সেটা ২০০৮ সাল। এখনো মনে হয় সেদিন। অভিজিত সমস্ত মুক্ত চিন্তার বাঙলার ব্লগারদের নিয়ে একটা ইবুক বার করছিল। সেই সূত্রে আমরা ঠিক করি একটা রেডিও আলোচনা করে, বইটাকে জনপ্রিয় করতে হবে। কিন্ত যা হয়। প্রায় ১ ঘন্টার আড্ডা হলো-আমি রেকর্ড করলাম। অভিজিতের কন্ঠ , আবেগের সাথে যারা পরিচিত না -তারা এটা অবশ্যই দেখবেন। এটা ইন্টারভিউ না-আড্ডা-বিতর্ক -
আরো দুটো আড্ডার ইন্টারভিঊ রেকর্ডিং আছে। আমার আগের কম্পুটারটা ক্রাশ করে গেছে। এখন হার্ড ড্রাইভ থেকে বার করতে হবে।
সেটা ২০০৩ সালের নভেম্বর মাস। নতুন চাকরিসূত্রে ক্যালিফোর্নিয়ায়। তখন স্যোশাল মিডিয়া ব্লগ এসব কিছু শুরু হয় নি। স্যোশাল মিডিয়া মানে ইহাহু গ্রুপ। সেই গ্রুপের একটা পোষ্ট কিভাবে যেন চোখে এল। ভীর বলে এক হিন্দু মৌলবাদি প্রমান করার চেষ্টা করছে, এটমের ধারনা বেদে আছে। বিরুদ্ধে অভিজিত রায় নামে একজন লিখে যাচ্ছে। সব ইংরেজিতে। ইহাহু গ্রুপটার নাম মুক্তমনা । আমি যথারীতি অভিজেতের সাপোর্টে লিখলাম। সেই সূত্রে আমাদের প্রথম পরিচয়। ও জানাল ওর একটা ওয়েব সাইট ও আছে। সেটার নাম মুক্তমনা । ওখানে সবাই ইসলামের বিরুদ্ধে লেখে। কিন্ত হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে লেখার লোক পাওয়া যায় না ! ও মাঝে সাঝে লেখে! যদি আমি ওর সাইটে হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে লিখি!!
আমি যে লেখক সেটাই জানতাম না ! তারপরে ১৫ বছর একলাইন বাংলা লিখি নি। আমি অভিজিতকে বল্লাম ভাই এই ত অবস্থা ! ও তখন আমাকে বর্নসফট বলে বাংলায় লেখার একটা সফটোয়ার দেখাল । বললো, প্রবাসে থেকে যারা লেখে সবার বাংলার অবস্থায় খারাপ। আর এই সব নতুন লেখকদের জন্যই মুক্তমনা !
তখন ও মুক্তমনা ব্লগ সাইট না । পিডিএফ করতে হত। অভিজিতকে পাঠালে, ও ছাপাত টাইটেল দিয়ে। নিজেই ওয়েব সাইট মেইন্টেইন করত। ও তখন সিঙ্গাপুরে বায়োমেকানিকে পি এই চ ডি ছাত্র। আমার সব পি ডি এফের প্রথম প্যট্রন ও। শুধু আমি না -আমার মতন অনেক হেজি পেজি লেখকদের মুক্তমনাতে নিয়ে এসে ক্রমাগত উৎসাহ দিয়ে লেখক হিসাবে ওই দাঁড় করিয়েছে।
তখন মুক্তমনা শুধু বাংলাদেশীদের জন্য ছিল না । ভারতের অনেক অবাঙালী নাস্তিক ওই ইহাহু গ্রুপে ছিল। ধর্ম নিয়ে মারামারি বেশী হত। রাজনীতি কম।
তখন ও অভিজিত আর বন্যার বিয়ে হয় নি। র্যোমান্স চলছে। ওরা সদ্য প্যারিসে মিট করেছে। ওদের ওই রোম্যান্স পর্বের অনেক সুঃখ দুঃখ ভালো সময়ের ভাগীদার আমি। আজ সেই সুঃখ স্মৃতি গুলোই শুধু মনে পড়ছে যখন আমরা বেশ গটাপ কেস করে মুক্তমনা সাইটে বিতর্ক জমাতাম। আর কিছু ভাবতে পারছি না । অভিজিতের একটা দীর্ঘ ইন্টারভিঊ নিয়ে ছিলাম ঃ
মৃত্যু নিয়ে ওর সাথে আমার অনেক আলোচনা হয়েছে সেই ২০০৪ সাল থেকেই। এতদিন এত কথা, এত ইমেল হওয়া সত্ত্বেও নানান কারনে ওর সাথে দেখা হয়েও হচ্ছিল না । সেটাও হল গত নভেম্বর মাসে। ওরা আমাদের বাড়িতে এসেছিল। বাংলাদেশ যে আর নিরপদ না সেটা নিয়েই আলোচনা হল অনেক।
এরপরেও যে কেন ওরা বাংলাদেশে গিয়েছিল, আমার জানা নেই । জানলাম যখন ও প্লেনে উঠছে আই এডি থেকে। আমি ওদের মেয়ে তৃষার লোকাল গার্জেন। বন্যা প্লেনে ওঠার কিছুক্ষন আগে জানাল, বিপ্লব আমরা বাংলাদেশে যাচ্ছি, তৃষার কিছু হলে দেখ!! আমি তখন আর কি বলব? ফেসবুকে চ্যাটে খোজ নিত। জানলাম বাংলাদেশে নেমেই ওদের ফুড পয়জন হয়েছে।
তৃষাকে কিছুক্ষন আগে হোস্টেল থেকে তুলে প্লেনে তুলে দিলাম। বন্যার মা এবং বাকী দুই বোন আমেরিকাতেই থাকে। ও নানীর কাছে গেল। তৃষা বেশ শক্ত আছে। মায়ের মতন মানসিক দিক দিয়ে খুব শক্ত ওদের মেয়ে।
তৃষা জানতে চাইল, কেন মেরে ফেলা হল ওর বাবাকে। আমি জানিয়ছি, লেখকেরা মরে না । অভিজিত যা লিখে গেছে, তাতে রক্তবীজের মতন সহস্র ব্লগারদের কলমে ও বেঁচে থাকবে। মানুষের দেহকে খুন করা যায়, চেতনা কে না । ২০০৩ সালে আমরা যখন লিখতাম, মোটে ৫-৬ ব্লগার ছিল মুক্তমনা সাইটে। আজ শয়ে শয়ে, হাজারে হাজারে বাংলাদেশী যুবকেরা ব্লগে লিখছে। তাদের গুরু একজনই -অভিজিত রায়।
অভিজিত রায়রা মরে না । যারা ভাবে রক্তপাত করে অভিজিত রায়কে আটকানো যাবে তারা ভুল পথে। হাজার অভিজিত রায় এখন রেডি। আমি প্রথমে একটু ভয় পেয়েছিলাম। তারপরে মনে হল, ভয় পেলে ওরা জিতে গেল। আমরা হেরে গেলাম। এটা লড়াই। চেতনা মুক্তির, বিজ্ঞান চেতনার লড়াই। অভিজিত রায় কমিনিউস্ট, হিন্দুইস্ট, ইসলামিস্ট, রাবিন্দ্রিক কাওকেই ছাড়ে নি। এ লড়াই বন্দুক, ছুড়ি দিয়ে জিততে পারবে না কোন প্রতিপক্ষ।
কাল একজন বিশিষ্ট আমেরিকান শিল্পপতির সাথে কথা হচ্ছিল। উনি ভারত এবং চীনে বেশ ঘন ঘন যাতায়ত করেন। আমাকে একটা প্রশ্ন করলেন, যেটা আমাকেও ভাবাচ্ছে ---
উনার বক্তব্য, ভারত এবং চীনের মধ্যে ভারতীয়রা অনেক বেশী বন্ধুত্বপূর্ন, বুদ্ধিমান ও বটে। তাছারা ভারতীয়রা যেভাবে তাদের পরিবারের লোকেদের দেখাশোনা করে, সেটা অনুকরনযোগ্য। কিন্ত যেটা উনি এখনো বুঝতে পারেন নি, এমন একটা দেশে, যেখানে এত বুদ্ধিমান, বিচক্ষন এবং কেয়ারিং লোকেদের বাস-সেখানে কি করে কাস্ট এবং ক্লাসের মধ্যযুগীয় চিন্তাভাবনা এত স্ট্রং । কেন এখনো ভারতীয়রা কাস্ট এবং তাদের "স্যোশাল পজিশন" নিয়ে অবসেসড। বুদ্ধিমান জাতি হিসাবে ভারতীয়রা এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে না কেন?
উনি এই প্রশ্নটা তার ভারতীয় শিল্পপতি বন্ধুদের ও করেছিলেন। তাদের কাছ থেকে উত্তর পেয়েছেন, ভারতীয়রা কর্মফলে বিশ্বাস করে-সেই জন্য অনেকেই তাদের স্যোশাল পজিশনটা আগের জন্মে কর্মের ফল হিসাবে মেনে নেয়!!
বাংলাতে কম হলেও অন্যান্য রাজ্যে কাস্টের প্রভাব এখনো সাংঘাতিক। একটা ঘটনা মনে এল। আমি তখন আমেরিকাতে কাজ করতাম কিন্ত ভারতে আসতে হত । একটা সুইস কোম্পানীতে কাজ করতাম । ভারতে তাদের হেডকোয়ার্টার ছিল মুম্বাইতে। যিনি ভারতে ওই কোম্পানীর হেড- খুব দক্ষ ম্যানেজার। কোন দক্ষিনী আয়ার বা আয়াঙ্গার এই টাইপের হবে। উনার সাথে প্রথম মিটিং এর পর হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন-আচ্ছা আপনি ত বাঙালী ব্রাহ্মন ?
আমি বল্লাম হঠাৎ আপনার আমাকে ব্রাহ্মন বলে মনে হল কেন?
উনি বল্লেন, না আপনাকে দেখে বুদ্ধিমান লোক বলে মনে হচ্ছে-তাই ভাবলাম আপনি ব্রাহ্মন ।
আমি বল্লাম না আমি ব্রাহ্মন নই !!!
অর্থাৎ ঐ ব্রাহ্মন ভদ্রলোকের মজ্জায় ঢুকে গেছে, বুদ্ধিমান উচ্চশিক্ষিত লোক মানে ব্রাহ্মনই হবে। পরবর্তীকালে দিল্লীতেও এই ধরনের ঘটনা বার দুই ফেস করেছি। এবং অনেক বাঙালী ব্রাহ্মনরাও ভাবে ব্রাহ্মন মানেই বুদ্ধিমান, উচ্চ ইন্টেলেকচুয়াল টাইপের। আমি নিশ্চিত তারা মমতা ব্যানার্জি ব্রাহ্মন সেটা ভুলে যায়!!
জাতি এবং সমাজে উচ্চ নীচ ভেদ একটা বুদ্ধিমান জাতি কি করে মেনে নিয়েছে এদ্দিন-সেটা আমাকেও ভাবাচ্ছে।
আজ অমর একুশে। ভাষা দিবস। বাংলা ভাষার জন্য দুফোঁটা চোখের জল ফেলার দিন। আসলে সবটাই দ্বিচারিতা। অন্তত নিজের দিকে তাকালে সেটাই আগে মনে হবে।
ছোটবেলাতে গণিত, পদার্থবিদ্যা বা ইংরেজি নিঁখুত ভাবে শিখতে হত। কিন্ত বাংলাটা ছিল শুধু নোট মুখস্থ করে উদ্ধার করার জন্য। ভবিষ্যতে কোন কাজে আসবে? না উচ্চ শিক্ষায়, না চাকরিতে, না প্রেমে। বাংলায় অজস্র বানান ভুল করতাম ছোটবেলা থেকেই। কেও দেখেনি কোনদিন। বাংলার শিক্ষক মশাইরা একটু বকে দিতেন-বাবা আর দুটোত বছর- তারপর বাংলা থেকে ছুটি। বাংলা পরীক্ষা নিয়ে বন্ধুরা হাসাহাসি করতাম। পরীক্ষার দিন হল থেকে বেড়িয়ে এ ওকে জিগোতেম-কত পাতা ভাটালি? মানে বাংলা পরীক্ষার খাতা মাস্টারমশাইরা দেখবেন না । দিস্তাভরে গরুর রচনা লিখলেই হল। এটা ছিল আমাদের ধারনা। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতন আমার হাতের লেখা ছিল খারাপ। ভীষন খারাপ। ফলে বানান, গঠন এবং হাতের লেখার যুগপৎ ব্যর্থতায়, বাংলাতে খুব কম নাম্বার পেতাম। তাই নিয়ে কারোর কোন মাথাব্যাথা ছিল না । অঙ্কে ৯৯ পেলেও মা একবার জিজ্ঞেস করত কোনটা ভুল করলি। বাংলাতে ৫০ পেলে বাড়িতে বলত, আরেকটু ভাটিয়ে লিখতে পারলি না ?
উচ্চমাধ্যমিকের পর আর বাংলা লিখতে হল না কোন দিন। সেটা ১৯৯১ সাল। তাও বাড়িতে ফোন আসার আগে সপ্তাহে একটা করে চিঠি লিখতে হত মাকে। ১৯৯৩ সাল নাগাদ গ্রামশহরেও ফোন চলে এল। ব্যস-সপ্তাহে একদিন বাংলা লেখার যেটুকু দরকার ছিল, তার থেকেও মুক্ত হলাম। তারপর টানা এগারো বছর একটাও বাংলা শব্দ কোথাও লিখতে হয় নি। ইনফ্যাক্ট নেট জগতেও প্রথমে ইংরেজিতেই লিখতাম। তখন বাংলায় অভ্র আসে নি। সেটা ২০০৪ সাল। ছিল বর্নসফট বলে একটা বাংলা টাইপিং সফটওয়ার। বাংলাদেশী লেখক বন্ধুদের উৎসাহে, বর্নসফটেই লেখা শুরু করি সেই বছর । নিশ্চিত ছিলাম হাত থেকে একটা লাইনও বেড়োবে না । কঠিন কঠিন বানান। ক্রমাগত বুঝেছি, মাতৃভাষা সত্যিই মাতৃদুগ্ধ। যে ভাষা মনে জমে থাকে, তা বানান না মেনেও ঠিকই বেড়িয়ে আসবে।
সেই শুরু। তারপর থেকে লিখেই চলেছি। অনর্গল। ভুল ভাল গঠন আর বানানেই বাংলা লিখি। তাও লিখি। কারন এই প্রবাসে প্রাণের কথা আর কাকেই বা বলবো? জমে থাকা অনুভূতিগুলো মাটির নীচে থাকা মিথেন গ্যাসের মতন উর্ধচাপে নির্গত হতে থাকে। হয়ত পশ্চিম বঙ্গে থাকলে লিখতে হত না । কারন মনের কথা বলার লোক থাকত অনেক। এবং আমি দেখেওছি, ভারতে গেলেই আমার লেখার ইচ্ছা কমে যায়। আসলে মনের কথাটা খুলে বলার লোক পেলে, আর দরকার হয় না লেখার।
বই পড়ার সময়, অবসর ধৈর্য্য কোনটাই আর নেই । মাঝে সাঝে দু একটা কবিতা বা ছোটগল্প পড়ে ফেলি বাংলায়। অখন্ড কাজের চাপে ওটাই আমার রিক্রিয়েশন । অথবা ওইটুকুই নাড়ির যোগ। ছেলেও আমার সাথে কথা বলে ইংরেজিতে। নাতি নাতনি হলে, তারাও ইংরেজিতেই বলবে। আশে পাশের বাঙালীরাও বাংলায় কথা বলাতে খুব বেশী স্বচ্ছন্দ নয়। তবে উইকেন্ড পার্টিতে বাংলিশ আড্ডা হয়। হুইস্কির দুপেগের আগে বাংলা। নেশা চাপলে ইংরেজি। বিলিতি মাল ত!
শুধু একটা পজিটিভ টোনে লেখাটা শেষ করি। কেন বাংলায় লিখব? অথবা কেন লিখব ? কারন লেখার মাধ্যমেই চিন্তার গভীরতাটা অন্যকে সহজে বোঝাতে পারি। লেখালেখি করার অভ্যেস থাকলে দূরহ একটা ধারনা খুব সহজে বোঝানো সম্ভব হয়। পেশাদারি জীবনে মার্কেটিং , সেলস বা ব্যবসায়, এই স্কিলটা সব থেকে গুরুত্বপূর্ন। লেখালেখির অভ্যেস না থাকলে, আজথেকে কুড়ি বছর আগে ছাত্র জীবনে ট্যান থিটা ভাষাতেই কথা বলতে অভ্যস্ত ছিলাম। এখন একটা গুছিয়ে গল্প বলতে সক্ষম-নইলে আমেরিকাতে ব্যবসা করে খেতে হত না । এই স্কিলটা লেখালেখি করতে করতেই এসেছে। টেকনিক্যাল স্কিল নিয়ে পেশাদার জগতে খুব বেশীদূর ওঠা যায় না -কিছুদূর গিয়ে, গল্প বলার স্কিলটাও লাগে।
শুধু এই কারনেই আমি নতুন প্রজন্মকে বাংলায় লিখতে বলব। বানান, ভাষার পরোয়া না করে, ভাষা পুলিশের হুইসেল অগ্রাহ্য করে শুধুই নিজের চিন্তাটাকে জমিয়ে ক্ষীর করে নামিয়ে দাও। অন্য কারুর না আসুক, নিজের কাজে আসবে।
মমতা ব্যানার্জি তেলেভাজা শিল্পের কথা বলাতে দেখলাম বাজার আনন্দ থেকে সবাই হ্যাটা দিচ্ছে। এতে একই সাথে বাঙালীর সামন্ততান্ত্রিক মুখোশ এবং ব্যবসাবিমুখ চরিত্র-দুটোই যুগপৎ প্রকাশমান। কেও ব্যবসা তেলেভাজারই করুক বা আই টির করুক, দুটোই ব্যবসা। যদি সফল ভাবে কেও করতে পারে-দুটী ক্ষেত্রেই পরিশ্রম, ধৈর্য্য, নিষ্ঠা লাগে। কাস্টমারকে খুশী রাখা খুব সহজ না -কোন ব্যবসাতেই না । এই জন্য যেকোন কোন "বড় ব্যবসায়ী" একজন "ছোটব্যবসায়ী" কে যেকোন চাকুরিজীবির থেকে বেশী শ্রদ্ধা করে। গোলামী করতে করতে বাঙালীর এত দুরাবস্থা-তারা এটাও বোঝে না প্রতিটা মানুষের সৎভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টাকেই শ্রদ্ধা করতে হয়। থমাস এডিসন এককালে হকার ছিলেন। দিদিকে ধন্যবাদ ভুল থেকে শিখে উনি বুঝছেন, ছোট ছোট শিল্প করেই বাঙালীকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। আজ যে তেলেভাজা শিল্প করতে সক্ষম, কাল সে খাদ্য প্যকেজিং করে আরো দশটা বেকার ছেলেকে চাকরি দিতে পারবে। কিন্ত যারা দিদিকে হ্যাটা দিচ্ছে-সেই হোয়াইট কলার বাঙালী এক মালিকের গলাধাক্কা খেয়ে অন্যের দরজায় চাকরির জন্য লাইন দেবে। আসুন সবাইকে, সব সৎ পেশাকে আমরা শ্রদ্ধা করতে শিখি।আমরা বাঙালীরা এখনো সামন্ততান্ত্রিক যুগে এই ব্যপারে। স্বাধীনতার থেকে দাসত্বেই বাঙালীর প্রবৃত্তি বেশী।
আর বাজার আনন্দের ভূমিকা আরো ন্যাক্কারজনক। শুধু টিপ্পনীতেই শেষ নাই-আজ আবার খবর বার করেছে তেলেভাজার দোকানদাররা কত গরীব! এটা লেখে নি, আমেরিকাতে তেলেভাজা বিলিয়ান ডলারের শিল্প। কারন এখানে তেলেভাজাকে প্যাকেজিং করা হয় ঠিক ঠাক করে। সিঙারা বা চিকেনের ফ্রাই আমরা বাড়িতে করি কিন্ত ফ্রোজেন ছাঁচ কিনি। নিজেদের তেলে ভাজি বলে, বদহজমের সমস্যা থাকে না । ইনফাক্ট আমি চিকেন রোল, সিঙারা আর আলুর চপ খেয়ে এটা লিখতে বসেছি। এগুলো সব ফ্রোজেন ছাঁচে পাওয়া যায়-বাড়িতে হাল্কা তেলে ভেজে নিলেই হল। আমি ত বলবো একটু উদ্ভাবনা , আমেরিকার মতন প্যাকেজিং করতে পারলে বাঙালীর তেলেভাজা বিশ্বজয় করবে।
আপের সম্ভাব্য বিজয়ে, যারা উল্লাসিত , ভাবছেন এবার আপ সারা ভারতে বিজেপিকে টেক্কা দেবেন, আমি কিন্ত তাদের দলে নেই -যদিও আমি সেটাই চেয়েছি। কারন সেটা ভারতের জন্য ভাল হত। দিল্লীতে আপ জিতবে এটা আমি লোকসভা ভোটে আপের হারের পরেও লিখেছি। কিন্ত এটাও লিখছি, আপ গোটা ভারতে আসার ব্যপারে আমি আশাবাদি না এখনো।
অনেকেই এই ফোরামে জিজ্ঞেস করেছেন,পশ্চিম বঙ্গে আপ নেই কেন? অন্য রাজ্যেই বা কেন এত বাজে দশা-পাঞ্জাব বাদে।
আসল সত্যটা সবার জানা উচিত। স্যার কার্ল পপারের পলিটিক্যাল ম্যাক্সিম আপের জন্যও খাটে। ওদের যা শক্তি, সেটাই দুর্বলতা । আপ কোন পলিটিক্যাল থিওরী বা আইডিওলজী মেনে চলে না । এটার ফ্লিপ সাইড হচ্ছে এর ফলে সবাই আপ জয়েন করতে চায়। তাতে চোর, চাকর, সৎ সন্ন্যাসী সবাই আছে। ওদের কোন সংগঠিত স্ট্রাকচারালিজম নেই ।
এর ফল হচ্ছে রাজ্য ইউনিটগুলো কিভাবে চলবে, তারা কতটা স্বাধীনতা পাবে-এগুলো নিয়ে আপ গভীরে ভাবে নি। অনেকেই আপের জন্য পশ্চিম বঙ্গ সহ অন্য রাজ্য থেকে কাজ করতে এসেছিল। এসে দেখেছে, আপ একদম কংগ্রেসের মতন দিল্লী ভিত্তিক সেন্ট্রালিজমে পার্টি চালাতে চাইছে। ওদের বক্তব্য ওরা "আপের" ব্রান্ডিং ঠিক রাখতে চাইছে। কিন্ত রাজ্য ইউনিট গুলো স্বাধীনতা না পেলে কাজ করবে কি করে-আর রাজ্যের ভালো ট্যালেন্টেড লোকেরা কেনই বা দিল্লীর আপের নেতাদের চামচা গিরি করবে? ফলে যারা আপের রাজ্য ইউনিটগুলোর জন্যে এসেছিল, দিল্লীতে আপের নেতাদের দাদাগিরি বা কর্পরেট টাইপের ব্রান্ড ম্যানেজমেন্টের জন্য বসে গেছে।
আপ মুখে যতই ডিরেক্ট ডেমোক্রাসির কথা বলুক, ওদের পার্টির মধ্যে গণতন্ত্রের অবস্থা দশ জনপথের কংগ্রেসের মতন করুণ। যে পার্টির নিজের মধ্যে ডেমোক্রাসি নেই, তারা ভারতে ডিরেক্ট ডেমোক্রাসি আনবে তা অবান্তর কল্পনা।
তবুও ভরসা এই যে আপ ভুল থেকে দ্রুত শিক্ষা নেয়। আশা করি আপের দিল্লীর নেতারা বুঝবে, দিল্লীতে থেকে রাজ্য ইউনিট চালাতে গেলে দশা হবে কংগ্রেসের মতন বা তার থেকেও বাজে। কারন আপের রাজ্য ইউনিট এখনো গড়ে ওঠে নি। নিজের পার্টিতে গণতন্ত্র প্রাক্টিস না করলে, অচিরেই আপের সাফল্য তাসের ঘরের মতন ভেঙে পড়বে।
আজ দিল্লীতে ভোট। বিজেপি আপের থেকে যদি হাজার গুনে ভালোও হয়, তাও এই নির্বাচনে আপের জেতা ভারতীয় গণতন্ত্রের অস্তিত্বের জন্য জরুরী। শক্তিশালী শাসক দল না -শক্তিশালী বিরোধি শক্তিই গণতন্ত্রের সাফল্য এবং অস্তিত্বের মূল চাবিকাঠি।
পৃথিবীর প্রথম গণতন্ত্র আসে খৃষ্টজন্মের পাঁচশো বছর আগে নগর রাষ্ট্র এথেন্সে। সেই এথেনিয়ান ডেমোক্রাসি থেকে অনেক কিছু শেখার আছে আজো। ওই গণতন্ত্রেই প্রথম ইদিওটেস ( গ্রীক ) বা ইডিয়ট শব্দটির উৎপত্তি। এথেন্সে যারা ভোট দিত না, রাজনীতিতে উৎসাহ দেখাত না তাদের বলত "ইদিওতেস"
"We do not say that a man who takes no interest in politics is a man who minds his own business; we say that he has no business here at all-Pericles"
এথেন্সের গণতন্ত্র আরো একটা গুরুত্বপূর্ন শিক্ষা দিয়েছিল ভবিষ্যতের সমস্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে। পার্শিয়ার বিরুদ্ধে সালামির নৌযুদ্ধে , এথেন্সকে শত্রুমুক্ত করেছিলেন জেনারেল থেমিস্টকল। সালামি এবং প্লাটিয়ার যুদ্ধে সাফল্যের কারনে উনি হয়ে উঠলেন এথেন্সের সব থেকে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ। কিন্ত এই থেমিস্টেকলকেই তাড়িয়েছিল এথেনিয়ান গণতন্ত্র-তাদের ভয় ছিল, জনপ্রিয়তার কারনে একদিন স্বৈরাচারী হয়ে উঠবেন থেমিস্টিকল!
ঠিক এক কারনে ব্রুটাস হত্যা করেছিলেন রোমান মহানায়ক জুলিয়াস সিজারকে। ব্রুটাস ক্যাম্পের দীক্ষাগুরু কাটো চান নি, কোন একজনের হাতে এত ক্ষমতা তুলে দিতে যাতে রোমান গণতন্ত্রটাই ধ্বংস হয়।
আজ ভারতের গণতন্ত্রেও সেই অবস্থা। পরিস্কার ভাবেই বিজেপির সুসংগঠন এবং স্ট্রাটেজির সামনে বিরোধি পক্ষ দিশেহারা। কংগ্রেস রাহুলের কাঁধে চেপে সক্ষাত সলিলে। সিপিএম সোভিয়েতের শবসাধনায় বাস্তবকে অস্বীকার করে এখন পশ্চিম বঙ্গ রাজনীতিতেও অপ্রাসঙ্গিক। মমতা জয়ললিতা এতটাই পপুলিস্ট এবং কোরাপ্ট এরা রাজ্য রাজনীতিতে টিকবেন -কিন্ত রাজ্যের বাইরে এদের কেও পুঁছবে না । মুলায়েম মায়াবতীর জাতপাত ধর্মের গুন্ডামোর রাজনীতির চেয়ে উত্তর প্রদেশে লোকে বিজেপিকেই চাইছে। জীতন রাম মঞ্জি মুখ্যমন্ত্রীত্ব বাঁচাতে আমিত শাহের পায়ে পড়ে গেছেন! এই অবস্থায়, ভারতে বিজেপির বর্তমান অবস্থান অপ্রতিরোধ্য।
বিজেপি ভাল না খারাপ এই বিতর্কে না গিয়েও, এটা পরিস্কার ভাবে বলা যায়-একচ্ছত্র নিরঙ্কুশ ক্ষমতাই সব দুর্নীতির উৎস। স্বৈরাচারের সূতিকাগৃহ। কোন গণতন্ত্রেই নিরঙ্কুশ ক্ষমতা কোন ব্যক্তিকে বা দলকে দেওয়া উচিত না । সেটা হবে গণতন্ত্রের আত্মহত্যা। শুধু এই কারনেই আজ আআপের জেতা বিশেষ জরুরী।