Sunday, December 31, 2017

অস্তিত্ববাদের দৃষ্টিতে আরেকটি বছর

এই মহাবিশ্বের বয়স ১৩৭৭ কোটি বছর। পৃথিবীর জন্ম ৪৫৪ কোটি বছর আগে। মানুষ এল সেইদিন - খুব বেশী হলে দুই লাখ বছর আগে।

এই অনন্ত চক্রে ২০১৮ আরো একটি এডিশন- কি যায় আসে! কিন্ত আমাদের ছোট ছোট চাওয়া পাওয়ার কুয়োর মহাবিশ্বে, একটা বছর অনেকটাই। সেই অনুন্নত প্রযুক্তির যুগে মাত্র এক বছরেই গোটা গ্রীসকে একত্রিত করেছেন আলেক্সজান্ডার। পরের বছর জয় করেছেন মিশর, পারস্য। সেই কালেও এক বছর ছিল অনেক। মুশকিল হচ্ছে আমরা আলেক্সান্ডার নই- ভাঙা গড়ার সুতীব্র ইচ্ছা আমাদের নেই- আছে শুধু গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে পিঁপড়ের জীবন মৃত্যুচক্রে একটা ফুঁটকি হয়ে বেঁচে থাকা।

এক্সিস্টেন্সিয়ালিজম বা অস্তিত্ববাদের সমস্যা সবাইকেই নাড়া দেয়। কখনো জ্ঞাতে অজ্ঞাতে। জীবনের আসলেই ত কোন পরম উদ্দেশ্য নেই। তাহলে কিসের জন্য বেঁচে থাকা? মৃত্যু আসবেই, এই ভেবেত আর বেঁচে থাকা যায় না। পরম বিশ্বাসীদের এই সমস্যা নেই-তাদের জন্য আছে জন্নত, স্বর্গ, পরজন্মের হাতছানি। আমাদের মতন নিধার্মিকদের সেই আশা ভরসার জায়গাটাও নেই-এটাই জীবন - এই জীবনেই যতটুকু পাওয়া তার চেষ্টা করে যেতে হবে।

আলটিমেটলি জীবনটাই হচ্ছে সেই তালা খোলার চেষ্টা করা যার চাবি আমার কাছে নেই। কিন্ত চেষ্টাটা করে যেতে হবে, কারন নইলে সময় কাটবে না। শুধু আশাটা রেখে যেতে হবে- তালাটা খুললেও খুলতে পারে কোনদিন। ঠিক এই কারনেই কমিনিউস্ট, হিন্দুত্ববাদি বা ইসলামিস্টরা ক্রমশ র‍্যাডিক্যাল হয়ে ওঠেন- কারন তাদের দৃঢ় ধারনা- তাদের দর্শনে ওই চাবিটা আছে-বাকী কারোর দর্শনে নেই! আর যতই তারা হতাশাই ভুগতে থাকেন যে চাবিটা কিন্ত পাওয়া যাচ্ছে না- তারা বুঝতে চান না, চাবিটাই নেই-তারা আরো র‍্যাডিকাল বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন যে বিশ্বাসের গভীরতাই সেই চাবি আসিবে। কিন্ত না, আসে না। আসে মৃত্যু। আসে ধ্বংশ। আসে হতাশা।

সবটাই ছলনা। শ্রী রামকৃষ্ণের যত মত তত পথের আসল মানে হল- যত মত তত পথে ভুলিয়া থাক-চাবি আসিবেই। যত মত তত আলেয়ার আশা- চাবি মিলিবেই।

Saturday, December 16, 2017

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি

বাংলাদেশ সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যারা স্বাধীনতার পরে, মুক্তিযুদ্ধের প্রামান্য ইতিহাস তৈরী করার চেষ্টা করে নি বহুদিন। আমরা ভারতীয়রা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানি না-এটা যদি লজ্জার হয়-তাহলে ভাবুন ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত, সরকারি ভাবে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চা প্রায় বন্ধ ছিল-যা চলত তাও সরকারি ভাবে বিকৃত। বাংলাদেশে যারা বড় হয়েছে ঐ সময়টাতে, তারাও জানেনা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস। কারন সরকারি বইগুলো এমন ভাবে লেখা হত, যাতে শেখ মুজিবর রহমান, আওয়ামী লীগের ভূমিকা এবং ভারতের মিলিটারি ও ইন্দিরা ভূমিকা সম্পূর্ন অজ্ঞাত থাকে।

আমি মাস খানেক আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধীর অবদান নিয়ে একটা পোষ্ট দিই। বিষয়টা এই, আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নিক্সন বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অতি সক্রিয় ছিলেন। এতটাই যে আমেরিকার নির্দেশে সৌদি আরব, জর্ডন এবং ইরান পাকিস্তানকে ফাইটার প্লেন দিয়ে সাহায্য করছিল- ইরান ত তার বিমান ঘাঁটিও ব্যবহার করার অনুমতি দেয়। শুধু তাই না নিক্সন চিনকে সঙ্গে নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ানের ওপরে চাপ সৃষ্টি করেন জাতি সঙ্ঘে-তাতে কাজ না হলে ইন্দিরাকে ফোন, ফ্যাক্স হুমকি কিছুই বাকী রাখেন নি। একসময় সোভিয়েত ও ভারতে জানিয়ে দেয়, আমেরিকা ভারত আক্রমন করবে বাংলাদেশ ইস্যুতে । তবে তারাও নৌবহর পাঠাচ্ছে। ইন্দিরা গান্ধী জেনারেল ম্যকেনশকে প্রশ্ন পর্যন্ত করেছিলেন আমেরিকা আক্রমন করলে কি হবে? ম্যাকেনশর উত্তর ছিল, তার আগেই বাংলাদেশ মুক্ত হবে। চীন এবং আমেরিকার সাঁড়াশি আক্রমনের মুখে নার্ভ ঠিক রেখে ইন্দিরা গান্ধী গোটা পৃথিবী চষে ফেলেছিলেন বাংলাদেশের সমর্থনে। জানাচ্ছিলেন কিভাবে খুন ধর্ষন এবং জেনোসাইড চালাচ্ছে খান সেনারা। ইউ টিউবে তার অসংখ্য ইন্টারভিঊ পাওয়া যাবে কখনো বিবিসি, কখনো ফরাসী টেলিভিশনকে দেওয়া ( যা ফ্রেঞ্চেই দিয়েছিলেন ইন্দিরা) । পুরো ব্যপারটা পড়ার পরে আমার মনে হয়েছিল ইন্দিরা গান্ধী না থাকলে বাংলাদেশের রক্তক্ষয় হত আরো বেশী- হয়ত বাংলাদেশ স্বাধীন হত-কিন্ত রক্ত ঝড়ত আরো আরো অনেক। শেখ মুজিব যদি জাতির পিতা, ইন্দিরাকে বাংলাদেশ নামক জাতির মাতা বললে ভুল হবে না। এটা শুনে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশী আমাকে জানালেন, আমি নাকি ইতিহাস ফ্যাব্রিকেট করছি বাংলাদেশের মুক্তযুদ্ধকে ছোট করার জন্য! আসল সত্যটা হচ্ছে এই-এরা সেই ১৯৭৫-৯৬ এর বাংলাদেশের প্রোডাক্ট। যেখানে আওয়ামী লীগ, শেখ মুজিব, ইন্দিরা, ইন্ডিয়া সব কিছুই অস্বিকার করা হত।

১৯৮৫ সালের একটা ঘটনা বলি। তখন রাজশাহী রিলে স্টেশনের দৌলতে মুর্শিদাবাদ নদীয়াতে বাংলাদেশের সরকারি টিভি চ্যানেলের সব অনুষ্ঠান আমরা দেখতে পেতাম। ১৬ ই ডিসেম্বরের বিজয় দিবসে ভারতের দূরদর্শনে এমনিতেই অনেক কিছু হয়। আমাদের আশা ছিল বাংলাদেশে দূরদর্শনে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক ডকুমেন্টারী দেখাবে। করিমপুরের মতন ভারতের এক প্রান্তিক মফঃশহরে টিভি তখন সবে এসেছে। পাড়ার বয়স্ক লোকেরা একাত্তর নিয়ে অনেক কিছু জানতেন। কারন একাত্তরের যুদ্ধে গোটা করিমপুরেই আশ্রয় নিয়েছিল প্রায় চার লাখের বেশী শরনার্থী। অনেক আশা নিয়ে ১৬ ই ডিসেম্বর তারা বাংলাদেশ টিভির সামনে বসেছিলেন।

অহ-কোথায় কি। টিভিতে দেখায় শুধু জেনারেল এরশাদের কবিতা। বাংলাদেশে তখন এরশাদের ডিক্টেটরশিপ। এই এরশাদ মুক্তিযোদ্ধাও নন। একাত্তরের যুদ্ধে তার পোস্টিং ছিল পাকিস্তানে। ফলে পাকিস্তান সরকার তাকে গ্রেফতার করে। ১৯৭৩ সালে সিমলা যুক্তির জন্য মুক্ত হয়ে বাংলাদেশে আসেন। তাকে মিলিটারীতে উচ্চ পজিশনে পুনঃবাসন দেন শেখ মুজিব নিজে।

অথচ এই এরশাদ মালটা নিজের ডিক্টেটরশিপের সময়,এই ১৬ ই আগস্ট বিজয় দিবসে টিভিতে শুধু কবিতা চালাত-সাথে যুদ্ধের ফটো ভিডিও। দেখে মনে হতে পারে জাস্ট এরশাদের শব্দের জোরে স্বাধীনতা এসেছে। ব্যাচারা কিই বা আর করবে! কারন ওই দিন ইতিহাস ঘাঁটলে গেলে দেখা যেত, এরশাদ মুক্তিযোদ্ধাই না! কে আর টিভিতে নিজের প্যান্ট খোলে! না ওই সময় বাংলাদেশের মুক্তযুদ্ধের চর্চা প্রায় নিশিদ্ধই ছিল। শুধু তাই না। যদিও বা কখনো সখনো মুক্তযুদ্ধের সিনেমা আসত বাংলাদেশ টিভিতে- সেখানে সিনেমার চরিত্ররা যদি কখনো সখনো মুজিবের নাম মুখে আনতেন, সেখানে অডিও সাইলেন্স করা হত। এই সময়টাতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ইতিহাস মোছার সব চেষ্টা হয়েছে যঘন্য ভাবে।

এটা এখন কিছুটা বদলেছে। শেখা হাসিনার শাসনকালে স্বাভাবিক ভাবেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে আবার ফেরানো হয়। অনেক ব্লগার ইতিহাস রক্ষায় সচেতন হয়ে অনেক নতুন দলিল তৈরী করেছেন। ফলে এখন গুগল করলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক কিছুই আমরা জানছি।

আমি অবশ্য বই এর অভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে জেনেছি মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকেই। আমেরিকাতে অনেক মুক্তিযোদ্ধা অভিবাসন নিয়েছেন। তাদের সাথেই নানান পার্টিতে গল্প করে জেনেছি কিভাবে তারা জেলে সেজে নৌকা নিয়ে রেইড করতেন -কিভাবে থানা রেইড হত। খান সেনারা ভয়ে সেনা ছাউনির বাইরে ট্যাঙ্ক ছাড়া বেড়ত না। এত বীরত্ব এবং আত্মহুতির গল্প আমি নিজেই জানি সেগুলো লিখলে ডজন খানেক সিনেমার স্ক্রিপ্ট তৈরী। আমার ধারনা, মুক্তিযুদ্ধের নানান ঘটনাগুলো যদি সেলুলয়েডে বন্দি করার চেষ্টা হয়- অন্তত দুশো সিনেমা নেমে যাবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে এখনো হলিউড ফি বছর তিনটে চারটে সিনেমা নামাচ্ছে। কিন্ত বাংলাদেশে কালে ভদ্রে একটা আধটা সিনেমা নামে মুক্তি যুদ্ধের ওপরে। আমার কোন সন্দেহই নেই মুক্তিযুদ্ধই বাঙালীর ইতিহাসের সব থেকে গৌরবজ্জ্বল অধ্যায়। মুক্তযুদ্ধে ঘটনা সিনেমা বন্দী না করলে, আবার এরেকটা এরশাদ আসবে না কে বলতে পারে?

Friday, December 8, 2017

হ্যাজব্যান্ড নামক হ্যাজটার ল্যাজ রেখে হবেটা কি?

ডিসেম্বর বিয়ের মাস-ফেসবুক ফিড খুলতেই বিয়েবাড়ির ফ্যাশনে হাসিখুসি মুখের রোশনাই। এর মধ্যে কটা বিয়ে পাঁচ বছর অব্দি টিকবে জানি না-তবে ডিভোর্স রেট সর্বত্রই এত বেশী, এই প্রশ্নটা সামাজিক এবং রাজনৈতিক ভাবে তোলাই উচিত- একবিংশ শতাব্দিতে "বিয়ে" নামক ইন্সটিটুশনটা আর কদ্দিন ?

যেহেতু কৃত্রিম গর্ভে সন্তানের জন্ম হতে এখনো ত্রিশ চল্লিশ বছর বাকী- সেহেতু প্রশ্ন উঠতেই পারে, সন্তান মানুষ করতে বিবাহ নামক সেই বাতিল প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া উপায় কি? ফ্রান্স সহ ইউরোপে পোষাকি বিয়ে প্রায় উঠে গেলেও -সেখানে লিভ টুগেদার করাকে বিয়ের লিগ্যাল স্টাটাস দেয় রাষ্ট্র। নাগরিকের উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলে রাষ্ট্রই কোলাপ্স করবে- বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের চিকিৎসার খরচ চালাতে তরুন সমাজকেই ট্যাক্স দিতে হয়। সুতরাং ভারত চীনের মতন জন সংখ্যায় জর্জরিত হাতে গোনা কিছু দেশ বাদ দিলে, উন্নত বিশ্বে যেখানে ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রসারের সাথে সাথে "মা" হওয়ার প্রবণতা কমে এসেছে- সেখানে রাষ্ট্রকে প্রচুর খরচ করতে হয় মা হওয়ার জন্য ঘুঁশ দিতে। ইউরোপের কমবেশী সবদেশেই এটা সমস্যা -এর মধ্যে রাশিয়ার জন সংখ্যা কমছে এত দ্রুত হারে ২০০৬ সালে পুতিন পার্লামেন্টে ঘোষণা করেন, জনসংখ্যা বাড়ানোর জন্য তারা "মায়েদের" প্রচুর ইন্টেন্সিভ দেবেন। রাশিয়াতে যেসব মেয়েরা তিনটি সন্তান নেয়, রাষ্ট্র তাদের বিনা পয়সায় ফ্ল্যাট এবং গাড়ি দেয়। এতে অবশ্য লাভ হয়েছে সামান্যই। রাশিয়ার ফার্টালিটি রেট 1.34 থেকে বেড়ে এখন 1.46. অর্থাৎ অধিকাংশ মেয়েরাই ফ্ল্যাট গাড়ির লোভের থেকে চাইল্ডলেস থাকাই পছন্দ করছেন বেশী।

অধিকাংশ ডিভোর্সের ক্ষেত্রে, মেয়েদের নিজস্ব কেরিয়ার সংক্রান্ত চাহিদাটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যেহেতু শিল্প বিপ্লবের চাহিদা অনুযায়ী আমরা সংসার কেন্দ্রিক থেকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক কেরিয়ার কেন্দ্রিক অবজেক্টিভ গুলিকেই রাজনৈতিক এবং সামাজিক ভাবে মেনে নিচ্ছি- সেহেতু অধিকাংশ চাকুরীজীবি বিবাহিত মহিলারাই প্রশ্ন তুলছেন একটা হ্যাজবান্ড রেখে হ্যাজ ছাড়া জীবনে পাচ্ছি টা কি? সন্তান নেওয়া এর অনেক পরের ব্যপার। আসলে ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তা, তার সাথে বলিউডের আফিঙে বড় হওয়া এই নতুন প্রজন্মের মেয়েরা প্রায় সবাই বিবাহিত জীবনে অখুশী। যেহেতু স্বামীর রোজগারের দরকার এদের নেই, অধিকাংশই একটা "কারন" থেকেই ডিভোর্স করছে। একটা অচেনা ছেলে, যার ওপর ডিপেনডেন্ট ও নই, তার জন্য আমরা কেরিয়ার বিসর্জন দেব কেন?

মুশকিল হচ্ছে বিবাহিত জীবনে রোম্যান্স কোন কালেই ছিল না-সাধে কি বৈষ্ণব সাহিত্যে প্রেম মানেই পরস্ত্রীর সাথে পরকিয়া! কিন্ত এই শারুখ খান, আমির খান, ঋত্বিক রোশনের মতন রোম্যান্টিক নায়কদের যুগে কোন মেয়ে বিশ্বাস করতে রাজী না- বিয়ে সংসারের অধিকাংশটাই কর্তব্য-বাকীটা মায়াময়।

এই বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটির সংজ্ঞা নিয়েও নৃতাত্ত্বিকদের মধ্যে একাধিক মতানৈতক্য। বিবাহে স্বামী এবং স্ত্রীর অধিকার ঠিক কি কি হবে, কি কি হওয়া উচিত-সেই নিয়ে কোন কোনসেন্সাস নেই কোন দেশে, কোন সংস্কৃতিতে। শুধু ডিভোর্স আইনের ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও অধিকাংশ রাষ্ট্রের ঐক্যমত -ইহা মৌলিক অধিকার হতে পারে না। পৃথিবীর সব থেকে লিব্যারাল কোর্ট ইউরোপিয়ান ইউনিয়ানের সুপ্রীম কোর্ট ও মেনে নিয়েছে, ডিভোর্স মৌলিক অধিকার হতে পারে না।

তবে আসল সমস্যার দিকে ফিরি। মূল সমস্যা এটাই আজকে মেয়েরা যেখানে কেরিয়ারে এগোতে চাইছে-খুব স্বাভাবিক ভাবেই মা হতে গেলে তাদের কেরিয়ারে স্যাক্রিফাইস করতে হচ্ছে। খাস ভারতেই ২৭% মহিলা আই টি ইঞ্জিনিয়ার শুধু মা হওয়ার জন্য কেরিয়ার বিসর্জন দেন। যারা টিকে যান, তারাও কেরিয়ার কম্প্রোমাইজ করেই টেকেন। যারা কম্প্রোমাইজ করতে চান না-তারা ডিভোর্স করে বেড়িয়ে আসেন। কিন্ত এর কোনটাই কি সমাধান?

খুব অদ্ভুত হলেও সত্যি- মেয়েদের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, রাষ্ট্রকে যে সন্তান পালনের দ্বায়িত্ব নিতে হবে, এটা প্রথম কার্যকর করেন লেনিন- অক্টবর বিপ্লবের সাথে সাথেই। রাশিয়াতে বিয়ে প্রায় তুলে দেওয়া হয়, আবর্শণ আইন শিথিল হয়-এবং সাথে সাথে সরকারি ক্রেশ বা সন্তানালয় গড়া হয়। কিন্ত কমিনিউস্ট রাষ্ট্র ত- এরা যত পরিকল্পনা করে-বাস্তবে হয় তার উলটো। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয় নি। সরকারি কেয়ারটেকার সংস্থা গুলোতে দেখভালের অভাবে শুধু ১৯১৯-২৩ সালের মধ্যেই ৫ লাখ শিশুর মৃত্যু হয়। ফলে স্টালিন ক্ষমতা হাতে পেয়েই দেখলেন, লেনিনের আদর্শবাদি কার্যকলাপে রাশিয়ার জনসংখ্যা কমছে। মিলিটারিতে লোক পাওয়া সমস্যা হতে পারে। ১৯২৫-২৯ একাধিক ডিক্রি জারী করে স্টালিন আবার লোকজনকে বিয়ে করতে বাধ্য করলেন। আবর্শন প্রায় বন্ধ হল। রাষ্ট্রীয় শিশুপালন সংস্থা বন্ধ করে, মেয়েদের মায়ের দ্বায়িত্ব পালন করতে বাধ্য করলেন স্টালিন। ইনফ্যাক্ট ১৯৩৪ সালের মধ্যেই রাশিয়াতে বিভিন্ন উচ্চ পজিশনে মেয়েদের সংখ্যা কমে আসে-সেন্ট্রাল কমিটিতে বোধ হয় মোটে দুজন ভদ্রমহিলা ছিলেন-কারন তখন লেনিনের "নারীবাদ" বাতিল করে সর্বত্র স্টালিনের "মাতৃবাদের" ভজনা চলছে। সোভিয়েত ইউনিয়ানের ইতিহাসের এই দিকটা অনেকেই জানে না-- যে নারীর সমানিধিকার সংক্রান্ত সব থেকে বড় পরীক্ষাটি এক শতাব্দি আগেই ব্যর্থ হয়েছে।

অর্থাৎ এই মৌলিক সমস্যা-যে ছেলে মেয়ে মানুষ করার ক্ষেত্রে মেয়েদের অনেক বেশি দ্বায়িত্ব নিতে হয়-এটার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত- ডিভোর্স কিন্ত বাড়তেই থাকবে।

তবে সবটাই দিশাহীন না। আমেরিকাতে ১৯৮০ সালে ডিভোর্স রেট ছিল হায়েস্ট। আস্তে আস্তে সেটা কমেছে। এখন প্রায় ৭০% সম্ভাবনা যে একটা বিয়ে ১০ বছর টিকবে। যেটা ১৯৮০ সালে ছিল ৪৮%। এটা কি করে হল?

আসলে ভুল থেকেই সবাই শিক্ষা নেয়। এখন আমেরিকাতে বিয়ের আগে ছেলে মেয়েরা "আবেগ" এবং "প্রেম" বাদ দিয়ে, প্রাক্টিক্যাল কন্সিডারেশন গুলোকে সামনে রেখেই বিয়ে করে। ইহার্মোনির মতন ডেটিং সাইট, এখন ডেটাসায়েন্স ম্যাচিং করাচ্ছে-অর্থাৎ একজনের কাছ থেকে প্রায় সাতশো আটশো রকমের প্রেফারেন্স জেনে, জানিয়ে দিচ্ছে কোন পার্টনার তার জন্য স্টেবল। প্রেমের থেকে প্যার্টান ভিত্তিক বিয়ের দিকেই এগোচ্ছে আমেরিকান সমাজ, যার সুফলও মিলছে কম ডিভোর্স রেটে। ভারতে এখনো এটা আসে নি। হয় এরেঞ্জড মেরেজ না হলে লাভ মেরেজ। দুটোই আসলে ডিজাস্টার। হওয়া উচিত ডেটা সায়েন্স ভিত্তিক মেরেজ-যেখানে আগে থেকেই বলে দেওয়া সম্ভব-এই পার্টনারশিপ চলবে কি না।

অর্থাৎ সমাধান সেই বিজ্ঞানের পথেই। আবেগ, আইন, প্রেম -কোন কিছুই বিবাহ নামক এই অচলায়তনকে বাঁচাতে পারবে না।

Wednesday, October 4, 2017

বাংলা সংস্কৃতির ওপর ত্রিফলা আক্রমণ

পূজোর কটাদিন ভাবসাব দেখে মনে হয় বাংলা সংস্কৃতি শত পুস্পে বিকশিত। কিন্ত বাস্তব এটাই পশ্চিম বাংলার বাংলা সংস্কৃতি এখন বিপন্ন। ইসলামিক, উত্তর ভারতীয় হিন্দুত্ববাদের আগ্রাসন এবং কমিনিউস্টদের দৌড়াত্মে, আমাদের শত শত বছরের পুরাতন বাংলা সংস্কৃতি- যা বৌদ্ধ, চৈতন্য, লালন , রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের উদার আবহে বটবৃক্ষের মতন ছড়াচ্ছিল, তার বিপন্ন জরাজীর্ন হাল।

আসল সমস্যা বাঙালী জাতির অলস্যে। যে জাতি কঠিন এবং সৎ পরিশ্রমে বিশ্বাস রাখে না। এই জাতি আস্থা রাখে চিট ফান্ডে, বিট কয়েনে। একবার ও বোঝে না, অর্থনীতির নিয়মেই সস্তায় না খেটে বড় লোক হওয়া যায় না, ভাল থাক যায় না। ঠিক এই ধরনের অলস চিন্তা ধরেই বাংলার এক বিশাল অংশের তরুন বিপথে- তাদের ধারনা কমিনিউজম, হিন্দুত্ববাদ বা ইসলাম তাদের সমাজ এবং দেশকে উদ্ধার করবে। বিভিন্ন রকমের হতাশা থেকেই তাদের এই বিপথযাত্রা। কিন্ত বটম লাইন সেই এক- সৎ ভাবে খেটে , সৎ ব্যবসা, আন্তারপ্রেনারশিপের মাধ্যমে বাংলার পরিবর্তন হবে-এই বিশ্বাস বা দৃঢ়তা আমি বাংলার নতুন প্রজন্মে দেখছি না। শুধু দেখা যাবে বিজাতীয় আদর্শবাদের প্রতি ঝোঁক।

পেট্রো ডলার ঢুকিয়ে বাংলার গ্রামে গ্রামে মাদ্রাসার চাষ করে, বাঙালী মুসলিমদের বাংলার মূল শ্রোত থেকে সরানোর কাজ ভাল ভাবেই সম্পন্ন। তাদেরকে ভাবানো হচ্ছে তারা বাঙালী না মুসলমান। ফল হাতে হাতে টের পাচ্ছেন মীর বা নূরের মতন বাঙালী মুসলিম অভিনেতা অভিনেত্রীরা। ফেসবুকে দূর্গাপূজোর শুভেচ্ছা যদি কোন মুসলিম অভিনেতা অভিনেত্রী জানাচ্ছেন মৌমাছির ছাঁকের মতন দাঁড়িয়ালা মুসলিমরা ভন ভন করছে। অথচ, দূর্গাপূজো, ঈদে পারস্পারিক শুভেচ্ছা জানানো বাঙালীর শত শত বছরের ঐতিহ্য। এই সব বাঙালী মোল্লারা হঠাৎ করে আবিস্কার করেছে, বাঙালী না তাদের পিউর এবং আন ডাইল্যুটেড মুসলমান হতে হবে। তারা তাদেরকে আর বাঙালী মনে করে না-তাদের অস্তিত্বে এখন আন্তর্জাতিক ইসলামিক ব্রাদারহুড! এবং এর পেছনে প্যাট্রোনাইজেশন আছে ভারতের সব রাজনৈতিক দলের।

ইসলামিক মৌলবাদের উত্থান ঠেকাতে বাঙালী বুদ্ধিজীবি সমাজ কিস্যু করে নি। ফলে ভীত একদল বাঙালী হিন্দু যুবক- উত্তর ভারতের হিন্দুত্বের আশ্রয় চাইছে। পশ্চিম বাংলায় রাম নবমী, ধণতরেশ, হনুমান চল্লিশা-এসব ছিল না। কিন্ত দ্রুত ঢুকছে। নীরব প্রশয় এক বিশাল অংশের বাঙালী হিন্দুদের। এসবই ইসলামিক মৌলবাদের উত্থানের রিয়াকশন -কিন্ত ফল এই যে বাংলার উদার সংস্কৃতি এখন বিপন্ন উত্তর ভারতের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে। ফলে এই যে বাংলাকে আরো দাঙ্গা দেখতে হবে আগামী সময়ে।

এবার আসি বাংলার বাম বুদ্ধিজীবি এবংহরেক রকমের কমিনিউস্টদের নিয়ে। এদের কাছে বিদ্যাসাগর কলোনিস্ট এবং বু্জোয়া। রবীন্দ্রনাথ বুর্জোয়া কবি। স্টালিন, লেনিন, মাওএর মতন কুখ্যাত খুনীরা এদের আরাধ্য দেবতা আজো। এদের ৩৪ বছরের শাসনের তান্ডবে বাংলা ছাড়া হয়েছে বাংলার সব কৃতী সন্তান। যাদের কেউ আজকেও ঘরে ফিরতে চাইছে না। ফলে বাংলায় একটা বিরাট ক্রাইসিস ইন্টেলেকচুয়াল লিডারশিপের। বাংলায় যারা নিজেদের বুদ্ধিজীবি বলে দাবী করে তাদের কারুর কোন আইডিয়াই নেই কিভাবে প্রযুক্তি পালটে দিচ্ছে বা দিচ্ছে গোটা পৃথিবী। তারা স্বপ্নের রাজনীতি ফেরি করে ( সেটা সোভিয়েত কমিনিউস্ট সমাজই হোক বা শরিয়াই হোক ), বাঙালী যুবকদের বোকা বানায়। কারন বাঙালী যুবকরা একে অলস-তারপরে হতাশ। ফলে সস্তায় রাজনৈতিক বাজিমাতের ভাল ভাল কথা শুনে এরা আকৃষ্ট।

বাংলার বুদ্ধিজীবীদের কাউকে বলতে শুনিনি যে একটা জাতির উন্নতির একটাই উপায়। পরিশ্রম এবং সৎ ব্যবসা । প্রকৃত কারিগড়ি শিক্ষা। তারা নিজেরা গর্দ্ভব এবং আরো কিছু গর্দ্ভভ অনুসারী পেয়ে কলা ঝোলাচ্ছে কখনো কমিনিউস্ট স্বর্গের, কখনো বৈদিক সমাজের , কখনো খিলাফতের। এই ভিসিয়াস সাইকল থেকে বাঙালী বেড়োতে না পারলে বাংলা সংস্কৃতির ভবিষ্যত নেই।

এখন দরকার একটা বাঙালী জাতিয়তাবাদি আন্দোলনের। যেখানে নতুন করে মুল্যায়ন করা হৌক বিদ্যাসাগর , প্রফুল্ল চন্দ্র এবং স্যার রাজেন মুখার্জিকে। কারন বাংলার ইতিহাসে এই গুটিকয় ব্যক্তিকেই আমি পেয়েছি, যাদের চরিত্র ছিল ইস্পাত সম। ব্যবসায়িক বুদ্ধি এবং আন্তারপ্রেনারশিপকে যারা গুরুত্ব দিয়েছিলেন জীবন দিয়ে। বিদ্যাসাগর বলতেন পথে বসে আলু পটলের দোকান দেবেন, কিন্ত বৃটিশদের অন্যায়ের কাছে মাথা নোয়াবেন না। আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রসায়নকে ল্যাবে আটকে রাখলেন না। বাড়ির বারন্দায় তৈরী করলেন বেঙ্গল কেমিক্যাল। স্যার রাজেন মুখার্জি দেখিয়েছেন বাঙালীরাও পারে আন্তর্জাতিক মানের ইঞ্জিনিয়িরিং বিজনেস। শুধু দরকার সদিচ্ছা এবং পরশ্রমের।

আমেরিকান গান কালচার

মানুষের বিশ্বাস বড়ই কঠিন ঠাঁই। ইসলামিক বিশ্বাস, হিন্দু বিশ্বাস, ক্রিষ্ঠান বিশ্বাস, কমিনিউস্ট বিশ্বাসের সাথে আরেকটা সংযোজন -আমেরিকানদের বন্দুক বিশ্বাস। হ্যা, সেই ১৭৯১ সালে যখন সেকন্ড এমেন্ডমেন্ট লেখা হল, তখন থেকেই আমেরিকানরা বিশ্বাস করে বন্দুকের নলই স্বাধীনতার উৎস। মানে কি না, জনসাধরনের কাছে অস্ত্র থাকাটা আমাদের আমেরিকাতে ফান্ডামেন্টাল রাইট। এর কারন আছে। আমেরিকার ফাউন্ডিং ফাদাররা ছিলেন রাজনৈতিক দিকপাল। ইতিহাস ঘেঁটে উনারা দেখেছিলেন, নির্বাচিত সরকারের মধ্যেই টেন্ডেন্সি থাকে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠায়। এর ফলে জনগণ গণতান্ত্রিক অধিকার হারায়। ফলে সেই ১৭৯১ সালে আমেরিকার ফাউন্ডিং ফাদাররা ভাবলেন জনগণের কাছে বন্দুক থাকাটাই একমাত্র রোধ করতে পারে স্বৈরাচারের উত্থান। বা বিদেশী শক্তির আক্রমন। ফলে অস্ত্র রাখা আমেরিকাতে মৌলিক অধিকার।

একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, সেই অষ্টাদশ শতাব্দিতে পলাশি থেকে বক্সারের প্রান্তরে যখন ভারতীয় নবাব এবং সেনারা ক্ষুদ্রতর বৃটিশ সৈন্যদের কাছে আত্মসমপর্ন করেছে বা হেরেছে, আমেরিকার স্বাধীনতা যোদ্ধারা বৃটিশ সেনাদের মেরে তাড়িয়েছে। এর পেছনে আমেরিকানদের গান কালচারের ভূমিকা আছে। অস্ত্র সম্ভারে আমেরিকান পেট্রিয়টরা বৃটিশদের থেকে এগিয়েই ছিলেন। ফলে আমেরিকার স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে একটা বিশ্বাস তৈরী হয়-- জনগণের বন্দুকই স্বাধীনতার উৎস । এই পরিবেশেই পাশ হয়, সেকন্ড এমেন্ডমেন্ট যেখানে বন্দুক রাখা আমেরিকাতে মৌলিক অধিকার। সেই ইতিহাসটা ভুলে গেলে কিন্ত চলবে না। যে দেশটার জন্মই হয়েছে বন্দুকের জোরে এবং সেই বন্দুক ছিল জনগণের হাতে।

কিন্ত ২০১৭ সাল ত আর ১৭৯১ না। এখন গাদা বন্দুক চলে না- চলে মেশিনগান। স্টিফেন প্যাডক এখন একাই ১০ টা মেশিনগান চালিয়ে ৫৯জনকে খুন এবং ৫৫০জনকে আহত করার ক্ষমতা রাখে। এত আর ১৭৯১ সালের গাদা বন্দুক না। এই নিয়ে আমেরিকাতে বহুবার সুপ্রীম কোর্টে সওয়াল হয়েছে-অন্তত মেশিন গান, অটোমেটিক ওয়েপন রাখা নিশিদ্ধ হৌক। কিন্ত সুপ্রীম কোর্ট মানে নি। কারন সেকন্ড এমেন্ডমেন্টের নোশনই হচ্ছে জনগনের আর্মি যেন সরকারের আর্মির সমতুল্য অস্ত্র রাখতে পারে। নইলে জনগণ স্বৈরাচারী সরকারকে রুখবে কি করে??

সুতরাং কংগ্রেস এবং সেনেট সংবিধানের সেকেন্ড এমেন্ডমেন্টের পরিবর্ধন না করলে, এই গেরো থেকে আমাদের মুক্তি নেই।

আর সেকেন্ড এমেন্ডেমেন্টের বিরুদ্ধে বলার মতন একজন রাজনীতিবিদ ও আমেরিকাতে নেই। যারা বলছেন, তারা বলছেন সেকেন্ড আমেন্ডমেন্ট ঠিক, কিন্ত গান কন্ট্রোল দরকার। অনেকটাই সেই পুরাতন লেবু কচলানো- হিন্দু, ইসলাম ধর্মে সমস্যা নেই- ভক্তবৃন্ধের সমস্যা। আর এদিকে গুচ্ছ গুচ্ছ আমেরিকান আছে যাদের বাড়িতে এক গুচ্ছের বন্দুক। আমার এক প্রতিবেশীর বাড়িতেই আছে চারটে বন্দুক। এগুলো এদের অবশেসন । এদিকে আমাদের পাড়াতে ডাকাত ত দূরের কথা, চুরির কথাও কেউ কোন দিন শোনে নি। অর্থাৎ গান কালচার শ্রেফ একধরনের ধর্ম বিশ্বাস।

এই সব ভাবের ঘরে চুরি কদ্দিন চলে দেখা যাক। মধ্যেখান থেকেই ধরেই নিয়েছি বন্দুকের গুলিতে পরকাল প্রাপ্তির সম্ভাবনা ( নেক্সট ত্রিশ বছরে ) - ১ ইন মিলিয়ান। ক্যান্সারে মৃত্যুর সম্ভাবনা সেখানে ১ ইন ১০০। সেই ভেবেই শান্তনা নিই। যে বন্দুকের গুলিতে মরার আগে, রোগে মরব।

কি আর করা যাবে। এই একবিংশ শতাব্দিতেও হরেক রকমের বিশ্বাসের জিম্মি হয়েই কাটাতে হবে।

Tuesday, September 26, 2017

প্রযুক্তি ও ইতিহাস- পর্ব-৩, ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ (১৯৭১), বাংলাদেশের স্বাধীনতা

অন্যান্য ইতিহাসের মতন '৭১ এর যুদ্ধের ইতিহাসের ক্ষেত্রেও ব্যক্তিবীরত্ব, শৌর্য্য এবং স্ট্রাটেজির কথাই আমরা ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি। স্ট্রাটেজির গুরুত্ব যেকোন মিলিটারী ক্যাম্পেইনের ক্ষেত্রেই সর্বাধিক-কিন্ত তা সত্ত্বেও কি আজকের যুদ্ধ, কি আলেক্সান্ডারের সময়- যুদ্ধাস্ত্র যদি সেকেলে হয়, কোন স্ট্রাটেজি, কোন বীরত্বই কিন্ত শেষ রক্ষা করতে পারে না।

     ভারত-পাকিস্তানের '৭১এর যুদ্ধকে সেই অর্থে ব্যপক যুদ্ধ বলা চলা না। পাকিস্থানি মিলিটারির যুদ্ধের কোন ভাল প্রস্তুতি ছিল না- যুদ্ধক্ষেত্রেও  যুদ্ধ করার ইচ্ছা একদমই ছিল না। হারা যুদ্ধ কে আর যেচে লড়ে?

             পাকিস্তানের নেতৃত্বকে এক্ষেত্রে দোষ দেওয়া চলে না। তারা জানত যুদ্ধ হলে, বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঠেকাতে গেলে ভারতকে আটকানোর একটাই উপায় আছে। সেটা হচ্ছে আমেরিকা এবং চীনকে যুদ্ধে জড়ানো। ফলে পাকিস্তানের রাজনৈতিক এবং সামরিক নেতৃত্ব, নতুন সরঞ্জাম কেনার বদলে, সব টাকা খরচ করে ওয়াশিংটনের লবিস্টদের পেছনে- আমেরিকান সেনেটের এবং কংগ্রেসম্যানদের লিগ্যাল ঘুঁশ দিতে ( সে কেচ্ছা পরে হবে )। ইনফ্যাক্ট এতে তারা প্রায় সফল ও হয়। কারন তখন ঠান্ডা যুদ্ধের আবহে ভারত-রাশিয়া অবিচ্ছেদ্য এক্সিস। তার মধ্যে বাংলাদেশ চলে এলে, ভারত মহাসাগরে সোভিয়েত আধিপত্য বাঁধা। ফলে বাংলাদেশের জন্ম ঠেকাতে পাকিস্তানের থেকেও আন্তর্জাতিক মার্কেটে বেশী সক্রিয় ছিল আমেরিকা। শুধু রাশিয়ার হুমকিতে সরাসরি যুদ্ধে জড়ায় নি। বাদবাকি সব কিছুই করেছে। তখন পাকিস্তানের বিমান বাহিনীকে সাহায্য করতে সৌদি আরব, জর্ডন, সিরিয়া, ইরাণ সবাই অত্যাধুনিক বিমান দিয়ে, বৈমানিক দিয়ে সাহায্য করেছে। মনে রাখতে হবে, এই সব ইসলামিক দেশগুলি তখন সবাই আমেরিকার দাসানুদাস।  তার ওপরে তারা মনে করেছিল, বাংলাদেশের জন্ম মানে, ইসলামের  ভ্রাতৃত্বের ওপর আঘাত। ফলে একটি মুসলিম দেশ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশকে সাহায্য ত করেই নি-বরং চারটি ইসলামিক দেশ ( সৌদি, জর্ডন, সিরিয়া এবং ইরান)  পাকিস্তানকে অত্যাধুনিক প্লেন দিয়ে সাহায্য করেছে। এটা জেনেও যে পাকিস্তান বাংলাদেশে গণহত্যা চালাচ্ছে।

যুদ্ধের কদিন বাদেই ভারত পাকিস্তানের সব রানওয়ে ধ্বংস করে। ফলে ইরানের বিমান ঘাঁটি থেকে পাকিস্তানের যুদ্ধ বিমান উড়ে যেত বা লুকিয়ে রাখা হত।

 তবে হ্যা আমেরিকার তুলনায় তা নগন্য। কারন নিক্সন তখন একবার চীনকে ভারত আক্রমণ করতে প্ররোচনা দেয় -আবার ইরান এবং জর্ডনের মাধ্যমে যুদ্ধ বিমান পাঠায়। সাথে সাথে সোভিয়েত ইউনিয়ানকে হুমকি। হ্যা, একবার না, তিনবার ব্রেজনেভকে ফোন করে ছিলেন নিক্সন। তিনবারই ব্রেজনেভ বলেন-আরে মশাই যুদ্ধ থামাতে হবে ত, শেখ সাহেবের নেতৃত্ব স্বীকার করে নিতে পাকিস্তানের মিলিটারি জুন্টাকে চাপ দেন নি কেন? আসলে তখন সোভিয়েত-পাকিস্তান সম্পর্ক খারাপ ছিল তাও না। সোভিয়েত ইউনিয়ান এবং চীন -কিন্ত বাংলাদেশ আসলে চায় নি। তারা চেয়েছিল  শেখ মুজিবরের প্রধানমন্ত্রীত্ব পাকিস্তানের মিলিটারি শাসক মেনে নিক। একমাত্র  হেনরী কিশিঞ্জার তাবেদারি করেছে পাকিস্তানের যঘন্য মিলিটারী শাসকদের।  ইউ এন এ সিনিয়ার বুশ পারলে প্রায় প্রতিদিনই যুদ্ধ বিরতির রিজল্যুউশন আনতেন। আর সোভিয়েত ইউনিয়ান ভেটো দিত।  প্রক্সি ওয়ার ( ইরান/জর্ডন), ব্রেজনেভকে হুমকি, চীনকে উস্কানি ভারত আক্রমনের জন্য, ইউ এনে যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাব, ভারত মহাসাগরে ইউ এস টাস্কফোর্স এবং ইউ এস এস এন্টারপ্রাইজ পাঠানো ভারতের নৌবাহিনীকে ভড়কানোর জন্য-আমেরিকা বাংলাদেশের জন্ম আটকানোর জন্য ওই সময় পুরো মরিয়া। সত্যি কথা বলতে কি-বাংলাদেশের জন্ম আটকাতে পাকিস্তানের সেনা বাহিনীও আমেরিকার নেতৃত্বের মতন আন্তরিক ছিল না!

  সমস্যা হচ্ছে এর পেছনে ঠান্ডার যুদ্ধের কারন ত ছিলই, পাকিস্তানের প্রচুর টাকা ওয়াশিংটনের লবিস্টদের কাছেও গেছে। শোনা যায় ( এটা ভেরিফায়েড হিস্ট্রি না, আমি ওয়াশিংটনের কিছু ওল্ড টাইমারদের কাছে কানাঘুঁশো শুনেছি ) পাকিস্তান তখন এত টাকা খরচ করেছে আমেরিকা, ইংল্যান্ড ইত্যাদি দেশের রাজনীতিবিদদের কিনতে , তারা কিন্ত তাদের নৌবাহিনী বা বিমান বাহিনী আধুনিকরনে সেই ভাবে টাকা ঢালে নি।  এর ফলে পাকিস্তানের সমর সজ্জা ভারতের থেকে অনেক পিছিয়ে ছিল প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে। আমি মূলত ইতিহাসের সেই দিকটাই তুলে ধরব।

         প্রথমেই নৌযুদ্ধে আসি। বলতে গেলে যুদ্ধ শুরুর দুদিনের মধ্যেই গোটা ভারত মহাসাগরের দখল ভারতের নেভির হাতে আসে।  করাচি এবং চিটাগং-দুটো বন্দরই অবরুদ্ধ করে রেখেছিল ভারত।

  এবার এই প্রসঙ্গে মজার তথ্য দিই । করাচি পোর্ট অবরোধের প্রথম দিনই পাকিস্তানের  ডেস্ট্রয়ার পি এন এস খাইবার ডুবিয়ে দেয় ভারতের ওশা মিসাইল বোট।  পি এন এস খাইবার আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বৃটিশ ডেস্ট্র্যয়ার যা ১৯৪৩ সালে প্রথম যুদ্ধে নামে। ১৯৫৬ সালে বৃটেন তা পাকিস্তানকে বেচে দেয়। অর্থাৎ প্রায় ২৮ বছরের পুরাতন প্রযুক্তি-তাও পাকিস্তানি মিলিটারির হাতে-যাদের স্পেয়ার স্পার্টস দুর্নীতির জ্বালায় আদৌ কোন কিছু মেইনটেইন হত কি না কে জানে। সেখানে ওসা মিশাইল বোট  অত্যাধুনিক বৃহৎ টর্পেডো বোট ।  লেটেস্ট রাশিয়ান টেকনোলজি। ভারতের নেভিতে এসেছে ১৯৭১ সালে। পরের দিন পাকিস্তানের আরো দুটো যুদ্ধজাহাজ ডোবে- পি এন স সাহজাহান এবং পিন এস মুহাফিজ। ঘাতক সেই আই এন এস ভীর-যা অত্যাধুনিক মিসাইল বোট।  এর মধ্যে পি এন এস সাহজাহান আসলে বৃটিশ নেভির দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আমলের ডেস্ট্র্যয়ার -সেই ১৯৪৩ এর তৈরী। এস মুহাফিজ তৈরী হয়েছিল ১৯৫৬ সালে। সেখানে আই এন এস ভীর ভারতের নেভিতে এসেছে ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে।

 এবার আপনারাই বুঝে দেখুন।  মাত্র তিনটে রাশিয়ান ওশা মিশাইল ক্লাস বোট নিয়েই ভারত পাকিস্তানের ডেস্ট্রয়ার দের একদম দফারফা করে দেয় ( অপারেশন ট্রাইডেন্ট) । মনে রাখতে হবে এই সব বোট গুলি ডেস্ট্র্যারদের থেকে অনেক ছোট ( ১/১০ ভাগ হবে হয়ত)।  কিন্ত বোট গুলি ছিল অত্যাধুনিক। সেখানে  পাকিস্তান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাতিল নৌবহর নিয়ে যুদ্ধে নেমেছিল।

 '৭১ এর নৌ যুদ্ধে পাকিস্তান একটাই সাফল্য পায়। সেটা হচ্ছে পাকিস্তানের সাবমেরিন পি এন এস হাঙ্গর আই এন এস খুকরীকে ডুবিয়েছিল। এর কারন ও সেই এক। পি এন এস হাঙ্গর কমিশণ হয় ১৯৬৯ সালে-মানে একদম অত্যাধুনিক সাবমেরিন সেটি। সেখানে  আই এন এস খুকরী, পুরাতন ফ্রিজেট-কমিশন বয়সকাল ১৯৫৬। পাকিস্তানের আরেক সাবমেরিন পি এন এস গাজি, বিশাখাপত্তনম বন্দরে বিস্ফোরনেই ডুবে যায়। শোনা যায়, নিজেদের পাতা মাইনে নিজেরাই মরে। এই গাজি ও অতি প্রাচীন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আমেরিকান সাবমেরিন। তবে ইলেক্ট্রিক ক্লাস হওয়ার কারনে এর প্রযুক্তি সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আমলের সব থেকে এগিয়ে ছিল। কিন্ত ১৯৭১ এ তা ছিল অচল সিকি।

 বাংলাদেশে নৌ যুদ্ধ কিছু হয় নি। পাকিস্তানের ইস্টার্ন কমান্ডের হাতে ছিল মোটে ৪ টে গানবোট। যুদ্ধ জাহাজ একটিও ছিল না। ইচ্ছা করেই রাখনি পাকিস্থান। কারন তারা জানত পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ জাহাজ রাখা মানে ওটা যুদ্ধের পরে বাংলাদেশে হাতে যাবে। পাকিস্তানের এই গানবোটগুলো মূলত ব্যবহৃত হয়েছে নির্বিচারে বাংলাদেশের নিরীহ লোকদের মেশিনগানের গুলিতে মারার জন্য। যুদ্ধ শুরু হলে, যুদ্ধের ছদিনের মধ্যেই চারটি গানবোটই ডুবে যায় ভারতের বিমান আক্রমনে  ।

 এবার আসি আকাশ যুদ্ধে। '৭১ এর যুদ্ধে পাকিস্তানের বিমান বাহিনী লড়তেই চায় নি। যেটুকু উড়েছে, প্রায় সবটাই পাকিস্তানের আকাশে ভারতের আক্রমন ঠেকাতে। পাকিস্তানের বিমান ও ছিল পুরোনো- এফ -৬ -যা মিগ-১৯ এর চৈনিক ভার্সন । এবং কানাডিয়ান সাবরে। সেখানে ভারতের হাতে '৭১ সালে তুলনায় অত্যাধুনিক মিগ-২১, সু-৭  -এই দুটী ফাইটার প্লেন তখন সোভিয়েত ইউনিয়ানের ও মুখ্য ফাইটার প্লেন । সাথে ছিল বৃটিশ হান্টার-যা অবশ্য সাবরের মতন পুরোনো।

যদিও জর্ডন এবং সৌদি আরব আমেরিকান এফ সিরিজের প্লেন পাকিস্তানে পাঠিয়ে ছিল-কিন্ত এর কোন কিছুই তখন মিগ-২১ বা সু-৭ এর সমতুল্য ছিল না।  আসলে আমেরিকার আইন অনুযায়ী আমেরিকা তার বন্ধু দেশকেও অত্যাধুনিক ফাইটার প্রযুক্তি দিতে পারে না-এক ধাপ পেছনের প্রযুক্তি দিতে তারা বাধ্য। সেখানে সোভিয়েত ইউনিয়ান ভারতকে দিয়েছে, তাদের লেটেস্ট ফাইটার প্লেন মিগ-২১ ও সু-৭।  ফলে জর্ডন, সৌদি ইত্যাদিদের দিয়ে প্রক্সি যুদ্ধ করিয়েও আমেরিকা সুবিধা করতে পারে নি-কারন মিগ-২১ ঠেকাতে গেলে তাদের নিজেদের যুদ্ধে নামতে হত। এই সত্য জানা ছিল পাকিস্তানের ও । ফলে তারা যুদ্ধ না করে অধিকাংশ সময় ইরানের বিমান ঘাঁটিতে ফাইটার প্লেন লুকিয়ে রাখাই শ্রেয় বলে মনে করত।

  যুদ্ধের ৪৮ ঘন্টার মধ্যেই পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের আকাশ সম্পূর্ন ভাবে ভারতের দখলে চলে আসে।

  অর্থাৎ ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাচ্ছে পাকিস্তানে নৌবাহিনী তৈরী হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাতিল  নৌজাহাজ সস্তায় কিনে।  কোন আধুনিকরন করেনি '৭১ এর যুদ্ধ আসন্ন জেনেও। বিমান বাহিনীতেও একই অবস্থা।  তারা টাকা খরচ করেছে বড়দা আমেরিকাকে মাঠে  নামিয়ে। স্ট্রাটেজি হিসাবে খুব ভুল কিছু না। কিন্ত যুদ্ধ শুরু হলে যে তারা কয়েকদিন ও টিকবে না-এটা প্রথম থেকেই তাদের জানা ছিল।

 সেইজন্যই আমি মনে করি বাংলাদেশের আসল জন্মদাত্রী জননী ইন্দিরা গান্ধী। উনি যেভাবে দশহাতে আমেরিকা+ ন্যাটো + ৫০ টি মুসলিম দেশ + চীনের বিরুদ্ধে ডিপ্লোম্যাটিক লড়াই এ নেমেছিলেন, তা এক কথায় একটি এপিক। মনে রাখতে হবে সুহৃদ সোভিয়েত ইউনিয়ান ও পাকিস্তান ভাগ চায় নি-কারন পাকিস্তানের সাথে সোভিয়েতের সম্পর্ক মোটেও খারাপ ছিল না।  সেই অবস্থায় সোভিয়েত ইউনিয়ানকে নিজের হাতে রাখাও খুব সহজ কাজ ছিল না। কিন্ত ইন্দিরা পেরেছিলেন। তার অসাধারন বুদ্ধি এবং বাগ্মীতা দিয়ে। সোভিয়েত ইউনিয়ান ইউ এন রিসোলিউশনে ভিটো না দিলে,  আমেরিকা ইউ এনের শান্তিবাহিনীর ছাতার তলায় ইউ এস এস এন্টারপ্রাইজকে নামিয়ে দিত।

ইনফ্যাক্ট একবার ইউ এন যুদ্ধ বিরোধি  রিসোলিউশন পাশ করাতে পারলে, ভারতের বিরুদ্ধে আমেরিকার সরাসরি যুদ্ধে নামার সীলমোহর পেয়ে যেত ইউ এন পিস কিপিং ব্যানারে। তবে ম্যাকেন শর ইন্টারভিউতে শুনেছি, আমেরিকা যুদ্ধে নামবে, এটা ধরেই উনি স্ট্রাটেজি ঠিক করেছিলেন। তার মধ্যে একটা হচ্ছে ডিসেম্বরের শীতে আক্রমন । যাতে উত্তর থেকে বরফ পেরিয়ে চীন বেগ দিতে না পারে। না হলে ম্যাকেনশর মতে অক্টবরেই তারা তৈরী ছিলেন আক্রমনের জন্য।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা চলে যেত বিশ বাঁও জলে।








     


   











Sunday, September 24, 2017

প্রযুক্তি ও ইতিহাস - দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত বিজয় - পর্ব দুই

 বাংলায় এখনো  অনেক  কমিনিউস্ট - যাদের কাছে স্টালিনের মতন  কুখ্যাত খুনী পরম পূজনীয়। এদের স্টালিনের বিরুদ্ধে যতই বলুন, দেখবেন, ফাইনাল দাবী- হু হু বাবা, যাই বলনা কেন,  স্টালিন না থাকলে হিটলারকে কে ঠেকাত ?

  এটাও ইতিহাসের চূড়ান্ত অজ্ঞতা ছাড়া কিছু না। হিটলার আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়ান - পশ্চিম এবং পূর্ব দুটো ফ্রন্টেই হেরেছেন। সেটাও বাদ দিচ্ছি।  আসল ইতিহাস হচ্ছে  গ্রেট পার্জের আগে ( যে গ্রেট পার্জের মাধ্যমে স্টালিন কয়েক লাখ উচ্চপদস্থ রাশিয়ানকে হত্যা করেছিলেন প্রতিবিপ্লব ঠেকানোর নামে ) সোভিয়েত ইউনিয়ান, জার্মানির থেকে ট্যাঙ্ক এবং ফাইটার প্লেন প্রযুক্তিতে এগিয়ে ছিল। কিন্ত স্টালিন রাশিয়ান বুদ্ধিজীবি গণহত্যা শুরু করলে, খুব স্বাভাবিক কারনেই সোভিয়েত ইউনিয়ান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মানীর থেকে অনেকটাই পিছিয়ে যায় মিলিটারী প্রযুক্তিতে।

  এখানে একটা প্রশ্ন অনেকেই করেন না। ১৯৩৯ সালে হিটলার স্টালিনের সাথে ভাগ করে খেলেন, পোলান্ড।  পয়লা সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ , পোলান্ড আক্রমন করেন হিটলার। ১৮ ই সেপ্টেম্বর স্টালিন আক্রমন করলেন পোলান্ড। একটা স্বাধীন দেশকে টুকরো টুকরো করে হিঁচড়ে খাওয়ার জন্য চললো শতাব্দির দুই কুখ্যাত ফ্যাসিস্ট শক্তির আক্রমন। হিটলার দখল নিলেন পোলান্ডের পশ্চিম দিকের, স্টালিন পূর্বদিকের। দখলীকৃত পোলান্ডের জনগোষ্ঠি শতাব্দির দুই কুখ্যাত কসাইএর হাতে তখন।  হিটলার এবং স্টালিন-দুই মহান ব্যক্তি (!) পোলান্ডের লোকজনকে ধরে নিয়ে গেল ক্রীতদাস বানিয়ে নিজেদের দেশে-বিনাপয়সায় খাটাবে বলে। যারা অনিচ্ছুক, তাদের ফেলা হল মেশিনগানের সামনে। পোলান্ডের জনগণের প্রতি যে যঘন্য আচরন এবং গণহত্যা হয়েছে-তাতে  নৃশংসতার প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন স্টালিন এবং হিটলার।

 প্রশ্ন এটাই- ১৯৪১ সালে জুন মাসে হিটলার যদি সোভিয়েত আক্রমনই করবেন-তাহলে ১৯৩৯ সালে সোভিয়েতের সাথে ভাগ করে পূর্ব ইউরোপ খাচ্ছিলেন কেন?  ১৯৩৯-১৯৪১, স্টালিন এবং হিটলারের সম্পর্ক বেশ গলায় গলায়-দুজনেই ভাগ করে দখল করছেন ইউরোপের ছোট ছোট দেশগুলি। হিটলার একটা দেশ দখল করেন ত, স্টালিন অন্যদেশ। ভাব এমন এই দুই জনই ইউরোপ দখল করে খাবেন। যদি ভবিষ্যতে সোভিয়েত আক্রমনের পরিকল্পনাই থাকে, তাহলে ত স্টালিনের শক্তিবৃদ্ধিতে সহায়তা করার কোন কারন ছিল না।  ১৯৩৯ সালের মলটভ, রিবেনট্রপ চুক্তির মুল বক্তব্যই ছিল -চল যাই দুজনে মিলে ইউরোপ ভাগ করে নিই।


  এর মূল কারন এই যে, স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধে জার্মানী এবং সোভিয়েত ইউনিয়ান মুখোমুখী হয় ১৯৩৭ সালে। ওই যুদ্ধে সোভিয়েত বিমান বাহিনী জার্মান বিমান বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে। হিটলার বোঝেন, ইউরোপ দখল করতে গেলে সোভিয়েতের সাথে ভাগ করেই তা করতে হবে। এবং সেই মতন স্টালিন হিটলারের আগ্রাসণনের দোসর হতে রাজীও হলেন।  তবে হিটলার তখনো যেটা জানেন না-স্টালিনের গ্রেট পার্জের ফলে সোভিয়েত বাহিনী ক্রমশঃ দুর্বল হয়েছে ১৯৩৪-১৯৪১।  সেটা  হিটলার দেখলেন যখন স্টালিন ফিনল্যান্ড আক্রমন করলেন, দখল করার জন্য ( 1939, 29 Nov) । ইতিহাসে এটি উইন্টার যুদ্ধ নামে খ্যাত।

  ফিনল্যান্ড একটা ছোট্ট দেশ। সোভিয়েত দখলদারদের ঠেকানোর জন্য তাদের কাছে আছে মোটে ৩২ টি ট্যাঙ্ক, ১১৭ টা প্লেন। যেখানে রেড আর্মি পাঠিয়েছিল বিশাল বাহিনী- ৩৯০০ টি ফাইটার প্লেন, ২৫০০ এর কাছকাছি ট্যাঙ্ক।  প্রথমে মনে করা হয়েছিল মাত্র এক সপ্তাহেই সোভিয়েত ইউনিয়ান দখল করবে ফিনল্যান্ড। কিন্ত না। ফিনল্যান্ড, প্রায় ছমাস রুখে দিয়েছিল রেড আর্মিকে। এতেই সবাই পরিস্কার ভাবে বুঝে যায়, স্টালিন গ্রেট পার্জের নামে যে ৩০,০০০ আর্মি অফিসারদের খুন করেছে, তাতে রেড আর্মির অবস্থা খুবই খারাপ। এতটাই খারাপ যে ফিনল্যান্ডের মতন এক পুঁচকে আর্মিও তাদের নাস্তানাবুদ করে। হিটলার দেখলেন এবং বুঝলেন, স্টালিনের সাথে শান্তিচুক্তি করে ডাঁহা ভুল হয়েছে।  জার্মান প্যান্থার বাহিনীর সামনে রেড আর্মি শ্রেফ উড়ে যাবে। সুতরাং সোভিয়েত ইউনিয়ান ও পুরো দখল করা যাক। কারন পশ্চিমদিক তখন সম্পূর্ন জার্মানির দখলে। পূর্বদিকটাই বাদ যায় কেন?
 
    সেই হিসাব মতন ১৯৪১ সালের ২২ শে জুন শুরু হল অপারেশন বার্বারোসা। হিটলার আক্রমন করলেন সোভিয়েত ইউনিয়ান। পৃথিবীর ইতিহাসে এটাই বৃহত্তম যুদ্ধ।  দুইদিক মিলিয়ে ছয় মিলিয়ান সৈন্য।

  যুদ্ধ বলা ভুল। প্রথম ছদিন কোন যুদ্ধই হয় নি। রাশিয়ানরা মার খেয়ে পালিয়েছে, নইলে বন্দী হয়েছে। প্রথম ছদিনেই সোভিয়েত ইউনিয়ানের ৬৫০ কিলোমিটার ভেতরে ঢুকে আসে জার্মান বাহিনী। রাশিয়ানরা প্রথম বাধাদিতে সক্ষম হয়, ড্যান্যুব  নদীর ধারে। এবং এটি কাজে আসে। কারন বাধা পেয়ে, হিটলার সিদ্ধান্ত নেন, মস্কো দখল করে হবে কি? না আছে তেল, না আছে খাবার। বরং দক্ষিনে পাঠিয়ে দিলেন সেনাদের। ইউক্রেনের খাবার এবং তেল যুদ্ধের জন্য জরুরী।  মস্কো বাদ দিয়ে দখল কর ইউক্রেন।

  যাইহোক অক্টবর পর্যন্ত যুদ্ধ চলেছে এক তরফা। সব জায়গাতেই হারছিল রাশিয়ানরা। কোন বীরগাথা সম্ভব না। কারন রাশিয়ান ট্যাঙ্ক বা বিমান বাহিনী, জার্মানীর কাছে শিশুতুল্য। যুদ্ধের প্রথম তিন মাসেই প্রায় ৬০০ হাজার রেড আর্মি মারা যায়। সেখানে জার্মান বাহিনীর হতাহতের সংখ্যা ছিল নগন্য।  মস্কোর মাত্র কুড়ি মেইল দূরে ক্যাম্প করে বসে আছে জার্মান বাহিনী। মস্কোর পতনের ভয়ে সবাই পালিয়েছে আরো পূর্ব দিকে।

  এই অবস্থায় হঠাৎ করে আস্তে আস্তে যুদ্ধের মোড় ঘুরতে থাকে। এবং তার মূল কারন , সোভিয়েতের ইউনিয়ানের নতুন টি-৩৪ ট্যাঙ্ক।

   অপারেশন বারবারোসা শুরু হওয়ার প্রথম দিন থেকেই টি-৩৪ ট্যাঙ্ক রেড আর্মিতে ছিল। এবং টি-৩৪ ট্যাঙ্ক এবং এর কামান তখন জার্মান ট্যাঙ্কের থেকে উন্নত।  কিন্ত  জার্মান ট্যাঙ্ক ঘায়েল করা সত্ত্বেও, টি-৩৪ যুদ্ধের গতি ঘোরাতে পারছিল না। মূল কারন এর মেকানিকাল গলদ। ট্যাঙ্ক প্রায় রাস্তায় খারাপ হয়ে বসে যেত। ফলে অধিকাংশ টি-৩৪ ট্যাঙ্ক যুদ্ধে না- শ্রেফ মেকানিক্যাল ম্যালফাংফশনিং এ হারিয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ান।

       এর ও কারন আছে। মিখাইল কোশেন নামে এক আর্মি ইঞ্জিনিয়ার ১৯৩৭ সালে স্টালিনকে নেক্সট জেনারেশন ট্যাঙ্ক টি-৩৪ বানানোর প্রস্তাব রাখেন। স্টালিন তাকে ফান্ডিং দিলেন। কমিনিউস্ট দেশে যেহেতু মার্কেট কম্পিটিশন নেই, প্রতিযোগিতার আবহ বজায় রাখার জন্য একই প্রজেক্ট তিন চারটে সরকারি কোম্পানীকে দেওয়া হত।  টি-৩৪ এর পাশাপাশি আরো চারটি নতুন প্রজন্মের ট্যাঙ্কের গবেষনার ফান্ডিং স্টালিন দিয়েছিলেন। তবে কমিনিউস্ট দেশে যা হয়- মিখাইলের ভাগ্যে জুটল খুব কম ফান্ডিং। কারন কমিনিউস্ট নেতাদের তেল মারাতে উনি দক্ষ ছিলেন না। এমন কি ১৯৩৯ সালে একবার তার প্রজেক্ট বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। কোশেনের সাথে স্টালিনের সম্পর্ক ছিল বেশ ভাল। সেই যাত্রায় স্টালিনের সাথে দেখা করে, কোন রকমে টি-৩৪ এর প্রজেক্টটি বাঁচিয়ে রাখলেন তিনি।

 কিন্ত অপরেশন বার্বারোসাতে দেখা গেল একমাত্র টি-৩৪ ই প্রতিরোধে সক্ষম প্যান্থার বাহিনীর। এই ডিজাইন স্ল্যান্টেড আর্মার ভেদ করার ক্ষমতা ছিল না জার্মান আর্মির সেই সময় ( যদিও পড়ে টাইগার ট্যাঙ্ক এই ক্ষমতার অধিকারি হবে )।  কিন্ত তাও সুবিধা করা যাচ্ছে না। যেখানে সেখানে মেকানিক্যাল ফেলিওরে বসে যাচ্ছিল  টি-৩৪।

  এদিকে যুদ্ধের কারনে  গোটা   টি-৩৪ ট্যাঙ্ক ফ্যাক্টরি রাতারাতি উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে উড়াল পর্বতে। পর্বতের  প্রবল শীতে না খেতে পেয়ে কাজ করেছেন টি-৩৪ এর ইঞ্জিনিয়াররা। অনেকে মারাও গেছেন অত্যাধিক কাজের চাপে, ম্যালনিউট্রিশনে। কারন যে করেই হৌক টি-৩৪ এর ডিজাইন ডিফেক্ট সারাতেই হবে। স্টালিনের চাপ প্রচন্ড।  এমন অবস্থা ডিজাইন ঠিক হয়েছে কি না বোঝার উপায় নেই- নতুন ডিজাইন-কোন ইঞ্জিনিয়ারিং টেস্ট হয় নি। সরাসরি ফ্রন্টে টী-৩৪। সেখানেই ফিল্ড টেস্ট! যুদ্ধ চলছে, তার মধ্যেই একের পর এক নতুন ডিজাইনের টি-৩৪ নেমে যাচ্ছে।

 ১৯৪১ সালের অক্টবর মাসেই বোঝা যায়, আস্তে আস্তে টি-৩৪ আর মেকানিক্যাল ফেলিওরের জন্য বসে যাচ্ছে না। ঠিক এই সময় থেকেই মার দিকে শুরু করে রেড আর্মি। কারন রিলাইয়েবল টি-৩৪ নিয়ে এবার জার্মান বাহিনীর মোকাবিলা করা আস্তে আস্তে সহজ হচ্ছিল।

    সোভিয়েত বিজয়ের প্রধান এবং মুখ্য কারন ট-৩৪ ট্যাঙ্ক। তবে স্টালিনিস্ট রাশিয়া মিখাইল কোশেনকে পর্যাপ্ত ফান্ডিং দিলে,  সোভিয়েত ইউনিয়ানে ঢুকতেই পারত না প্যান্থার বাহিনী। যাইহোক, উড়াল পর্বতের প্রবল ঠান্ডা অগ্রাহ্য করে টি-৩৪ এর ইঞ্জিনিয়াররা যে কাজ করে গেছেন, তার স্বীকৃতি তারা খুব বেশী পান নি।




     

 

 

 









 








Friday, September 22, 2017

প্রযুক্তি এবং ইতিহাস-১

স্কুল লেভেল থেকেই ইতিহাস ভাষ্যের ( ন্যারেটিভ) দখল নেওয়ার কাজটা সব পার্টিই করে। কারন ভবিষ্যতের ক্যাডার তৈরীর জন্য, ওটা প্রথমে দরকার। রাজনৈতিক পার্টির অন্ধ সাপোর্টার বেস তৈরী করার ওটাই প্রথম ধাপ। আর সেই কারনে পৃথিবীর সব দেশেই ইতিহাসের ভাষ্য ভীষন ভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রানদিত। অর্থাৎ ইতিহাসের গল্পে হিরো-ভিলেন থাকে-এবং তাদের নির্মান করা হয় গল্পের মাধ্যমে । প্রয়োজন মাফিক। যদিও আমি যেটুকু ইতিহাস ঘাঁটি, তাতে এটাই আমার কাছে পরিস্কার হয়, ইতিহাসের আসল গল্পের হিরো কিন্ত কারিগড়রা। প্রযুক্তিবিদরা।

এই লেখাটাই বেশ কিছু ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ করব- যেখানে ইতিহাসের গল্পটা, রাজনৈতিক প্রয়োজনে অন্যভাবে আমাদের জানানো হয়েছে ছোটবেলা থেকে।


ধরুন পলাশীর যুদ্ধ। মিরজাফর বিশ্বাসঘাতক, ক্লাইভ ভিলেন, সিরাজ ট্রাজিক হিরো। এটাই ভারতের ইতিহাসের মেইনস্ট্রিম ন্যারেটিভ। এবার ব্যপারটাকে একটু অন্যভাবে দেখি।

২৩শে জুন ১৭৫৭, রাত একটার সময়, ক্লাইভ, তার সেনাপতি মেজর কিলপ্যাট্রিক, মেজর কোটে এবং মেজর গ্রান্ট পলাশীর আম্রকুঞ্জে আশ্রয় নেন। সাথে মেরে কেটে ৩০০০ সেনা। কোন ঘোরসওয়ার ( ক্যাভেলারী) নেই। মোটে ৮ টা কামান, তার মধ্যে দুটো হাউতজার ( যা উচ্চ উচ্চতায় ছুড়ে অনেক দূরে গোলা ফেলা যায়)। কামানগুলোও ছোট ছোট-গোলার ওজন মোটে ছ পাউন্ড বা তিন কিলো। যেখানে নবাবের কামান ৫৩ টি-গোলার ওজন ১৮, ২৪ এবং ৩২ পাউন্ড। বিশাল বড় বড় কামান। প্রতিটা কামান টানতেই লাগত ত্রিশ থেকে চল্লিশটা মোষের গাড়ি।

২২ শে জুন থেকেই পলাশীর প্রান্তরে ক্যাম্প করে আছে নবাবী সেনা। তাদের যুদ্ধ করার ইচ্ছা বিশেষ নেই। কারন তাদের মাইনে হয় নি। ১৯ শে জুন মুর্শিদাবাদ থেকে অনেকেই আসতে চাই নি। শেষে প্রচুর বোনাস দিয়েই তাদের আনতে হয়। সিরাজের মিসম্যানেজমেন্ট আরো সুবিধা করে দেয় মিরজাফরের চক্রান্ত-কারন সেনারাই যখন যুদ্ধে ইচ্ছুক না- মিরজাফরের চক্রান্তের বিরুদ্ধে তার সেনারা দেশপ্রেমের কারনে বিদ্রোহ করবে, তার লেশমাত্র নেই।

নবাবের বাহিনী বিশাল। মিরজাফরের কম্যান্ডেই আছে ১৪ হাজার ঘোড়াসওয়ার ৩৮ হাজার পদাদিক । মীর মদন মোহনলালের কমান্ডে আছে ৬ হাজার ঘোরসওয়ার, সাত হাজার পদাদিক। ৫৩ টি কামানের গোলন্দাজ বাহিনী আলাদা। এর সাথে ফরাসী গোলন্দাজ মসিয়ে ফ্রেজের আছে পঞ্চাশ জন গোলন্দাজ এবং ৬ টি কামান। মোদ্দা কথা মীরজাফরের সেনারা কিছু না করলেও মীর মদনের হাতে যে সেনা, ঘোড়া এবং কামান আছে-তাই দিয়েই জেতা উচিত।

এদিকে ক্লাইভ আছেন দোটানায়। মীর জাফর কি করবেন বলা যাচ্ছে না। কোন ঘাটের জল খাচ্ছেন বা খাবেন কেউ জানে না। দুদিন আগে মীর জাফরের প্রাসাদ ঘিরে তাকে বন্দী করেন সিরাজ। কারন তার কাছে খবর ছিল, মীর জাফর বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেন। মীর জাফর কোরান স্পর্ষ করে প্রতিজ্ঞা করেছেন সিরাজের কাছে, বিশ্বাসঘাতকতা তিনি করবেন না। সেই খবর পৌছে গেছে ক্লাইভের কাছে। মীর জাফর যদি ক্লাইভের দিকে যুদ্ধ না করেন, শ্রেফ মীর মদনের ছ হাজার ঘোর সওয়ারই কচুকাটা করে দেবে তাদের।

সকাল আটটায় যুদ্ধ শুরু হয়। ফরাসী গোলন্দাজরা এবং নবাবের গোলন্দাজরা আগুয়ান ক্লাইভ বাহিনীর দিকে গোলা ছুড়তে থাকে। আধ ঘন্টায় ক্লাইভের প্রায় পঞ্চাশ জন মারা যায়। বেগতিক বুঝে ক্লাইভ পিছিয়ে এসে আম বাগানে লুকালেন। এতে নবাবের গোলার থেকে বেঁচে গেল কোম্পানীর সেনারা। সিরাজ ইনফ্যান্ট্রি ( পদাদিক ) পাঠালেন হাজার দশেক। কিন্ত এবার ক্লাইভের গোলন্দাজরা এবং বন্দুকবাজরা গুলি গোলা চালিয়ে তিন ঘন্টা আটকে রাখল তাদের। নবাবের প্রায় শ দুয়েক পদাদিক ঘায়েল-কিন্ত বৃটিশ ক্যাম্পে কেউ ঢুকতে পারল না।

মাত্র আটটা কামান দিয়ে কি করে এত বড় ইনফ্রান্ট্রি আটকানো সম্ভব-তার কারন ও উন্নত বৃটিশ প্রযুক্তি। কোম্পানীর সেনাদের কাছে ছিল ক্যানিস্টার শেল বা গ্রেপ শট। অর্থাৎ এই গোলা গুলির মধ্যে থাকে ছোট ছোট লোহার বল। যখন ফাটে -তখন এক সাথে ডজনে ডজনে গুলির মতন চারিদিকে ছড়িয়ে যায়। এই ক্যানিস্টার শেলের জোরেই হুগলিতে নবাবের চল্লিশ হাজার সেনাকে আটকে দিয়েছিল মাত্র হাজার খানেক কোম্পানীর সিপাই আর দুটো কামান। যার জেরে সিরাজ দৌল্লা আলিনগরের সন্ধি করতে বাধ্য হোন।

সকাল এগারোটার সময় পলাশীর যুদ্ধের আসল ঘটনা ঘটে। মুশল ধারে বৃষ্টি নামে। নবাবের কামান ঢাকার কোন ব্যবস্থা নেই। কোম্পানীর লোকেরা তখন ত্রিপলের ( ট্রিপলিন ) ব্যবহার জানে কারন তা বৃটেনেই সদ্য আবিস্কৃত। ট্রারপলিন কথাটা এসেছে তার কারন প্রথম ত্রিপল যখন আবিস্কার হয়, তখন কাপড়ের ওপরে টার লাগিতে তা তৈরী হত। তখনো প্লাস্টিক আবিস্কার হয় নি। টারই ছিল বৃষ্টিনিরোধক। বৃষ্টির সময় নবাবের সব গোলা যখন ভিজে অকেজো-কোম্পানীর গোলাগুলি বা কামানের কিছু হল না। তা ছিল ত্রিপল দিয়ে ঢাকা। মুশকিল হচ্ছে, কোম্পানীর সেনাদের কাছে যে ত্রিপল দিয়ে ঢাকার মতন প্রযুক্তি আছে -সেই খবরটাও পর্যন্ত পৌছায় নি নবাবের ক্যাম্পে। যার ফলে ভুল সিদ্ধান্ত নেবেন মীরমদন ।

এদিকে বৃষ্টি যখন মুশলধারে, ক্লাইভ তার জেনারেলদের ডাকলেন। জিজ্ঞেস করছেন এই বৃষ্টির মধ্যে পালাই না এই ভাবেই চলুক? কারন মিরজাফর তখন ও দাঁড়িয়ে। ক্লাইভের দিকে তার সাহায্য না আসলে কচুকাটা করবে নবাব বাহিনী। সবাই গঙ্গা দিয়ে পালানোর দিকেই রায় দিলেন। ক্লাইভের সাথে আছে ২০০ বড় নৌকা। কাজটা কঠিন না। মীরজাফর কথা না রাখলে, পালাতে হবে-সেটা জেনে, দুশো নৌকাকে খুব কাছেই বেঁধে রেখেছেন ক্লাইভ। মেজর প্যাট্রিক বেঁকে বসলেন। প্যাট্রিক বল্লেন, বৃষ্টিতে ওদের কামান অকেজো হবে। ফলে ওরা পালাবে। ক্লাইভ সহ সবার মনে ধরল যুক্তিটা। দেখাই যাক। যদি নবাবের কামান অকেজো হয়ে থাকে বৃষ্টিতে তাহলে জয় নিশ্চিত।

বৃষ্টি থামে বেলা একটা নাগাদ। মীর মদন ভাবলেন এটাই সুযোগ ঘোড়া ছুটিয়ে কোম্পানীর সেনাদের কচুকাটা করার । কারন মীর মদন ভেবেছিলেন যেহেতু ক্লাইভের কামানগুলো নেতিয়ে গেছে জলে ভিজে, ক্যাভেলারি চার্জ আটকানোর ক্ষমতা নেই ক্লাইভের। একমাত্র ক্যানিস্টার চার্জের ভয়েই যুদ্ধের প্রথম তিন ঘন্টা কোন ক্যাভেলারি চার্জ করেন নি মীরমদন।

মীর মদনের ভুল সিদ্ধান্তে মাত্র কয়েক মিনিটেই যুদ্ধের ভাগ্য গেল ঘুরে। মীর মদন প্রায় দুহাজার ঘোড়সওয়ার নিয়ে কোম্পানীর কামান গুলোর দিকে ছুটে গেলেন। কিন্ত উনি জানতেন না ওগুলো কাজ করছে। ফলে শীঘ্রই কামানের ক্যানিস্টার শটে মীরমদন সহ সমগ্র ঘোরসওয়ার বাহিনীই আহত হয়।

মীর মদনকে আহত অবস্থায় দেখে সিরাজ মীর জাফরের কাছে টুপি খুলে অনুরোধ করলেন বৃটিশ দের আক্রমন করতে। মীরজাফর একদিকে সিরাজকে আসস্ত করলেন, অন্যদিকে ক্লাইভের কাছে খবর পাঠালেন সিরাজের দিক -যা ছিল রাইট ফ্ল্যাংক, আক্রমণ করতে।

ততক্ষনে ক্লাইভ বুঝে গেছেন নবাব পক্ষের একটাও কামান কাজ করছে না। ফলে মীর জাফর কি করবে সেই আশায় বসে থেকে লাভ নেই। ক্লাইভের সেনারা মিরজাফরের সেনাদের ও আক্রমণ করে। এমন অবস্থায় বেলা দুটোর সময় সিরাজ দু হাজার ঘোরসওয়ার সহ পালিয়ে যান মুর্শিদাবাদে।

এই সময় কিন্ত মীর জাফর সহ নবাবের সব সেনারাই যুদ্ধে নেমে গেছে। তারা গাদা বন্দুক হাতে আম গাছে আড়াল থেকে গুলি ছুঁড়েছে। কিন্ত তাই দিয়ে ক্যানিস্টার শেলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জেতা সম্ভব না। একেতে যুদ্ধ করার তাগিদ এমনিতেই তাদের কম যেহেতু মাইনে নিয়ে অসন্তোষ আগে থেকে ছিলই। ওই সব দেশপ্রেম বলে তাদের কিছু ছিল না। তাদের কাছে নবাব ও বিদেশী, ক্লাইভ ও বিদেশী। ফলে নবাবের সেনারা আস্তে আস্তে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে পালিয়ে যায়। বেলা পাঁচটার মধ্যেই ক্লাইভের জয় নিশ্চিত হয়ে যায়।

রাতের বেলায় মীরজাফর চিঠি পাঠান ক্লাইভকে যে তিনি দেখা করতে চান। ২৩শে জুন সকালে ক্লাইভ মিরজাফরের সাথে দেখা করেন এবং নির্দেশ দেন মুর্শিদাবাদে দ্রুত ফিরে সিরাজকে হত্যা করতে, যাতে সিরাজ তার ধণরত্ন নিয়ে না পালাতে পারে।

কিন্ত এরকম ইতিহাস লিখলে ভারতীয়দের মধ্যে দেশত্মবোধ জাগবে কি করে? ফলে ভারতের জাতিয়তাবাদের উত্থানের সময় মীরমদনের লড়াইকে দেখানো হল বীররসে

নবীন চন্দ্র সেন লিখলেন - ( কবিতা-পলাশীর যুদ্ধ )
" 
অকস্মাত্‍‌ একেবারে শতেক কামান 
করিল অনলবৃষ্টি 
ভীষণ সংহার দৃষ্টি। 
কত শ্বেত যোদ্ধা তাহে হল তিরোধান। "

 
মুশকিল হচ্ছে, শত কামান না, বৃটিশদের ছিল মোটে আটটি কামান। খুব পরিস্কারভাবেই নবীন সেন, এমন ভাবে লিখেছেন যেন ক্লাইভের ছিল প্রচুর সেনা এবং কামান-তার বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে দেশপ্রেমী নবাবের সৈন্যরা। না তেমন কিছু হয় নি। মুষ্টিমেয় কিছু কোম্পানী সৈন্যর সামনে, পালানোর প্রথম সুযোগেই নবাবের সেনারা পালিয়েছিল। এবং মিরজাফর যুদ্ধে নামলেও সিরাজ হারতেন ই। কারন সেই প্রযুক্তি। নবাবের সমর প্রযুক্তি ছিল নেহাতই আদ্যিকালের। বৃষ্টিতে কামান ঢাকার মতন নুন্যতম প্রযুক্তিও তাদের হাতে ছিল না।

ইতিহাসের এই নব মুল্যায়ন এই জন্যে গুরুত্বপূর্ন, ভারতীয় সমাজে বর্ণবাদের জন্য কারিগড়দের সমাজে উচ্চস্থান দেওয়া হয় নি। যতসব আটভাট গুলমারা ধর্মীয় দর্শন যারা কপচাতে পারে, ভারতীয় সমাজে উচ্চস্থান তাদের। মুসলমানরা আসাতে ভারতের বর্ণবাদ ত কমেই নি, বরং মুসলমান শাসকরাও ভারতের বর্ণবাদ টেকাতেই সচেষ্ট ছিলেন। কারিগড়, কৃষক বা উৎপাদকশক্তির যারা ধারক ও বাহক- তাদেরকে পায়ের নীচে রেখে, গুলবাজ দার্শনিকদের মাথায় বসানো ভারতে ট্রাডিশনে পরিণত। পশ্চিম বঙ্গের বাম শাসনকাল ও একই দোষে দুষ্ট। অনুৎপাদক বাম বুদ্ধিজীবিদের উৎপাদক শ্রেনীর মাথায় বসিয়ে বাঙালী জাতির সর্বনাশ করা হয়েছে । এবং এই সব সর্বনাশের শুরু হয় সেই সব ন্যারেটিভ থেকে যেখানে ইতিহাসে বা মানব সভ্যতায় কারিগড়ি বিদ্যার গুরুত্ব অগ্রাহ্য করে কখনো বাম, কখনো ডান চশমায় ইতিহাসকে দেখানো হয়।

পরে কিস্তিতে আরেকটা গল্প লিখছি।













Saturday, September 9, 2017

গৌরী লঙ্কেশ এবং হিন্দুত্ববাদি

(১)
গৌরী লঙ্কেশের নাম আগে শুনিনি। কন্নডভাষি কোন পত্রিকার সম্পাদকের নাম কেউ না জানতেই পারে। ব্যাঙ্গালোরে উনাকে কালকে গুলি করে মারা হয়। উনি একজন বাম লিব্যারাল ঘরানার সম্পাদক। হিন্দুত্ববাদিদের বিরুদ্ধে লিখতেন। আবার কংগ্রেসকেও গালাগাল দিতেন। উনার পত্রিকা লঙ্কেশ পত্রিকে। তবে ইদানিং কালে উনার সাথে সাপে নেউলে সম্পর্ক ছিল ব্যাঙ্গালোর বিজেপির। কে খুন করেছে এখনো পুলিস জানে না-কিন্ত অনুমান করা শক্ত না।
কন্নড় ভাষার এই রাজনৈতিক সাপ্তাহিকটি গোটা ভারতেই ব্যতিক্রম। এর প্রতিষ্ঠাতা গৌরীর পিতা পি লঙ্কেশ। ছাপা হয় কয়েক লাখ। কোন বিজ্ঞাপন এরা নেন নি কোনদিন। কারন বিজ্ঞাপন নিলেই দেহবিক্রি আবশ্যক। কোন রাজনীতিবিদকেই ছেড়ে কথা বলে না লঙ্কেশ পত্রিকে। কারুর তাবেদারি করে না। ফলে নীতিগত কারনে তারা কোনদিন বিজ্ঞাপন নেয় না। লসেই চলে পত্রিকা। কিন্ত ওদের পাবলিকেশন হাউসে বেশ কিছু কেরিয়ার সংক্রান্ত লাভ জনক প্রকাশনাও আছে।
পি লঙ্কেশের মৃত্যুর পরে পত্রিকার হাল ধরেন তার কন্যা। এখানেও ইতিহাস বর্ণময়। পি লঙ্কেশ কন্নড জাতীয়তাবাদি। উনিই বলেছিলেন হৃদয়ের কথা একমাত্র মাতৃভাষাতেই লেখা সম্ভব। গৌরী কিন্ত ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া ছাত্রী। মিডিয়া কমিউনিকেশনে ডিগ্রি নেওয়ার পরে বাবার পত্রিকাতে আসেন নি- জাতীয় লেভেলেই সাংবাদিকতা করেছেন কুড়ি বছর। এই কুড়ি বছর বাবার পত্রিকাতে একটিও লাইন লেখেন নি।
বাবার মৃত্যুর পরে যখন কর্পরেট হাউস ছেড়ে এই ঐহিত্যবাহী কন্নড় পত্রিকার হাল ধরেন গৌরী-উনি অকপটে স্বীকার করেন, এর আগে পর্যন্ত শুধুমাত্র মালিকপক্ষের জন্য লিখেছেন। নিজের পত্রিকা হাতে পাওয়ার পরে, কোন কম্প্রোমাইজ না করেই ভ্রষ্ট রাজনীতির বিরুদ্ধে কলম ধরেন গৌরী লঙ্কেশ। পরিনতি মৃত্যু।
কোন সন্দেহ নেই, ভারত এবং আমেরিকাতেও রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা এখন আগ্নেয়গিরির লাভাশ্রোত। শাসক দলের মতের বিরুদ্ধে কথা বললেই, তাকে পিটিয়ে দাও, গালাগাল দাও। বেশী জ্বালালে মেরেই দাও!!
রাজনৈতিক অবস্থা সত্যিই খুব খারাপ। জৈন ধর্মে আমরা শিখি অনেকান্তবাদ। অর্থাৎ একই বাস্তবতার অনেক রূপ থাকতে পারে। কেউ বামপন্থী, কেই দক্ষিনপন্থী দৃষ্টিতে তার সমাজ, রাষ্ট্রকে দেখবে সেটাই স্বাভাবিক। তাদের মধ্যে তর্কাতর্কি, বিবাদ সব কিছুই হতে পারে। কিন্ত সেই বিতর্কের জায়গাটা না থেকে যদি তারা দাবী করে দক্ষিন পন্থী জাতিয়তাবাদই একমাত্র পথ, বা বামপন্থাই পথ-তাহলে দুদলই ফ্যাসিজমের শব সাধক।
গৌরী লঙ্কেশ একজন বামপন্থী। উনার লেখা সাবেকি বাম ঘরানার। মাওবাদিদের সমর্থনেও উনি লিখেছন। কিন্ত রাজনৈতিক ভাবে উনার বিরোধিতা না করে যখন, বুলেট দিয়ে কলম থামাতে হয়, সেটা সুস্পষ্ট ভাবেই ফ্যাসিজমের প্রতিধ্বনি।
তবে আমি আশাবাদি। আস্তে আস্তে অর্থনীতি ক্রমশ হাতুড়ে অর্থনীতিবিদদের হাত থেকে সলিড বিগ ডেটা মডেলে আসছে। যার মানে খুব নিকট অতীতেই, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও চালিত হবে ডেটা সিম্যুলেশন এবং এলগোরিদম থেকে। সেখানে বামপন্থা, বা দক্ষিনপন্থা রাজনীতির ভূমিকা থাকবে কম- গণিতের ভূমিকা থাকবে বেশী। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে যত বেশী ডেটা সিম্যুলেশন, গেম থিওরীর সাহায্য নেওয়া যাবে-দেশ এবং দশের তত সুদিন আসন্ন। বামপন্থা, দক্ষিনপন্থা ইত্যাদির রাজনৈতিক আইডিওলজির ওপর দেশ চালাতে গেলে, ভরাডুবি সময়ের অপেক্ষা।
একবিংশ শতাব্দিতে বিংশ শতাব্দির রাজনৈতিক আদর্শ অচল নয়া পয়সা। অথচ ভারত, আমেরিকাতে সেই বাতিল আদর্শেরই আজ রমরমা।
আমি অফিসে ঢুকে আমেরিকান কোম্পানীর জন্য অত্যাধুনিক কোডিং করব, বাড়িতে ঢুকে হনুমান চল্লিশা- আর রাজনীতির বেলায় আদ্দিকালের জাতীয়তাবাদি, ধর্মবাদি, ধর্মঘটবাদি, টুপিবাদি ইত্যাদি বাতিল রাজনৈতিক তত্ত্বের চর্চা-খুব বেশীদিন এতগুলো স্ববিরোধিতা একত্রে চলতে পারে না।
(২)
গৌরী লঙ্কেশের মৃত্যুতে স্যোশাল মিডিয়াতে একদলের পৈশাচিক উল্লাশ। ট্রলের ঢল টুইটারে। নতুন কোন অভিজ্ঞতা না। অভিজিতের মৃত্যুতে যেমন ফেসবুকে উৎসব করেছিল কিছু বাঙালী মুসলমান, আজ গৌরীর মৃত্যুতে প্রকাশ্যে উল্লাসিত কিছু কট্টরপন্থী হিন্দু। গৌরী লঙ্কেশের "অপরাধ" উনি হিন্দু ধর্মের কট্টর সমালোচক ছিলেন! অভিজিতের অপরাধ, সে ইসলামের সমালোচক ছিল!
২০০৭ সালে ষষ্টি দুলে বলে একজন তৃনমূলীকে, তার সাত বছরের ছেলের সামনে চোখে উত্তপ্ত রড ঢুকিয়ে হত্যা করেছিল সিপিএমের হার্মাদ বাহিনী। সেই সময় স্যোশাল মিডিয়াতে সিপিএমের হার্মাদ ট্রলরা একই দাবী করে-ষষ্টি নাকি ছিল ফরেদারদের দালাল-শ্রেনী শত্রু-তাই তার নৃশংস হত্যা জায়েজ। আমি ওই ঘটনার পর থেকে অনেক ভদ্রবেশী সিপিএম সমর্থককেও আনফ্রেইন্ড করতে বাধ্য হয়েছিলাম। সেটা অর্কুটের যুগ।
অভিজিতের মৃত্যুতে কিছু বাংলাদেশী মুসলমানদের উল্লাসে এটা পরিস্কার ছিল, ধর্ম এদের মানুষের বদলে অমানুষ বানিয়েছে। তবে তারা আমার ফ্রেইন্ড লিস্টের লোক না। ফলে আনফ্রেইন্ড করার ঝামেলা নিতে হয় নি। আজকে ফ্রেইন্ডলিস্টের বেশ কিছু হিন্দুত্ববাদিদের আনফ্রেইন্ড করতে বাধ্য হলাম। ঠিক যেভাবে ষষ্টিদুলে হত্যার পরে, অর্কুট জমানাতে কিছু ফ্রেইন্ড লিস্টে থাকা কিছু সিপিএমকে আনফ্রেইন্ড করতে বাধ্য হয়েছিলাম।
যারা মানুষের জীবনের থেকে, নিজের ধর্ম, জাতি, রাজনীতিকে বেশী গুরুত্বপূর্ন মনে করে- এতটাই বেশী গুরুত্ব দেয় যে তার জন্য খুনকেও সমর্থন করে গর্বিত পশু হতে চাইছে-তাদের এই অধপতনকে যদি নাগরিক সমাজ নীরবে প্রশয় দিতেই থাকে, একদিন না একদিন সেই ঘৃণার বিষবাস্পে সমাজে বসবাস করাই অসম্ভব হবে।
কোন ধর্ম, কোন রাজনৈতিক আদর্শই মানুষের জীবনের থেকে বড় হতে পারে না। ধর্ম, রাজনীতি সবকিছুই মানুষের জন্য-সুতরাং মানুষ মেরে যদি কেউ ভাবে তার ধর্ম, তার রাজনীতি প্রতিষ্ঠা পাবে-সে মূর্খ। লেনিন, স্টালিন কোটি কোটি লোক খুন করে তাদের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন?? বরং ইউরোপীয়ান ইউনিয়ানে আইন এনে স্টালিনকে হিটলারের সম পর্যায়ের খুনী বলে স্বীকার করা হয়েছে হলডোমার জেনোসাইডের হোতা হিসাবে।
ঠিক তেমনি ভাবে বাংলাদেশে ১০০% ইসলামের প্রতিষ্ঠার জন্য, প্রতিদিনই দেখি কিছু হিন্দুকে হত্যা করা হচ্ছে, ঘরবাড়ি পোড়ানো হচ্ছে।
ভয় দেখিয়ে ভারতে পাঠানো হচ্ছে। এতে কি বাংলাদেশে ১০০% ইসলাম আসবে? সেসব কিছুই হবে না। পাকিস্তানের মতন জঙ্গীরাষ্ট্রে পরিণত হবে। তবে শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ যে উনি অন্তত বেশ কিছু জঙ্গী সাফ করে কিছুটা হলেও উঠোন পরিস্কার করেছেন।
ভারতেও এখন যারা হিন্দুত্ববাদের সেন্ট্রাল থিমকে চ্যালেঞ্জ করছে, তাদের নানান ভাবে ভয় দেখানো হচ্ছে। এক্সট্রিম কেসে মেরে ফেলাও হচ্ছে। মহত্মা গান্ধীর খুনী নথুরাম গডসে মূর্তি বসিয়ে পূজা হচ্ছে!! এই ভাবে ভারত হিন্দুরাষ্ট্র হবে? শ্রীচৈতন্যের আমলে অনেক ধর্মান্তরিত মুসলমান, আবার বৈষ্ণব ধর্মের প্রেমের আঁচলে ফিরে আসে। তাকে তার জন্যে খুন খারাপি গোরক্ষা কমিটি বানাতে হয়েছিল?
জাতি, ধর্মের কারনে হত্যা নতুন কিছু না। পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম দিন থেকেই এগুলো ছিল। বর্তমান আধুনিক পৃথিবীতেও আমাদের সেই মৃত্যুভয়ে কাটাতে হবে ?
অথচ প্রাচীন ভারতেই ছিল মুক্ত চিন্তার স্বাধীনতা। গৌতম বুদ্ধ, মহাবীর-এরাও হিন্দু ধর্মকে, বেদকে চ্যালেঞ্জ করেছেন- কেউ কি তাদের হত্যা করেছে সে দিন ?
তাহলে কিকরে এটা সম্ভব, গৌতম বুদ্ধ যে মুক্তমনের স্বাধীনতার পরিবেশ আড়াই হাজার বছর আগে পেয়েছিলেন, একবিংশ শতাব্দির ভারত, তা গৌরী লঙ্কেশ, এম এম কুলবর্গী, গোভিন্দ পানসেরকে দিতে অক্ষম?

ধংসযজ্ঞের ঘৃতাহুতি

এই সপ্তাহটা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঘনঘটা। রবিবার ফ্লোরিডাকে দুরমুশ করবে ক্যাটেগরী-৫ হারিকেন ইরমা। এখন সে কিউবার উত্তরে। ফ্লোরিডার প্রায় সব বাসিন্দারাই থাকে এর নয়নাভিরাম সৈকত শহরগুলিতে। সেখান থেকে সবাইকে আপাতত সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। প্রায় এক কোটি লোক, নিজের বাড়িঘর ছেরে অন্যত্র-দেখছেন রবিবার দুপুরে ইরমা তাদের বাড়ির আস্ত রাখবে কি না।

শুধু ইরমা না। ইরমার উত্তর দিকে আরেকটা ক্যাটেগরী-৪ হারিকেন এগোচ্ছে- হারিকেন হোসে। সেটাও ক্যাটেগরী ফাইভ হয়ে পূর্ব উপকূলে ঝাঁপাতে পারে আগামী সপ্তাহের বুধ বৃহস্পতি নাগাদ।

আটলান্টিকের ক্যারিবিয়ান সমুদ্রে দুটী হারিকেনের একত্রে উদ্ভব- বিরল ঘটনা। হয়ত গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর জন্য, এটাই এখন বারে বারে ঘটবে। আরো বেশী ঝড়, বৃষ্টি। এবং ধ্বংসলীলা বা মানুষের বিরুদ্ধে প্রকৃতির প্রতিশোধ।

সেপ্টেম্বার মাসটাকে আমেরিকাতে বলে হ্যারিকেন সিজন। এই সময়টাতে ক্যারিবিয়ান সমুদ্রে অনেক সাইক্লোন তৈরী হয়-এর মধ্যে গুটিকয়েক আস্তে আস্তে উষ্ণবাস্প সংগ্রহ করে আরো বেশী গতিবেগে হারিকেন হয়ে ঝাঁপিয়ে পরে মূলত আমেরিকার দক্ষিনপূর্ব উপকূলে।

আমেরিকান হারিকেনের সাথে প্রথম সাক্ষাত ২০০২ সালে। সেপ্টেম্বের এর ঠিক এই সময়টাতেই সেবার পূর্ব উপকূল তছনচ করেছিল হারিকেন গুস্তাভ। তবে নর্থ ক্যারোলিনা থেকে সে যখন নিউ জার্সিতে পৌঁছায়, তখন সে দুর্বল ক্যাটেগরী ওয়ান হারিকেন। তাতেই গাছের ডাল ভেঙে এমন অবস্থা, রাস্তা ঘাট অনেক জায়গায় আটকে যায়। দুদিন বাড়িতে কারেন্ট ছিল না। আর আমেরিকাতে পাওয়ার না থাকলে কি বিভৎস অবস্থা হয়, সেই অভিজ্ঞতাও প্রথম। ফ্রিজ থেকে মাছ মাংস ফেলে দিতে হয়েছিল।

দ্বিতীয় এবং সর্বাধিক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা ২০১২ সালে, মেরীল্যান্ডে। হারিকেন স্যান্ডি সেবার ক্যাটেগরী-৩ হারিকেন। সাইক্লোনের চোখ আমার বাড়ি থেকে ১৫০ মাইল দূরে আটলান্টিক মহাসাগরে-কিন্ত তাতেই গাছের ডালের অজস্র আঘাতে বাড়ির ছাদ এবং দেওয়ালের প্রচুর ক্ষতি হয় সেবার। ছয়দিন থাকতে হয়েছে পাওয়ার ছাড়া-কারন, লাইন ছিন্নভিন্ন। অবস্থা এতই খারাপ ছিল, পাওয়ার লাইন মেরামতের জন্য, গোটা আমেরিকার অন্যান্য পাওয়ার কোম্পানী ৫০,০০০ লোক পাঠায় বাল্টিমোর পাওয়ারকে। এই ঘটনায় বাল্টিমোর পাওয়ার ইলেক্ট্রিক কোম্পানীর এত দুর্নাম হয়-ওরা এর পরের থেকে সব ট্রান্সমিশণ পাওয়ার লাইন, আন্ডার গ্রাউন্ড বানানো শুরু করে।

এই সপ্তাহে আরো তিনটে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটেছে বা ঘটার ইঙ্গিত আছে।

ইয়োলোস্টোন ন্যাশানাল পার্কে ঘন ঘন ভূমিকম্পের আভাস মিলেছে। ইয়োলোস্টোন ন্যাশানাল পার্ক বসে আছে এক সুপার ভলকানোর ওপরে-যার পাঁচ মাইল নীচে আছে নিউয়ার্ক সিটির তিনগুন বড় জ্বলন্ত লাভা চেম্বার। প্রতি ৬৪০,০০০ বছর বাদে একবার করে হয়েছে সুপার ভলকানিক ইরাপশন। সেই পিরিয়ড অনেকদিন হল পেরিয়েছে, বিজ্ঞানীরা জানেন একটি বড় সুপার ভলকানিক ইরাপশন এখন অপেক্ষা মাত্র। তবে তা এখনই হবে না আরো হাজার হাজার বছর অপেক্ষা করতে হবে, তা জানা নেই। সুপার ভলকানিক ইরাপশন , এক্সটিংশন লেভেল ইভেন্ট। ভলকানিক ইরাপশন থেকে আরাই ট্রিলিয়ান টন ছাই এবং গ্যাস বেরোবে। দশ বছর গোটা পৃথিবীর আকাশ ঘিরে থাকবে ছাই। ফসলের উৎপাদন ধ্বংস হবার ফলে প্রায় পৃথিবীর প্রায় ৯০% লোক অনাহারে থাকবে, ধ্বংস হবে আমেরিকার ৯৫% শহর জনপদ। তবে আশার কথা বিজ্ঞানীরা বলছেন এই ভূমিকম্পের ফলে ম্যাগমা চেম্বারের পরিবর্তন এখনো তারা দেখছেন না। যদি এই ভূমিকম্পের ফলে ম্যাগমা চেম্বার একটুও নড়ে, গোটা পৃথিবীর স্টক মার্কেটে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠবে।

কাল মেক্সিকোতে বিরাট ভূমিকম্প হয়েছে, প্রশান্ত মহাসাগর বরাবর। কিন্ত জনবহূল এলাকাতে না হওয়াতে ক্ষয় ক্ষতি কম।

গত বুধবার পৃথিবীর দিকে ধেয়ে এসেছে, এই দশকের সব থেকে শক্তিশালী সৌড়ঝড়। সূর্য্যের করোনার একটি বড়সর বিস্ফোরন থেকে তৈরী এই প্লাজমা ঝড় পৃথিবীর রেডিও কমিনিউকেশন স্তব্ধ করেছে প্রায় এক ঘন্টা।

যেটা দেখা যাচ্ছে গ্লোবাল ওয়ার্মিং ই হোক বা লুমিং সুপার ভলকানিক ইরাপশন -অনেক কারনেই মানুষের ভবিষ্যতের সামনে প্রশ্ন চিহ্ন। এগুলোর সমাধান ট্রিলিয়ান ডলারের রিসার্চ এবং প্রযুক্তি দাবি করে। যেমন নাসা, একটি ওপেন প্রোজেক্ট দিয়েছে এবার-কি করে ইয়োলোস্টোনের লাভাকে আস্তে আস্তে ডিফিউজ করা যায়। বর্তমানে তাত্ত্বিক সমাধান-যখন দেখা যাবে প্রাক্টিক্যাল কিছু সম্ভব-হয়ত মেগা প্রোজেক্টে হাত দেবে সরকার। কিন্ত ইয়োলোস্টোনের তলায় শুয়ে থাকা টাইম বোম্বকে ডিফিউজ করতে না পারলে, গোটা পৃথিবীর সভ্যতা ধ্বংশ হতে পারে যেকোন সময়।

অন্যদিকে গ্লোবাল ওয়ার্মিং কমানোর জন্য বাতাসের কার্বন ডাই ওক্সাইড কি করে রক বা পাথরে শুষে নেওইয়া যায় তার জন্যেও আবিস্কৃত হচ্ছে অনেক প্রযুক্তি।

মুশকিল হচ্ছে এখনো এই সব গবেষনাতে শুধুই সরকারি ফান্ড। অথচ এখানেই দরকার সব থেকে বেশী টাকা না হলে মানুষ বলে এই প্রজাতিটাই পটল তুলবে। সেটা না করে সব দেশেই সব থেকে বেশী টাকা যায় মিলিটারীর পেছনে। মিলিটারি প্রযুক্তির পেছনে।

আমি বহুদিন আগে লিখেছিলাম, মানব সভ্যতার সামনে ইয়োলোস্টোনের মতন ক্রাইসিস থাকা ভাল। কারন সেক্ষেত্রে সবাই যুদ্ধাস্ত্রের পেছনে খরচ কমিয়ে, একত্রে মানব সভ্যতাকে বাঁচানোর জন্য গবেষনায় টাকা ঢালবে। তাতে এই তেলের জন্য যুদ্ধ, জিহাদি, জঙ্গিবাদ ইত্যাদি কমবে। ক্রাইসিসের সামনে শ্রেফ বাঁচার জন্য মানুষ জাতীয়তাবাদি, সাম্রাজ্যবাদি, ধর্মবাদি এজেন্ডাগুলোকে পেছনে রেখে, আন্তর্জাতিক হবে-কারন এই ধরনের বিরাট বৈজ্ঞানিক সমাধানের জন্য পৃথিবীর প্রতিটা বিজ্ঞানী এবং প্রযুক্তিবিদকে দরকার।

আমাদের উদবৃত্ত পুঁজি( ট্যাক্স ডলার) যদি ধ্বংসের যজ্ঞের ( যুদ্ধ) ঘি হিসাবে না ব্যবহৃত হয়, তাহলে সেই টাকায় এই সব প্রাকৃতিক বিপর্যয় আটকানোর জন্য প্রযুক্তির উদ্ভাবন সম্ভব।

আমাদের রাজনীতি এবং সভ্যতা-দুটোই প্রশ্নবিদ্ধ। শুধুই এই কারনে যে কি করে একটি উন্নত প্রজাতি নিজেদের বাঁচানোর জন্য গবেষনা না করে, নিজেদের মৃত্যু সাধনার গবেষনায় টাকা ঢালে?