Friday, August 21, 2009

জিন্না কি ধর্ম নিরেপেক্ষ ছিলেন?


জিন্নার ভূত ভারতের ঘারে চিরকুমার। কায়েদ-ই-আজমকে ধর্ম নিরেপেক্ষ বলে দাবী করে ভারতের প্রাত্তন বিদেশমন্ত্রী যশোবন্ত সিং বিজেপি থেকে বিতাড়িত হলেন। যশোবন্ত বিজেপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রাণপুরুষ। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং থেকে নির্বাচিত সাংসদ। এর আগে আদবানী জিন্নাকে ধর্ম নিরেপেক্ষ বলায় বিপাকে ছিলেন কিছুদিন। এসব কথা যাক। ভারতে বিজেপি এবং সিপিএম-সাংঘাতিক ভাবেই ফ্যাসিস্ট পার্টি। পার্টি মেম্বারদের আদর্শগত ভিন্নমত প্রকাশের অনুমতি নেই। এর আগে সিপিএম স্পীকার সোমনাথ মুখার্জিকে একই ভাবে তাড়িয়েছে। উদার গণতন্ত্রের শত্রু এইসব পার্টিগুলি এমনিতেই এখন ডুবন্ত নৌকা। ভারতীয় ভোটারদের কাছে প্রত্যাখ্যাত। তাই সাক্ষাত সলিলে ডুবন্ত ফ্যাসিস্ট পার্টিগুলির হারিকিরির ওপর টর্চলাইট ফেলার জন্যে এই লেখা নয়। মহম্মদ আলি জিন্না এবং ভারতভাগ-সেটা নিয়ে নিজের মত প্রকাশ করতে চাইছি মাত্র।

কায়েদি আজম জিন্না দক্ষিন এশিয়ার সম্ভবত সব থেকে জটিল রাজনৈতিক চরিত্র। আর ধর্ম নিরেপেক্ষতা, আমাদের অভিধানের সর্বাধিক বিতর্কিত শব্দ। সুতরাং এই দুটি ককটেলকে একত্রিত করলে যে জটিল বিশ্লেষন পাওয়া যাবে-সেটা ব্যাক্তিনিরেপেক্ষ হওয়া অসম্ভব। তাই এই ব্যাপারে ভিন্নমত থাকবেই-এবং সেটা ধরে নিয়েই আমি নিজের দৃষ্টিভংগীতে জিন্নার রাজনৈতিক দর্শনের ওপর আলোকপাত করব।

কোন মানুষের জীবনেই তার রাজনৈতিক দর্শন স্থিতিশীল না। ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে তা বিবর্তিত হতে থাকে। এই বিবর্তনের মূলে থাকে অর্জিত জ্ঞানের সাথে বাস্তবতার পার্থক্য। জিন্নার জীবনে এটা হয়েছে সব থেকে বেশী। এবং সেই দৃষ্টিতে জিন্নাকে না বুঝলে কোন সত্যে উপনীত হওয়া খুব কঠিন।

প্রথমেই যে প্রশ্নটি আমাদের গভীর ভাবে বিশ্লেষন করতে হবে সেটা হচ্ছে ১৯০৬ সালে যখন মুসলীম লীগের জন্ম হল-জিন্না সেখানে যোগদানের বদলে-তাদের খুব অবজ্ঞার চোখে দেখেছিলেন।লীগের নেতাদের সম্মন্ধে তার উক্তি " ওরা অত্যন্ত বেশী মুসলমান"। অর্থাৎ ১৯০৬ সালে জিন্না নিজেই বলেছিলেন, তার মতন আধুনিক লিব্যারাল ডেমোক্রাটদের জন্যে লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বেমানান। প্রশ্ন হচ্ছে পরবর্তী দশকে কি এমন ঘটল তার জীবনে এবং ভারতের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে যে তিনি লীগে যোগ দিলেন (১৯১৩) এবং তার প্রেসিডেন্ট ও হলেন লখনো অধিবেশনে (১৯১৬)। পাশাপাশি এটাও মনে রাখতে হবে তিনি ১৮৯৬ সালে কংগ্রেসে যোগ দেন। কংগ্রেসে ফিরোজ শা মেহেতা, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি এবং গোপাল কৃষ্ণ গোখলে -এরাই ছিলেন জিন্নার ঘনিষ্ট রাজনৈতিক সহচর। বৃটেনের তার ছাত্র জীবন থেকে তিনি মূলত হিন্দু এবং পার্শী জাতিয়তাবাদি নেতাদের সাথেই ওঠাবসা করেছেন। ব্যারিষ্টার হিসাবে তার ক্লায়েন্ট বেস ছিল মুম্বাই এর পার্শীরা। জিন্নার সামাজিক জীবনে কোন মুসলিম বন্ধুর পর্যন্ত দেখা পাওয়া যাচ্ছে না এই সময়। পোষাকে এবং খাদ্যে ১০০% সাহেব ছিলেন জিন্না। ইসলামে নিশিদ্ধ শুয়োরের মাংস এবং দৈনিক মদ্যপান-কোন কিছুতেই অরুচি ছিল না জিন্নার। এই সময় মুসলিমদের জন্যে একটি কাজই করেছেন। ওয়াকফ বা ধর্মীয় কারনে মুসলিমরা যে জমিদান করে-সেটাকে আইনসিদ্ধ করিয়েছেন। কিন্ত তার থেকেও তিনি বেশী সক্রিয় ছিলেন বাল্যবিবাহ নিরোধক আইন আনতে। মনে রাখতে হবে এটা সেই সময়- যখন রবীন্দ্রনাথ অক্লেশে তার কন্যাদের বাল্যবিবাহ দিয়েছেন। জিন্নার হিন্দু মক্কেলরা যথা গোখলে বা তিলক, আধুনিকতার প্রশ্নে তার থেকে অনেক পিছিয়ে-এরা বাল্যবিবাহের সমর্থক ছিলেন। তাহলে কি এমন ঘটল জিন্নার মতন একজন আধুনিক এবং ইসলাম থেকে শত যোজনদূরে অবস্থান করা সাংঘাতিক বুদ্ধিমান ব্যাক্তিত্ব লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পাঁকে ডুবলেন?

দ্বিতীয় যে প্রশ্নটি আমরা কোনদিন করি নি-সেটা হচ্ছে আবুল কালাম আজাদের সাথে জিন্নার রাজনৈতিক দর্শনের পার্থক্যের উৎস কি? এটাত আমার কাছে বিরাট ধাঁধা। জিন্না ছিলেন ১০০% বৃটিশ। মনে, প্রানে এবং দর্শনে। সেখানে আবুল কালাম আজাদ ছিলেন ১০০% ধর্মভীরু মুসলমান। আজাদের পরিবার ছিল কলকাতার বিখ্যাত ইসলামিক শিক্ষকদের পরিবার। বলতে গেলে একরকম মসজিদেই মানুষ হয়েছেন তিনি। সুতরাং আজাদের মতন মুসলীমরা লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করবে এবং জিন্নার মতন বৃটিশ শিক্ষিত মুসলিমরা কংগ্রেসের ধর্ম নিরেপেক্ষতাকে গ্রহন করবে, এটাই স্বাভাবিক প্রত্যাশা। কিন্ত হল উলটো। মৌলনা আজাদ হয়ে উঠলেন হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের কান্ডারী। আর জিন্না হিন্দু-মুসলমানে ভারত ভাগের ভগীরথ। এই ধাঁধার সমাধান কি? এদের দুজনেরই ব্যাক্তিগত জীবনের অলিগলিতে না ঢুকলে, আমরা বুঝবো না জিন্না কেন লীগ রাজনীতিতে ঢুকলেন। যাদের সম্মন্ধে প্রথমদিকে তার একছত্র অবজ্ঞা ছাড়া আর কিছুই ছিল না।

প্রথম প্রশ্নের উত্তরে পাকিস্থান বা বাংলাদেশের ইতিহাস যেভাবে লেখা হয় সেটা হচ্ছে, জিন্না কংগ্রেসকে হিন্দুদের সংগঠন বলে মনে করতেন। হিন্দুদের কাছ থেকে তিনি প্রাপ্য মর্যাদা পান নি। এটাও একধরনের সরলীকরন। তিলকের মতন হিন্দুজাতিয়তাবাদি নেতা জিন্নাকেই বৃটিশদের বিরুদ্ধে তার উকিল হিসাবে নিয়োগ করেছেন। মুসলীম লীগ এবং কংগ্রেস যাতে একসাথে বৃটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার সংগ্রাম করতে পারে তার জন্যে জিন্না ১৯৩০ সাল পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন অক্লান্ত।

কিন্ত আসল ফাটলটা এসেছে কংগ্রেসের হিন্দু নেতাদের কীর্তিকলাপে। কংগ্রেস নিয়ে জিন্নার মোহভঙ্গের প্রথম এবং প্রধান কারন অবশ্যই গান্ধী। এবং এর সুত্রপাত গান্ধীর খিলাফত আন্দোলনের সমর্থনের মধ্যে দিয়ে।

তাহলে জিন্নাকি ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত আন্দোলন (১৯২১) সমর্থন করতেন না? প্রশ্নই ওঠে না। জিন্না খুব পরিষ্কার ভাবেই বুঝেছিলেন এ আসলে ইসলামিক মৌলবাদিদের বৃটিশ বিরোধিতা যা হবে ইসলামিক সমাজের আধুনিকরনের অন্তরায়। গান্ধী এসব কিছু না বুঝেই কুখ্যাত আলি ভাতৃদ্বয়কে ( মৌলনা মহম্মদ আলি এবং সৈকত আলি) সমর্থন জানালেন। জিন্নার অমত স্বত্ত্বেও তিলক স্বরাজ ফান্ড থেকে গান্ধী এই আলি ভাতৃদ্বয়কে টাকা জোগালেন আন্দোলন শুরু করার জন্যে।

যে খিলাফত আন্দোলন ছিল বৃটিশদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের আন্দোলন, তা অচিরেই হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার রূপ নিল মালাবারে এবং নোয়াখালিতে। আসলে খিলাফত আন্দোলন হয়ে উঠল মুসলমান প্রজাবিদ্রোহ। হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে। আলি ভাতৃদ্বয় হিন্দু নিধনের ডাক দিলেন এবং গান্ধীকেও হিন্দুনেতা বলে অবজ্ঞা করার উপদেশ দিলেন। গান্ধীকে ত এবার গিলতে হয়। ফলে গান্ধী তার মহান সত্যবাদি ঢ্যামনামো অব্যাহত রাখলেন--" আলি ভাতৃদ্বয়ের কীর্তি জিহাদের অপব্যাখ্যা" বলে দুবাটি কেঁদে নিলেন।

খিলাফত আন্দোলন যে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার রুপ নেবে, তা নিয়ে জিন্না আগেই গান্ধীকে সাবধান করেছিলেন। কারন জিন্নার ঘটে বুদ্ধিসুদ্ধি ছিল গান্ধীর চেয়ে কিছু বেশী। যাইহোক জিন্না বুঝলেন গান্ধী এবং কংগ্রেস ইসলামিক মৌলবাদকে নিজের সন্তানের মতন করে লালন করতে চাইছে। মৌলবাদিদের ইসলামিক সমাজের নেতা বানাতে চাইছে কংগ্রেস যা মুসলিমদের হিন্দুদের থেকে পিছিয়ে দেবে। কংগ্রেসের ইসলামিক মৌলবাদি তোষনের সেই ট্রাডিশন আজও চলছে। এবং কি আশ্চর্য্য কংগ্রেসের এই মৌলবাদি তোষন যে মুসলমান সমাজের জন্য ভয়ংকর এবং ক্ষতিকর তা প্রথম বলেন জিন্না-কোন হিন্দু নেতা না। এবং ধর্মনিরেপেক্ষতার প্রতীক মৌলনা আবুল কালাম আজাদও কংগ্রেসের মৌলবাদি তোষনের বিরুদ্ধে কিছু বলেন নি। কারন মৌলনা আজাদ ছিলেন ভারতীয় মুসলমানদের রক্ষনশীল অংশেরই প্রতিনিধি। আহা করি ধাঁধাটি পাঠকদের কাছে কিছুটা পরিষ্কার হচ্ছে।

সংখ্যালঘুদের জন্যে আলাদা আইন-একমাত্র সংখ্যালঘু মৌলবাদিদের মুসলীম সমাজের প্রতিনিধি হিসাবে গণ্য করার দীর্ঘ ভারতীয় ট্রাডিশন গান্ধীই শুরু করেন। ভারতীয় বল্লাম এই কারনে, ভারতের প্রতিটি পার্টি-সিপিএম থেকে কংগ্রেস-এই দোষে দুষ্ট। জিন্না স্বাধীনত্তোর ভারতে কংগ্রেসের এই ধরনের সংখ্যালঘু নীতির জন্যে মুসলীমদের কি সাংঘাতিক ক্ষতি হবে সেই নিয়ে নিশ্চিত ভাবেই চিন্তিত ছিলেন।


তবে ১৯২৯ সালেও জিন্না মোটেও পাকিস্থানের কথা ভাবছেন না। বরং ঐক্যবদ্ধ ভারতে মুসলীমদের স্বার্থরক্ষার জন্যে ১৪ দফা দাবী জানালেন। কংগ্রেস সেই দাবীগুলি প্রত্যাখ্যাত করলে, পাকিস্থানের দাবী করা ব্যাতীত জিন্নার হাতে আর কোন উপায় থাকল না।

কিন্ত কংগ্রেস কেন মানল না সেই ১৪ দফা দাবী? ১৪ টি দাবীর মধ্যে ১১ টি দাবী ছিল সাম্প্রদায়িক। কিন্ত সেগুলি সবই স্বাধীনত্তোর ভারত বর্ষে মুসলমানদের জন্যে মানা হয়েছে। তাহলে মুসলিমদের স্বার্থ রক্ষার জন্যে স্পেসিফিক দাবীগুলিতে কংগ্রেসের আপত্তি ছিল না। ছিল প্রথম তিনটি দাবী নিয়ে যা মূলত ভারতে কেন্দ্র বনাম রাজ্যের ভূমিকা কি হবে তাই নিয়ে। সেখানে জিন্না খুব পরিষ্কার ভাবেই রাজ্যগুলির হাতে অধিক ক্ষমতা দাবী করলেন। যা ভারতের মুখ্যমন্ত্রী এবং অন্যান্য পার্টি বহুদিন থেকে করে এসেছে এবং ১৯৯০ সালের আগেও কংগ্রেস শক্তিশালী যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর দোহাই দিয়ে বিকেন্দ্রীকরনের দাবী মানে নি। ১৯৯০ সালের পরে কংগ্রেস দুর্বল হতে থাকে। ফলত আস্তে আস্তে রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতা আসতে থাকে। অবশ্য আমেরিকার কাঠামোর সাথে তুলনা করলে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে, আরো অনেক বেশী বিকেন্দ্রীকরন হওয়া উচিত।

প্রশ্ন হচ্ছে কেন কংগ্রেস বিকেন্দ্রীকরনের দাবীগুলি মানল না? এর পেছনে নেহেরুর ভূমিকা কি?
আসল গল্পটা হল নেহেরু ১৯২৮ সালে ডমিনিয়ান স্ট্যাটাসের জন্যে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো কি হবে তার একটা খসরা পেশ করেছিলেন। সেখানে রাজ্যগুলির হাতে সীমিত ক্ষমতা দেওয়ার কথা ছিল যা পরবর্ত্তীকালে ভারতের সংবিধান স্বীকৃত হয়। ভারতে ক্ষমতা এবং প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরন হলে কংগ্রেসের নেতাদের ক্ষমতা নিশ্চিত ভাবেই হ্রাস পেত। একালেও যেমন-সেকালেও কংগ্রেসের অনেক বড় নেতারই কোন প্রদেশিক ভিত্তি ছিল না। তারা ছিল দিল্লীকেন্দ্রীক রাজনীতি করে গোটা ভারতের ওপর ছড়ি ঘোরানোর লোক। সুতরাং সম্পূর্ণ ভাবে নিজেদের স্বার্থের জন্যেই নেহেরু এবং তার অনুগামীরা জিন্নার দাবীগুলি প্রত্যাখ্যান করলেন ও জিন্নাকে পাকিস্থানের দাবী তুলতে বাধ্য করালেন। যশোবন্ত সিং এর বইটিতে নেহেরু বনাম জিন্নার এই দ্বৈরথকেই পাকিস্থান সৃষ্টির ভিত্তিভূমি বলে দাবী করা হয়েছে। এবং এই দৃষ্টি ভংগী মেনে নিলে, দেখা যাচ্ছে পাকিস্থান সৃষ্টির জন্যে নেহেরুর ক্ষমতার লোভই মূলত দায়ী।

জিন্না পাকিস্থান চান নি। নেহেরু তাকে বাধ্য করেছিলেন। ঠিক এই কথাটাই যশোবন্ত সিং লিখেছেন।আমি যতটুকু ইতিহাস পড়েছি, তাতে এই দাবীর কোন ত্রুটি দেখছি না। কারন ১৯৩০ সালের পর লীগ বা জিন্নার ইতিহাস থেকে বোঝা যাবে না, জিন্না কেন পাকিস্থান চাইতে বাধ্য হলেন। তার ডিরেক্ট একশন বা ডেলিভারেন্স ডে ছিল কংগ্রেসের কেন্দ্রীকতা রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াই। যা হয়ে উঠলো হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা। হতে পারে দাঙ্গায় অনেক হিন্দু প্রান হারিয়েছিলেন-এবং সেই দায়ভার জিন্না কখনোই এড়াতে পারেন না। কিন্ত যে নেহেরু-কংগ্রেস তাকে এই কাজে বাধ্য করেছিল, তাদের কি কোন দায় নেই??

ভাগ্যের কি পরিহাস। আজ ২০০৯ সালে দেখতে পাচ্ছি জিন্নার ১৪ দফা দাবীর সব কিছুই স্বাধীন ভারতে মানা হচ্ছে, কারন ভারতে কেন্দ্রীয় পার্টিগুলি এখন অনেক দুর্বল। আঞ্চলিক দলগুলির ওপর নির্ভরশীল। অথচ ১৯২৯ সালে নেহেরু মানলেন না জিন্নার দাবী। নিজের ক্ষমতার লোভকে সরিয়ে যদি ভারত বর্ষের ভবিষ্যতের কথা ভাবতেন নেহেরু, তাহলে পাকিস্থানের জন্মই হয় না আজ।

এই কঠোর সত্যটি ভারতবাসীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে যশোবন্ত সিং কে জানাই অশেষ ধন্যবাদ। দেশভাগের জন্যে গান্ধী এবং নেহেরুকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ঐতিহাসিক বিচার করা উচিত আপামর ভারতীয়দের।






Friday, August 14, 2009

মুসলমানদের জীবনে সব থেকে বড় প্রাপ্তি কোরান?

আজকের আজকালেই পড়লাম। সিপিএমের বিতর্কিত মন্ত্রী আব্দুল রেজ্জাক মোল্লা আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলমান ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তিমূলক পেশাদারি শাখার উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেছেন-মুসলমানরা ভাগ্যবান-কারন তাদের জীবনের পরম প্রাপ্তি কোরানে জ্ঞান অর্জনের নির্দেশ আছে।

মন্ত্রী বলতেই পারতেন ইসলাম জ্ঞানার্জন করতে নির্দেশ দিয়ে থাকে। আমাদের ও মাথাব্যাথা থাকত না। কিন্ত ভোটের বাজারে সংখ্যালঘু তোষনের তাড়নায় এই প্রবীন কমিনিউস্ট নেতাটিও বলে বসলেন মুসলীমদের জীবনে সব থেকে বড় প্রাপ্তি কোরান! কোরান যেহেতু খাবার জন্য কোন মিস্টি না বা পাছা মোছার ন্যাপকিন না-এই কথাটির একটিই মাত্র অর্থ হয়। মুসলমানদের কোরান অনুসরন করে জীবন ধারন করা উচিত-এবং তারা খুবই ভাগ্যবান যে তাদের জীবনাদর্শ ঠিক করার জন্যে পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ঠ ধর্মগ্রন্থ তাদের আছে!

জামাত বা বুর্জোয়া পার্টির নেতারা ইসলামি মনন তোষন করে ভোট পাওয়ার জন্যে এরকম কথাবার্ত্তা এই উপমহাদশে আবাহমানকাল থেকে বলে আসেন। কিন্ত যখন কোন বর্ষীয়ান কমিনিউস্ট নেতা এবং মন্ত্রী এই ধরনের প্রতিক্রিয়শীল কথাবার্ত্তা বলেন তখন বিষয়টি একটু গভীরে না গেলে বোঝা যাবে না কিভাবে এইধরনের ধর্মীয় তোষন দক্ষিনএশিয়ার রাজনীতিকে সাম্প্রদায়িক কুম্ভীপাকে আবদ্ধ রাখে। এবং ধর্মীয় ধারনাগুলির সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিই মৌলবাদের আসল আঁতুর ঘর।

ক্ষমতার উৎস কি? কিসের বলে কোরান বা ধর্মগ্রন্থগুলি আজ বলীয়ান? বা সভ্যতার চাকা উলটোদিকে ঘোরাতে চাইছে? এই প্রশ্নটির মূলে আমাদের আঘাত করতে হবে। এইসব গুটিকয় মৌলবাদিদের এত ক্ষমতা আসে কি করে?

গত শতাব্দিতে "ক্ষমতা" এবং তার উৎ স নিয়ে সব থেকে বেশী দার্শনিক কাজ করেছেন মাইকেল ফুঁকো। তার বিখ্যাত গ্রন্থের নাম "ডিসিপ্লিন এন্ড পানিশ" । ফুকোর কাজের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল জ্ঞান এবং ক্ষমতার মধ্যে সম্পর্ক। ফুকো এই প্রসঙ্গে "সাধারন জ্ঞান" বলে একটি সামাজিক প্যারামিটার চালু করেন-যার অর্থ- যত বেশী লোক কোন একটা বিলিফ সিস্টেমের ( ধরুন এই হিন্দুত্ববাদি, ইসলামিস্ট বা কমিনিউজম) বিশ্বাসগুলিকে সাধারন জ্ঞান হিসাবে গ্রহন করবে, সেই বিলিফ সিস্টেম সমাজের ওপর তত ছড়ি ঘোরাবে। এমন নয় যে ব্যাপারটা আমরা জানি না। কিন্ত এইসব বিলিফ সিস্টেমের ক্ষমতার উৎস সন্ধান করতে হলে-আমাদের ইতিহাস থেকে দেখতে হবে কি ভাবে একটি বিলিফ সিস্টেমের কিছু বিশ্বাস সাধারন জ্ঞানে পরিণত হচ্ছে। সাধারন জ্ঞান বলতে এক্ষেত্রে আমরা বুঝবো-জন সাধারন যে জ্ঞানগুলিকে নর্ম বা স্বাভাবিক বলে গ্রহণ করেছে।

যেমন ধরুন -কমিনিউস্টদের রাজনৈতিক বিশ্বাস হচ্ছে একদিন সাম্যবাদি কমিনিউস্ট সমাজ আসবে। যতবেশী লোক এটাকে বিশ্বাস করবে-প্রমান্য সত্য হিসাবে দেখবে, কমিনিউস্টদের তত শক্তি বৃদ্ধি হবে। সোভিয়েতের পতনের আগে, অনেক অনেক বেশী লোকের কাছে এটা ছিল একটি স্বতসিদ্ধ প্রমানিত বিশ্বাস-তাই সাধারন জ্ঞান। কারন তারা মনে করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ানে সত্যিকারের সমাজতন্ত্র -সাম্যবাদি সমাজ আছে। কিন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ান ভেঙে গিয়ে সাম্যবাদের নরকগুলজার ক্রমশ প্রকাশ্য হতে, আজকের সমাজের খুব অল্প লোকের কাছেই এটা বিশ্বাস্য যে কমিনিউজম বলে আদৌ কোন সমাজ কোন দিন আসতে পারে। ফলে ধণতন্ত্রের এই চরম দুর্দিনেও কমিনিউস্টরা প্রতিটা দেশে মাটি হারাচ্ছে! কারন সেই সাধারন জ্ঞানের ভিত্তিটা-অর্থাৎ জনসারাধন যে মনে করত সাম্যবাদী স্বর্গীয় সমাজের অস্তিত্ব আছে-সেই জায়গাটাই আজ ভীষন দুর্বল। কোন তত্ত্বের নির্ভুলতা বা বৈজ্ঞানিক সত্য সেই তত্ত্বের শক্তির উৎস না। তত্ত্বের পেছনের ক্ষমতার উৎসের আসল নাম মানুষ। তারা বিশ্বাস করেছিল বলেই একদিন কমিনিউস্ট গাঙে জোয়ার ছিল।

ঠিক একই ব্যাপার কোরানের জন্যেও সত্য। কোরান আল্লা প্রেরিত নির্ভুল এবং শ্রেষ্ঠ জীবন দর্শন--এটাই মুসলমান সমাজের সাধারন জ্ঞান। বিশ্বাস না। কারন ইসলামের জন্ম লগ্ন থেকেই যেসব বুদ্ধিজীবিরা এই বিশ্বাসের বিরোধিতা করতে গেছে, তাদের প্রায় সবাইকেই খুন করা হয়েছে। কোরানে অবিশ্বাসীদের প্রতি অভিশাপ, ঘৃণা, ভয়দেখানো কি নেই! দাস প্রথার সমর্থন থেকে বৌ পেটানোর অনুমতি সব কিছুই পাওয়া যাবে। আবার বিদ্যান, বুদ্ধিমান দয়ালু ক্ষমাশীল হওয়ার উপদেশ ও আছে। বাকী ধর্মগ্রন্থগুলির মতন কোরান ও একটি ভাল-খারাপ উপদেশের ককটেল। এবং বাকী ধর্মগ্রন্থগুলির মতন এটিও একটি প্রতিক্রিয়াশীল গ্রন্থ কারন এর রাজনৈতিক তত্ত্বগুলি সপ্তম শতকের আরবদেশের উপযোগী। মোদ্দা কথা বাকী ধর্মগ্রন্থগুলির ন্যায় অতীতের নৃতাত্ত্বিক প্রয়োজন মেটানোর জন্যেই কোরান লিখেছিলেন সম্ভবত ২০ জন জ্ঞানী ব্যাক্তি। কিন্তু এইসব সত্য ইসলামিক ব্যাটারীর চার্জার হতে পারে না। "কোরান শ্রেষ্ঠ জীবন দর্শন" এটাকে বিশ্বাস না-একদম সাধারন জ্ঞানের পর্যায়ে নিয়ে এলে তবেই এই ইসলামি মৌলবাদের আসল ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। এবং মাননীয় কমিনিউস্ট মন্ত্রী মহোদয় ঠিক সেটিই করলেন-তিনিও সেই গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে মৌলবাদিদের ক্ষমতার উৎসেই রাবার স্ট্যাম্প মারলেন। মুসলামানদের শিক্ষিত করতে যদি এই ভাবে কোরানের সাহায্য নিতে হয় তাহলে প্রক্ষান্তরে সেই মৌলবাদেরই বীজ চাষাবাদ করা হয়। কারন "কোরান শ্রেষ্ঠ জীবন দর্শন" সেই তত্ত্বকেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে যা মৌলবাদের আসল শক্তি। বা ঘাঁটি।

Saturday, August 8, 2009

মায়ান সভ্যতা-মিথ এবং বাস্তব





টুলুমের সূর্য্য মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ

ইচ্ছাটা ছিল বহুদিন থেকেই। মায়াবী মায়ান সভ্যতার স্বাপত্য কীর্তি ঘুরে দেখার। মন্দার বাজারে সুযোগ জুটে গেল। এখন সব ট্র্যাভেল প্যাকেজে বাম্পার ডিল পাওয়া যাচ্ছে! ফ্লাইট খরচ থেকে ফাইভ স্টার হোটেল, অঢেল খানা পিনা-সব মিলিয়ে এত সস্তায় এই দশকে কোন প্যাকেজ পাওয়া যেত না! তাছাড়া মায়ান সভ্যতার ধ্বংশাবশেষ মেক্সিকোর ইকাকুনটন পেনিনসুলাতে সব থেকে ভাল ভাবে সংরক্ষিত। যেটি মেক্সিকোর সেরা ক্যারিবিয়ান বিচ ডিস্ট্রিক্ট। সবুজ সমুদ্রজলের ক্যাঙ্কুন। বছরে ৪০ লাখ আন্তর্জাতিক পর্যটক এখানে আসে একই সাথে ক্যারিবিয়ানের সুবজ সমুদ্র আর মায়ান সভ্যতা ঘুরে দেখার জন্যে।

এই প্রসঙ্গে মায়ানদের সম্মন্ধে দুচার কথা বলে রাখি। আজকের মেস্কিকানরা ( বা আমরা আমেরিকায় বাঙালীরা যাদের ঠাট্টা করে হোজে মামা বলি) মায়ানদের উত্তরপুরুষ। আনুমানিক ১০০০ খৃষ্ঠপূর্বাব্দে মেক্সিকো বা এই পুরো ক্যারিবিয়ান বেল্টে মায়ান সভ্যতার শুরু। বর্তমানে সে মায়ান স্থাপত্যের ধ্বংশাবশেষ আমরা দেখি, তার সবটাই পোষ্ট ক্ল্যাসিক্যাল মায়া সভ্যতার। আনুমানিক ৭০০-১০০০ খৃষ্ঠাব্দ এই স্থাপত্যগুলির ইতিহাসকাল । মায়ানরা লিখতে জানত-তাদের অক্ষরের সংখ্যা ১০,০০০। প্রাকটেলিস্কোপহীন জ্যোর্তিবিদ্যার নানান নমুনার সাক্ষর তাদের স্থাপত্যে। রাজনৈতিক সিস্টেম ছিল রেনেসাস সাময়িক ইউরোপের মতন-নগর রাষ্ট্র। আনুমানিক শতাধিক নগর রাজ্য নিয়ে গড়ে উঠেছিল মায়ান সাম্রাজ্য। যা স্প্যানিশ আক্রমনে ১৬৮০ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ ধ্বংশ হয়। যদিও মায়ানরা ১৭০ বছর ধরে ইউরোপিয়ান হার্মাদ দস্যুদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার লড়াই লড়ে গেছে। কিন্ত ক্রমাগত বিদ্রোহ এবং গেরিলা যুদ্ধ করেও হার মেনেছে বন্দুক এবং কামানের কাছে। স্প্যানিশরা এদের দাশ হিসাবে ক্যারিবিয়ানের অন্যান্য দ্বীপে চালান করত। মায়ান পুরুষদের মেরে ফেলে নারীর গর্ভে ইউরোপিয়ান বীজ বপন করেছিল স্প্যানিশ জলদস্যুরা যার ফলশ্রুতিতে আজকের মিশ্র মেক্সিক্যান জাতির জন্ম। মেক্সিকানদের মধ্যে কাওকে মায়ান আদিবাসীদের মতন দেখতে-আবার কেও কেও দেখতে পুরো ককেশিয়ান। তবে অধিকাংশ মেক্সিকানদের দেখতে মায়ান এবং স্প্যানিশদের মাঝামাঝি।

মেক্সিকো যুক্তরাষ্ট্রের পাশে হলেও অনেক বেশী সমাজতান্ত্রিক। ক্যাঙ্কুন এয়ারপোর্টে নামতেই সেটা টের পেলাম। মেক্সিকোর টুরিজম কতৃপক্ষ, নানান টুরিস্ট এজেন্সি এখানে কিভাবে কাষ্টমারদের পকেট মারে, সেই ব্যাপারে সাবধান করার জন্যে লোক রেখেছ! শুধু তাই না, নানান টুরে, এখানে কিভাবে পয়সা বাঁচাতে হয়, সেই ব্যাপারে সরকারী কর্মচারিদের কাছ থেকে নানান টিপস পেলাম। সরকারি কর্মচারিরা কাজ করে না-বসে বসে মাইনা চুরি করে, এই স্টিরিওটাইপ ধারনায় যারা ভোগেন তাদের মেক্সিকোতে ঘোর উচিত। শুধু টুরিজম ডিপার্টমেন্টের কর্মীরাই না, এখানে সরকার এবং সাধারন মানুষও সরকারী উদ্যোগের ওপর অনেক ভরসা রাখে। এর অনেক উদাহরন গোটা ট্যুর জুরেই পেলাম।

ক্যাঙ্কুন আমেরিকান পর্যটকদের কাছে ভীষন জনপ্রিয় কারন এখানকার হোটেলগুলো সব অল-ইক্লুসিভ প্যাকেজ দেয় অর্থাৎ খানা-পিনা হোটেল ভাড়ার মধ্যেই ধরে নিচ্ছে খাওয়া মানে, তিন কোর্স মিল বা মাত্র তিনটে ড্রিংস এমন না সকাল আটটা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত যতখুশি খাও যতখুশি পান কর সব ধরনের ককটেল আমাদের রিসর্টেই ছিল ১১টা বার আর ৫ টা রেস্টুরেন্ট! তার সাথে সন্ধ্যায় লোকনৃত্যের জমাটি আসর! আসলে এই ১০০ মাইল সৈকতরেখা জুরে যেখানে এককালে মায়ান সভ্যতা ছিল-সেখানে আজও কোন সভ্যতা গড়ে ওঠে নি শুধু কিছু প্রাসাদসম হোটেল ( কিছু কিছু রিসর্ট ১০,০০০ একর জমির ওপর তৈরী!) আর বনজঙ্গল বাইরে বেড়িয়ে রেস্টুরেন্টে খাওয়া এখানে অসম্ভব অল-ইনক্লুসিভ প্যাকেজগুলো পৃথিবীর অনেক টুরিস্ট স্পটেই রিসর্টগুলি চাইছে কিন্ত স্থানীয় ব্যাবসায়ীদের বিরোধিতায় সম্ভব হচ্ছে না কারন সেক্ষেত্রে টুরিষ্ট স্পটের রেস্টুরেন্ট ব্যাবসা লাঠে উঠবে

এখান কার রিসর্টগুলির বৈশিষ্ট সমুদ্রর সাথে প্রায় মিশে যাওয়া বিরাট বিরাট সুইমিং পুল এত বড় সুইমিং পুল আমি লাস ভেগাসের বেলাজিও বা সিজারেও দেখি নি সুইমিং পুলে সাঁতার কাটতে কাটতেই ক্যারিবিয়ানের সবুজাভ নীল দেখা যায় যদিও সমুদ্র সৈকত এখানে প্রাইভেট পানপ্রিয় পর্যটকদের জন্য এ স্বর্গরাজ্য- বীচেই ককটেল বার সম্পূর্ণ ফ্রি বীচটি অবশ্য অত ভাল না বীচের তলায় কোরাল রীফের জন্যে পায়ে বেশ লাগে ঢেও কিছু উঁচু না ক্যারিবিয়ান সমুদ্রের সব থেকে ভাল বীচ আছে কিউবাতে মধ্যাহ্ন এবং অপরাহ্নের প্রচন্ড দাবাদহে অনেকেই বাইরে বেড়োতে চাইছিল না। অধিকাংশ টুরিস্টই সুইমিংপুলে বসে শুধু ককটেল পান করে আর জলের তলায় গা ডুবিয়ে শুয়ে থাকে যারা একটু এডভেঞ্চারপ্রেমী-তারা সার্ফিং বা স্নটলিং করে
সমুদ্র আর সুইমিং পুল যেখানে একসাথে মিশে থাকে!

ক্যাঙ্কুন এলাকায় মায়ান সভ্যতার দুটি বিখ্যাত ধ্বংশাবশেষ আছে। টুলুম আর চিচেনিটজা। টুলুমে আছে সূর্য্যমন্দির। অনেকটা আমাদের কোনার্কের মতন। আর চিচেনিটজাতে আছে পিরামিড। টুলুমের সুর্য্য মন্দির অবশ্য আমাদের কোনার্কের মন্দিরটির চেয়ে অনেক ছোট। স্থাপত্য এবং কারুকার্যও তেমন কিছু না। যদিও কোনার্ক এবং টুলুমের সূর্যমন্দিরের বয়স প্রায় সমসাময়িক। তবে কোরাল রিফের ওপর তৈরী এই মন্দিরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দুর্দান্ত।

ক্যারিবিয়ান সমুদ্রের কোরাল রীফের ধারে গড়ে উঠেছিল মায়ানদের বিখ্যাত সূর্যমন্দির
টুলুম মানে দেওয়াল ঘেরা শহর মায়ানদের সব রাজ়্যই ছিল নগর-রাজ্য তবে নগরে থাকত শদুয়েক বনিক এবং রাজা শ্রেনী বিভক্ত মায়ান সমাজে, নীচু শ্রেনীর মায়ানদের বাস ছিল দেওয়ালের বাইরে গ্রামে সূর্য্যমন্দিরে বছরে চারবার নরবলি হওয়ার হিসাব পাওয়া গেছে। মূলত অপরাধীদের দেবতার কাছে বলি দিত মায়ানরাতাদের নরখুলি মন্দিরেগাত্রের শোভা বর্ধনের কাজে লাগানো হত বলে জানা যায়। কোনার্কের সূর্যমন্দিরের মতন এখানেও একাধিক সূর্যঘরির সন্ধান পাওয়া যায়। আহ্নিক গতি পর্যবেক্ষনের জন্যে পিনহোল তৈরী করে দরজার ওপর ফেলাটা গ্রীক, মিশর এবং ভারতের মতন এখানেও চালু ছিল তবে মায়ানদের সমস্যা হচ্ছে এরা ঘোড়া বা পুলির ব্যাবহার জানত না ফলে ভারী পাথর বেশী ওপরে তুলতে পারে নি-কেন না সব কিছুই মানুষদের গায়ের জোরে করা। ফলত এরা মিশরের মতন বড় পিরামিড বা কোনার্কের মতন বড় সুর্য্য মন্দির বানাতে পারে নি
অতীতের টুলুম নগরী-যা 1000বছর আগে ছিল অনেকটা এই নীচের ছবির মতন


যেটা সব থেকে ভাল লাগল সেটা হচ্ছে মেক্সিকান সরকারের সমাজতান্ত্রিক দায়বদ্ধতা এখানে আইন আছে গ্রামবাসীরা হোটেলের মধ্যে ঢুকে তাদের কুটির শিল্প বেচতে পারবে যেহেতু হোটেলগুলিতে প্রচুর টুরিস্ট আসে এবং স্থানীয় গ্রামবাসিরা তা থেকে উপকৃত হতে পারে সেই জন্যেই এহেন আইন তার জন্যে হোটেল কতৃপক্ষ লবিতে গ্রামের লোকেদের পসরা সাজিয়ে বসতে দিচ্ছে আমাদের দেশের ফাইফ স্টার হোটেল বা রিসর্ট গুলির কোন সামাজিক দায়বদ্ধতা নেই শুধু তাই না, টুলুমে আমাদের যে টুর গাইড ছিল সে আরো জানাল, সমস্ত টুরবাসগুলিকে সরকারী হান্ডিক্রাফটের এক বিশাল দোকানের সামনে ৩০ মিনিট নুন্যতম থামতে হয় যাতে স্থানীর গ্রামবাসীদের তৈরী কুটির শিল্পের কিছু সুরাহা হয় এমন কি সেই গাইড ভদ্রলোক আমাদের বার বার অনুরোধ করছিলেন, তাকে টিপস দেওয়ার বদলে যেন, আমরা কিছু কিনি সেই সরকারী দোকান থেকে কারন স্থানীয় আদিবাসিরা এই সরকারী সাহায্যেই বেঁচে থাকে আমার ধারনা এই আইনগুলি আমাদের দেশেও চালু করা উচিত

হোটেলের মধ্যেই পসরা সাজিয়েছে গ্রামের লোকেরা-সরকারি আইন!

তবে আমেরিকান টুরিস্টরা সত্যি আমাকে অবাক করেছে এখানে খাওয়ার জন্যে এলাহি আয়োজন সব সময় এত হাজার রকমের মেক্সিকান খাবার-দুদিনেই দশকিলো ভুঁড়ি বাড়তে পারে কিন্ত অধিকাংশ আমেরিকান সেই বার্গার হটডগ আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এর বাইরে কিছু খাবে না কূপমুন্ডকতা আর কাকে বলে! আগেকার দিনের বাঙালীরাও ছিল ঠিক এই রকম ভারতের অন্যরাজ্যে বেড়াতে গিয়েও বাঙালী রেস্টুরেন্ট খুঁজবে এখানেও হোটেল কতৃপক্ষ আমেরিকানদের ফার্স্ট ফুড প্রীতিকে সন্মান জানিয়ে, গোটা দুয়েক ফার্স্টফুড কর্নার বানিয়ে দিয়েছে! ডলারের জোরে এই ভাবেই আমেরিকান সংস্কৃতি সর্বত্র ছড়াচ্ছে এমনকি টুলুমেও কোন মেক্সিক্যান রেস্টুরেন্ট নেই-আছে সেই ম্যাকডোনাল্ড আর সাবওয়ে!

মেক্সিক্যান সংস্কৃতিতেও সেই অবক্ষয়ের ছাপ স্পষ্ট। এখানে রাতে লোকনৃত্যের আসর বসত। সালসা নৃত্য ত গোটা পৃথিবী জুরেই সমাদৃত। তা সত্ত্বেও এখানে আমেরিকান টুরিস্টদের খুশী করতে হিপ হপ,জ্যাজ, রাপ সব স্ট্যাইলের আমেরিকান এন্টারটেইনমেন্টই চলছে। কারন তা না হলে আমেরিকান দের মন ভরবে না।

শুধু ডলারের জোরে কিভাবে তৃতীয় শ্রেনীর খাবার আর সংস্কৃতি আমেরিকা গোটা পৃথিবী জুরে রপ্তানী করছে-তা ভাবতেই গা ঘিনঘিন করে ওঠে। দেখে মনে হয় ভাল সংস্কৃ্তি পৃথিবীতে টেকে না-বিজয়ী জনগোষ্ঠি গুলির সংস্কৃতিই ক্রমশ ছড়িয়ে যায়। যেমন, মায়ানদের মধ্যে কিছু স্প্যানিশ প্রথম আসে ১৫১৪ সালে। একটি জাহাজ ভেঙে ওরা উপকুলে পৌছালে মায়ানরা তাদের উদ্ধার করে। পরবর্ত্তীকালে সেই ১৪ জন স্প্যানিশ মায়ান মহিলা বিবাহ করে, সেখানেই ঘর সংসার পাতে। মায়ানরা স্প্যানিশদের নিজের আপনজন করে নিয়েছিল। কিন্ত ১৫২৬ সালে স্প্যানিশরা আবার এই উপকূলে হানা দিল-মায়ান আদিবাসিদের দাস বানানোর জন্যে। এই ছিল উন্নত ইউরোপিয়ান সভ্যতা! অথচ তাদের বন্দুক আর কামানের জোরে আজকের মেক্সিকো প্যানিশ কলোনী।

উন্নততর সভ্যতা ব্যাপারটা পুরোটাই গল্প--অথবা উন্নততর সভ্যতা মানে উন্নততর হিংস্র মানবপশুদের পাশবিক আস্ফালন। এটাই পৃথিবীর ইতিহাস। সেকালেও ছিল। একালেও তাই। নইলে অথিতিপরায়ন মায়ান সভ্যতাকে হারিয়ে মানুষকে দাস বানানো স্প্যানিশ সভ্যতা মেক্সিওর নিয়তি হয় কি করে?