা থেকে নির্গত হয় এক্সরে। কখনো আরো শক্তিশালি গ্যামারে। যখন ব্ল্যাকহোল কোন নিউট্রন স্টারকে টেনে খায়। এগুলি এক্সরে বা গামা রে টেলিস্কোপে ধরা পরে। যেগুলি আছে আমাদের মহাকাশে , নানান স্যাটেলাইটে । আবার কখনো দুটী ব্ল্যাকহোল একে অন্যকে টেনে নিয়ে একটি বিন্দুতে অন্য ব্ল্যাকহোল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। তখন তৈরী হয় প্রচন্ড শক্তিশালী গ্রাভিটেশনাল ওয়েভ। যা হাজার হাজার আলোকবর্ষ দূরের পৃথিবীর স্পেসটাইমকে বাঁকিয়ে দেয়। সেটাই প্রথম ধরা পরে লিগো ইন্ট্রারফেরোমিটারে ২০১৫ সালে। যা পদার্থবিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির যুগ্ম বিষ্ময় !  একটি প্রোটনের দৈর্ঘ্য কত?  এক সেন্টিমিটারকে এককোটি ভাগে ভেঙে, আবার তাকে এককোটি বার ভাংলে যে দৈর্ঘ্য হবে তার থেকেও ছোট । লিগোর ইন্টারফেরোমিটারের দৈর্ঘ্য ৪ কিলোমিটার। গ্রাভিটেশনার ওয়েভ, যা হাজার হাজার আলোকবর্ষ দূর থেকে আসছে- তা এই চারকিলোমিটার দৈর্ঘ্যকে খুব সামান্য কমিয়ে দেয়- যার পরিমান প্রোটনের ব্যাসার্ধ্যের সমান।  এত ছোট পরিবর্তন ধরে নিচ্ছে লিগো! 


দ্বিতীয় টাইপের ব্ল্যাকহোল গুলো রাক্ষুসে ব্ল্যাকহোল। এরা একটা গোটা গ্যালাক্সি গিলে ফেলতে পারে। এগুলি থাকে গ্যালাক্সির কেন্দ্রে। ইনফ্যাক্ট এই বড় ভরের ব্ল্যাকহোলগুলি- যা সূর্য্যের ভরের কোটিগুন -বা তারও বেশী- হয়ত গ্যালাক্সি সৃষ্টির মূলকারন।  যেমন আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রে আছে এমন এক ব্ল্যাকহোল যার ভর সূর্য্যের ভরের চল্লিশ লক্ষগুন। কি করে এর সন্ধান পেলেন বিজ্ঞানীরা ( যেকাজের জন্য এবার নোবেল প্রাইজ দেওয়া হল এন্ড্রিয়া গেইজ এবং রেইন হার্ড গেঞ্জেলকে)?

এন্ড্রিয়াগেইজের কাজ নিয়ে পুরো একটা পর্ব লিখব পরে- আপাতত এটা জানা যাক, এই কাজ করতে তার লেগেছে প্রায় ১৫ বছর। এত দীর্ঘ সময় ধরে তিনি আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রের চারটি নক্ষত্রের উপবৃত্তকার কক্ষপথ পর্যবেক্ষন করেছেন।  এর মধ্যে একটি হচ্ছে এস-২ , আরেকটি এস-৫৫। এস-২ এর কক্ষপথ আমাদের সূর্য্য থেকে নেপচুনের কক্ষপথের চারগুন, কিন্ত প্রদক্ষিন করে ১৬ বছরে। যা বৃহস্পতি সূর্য্যের চারদিকে পাক দিতে যা সময় নেয় তার থেকে কিছু বেশী। অন্যদিকে এস-৫৫ নেয় ১৪ বছর। মুশকিল হচ্ছে এরাত গ্রহ না, নক্ষত্র। সূর্য্যের থেকেও দশ-কুড়িগুন বেশী ভারী। এত ভারী ভারী নক্ষত্র কোন এক অদৃশ্যকেন্দ্রে লুকায়িত বিপুল ভরের প্রভাবে ঘুরে চলেছে-খুব দ্রুত-প্রায় ৫০০০ কিমি প্রতি সেকেন্ডে। আইনস্টাইনের তত্ত্বের দরকার নেই-শুধু নিউটনের সূত্র লাগালেই দেখাযাবে এই অদৃশ্য ভরের মান সূর্য্যের ভরের চল্লিশগুন! 

মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে খুব শক্তিশালী রেডিও ওয়েভ পাওয়া যায়-তা বহুদিন আগেই আবিস্কার করেছিলেন কার্ল জানস্কি ( ১৯৩১)। এই অঞ্চলটিকে বলে স্যাগিটেরিয়াস এ। এবারের নোবেল বিজেতা রেইনার্ড গেঞ্জেল ২০০২ সালে এই অঞ্চলের ইনফ্রারেড স্পেকট্রাম পর্যবেক্ষন করে প্রথম বলেন, এর কাছাকাছি ব্ল্যাকহোল আছে-না হলে অনেক স্পেক্ট্রামের ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব না। আসলে এই রাক্ষুসে ব্ল্যাকহোলের কাছাকাছি কখনো সখনো চলে আসে কোন গ্যাসপুঞ্জ, কখনো বা নক্ষত্র। বা নিউটন স্টার। বা ছোট ব্ল্যাকহোল। তখন রাক্ষুসে ব্ল্যাকহোল গিলে খায় তাদের। আর এই খাওয়ার সময় নক্ষত্রের গ্যাস, ম্যাটার সব প্রবল বেগে উচ্চতাপমাত্রায় ঢুকে যায় ইভেন্ট হরাইজনে। তাপ এত বেশী থাকে যে নিউক্লিয়ার ফিশন চলতে থাকে অবিরত। ফলে তৈরী হয় হরেক রকমের ইলেকত্রোমাগনেটিক স্পেকট্রাম। এক্সরে। গামারে। ইনফ্রারাড। 

আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রের এই রাক্ষুসে ব্ল্যাকহোল কি আমাদের একদিন খেয়ে ফেলবে ? 

 সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যদিও তারা ২৫,০০০ অলোক বর্ষ দূরে।  প্রায় ৩৫ লাখ বছর আগে, এক বিশাল হাইড্রোজেন গ্যাসপুঞ্জ ( যার ভর সূর্য্যের ভরের ১০০,০০০ হাজারগুন। এগুলি হচ্ছে গ্যালাক্সিতে নক্ষত্র তৈরীর উপাদান )  এই রাক্ষুসে ব্ল্যাকহোলের ইভেন্ট হরাইজনের কাছে এসে যায়। ফলে ব্ল্যাকহোল এই গ্যাস শুষে নেয়। এই গ্যাস সম্পূর্ন শুষে নিতে সময় লেগেছিল দশলাখ বছর। আর  ব্ল্যাকহোলের প্রবল গ্রাভিটেশনের টানে, হাইড্রোজেন পরমানুর ইলেকট্রন বিচ্ছিন্ন হয়ে জন্ম হয় এক উচ্চতাপমাত্রার প্লাজমা-যার থেকে তৈরী হয় হাইড্রোজেন ফিউশন চুল্লী। যা সূর্য্যের রান্নাঘর। 

অর্থাৎ যেই আমাদের রাক্ষুসে ব্ল্যাকহোল যখন এই হাইড্রোজেন গ্যাস শুষে নেওয়া শুরু করল, তার প্রবল টানে এবং চাপে এক সাময়িক সূর্য্যের জন্ম হয়। তার ব্যপ্তি বিশাল। আমাদের সৌরজগতের যে আকার তার থেকেও বড়। ভাবুন আমাদের সৌর জগতের সবটা জুড়েই সূর্য্য। কি প্রবল হবে তার আলোর তাপ ?  এই ঘটনায় যে উজ্জ্বলতা এবং  আলোর সৃষ্টি হয়েছিল, তার মান দশকোটি সূর্য্যের সমান। পৃথিবী থেকে ২৫,০০০ অলোক বর্ষদূরে এই উজ্জ্বল আলোকে দেখাযেত আমাদের আকাশে-যা চাঁদের আলোকেও হার মানাত সেই সময়। 


 কিন্ত তাতে কি কিছু ক্ষতি হতে পারত আমাদের পৃথিবীর? এখানে একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে। সূর্য্য কিন্ত মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে স্থির না। সেও সেই রাক্ষুসে ব্ল্যাকহোলের টানে  23 কোটি বছরে তার কক্ষপথ পূর্ন করে। এবং এই কক্ষপথ উপবৃত্তাকার।  বর্তমানে আমরা এই কক্ষপথের একদম দীর্ঘতম দূরত্বে আছি। যা আমাদের গ্যালাক্সির একদম বাইরের দিক। যেখানে নক্ষত্র খুব বেশী নেই। সব শান্ত। আগামি ত্রিশ মিলিয়ান বছরের মধ্যে আমাদের সূর্য্য আস্তে আস্তে গ্যালাক্সির ভেতরের দিকে ঢুকে যাবে।  যেখানে নক্ষত্রের সংখ্যা বেশী। ফলে মৃত নক্ষত্র থেকে জন্ম নেওয়া লুকিয়ে থাকা ব্ল্যাকহোলের সংখ্যাও বেশী।

 তারা কি আমাদের পৃথিবীকে খেয়ে নেবে?

সেই সম্ভাবনা কম। কিন্ত ক্ষতি হতে পারে অন্যদিক থেকে। আমাদের সৌর জগতের একদম বাইরের দিকটা হচ্ছে কুইপার বেল্ট।  এখানে আছে অসংখ্য গ্রহানু-যারা এমোনিয়া জল আর মিথেনের বরফে তৈরী।  এর মধ্যে প্রায় ১ লাখ গ্রহানু আছে যাদের ব্যাস ১০০ কিমির বেশী।  সূর্য্য যখন আস্তে আস্তে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ভেতরের দিকে যাবে তখন এই সব লুকিয়ে থাকা ব্ল্যাকহোল বা অন্য নক্ষত্রদের প্রভাবে বা ধরুন হঠাত করে যদি মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির রাক্ষুসে ব্ল্যাকহোল আবার বিশাল কোন গ্যাসপুঞ্জ খাওয়া শুরু করে- নানান কারনেই এই কুইপার বেল্টের স্থিতিশীলতা নষ্ট হতে পারে। সেক্ষেত্রে তারা কক্ষচ্যুত হয়ে ধূমকেতু হিসাবে সূর্য্যের দিকে ধাওয়া করবে।  এই পর্যন্ত ঠিক ছিল। কারন এই ধরনের অধিকাংশ দলছুট গ্রহানু বৃহস্পতির অভিকর্ষের টানে, বৃহস্পতি পিঠেই ঝড়ে যায়। কিন্ত ধরুন যদি ওই ধরনের রাক্ষুসে খাওয়ার সময় আমাদের সৌর জগত  ৫-১০,০০০ আলোক বর্ষ দূরেও থাকে, কুইপার বেল্ট ধ্বসে গিয়ে  দলে দলে ধূমকেতু তৈরী হবে। সেক্ষেত্রে কয়েকটি বৃহস্পতিকে ডজ করে পৃথিবীর দিকে ধাওয়া করতেই পারে।  বেসিক্যালি এখন চারমাসে একটি বড় এস্টারয়েড পৃথিবীকে ধাক্কা মারে। কিন্ত তা আমাদের বায়ুমন্ডলে পুড়ে যায়।  সূর্য্য যখন মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রের কাছাকাছি যাবে, তখন ব্ল্যাকহোলের সামনে ওমুন গ্যাসীয় খাবার আবার এসে গেলে, তার থেকে যে আলো তৈরী হবে, তার ্বিকিরন চাপেই  ভেঙে যেতে পারে কুইপার বেল্ট!  তখন দেখা যাবে প্রতি সপ্তাহে একটি করে বড় এস্টারয়েড ধেয়ে আসছে পৃথিবীর দিকে।

কিন্ত এমন ঘটনা কি অতীতে ঘটেছে? পৃথিবীতে প্রানের বয়স ৫০০ মিলিয়ান বছরের বেশী। এর মধ্যে  অনেকবার সূর্য্য  গ্যালাক্সির সব থেকে ঘন এলাকা পার করে এসেছে। তাহলে তখন আমাদের প্রানী মন্ডল ধ্বংস হয় নি কেন? 

হয়েছে। প্রায় ছবার পৃথিবীর প্রানী জগত প্রায় ধ্বংস হতে চলেছিল। লাস্ট টাইম যখন ডাইনোসররা ধ্বংস হল। সেই সময় সূর্য্য ছিল, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির সব থেকে ঘন এলাকাতে । যেখানে নক্ষত্র, গ্যাসপিন্ড আর মৃত তারাদের কবরস্থল। মানে ব্ল্যাকহোল কিলবিল করছে। 

নিউয়ার্ক উনিভার্সিটির মাইকেল রাম্পিনো দেখিয়েছেন প্রতি ২৬ মিলিয়ান বছর অন্তর অন্তর, পৃথিবী বৃহৎ মাস এক্সটিংশনের সম্মুখীন হয়েছে। বিজ্ঞানীরদের একটি বড় অনুমান এর কারন ২৬ মিলিয়ান ( দুই কোটি ষাটলাখ) বছর অন্তর অন্তর সূর্য্য আসলেই গ্যালাক্সির ঘন অঞ্চলে চলে আসে। যেখানে লুকিয়ে আছে অনেক ব্ল্যাকহোল। মৃত নক্ষত্র।  সংঘর্ষ হলে, সূর্য্যই চলে যাবে ব্ল্যাকহোলের পেটে। কিন্ত সংঘর্ষ না হয়ে, খুব দূর থেকেও প্রবল অভিকর্ষের টানে বা ব্ল্যাকহোলের ইভেন্ট হরাইজনে ঘটা গ্যাস নির্গত প্রবল আলো থেকে ঘেঁটে যেতে পারে কুইপার বেল্ট। তখন বড় বড় পাথর আছড়ে পড়বে পৃথিবীর বুকে।  

তবে এই তত্ত্ব এখনো পরীক্ষিত না। 

তাহলে ব্ল্যাক হোল মানেই কি মৃত্যু?  সাক্ষাত যমরাজ? 

মোটেও না। ব্ল্যাকহোল আমাদের আশার আলোও বটে। আস্তে আস্তে সব গ্যালাক্সি, সব নক্ষত্রের মৃত্যু হবে। কিন্ত ব্ল্যাকহোলদের মৃত্যু হয় খুব আস্তে। এই মহাবিশ্ব মরে ভূত হলেও ব্ল্যাকহোলরা আরো অনেকদিন থেকে যাবে। কেন?

 ব্ল্যাকহোলের ইভেন্ট হরাইজন থেকে নির্গত হয় হকিং রেডিয়েশন।  ইভেন্ট হরাইজনের কাছে,  শুন্যস্থানের স্পেস টাইম ঘেঁটে দেওয়া জন্য তৈরী হয় পার্টিকল-এন্টিপার্টিকল। যাদের ধ্বংসে তৈরী হয় দুটী ফোটন কনা। একটি মহাবিশ্বে ছড়িয়ে যাবে, অন্যদিকে ব্ল্যাকহোলে চিরকালের জন্য আটকে থাকবে।

অর্থাৎ ব্ল্যাকহোল সম্পূর্ন কালো না- তার ইভেন্ট হরাইজন থেকে কিছু এনার্জি পাওয়া যায়। কিন্ত ভাবছেন সেখানে মানুষ থাকবে কি করে? গ্রাভিটি এত শক্তিশালী? সেত মানুষকে পাস্তা ( স্পাগোটি) বানিয়ে ছেড়ে দেবে? 


ওয়েল এখানেই মজা আছে।  ধরুন পৃথিবীর ব্যাসার্ধ ৬৪০০ কিলোমিটার। এবার ধরুন হঠাৎ করে সেই ব্যাসার্ধের মান অর্ধেক করে দিলেন-সঙ্গে সঙ্গে "জি" মানে ভূপৃষ্টে টানের পরিমান বাড়বে ৪ গুন। এইটুকু সহ্য করে নিতে পারে মানুষ। কিন্ত যদি পৃথিবীর ব্যাসার্ধকে   ১/১০ ভাগ মানে, ৬৪০ কিমি করে দেওয়া হয়? সেক্ষেত্রে  ভূপৃষ্টে টানের পরিমান হবে ১০০ জি। যা মানুষ ২ সেকেন্ডের বেশী সহ্য করতে পারবে না। মারা যাবে।  এবার যদি ব্যাসার্ধ্য ৬৪ কিমি করে দেওয়া হয়? তখন ভূপৃষ্টে জি এর মান ১০,০০০ জি। ওই শক্তিদিলে, আমাদের দেহ একদম মাটিতে মিশে যাবে দশ সেকেন্ডের মধ্যে। দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে মাটিতে।  এবার যদি পৃথিবীকে ১ কিমির গোলকের মধ্যে ঢুকিয়ে দিই? তখন সেই প্রবল বলে দেহের কোষ শুধু না, নানান জৈব অনুগুলি পর্যন্ত ভেঙে গ্যাস হয়ে যাবে। 

আর যদি পৃথিবীকে ৯ মিলিমিটারের গোলকের মধ্যে ঢোকায়-তখন সেই ইভেন্ট হরাইজনে ফোর্সের পরিমান? কল্পনার অতীত। ওই বলে পরমানু কোলাপ্স করে নিউট্রন হয়ে যায়!

তাহলে ইভেন্ট হরাইজনে সভ্যতা বাঁচবে কি ককরে? আমরা বাঁচব কিভাবে? 

 হ্যা, এই রাক্ষুসে ব্ল্যাকহোলগুলোই তখন হবে ভরসা। কেন সেটাও নিউটন দিয়েই বলেদেওয়া যায়, আইনস্টাইন লাগে না।  ধরুন আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ব্ল্যাকহোল। সূর্য্যের ভরের চল্লিশ লাখগুন তার ওজন। তাহলে তার ইভেন্ট হরাইজন হবে ৬০/৮০ লাখ কিমি। সেখানে অভিকর্ষজ বল প্রবল, কিন্ত অত বেশীও না। 

তবে কিনা তদ্দিনে আমাদের "দেহ" থাকবে না । এই মানব দেহ যেটুকু কাজ করে, চিন্তা করে তার তুলনায় প্রচুর এনার্জি খায়।  যেকোন উন্নত সভ্যতায় "দেহ" থাকার সম্ভাবনা কম। দেহ মানেই মৃত্যু। প্রচুর এনার্জি খরচ। আর  আমরা যেটুকু চিন্তা করতে পারি, এক সেন্টিমিটারের ছোট সিলিকন চিপ তার থেকেও বেশি  ভাবতে পারে!  সুতরাং ভবিষ্যতে কাজের জন্য থাকবে রোবট- আর মানবচেতনা, চিন্তা হয়ত ঢুকে যাবে চিপের মধ্যে।  এই মানবদেহ মেইনটেইন করতে আমরা এত কার্বন ডাই অক্সাইড তৈরী করছি, গোটা পৃথিবী ধ্বংস হতে চলেছে। আমার ধারন আগামী কয়েক শতাব্দির মধ্যেই দেহ ব্যাপারটাই থাকবে না। শুধু মন রয়ে যাবে। 

 সেই সভ্যতা কিন্ত এই ব্ল্যাকহোলের গ্রাভিটির সাথে কিছুটা হলেও সহবস্থান করতে পারবে। 

কিন্ত এই গ্যালাক্সিতে যে এক কোটি ব্ল্যাকহোল এখানে ওখানে লুকিয়ে আছে-সেগুলো হচ্ছে যুদ্ধের ফিল্ড মাইন । সূর্য্য কিন্ত এই গ্যালাক্সি প্রদক্ষিন করছে। সুতরাং ওমন এক ব্ল্যাকহোলে পা দিলেই কুইক স্যান্ড। সূর্য্য চলে যাবে ব্ল্যাকহোলের পেটে। 

তাহলে সেইসব ব্ল্যাকহোলদের আগে থেকে আমরা সনাক্ত করতে পারি না? যারা ঘাপটি মেরে পরে আছে? যাদের ইভেন্ট হরাইজনে কোন গ্যাস নেই, তারা নেই-ফলে সবকিছুতে মৃত্যুর শান্তি? 

 উত্তর হচ্ছে-সম্ভব। গ্রাভিটেশনাল মাইক্রোলেন্সিংর মাধ্যমে। ১৯৯২ সালেই আবিস্কৃত হয়েছে এই মাইক্রোলেন্সিং। সেটা বুঝতে আমাদের আবার আইন স্টাইনের সমীকরন এবং হকিং পেনরোজে ফিরে যেতে হবে। যারা রায় চৌধুরী সমীকরন কাজে লাগিয়ে ব্ল্যাকহোল সংক্রান্ত অনেক ফিজিক্সের আগে থেকেই নির্ভুল ভাবে বলে গেছেন। সেটাই পরের পর্বে লিখছি। 

  


 


 




  


 


 

 

  

Saturday, October 10, 2020

রায়চৌধুরী সমীকরন থেকে পেনরোজ হকিং সিঙ্গুলারিটি তত্ত্ব -পর্ব-2

                                                                            (৪)

রায়চৌধুরী সমীকরন এবং তার গুরুত্ব বোঝার  আগে অমলবাবুর সাথে একটু পরিচয় সেরে নেওয়া যাক।

       অমল রায়চৌধুরীর জন্ম বরিশালে। ১৯২৬। জন্মের পর তার পিতা -যিনি গণিতের শিক্ষক ছিলেন, চলে এলেন কোলকাতায়। হিন্দু স্কুলে তার পড়াশোনা। প্রেসিডেন্সিতে ১৯৪২ সালে  ফিজিক্সে  বি এস সি। ভারত তখন টালমাটাল। একদিকে কুইট ইন্ডিয়া।  কোলকাতার আকাশে জাপানী প্লেনের সর্টি।  দুর্ভিক্ষ। অন্যদিকে জিন্নার ডাকে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক ক্রমশ খারাপের দিকে। 

  কোলকাতায় থাকা "সেফ" না। অমল বাবুর ফ্যামিলি বরিশালে ফিরে এল। সেখানে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের অবনতি। চাপা টেনশন। শেষে অমলবাবুর ফ্যামিলরা আবার কলকাতায় ফিরলেন। অমল রায় চৌধুরী ১৯৪৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিজিক্সে এম এস সি পাশ করেন ।

 ছোটবেলা থেকে অমলের নেশা অঙ্কে। এলজেব্রার বই পেলে দুই দিনে সব অঙ্ক শেষ। বাকী সাবজেক্টে মন নেই। কিন্ত অঙ্ক না নিয়ে পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়লেন। কেন?

 কারন অমলবাবুর পিতা। উনি অমলকে বললেন দেখছিস ত কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়ার পরেও স্কুলের শিক্ষকতা করছি। অঙ্ক বাদ দে। অন্য সাবজেক্ট নিয়ে পড়।  সুযোগ বেশী।

 অমল রায়চৌধুরী ফিজিক্স নিলেন। কারন অঙ্ক করার সুযোগ বেশী। কিন্ত ল্যাবেটরীর ক্লাস তার ভাল লাগত না। 

এম এস সি পাশ করে যাদবপুরের কাল্টিভেশনে গবেষনা করতে ঢুকলেন (১৯৪৬)।  পদার্থবিদ্যার তাত্ত্বিক কাজে ফেলোশিপ প্রায় থাকেই না। ফলে এক্সপেরিমেন্টাল কাজ শুরু করতে হল। ধাতু -অর্থাৎ মেটালের ধর্ম নিয়ে পি এইচ ডি শুরু করলেন।

কিন্ত ল্যাবে মন নেই। অঙ্ক করতে, অঙ্কের সমাধান করতে ভালবাসেন অমল।  আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সমীকরনের সমাধান নিয়ে প্রচুর চর্চা-বিতর্ক চলছে। মহাবিশ্ব  প্রসারনশীল-মানে একটা বিন্দু থেকে শুরু করে আজকের অবস্থায় এসেছে-তাই নিয়ে দুর্দান্ত সব কাজ ফিজিক্সের জার্নালে পড়ছেন। কিন্ত দিনের বেলায় স্পেক্টোফটোমিটারে রিডিং নিচ্ছেন! মন ভরে আছে সব বিরাট বিরাট ইকোয়েশনে। হাত মন নিশপিশ করছে সেসব সলভ করতে। কিন্ত উপায় নেই!

ফলে সাড়ে চার বছর বাদে দেখা গেল এক্সপেরিমেন্টাল কাজে  কিছুই করতে পারেন নি।  একটি পেপার ও না। অমল রায়চৌধুরীর আত্মবিশ্বাস ধাক্কা খেয়েছিল।  এদিকে পারিবারিক অবস্থা খারাপ। ফেলোশিপ গেছে। ফলে আশুতোষ কলেজে ফিজিক্সের লেকচারারের কাজ নিলেন। সেটা ১৯৫০ সাল।

কি আর করা যাবে। পাখীকে সাঁতার কাটতে বলা আর মাছকে উড়তে বলা একই ব্যাপার! 

কলেজে পড়ানোর কাজ একদিকে ভাল। কারন এখন তিনি মুক্ত।  যা চাইবেন তাই নিয়ে কাজ করতে পারবেন। ফলে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্ণিতের অধ্যাপক সেনের কাছে গেলেন, আইনস্টাইনের সমীকরনের এক বিশেষ সমাধান নিয়ে। 

সেই সময় কোলকাতায় কসমোলজিতে ডিফারেন্সিয়াল জিওমেট্রী বোঝার মতন কেউ ছিল না। সেন কিছুই বুঝলেন না। শুধু বল্লেন কোলকাতার ম্যাথ গেজেটে ছাপিয়ে দাও। আর হ্যা, শেষে আমার নাম টা দিও কিন্ত।

অমলরায় চৌধুরী বুঝলেন কোলকাতার বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে তার পাওয়ার কিছু নেই।  এর থেকে নিজে কাজ করে বিদেশী জার্নালে পাঠানোই ঠিক কাজ হবে।

তিনি প্রথমেই যে প্রবলেমটা সমাধান করার চেষ্টা করছিলেন -সেটা হচ্ছে এই যে আইনস্টাইনের সমীকরনের সব সমাধান তখনো পর্যন্ত আইসোট্রোপিক হমোজেনাস মহাবিশ্বের অনুমান। অর্থাৎ মহাবিশ্বের ভর, ধর্ম চারিদিকে সমান! কিন্ত মহাবিশ্ব তা না। তার ধর্ম বা ভর চারিদিকে সমান ভাবে ছড়িয়ে নেই। তাহলে একটা বিন্দু থেকে যাত্রা শুরু করে  কি করে তৈরী হল এই এনাইসোট্রোপিক মহাবিশ্ব যার চারিদিক সমান না?

 তা ছাড়া সব সমাধানেই সিঙ্গুলারিটি আসছে- যার কোন পরীক্ষালদ্ধ প্রমান তখনো নেই। তাহলে কি এমন সমাধান পাওয়া যাবে, সেখানে স্পেস টাইম ক্ষুদ্র ব্যাসার্ধে ভেঙে পড়বে না?  এমন হাজারো চিন্তা তরুন অমলের মাথায়। 

১৯৫০ থেকে ৫৫ সালের মধ্যে এই সমস্যাগুলির সমাধানে তিনটে পেপার পাবলিশ করেন অমল রায়চৌধুরী। এর মধ্যে তার তৃতীয় পেপারে ছিল তার বিখ্যাত রায়চৌধুরী ইকোয়েশন। 

 উনি দেখালেন গ্রাভিটেশনাল ফোর্স ছাড়াও ঘুর্নয়মান বস্তু বা ক্লাস্টারের জন্য আইনস্টাইনের ইকোয়েশনের সমাধান করতে গেলে দেখা যাচ্ছে, গ্রাভিটেশন ছাড়াও, ঘুর্ননের জন্য সিওডোফোর্স, শিয়ারিং ফোর্স, টর্সন আরো অনেক কিছুই বস্তুর ওপর কাজ করছে।  এদের কেউ গ্রাভিটেশনের পক্ষে, কেউ বিপক্ষে কাজ করে। 

কেন গুরুত্বপূর্ন এই কাজ? কারন বিপুল পরিমান ভর নিজের গ্রাভিটেশনের চাপে 
কোলাপ্স করতে পারে। তাতে সিঙ্গুলারিটি তৈরী হয়-অর্থাত স্থান কালের জ্যামিতি এমন ভাবে ভেঙে যায়- সেই সমাধান বিশ্বাসযোগ্য না। 

রায়চৌধুরী সমীকরন থেকে প্রথম জানাগেল, গ্রাভিটেশনাল কোলাপ্স আটকাতে কিছু বিরুদ্ধ ফোর্সও তৈরী হচ্ছে।  সুতরাং খুব ক্ষুদ্র গোলকের মধ্যে সব ভর ঢুকিয়ে দিলেই সব কিছু 
কোলাপ্স করবে ( যা সোয়ার্জ চাইল্ড সমাধানে ছিল )-ব্যপারটা অমন জলবৎ তরলং না। খুব ক্ষুদ্র ব্যাসার্ধের মধ্যে অনেক ভর ঢুকিয়ে দিলেও জ্যামিতি সম্পূর্ন ঘাঁটবে না-যা সোয়ার্জচাইল্ড সমীকরনে হচ্ছিল। 

অর্থাৎ একটা সূত্র পেলেন বিশ্বের  বিজ্ঞানীরা।  আইনস্টাইনের সমীকরনে যে সিঙ্গুলারিটি আসে- যার থেকে ব্ল্যাকহোলের  উৎপত্তি-তা সম্পূর্ন বোধগোম্যের বাইরে তা না। 

,মুশকিল হচ্ছে, আইনস্টাইনের মতন রায়চৌধুরীও সমীকরন দিয়ে সরে গেলেন। সমাধান তিনিও দিয়ে যান নি। তার জন্য আমাদের হকিং-পেনরোজ পর্যন্ত পনেরো বছর অপেক্ষা করতে হবে (১৯৭০)।  সেটা নিয়ে পরের পর্বে লিখব। 

দুঃখের ব্যপার এই যে অমল বাবু নিজের সমীকরন সমাধান করার চেষ্টা করলেন না কেন? কেন সেই কাজ পেনরোজ হকিং এর জন্য পড়ে রইল? 

১৯৫৭ সালের মধ্যে তার কাজ গোটা বিশ্বে সমাদৃত। কিন্ত আশুতোষ কলেজের এক ফিজিক্সের লেকচার তার কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন তার উপায় ই বা কি?  অমল বাবু আবার কাল্টিভেশন অব ফিজিক্সে গবেষক হওয়ার দরখাস্ত করেন । এবারো কেউ  পাত্তা দিল না। তার কাজ কোলকাতায় কেউ বুঝত না। ফলে কিছুটা বাধ্য হয়েই ১৯৬২ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে প্রফেসর হিসাবে যোগ দেন। 

এখানে তিনি সারাদিন ছাত্র পড়াতেন। ল্যাব নিতেন। রিসার্চের সময় পেতেন কম। নিজেকে উজাড় করে ছাত্রদের দিয়েছেন। কিন্ত তার কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে পরিবেশ ফুসরত দরকার ছিল, সেটা পান নি। ফলে তার সমীকরনের সমাধান করে পেনরোজ হকিং ব্ল্যাকহোল তত্ত্বের মূল জনক। পেনরোজ স্বীকৃতি স্বরূপ নোবেল প্রাইজ পেলেন এবছর।  তিনি হয়ে রইলেন প্রিয় মাস্টার মশাই। 


                                                            (৫)

  গণিত আসলে কি? সমীকরন বা ইকোয়েশন এদ্দিন ধরে যা করে আসছি সেটাই আসলে কি ? গণিত আসলে বিজ্ঞানের ভাষা। ভাষাতে যেমন আছে অক্ষর, অক্ষর সাজিয়ে শব্দ-সেখান থেকে বাক্য। গণিত ও তাই। এখানে "বাস্তবতার" ব্যবহারকে ভাষা দিতে নোটেশন-নোটেশন থেকে ইকোয়েশন বা সমীকরনের জন্ম। আর তার সমাধান হচ্ছে একেকটি গল্প, বা কবিতা বা উপন্যাস। 

                   - তলের পরিবর্তনের জ্যামিতি যা  রিকি কার্ভেচার বলে আগের পর্বে জানলাম, সেটা কিভাবে বদলাবে যদি আইনস্টাইনের ফিল্ড ইকোয়েশন একটি ঘুর্নয়মান ভরের জন্য সমাধান করা হয়?  দুটি ঘটনা যদি আগে পিছে ঘটে তারাই বা এই কার্ভেচারে জ্যামিতে কিভাবে আসবে সমীকরনের অংশ হিসাবে?

                   -জিওডেসিস্ক , অর্থাৎ যে পথে একটি বস্তু একটি তলের ওপর  পয়েন্ট এ থেকে বি তে ক্ষুদ্রতম দূরত্বে পৌছাবে। যেমন ধরুন ইন্টারন্যাশাল ফ্লাইটগুলি জ্বালানী কমাতে  পৃথিবীর এক শহর থেকে যখন অন্যশহরে যায় তখন লক্ষ্য থাকে কিভাবে পৃথিবীর গোলকতলের ওপর সংক্ষিপ্ততম পথ নেবে। গ্রাভিটেশন বা অভিকর্ষজ বলের প্রভাবে কিভাবে একটি পার্টিকল একটি বিন্দু থেকে অন্য বিন্দুতে যাবে, সেটা আইনস্টাইনের ফিল্ড সমীকরনে খুব সহজ -জাস্ট একটা জিওডেসিস্ক যা স্থান কালের তলে ক্ষুদ্রতম পথে এক বিন্দু থেকে অন্য বিন্দুতে পৌঁছে যায়।

   

     মূলত এই তিনটিই ভিত্তি রায়চৌধুরী সমীকরনের।  হকিং-পেনরোজ সিঙ্গুলারিটি থিওরেম কিভাবে রায়চৌধুরী সমীকরন থেকে এল সেটি নিয়ে পরের পর্বে লিখব। এবার সংক্ষেপে রায় চৌধুরী সমীকরনটি জেনে নিই। 

 রায়চৌধুরী সমীকরনের বাঁদিকের টার্মটি  যেহারে মহাজাগতিক বস্তুর ভর বেড়ে চলেছে বা কমছে। সেই রেট। এটিকে বলে এক্সপানশন স্ক্যালার। কারন এই টার্মটি থেকেই বোঝা যাবে মহাজগত একটি ক্ষুদ্রকনা থেকে শুরু করে কিভাবে চারিদিকে তার এক্সপানশন হচ্ছে। 


  কিন্ত এই বস্তুর ভরের এই এক্সপানশন বা বর্ধন রেট কার কার ওপর নির্ভরশীল? সেটাই সমীকরনের ডানদিক। 

 ডানদিকে চারটি গুরুত্বপূর্ন টার্ম।

 এক ভরের এক্সপানশন ভরের বর্গানুপাতিক- অর্থাৎ স্কোয়ারের ওপর নির্ভরশীল 

  দুই শিয়ার ফোর্স -অর্থাৎ স্থানকালের যে জ্যামিতিক তল-তার গাঁ ঘেষে আরেকটি ফোর্স তৈরী হয়।

   তিন টর্সন । স্থানকালের জ্যামিতিক তলগুলোকে মুচরানোর জন্য আরেকটি ফিল্ড

   চতুর্থ টাইডাল টেন্সর থেকে উদ্ভুত রায়চৌধুরী স্ক্যালার। যা আসলে ক্ল্যাসিক্যাল গ্রাভিটেশনাল বলের আরেক রিপ্রেজেন্টেশন। 

 তাহলে দাঁড়াল কি? ধরুন একটি গ্যালাক্সি তৈরী হচ্ছে। শুরুতে গ্যাসগুলি বৃত্তাকারে ঘুরছে।  স্থানকালের জ্যামিতি গ্যাসের ভরের জন্য আস্তে আস্তে গ্যালাক্সির স্ট্রাকচার চেঞ্জ করছে। রায়চৌধুরী সমীকরন দেখাচ্ছে সেখানে গ্রাভিটেশন বা অভিকর্ষজ বল ছাড়া-শিয়ারিং ফোর্স, টর্সন আরো অনেক কিছুই আছে-যার প্রভাবে আস্তে আস্তে গ্যালাক্সির এক্সপানশন হবে। এবং চারিদিকে সমান ভাবে তা হবে না।

শুধুই কি তাই? যদি গ্রাভিটেশনের ফোর্স অন্যান্য টার্মের থেকে বেশী হয়? তাহলে সিস্টেম কোলাপ্স করে-সব মাস একসাথে এসে সিঙ্গুলারিটিটে ঢুকে যাবে।

যদি শিয়ার বা টর্সন বেশী থাকে? জ্যামিতির তলকে আরো টানতে থাকুন- সিস্টেম আস্তে আস্তে বড় হবে।

অর্থাৎ অভিকর্ষজ বলের প্রভাবে বড় বড় নক্ষত্রগুলি কিভাবে  নিজের ভরের চাপে, নিজেরা কেন কোলাপ্স করে ব্ল্যাকহোলের দিকে যাবে বা স্থিতিশীল অবস্থা বজায় রাখতে পারবে -কেন পারবে-তার একটা দিশা পাওয়া গেল রায় চৌধুরী ইকোয়েশন থেকে। 

রায়চৌধুরী ইকোয়েশনকে অনেক সময় ল্যান্ডাউ-রায় চৌধুরী ইকোয়েশন বলা হয়। কারন নোবেল জয়ী সোভিয়েত বিজ্ঞানী লেভ ল্যান্ডাউ  প্রায় একই সময়ে এই সমীকরন, অন্যভাবে দেখান। 

দুর্ভাগ্য আমাদের।   অমল রায়চৌধুরীর নাম লেভ ল্যান্ডাউ, পেনরোজ, হকিং, হয়েল ইত্যাদিদের সাথে উচ্চারিত হয়। যারা এই শতাব্দির শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী।  অথচ ১৯৫৭ সালে রায়চৌধুরী ইকোয়েশন তৈরী করার পর, তিনি ভারতের রিসার্চ ইন্সটিউটের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন কেউ যদি তাকে গবেষক হিসাবে নিতে রাজি হয়। কারন আশুতোষ কলেজে ছাত্র পড়িয়ে বিচ্ছিন্ন ভাবে এই গবেষনা টেনে নিয়ে যাওয়া ছিল অসম্ভব। তিনি গবেষনার পরিবেশ খুঁজছিলেন। কোলকাতায় কেউ তার কাজ বুঝতেই পারে নি। কারুর কাছ থেকে এতটুকু সাহায্য পান নি। 

পরের পর্বে হকিং পেনরোজ কিভাবে রায়চৌধুরীর ইকোয়েশন কাজে লাগিতে ব্ল্যাকহোলের ধারনা দিলেন-সেটা নিয়ে আলোচনা করা যাবে।  একদম শেষ পর্বে ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্ব পরীক্ষার মাধ্যমে কিভাবে প্রমানিত হয়ে চলেছে  ।  যার জন্য এবছর পেনরোজের সাথে নোবেল প্রাইজ পেলেন এন্ড্রিয়া গেইজ এবং রিচার্ড গেঞ্জেল। যারা দেখিয়েছেন গ্যালাক্সির জন্মই সম্ভব না ব্ল্যাকহোল ছাড়া এবং আমাদের মিল্কওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রেও আছে এক সুপার ব্ল্যাকহোল।  এই আবিস্কারের গল্পও চিত্তাকর্ষক এবং ধারাবাহিক। 





   

  

                  

                  

                        

রায়চৌধুরী সমীকরন থেকে পেনরোজ হকিং সিঙ্গুলারিটি তত্ত্ব -পর্ব-১

                                                                     (১)
রজার পেনরোজ বেশ ঘন ঘন কোলকাতায় এসেছেন গত দুই দশক। মূলত তার ব্লক ব্লাস্টার বেস্ট সেলার " এম্পায়ার নিউমাইন্ডের" দৌলতে কিশোর বয়স থেকেই তার নাম শুনেছেন অধিকাংশ বুদ্ধিজীবি বাঙালী।্পেনরোজের  কোয়ান্টাম কনসাসনেসের কনজেক্টচার খায় না মাথায় দেয়, সেটা না বুঝলেও, অজানা অচেনা চেতনার বিজ্ঞান যে বিজ্ঞানের চেনাজানা পথে বোঝা যাবে না, সেটুকু পেনরোজ পড়েই জেনেছি কলেজ জীবনে। 

 রজার পেনরোজ নোবেল না জিতলেও কিছু যায় আসত না। তিনি গণিত এবং অঙ্কে এতকিছু নতুন ধারনা, নতুন সমাধানের জন্ম দিয়েছেন ( পেনরোজ টাইলিং, পেনরোজ লুকাস আর্গুমেন্ট ইত্যাদি)  সেগুলোর ফর্দ বানালে মনে হবে,  সেটা বুঝি একটা গোটা দেশের এক শতাব্দির অবদান!  তার কাজ নিয়ে জার্নালিস্ট সিমপ্লিফিকেশনে লেখা বেশ কঠিন, কিন্ত ইচ্ছা রইল পরে লিখব। 

 রজার নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন ব্ল্যাকহোলের পদার্থবিদ্যায় তার অবদানের জন্য- যা পেনরোজ হকিং সিঙ্গুলারিটি তত্ত্ব নামে খ্যাত।  যার উৎসে আছে এক বাঙালী বিজ্ঞানীর নাম- অধ্যাপক অমল রায়চৌধুরী-যিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে বহুদিন অধ্যাপনা করেছেন।  এই তথ্যটুকু নানান ওয়েব্জাইনের দৌলতে সবাই জেনে গেছে। কিন্ত কোন লেখাতেই রায়চৌধুরী সমীকরন এক্সাক্টলি কি- সেটা নিয়ে কোন সহজ আর্টিকল চোখে পড়ল না।  যেহেতু, তার কাজ ডিফারেন্সিয়াল জিওমেট্রি নিয়ে, এটা সহজ করে বোঝানো বেশ কঠিন। আমি এই প্রবন্ধে চেষ্টা করছি,  সহজ করে বোঝাতে, যাতে একটা সাধারন ধারনা হয়। ( তবে লিখতে গিয়ে বুঝলাম কাজটা বেশ কঠিন)। 

                                                                              (২)
আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরী অব রিলেটিভিটির প্রকাশকাল ১৯১৫। ঘনঘোর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্যেই আইনস্টাইন সুন্দর একটি টেন্সর সমীকরন দিলেন-কিভাবে মাস অর্থাৎ ভরের প্রভাবে স্থান-কালের জ্যামিতিটাই বদলে যাবে। 

কিন্ত সমীকরন হচ্ছে একটা সিস্টেম কিভাবে আচরন করবে সেটা বোঝানোর জন্য বিভিন্ন রাশিগুলির ( যেমন নক্ষত্রের ভর, গ্যালাক্সির ভর, তাদের স্থান কালের জ্যামিতির নানান প্যারামিটার)  মধ্যে যে সম্পর্ক, সেটির গণিতিক রূপ।  অর্থাৎ পদার্থবিদ্যা বা বিজ্ঞানে ইকোয়েশন হচ্ছে ( বা যেকোন গণিতের জন্যই ইহা সত্য- তা বিজনেস গণিত হলেও ) মেকানিকের স্ক্র ড্রাইভার বা ইলেক্ট্রিশিয়ানের মাল্টিমিটার।  
টুল বা তাত্ত্বিকদের সেই যন্ত্র হচ্ছে ইকোয়েশন-যেটা দিয়ে তারা মহাবিশ্বের প্রকৃতির রহস্যের ঘোমটা খুলবেন। 

তা ধরুন আইনস্টাইন ১৯১৫ সালে শুধু জেনারেল থিওরী অব রিলেটিভিটির সমীকরনটাই দিয়ে গেলেন। তাতে কিন্ত সমাধান নেই। কিভাবে আইন্সটাইনের সমীকরনের সমাধান করা যায়, সেটা আরেকটা বিরাট ইতিহাস গত একশো বছর ধরে। 

তত্ত্ব-সমীকরন দিলেই ত বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন না। কারন তত্ত্ব/ সমাধান  তৈরীর মূলে থাকে "এসাম্পশন"-অসংখ্য অনুমান। সেই অনুমান ঠিক কি করে বুঝবেন?

  সুতরাং  আইনস্টাইন শুধু রিলেটিভিস্টিক গ্রাভিটেশনের সমীকরন দিয়ে দেবেন এবং বিখ্যাত হবেন, ব্যপারটা মোটেও অত সহজ না ১৯১৫ সালে।   তার সমীকরনের অসংখ্য সমাধান থাকলেও, তাকে দুটি ক্ষেত্রে সমীকরনটা সমাধান করতে হল যেখানে পরীক্ষালদ্ধ প্রমান সম্ভব--

          আইনস্টাইনের হাতে যে ডেটা ছিল, যা নিউটনিয়ান ফিজিক্স দিয়ে ব্যখ্যা করা যায় না- সেটা হচ্ছে মার্কারী বা বুধের প্রিশেশন।  সমস্ত গ্রহ সূর্যের চারিদিকে উপবৃত্তাকার কক্ষে ঘোরে। এটা আমরা জানি। এই উপবৃত্তাকার কক্ষপথ একটা সমতলে থাকে।মুশকিল হচ্ছে এই যে সমতলে সমস্ত গ্রহ ঘুরছে, সেই সমতলটি আবার একটু আধটু দুলতে থাকে-বেশ নিয়ম মেনে, লাট্টুর মতন। এর কারন বুধের ওপর অন্যান্য গ্রহদের টান ( তা সূর্য্যের থেকে যতই কম হোক না কেন)।  

   যোশেফ ভার্নিয়ার ( যার নামে ভার্নিয়ার স্কেল), ১৮৫৯ সালে জানালেন, নিউটনিয়ান মেকানিক্স দিয়ে এই  প্রিশেসন ডেটা মিলছে না। উনি ১৬৯৭ থেকে ১৮৪৮ সাল পর্যন্ত মার্কারির সমস্ত প্রশেশনের ডেটা নিলেন।  দেখাগেল মার্কারির প্রিশেন এঙ্গল- অর্থাৎ এই যে হেলছে দুলছে নিজের অক্ষ থেকে, যতটা এঙ্গলে হেলেছে তা ৫৭০ সেকেন্ডের কাছাকাছি। নিউটনিয়ান মেকানিক্স দিয়ে ৫৪০ পর্যন্ত ব্যখ্যা করা যাচ্ছে । ৩০ সেকেন্ডের পার্থক্য ( বর্তমানে আমরা জানি এক্যুরেট ৪২ সেকেন্ডের পার্থক্য থাকে)- কোন ব্যখ্যা নেই।

  ১৯১৫ সালেই তার সেই ভীষন জটিল সমীকরনের বেশ সহজ সরল এক সমাধান করে ( এবং যা করতে গিয়ে তাকে এক গুচ্ছের অনুমানের সাহায্য নিতে হয়) আইস্টাইন  দেখালেন এই ৩০ সেকেন্ডে পার্থক্য, তার জেনারেল থিওরী অব রিলেটিভিটি  ব্যখ্যা করতে পারছে। 

 কিন্ত বিজ্ঞানীরা তাকে বিশ্বাস করবে কেন? রেজাল্ট জানা থাকলে, অনুমান গুলি ম্যানুপুলেট করা সহজ। সুতরাং তার সমীকরন যতই সুন্দর হোক, দরকার ছিল এই সমীকরন থেকে "প্রেডিক্ট" করা কোন ঘটনা -যা নিউটনিয়ান মেকানিক্স দিতে পারবে না-এবং এস্ট্রোনমাররা তা পরীক্ষা করে দেখতে পারবেন।

 হেনরী ক্যাভেন্ডিশ ( হ্যা আমাদের সেই বিখ্যাত কেমিস্ট যিনি হাইড্রোজেন আবিস্কার করেছিলেন) ১৭৯৭ সালে দেখান যে নিউটনিয়ান মেকানিক্সএর একটি প্রতিপাদ্য হচ্ছে, সূর্য্যের মতন বৃহৎ ভরের বস্তুর কাছ দিয়ে আলো আসার সময় বেঁকে যাবে। ১৯১১ সালে আইনস্টাইন দেখালেন,  ( তখন ও জেনারেল রিলেটিভিটি আসে নি) এর মান হবে , এক সেকেন্ডের কিছু কম। এবং তার প্রেডিকশন জোহান সোল্ডনারের সাথে মিলে যাচ্ছে যিনি ১৮০০ সালে একই প্রেডিকশন করেছিলেন।

 কিন্ত ১৯১৫ সালে  জেনারেল থিওরী আবিস্কার করার সাথে সাথে আইনস্টাইন বুঝলেন, ১৯১১ সালের কাজ ভুল।  আসলে সূর্য্যের প্রভাবে যে নক্ষত্রের আলো বেঁকে যাবে ( নইলে আলোর সরলরেখায় চলা উচিত চিরকাল ) তার মান 1.75 সেকেন্ড। 

 কি করে তা মাপা যাবে? তার জন্য সূর্য্যগ্রহন হওয়া দরকার। পূর্নগ্রাস সূর্য্যগ্রহনের সময় যদি দূরের নক্ষত্রগুলোকে দেখি যা সূর্য্যের দিকে আছে তখন, তাদের আলো কতটা বেঁকেছে জানা সম্ভব। কাজটা বেশ কঠিন। কারন পার্থক্য মাত্র 1.75 second-খুব ক্ষুদ্র এবং সূক্ষ্য। 

 মুশকিল হচ্ছে সেটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। সূর্য্যগ্রহন বন্ধুদের দেশে না হলে যুদ্ধের বাজারে এই পরীক্ষা করা অসম্ভব। আমেরিকান এস্ট্রনমাররা ১৯১৬ সালে রাশিয়ায় সূর্য্যগ্রহনের সময় এটা পরীক্ষা করার চেষ্টা করেন-কিন্ত  টেলিস্কোপ কেড়ে নিয়ে দেশে ফেরত পাঠিয়েছিল রাশিয়া (১৯১৭)। 

   এদিকে বৃটিশ এস্ট্রোনমার আর্থার এডিংটন এই পরীক্ষা করতে চাইছেন। কিন্ত রাষ্ট্র বলছে এইসব বিজ্ঞান ছাড়-এখন যুদ্ধে যাও।  এডিংটন যুদ্ধে সৈনিক হিসাবে গেলেন না।

শুধু তাই?  শত্রু রাষ্ট্র জার্মানীর বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের কাজ পরীক্ষা করতে চাইছেন। তাকে বৃটেনের মিডিয়া জাতির শত্রু হিসাবে দাগিয়ে দিল।  বিজ্ঞানীর কাজ ত দূরের কথা, প্রায় জেলে ঢুকতে চলেছিলেন আর্থার এডিংটন। কিন্ত শান্তিবাদি হিসাবে তিনি অনড়!

 যাইহোক যুদ্ধ শেষ হলে, তিনি পরীক্ষা করার অনুমতি এবং গ্রান্ট পেলেন।  সেটা ১৯১৯ সাল।  মে ২৯, ১৯১৯ সেই বিখ্যাত দিন। অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিন আফ্রিকা-দুই জাগাতেই সূর্য্যগ্রহনের সময় নক্ষত্রদের আলোর অপরসরনের পরীক্ষা হয়।  দুই জায়গায় রেজাল্ট এক ।  1.75 second. ৩০শে মে সমস্ত বিশ্বের নিউজপেপারে এল আইনস্টাইনের জেনারেল রিলেটিভিটির এই অদ্ভুত আবিস্কার।  

   বিজ্ঞানীরা এবার নিশ্চিত আইনস্টাইনের সমীকরন নির্ভুল, নিখুত এবং সুন্দর।

                                                                       (৩)

  কিন্ত এই সমীকরন নিখুঁত হওয়াটাই আবার অনেক সমস্যার জন্ম দিল। ভীষন জটিল এই টেন্সর সমীকরন। এখানে ভর, নিউটনের সমীকরনের মতন নিরীহ ঠুঁটো জগন্নাথ না। ভর এখানে এনার্জি মোমেন্টাম টেন্সর। এইটা না বুঝলে রয়চৌধুরী সমীকরন বোঝা মুশকিল। 


আইনস্টাইনের ফিল্ড ইকোয়েশনে ভর হচ্ছে " টেন্সর ফিল্ড"।  টেন্সর ফিল্ড বোঝার আগে ভেক্টর ফিল্ড বোঝা যাক।  ধরুন একটা চার্জ অন্য চার্জকে টানছে বা দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। আমরা সবাই জানি ওটা ইলেক্ট্রোস্টাটিক ফিল্ড।  সোজা ভাষায় কোন এক ডিরেকশনে ফোর্স থাকলে, সেইদিকে বস্তুর ত্বরন থাকবে। এটা ভেক্টর ফিল্ডের সহজ উদাহরন। 

  টেন্সর ফিল্ড আরো জেনারালাইজড। ধরুন একটা বাঁশ। আপনি দুমড়াচ্ছেন। মানে ক্লক ওয়াইজ বা এন্টিক্লক ওয়াইজ একটা ফোর্স দিচ্ছেন। তার মানে কি বাশটা শুধুই ওই ক্লক ওয়াইজ বাঁ এন্টি ক্লক ওয়াইজ দুমড়াবে? 

 মোটেও না। আপনি ঘোরানোর জন্য ফোর্স দিচ্ছেন-কিন্ত বাশটার ফাটল তৈরী হল ধরুন ওপর নীচ। ভার্টিকাল। কারন ম্যাটেরিয়ালের একদিকে ফোর্স দিলে, ডিফর্মেশন অন্য অনেক দিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে। ক্ল্যাসিকাল পদার্থবিদ্যায় এই ধরনের  শিয়ার, টর্সন ইত্যাদি নানাবিধ ফোর্স্ফিল্ড দেখতে পাবেন।

 আরেকটা উদাহরন দিই।  ধরুন জলঘোলা করছেন। আপনি বল প্রয়োগ করছেন বৃত্তাকারে-কিন্ত জল উথাল পাতাল হচ্ছে। অর্থাৎ একদিকে ফোর্স দিলেন, কিন্ত প্রভাব ছড়াচ্ছে সব দিকে। 

 এই ধরনের  ঘটনাগুলিকে ব্যখ্যাকরার জন্য গণিতের  দুটি জিনিস খুব প্রয়োজনীয় 

   এক,  টেন্সর। যা একধরনের ম্যাট্রিক্স এবং একদিকের বলপ্রয়োগ অন্যদিকে কিভাবে ছড়ায় তার একটা "রিপ্রেজেন্টেশন" বা নোটেশন দেয়। সমাধান দেয় না কিন্ত!

  দুই রিকি ফ্লো। রিকি ফ্লো দাঁড়িয়ে আছে রিকি কার্ভেচার টেন্সরের ওপর। 

  ওই যে বল্লাম বাঁশকে দুমড়ে মুরছে দিচ্ছেন। জলকে ঘুলিয়ে দিলেন। কি হচ্ছে এফেক্টটা? বাঁশটা ছিল সিলিন্ডার- কিন্ত তার তল গুলিকে সব ঘেঁটে দিয়েছেন। তারা বেঁকে দুমড়ে মুছড়ে গেছে। জলঘোলা করার সময় ভাবুন। জলের তল ছিল সমতল। কিন্ত সেই তলের জ্যামিতি সব আলাদা করে দিলেন ফোর্স চালাতে। 

   রিকি টেন্সর ডিফারেনশিয়াল জিওমেট্রির সব থেকে গুরুত্বপূর্ন রেজাল্ট। ভাবছেন ডিফারেন্সিয়াল জ্যামিতিটা কি?   ওইযে বল্লাম জল বাঁশ মাটি-এদের ওপর বলপ্রয়োগে যখন এদের জ্যামিতি বদলে দিচ্ছেন তখন কি হচ্ছে ? ক্রমাগত তাদের তলের পরিবর্তন হয়ে চলেছে।  এই পরিবর্তনশীল তলের জ্যামিতিকে ধরার জন্য রিকি টেন্সর লাগে।

 আবার ফিরে আসি আইনস্টাইনে। উনার সমীকরন বলছে বস্তুর ভরের জন্য স্থান কালের যে জ্যামিতি  তা দুমড়ে মুছরে দিচ্ছে ।  তাহলে আইনস্টাইনের সমীকরনটা এইভাবে ভাবুন 

     ভর, অর্থাৎ এনার্জি-মোমেন্টাম টেন্সর , স্থান কালের রিকি টেন্সরগুলোকে বদলে দিচ্ছে। তাহলে  আইনস্টাইনের ফিল্ড ইকোয়েশন  হবে এই রকম 

   স্থানকালের রিকি কার্ভেচার টেন্সরের পরিবর্তন =কনস্টান্ট  x মাস টেন্সর 

  বাদিকেরটা আসলে লেখা হয় আইনস্টাইন টেন্সর হিসাবে যা রিকিটেন্সরের সাথে গ্রাভিটেশনাল  মেট্রিক গুন করে পাওয়া যায়। আর কনস্টান্টের ভ্যালু , উনিভার্সাল গ্রাভিটেশনাল কনস্টান্ট/ (আলোর বেগের) ^4 

 মোদ্দা কথা আইনস্টাইনের সমীকরন মানে বিভিন্ন টাইপের মাস- মানে নক্ষত্র, গ্যালাক্সি এরা কিভাবে স্থানকালের জ্যামিতিকে বদলে দিচ্ছে, সেটা বলে দেয়। 

       আইনস্টাইনের সমীকরন এত জটিল , উনি নিজেও ভাবেন নি কেউ এর সমাধান করবে। কিন্ত জার্মান গণিতজ্ঞ কার্ল সোয়াজচাইল্ড কয়েকমাসের মধ্যেই প্রথম গ্রহনযোগ্য সমাধান আনলেন দুটো স্পেশাল কেসে 
    
        এক, যদি ভর একটি গোলক হয় ( সূর্য্য বা অধিকাংশ নক্ষত্র প্রায় গোলক)।
         দুই,  যদি ভর একটি পয়েন্ট মাস হয়। মানে ধরুন একটি কনা, যার ভর সূর্য্যের থেকেও বেশী। 

   তার সমাধানে একটা অদ্ভুত প্যারামিটার এল, যাকে এখন আমরা সোয়ার্জচাইল্ড রেডিয়াস বলব। ব্যপারটা এই, সোয়ার্জচাইল্ড সমাধানে দুটো টার্ম থাকে- একটা ( 1-r_s/r)   [ 1/(1-r/r_s)] । এর মানে দাঁড়ায় এই যে ধরুন সূর্য্যের যে ভর, তাতে সূর্য্যের ব্যাসার্ধ্য যদি ৩ কিমি হত, তাহলে সূর্য্যের জন্য তার আশেপাশের স্থান-কাল পুরো দুমরে মুছরে শেষ হয়ে যেত-মানে সব এত বেশী গ্রাভিটেশনার পুল তৈরী হত, সেখানে আলো আটকে যাবে। সব কিছু আটকে যাবে। পৃথিবীর যা ভর, তাতে তার সোয়ার্জ চাইল্ড র‍্যাডিয়াস ৯ মিলিমিটার মোটে। অর্থাৎ পৃথিবীর সবকিছুকে একটা ৯ মিলিমিটার ব্যসার্ধের গোলকের মধ্যে পুরদিতে পারলে, তার মধ্যে আলো আটকে যাবে। 

  যাইহোক অদ্ভুত প্রতিভা ক্ষনজন্মা জার্মান ইহুদি বিজ্ঞানী সোয়ার্জ চাইল্ডের।  তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। উনি নিজের ইচ্ছায়  জার্মান কামান বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। কামান বাহিনীর অঙ্ক করেন দিনে।  বাতাসের গতিবেগের ওপর নির্ভর করে কত ডিগ্রিতে কামান ছাড়ালে, কোথায় গোলা পৌছাবে।     রাশিয়ান ফ্রন্টে। এটা তার যুদ্ধের কাজ। কিন্ত রাশিয়ান ফ্রন্ট অনেক শান্ত। অধিকাংশ সময় কাজ নেই। তাই বসে বসে অঙ্ক করেন।  ১৯১৫ সালে আইন স্টাইনের ফিল্ড সমীকরন দেখে আনন্দে সেই নিয়েই পরে রইলেন একমাস । যে সমীকরন সমাধান করা প্রায় অসম্ভব মনে হয়েছিল আইনস্টাইনের কাছে,  তার কাজ দেখে আইনস্টাইন আনন্দে বিহ্ববল । সোয়ার্জচাইল্ডকে জানালেন তিনি ভাবতেই পারেন নি মাত্র একমাসের মধ্যে কেউ তার সমীকরনের এত ভাল সমাধান দেবে।

 তবে ওই সোয়ার্জচাইল্ড র‍্যাডিয়াসের ব্যপারটাই উনি বিশ্বাস করলেন না। তার মনে হল এমন বাস্তবে হওয়া সম্ভব না। 

  দুর্ভাগ্য এই যে এর কয়েকমাস বাদেই সোয়ার্জচাইল্ড মারা যান।  কিন্ত ব্ল্যাকহোলের প্রথম তাত্ত্বিক তিনিই। 

  রায়চৌধুরী তার সমীকরন দেন ১৯৫৫ সালে।  ১৯১৫-৫৫, প্রায় চল্লিশ বছর আইনস্টাইনের সমীকরনের আরো অনেক সমাধান আসবে। 

  ১৯২২ সালে ফ্রিডম্যান দেখালেন, তার সমাধানে এই মহাবিশ্ব সম্প্রসরানশীল। হাবল ১৯২৯ সালে সেটার প্রমান দিলেন। লার্মাট, রেইন্সনার, নর্সডার্ম, কের- এরাও গুরুত্বপূর্ন সমাধান দিয়েছেন। 

  তাহলে রায়চৌধুরী এক্সক্টলি কি করলেন যার জন্য তার সমীকরন এত গুরুত্বপূর্ন? 

   আসলে উনার কাজের গুরুত্ব বুঝতে গেলে প্রথমেই বুঝতে হবে, এদ্দিন (১৯৫৫) পর্যন্ত আইনস্টাইনের সমীকরনের যত সমাধান এল, তাতে মহাবিশ্বের এই বস্তুগুলিকে স্টাটিক-মানে স্থির ভরের স্থির বস্তু হিসাবে ধরা হত।  কিন্ত আসলেই ত সূর্য্য থেকে সব নক্ষত্র স্থির না- তাদের ঘুর্নন আছে-আবার গ্যালাক্সিতেও কক্ষপথে ঘুরছে। 

 সেক্ষেত্রে রিকি কার্ভেচারের কি হবে?  এটাই আমরা দেখব পরের পর্বে।